#তুমি_রঙিন_প্রজাপতি
#writer_sumaiya_afrin_oishi
#পর্বঃ২৩
ওপাশ থেকে এক পুরুষালী গম্ভীর কণ্ঠে ভেসে আসলো,
“আমি, আমি ফাহাদ। ভয় পেয়ো না তুমি। দরজা খোলো।”
মধ্যরাতে প্রিয় পুরুষটির কন্ঠ শুনেও চমকালো না চাঁদনী। যেন এমনটাই হওয়ার ছিলো। তার মন বলছিল ফাহাদ আসবে। সঙ্গে সঙ্গে মলিন ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটলো মেয়েটার। শরীর অস্বাভাবিক মাএায় কাঁপছে, নিজেকে স্হির রাখতে পারছে না চাঁদ। তবুও কোনো মতে টলতে টলতে রুমের লাইট অন করে নিলো। কাঁপা কাঁপা হাতে দরজা খুলে দিলো। এরিমধ্যে কাঙ্ক্ষিত পুরুষটির দেখা মিললো। মনে হচ্ছে, শত জনম পর দেখেছে এই মুখটা।
ফাহাদ ও এক পলক তাকালো, মেয়েটার পড়নে এখনো হলুদ শাড়ী, চোখ মুখ শুকনো লাগছে, চোখে কাজল লেপ্টে আছে অবহেলায়।
কিন্তু দুজনার কারো মুখে কথা নেই। কেউ কিচ্ছুটি বলছে না।
হঠাৎ দু’জনার দৃষ্টি বিনিময় হলো, সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো ফাহাদ। ভিতরে প্রবেশ করে আবারো শাড়ী পরিহিত কন্যার দিকে একবার আড় চোখে তাকালো। মেয়েটা এখনো দরজা ঠে*স দিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।
একি মেয়েটা অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে। এইতো মনে হচ্ছে, এক্ষুনি পড়ে যাবে। ফাহাদ দ্রুত ব্যাগ গুলো সাইডে রেখে লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেলো, ব্যস্ত কণ্ঠে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“এ্যাই মেয়ে? কি হয়েছে তোমার?”
চাঁদনী নিভু নিভু চোখে সেদিকে এক পলক তাকালো, ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে মলিন কন্ঠে বললো,
“আমায় ধরুন ফাহাদ। বিছনায় নিয়ে চলুন না?”
ফাহাদ কোনো দ্বিধা ছাড়াই ধরলো হাতটা। মুহুর্তেই আ”ত’ঙ্কি’ত হয়ে গেলো। মেয়েটির শরীরে অস্বাভাবিক তাপমাত্রা। মনে হচ্ছে তার হাতটা পু’ড়ে যাচ্ছে। এতো জ্বর হয়েছে মেয়েটার। অথচ সে জানতোই না। ভিতরে ভিতরে ভীষণ অপরাধ বোধ কাজ করছে তার।
তবুও নিজেকে ধাতস্ত করে, তান্মধ্যে ফাহাদ পুনরায় চিন্তিতো ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো,
“এতো জ্বর বাঁধালে কি করে তুমি?”
চাঁদনী নিরুওর। ফাহাদ আর কিছু না বলে তাকে ধরে বিছনায় বসিয়ে দিলো।
চাঁদনী বসে থাকতে পারছে না, মাথাটাও ভার হয়ে আছে। তাই নিজে নিজেই কোনো মতে কাঁথাটা গায়ে জড়িয়ে সুয়ে পড়লো।
ফাহাদ কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। মিনিট খানিক সময় চাঁদনী’র দিকে তাকিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। অনেক পথ জার্নি করে এসেছে যার ফলে গায়ে ধুলো বালি। আপাতত আগে একটু ফ্রেশ হওয়া খুব দরকার।
মিনিট পাঁচেক সময়ের মধ্যেই ফিরলো ফাহাদ। বিছনায় এক পলক তাকিয়ে দেখতে পেলো, চাঁদ কাঁথার নিচে থেকেও কাঁপছে। কিন্তু মেয়েটা চোখ বন্ধ করে আছে, তার চোখের কার্ণিশে দিয়ে অনবরত ঝড়ছে লোনা জল।
ফাহাদ এগিয়ে আসলো, খাটের ডান সাইটে, মেয়েটার মাথার পাশে বসলো। সমস্ত জড়তা, দ্বিধা ভুলে হাত রাখলো চাঁদনী’র কপালে।
উষ্ণ শরীরে হঠাৎ শীতল হাতের স্পর্শে চোখ খুলে তাকালো চাঁদ। ফাহাদে’র হাতটা নিজের দুর্বল হাত দিয়ে সরিয়ে দিয়ে অভিমানী কণ্ঠে বললো,
“দূরে সরে গিয়ে বসুন। আমাকে ছুঁয়ে দিলে আপনার ইগো চলে যাবে,রেপুটেশন নষ্ট হবে।”
ফাহাদ ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লো। সরিয়ে দেওয়া হাতটা দিয়ে পুনরায় কপাল ছুঁয়ে শান্ত কণ্ঠে বললো,
“এতো জ্বর কখন থেকে হলো? ঔষধ খেয়েছো তুমি?”
“আপনার না জানলে ও চলবে। অভিমানী কণ্ঠে অন্য দিকে তাকিয়ে বললো চাঁদনী।
ফাহাদ কিছু বললো না। উঠে দাঁড়ালো, আলমারি খুলে দেখলো কাঁথা -কম্বল কিছু নেই। বাসায় আজ মানুষ বেশি যার ফলে সেগুলো অন্য রুমে আছে। অনেক খুঁজে একটা পাতলা কম্বল পেলো। সেটা চাঁদনী’র গায়ে জড়িয়ে দিলো। চাঁদনী হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠলো, জ্বরের ঘোরে “মা”, “মা” বলে কাতরাচ্ছে। শক্ত পোক্ত মেয়েটার একি হা’ল? ফাহাদ অস্হির হয়ে গেলো। এই মুহুর্তে কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। দ্রুত চাঁদনী’র মুখোমুখি এগিয়ে বসলো, হাত দিয়ে চোখের জলটুকু মুছে দিয়ে গাল ছুঁয়ে অস্হির হয়ে বললো,
“এ্যাই, এ্যাই চাঁদ? কষ্ট হচ্ছে তোমার? খারাপ লাগছে? কোথায় কষ্ট হচ্ছে? কাঁদছো কেনো তুমি?”
“কাঁদছি না তো আমি।”
“আচ্ছা তোমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তাই না চাঁদ ? শুধু কি জ্বর হয়েছে নাকি শরীর ও ব্যাথা করছে? বলো আমায় প্লিজ! আমার ব্যাগে মেডিসিন আছে, আমি মেডেসিন দিচ্ছি তোমায়। ঠিক হয়ে যাবে কেঁদো না।”
চাঁদনী’র কান্না থেমেছে ইতোমধ্যে। ফাহাদে’র কথার বিপরীতে মৃদু হাসলো সে, খানিক বাদে তাচ্ছিল্য করেই হঠাৎ বলে উঠলো,
“শরীরের কষ্ট চোখে পড়ছে তোমার, মনে যে পাহাড় সমান কষ্ট তা দেখছো না তুমি? সেগুলো তোমার চোখে পড়ে না। হাহ্!
এই যে হঠাৎ করেই মেঘ আসে ঝ’ড় আসে বৃষ্টি আসে তবুও তোমার আসার কোনো নাম নেই।
আমার ভিতর জুড়ে যে ঝ’ড় যে বৃষ্টি ঝ’রে পড়ে দু’চোখ বেয়ে তোমার কাছে তার কোনো দাম নেই।”
ফাহাদ চমকে উঠলো, এই অভিমান, তাচ্ছিল্য যে বড়ই গাঢ়! এর বিপরীতে কিছু বলার ভাষা নেই তার। নিজের ভিতরের অপরাধ বোধ জাগ্রত হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। নত মাথায় এখনো চাঁদনী’র গাল ছুঁয়ে বসে আছে ছেলেটা। চাঁদনী আবারো সরিয়ে দিলো হাতটা। ফাহাদ চট করে তাকালো চাঁদনী’র মুখের পানে। এই দৃষ্টিতে রয়েছে অসহায়ত্বের ছাপ, অপরাধ বোধ। চাঁদনী এসব দেখছে না আর না বুঝার চেষ্টা করছে। মানুষটার প্রতি বড্ড অভিমান জমেছে তার কোমল মনে। এতো দিনের জমানো অভিমান এখন অভিযোগে পরিণত হয়েছে।
চাঁদনী ফাহাদে’র দিকে তাকিয়ে আক্ষেপ করে বললো,
“এত গুলো দিন আমায় একটিবার মনে পড়েনি তোমার?”
“পড়েছে।” ছোট্ট করে বললো ফাহাদ।
চাঁদনী আবারো হাসলো। এই হাসির আড়ালে রয়েছে চা’পা কষ্ট, দীর্ঘশ্বাসের গল্প। মুখে হাসি ঝুলিয়েই বললো,
“তা-তো দেখছিই। আচ্ছা তোমায় একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?”
