তুমি রবে ১২
.
.
বাড়িতে ফেরার পর আবরার গায়ের স্যুটটা সোফাতে ফেলে চেঁচিয়ে হীরাকে বললেন,
– “তোমাদের কী সমস্যা আমি বুঝতে পারলাম না। এভাবে এঙ্গেজমেন্টটা পেন্ডিং রাখার মানে কী?”
আশফি পকেটে দু হাত পুরে চুপচাপ দাড়িয়ে রইল। দিশানও চুপ করে সোফাতে এসে বসলো। আবরারের চেঁচামেচি শুনে তার ছোট ছেলে আজাদ আর তার বউ জেবা চলে এলো নিচে। হীরা তার হাতের ব্যাগটা সোফাতে রেখে বলল,
– “তুমি কাল যখন জোজোকে ফোন করলে তখন তাকে বলোনি কেন আজকের ব্যাপারটার কথা?”
আবরার চেঁচানো কণ্ঠেই বলল,
– “এত ঘটা করে বলতে হবে কেন? যেটা আজ বাদে কাল হবেই সেটা আজ হলে কী সমস্যা ছিল? মিনহাজ ব্যাপারটা নর্মালি নিলেও ঐন্দ্রী মেয়েটা কী পরিমাণ কষ্ট পেল আন্দাজ করেছো?”
হীরা আশফির দিকে একবার তাকাল তারপর সেও চেঁচিয়ে আবরারকে বলল,
– “আমি কিছু জানি না। তোমরা দাদা নাতি মিলে বুঝে নাও।”
হীরা চলে গেল ওপরে। আজাদ জিজ্ঞেস করল আবরারকে,
– “কী হয়েছে আব্বা? আংটিটা পরাননি আপনারা?”
আবরার ক্রোধে ফেঁটে পড়ে আশফির দিকে চেয়ে বলল,
– “আমার কাছে জানতে চাইছিস কেন এ কথা? যে পরায়নি তাকে জিজ্ঞাসা কর।”
এ কথা বলে আবরারও চলে গেল ওপরে। আর তারপর আশফিও আর দাড়িয়ে থাকল না নিচে। সেও তার রুমের দিকে রওনা হলো। জেবা দিশানের পাশে বসে তার কাছে জানতে চাইল,
– “ঘটনা কী বল তো দিশান?”
– “কী আর ঘটনা? ভাইয়া জানতো না আজকে তার আর ঐন্দ্রীর আংটি পরানো হবে। তাকে জানানো হয়নি বলে সে আংটিটা পরায়নি আর নিজেও পরেনি।”
– “আগে থেকে জানতো না তো কী হয়েছে? পরে তো জানলোই। কিন্তু পরাল না কেন?”
– “ভাইয়া এসব ব্যাপার নিয়ে এখনই কিছু ভাবতে চায় না। আরও কিছুদিন সময় চায়।”
দিশান দাঁড়িয়ে পড়ে ক্লান্ত স্বরে বলল,
– “রুমে যাচ্ছি চাচি আম্মা।”
ঘন্টাখানেক পর আশফি নিচে নেমে এলো। ডাইনিং এ তখন হীরা আর জেবা রাতের খাবার সাজাতে ব্যস্ত। আশফিকে রেডি হয়ে নামতে দেখে হীরা তাকে জিজ্ঞেস করল,
– “জোজো? কই যাচ্ছিস?”
– “ফ্লাটে, কাল তো আর অফিস অফ দেবো না।”
হীরা ওর কাছে এগিয়ে এসে বলল,
– “অফ দিতে হবে না। এখান থেকেই যাবি।”
আশফি তাকে কিছু বলতে গেলে সে বলল,
– “হোক দেরি, তাও এখান থেকেই যাবি। এসে একটা দিনও মন বসে না এখানে তোমার। ওখানে কি বিয়ে করে বউ রেখে আসছো?”
– “কী সব বলছো দাদীবু? আচ্ছা যাব না। ওপরে যাচ্ছি।”
– “না, খেয়ে তারপর যাবি।”
আশফি খাবার টেবিলে বসে জেবাকে জিজ্ঞেস করল,
– “শাওনকে দেখছি না? বাড়িতে নেই?”
– “ও ওর মামার বাড়িতে বেরাতে গেছে কালই। তুই আসবি জানলে হয়তো যেতোই না।”
– “সমস্যা নেই, বাড়িতেই তো থাকে। ঘুরে আসুক। শায়খ কি ডিউটিতে?”
