#তুমি_রঙিন_প্রজাপতি
#writerঃsumaiya_afrin_oishi
#পর্বঃ২
বাসর ঘরের এক কোণে গুটিশুটি মেরে বসে আছে চাঁদনী। রুমের মৃদু আলোতে চাঁদনী’র ফ্যাকাশে মুখটা বিদ্যমান। মেয়ে’টার দৃষ্টি এলোমেলো, হৃদয়ে চলছে প্রবলবেগে ঝ’ড় হাওয়া!
এই রাত নিয়ে কতশত স্বপ্ন থাকে মেয়েদের। তেমনি তারও তো কিশোরী মনে এই রাত নিয়ে স্বপ্ন বুনিয়েছিলো। তার বি’ষ’ন্ন জীবনে একফালি আলো নিয়ে কেউ একজন এসে তার রঙহীন সাদাকালো জীবনটা রঙিন আলোয় আলোকিত করবে। স্বামী নামক সেই প্রিয়তম পুরুষটি একে একে তার সমস্ত দুঃখগুলো মুছে দিবে একটু একটু করে, যেখানে থাকবে না কোনো মন খারাপের ছাপ, থাকবে না কোনো দুঃখের গল্প। সুন্দর একটা পরিবার থাকনে।
সেখানে থাকবে শুধু শান্তি! থাকবে শুধু সুখ আর সুখ! এটাই তো খুব করে চেয়েছিলো সে।
কিন্তু, কিন্তু বিপরীতে তার সাথে হলো পুরোই উল্টো। আকস্মিক ভাবে অচেনা, অজানা এক পুরুষের সাথে পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হলো সে। কবুল বলার সাথে সাথে, এমনকি কাগজে কলমে ভিন্ন পুরুষ মানুষ থেকে লোকটা হয়ে গেলো তার স্বামী! তার অর্ধাঙ্গিন! অথচ মানুষটাও তাকে একা রেখে চলে গেলো। স্বামী নামক মানুষটির অবয়া অবধি ভালো করে দেখলো না সে।
বাসর রাতে সুখময় দীর্ঘ অপেক্ষা করে প্রিয় পুরুষটি জন্য অপেক্ষা করে নারী। সেই সাথে লাজুক হেসে দেখে রঙিন কতশত স্বপ্ন। দীর্ঘ অবসান ঘটিয়ে তবেই আসে কাঙ্ক্ষিত মানুষটি৷ অথচ তার এই অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে কেউ আসবে না। কারণ মানুষটি তার জন্যই নাকি বাসা থেকে চলে গিয়েছে।
নিজের ভাগ্যের উপরে করুণা হচ্ছে চাঁদনী’র! শ্যামময়ী মেয়ে’টার চোখেমুখে লেপ্টে আছে বিষন্নতা। ভাগ্য তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? কি হচ্ছে তার সাথে? আদৌও জানে না সে! নিয়তি তাকে নিয়ে রীতিমতো খেলছে যেন। শুধু নিজেকে পৃথিবীর সব থেকে অভাগী মনে হচ্ছে। সে যেখানে যায় দুঃখ তার পিছু ছাড়ে না। নিজের ভাগ্যের উপর সীমাহীন অভিযোগ চাপলো। এতো মন্দ ভাগ্য কারো হয় বুঝি?
চোখটা ভীষণ জ্বালা করছে তার, বুকটা অসহ্য যন্ত্রণা করছে, অথচ চাইলেও সে মন খুলে কাঁদতে পারে না। সময়ের সাথে সাথে কান্নারাও হারিয়ে গিয়েছি। কতইবা কাঁদতে পারে মানুষ! দুঃখ যার নিত্যদিনের সঙ্গী তার আর কান্না!
দুঃখ কষ্ট পেতে পেতে একটা সময় এসে সব হজম হয়ে যায়। বারকয়েক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লো চাঁদনী। না চাইতেও আনমনে চাঁদনী ভেবে যাচ্ছে আজ তার সাথে হওয়া ঘটনাগুলো।
ফ্লাশব্যাকঃ
আফজাল হোসেন সিদ্ধান্ত নিতে নিজের সাথে কতক্ষণ হিমশিম খাচ্ছেন। এই সিদ্ধান্ত যে ভীষণ ভয়াবহ ঠেকলো মস্তিষ্কের কাছে। কিন্তু, পুনরায় আবার মন বলছে, “এই পরিস্থিতিতে এই সিদ্ধান্তই সঠিক আফজাল!”