“হুম।”
“আচ্ছা শোনো? আমারে ক্যান চাইছো না তুমি?
আমারে তোমার জীবনে চাইলে খুব বেশী কি ক্ষ*তি হইতো?আমারে লইয়া আশা দেখলা না ক্যান?
আমার জীবনে তুমি আশার আলো,
হইয়া আইলে কি তোমার খুব ক্ষতি হইতো?
তুমি এমন কইরা পর হইয়া গেলা কেন?
একটুখানি আপন থাকতে পারলা না?”
থামলো চাঁদ গলা ধরে আসছে তার, কণ্ঠনালি কাঁপছে ভীষণ। কিন্তু ফাহাদ স্বাভাবিক। মিনিট খানিক সময় চুপ থেকে বলে উঠলো ফাহাদ,
“তুমি ভীষণ ভালো মেয়ে চাঁদ। তুমি, তুমি আমার থেকে বেটার কাউকে ডিজার্ভ করো চাঁদ। আমি তোমার যোগ্য নয়।”
“অযুহাত দিচ্ছো তুমি? কথা এড়িয়ে যাচ্ছো?”
“না। না। একদমই না। আমি সত্যি বলছি চাঁদ। আমি, আমার মতো ছেলের যোগ্যতা নেই তোমাকে পা…”
চাঁদনী হাত উঁচু করে ফাহাদ’কে থামিয়ে দিয়ে বললো,
“হুস চুপ।”
সাথে সাথে থেমে গেলো ফাহাদ। গাঢ় দৃষ্টিতে তাকালো মেয়েটার দিকে। চাঁদনী উঠে বসলো। এতক্ষণ সুয়ে থাকার ফলল কিছুটা ভালো লাগছে তার। নিজেকে সামলে নিয়ে ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বললো,
“পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মিথ্যা সান্ত্বনা কি জানেন? “তুমি আমার থেকে বেটার কাউকে ডিজার্ভ করো!”
আরে কাউকে একবার মনে ধরে গেলে কে বেটার, কে কী ডিজার্ভিং- এত সমীকরণ কষার সময় কই!
এই ধরুন?
যার প্রিয় ফুল শিউলি, টাটকা একটা গোলাপের থেকে সে শিউলি পেলেই বেশি খুশি হবে।
তেমনি যা আমরা চাই, যা ভাল্লাগে, সেটাই মুখ্য আসলে। আর বেটারের কি শেষ আছে? আমি কারো থেকে বেটার, কেউ আমার থেকে বেটার, কেউ বা তার থেকে। কিন্তু, ভালো লাগা যদি এক জায়গা এসে থেমে যায়.!
সে যেমনই হোক না কেন, তার থেকে বেটার কেউ হতে পারে না। সেই বেটার!
আর হ্যাঁ, সব ভালোতে কি ভালোবাসা হয়!”
ফাহাদ ভরকে গেল! এতটুকু বাচ্চা মেয়ে দারুণ কথা জানে। এর সাথে যুক্তি-তর্কে পারা অসম্ভব। কিন্তু, সাথে সাথে মুগ্ধ ও হলো কেনো জানি। মনে মনে হাসলো কিঞ্চিৎ। পরক্ষণে নিজের ভালো লাগা’কে ফের প্রশ্ন করলো,
“এতো ভালোবাসো কেনো আমায় চাঁদ?”
“আমি তোমাকে কারণ ছাড়াই ভালোবাসি! আর তুমি আমাকে অকারণেই অবহেলা করো।
এতো কিছুর পরেও তুমি চাইলে আমার হতে পারতে। কিন্তু তুমি চাওনি বরং কারণে অকারণে অবহেলা করছো। তুমি চাইলে সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখতে পারতে, কিন্তু তুমি খুশী হয় বিচ্ছেদে।
তুমি চাইলে অতীত ভুলে কাছে টেনে নিতে পারতে আমাকে। কিন্তু তুমি গুরুত্ব দিয়েছো শুধু দূরত্ব’কে। ছোট বেলা থেকে শুদ্ধতম ভালোবাসার কা’ঙ্গা’ল আমি।
তুমি চাইলে কা’ঙ্গা’লি’নী’র দুঃখ গুলো ভালোবাসা দিয়ে ভুলিয়ে দিতে পারতে।কিন্তু, তুমি উল্টো মনকে বি’ষি’য়ে দিয়েছো অবহেলা করে।
তুমি চাইলে পারতে সব কিছু ভুলে আবার নতুন করে শুরু করতে, কিন্তু তুমি এমন কিছু চাওনি কখনো।
চেয়েছো আমাকে ক্রমশ দূরে সরিয়ে নিজের মতো থাকতে।
সত্যি বলতে কি, ভালোবাসায় দু’জনার সমান আগ্রহ না থাকলে “ভালোবাসা” শব্দটাই মূল্যহীন সেখানে।”
থামলো মেয়েটা।স্বাভাবিক ভাবেই বললো কথাগুলো। কিন্তু এর ভিতরে লুকিয়ে রয়েছে কত অভিযোগ, মানুষটাকে পেয়ে ও না পাওয়ার আক্ষেপ। ফাহাদ বুঝেছে সে সব কিন্তু কিচ্ছুটি বুঝানোর চেষ্টা করলো না। খানিকটা লম্বা শ্বাস ফেলে নিশ্চুপ হয়ে কিছুক্ষণ দম নিয়ে বললো,
“তোমার দিক দিয়ে তোমার ভাবনা সঠিক চাঁদ। জীবন যত সহজ মনে হয় আসলে ততোটা সহজও নয় সবার জন্য। আসলে মানুষ হিসেবে আমরা মাঝে মাঝে এমন কিছু পরিস্হিতির সম্মুখীন হই যেখানটায় দাঁড়িয়ে নিজের খারাপ লাগা, মন্দ লাগা, কষ্ট গুলো চাইলেও কাউকে বুঝতে পারি না।
হয়তো তখন আপনজন বলতে যাদের ভাবি তাদের কাছ থেকেও প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ভয়ে মুখ লুকিয়ে পালিয়ে বেড়াই কিংবা বলতে যেও থেমে যাই। তখন
বুকের ভেতর কষ্টের ঘর বাঁধি, নিরবে অশ্রু ঝড়াই।
কিছু কথা, কিছু ভাবনা আপন মনেই ভাবতে হয়। যেগুলো কেউ কখনো বোঝে না কিংবা তা কখনো কাউকে বোঝানোই যায় না। কিছু কথা, কিছু ভাবনা একান্তই ব্যাক্তিগত।”
এতটুকু বলে এক পলক চাইলো চাঁদনী’র মুখের পানে। মেয়েটা মলিন মুখে বসে আছে নিরব হয়ে, ক্ষণে ক্ষণে গায়ে ঝাঁকি দিচ্ছে। মায়া হয় ফাহাদে’র। ভীষণ মায়া! সকল কিছু ছেড়ে ছুঁড়ে জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছে হয়, “আমার তোমাকে শেষ অবধি লাগবে। কথা দেও, থেকে যাবে আমার হয়ে?”
কিন্তু, কিন্তু মন চাইলেও সব চাওয়া সম্ভব নয়। কিছু মানুষ কথা ভিতরে রাখতে পছন্দ করে। এদের ভয় হয়, বলে দিলে যদি সচতা ভেবে ছুঁড়ে ফেলে। কিংবা হারানোর ভয়ে বলা হয় না ক্রমশ চেপে যেতে হয়। তেমনি ফাহাদ ও পারে না। নিজের সুপ্ত ইচ্ছেটুকু লুকিয়ে পুনরায় আবার চাঁদকে বললো,
“বসে থাকতে তোমার কষ্ট হচ্ছে না? অযথা কেনো কষ্ট করছো? সুয়ে আরাম করো।”
“আমার কষ্ট সহ্য করার অভ্যাস আছে। আপনি বরং সবকিছু ভুলে ঘুমান। কত জার্নি করে আসলেন, কত ক্লান্ত আপনি। আমার চিন্তা না হয় বাদ দিন।”
ফাহাদ চোখ ছোট ছোট করে চাইলো। এতক্ষণ কি সুন্দর তুমি, তুমি করে বলছিলো। শুনতে বেশ ভালোই লাগছিলো। হঠাৎ আপনি কেনো?
বাপরে এতো অভিমান কৃষ্ণকলির! আনমনে হাসলো ফাহাদ। গাঢ়ো দৃষ্টিতে কৃষ্ণ রঙা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললো,
“বুঝলে কৃষ্ণকলি,তোমাকে ভুলে থাকার অভিনয় করছি শুধু,কিন্তু ভুলতে পারলাম কই?”