– “হ্যাঁ, নাইট ডিউটিতে আছে।”
রাতের খাওয়া শেষে দিশান আর আশফি বসে গল্প করছিল আশফির রুমের বেলকনিতে বসে। তখন হীরা এলো তাদের কাছে। এসে দিশানের পাশে বসলো। দিশান এক গাল হেসে বলল,
– “কূটনৈতিকবাজ কি ছাড়ল তাহলে?”
হীরা দিশানের পিঠে চাপড় দিয়ে বলল,
– “শুনতে পেলে ন্যাংটা করে রোদে শুকাতে দেবে তোকে।”
আশফির মুখটা গম্ভীর দেখে হীরা দিশানকে বলল,
– “কী হয়েছে এবার বল তো তোরা?”
দিশান আশফির দিকে তাকিয়ে তারপর মাথা নিচু করে বলল,
– “যার ব্যাপার তার কাছে জিজ্ঞেস করলেই উত্তর পাবে।”
হীরা উঠে এবার আশফির পাশে বসলো। আশফি মাথাটা উঁচু করে হীরার দিকে একবার তাকিয়ে তারপর বাহিরের পানে তাকাল।
– “কোনো সমস্যার মাঝে আছিস ভাই?”
– “নাহ, সমস্যা কিছুই না। আমি আসলে এই বিয়ের সম্পর্কের ব্যাপারে একটু ডিপলি ভাবতে চাই দাদীবু। নিজের মতের বিরুদ্ধে এত জলদি কিছু করে পরে দুজনে মিলে পস্তাতে চাই না।”
– “কিন্তু এ সমস্যা তোর মূল সমস্যা না। তোর চেহারায় স্পষ্ট ভেসে উঠেছে তুই মনের দিক হতে খুব অশান্তির মাঝে আছিস। প্রেমে টেমে পড়েছিস না কি বল তো?”
দিশান হেসে উঠল হীরার কথাতে। আশফিও মৃদু হেসে তাকাল হীরার দিকে। বলল,
– “প্রেমে আবার পড়ে কীভাবে দাদীবু?”
দিশান তখন বলল,
– “আছাড় খেয়ে ভাইয়া।”
দিশানের হাসির সঙ্গে আশফির হাসিও সামিল হলো। হীরা কপট রাগের সুরে বলল,
– “দুটোকেই কিন্তু এখন শুকনা মরিচ আর পান্তাভাত খাওয়াব। দাদীবুর সঙ্গে ফাজলামি শুরু করেছো না?”
নরম সুরে এবার আশফিকে হীরা বলল,
– “তুই বিয়ে ব্যাপারগুলোতে খুব ছোট থেকেই একটা ‘না’ মনোভাব পুষে রেখেছিস ভেতরে। কখনো কোনো বিয়ে বাড়িতেও যাসনি। আমিও তোকে কখনো তোর এ মনোভাব থেকে বের করতে পারিনি। ভেবেছিলাম বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তুই এই সম্পর্কটার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারবি। কিন্তু আজও সেই একই মনোভাব তোর মাঝে। কোনোদিনও কি এই মনোভাব থেকে বের হতে পারবি না?”
আশফি কিছু সময় নীরব থাকল হীরার প্রশ্নে। তারপর বলল,
– “হ্যাঁ মনোভাব হওয়ার মতো এখনো জীবনে কিছু পাইনি দাদীবু। তাই বলতে পারছি না কী হবে।”
হীরা নাতির মুখটার দিকে তাকাল। সে বুঝতে পারল এক অসীম বিষণ্নতার মাঝে তার নাতিটা দিন পার করছে। কিন্তু মুখ ফুটে সে কোনোদিনও বলবে না সে কথা। ছোটবেলা থেকে ও মানুষটাই এভাবে তৈরি হয়েছে। ওর মনের গভীরে ঢোকা যেমন বড্ড মুশকিল তেমন ও মানুষটাও বড্ড মুশকিল ধরনের। বাবা-মা ছাড়া দুটো নাতিকে সে বুকে আগলে বড় করেছে। তাই সে তাদের নাড়ীনক্ষত্র খুব ভালোভাবেই চিনে আর বুঝেও। কিন্তু তার চিন্তা শুধু আশফিকে নিয়ে আর তা শুধু একটা জায়গাতেই। কেউ কি তার মতো করে তার এই নাতিটাকে বুঝবে? সে যে অনেকটা অন্য ধাতুর মানুষ।
আশফি অফিসের আসার আগে আনোয়ার উপস্থিত সকল এমপ্লয়িকে স্বর উচ্চ করে বলল,
– “যারা ইতোমধ্যে উপস্থিত, তাদের মধ্যে তিনদিনের বেশি কে কে ছুটি নিয়েছেন আর তা কেন নিয়েছেন আমার টেবিলে তার একটি করে নতুন দরখাস্ত জমা দিয়ে যান। আর যারা এখনো উপস্থিত হয়নি জানি না আজকে তাদের কপালে কী আছে। তারা এলে তাদের কাছে এই খবরটি পৌঁছে দেবেন।”
সামনে থেকে রাতুল প্রশ্ন করল,
– “কোনো সমস্যা স্যার?”