চোখের সামনে তো আর একটা অসহায় মেয়ের এই অবস্থা সহ্য করা যায় না। যেভাবেই হোক মেয়ে’টার সম্মান রক্ষা করবে তিনি।
সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে নিজের মনে’র সিদ্ধান্তকে প্রধান্য দিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হলো আফজাল হোসেন।
.
.
ঘরভর্তি মানুষে’র সামনে অপমান অ’প’দ’স্ত হয়ে নিজের মান-সম্মান সব হারিয়ে সেই থেকে নির্বাক ভঙ্গিতে বসে আছে এক অসহায় পিতা। হঠাৎ ঘাড়ে কারো স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠে ফিরোজ মিয়া। সামনে থাকা লোকটিকে দেখে নড়েচড়ে বসে তার দিকে নিভু নিভু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কিছু বলার আগেই আফজাল হোসেন বললো,
“আপনাদের যদি আপওি না থাকে তবে আপনার মেয়ে আমি…..”
বলতে পারলোনা পুরো কথা আফজাল। এরমধ্যে পাশের বাড়ির এক দুর্দান্ত মহিলা মুখের কথা কেঁড়ে নিয়ে অবাক হয়ে বললো,
“কিহ্! আপনে হের মেয়ে’রে বিয়া করবার চান?”
মুহুর্তেই লোকজন নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি শুরু করলো। শেষ কিনা এই বুড়া বেডা চাঁদনী কে বিয়ে করতে চায়! এদের এমন বানোয়াট, উদ্ভট কথা শুনে আফজাল হোসেন রেগে যান। ধ’ম’কে’র সুরে বললো উঠলো,
“চুপ করুন আপনারা! ছিঁ! ছিঁ! কি বলছেন এসব আপনারা? চাঁদনী আমার মেয়ে’র বয়সী। ওকে আমি এই মুহূর্তে আমার বড় ছেলের বউ করতে চাই।”
ধমক লোকজন কিছুটা চুপ হলো। ফিরোজ মিয়ার মলিন মুখটায় দেখা দিলো উচ্ছাসিত আনন্দের ধারা। জোছনা চাঁদনী কে ধরে নিজের বাবা’র ঘর খানার দিকে যাচ্ছিলো। হঠাৎ এখানে আফজাল হোসেন’কে দেখে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পরলো জোছনা। এতক্ষণে চাঁদনী’র জন্য অস্হির চিত্র মন’টা আশেপাশে কে কোথায় হুঁশ ছিলো না তার। মুহূর্তেই জোছনা ব্যাস্ত পায়ে এগিয়ে এসে অবাক হয়ে বলে উঠলো,
“আরে আঙ্কেল! আপনি এখানে?”
ঘাড় বাঁকিয়ে জোছনাকে দেখে আফজাল হোসেন ও খানিকটা অবাকে’র স্বরে পাল্টা প্রশ্ন করলো,
“আরে বউ মা তুমি? তুমি আসিফে’র (জোছনার স্বামীর নাম) বউ না?”
“জ্বি। তা আঙ্কেল আপনি এখানে কোথাথেকে আসলেন?”
“আসলে বরপক্ষ’র থেকে আসছিলাম আমি। হঠাৎ এমন একটা বিশৃঙ্খল কান্ড বাঁধবে বুঝতে পারিনি। সে যাই হোক, চাঁদনী তোমার কি হয় মা?”
“বোন। চাচাতো বোন আমার।”
টুকটাক কথা বলে আফজাল হোসেন তার সিদ্ধান্ত জানায় জোছনা কে। জোছনা মনেমনে ভীষণ খুশী হয়েছে। আফজাল হোসেন’কে চেনে সে। তার শ্বশুরে বন্ধু আফজাল। সেই সুবাদে শ্বশুরে’র সাথে কয়েকবার দেখেছে সে। নিঃসন্দেহে লোকটা ভীষণ ভালো। স্বামী’র নিকট অনেক অনেক প্রশংসা শুনেছে আফজাল হোসেনে’র। যে মানুষ’টা এতো ভালো। নিশ্চয়ই তার ফ্যামিলি’র মানুষগুলো ও ভালো। তার ছেলের বউ হবে তার চাঁদ! তার চাঁদও অনেক,অনেক সুখে থাকবে। ভাবতেই জোছনার ভিতরটা জুড়ে শীতল হাওয়া বইছে। এজন্যই মানুষ বলে, “সৃষ্টিকর্তা যা করে বান্দা’র ম’ঙ্গ’লের’ জন্যই করে!”