ভুলে থাকার চেষ্টা করি যতবার! ঠিক মনে পড়ে ততবারই।
বুঝলে অভিমানী কৃষ্ণকলি, বাড়ি থেকে যাওয়ার পরে ঘুমাইনি বহুরাত।
ঘুমের যত চেষ্টা করি ঘুমতো আসে না, ঘুমটা তো তুমি নিয়েছো কেঁ’ড়ে।
তাই রাত গুলো জেগেই গেছি, শুধু কথা হয়নি।”
চাঁদনী বুঝছে ফাহাদ তাকে কিছু বলছে, কিন্তু শব্দ গুলো মিলাতে পারছে না।
সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফাহাদ’কে জিজ্ঞেস করলো,
“কিছু বললেন?”
ফাহাদ দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে বললো,
“নাহ।”
রুম জুড়ে পিনপতন নীরবতা। দুজনেই চুপচাপ। চাঁদনী জেদ ধরে বসে আছে। ফাহাদ আরো কয়েকবার বলেছে সুইতে কিন্তু সে না জবাব দিচ্ছে আর না শুনছে কথা।
কিশোরী মেয়ের আবেগ, অনুভূতির, অভিমান ভীষণ ভ’য়ংক’র হয়। এর সাথে আবেগে গা ভাসানো যাবে না। এমনিতেই মেয়েটা অসুস্থ এরমধ্যে কি জেদ!
ফাহাদ হঠাৎ গম্ভীর কণ্ঠে ধমকে বললো,
“কি সমস্যা তোমার চাঁদ? এভাবে বসে আছো কেনো? সুয়ে পড়ো বলছি।”
চাঁদনী’র মধ্যে কোনো হেলদোল নেই। সে বরং ফাহাদ’কে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ মৃদু চেঁচিয়ে পাল্টা প্রশ্ন,
“আপনার কি সমস্যা? আমার পিছনে পড়ে আছেন কেনো? কেনো নিজের মূল্যবান সময় নষ্ট করছেন? আমি তো আপনার কেউ না। এতবড় পৃথিবীতে আমার তো কেউ নেই আর না ছিলো কখনো।আমাকে কারো মনে পড়ে না। আমি ভীষণ একা। তাই আমার ভালো খারাপ আমি দেখে নিবো। আপনার অযথা ভাবতে হবে না।”
ফাহাদ ভ্রুকুটি করে চাইলো। ঠান্ডা মাথার মেয়েটার এতো রাগ জানা ছিলো না তার।পরক্ষণে পাল্টা রাগ না করে বরং কোমল কণ্ঠে ফাহাদ বললো,
“কে বললো তোমার কেউ নেই? কেউ তো অবশ্যই একজন রয়েছে, যে সারাক্ষণ মনে করে তোমায়। তুমি হয়তো দেখছো না কিন্তু, তাহার ভাবনা জুড়ে শুধু তোমার বিচারণ চাঁদ।”
না! নেই কেউ আমার। আমাকে মনে করার মত তেমন কেউ নেই
যে আমায় ভেবে মন খারাপ করবে,
যে আমার জন্য অপেক্ষা করবে
অপেক্ষায় ক্লান্ত হয়ে কেঁদে কেঁদে চোখ ভাসাবে।
আমাকে মনে করার মত তেমন কেউই নেই,
যে প্রতিদিন আমার খোঁজ নিবে
একটু কল দিয়ে জিজ্ঞেস করবে “কিরে কেমন আছিস” । মন ভালো আছে তোর?
এমন কেউ ও নেই…
যে ঘুমাতে যাওয়ার আগে হলেও একবার বলবে
এ পৃথিবীতে তোমার মত আমার আর কেউ নেই।
শুধু তুমি পাশে থাকলে শত দুঃখের মাঝেও আমি হাসতে পারি।
তুমি থাকলে আমার আর কিচ্ছু চাই না ।
যে বিনা প্রয়োজনে আমার একটু খোঁজ নিবে।
পায়ে পা মিলিয়ে এগিয়ে দিবে একটু পথ।
আমার জীবনের কঠিনতম মুহূর্তে একটু সাহস দিয়ে বলবে,তুমি ঠিক পারবে।
আমার এমন কেউও নেই। সত্যি বলতে আমার “আমার” বলতে কোনো মানুষ নেই।প্রয়োজন ছাড়া আমি সবার পর।আমি ছাড়া এ পৃথিবীতে আমার বলতে আর কেউ নেই।আমি ভীষণ রকম একা
যেমন একা হয় নদীর স্রোতে ভেঙে যাওয়া চর ।
কথাগুলো বলতে বলতে চোখ দু’টো ছলছল করছে মেয়েটার। চোখের জলটুকু আড়াল করতে অন্য দিকে তাকালো চাঁদ। শরীরে কাঁ*টা দিচ্ছে কিন্তু শরীরের এই কষ্টে যেন কিছুই না। মনের কোঠরে যে এর থেকেও তী’ব্র কষ্ট রয়েছে।
ফাহাদ উঠে দাঁড়ালো আবারো চাঁদনী’র একদম পাশে এসে বসলো। নরম হাতটা নিজের পুরুষালী শক্ত হাতের মুঠোয় আবদ্ধ করে নিয়ে অনুরোধ করে বললো,
“এতো অভিমান করে থেকো না চাঁদ! নিজকে….”
ফাহাদে’র কথার মধ্যেই চাঁদনী স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
আমার কেউ নেই, কেউ ছিলোনা।
এটা অভিমানে করে নয়,অনুভবে বলছি।
যারা এসেছিলো আমার জীবনে,তারাই আমাকে আলো ভেবে পথ চিনে বাড়ি ফিরে গেছে।
আর আমি,ল্যাম্পপোস্টের মতো বহুকাল দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ভেবেছি সৃষ্টিকর্তা আমার জন্য
কাউকে বানিয়েছে। কিন্তু আমি ভুল।
এক মাথার উপর আকাশ ছাড়া,আমাকে কেউ ভালোবাসে নি। প্রচন্ড তৃষ্ণায় কথা বলার জন্য
যখন প্রিয় মানুষ গুলো’কেখুঁজেছি?
তখন হাতরিয়ে দেখতাম,শুনশান নিরবতায়
একটা মাথার উপর চাঁদ দাঁড়িয়ে,
তাও অন্যের আলোয় আলোকিত। আমার কেউ নেই,
কেউ ছিলোনা। জানেন? এই অনুভূতিটা বড্ড বাজে।,আমি নিঃসঙ্গ আকাশ হয়ে
আজন্ম শূন্যে ভেসে যাই।”
জড়িয়ে আসছে তার কণ্ঠ, আগের তুলনায় দ্বিগুণ কম্পন দিচ্ছে শরীর । এতক্ষণে জিদ ধরে বসে থাকার শক্তিটুকু ফুরিয়ে এসেছে। নিভু নিভু চোখে একবার আশেপাশে তাকিয়ে কিছু খোঁজার চেষ্টা করছে। কিন্তু মনে হচ্ছে পড়ে যাবে। এরিমধ্য ফাহাদ ঝড়ের বেগে এগিয়ে এসে চাঁদনী’কে দুই হাতে ধরে ফেললো। মেয়েটার শরীর অস্বাভাবিক ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে এখন। ফাহাদে’র কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। এতো রাতে কাউকে ডাকা ও সম্ভব নয়, সবাই ঘুমাচ্ছে।
হুট করে সমস্ত ভাবনা চিন্তা ভুলে গিয়ে চাঁদনী’কে জোড় করে কাঁথা, কম্বল মুড়িয়ে সুয়ে দিলো। কিন্তু না এখনো কাঁপছে মেয়েটা। অতঃপর নিজেও সুয়ে পড়লো কম্বলের মধ্যে । দুই হাতে জড়িয়ে ধরে নিজের বাহুর সাথে আবদ্ধ করে নিলো কৃষ্ণকলি কে। এই প্রথম শক্ত এক আলিঙ্গন পেয়ে কেঁপে উঠলো চাঁদ। তার মাথা ঠেকেছে প্রিয় পুরুষটির প্রশান্ত বক্ষে। সবকিছু এত দ্রুত হয়েছে যে, মেয়েটার বাকরুদ্ধ। নিজেকে ছাড়াতে চেয়ে ও পুরুষের শক্তির সাথে পারছে না। ফাহাদ তারমধ্যে এক ধমক দিয়ে বললো,
“এতো নড়ছো কেনো চাঁদ? চুপ করে সুয়ে থাকো না।”
“আমায় ছাড়ুন বলছি।”
“সত্যিই ছেড়ে দিবো? আচ্ছা বলোতো, আমার স্পর্শ তোমার খারাপ লাগছে চাঁদ?”