– “সমস্যা নাকি অন্যকিছু জানি না। স্যার আজকে প্রতিটা নতুন পুরাতন স্টাফদের যাবতীয় সব ব্যাপার আবার খতিয়ে দেখবেন। আর যারা অফিসে লেট করে আসে তাদের জন্যও কিছু স্টেপ নেবেন। এক কথায় স্যার আরও দ্বিগুণ স্ট্রিক্ট হতে চলেছেন।”
এবার আনোয়ার অফিস পরিষ্কার করার লোকগুলোর কাছে গেল। তাদের কাছে এসে বলল,
– “স্যার কিছুদিন লক্ষ্য করেছেন আপনারা অফিস পরিষ্কারের কাজে বড্ড গাফেলতি করছেন। ময়লার ডাস্টবিনগুলো কোনো কোনোদিন আপনারা পুরো দিন পার করে তারপর ফেলেন। আর তাছাড়া ফ্লোরে প্রচুর ধুলোও লেগে থাকে বিভিন্ন জায়গায়। আজ স্যার আপনাদের কাজ শেষবারের মতো দেখবেন। তারপর আপনাদের কাজ বুঝে হয় রাখবেন আর না হয় আউট করে দেবেন। তাই বলছি, দেখে শুনে পরিষ্কারের কাজটা করুন।”
আনোয়ারের কথা শেষ হতেই আশফি হনহনিয়ে অফিসের ভেতর ঢুকে পড়ল। আনোয়ার তার পিছু পিছু আসতে থাকল। অফিসে ঢুকে করিডোরের ফ্লোর দেখে আনোয়ারকে সে বলল,
– “অফিসে এমপ্লয়ি আসে সকাল নয়টাতে। আর ফ্লোর ক্লিন হয় কখন?”
আনোয়ার কিছু বলতে যাবে তখন আশফি বলল,
– “কোনোরকমে ঝার দিয়ে উদ্ধার হয় তারা। এমন ক্লিনমাস্টার আমার প্রয়োজন নেই। এ মাসের বেতনসহ ওদের অগ্রীম মাসের বেতনটাও দিয়ে বিদায় করুন।”
– “জি স্যার।”
আশফি প্রতিটা ডেস্কে চোখ বুলাল, কেবিনগুলোও দেখল। প্রায় প্রত্যেকেই উপস্থিত শুধু ঐন্দ্রী, খুশি আর তার আন্ডারের এমপ্লয়ি মাহি অ্যাবসেন্ট। আশফি আনোয়ারকে বলল,
– “যারা এখনো আসেনি তারা এলে এক এক করে আমার কেবিনে পাঠিয়ে দেবেন।”
– “ওকে স্যার।”
আশফি যাওয়ার পরই মাহি অফিসে ঢুকল। আনোয়ার তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
– “আপনি আপনার অ্যাবসেন্ট করার কারণ উল্লেখ করে একটি নতুন দরখাস্ত লিখে আমাকে এখনই দিন। আর আপনাকে স্যার তার রুমে ডেকেছেন।”
মাহি কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে তার সব অ্যাবসেন্টের কারণসহ দরখাস্ত লিখতে বসল। কিন্তু গতকাল আর তার আগেরদিনের অ্যাবসেন্ট করার কারণ সে কী লিখবে খুঁজে পেল না। তবে সে যে মানসিকভাবে বিক্ষিপ্ত ছিল সেটাই উল্লেখ করল। লেখাটা শেষ করে মাহি আনোয়ারের কাছে কাগজটা জমা করে আশফির কেবিনের দিকে গেল। প্রচন্ড অস্বস্তিবেধ হচ্ছে তার আশফিকে ফেস করতে। এখন আবার সে কী বলবে সেটাই ভাবতে ভাবতে দরজাতে নক করল সে। আশফি তাকে আসার অনুমতি দিলে মাহি তার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল। তখন আনোয়ারও নক করে কেবিনে ঢুকল। দরখাস্তগুলো আশফির কাছে জমা করে সে বেরিয়ে গেল। আশফি প্রতিটা দরখাস্ত দেখে দেখে মাহির দরখাস্ত হাতে নিয়ে সেটা পড়তে শুরু করল। মাহি সেখানে তার মাঝখানে জ্বর হওয়ার জন্য তিনদিন ছুটি মঞ্জুর করেছিল সেটা উল্লেখ করেছে। আর এর মাঝে একদিন বাদ একদিন মোট দু’দিন সে অ্যাবসেন্ট করেছে। সেটার কারণ হিসেবে সে উল্লেখ করেছে ব্যক্তিগত সমস্যা বলে। কাগজটা হাতে নিয়ে সে মাহির দিকে তাকাল এবার। তাকে স্বাভাবিক কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
– “ব্যক্তিগত সমস্যা বলতে দরখাস্তে কোনো সমস্যা উল্লেখ হয় জানতাম না তো। এটা কি নতুন কোনো বিষয় হিসেবে চালু হয়েছে না কি আপনিই করলেন?”