জোছনা অনেক কিছু ভেবে ক্ষানিকটা সময় নিয়ে হঠাৎ বলে উঠলো,
“আপনি সবকিছু ব্যাবস্হা করুন আঙ্কেল।”
জোছনার সাথে তাল মিলিয়ে ফিরোজ মিয়া ও সায় দিলো। বিনিময়ে আফজাল মুচকি হেসে পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে এক সাইডে চলে গেলো। চাঁদনী এতক্ষণ নির্বাক ভঙ্গিতে একটা চেয়ারে বসে ছিলো। পাড়া-প্রতিবেশীরা তাকে ঘিরে ধরে একএকজন নানা’ন কথা বলছে। এরিমধ্য জোছনা এসে বিরক্তি হয়ে সবাইকে তাড়িয়ে দিলো। কেউ কেউ মুখ বাঁকিয়ে যাচ্ছে, কেউ কেউ এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। জোছনা সেদিকে পাওা না দিয়ে বারকয়েক দীর্ঘ নিঃশ্বাস টেনে বোনের কাঁধে হাত রেখে মৃদু কণ্ঠে ডাকলো,
“চাঁদ!”
চোখ তুলে তাকালো চাঁদনী। মলিন কন্ঠে বললো,
“আপা!”
“তোর আপা তোর ভালো’র জন্য একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছে চাঁদ। এদের থেকে তোর মুক্তি’র ব্যবস্হা করেছি। তোর কোনো আপওি নেই তো বোন?”
“আমার পৃথিবীতে তুমি একমাত্র ব্যক্তি আপা। যাকে আমি ভীষণ সম্মান ও ভরসা করি। তোমার সমস্ত সিদ্ধান্ত আমি বিনাবাক্যে মেনে নিয়েছি আজও তার ব্যতিক্রম হবে না আপা। আমি মুক্তি চাই আপা! আমার শ্বাস আঁটকে আছে আপা! এই জীবন থেকে মুক্ত হয়ে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে চাই।”
জোসনা মলিন হেসে বোনকে পরম আবেশে জড়িয়ে ধরলো।
.
.
তুমি সব জেনেশুনেও এমন একটা সিদ্ধান্ত কি করে নিলে আব্বু? সরি আব্বু! এ বিয়ে আমি করতে পারবো না! এটা সম্ভব না আব্বু। আমি মেয়েদের জাস্ট ঘৃ’ণা করি! ওরা ছ’ল’না’ম’য়ী! একবার বহুকষ্টে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছি আব্বু। আর কারো সাথে নিজেকে জড়াতে চাই না আমি।”
“দেখ বাপ সব মেয়ে এক না। ভুল মানুষের জন্য তুই কেনো তোর সুন্দর জীবনটা নষ্ট করবি? তাছাড়া আমি বাধ্য হয়ে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি ফাহাদ। আমার সম্মানটা রাখ বাপ।
“জোর করে কিছু হয় না আব্বু। এটা অসম্ভব!”
চাঁদনীদের বাড়ির সামনের আঁকাবাঁকা ইটের রাস্তার মাঝ খানে দাঁড়িয়ে বাপ-ছেলের মাঝে তুমুল কথা-কাঁ-টা হচ্ছে।
অনেকদিন পড়ে ছুটিতে বাড়িতে এসেছে ফাহাদ। বাড়ির পাশে মাঠের উপরে গোল হয়ে বসে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলো ফাহাদ। হঠাৎ বাবা ফোন দিয়ে জানিয়েছে, বিয়ে বাড়ি ঝামেলা হয়েছে খুব। সে যেন এক্ষণি এখানে আসে। এইটুকু বলেই ফোন কেটে গিয়েছে। তারপর অনেক ট্রাই করেও পাওয়া গেলো না বাবা’কে। ভীষণ চিন্তিতো হলো ফাহাদ। বাবা’র কিছু হলো না তো? বাবা’কে ভীষণ সম্মান ও ভালোবাসে ফাহাদ। তাইতো সবকিছু ছেড়ে ছুঁ’ড়ে দ্রুত চলে এসেছে বাবা’র দেওয়া ঠিকানায়। আর এসে কিনা বাবা জানালো তাকে বিয়ে করতে হবে। এটা কখনো সম্ভব না। এমনটা জানলে সে কি আর আসতো?
