#তুমি_ছিলে_বলেই২
#পর্বঃ৯
#দিশা_মনি
স্নেহা বসে আছে একটি লেকের ধারে। তার মন মেজাজ আজ ভালো নেই। আজ ২২ মার্চ। এই তারিখটাকে সে ঘৃণা করে। কারণ আজকের দিনেই সে তার মাকে হারিয়ে ফেলেছিল। স্নেহা যখন বিষন্ন মনে বসে ছিল তখন হঠাৎ করে সোহাগ এসে তার পাশে বসে। সোহাগকে দেখে স্নেহা কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না। কিছুক্ষণ মৌনতা বজায় রেখে বলে,
‘দিশা কি এখনো তোমার সাথে আগের মতোই ব্যবহার করছে?’
সোহাগ আফসোস করে বলে,
‘ঐ মেয়ে পরিবর্তন হওয়ার নয়। চৌধুরী পরিবারের রক্ত ওর গায়ে বইছে তো। তবে তুমি চিন্তা করো না। আমি খুব শীঘ্রই ঐ মেয়েকে লাইনে আনব।’
‘আনতে পারলেই ভালো। আমার মনে হয়, আমি তোমার ঘাড়ে একটা ঝামেলা ঝুলিয়ে দিলাম।’
‘তুমি এমন ভেবো না স্নেহা। ঐ মেয়ে এটারই যোগ্য ছিল।’
‘আচ্ছা, বাদ দাও৷ তুমি আজ হঠাৎ এখানে এলে যে?’
‘বাড়িতে দিশার ঘ্যানঘ্যান শুনতে ভালো লাগছিল না। তাই চলে এলাম।’
‘ওহ।’
‘তোমার মন কি খারাপ স্নেহা?’
‘হুম।’
‘কারণটা জানতে পারি?’
‘আজকের দিনে আমি আমার খুব প্রিয় একজনকে হারিয়েছিলাম। আমার মাকে।’
‘শুনে খুব খারাপ লাগল। আচ্ছা, আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিবে?’
‘হ্যাঁ, বলো।’
‘চৌধুরী পরিবারের সাথে তোমার কিসের শত্রুতা?’
চৌধুরী পরিবারের নাম শুনতেই স্নেহার মাথায় রাগ চেপে গেল। সে নিজেকে শান্ত করে বলল,
‘এই চৌধুরী পরিবারের জন্যই আমার জীবনের সুখ শান্তি সব নষ্ট হয়েছে। ওরা আমার সব সুখ কেড়ে নিয়েছে। আমার মাকে আমি হারিয়েছি শুধু ঐ চৌধুরী পরিবারের জন্যই।’
সোহাগ উদগ্রীব হয়ে জানতে চায়,
‘কি করেছিল চৌধুরী পরিবার তোমার সাথে, আমাকে বলো।’
স্নেহা বলতে শুরু করে,
‘আমার মা শিউলি ছিলেন এক ছাপোষা বাঙালি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। ছোটবেলা থেকেই তিনি অনেক মেধাবী ছিলেন। তার আরও একটা গুণ ছিল। তিনি অনেক ভালো গান গাইতে পারতেন। আমার নানুজান নিম্নমধ্যবিত্ত হলেও তার নিজের মেয়েদেরকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। তাই তো উনি আমার মাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পাঠান। সেখানেই আমার মায়ের সাথে পরিচয় হয় আব্বাস চৌধুরীর। আলতাফ চৌধুরীর ছোট ভাই। আব্বাস চৌধুরী আমার মায়ের গান শুনে তার প্রেমে পড়ে যান। তিনি সবসময় আমার মায়ের পেছনে পড়ে যান। কিন্তু আমার মা তাকে বিশেষ পাত্তা দেয়নি প্রথমদিকে। তবে একসময় মাও তার পাগলামি দেখে আর মুখ ফিরিয়ে থাকতে চান নি। আব্বাস চৌধুরী একদিন আমার মাকে বলেন তিনি আমার মাকে