চাঁদনী নিশ্চুপ। ফাহাদ হাতের বাঁধন ডিলে করে বললো, “কি হলো বলো? ”
“তুমি খুউব, খুব খারাপ মানুষ। কিন্তু তবুও, মন বলে তোমার কাছে যাই,তোমারে একটা বার ছুঁইয়া দেখি।
বিবেক বলে,পাষাণের কাছে যাইতে নাই,
দূরেই ভালা।পাষাণ মানুষ দূর থাইকাই সুন্দর।”
ফাহাদ মুচকি হাসলো। চাঁদনী হাঁপিয়ে গিয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিলো। শীতল শরীরের উষ্ণতা পেয়ে ঠায় নিলো প্রশান্ত বুকে। মনে হচ্ছে, অদ্ভুত এক শান্তি অনুভব করছে সে।
ফাহাদ আরো একটু শক্ত করে জড়িয়ে নিলো তার কৃষ্ণকলি’কে। তার বুক ধুকপুক করছে। তবুও ভীষণ শান্তি খুঁজে পাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে অশান্ত মনটা বহুদিন পরে একদম শান্ত হয়ে উঠলো। ইশশ! স্ত্রী’কে জড়িয়ে ধরার মধ্যে, এতো সুখ, এতো শান্তি আল্লাহ দিয়ে রেখেছে যে অ’তৃ’প্তি আ*ত্মা*টায় শীতল হাওয়া বইছে! আবেশে চোখ বন্ধ করে নিলো ছেলেটা।
এরিমধ্যে চাঁদনীও শক্ত করে জড়িয়ে নিলো প্রিয় পুরুষটি’কে। তার এতোদিনের সমস্ত মান-অভিমান চুকে গিয়েছে এক আলিঙ্গনে। আনন্দে চোখ থেকে লোনা জল ভিজিয়ে দিচ্ছে প্রশান্ত বুকটা। ফাহাদ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
“প্লিজ! আর কেঁদো না চাঁদ। মাথা ব্যথা করবে তোমার। ইশশ শরীরে কি জ্বর!
প্রিয় পুরুষের আদুরে স্পর্শে চাঁদনী’র এতক্ষণে’র আঁটকে রাখা চাপা কান্নাটা শব্দ করে বেরিয়ে আসলো। ফাহাদ’কে দু’হাতে ঝা’প’টে ধরে কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বললো,
“জ্বর তো ঠিকই আসে;তুমি আসো না,
দূরত্ব বাড়াও কেবল, ভালোবাসো না।
তুমি এসো আবার;ঠিক জ্বর যেমন আসে,
তুমি বসো আবার;একটু দূরত্বে কিংবা পাশে।জ্বর তো কেবল শরীর পুড়ে-আর তুমিতো পুড়ো মন,
তোমার নেশায় বিভোর থাকি আমি সারাক্ষণ।
তবুও জ্বর এলো;তুমি এলে না,
আসি আসি করে কেবল করো ছলনা!তুমি না হয় জ্বরের মতোই আসো,
এই বাহানায় একটুখানি আমায় ভালোবেসো।
জ্বর এলে পানসে লাগে;তিতা লাগে সবই,
তুমি এলেই ছন্দ আসে, সবকিছু ভালো লাগে।
তুমি এসে কপালে রাখো তোমার হাত,এসে দেখো-কতখানি বিরহে কাটাই নির্ঘুম রাত।
প্রিয় জ্বর-তুমি আবার ফিরে এসো,তুমি হয়ে একটুখানি আমার পাশে বসো।”
মেয়েটার আবেগি কথায় অনুতপ্ত হলো ফাহাদ। তপ্ত এক শ্বাস ছাড়লো খুব গোপনে। অতঃপর হাতাশ কণ্ঠে বিড়বিড় করে বললো,
আমি যে ভীষণ নিরুপায় চাঁদ পাখি! আমি সব কিছুর বিনিময়ে নিজেকে খুঁজেছি,না পেয়েছি পুরাতন আমি’কে, না পেয়েছি নতুনত্বে সাজানো কোনো আমি’কে।”
শুনলো না সেসব চাঁদ। নিজ থেকে আবারো মলিন কন্ঠে বললো,
“জানো প্রিয়?”
ভীষণ বেহায়া আমার মন, এতো অবহেলার পরেও সেই তোমাকেই খোঁজে সারাক্ষণ।
কিন্তু এটাও জানি আমি, তুমি করবে না আমার সাথে ভালোবাসার আ’লা’প’ণ। সবই বৃথা যায়, এতো ভালোবাসার আয়োজন। তবুও বেহায়া মন তোমার ভালোবাসা পেতে ম’রি’য়া হয়ে থাকে সারাক্ষণ।
দুনিয়ায় নি’ছ’ক র*ঙ তা’মা’শা’র প্রতি অনিহা জ’ন্ম নিলে আমায় ডাক দিও।
কথা দিচ্ছে, আমি দুনিয়ায় সমস্ত সুখের আলিঙ্গন ফেলে, পুনরায় তোমার অবহেলার আগুনের র’শ্মি’তে লিখে দিবো একখানা প্রিয় নাম, “আজও ভালোবাসি”!
কিয়াৎ সময় থামলো চাঁদ। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে আবারো বললো,
“ঘুমাও এবার তুমি। দেখি ছাড়ো আমায়।”
বলেই পুনরায় আবারো মাথা তুলি নিতে চাইলো। কিন্তু ফাহাদ ছাড়লো না। অপরাধীর ন্যায় বলে উঠলো,
“নাহ ছাড়ছি না! আসলে চাঁদ আমার কথা শোনো?”
“হয়েছে থাক।”
“নাহ! শোনো না?”
” কি শুনবো?তুমি এতো নি’ষ্ঠু’র’তম মানুষ কেনো? আমায় কেনো ভালোবাসো না ফাহাদ?
কি হতো আমাকে একটু ভালোবাসলে?
তোমার ভালোবাসা না পেয়ে আমার
হৃদয় মরুভূমির মতো হয়ে গেছে।
বলো আর কখনো ছেড়ে যাবে না আমায়? বলো? তুমি বারবার আসবে,আমায় ভালোবাসবে?”
ফাহাদ হুট করে চাঁদনী’র কপালে গভীর ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিলো। নিজের কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে নে’শা’লো কণ্ঠে বলে উঠলো,
আমি এতোটাও নি’ষ্ঠু’র নয়, চাঁদ পাখি। শান্ত হও তুমি। আর দূরত্ব নয়, এখন থেকে বৃষ্টি হয়ে জড়বো আমি,তোমার মন আকাশে!
অভিমান গুলো দিবো ধুয়ে,বৃষ্টি ফোঁটা হয়ে!
বৃষ্টি শেষে ফুল কুড়বো-তোমার হাতটি ধরে!”
.
.
চাঁদনী মনে হচ্ছে বিশাল আকাশটায় উড়ছে। তার এতো সুখ লাগছে কেনো? প্রিয় জনার সানিধ্যে এতো শান্তি বুঝি! শরীরের অর্ধেক অসুস্থতা যেন কে’টে গিয়েছে অব’লী’লা’য়। সে কথার ফুলঝারি নিয়ে বসেছে আজ। কখনো রাগ, কখনো, অভিমান, কখনো অভিযোগ করছে।
ফাহাদ কথা বলতে বারণ করছেন কিন্তু শুনছে না মেয়েটা। বিশ্বস্ত একটা বুকে মাথা রেখে একা একাই। এতোদিনে জমানো কথাগুলো যেন বলে হালকা হচ্ছে। ফাহাদ আর না করলো না। মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মনোযোগ দিয়ে শুনছে। কখনো বা মুচকি হাসছে।
এক সময় হাঁপিয়ে গিয়ে চুপ হয়ে আদুরী বিড়াল ছানার মতো গুটিশুটি মেরে আছে চাঁদ। শরীরে ঠান্ডা ভাব কেটে গিয়েছে। তবুও আগের ন্যায় প্রিয় পুরুষটি’কে শক্ত বাঁধনে আগলে রেখেছে। মনে হচ্ছে, ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে। ফাহাদ ছাড়াতে চেয়েও পারেনি আর না সেভাবে চেষ্টা করছে।
ফাহাদে’র এবার বেশ অস্বস্তি। মনের মাঝে পুরুষালী সুপ্ত এক অনূভুতি জাগ্রত হচ্ছে। খুব কাছ থেকে আজ ভালোবাসতে ইচ্ছে হয়। নারীর সানিধ্যে এসে কতক্ষণই বা নিজেকে সামলে রাখা যায়। নিজেকে বেসামাল লাগছে।
এবার দূরত্ব না বাড়ালেই নয়! না-হয় ভয়ংকর কা’ন্ড বেঁধে যাবে। ফাহাদ চাঁদনী’র কাছ থেকে দূরে যেতে চাইছে কিন্তু সে ঠিক ততটা কাছে আসছে, ছাড়তে চাইছে না শান্তিময় জায়গাটা। ফাহাদ মৃদু কণ্ঠে বললো,
“এবার ছাড়ো চাঁদ।”
“না। না। তোমাকে ছাড়ছি না। ছাড়লেই তুমি হারিয়ে যাবে আগের ন্যায়।” বাচ্চাদের মতো কণ্ঠ করে কথাগুলো বলে মুখ লুকালো পুনরায় চাঁদ।
ফাহাদ চাঁদনী’র মাথায় হাত দিয়ে কোমল স্বরে বললো,
“আর যাবো না বললাম তো।”
“থাক তবুও আমি ছাড়ছি না।”
“তুমি এতো অবুঝ কেনো চাঁদ পাখি? আচ্ছা শুনো?”