মাহি বলল,
– “আসলে আমি মানসিকভাবে একটু বিক্ষিপ্ত ছিলাম তাই আসিনি গতকাল। আর তার আগেরদিনের সমস্যাটা তো আপনি জানেন।”
আশফি এবার টেবিলে চাপড় মেরে বলল,
– “হোয়াট ডু ইউ মিন বাই আমি জানি? আপনার সাথে কি আমি অফিসের বাহির বসে কথা বলছি?”
মাহি রীতিমতো চমকে উঠল আশফির হঠাৎ রেগে যাওয়ার কারণে। আশফি বলল,
– “আপনি একজন নতুন এমপ্লয়ি হয়ে ইচ্ছামতো অফিসে আসেন। সময় জ্ঞান বলে ব্যাপারটা আমি হয়তো ভুলে যান। তাই প্রতিদিনই দেরি করে আসেন। আবার বিনা কারণে অ্যাবসেন্ট করে বলেন ব্যক্তিগত সমস্যা। কোম্পানি আপনাকে বেতন দিয়ে পুষে রাখছে কি আপনার ব্যক্তিগত সমস্যা দেখার জন্য?”
মাহি হতবাক হয়ে আশফির কথাগুলো শুনছে। চোখদুটো প্রায় ভিজে উঠেছে তার। আশফি আবার বলল,
– “আবার কালকের আগেরদিনের কাজগুলো এখানে জমা করে রেখেছেন তার প্রতিটা কাজেই ভুল। আর এই কাজগুলো কি আপনার? আপনি কেন করেছেন?”
এই প্রথমবার মাহি আশফির ভয়নাক ক্রোধের শিকার হলো। যা কোনোভাবেই সে কখনো আশফির থেকে আশা করেনি। কাঁপা কণ্ঠে সে জবাব দিলো,
– “খুশি ম্যাম ছিলেন না তাই কাজগুলো…”
আশফি কথা শেষ হতে দিলো না। সে পূর্বের রাগ বজায় রেখেই বলল,
– “আপনাকে কি এমন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে যে অ্যাবসেন্ট থাকবে তার কাজটা আপনাকে করতে হবে?”
মাহি বলল,
– “দায়িত্বটা খুশি ম্যামই দিয়েছিলেন আমাকে।”
– “তার কাজ সে কেন আপনাকে দেবে আর আপনি কেন করবেন? আর কী কাজ দিয়ে গেছেন আপনাকে সে?”
– “আপনার পেনড্রাইভে ট্রান্সফার করে দিয়েছি।”
ল্যাপটপটা অন করতে করতে সে বলল,
– “না জানি এখানে আবার কী গন্ডগোল করে রেখেছেন?”