কোনো ভাবে ছেলে’কে রাজি করাতে পারছে না আফজাল। হুট করে উনি ছেলের হাত ধরে কাকুতি মিনতি করে বললো,
“ফাহাদ বাবা! আমি তোর কাছে কখনো কিছু চাইনি। আমি তোর কাছে হাতজোড় করে জীবনের প্রথম ও শেষ বারের মতো একটা জিনিস ভিক্ষা চাইছি। সন্তান হিসেবে আমারও অধিকার আছে তোর উপরে। তুই বিয়েটা কর বাবা। আমি ওদের কথা দিয়েছি। আমার ইজ্জতটা রাখ বাপ! প্লিজ বাপ আমার! দরকার হলে আমি তোর পা…..”
মুখের বাক্য শেষ করার আগেই ফাহাদ চেঁচিয়ে বললো,
“আব্বু! ছিঁ! এসব কি বলো? ঠিক আছে আমি তোমার কথা মেনে নিলাম। তবে কাজটা তুমি মোটেও ভালো করলে না।”
আফজাল আর দেরী করলো না ছেলেকে নিয়ে ভিতরে চলে গেলো। ক্রোধে শরীর কাঁপছে ফাহাদে’র। চোয়াল শক্ত তার, ফর্সা মুখটা লাল হয়ে গেছে। তবুও নিজেকে শান্ত রাখার আপ্রান চেষ্টা করছে। বাবা তাকে ইমোশনাল ব্লাকমেই শুরু করলো। চোখ মুখ শক্ত করে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলো। এ কোথায় আসছে সে? দো’চালা একটা জী’র্ণ’শী’র্ণ ভাঙা চূড়া ঘর। তার ভিতরে মানুষজন গিজগিজ করছে।
মেয়ে’টা কেমন? চেনা নেই, জানা নেই অথচ তার বিয়ে! বাবা’র সম্মান রক্ষার্থে তাকে ব’লি’দা’ন হতে হলো। তবুও একমাত্র বাবা’র জন্য গম্ভীর হয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইলো ফাহাদ।
.
.
আবারো পুনরায় বর এসেছে শুনে চাঁদনী’র বুকে ডিপ ডিপ করছে। জোছনা আপা তার হাত ধরে তার পাশেই বসে আছেন।
আপা যখন জানিয়েছে তার পুনরায় বিয়ে ঠিক হয়েছে। আপার কথা মেনে নিয়েছে সে। নিজের ভাগ্য’কেও মেনে নিয়েছে সে। যে করেই হোক তার মুক্তি চাই এই জীবন থেকে, এই মানুষগুলো থেকে!