“হু।”
ফাহাদ চাঁদনী’র কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
তুমি এই নিষি রাতে,
হাতটা রাখবে হাতে?চোখে চোখে অল্প,
হবে রঙ্গিন গল্প।
শুনো না….
এবার আমায় পাগল করো,
তোমার প্রেমে মাতোয়ারা,বাঁচাও না হয় মা রো।আজ এই নিষি রাতে,
আ’গু’ন মনে, জল ঢেলে দাও তাতে।
দেখো না…
এই আমি কেমন একা,
দিবে একটু দেখা?
যেমন করে মেঘের বুকে বৃষ্টি থাকে চুপ,
তোমার বুকে মুখ লুকাবো,ভালোবাসবো খুব।
চেয়ে দেখো আজ,হৃদয় করছে কেমন,
শান্ত কি আজ করবে তুমি,বৃষ্টি শেষে তেমন?”
চাঁদনী ফাহাদে’র ইঙ্গিত বুঝতে পেরে লজ্জায় কুঁকড়ে গেলো। চ’ট করে ফাহাদ’কে ছেড়ে দিয়ে অন্য দিকে সুয়ে কম্বল দিয়ে মুখ ডেকে নিলো। কিন্তু শেষ র’ক্ষা হলো না। ফাহাদ এগিয়ে আসলো। বড্ড বেসামাল সে! চাঁদনী’র দিকে তাকিয়ে নে’শা’লো কণ্ঠে বললো,
“এতটুকুতেই এতো লজ্জা চাঁদ পাখি। আজ পালাচ্ছো কেন? অথচ তুমি চাও আমি তোমার কাছে আসি, ভালোবাসি।
আজ পালিয়ে লাভ হবে না। আমাকে সামলাতে হবে যে পাখি। বড্ড বেসামাল লাগছে। ”
চাঁদনী কিছু বলার আগেই ফাহাদ সকল দূরত্ব চুকিয়ে কাছে টেনে নিলো কৃষ্ণকলি কে। পরমুহূর্তেই আদরে আদরে ভরিয়ে দিলো মেয়েটাকে। একটা সময় দু’জনই আরো বেসামাল হয়ে উঠলো। অতঃপর সকল দুঃখ ভুলে দু’জন মানব -মানবী হারিয়ে গেলো একে অপরের ভালোবাসায়। আজ এই নিষিরাত সাক্ষী হয়ে রইলো, তাদের মধুচন্দ্রিমায়।
#চলবে….
#তুমি_রঙিন_প্রজাপতি
#writer_sumaiya_afrin_oishi
#পর্বঃ২৪ (প্রথম অংশ)
মিষ্টি একটি ভোর। চারপাশে পাখির কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত পরিবেশ। শান্ত পরিবেশ’টাকে গমগমে করে থেমে থেমে দূর খোঁয়াড়ি ঘর থেকে মোরগের হাঁক আসছে। হয়তো তারা নিজেদের শব্দ ধাড়া ঘুমন্ত মানুষ’কে জানান দিচ্ছে, “সকাল হয়েছে।” তবুও সবকিছু’কে উপেক্ষা করে সুখ নীড়ে’র মানুষ গুলো শান্ত ভঙ্গিতে ঘুমোচ্ছে।
প্রতিদিন চাঁদ ফজরের সময় উঠলেও আজ সেও উঠেনি। শেষ রাতের দিকে ঘুমানোর ফলে এখনো বেঘোর ঘুমাচ্ছে চাঁদনী। কিন্তু তার ঘুমটা বেশিক্ষণ আর দীর্ঘ স্হায়ী হলো না।
এরিমধ্যে ঘাড়ে কারো গরম নিশ্বাস অনুভব করতেই ঘুম ছুটে যায় তার। ঘুম ঘুম চোখে অন্য পাশে সুতে গিয়েও পারলো না। পুরুষালী শক্ত এক বন্ধনে আবদ্ধ পায় নিজেকে। পিটপিট করে চোখ খুলতেই দেখতে পায় আষ্ঠে-পৃষ্ঠে তাকে জড়িয়ে ধরে আছে ফাহাদ। তার মাথাটা ঠেকেছে প্রশান্ত এক শীতল বক্ষে। চাঁদনী ঘুরে পূর্ণ দৃষ্টি বুলালো ফাহাদে’র দিকে। মানুষটার চোখ দু’টো বন্ধ, তবে ঘুমাচ্ছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। পরক্ষণেই চাঁদনী মুচকি হাসলো। আজকের সকালটা ভীষণ স্পেশাল লাগছে তার কাছে। নিজেকে আজ ভীষণ সুখী মনে হচ্ছে। বিশ্বস্ত এক জোড়া হাত তাকে আষ্ঠে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে, শীতল একটি বুকে মাথা গুজার ঠাঁই পেয়েছে। চাঁদ মুখ লুকালো পুনরায় ফাহাদে’র উদাম বুকে। এখানেই মনে হচ্ছে পরম শান্তি খুঁজে পায় সে।
আজ পেয়েছে চাঁদ। একদম নিজের করে পেয়েছে মানুষটাকে। এখন দু’জনার মাঝে এক ইঞ্চি ও দূরত্ব নেই।
এইটুকুই তো চেয়েছে চাঁদ। আর কি চাই তার! ঠোঁটের কোণে হাসিটা আরো গাঢ় হলো মেয়েটার। পরক্ষণেই চোখ বন্ধ করে নিলো মেয়েটা। নিরবে অনুভব করছে প্রিয় পুরুষটি’কে।
কয়েক মিনিট যেতেই চোখ খুললো সে, কিঞ্চিৎ ঝুঁকে কোমল শীতল ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিলো ফাহাদ’র কপালে।
“কি ব্যাপার চাঁদ? বররের ঘুমের সুযোগ নিয়ে আদর করা হচ্ছে বুঝি! তুমি চাইলে সজ্ঞানে ও হবে, এতো লুকোচুরি’র কি আছে? আমরা আমরাই তো।”
হঠাৎ ঘুম ঘুম কণ্ঠে ফাহাদে’র এমন কথা শুনে ছিটকে দূরে সরে যেতে চাইলো চাঁদ। কিন্তু ফাহাদে’র বাহুবন্ধন থেকে বিছিন্ন হতে পারলো না।
এতক্ষণ যখন ফাহাদে’র কোনো রেসপন্স পায়নি তখন ভেবেছে লোকটা ঘুমাচ্ছে। যদি ঘুনাক্ষরেও টের পেতো ফাহাদ সজাগ, তাহলে কি আর আবেগি হয়ে এমন কাজ করতো। আর না এখন লজ্জায় পড়তে হতো।লোকটা তো দারুণ নির্লজ্জ! মুখে কিচ্ছুটি আঁটকায় না মনে হচ্ছে। এভাবে কেউ কাউকে লজ্জা দেয়?
বিপাকে পড়ে গেলো চাঁদ, লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকালো। অতঃপর বিড়বিড় করে বললো , নি’র্ল’জ্জ লোক!”
উচ্চ কণ্ঠে আর বলার সাহস হলো না। কিন্তু কিভাবে জানি বুঝলো ফাহাদ। চাঁদনী’র দিকে এক পলক চেয়ে বললো,
“কি বললে আমি নি’র্ল’জ্জ? আচ্ছা দাঁড়াও তবে…”
বলে দুষ্ট হাসলো ফাহাদ। চাঁদনী সহসায় চমকালো! মনের কথাও পড়তে পারে বুঝি লোকটা! এরিমধ্যে ফাহাদ কে আরো কাছে এগিয়ে আসতে দেখে আরো বেশি লজ্জায় কুঁ’ক’ড়ে উঠলো চাঁদনী। চাঁদনী’কে এভাবে লজ্জা পেতে দেখে মৃদু হাসলো ফাহাদ।
হাতের বাঁধন আগলা হয়েছে খানিকটা, সেই সুযোগে চাঁদনী উঠে ছুট লাগালো।
কিন্তু কিছু টা সামনে এগোতেই বিপওি বাঁধলো। শরীর ব্যাথায় আসড় হয়ে আছে, জ্বরটা এখনো আছে যার ফলে দুর্বল লাগছে ভীষণ। মাথা ঘুরে পড়ে যেতে নিয়ে ও পড়লো না। এরিমধ্যে ফাহাদ ছুটে এসে কোলে তুলে নিলো তাকে।
চাঁদনী নিজেকে বাঁচাতে ফাহাদে’র গলা জড়িয়ে ধরে ধরলো। ফাহাদ মুচকি হেসে ওয়াশরুমের গিয়ে দরজা লক করে দিলো।
.
.