মাহি নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আশফি ল্যাপটপের দিকে চেয়ে তাকে বলল,
– “লাস্ট ওয়ার্নিং আপনার জন্য। এভাবে নেক্সট ডেতে দেরি করলে, অকারণে অ্যাবসেন্ট আর অন্যের কাজ নিজে করলে ভদ্রতার সঙ্গে রেজিগলেশন জমা দিয়ে যাবেন। এখন আসতে পারেন।”
চোখের পানিটুকু মুছতে মুছতে মাহি বেরিয়ে এলো কেবিন থেকে। ভেতরে যে তাকে খুব করে বকেছে আশফি, তা বাহির থেকে প্রায় সবাই শুনেছে। সবাই মাহির দিকে তাকিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলা বলি করছে। মিলি এসে মাহিকে বলল,
– “মন খারাপ করো না মাহি। বসেদের কাছে এগুলো শোনার অভ্যাস তৈরি করো। আমরা তাদের কর্মচারী, শুনতে তো হবেই।”
মাহি মিলিকে কিছু না বলে নিজের ডেস্কে এসে বসলো। চোখদুটো সে আবারও মুছে নিলো। আজ যেন কান্নাটা অতি মাত্রায়ই পাচ্ছে তার। চেষ্টা করল নিজের কাজে মনোযোগী হওয়ার। আনমনা মন কিছুতেই কাজে লাগতে চাইল না। হঠাৎ করে পিসিতে হাত পড়ে কোনো একটা বাটনে ক্লিক লেগে গেল। তখন একটা ফাইল প্রজেক্টের কাজ বারবার ইরোর সামথিং আসতে লাগল মনিটরে। সবশেষে কাজটাকে ডিসমিস করার জন্য সিগন্যাল দিতে থাকল। মাহি ভয় পেয়ে দ্রুত ফাইলটা রিকভার করার চেষ্টা করল কিন্তু সম্ভব হলো না। এক পর্যায়ে ফাইলটা ডিসমিস হয়ে গেল। মিলি ব্যাপারটা খেয়াল করে মাহির কাছে এগিয়ে এলো।
– “কী হয়েছে মাহি?”
মাহি কম্পিউটারের মনিটরে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে মিলিকে বলল,
– “দেখো তো কী হয়েছে? কিছুই তো বুঝতে পারছি না।”
রীতিমতো ঘামতে থাকল মাহি। মিলি ট্রাই করল ফাইলটা রিকভার করার। কিন্তু সম্ভব হলো না। ঠিক তখনই আশফি প্রচন্ড ক্রোধরূপে এসে দাড়াল মাহির ডেস্কের কাছে। একটা কাগজ তার টেবিলে ছুড়ে চেঁচিয়ে তাকে বলল,
– “এই কাজটাও কি খুশি ম্যাম আপনাকে করতে বলেছিলেন?”
মাহি কাগজটা হাতে নিয়ে কিছু বলার সুযোগও পেল না। আশফি রাগ আর বিস্মিত মুখ করে মাহিকে বলল,
– “কী করে ফেলেছেন আপনি এটা?”
মাহির কম্পিউটারের মনিটরে চোখ গেল তার। রাগে আশফির কপালের রগ জেগে উঠেছে। চেঁচানো কণ্ঠে সে মাহিকে বলল,
– “আগামীকাল এটা নিয়ে কনফারেন্স হবে ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে। আর আজকেই আপনি এটাকে ডিস্কার্ড করে ফেললেন? আপনার ম্যাম আপনাকে এই কাজটা কী করে দিলো?”
আশফির চিৎকারে পুরো অফিস নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। মাহি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে কাঁদতে থাকল শুধু। এবার আশফি গলা নামিয়ে মাহিকে বলল,
– “এর সম্পূর্ণ দায়ভার আপনাকেই নিতে হবে। সারাদিন নাকি সারারাত জানি না, আজকের মধ্যেই কাজটা কমপ্লিট করে সাজিয়ে গুছিয়ে আমাকে প্রেজেন্ট করবেন আপনি।”
আশফি চলে যেতেই চোখের পানি ছেড়ে দিলো মাহি। মাথায় হাত রেখে বসে পড়ল সে। পুরো দুনিয়া ছেড়ে তার অন্য কোথাও চলে যেতে ইচ্ছা করছে এখন। কাঁদতে কাঁদতে মিমির নাম্বার ডায়াল করল সে। মিমি রিসিভ করতে মাহি কণ্ঠ স্বাভাবিক করে তাকে বলল,
– “শোন, আজ আমার ফিরতে দেরি হতে পারে। হয়তো রাতও হবে। একা থাকতে ভয় পেলে পাশের বাসা থেকে রিতুকে ডেকে নিয়ে আসিস।”
এটুকু বলে মাহি ফোনটা রেখে দিলো। বাসার সবাই আজ তার ফুপির বড় ছেলের বিয়ের জন্য দেশের বাড়ি ফরিদপুরে গিয়েছে। মাহির অফিস আর মিমির ভার্সিটির পরীক্ষার জন্য শুধু তারাই যেতে পারেনি।