ইতিমধ্যে বাড়ির মেয়ে – মহিলা’রা উঁকি-ঝুঁকি দিয়ে চাঁদনী’র বর দেখছে,বর দেখে কেউ কেউ হিংসায় জ্ব’লে উঠলো। এতো সুন্দর সুদর্শন পুরুষ চাঁদনী মতো মেয়ের বর হবে? এ যেন মানতেই পারছে না তারা। জোছনার মনেও কৌতূহল জাগ্রতো হলো তার চাঁদের বরটা কেমন হবে? সেও কাঠের বেড়ার ফাঁ’ক দিয়ে উঁকি দিলো সামনের ঘরটায়। পরক্ষণে দৃষ্টি’তে আঁটকে গেলো সামনে গম্ভীর হয়ে বসে থাকা লম্বা শক্ত-পোক্ত পুরুষটি’র দিকে। ছেলে’টার ভিতরে ছন্নছাড়া ভাব। গায়ের রং উজ্জল ফর্সা। চুলগুলো এলোমেলো, অনেকটা বড়ো বড়ো, লম্বাটে গালের খোঁচা খোঁচা চাপ দাঁড়ি গুলো অযত্নে বড়ো হয়ে আছে। তবুও বেশ সুদর্শন লাগছে তাকে। ফর্সা গায়ে কালো রঙের টি-শার্টটাও দারুণ মানিয়েছে।
মনে হচ্ছে এগুলো তার জন্যই পারফেক্ট। এগুলোর জন্যই তাকে বেশি সুন্দর লাগছে।
জোছনা হবুবোনে’র জামাইকে দেখে মৃদু কণ্ঠে বলে উঠলো,
“মাশাআল্লাহ! আমার বোন ছাড়া কারো নজর না পড়ুক।”
অতঃপর চাঁদনী’র কানে কানে ফিসফিস করে বললো,
“চাঁদ? এই চাঁদ! আমার চাঁদের জামাই’টা একদম চাঁদের মতো সুন্দর! তোদের দু’জনকে খুব সুন্দর মানাবেরে।”
আপার কথা শুনে খানিকটা লজ্জা পেলো চাঁদনী। লজ্জায়, অ’স্ব’স্তি’তে মাথাটা নিচু করে ফেললো সে। যা দেখে জোছনা হাসলো।
পরক্ষণেই আপা’র কথা শুনে মনের অজন্তেই লোকটাকে নিয়ে ভাবছে তার কিশোরী মন। আচ্ছা মানুষটা কেমন হবে? হঠাৎ করেই মানুষটাকে দেখা’র অদ্ভুত ইচ্ছে জাগলো তার ছোট্ট কিশোরী চঞ্চল হৃদয়ে। তবুও বক্ষ পিঞ্জরে দমিয়ে রাখলো এই তীব্র ইচ্ছেটি।
.
.
কিছুক্ষণের মধ্যেই বিয়ের কার্যক্রম শুরু হয়ে গিয়েছে। ফাহাদ’কে বারবার কাজী বলতেছে,
“বলো বাবা কবুল!”
কিন্তু ফাহাদ নিশ্চুপ। যা দেখে আফজাল হোসেন নড়েচড়ে কেশে উঠলো বারকয়েক। কিয়াৎক্ষণ পরে ফাহাদ বাবা’র দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে তিনবার বলে দিলো। বাবা-র মুখে দেখা গেলো স্নিগ্ধ হাসি’র রেখা। সবাই একসাথে বলে উঠলো,
“আলহামদুলিল্লাহ!”
বিয়ে শেষ হতেই সবাইকে উপেক্ষা করে,এমনকি সদ্য বিয়ে করা বউ’কে রেখে ফাহাদ বেরিয়ে পড়লো বাসা থেকে। কোথায় যাচ্ছে সে নিজে জানে না। রাগে ফুঁসছে সে। রাস্তার মাঝ দিয়ে এলোমেলো পায়ে হাঁটছে। ছেলের এমন আচরণে মন ক্ষু’ণ্ণ হলো আফজালে’র। পরিস্থিতি বেসামাল হওয়ার আগেই সবাইকে আশ্বাস দিয়ে বললো,
“কিছু মনে করবেন না আপনারা। হঠাৎ করেই সবকিছু তো বুঝতেই পারছেন, তাই একটু আরকি। তাছাড়া ওর একটা দরকারী কাজ আছে।”
একটু থেমে জোছনাকে তাড়া দিয়ে ব্যস্ত কণ্ঠে আবারো বললো,
” আমি আমার পএু বধু’কে আমার ঘরে এক্ষণই নিয়ে যেতে চাচ্ছি বউ মা। তুমি ব্যবস্হা করো।”
.
অতঃপর চাঁদনী’র বিদায়ে’র সময় হলো। তার সবার মতো ওতো কান্না করা’র মতো মানুষ নেই। তবুও চাঁদনী’র ভিতরটা তীব্র হা’হা’কা’র করছে, কিন্তু সে মোটেও কাঁদছে না। কাদের জন্য কাঁদবে সে? মোটেও কাঁদবে না!
জোছনা বোনের হাতটা আফজাল হোসেনে’র হাতে দিয়ে ভেজা কণ্ঠে বললো,
“আমার বোনটা’কে আমি আপনার হাতে তুলে দিলাম আঙ্কেল। ওকে দেখেশুনে রাখবেন। ওর সব থেকেও আপন বলতে কেউ নেই। প্লিজ! ওরে কষ্ট পেতে দিবেন না কখনো।”
“কান্না করো না মা। তোমার বোন আমার ঘরে আর একটা মেয়ে হয়েই থাকবে।”
আশ্বাস দিয়ে বললো আফজাল হোসেন। জোছনা এবার বোনের কপালে চুমু দিয়ে বললো,
“নিজের খেয়াল রাখিস চাঁদ। ভালো থাকিস তুই। যা এবার বোন। আর কখনো এই বাড়িতে না আসিস।”
কথা শেষ করে একবার চাচা’র নিকটে দৃষ্টি বুলালো জোছনা। লোকটা কিছুটা দূর থেকে নির্বাক ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে চাঁদনী’র মুখের দিকে। তবে কি সে কষ্ট পাচ্ছে? কে জানে। এরমধ্যে ফিরোজ মিয়া মেয়ের পাশে এসে হাত ধরে মৃদু কণ্ঠে বললো,
“আমারে তুই মাফ করে দিস চাঁদ! আমি নিরুপায় আছিলাম মা। তয় একটাই চাওয়া, তুই স্বামীর ঘরে সবাইরে লইয়া ভালো থাকিস। আল্লায় তোরে অনেক সুখ দিবে দেখিস।”
চাঁদনী চমকে তাকালো বাবা’র দিকে? এই লোকটা না-কি তার ভালোমন্দও চিন্তা করছে! তাচ্ছিল্য করে ক্ষীণ হাসলো চাঁদনী। বাবা’র প্রতি অভিমান জমতে জমতে আকাশ ছুঁই ছুঁই। কিন্তু বাবা কখনো তা বুঝলো না। সেও সবার মতো মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। অজান্তেই চোখ থেকে একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো মেয়েটার। পরমুহূর্তেই লোকচক্ষু’র আড়ালে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে ফেললো জলটুকু।
দূরে বিরক্তিকর ভঙ্গিতে চোখ মুখ কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছেন আফরোজা। স্বামী’র এমন আচরণে মুখ বাঁকিয়ে আরো কিছুটা দূরে চলে গেলো আফরোজা। বেজায় খুশী সে,আ’প’দ’বিপদ হয়েছে। চাঁদনী’র চোখ দু’টো বোন দু’টোকে খুঁজছে। মেয়ে দু’টোর জন্য গভীর মায়া তার। ছোট বেলা থেকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে সে। তিনবোনে’র মধ্যে ছিলো গলায় গলায় ভাব। এ নিয়েও কম বকা কিংবা মা’র খাননি আফরোজা’র হাতে।
অহনা-মোহনা দরজার সাথে চিপকে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। তার আপা চলে যাচ্ছে তাদের রেখে। চাঁদনী বোনদের নিকট এগিয়ে যেতেই দুই বোন হুমড়ি খেয়ে বোনের বুকে ঝা’পি’য়ে পড়ে কান্না’রত কণ্ঠে বললো,
“আপা! আপা! চাঁদ আপা! তুমি চলে যাচ্ছো?”
চাঁদনী বোনদের চোখের জলটুকু মুছে দিয়ে কপালে চুমু খেয়ে মলিন কন্ঠে বললো,
“কাঁদিস না পা’গ’লী’রা! যেতে’তো হবেই বোন। তোরা নিজেদের যত্ন নিস! ঠিকভাবে খাওয়া ধাওয়া, পড়াশোনা করবি ঠিক আছে? দু’জন মিলে মিশে থাকবি। ভালো থাকিস অহু-মহু!”
.
.
মিনিট খানিক পরে আফজাল হোসেন এগিয়ে এসে চাঁদনী’র হাত ধরে, আদুরে সুরে বলে উঠলো,
“দেরী হয়ে যাচ্ছে চাঁদনী। এবার চলো মা!”
অতঃপর নিজের ঘরটার দিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শ্বশুরে’র সাথে পা বাড়ালো নতুন পথে, নতুন জীবনে। শুরু হলো তার নতুন জীবনের সূচনা। কিন্তু এ জীবন কি তাকে আদৌও সুখ দিবে? উওর পেলো না চাঁদনী।
#চলবে……..
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ! ]