বেলা অনেকটা হয়ে গিয়েছে। সুখ নীড়ের সবাই একে একে উঠে গিয়েছে। বয়স্ক কয়েকজন মিলে বসার ঘরে বসে গল্প করছে,কেউ বা বাড়ির উঠনে চেয়ার পেতে বসে আছে। এরিমধ্য ফাহাদ’কে রুম থেকে বেরোতে দেখে হৈচৈ পড়ে গিয়েছে মানুষ গুলোর মধ্যে। সমবয়সী কাজিন গুলো এসে ঝাপটে ধরেছে তাকে। কেউবা খোঁচাচ্ছে আর মিটমিট হাসছে। কাজিনের দলকে সামলে, ফাহাদ একে একে সবার সাথে কুশল বিনিময় করলো। গতকাল অনেক রাতে বাসায় এসেছে যার ফলে কাউকে ডাকেনি তখন। আর না বাড়ির কেউ জানতো তার আগমনের কথা। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে তাকে দেখে বাড়ির সবাই অবাক হওয়ার সাথে সাথে খুশী ও হয়েছে। ফাহাদে’র আগমনে সকাল সকাল বেশ জমজমাট বিয়ে বাড়ি। ফাহাদ কিয়াৎক্ষণ সবার সাথে টুকটাক কথা সেড়ে না খেয়েই বাবা’র সঙ্গে বাহিরে বের হয়েছে।
এদের সবাইকে দেখা গেলোও চাঁদনী’কে দেখা যাচ্ছে না। মূলত ফাহাদই কড়া করে নিষেধ করছে তাকে রুম থেকে বেরোতে। মেয়েটা এখনোও ভীষণ অসুস্থ্য। রাতে একটু জ্বর কমলেও সকালে ঠান্ডা লাগানো’র জন্য এখন আবার শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে। নিজের বে’সা’মাল পা’গ’লা’মি’র জন্য ভিতরে ভিতরে অ’নু’ত’প্ত ফাহাদ। রেস্ট প্রয়োজন মেয়েটার। আর এই শরীরে কাজ তো নয়ই!
তাই যাওয়ার আগে বাহির থেকে ছিটকিনি আঁটকে গিয়েছে।
বেলা আট’টা বেজে গিয়েছে ইতোমধ্যে। এখনো নাস্তা হয়নি কারো। সবাই অপেক্ষা করছে।
চাঁদনী’কে এখনো রান্না ঘরে না পেয়ে ফাতেমা খানম ভিতরে ভিতরে রাগে ফে’টে যাচ্ছে। যদিও ফাহাদ জানিয়েছে চাঁদ অসুস্থ। তবুও তার পিওি জ্ব’ল’ছে।
বাসায় মেয়ের বিয়ের উপলক্ষে বিভিন্ন মেহমান যার ফলে দ’মে আছে৷ না হয় এতক্ষণে হাঁক ডাক ছেড়ে বাসা মাথায় তুলে ফেলতো।
রান্না ঘরে বসে কাজ করছে কয়েকজন মহিলা।
চাঁদের উপরে কাজের চাপ কমাতে বাবা বিয়ে উপলক্ষে বাসার কাজে সাহায্য করার জন্যই মূলত এদের রেখেছে। চাপা মেজাজ নিয়ে তাদের কাজের তদারকি করছে ফাতেমা খানম। নবাবজাদার বে’টি কি এমন অসুস্থ? সব কাজ না করার বাহানা। আর তার ছেলেটাও আজকাল বউয়ের আঁচল ধরেছে। চরম বিরক্ত সে।
মনে মনে চাঁদকে বারকয়েক গালি দেওয়া শেষ। এরিমধ্য আগুনে ঘি ডালার মতো ফাহাদে’র বড় মামি জিজ্ঞেস করলো,
“আপা তুমি একা কা’ম করতেছো, তোমার পোলার বউ কই? হেরেতো দেখতেছি না।”
“ন’বা’ব’জা’দি কিনা!সে কি আর কাজ করবো। দেখো গিয়ে ঘুমাচ্ছে। এরে তো খাবার সময় পাবে। যত জ্বা’লা সব আমার।” ফাতেমা খানম তাচ্ছিল্য করে বললো।
যা শুনে মামি হা-হুতাশ করছে। ফাতেমা খানমের সাথে তাল মিলিয়ে চাঁদনি’র জাত-পাত ধুয়ে দিচ্ছে। কয়েকজন মহিলা এদের সাথে যোগ দিয়ে নিজেদের পুএবধূর গুনগান গাইছে। কেউ বা আ’ক্ষে’প করছে। এরিমধ্যে আফজাল হোসেন ও ফাহাদে’র কথা শুনতে পাচ্ছে বসার ঘরে। সবাই আপাতত এসব কথা রেখে দিয়েছে।
এরিমধ্যে আফজাল হোসেন হাঁক ছেড়ে নাস্তা চাইছে। ফাহাদ এসেই রান্না ঘরে প্রবেশ করলো। একটা প্লেট রেডি করছে একাই।
মা তা দেখে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
“এগুলো কই নিয়ে যাচ্ছিস?”
“চাঁদের জন্য।” ফাহাদে’র সোজাসাপ্টা জবাব। মায়ের চেহারার রঙ পাল্টা, মুখ বাঁকালো।
বাহ’রে এসেই বউয়ের গো’লা’মী করছে। এত অধপতন হয়েছে তার ছেলের।
মা যে ভীষণ বিরক্ত তা বেশ ভালো বুঝেছে ফাহাদ ।
ফাহাদ প্লেট রেডি করা শেষ। খাবার প্লেট নিয়ে যেতে নিয়েও দাঁড়িয়ে মায়ের উদ্দেশ্যে মৃদু কণ্ঠে বললো,
” পরের মেয়েকে নিজের মেয়ে নাই বা মনে করতে পারো মা। তবে অন্ততো মানুষ হিসেবে তার প্রতি একটু সহনশীল হও। ভুলে যেওনা পরের মেয়েটাও মানুষ রোবট নয়।”
কথা শেষ করেই বড় বড় পা ফেলে চলে গেলো ফাহাদ। মা বিস্মিত চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইলো। সে ভেবেই পাচ্ছে না, এটা কি ফাহাদ?
রুমে সুয়ে আছে চাঁদ। শরীরটা চলছে না তার। তবুও ফাহাদ’কে রুমে আসতে দেখে উঠে বসলো।শুষ্ক ঠোঁটে আলতো হাসলো। কিন্তু ফাহাদ গম্ভীর মুডে আছে। হাতের প্লেটটা সামনে রেখে গম্ভীর কণ্ঠেই বললো,
“খেয়ে নেও।”
ফাহাদে’র এমন আচরণে চুপসে গেলো চাঁদ। হঠাৎ কি হলো লোকটির? ভেবে পাচ্ছে না সে। মলিন কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে তোমার?”
“কিছু হয়নি। তুমি তাড়াতাড়ি খাবার শেষ করো। ঔষধ খেতে হবে।”
“খেতে ইচ্ছে করছে না। তুমি খাইয়ে দেও না।” আবদারের সুরে বললো চাঁদ।
“হাত দিয়ে খাও।”
“আচ্ছা ঠিকাছে লাগবে না। আমি খাবো না নিয়ে যাও।”
“জেদ করছো কেনো চাঁদ? খাও বলছি।” খানিকটা ধমকে বললো ফাহাদ। অযথা ফাহাদে’র ধমক ঘাবড়ে গেলো চাঁদ। হঠাৎ করে অভিমানে চোখ দু’টো ছলছল করে উঠলো মেয়েটার। সে কি এমন বলছে? একটু তো আবদার করে বলেছে খাইয়ে দিতে। তাতে কি হয়েছে? যে তাকে এভাবে ধমক দিতে হবে। নাকি একদিন অসুস্থ তাতেই হাঁপিয়ে গিয়েছে লোকটা।
মুখ ঘুড়িয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে চোখের জলটুকু আড়াল করার চেষ্টা করছে। এরিমধ্যে শক্ত পোক্ত একটি হাত তার চোখের পানিটুকু মুছে দিলো। থমথমে কণ্ঠে পুরুষটি বললো,
“না কেঁদে আগে খাবারটা শেষ করো চাঁদ। আমি বাহিরে যাবো, অনেক কাজ পড়ে আছে।”
“আমি খাবো না বললাম তো। আপনি আপনার কাজ করুন গিয়ে।”
মুখ ফুলিয়ে বললো চাঁদ। ফাহাদ কিচ্ছুটি না বলে একটুকরো ডিম,রুটি চাঁদনীর মুখের সামনে ধরলো। চাঁদনী সাথে সাথেই খেয়ে মুখে নিলো। মনে মনে ভীষণ খুশী হলো। এটাই চেয়েছিলো, লোকটা তাকে বুঝুক, অভিমান জমতে না দিয়ে যত্ন করে ভে’ঙে দিক। এরিমধ্যে ফাহাদ থমথমে কণ্ঠে বললো,
“এত খুশী হবার কিছু নেই চাঁদ। আমি চাইনি কেউ খাবার সামনে নিয়ে কাঁদুক।”
চাঁদনী মুখ বাঁকালো। লোকটাতো আস্ত এক বিরক্তিকর মানুষ। ফাহাদ আর কিচ্ছুটি না বলে চুপচাপ খাইয়ে দিচ্ছে। অল্প কিছু খেয়ে আর খেতে পারলো না চাঁদ। ফাহাদ আর জোড় করলো না। হাত দিয়ে মুখটা মুছিয়ে দিয়ে ঔষধ খাইয়ে দিলো। এতটুকুতে ছিলো অতী যত্ন। মানুষটা যত্নশীল! চাঁদনী এতক্ষণ সবকিছু মুগ্ধ হয়ে দেখছিলো,কিন্তু সে চুপচাপ। ফাহাদ এখন খাচ্ছে চাঁদনী’র রেখে দেওয়া খাবারটাই।সে দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রিয় পুরুষটিকে দেখছে চাঁদ। ছন্নছাড়া এই পুরুষটির আগাগোড়া অদ্ভুত মুগ্ধতায় ছড়িয়ে আছে। চাঁদ নামক সপ্তদশী মেয়েটা ক্ষণে ক্ষণে এই মুগ্ধতায় আটকে যাচ্ছে।
ফাহাদের খাওয়া শেষ। চাঁদকে এতক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে আসছে সে। এখনো তাকিয়ে আছে মেয়ে’টা। ফাহাদ তাওয়াল দিয়ে হাত মুছতে মুছতে বললো,
“এভাবে হা করে কি দেখছে?”