মাহি কাজটা আবার কোথা থেকে শুরু করবে কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। ভাবতে ভাবতে প্রায় লাঞ্চ টাইম ওভার হয়ে গেল তার। কোনোরকমে শুরু করলেও সেটা ভুল হয়ে হতে থাকল বারবার। ইরোরই দেখাল। এরকরম করে প্রায় ছুটির সময় হয়ে গেল। সবাই যার যার কাজ শেষ করে বিদায় নিতে থাকল মাহিকে বেস্ট অফ লাক জানিয়ে। দু একজন এমপ্লয়ি থাকতে আনোয়ার আসলো মাহির কাছে। তাকে বলল,
– “কাজগুলো নিয়ে স্যার আপনাকে যেতে বলেছেন।”
– “আসছি।”
মাহিকে ডেকে দিয়ে আনোয়ারও চলে গেল। একে একে সবাই-ই বিদায় নিলো। মাহি তার হাতের কাজগুলো নিয়ে আশফির কেবিনে গেল। সে ভেতরে আসতে আশফি স্যুটটা খুলে সোফাতে রাখল। তারপর মাহিকে বলল,
– “কাজগুলো কমপ্লিট না হওয়া অবধি আপনাকে আজ যেতে দিতে পারব না। বাসায় ফোন করে জানিয়ে দিন ফিরতে দেরি হবে।”
মাহি দৃষ্টি নিচু করে বলল,
– “জানিয়েছি।”
– “করতে তো বোধহয় কিছুই পারেননি?”
মাহি নিশ্চুপ।
– “জানি আপনার একার দ্বারা সম্ভভ নয়। ওগুলো নিয়ে বসুন, আমি আসছি।”
আশফি বাহিরে গিয়ে সিকিউরিটিকে কিছু টাকা দিয়ে বলল,
– “কিছু খাবার কিনে নিয়ে আসতে পারবেন?”
– “জি স্যার, কেন পারব না?”
আশফি তাকে বলল কী কী খাবার আনতে হবে। তারপর কেবিনে চলে এলো। মাহি সোফাতে বসে সামনে একগাদা কাগজপত্র ছড়িয়ে কাজে নেমে পড়েছে। প্রচন্ড সিরিয়াসনেস তার চেহারার মাঝে দেখা যাচ্ছে এখন। কয়েক মুহূর্ত আশফি নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে তাকে দেখল। মেয়েটাকে তার এক এক দিন যেন এক একরকমভাবে সুন্দর লাগে। এই যেমন এখন তাকে কাজ করতে দেখে এখন অন্যরকম সুন্দর লাগছে। আশফি এসে মাহির থেকে একটু দূরে সরে বসল। তারপর ল্যাপটপটা কোলের ওপর নিয়ে কাজ শুরু করল। এর মাঝে সিকিউরিটি আনিস এলো হাতে খাবারের ব্যাগ নিয়ে। তারপর সে নিজেই খাবারগুলো টেবিলের ওপর সাজিয়ে রাখল। আশফি হেসে আনিসকে বলল,
– “ধন্যবাদ আপনাকে আনিস। ডিউটির বাইরে গিয়ে কাজটা করার জন্য।”
– “স্যার এটাও আমার ডিউটি। কোনো সমস্যা নেই। আর কিছু লাগলে বলবেন।”
– “আর কিছু লাগবে না।”
– “আচ্ছা তাহলে আমি আসি।”
আনিস যেতেই আশফি মাহিকে গম্ভীর সুরে বলল,
– “খাবারগুলো খেয়ে নিন।”
মাহি কাজগুলো দেখতে দেখতে বলল,
– “আমার খিদে নেই স্যার।”
– “দুপুরে লাঞ্চ করেননি। আর এই কাজটা শেষ করতে কত সময় লাগবে তার ঠিক নেই। খালি পেটে কখনো মাথাও ভালো কাজ করে না আর কোনো কাজে মনও লাগে না। তাই বলছি খেয়ে নিন।”
ভদ্রতা বজায় রাখতে মাহি মুখে একটু স্যান্ডউইচ পুরে পানি খেয়ে নিলো। আশফি তার সবকিছুই খেয়াল করল কিন্তু কিছু বলল না। মাহির মুখটা দেখে সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে তার ওপর মাহি অত্যাধিক ক্ষেপে আছে। শুধু রাগটা ঝারতে পারছে না বলে ভেতরে ভেতরে আরও বেশি ফুলছে। আশফির ইচ্ছে করল তাকে টেনে কোলের মধ্যে বসিয়ে সব খাবারগুলো খাইয়ে দিতে। আর তারপর তাকে বলবে,
– “আমাকে রাগ দেখাতে এলে ফলাফল এর থেকেও ভয়ানক হবে।”
কিন্তু তা তো আর সম্ভব নয়। তাই সে চুপচাপই রইল।
সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে, দুজনে কাজে এত বেশি মনোযোগী হয়ে পড়েছে কেউ আর কারো দিকে দু সেকেন্ড তাকিয়ে তাদের অবস্থাও দেখার সময় পায়নি। কাজ করতে করতে আশফি তার শার্টের ওপরের দুটো বোতাম খুলে ফেলেছে ভেতরে বাতাস প্রবেশের জন্য। মাহির মুখের ওপর একগাছা চুল এলোমেলো হয়ে বারবার উড়ছে আর সে তা কানের নিচে গুঁজতে গুঁজতে চুলগুলোই এলোমেলো করে ফেলেছে। আশফি ল্যাপটপে কাজ করার ফাঁকে মাহিকে বলল,
– “প্রিন্টার মেশিন ইউজ করতে পারেন?”