বিয়ে করতে চান। মা প্রথমে রাজি হয়নি তখন তিনি নিজের মৃত্যুর হুমকি দিয়ে মাকে রাজি করান। ওনারা বিয়ে করে নেন। কিছুমাস সব ভালোই চলছিল। তারপর উনি নিজের পরিবারকে এই বিয়ের কথা জানালে আব্বাস চৌধুরীর বাবা আতিউর চৌধুরী আর ভাই আলতাফ চৌধুরী কিছুতেই এই বিয়ে মেনে নেন না। কারণ আমার মা একজন নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে ছিলেন। তারা তখন জোরপূর্বক আব্বাস চৌধুরীর সাথে অন্য কারো বিয়ে ঠিক করেন। আর তিনি ছিলেন রাহেলা চৌধুরী। আমার মা এই ব্যাপারটা জানতে পেরে রাহেলা চৌধুরীর কাছে যান। আমি তখন মায়ের পেটে ছিলাম। কিন্তু রাহেলা চৌধুরীর কাছে গিয়ে যখন আমার মা সব বলেন তখন রাহেলা চৌধুরী আমার মাকে বাজে ভাবে অপমান করে। আমার মাকে বে*শ্যা এমনকি আমাকে জারজ সন্তান বলেন। এছাড়া আরো অনেক অপমান করে তাড়িয়ে দেন। শেষপর্যন্ত মা চৌধুরী বাড়িতেও গিয়েছিল সন্তানের দাবি নিয়ে। কিন্তু চৌধুরীরা আমার মাকে অপমান করে তাড়িয়ে দেয়।’
সোহাগ ভাঙা গলায় বলে,
‘তারপর?’
‘তারপর আর কি? আব্বাস চৌধুরী আর রাহেলা চৌধুরী বিয়ে করে নেন। যেই আব্বাস চৌধুরী আমার মাকে এত ভালোবেসেছিলেন তিনি রাহেলা চৌধুরীর সাথে মানিয়ে নিয়ে সংসার করতে থাকেন। কিছুদিনের মধ্যে নিপুণ আসে তাদের ঘরে। তিনি তো সুখী হলেন কিন্তু আমার অভাগী মার কপালে সুখ বলে কিছু রইল না। আমাকে জন্ম দেওয়ার পর তার দুঃখ আরো বাড়ল। সবাই বলতে লাগল, আমি নাকি জারজ সন্তান। আমার নাকি পিতৃপরিচয় নেই। আমার নানুজান এই অপমান সইতে পারলেন না। আমার মা তখন নানুজানকে নিয়ে চৌধুরী বাড়িতে গেলেন। সেদিন নিপুণের আকিকার অনুষ্ঠান চলছিল। সেদিন ঐ রাহেলা চৌধুরী আমার মাকে সবার সামনে বে**, মা**- গী আরো অনেক কিছু বলেছেন। সবার সামনে আমার মাকে জু**-তার মালা পড়িয়ে দিয়েছেন। আমার নানুজান তার মেয়ের এত অপমান সহ্য করতে পারেন নি। সাথে পাড়া প্রতিবেশীর গঞ্জনা তো রয়েইছে। এত কিছু সইতে না পেরে তিনি আত্ম**হত্যা করেন। আমার মা এতে আরো ভেঙে পড়েন। কিন্তু তিনি দমে যান নি। পাড়ার লোকের মন্দ কথা থেকে বাঁচতে তিনি আমার খালা এবং ছোট্ট আমিকে নিয়ে ঢাকায় চলে যান। সেখানে গিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করতে থাকেন। এরপর সবকিছু ভালোই যাচ্ছিল কিন্তু আমার যখন দশ বছর বয়স তখন ঘটে যায় আমাদের জীবনের সবথেকে বড় অঘটন। আব্বাস চৌধুরী আসেন আমাদের বাড়িতে। তিনি আমাকে মায়ের কাছ থেকে নিয়ে গিয়ে নিজের পরিচয় দিতে চান কিন্তু মা রাজি হন নি। কিন্তু তিনি হাল ছাড়ার পাত্র নন, নিয়মিতই আমাদের