চাঁদনী মুচকি হেসে বললো,
” তোমাকে।তুমি আস্ত একটা নে*শা ফাহাদ। মন চায় টুপ করে খেয়ে ফেলি।”
“কি আরো খেতে চাও আমায়? আসো তাহলে খেয়ে দেখো।”
ফাহাদে’র কণ্ঠ স্বর আগের মতোই অথচ কি ভ’য়ংক’র কথা। কিশোরী মেয়েটাকে বিপাকে ফেলার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। নিজের কথায় নিজেই লজ্জা পাচ্ছে। চাঁদনী আর কিছু না বলে দ্রুত কাঁথা মুড়ি দিয়ে সুয়ে পড়লো। ফাহাদ হাসলো।
রুমে বসে টুকটাক কাজ সেড়ে নিলো। অতঃপর চাঁদনী’কে উদ্দেশ্য করে বললো,
“আমি বাহিরে বের হচ্ছি। তুমি রেস্ট নেও চাঁদ। কিছু প্রয়োজন পড়লে সাথে সাথে কল করো আমায়। খবরদার! রুম থেকে বের হবে না কিন্তু বলে দিলাম।”
চাঁদ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। ফাহাদ একপলক চাঁদের দিকে তাকিয়ে রুম ছাড়লো।
চলবে…..
#তুমি_রঙিন_প্রজাপতি
#writer_sumaiya_afrin_oishi
#পর্বঃ২৪ ( শেষ অংশ)
একা একা রুমে সুয়ে বোরিং ফিল করছে চাঁদ। সময় কাটাতে মুঠোফোনটা হাতে নিয়ে গেইম খেলতে লাগলো। কয়েক মিনিট যেতেই দরজায় খটখট শব্দ করে রুমে প্রবেশ করলো ফাহাদে’র ছোট মামি। মানুষটা বেশ গম্ভীর স্বভাবের। তাকে দেখে চাঁদনী কিঞ্চিৎ চমকালো! কটুক্তি মূলক কথা শোনার ভয়ে সাথে সাথে ফোনটা লুকিয়ে রাখলো। সোয়া থেকে উঠে বসে ভদ্রতা সূচক মৃদু হেসে সালাম দিলো চাঁদ।
মামি জবাব দিয়ে এগিয়ে আসলো। রস ভারী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“শুনলাম তুমি নাকি অসুস্থ বউ? কি হয়েছে তোমার? এখন কেমন লাগছে শরীর?”
“এইটুখানি জ্বর হয়েছে মামি। এখন মোটামুটি ভালো আছি।”নম্র কণ্ঠে বললো চাঁদ।
মামি আরো একটু চাঁদের কাছে এসে কপালে হাত রেখে তাপমাত্রা দেখে রসিকতা করে বললো,
” আমগো ছেলে আসতে না আসতেই বেশ ভালোই জ্বর বাঁধিয়েছো বউ। এক রাতেই এই অবস্থা!”
মামি শ্বাশুড়ির বে’ফাঁ’স মূলক কথা শুনে চাঁদনী বিষম খেলো। এই মানুষটা এতো রসিকতা জানে আগে ধারণা ছিলো না তার। চাঁদ লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেললো সাথে সাথে। চাঁদের লজ্জারাঙা মুখটা দেখে মামি মুখ টিপে হাসলো খানিকটা। কথার প্রসঙ্গ পাল্টাতে জিজ্ঞেস করলো,
“ঔষধ খেয়েছো?”
চাঁদনী মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোধক সম্মতি দিলো। নিজে খাটের উপরে আরো খানিকটা চিপকে মামির জন্য বসার জায়গা করলো। হাত দিয়ে ইশারা করে মৃদু স্বরে বসতে বললো। মামিও মুচকি হেসে বসলো। মানুষটাকে উপর থেকে যতটা কঠোর মনে হয় একদমই তেমন নয়।
মামি ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করছে চাঁদ’কে। হঠাৎ কথায় কথায় চাঁদের কাছে জানতে চাইলো,
“তোমার বাবা’র বাড়ি থেকে কেউ আসেনি বউ? বিয়েতে কত লোকজন অথচ তোমাদের বাড়ির কাউকে দেখছি না যে।”
মামির এমন প্রশ্নে হঠাৎ করেই বুকের ভেতর চিনচিন ব্যাথা অনুভব করলো মেয়েটা । এতক্ষণের হাসি মুখটা চুপসে গেলো মুহূর্তেই।
চাঁদের বাবা নিজের দায়িত্ব ভুলে গেলেও আফজাল হোসেন ভুলেনি। এতকিছু হওয়ার পরেও নিজ দায়িত্বে দাওয়াত নিয়ে গিয়েছিল চাঁদের বাবার বাড়ি। এ বিষয়ে বাড়ির কেউ না জানলেও চাঁদকে বলেছে বাবা। কিন্তু তারা সাফ জানিয়ে দিয়েছে তারা কেউ আসবে না। জোছনা আপাকেও বলা হয়েছে কিন্তু সে ও পারিবারিক কিছু সমস্যার জন্য আসতে পারছে না। চাঁদ খুব গোপনে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো। বাবা-মা থাকতে ও আজ কেউ নেই তার।
পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
“আমার কেউ নেই মামি। আমি যে এতিম!”
উপর থেকে নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করতে চাইলেও পারছে না মেয়েটা। মামি টের পেয়েছে মেয়েটার কণ্ঠস্বর কাঁপছে, মেয়েটাকে অস্বাভাবিক লাগছে। হয়তো ভিতরে ভিতরে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। যা দেখে মামি চাঁদের কাঁধে হাত রেখে কোমল কণ্ঠে বললো,
“আমি দুঃখীত মা! আমি আসলে জানতাম না তুমি এতিম তোমার কেউ নেই।
মন খারাপ করো না দয়াকরে! মানুষ মরণ’শী’ল! কেউই চিরকাল বেঁচে থাকবে না। দু’দিন আগে পড়ে আমাদের সকলকেই মৃ’ত্যু’র স্বা’দ গ্রহণ করতে হবে। কষ্ট পেয়ো না মা!”
বাবা-মা থেকেও নিজেকে এতিম দাবি করার যে ব্যাপারটা! এই অ’স’হ্য যন্ত্রণায় বুকটা ঝ’ল’সে যাচ্ছে মেয়েটার। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে তার,
“আমি মোটেও এতিম নয়! কিন্তু বাবা-মা সব থেকেও আমি অ’না’থ!”
কিন্তু মনের কথাগুলো পুনরায় যত্ন করে মনেই গেঁথে নিলো। কিছু ব্যাথা, কিছু কথা মনেই রয়ে যায়। তেমনি চাঁদ ও পারছে না। নিজের দুর্বলতা সে কাউকে দেখাতে চায় না। থাক না কিছু কষ্ট একদম একান্তই।
বুক ফা*টা বোবা আ’র্ত’না’দ লুকিয়ে হাসলো চাঁদ। মামির কথার বিপরীতে মৃদু হেসেই বললো,
“এগুলো ব্যাপার না।আমি ঠিকাছি মামি।”
এরিমধ্য রুমে ফারিহা ও মিম আসলো। সাথে আরো অনেক জন প্রবেশ করলো। পরক্ষণেই সবাই মিলে গল্প গুজবে মেতে উঠলো।
.
.
বেলা গড়িয়েছে বেশ। সকাল গড়িয়ে দুপুর। বরপক্ষ এসে গিয়েছে ইতোমধ্যে। সুখ নীড়ে বিয়ের জমজমাট আয়োজন চলছে। চারপাশে আ’নন্দ হৈ-হু’ল্লা!