– “জি পারি।”
– “তাহলে শুরু করুন।”
কাগজগুলো প্রিন্টআউট করে মাহি সোফায় হেলান দিয়ে বসলো। আপাতত তার কাজ শেষ। এরপর তাকে কী করতে হবে তা সে জানে না। কাজের জন্য সে ঘড়ির টাইম দেখতেও ভুলে গেছে। রাত বাজে প্রায় আটটা। চোখদুটো কেমন যেন তার লেগে এলো। কিছুক্ষণের জন্য চোখদুটোকে সে বিশ্রাম দেওয়া জরুরিবোধ করল। প্রায় দশ মিনিট পর আশফি মাহিকে বলল,
– “ওই কাগজগুলো দিন তো?”
কিন্তু মাহির কোনো জবাব পেল না। তার দিকে আশফি তাকাতে দেখতে পেল সে ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু কাজটার মাত্র পঞ্চাশ ভাগ কমপ্লিট হয়েছে কেবল। তাও যেন আশফির ডাকতে ইচ্ছা হলো না। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল প্রচন্ড কেঁদেছে সে। চোখের পাতা ফুলে আছে। আর এ জন্যই এত দ্রুত চোখে ঘুম নেমে এসেছে তার।
কাজগুলো একা হাতে সামলাতে গিয়ে আশফি রাত দশটা বাজিয়ে ফেলল। এক সপ্তাহের একটা কাজ কয়েক ঘন্টায় কমপ্লিট করা কতটা মুশকিল তা আজ সে বুঝতে পারল। সে নিজেও ক্লান্ত এখন। তবে কাজগুলো মোটামোটি কমপ্লিট। কিছুক্ষণের জন্য চোখদুটোর বিশ্রাম দেওয়া তারও প্রয়োজন।
মিমি লাগাতার ফোন করে যাচ্ছে মাহিকে। কিন্তু কোনো রেসপন্স পাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে সে অফিসের নাম্বারে কল করল। বাহিরে প্রচুর ঝর বৃষ্টি শুরু হয়েছে আর রাতও দশটা ওভার প্রায়। আনিস তখন অফিসের ভেতরে এসেছে গেট লক করে দেবে কি না তা জানার জন্য। অনেক্ষণ যাবৎ টেলিফোন বাজতে শুনে সে নিজেই রিসিভ করল। মিমি মাহির কথা জিজ্ঞেস করতে সে বলল,
– “স্যারের সঙ্গে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজে আটকে গেছেন তিনি। তাঁরা দুজন এখনো কাজ করছেন।”
– “এত রাত হয়ে গেল, কখন ছাড়বে ওকে?”
– “জানি না। তবে বৃষ্টি কমলে হয়তো পৌঁছে দেবেন স্যার ওনাকে। আপনি টেনশন করবেন না। স্যার খুব ভালো মনের মানুষ। ভয়ের কিছু নেই।”
মিমি আনিসের কথা শুনে একটু আশ্বস্ত হলো। তার মনে পড়ল সেদিন বৃষ্টির মধ্যে এই মানুষটায় মাহিকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল। তাই একেবারে খারাপ তাকে ভাবা যায় না। তবুও টেনশনটা ভেতরে থেকেই গেল। টেনশনটা ভেতরে রেখেই সে ফোনটা রাখল। আনিস ভেতরে গিয়ে দুজনকে সোফার দু কোণায় ঘুমাতে দেখল। দু’বার ডাকলও সে আশফিকে। কিন্তু কোনো সাড়া নেই। এদিকে বৃষ্টির তেজ বাড়তেই আছে। আনিস তাদের আর না ডেকে চলে গেল। কেবিনের জানালাগুলোও খোলা। বাহিরের দমকা হওয়া এসে মাহির শরীরে কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে বারবার। ঘুমের মধ্যে সে সোফাতে পা তুলে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে পড়ল। এদিকে আশফিও ঘুমের মাঝে বহু আগেই সোফাতে পা তুলে এক কাত হয়ে শুয়ে পড়েছে। মাহি পা তুলে শুতেই আশফির পা এসে ঠেঁকল মাহির কোলের মাঝে। পা জোড়া উষ্ণ তাপ পেয়ে ঘুমটা যেন আরো গাঢ়ো হয়ে এলো তার। হঠাৎ লোডশেডিং হয়ে গেল। কেবিনটা অন্ধকারে ছেয়ে গেছে তখন। মাঝে মধ্যে বিদ্যুৎ চমকানোর বিকট আওয়াজ আর বাহিরের হীম বাতাস দুই মিলিয়ে মাহির ভেতরে চমকে ওঠা আর শরীরে ঠান্ডায় শিরশিরানির অনুভূতি হচ্ছে। সোফাটার মাঝেই এক পাশ থেকে অন্য পাশে সরে শুতে শুতে একদম আশফির পিঠের কাছে চলে এলো সে। আশফি তখন অন্যপাশ ফিরে শুতে গিয়ে পিঠের পিছে বাঁধা পেয়ে তন্দ্রাবিষ্ট চোখে বিদ্যুতের ঝলকানিতে মাহির মুখটা দেখল। মাহি ঠান্ডায় গুটিসুটি মেরে আশফির পিছে পড়ে আছে। মাহিকে টেনে নিজের বুকের মধ্যে নিয়ে দু বাহুর মাঝে জড়িয়ে ধরল সে।
……………………………..
(চলবে)
– Israt Jahan Sobrin
We use cookies on our website to give you the most relevant experience by remembering your preferences and repeat visits. By clicking “Accept All”, you consent to the use of ALL the cookies. However, you may visit "Cookie Settings" to provide a controlled consent.
This website uses cookies to improve your experience while you navigate through the website. Out of these, the cookies that are categorized as necessary are stored on your browser as they are essential for the working of basic functionalities of the website. We also use third-party cookies that help us analyze and understand how you use this website. These cookies will be stored in your browser only with your consent. You also have the option to opt-out of these cookies. But opting out of some of these cookies may affect your browsing experience.
Necessary cookies are absolutely essential for the website to function properly. These cookies ensure basic functionalities and security features of the website, anonymously.
Cookie
Duration
Description
cookielawinfo-checkbox-analytics
11 months
This cookie is set by GDPR Cookie Consent plugin. The cookie is used to store the user consent for the cookies in the category "Analytics".
cookielawinfo-checkbox-functional
11 months
The cookie is set by GDPR cookie consent to record the user consent for the cookies in the category "Functional".
cookielawinfo-checkbox-necessary
11 months
This cookie is set by GDPR Cookie Consent plugin. The cookies is used to store the user consent for the cookies in the category "Necessary".
cookielawinfo-checkbox-others
11 months
This cookie is set by GDPR Cookie Consent plugin. The cookie is used to store the user consent for the cookies in the category "Other.
cookielawinfo-checkbox-performance
11 months
This cookie is set by GDPR Cookie Consent plugin. The cookie is used to store the user consent for the cookies in the category "Performance".
viewed_cookie_policy
11 months
The cookie is set by the GDPR Cookie Consent plugin and is used to store whether or not user has consented to the use of cookies. It does not store any personal data.
Functional cookies help to perform certain functionalities like sharing the content of the website on social media platforms, collect feedbacks, and other third-party features.
Performance cookies are used to understand and analyze the key performance indexes of the website which helps in delivering a better user experience for the visitors.
Analytical cookies are used to understand how visitors interact with the website. These cookies help provide information on metrics the number of visitors, bounce rate, traffic source, etc.
Advertisement cookies are used to provide visitors with relevant ads and marketing campaigns. These cookies track visitors across websites and collect information to provide customized ads.