বাসায় আসতেন। আমায় চকলেট, খেলনা আরো অনেক কিছু দিতেন। কিন্তু আমি মায়ের কথামতো সবকিছু ডাস্টবিনে ফেলে দিতাম। এসব কথা জানতে পেরে একদিন রাহেলা চৌধুরী আসেন আমাদের বাসায়। সেদিন তিনি সব সীমা অতিক্রম করেন। আমার সামনেই আমার মায়ের চু**লের মুঠি ধরে টানেন, তাকে অজস্র নোংরা ভাষায় গালি দেন। আমাকেও জা**রজ বলেন। আমার মা সেদিন তার পা ধরে অনুরোধ করেন যেন তার সন্তানের সামনে তাকে অপমান করা না হয় কিন্তু তিনি তা শোনেন নি। বরং আমার সামনে আমার মায়ের মুখে টাকা ছুড়ে বলেছেন এসব নিয়ে যেন উনি দূরে সরে আসেন। আমার মা এত অপমান সইতে না পেরে ওনার গালে সপাটে চ*ড় বসিয়ে দিয়ে বলেন, উনি রাহেলা চৌধুরীর থেকে কিছু কেড়ে নেন নি। বরং রাহেলা চৌধুরীই আমার মায়ের কাছ থেকে সব কেড়ে নিয়েছেন। রাহেলা চৌধুরী সেদিন খুব ক্ষেপে যায়। তিনি আমার মাকে হুমকি দিয়ে বলেন, তিনি এসবের শেষ দেখে ছাড়বেন। সেদিন রাত ছিল আমাদের জীবনের সবথেকে ভয়াবহ রাত। রাতে যখন আমরা ঘুমিয়েছিলাম তখন হঠাৎ পোড়া গন্ধে আমার ঘুম ভাঙে। খালামনি আর আমি এক ঘরে শুয়েছিলাম আর আম্মু ছিল অন্য ঘরে। আমাদের ঘুম ভাঙতেই আমরা দেখতে পাই চারিদিকে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। আমি আম্মু আম্মু করে চিৎকার করতে করতে আম্মুর ঘরে ছুটে গিয়ে দেখি আম্মু আগুনে দাউ দাউ করে পুড়ছে। খালামনি ছুটে যেতেই আম্মু শুধু এটা বলেন,❝ যা তোরা এখান থেকে। আমার মেয়েটাকে দেখে রাখিস শিউলি।’
আর আমাকে বলেন,❝ভালো থাকিস মা। আর কখনো কাউকে অন্ধবিশ্বাস করিস না।❞
কথা বলতে বলতে স্নেহার চোখ ভিজে যায়। সে নিজের চোখের জল মুছে বলে,
‘এভাবেই আজকের দিনে আমি নিজের মাকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলেছিলাম। তবে আমি নিশ্চিত এটা কোন সাধারণ ঘটনা ছিল না। কেউ বা কারা পরিকল্পনা করে আমার মাকে খু***ন করেছিল। আর সেটা চৌধুরী পরিবারেরই কেউ। সেদিন তাদের উদ্দ্যেশ্য ছিল আমাদের সবাইকে শেষ করে দেওয়া। যদিও আমার সন্দেহ রাহেলা চৌধুরীর দিকে, তবে আমি নিশ্চিত হয়ে কিছু বলতে পারছি না। সব সত্য বের করতে, নিজের মায়ের আসল খু-**নিকে খোঁজার জন্য আমায় চৌধুরী বাড়িতে যেতে হবে। সেখানেই আমি খুঁজে পাব আমার মায়ের খু**নিকে।’
সোহাগ জানতে চায়,
‘কিন্তু তুমি চৌধুরী বাড়িতে কিভাবে যাবে?’
স্নেহা বলে,
‘সেই মোতাবেক পরিকল্পনা করা আমার শেষ। এবার শুধু সেই অনুযায়ী কাজ করতে হবে। আমি খুব শীঘ্রই চৌধুরী বাড়িতে পা রাখব। তবে মেয়ে হয়ে না, বউ হয়ে।’
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