কনে পক্ষ ছোটাছুটি করে বর পক্ষ’কে খাতির যত্ন করতে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছে। জোয়ান ছেলে-মেয়েরা আনন্দ উৎসবে মেতেছে।
ইতোমধ্যে খাওয়া ধাওয়ার পার্ট চুকে গিয়েছে। দুই পক্ষের মাঝে আলাপ চলছে।
সেই সাথে সময় বাড়াছে। এসে গিয়েছে কন্যা বিদায়ের পালা। বিয়ে বাড়ি সময়ের সাথে সাথে প্রিয়জনকে বিদায়ের ঘন্টা বাজছে। ধীরে ধীরে বিয়ে বাড়ির আনন্দ উৎসবে মুখরিত পরিবেশে শো’কে’র ছায়া পড়েছে। বর পক্ষ তাড়া দিচ্ছে বউ নিবার জন্য। কনেকে সামনে আনা হলো। বিদায়ের আমেজ চলছে।
বিদায় মুহুর্তে ফারিহা চিৎকার করে কাঁদছে। কাঁদছে মা -বোন, মাহিম আরো অনেকে । ফাহাদ একটু দূরে দাঁড়িয়ে নিজের চোখে জলটুকু আড়াল করছে। বাবা ক্ষণে ক্ষণে বুকে হাত দিচ্ছে। আদরের কন্যাকে পরের হাতে তুলে দিতে ভ’য়া’বহ এক ব্যাথায় বুকটা তী’ব্র হা’হা’কা’র করছে তার। তবুও কন্যাকে জামাইয়ের হাতে হাসি মুখে তুলে দিলো বাবা। আয়ান ফারিহার কোমল হাতটা শক্ত করে ধরলো। বাবা তা দেখে মৃদু হাসলো, অতঃপর মৃদু কণ্ঠে বললো,
“মেয়েটা আমার বড়ই আদরের বাবা। তোমার উপর ভরসা করে আমার আদরের কন্যাকে তোমার হাতে তুলে দিলাম । আজ থেকে জীবনের শেষ দিন অবধি তাকে ভালো রাখার দায়িত্বও তোমায় দিলাম। আমার মেয়েটাকে কখনো কষ্ট পেতে দিও না বাবা।”
বাবার গলা ধরে আসছে। বেশি কিছু বলতে পারলো না। আয়ান তাকে ভরসা দিলো। তার মেয়েকে কখনো কষ্ট পেতে দিবে না। সারাজীবন আগলে রাখবে। বাবা যেন চিন্তা না করে।
বাবা মেয়ের কপালে চুমু এঁকে দিলো, মাথায় হাত বুলিয়ে ফারিহা ও আয়ানকে আর্শীবাদ করলো। অতঃপর নিজের কষ্ট গুলো আড়াল করতে কিঞ্চিৎ দূরে সরে দাঁড়ালো।
একদিকে এতগুলো বছর পরে প্রিয়জনকে পাওয়ার আনন্দ, অন্যদিকে এতগুলো বছর আগলে রাখা স্বজনদের থেকে চলে যাবার কষ্টে বক্ষজুড়ে তোলপাড় করছে ফারিহার। নিজেকে আর স্হির রাখতে পারলো না। মাথা ঘুরে পড়ে যেতে নিলো অমনি পিছন থেকে ধরে ফেললো ফাহাদ। বোনকে দুই হাতে আলতো জড়িয়ে ধরলো। ফারিহা ভাইয়ের বুকে মাথা গুঁজে কান্নায় ভে’ঙে পড়লো। ফাহাদের ও চোখ দু’টো রক্তিম বর্ণ হয়ে আছে। হয়তো সবার অগোচরে সে ও কেঁদেছে। আদরের বোনকে বিদায় দিতে তার ও ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আজ। বোনের মাথায় স্নেহময়ী হাত বুলিয়ে দিয়ে কোমল কণ্ঠে ডাকলো,
“টুকি?”
ফারিহা কেঁদেই যাচ্ছে। কান্নারত আবেগি কণ্ঠে বললো, ভাই আমি আমি তোদের ছেড়ে যাবো না।”
“কাঁদিস না টুকি। এভাবে কাঁদে কেউ? শান্ত হ বোন। আমরা আছি না। আমরা কি হারিয়ে যাচ্ছি পা’গ’লী? গতকালই আবার তোকে নিয়ে আসবো। আমরা কি তোকে শ্বশুর বাড়িতে একেবারে দিয়ে দিচ্ছি নাকি?
তোর যখন ইচ্ছে তুই চলে আসবি।”
ফারিহা তবুও কাঁদছে। আজ তার কান্না থামছেই না যেন। ফাহাদ বোনকে কাঁদতে দিলো। মাথায় বুলিয়ে দিলো। মিনিট পাঁচেক পেরতেই ফারিহার কান্নার বেগ কমে এসেছে। বেলা ফুরিয়ে এসেছে, বর পক্ষ আবারো তাড়া দিচ্ছে। ফাহাদ বোনের হাতটা আয়ানের হাতে তুলে দিয়ে বললো,
“তোমার হাতে তুলে দিলাম বোনটাকে। আমার বোনটা বড়ই অবুঝ ভাই ওকে সামলে রেখো, আগলে রেখো। জীবন চলার পথে যদি কখনো মনেহয় আমার বোন তোমার যোগ্য নয়। তাকে নিয়ে তোমার চলছে না। তখন আমায় শুধু একবার বলিও। আমি বিনাবাক্যে আমার বোনকে আমার কাছে নিয়ে আসবো। আমি থাকতে কখনো আমার বোনদের এক ফোঁটা কষ্ট পেতে দিবো না। কিন্তু, খবরদার! আমার টুকির গায়ে একটা আঁচড় ও দিবে না।”
আয়ান মুচকি হেসে জবাব দিলো,
“এই হাত কখনো ছেড়ে দিবার জন্য ধরিনি ভাইয়া। চিন্তা করবেন না, আপনার বোনকে আমি আমার সাধ্য অনুযায়ী ভীষণ ভালো রাখার চেষ্টা করবো। এতটুকু ভরসা রাখুন আমার উপর।”
একে একে সবাই বিদায় দিলো ফারিহাকে। বরপক্ষ বউ নিয়ে গাড়িতে বসলো। মিনিট খানিকের মধ্যে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলতে লাগলো।
পিছনে ফেলে গেলো কিছু ব্যথিতো হৃদয়। সবাই চাতক পাখির মতো গাড়িটা যাওয়া দিকে তাকিয়ে রইলো। তান্মধ্যই হঠাৎ এক চিৎকার দিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো ফাতেমা খানম। মানুষ হিসেবে সে যেমনটাই হোক না কেনো মেয়েরা তার বড় আদরে।
চাঁদনী শ্বাশুড়ির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার চোখেও পানি। তার ছোট্ট ম’স্তি’ষ্কেও ভাবাচ্ছে আজ, ফাতেমা খানমের মতো কা’ট’খো’ট্টা শক্ত মহিলাও আজ মেয়ের জন্য চিৎকার দিয়ে কাঁদছে। অথচ তার মা তাকে নির্দয়ের মতো একা রেখে চলে গেলো। একটি বার খোঁজ অবধি নিলো না কখনো। পৃথিবীতে সব থেকে ঘৃণ্যিত মা’ই হচ্ছে তার মা। আর একবার মায়ের জায়গাটায় ঘৃণা জমা হলো।
এতক্ষণের কান্নার ফলে মাথা ঘুরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেতে নিলো ফাতেমা খানম । চাঁদনীর দৃষ্টি গোচর হতেই দৌড়ে এসে তাকে জাপ্টে ধরলো।
.
.
নতুন দম্পতিদের মধুচন্দ্রিমার রাত বেড়িয়ে যেয়ে মিষ্টি একটা ভোর উপহার দিলো প্রকৃতি। চারপাশে ইতোমধ্যে ভোরের আলো ফুটেছে।
আয়ান এখনো নিজের কাঙ্ক্ষিত নারীকে বুকে জাপ্টে ধরে শান্তির নিদ্রায় আছন্ন। ঘুমন্ত স্বামীর দিকে চুপটি করে তাকিয়ে রইলো ফারিহা। কতদিনের সাধনার পরে পুরুষটিকে পাওয়া। আজ তাদের ভালোবাসা স্বার্থকতা পেয়েছে। ফারিহার চোখে মুখে তৃপ্তিময় হাসি। চুপটি করে নরম ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিলো আয়ানের কপালে। অতঃপর আবার আয়ানের বুকে মুখ গুঁজে নিলো। শরীর ক্লান্ত তার, প্রশান্ত একটা বুক পেয়ে চোখ লেগে আসলো। এরিমধ্যে হঠাৎ করে দরজার বাহিরে ক্রমগত শব্দ করছে কেউ।
#চলবে……
কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ!