#তুমি_ছিলে_বলেই২
#পর্বঃ৬
#দিশা_মনি
নিপুণ বিয়ের আসরে বসে পড়েছে৷ তার চোখে মুখে হাসির লেশমাত্র নেই। দুচোখে জমে আছে জলের ফোয়ারা৷ তারা অপেক্ষা করছে নদীর স্রোতের মতো বয়ে আসার জন্য। কিন্তু নিপুণ অনেক কষ্টে সেটাকে আটকে রেখেছে। অনুপম নিপুণকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে মনে মনে বলছে,
“ঐ দিশার থেকে এই নিপুণ বেশি সুন্দরী। সেদিক দিয়ে বলতে হয় ঐ মেয়েটা পালিয়ে গিয়ে ভালোই করেছে। এইজন্যই আমার আম্মু বলত, যা হয় ভালোর জন্যই হয়।”
আলতাফ চৌধুরী, রাহেলা চৌধুরী সবাই দাঁড়িয়ে আছেন পাশেই। আলতাফ চৌধুরী এবার অনেকটা স্বস্তি পান। তার মেয়ে তার মুখে চুনকালি মাখালেও তার ভাইয়ের মেয়ে এই যাত্রায় তাকে উদ্ধার করলো। অপরদিকে রাহেলা চৌধুরী শুধু নিজের মেয়ের জন্য প্রার্থনা করে চলেছেন। অন্যদিকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছেন খোদেজা চৌধুরী। এই বিয়েতে তিনি একটুও খু্শি নন। তার মেয়ে প্রেরণা রাজরানী করার স্বপ্ন তার স্বপ্নই রয়ে গেলো।
কাজি বিয়ে পড়ানো শুরু করে দিয়েছেন। এক সময় তিনি নিপুণের উদ্দ্যেশ্যে বলেন,
“বলো মা কবুল।”
নিপুণ দীর্ঘক্ষণ চুপ করে থাকে। অনুপম এতে বিরক্ত হয়। নিপুণের উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“এই মেয়ে তুমি চুপ করে আছ কেন? কবুল বলো।”
নিপুণ দুচোখ বন্ধ করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেয়। শেষবারের মতো দীপ্রর মুখটা মনে করে। তার দুচোখ বেয়ে নোনাজলের স্রোত নামে। আর হয়তো তার দীপ্রকে নিজের করে পাওয়া হবে না। ভালোবাসার মানুষটাকে হয়তো চিরকালের মতো হারিয়ে ফেলতে হবে।
সবার জোরাজুরিতে সে কবুল বলতেই যাবে এমন সময় হঠাৎ চেনা পরিচিত কন্ঠ তার কানে এসে বাজে। দীপ্র এসে বলতে থাকে,
“নিপুণ কবুল বলবে না, এই বিয়েটাও হবে না। এই নিপুণ তুই উঠে আয় বলছি।”
নিপুণ দুচোখ মেলে দীপ্রকেই দেখতে থাকে। তার মুখে এতক্ষণে হাসি ফুটে ওঠে। সে উঠে দাঁড়ায়। দৌড়ে চলে আসে দীপ্রর কাছে। অনুপমও সাথে সাথে উঠে বসে। রাগী গলায় বলে,
“এসব হচ্ছে টা কি? একবার নয় দু, দু বার আমার সাথে অন্যায় করা হচ্ছে। মিস্টার চৌধুরী আপনি কিছু বলুন।”
আলতাফ চৌধুরী বলেন,
“দীপ্র তুই কেন এই বিয়েতে বাধা দিচ্ছিস? এই বিয়েটার সাথে আমাদের কোম্পানির ভবিষ্যৎ জড়িয়ে আছে।”
দীপ্র কোন রাখঢাক না রেখেই বলে দেয়,
“দুঃখিত আব্বু। এই বিয়ে হতে পারে না। কারণ আমি নিপুণকে ভালোবাসি। তাই আমি বেঁচে থাকতে ওকে অন্য কারো হতে দিতে পারব না।”
দীপ্রর এই কথা যেন চৌধুরী ভিলার ভিত নড়িয়ে দেয়। আলতাফ চৌধুরী, রাহেলা চৌধুরী এমনকি নিপুণও হতবাক হয়ে যায় দীপ্রর কথা শুনে। উপস্থিত মেহমানরাও স্তম্ভিত। সবাই কানাঘুষা শুরু করে দেয় চৌধুরী বাড়িতে ঘটে যাওয়া একের পর এক ঘটনা নিয়ে। আলতাফ চৌধুরী দীপ্রকে উদ্দ্যেশ্য করে বলেন,
“এসব কি পাগলের মতো কথা বলছ তুমি দীপ্র? নিপুণ তোমার চাচাতো বোন হয়। ওকে তুমি সবসময় বোনের নজরেই তো দেখেছ তাহলে এখন হঠাৎ….”
“তুমি ভুল ভাবছ আব্বু। আমি কখনো নিপুণকে বোনের নজরে দেখিনি। আমি ছোটবেলা থেকেই ওকে পছন্দ করি।”
আলতাফ চৌধুরী আর কিছু বলার মতো খুঁজে পান না। এদিকে অনুপম রেগে গিয়ে একটা ফুলদানি ছু*ড়ে মে*রে বলে,
“এখানে এসব কি নাটক হচ্ছে? আমাকে বিয়ের জন্য ডেকে এনে বারবার এভাবে অপমান করা হচ্ছে। এর চড়া মাশুল কিন্তু আপনাদের সবাইকে গুনতে হবে।”
খোদেজা চৌধুরী যেন আরেকটা সুযোগ হাতের কাছে পেয়ে যায়। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে এগিয়ে এসে তিনি আলতাফ চৌধুরীকে বলেন,
“প্রেরণা কিন্তু এখনো রাজি আছে ভাইজান। তুমি যদি অনুমতি দাও তাহলে…”
আলতাফ চৌধুরী অনুপমের কাছে গিয়ে বলে,
“আমাদের বাড়ির আরো একজন মেয়ে আছে প্রেরণা। আমার বোনের মেয়ে। তুমি চাইলে ওকে বিয়ে করতে পারো।”
অনুপম রেগে গিয়ে বলে,
“আমাকে আপনার কি মনে হয়? আমি বানের জলে ভেসে এসেছি? যখন পারছেন যার সঙ্গে পারছেন আমাকে বিয়ে দিতে চাইছেন? প্রথমে আপনার মেয়ে, তারপর আপনার ভাইয়ের মেয়ে আর এখন আপনার বোনের মেয়ে! সিরিয়াসলি!”
এমন সময় অনুপমের বাবা এগিয়ে আসে। আলতাফ চৌধুরীর উদ্দ্যেশ্যে বলেন,
“আমার কোন আপত্তি নেই। আমি আপনার বোনের মেয়েকেই নিজের বৌমা করব।”
অনুপম রেগে গিয়ে তার বাবাকে বলে,
“এসব তুমি কি বলছ?”
অনুপমের বাবা তাকে একটু সাইডে টেনে নিয়ে গিয়ে বলেন,
“তুই বেশি কথা বলিস না অনুপম। তুই নিজেও খুব ভালো করে জানিস যে, এই ডিলটা চৌধুরীদের জন্য যতটা গুরুত্বপূর্ণ আমাদের জন্যেও ঠিক ততটা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চৌধুরীদের কোম্পানিতে ইনভেস্ট করলে আখেরে লাভটা আমাদেরই হবে। আর তুই এত ভাবছিস কেন? প্রেরণা মেয়েটাও তো খারাপ না। আমি দেখেছি ওকে বেশ সুন্দরী আর সহজ সরল মেয়ে। আমাদের জন্য এরকম মেয়েই তো দরকার।”
নিজের বাবার মুখে এমন কথা শুনে অনুপম আর কথা বাড়ায় না। সে আলতাফ চৌধুরীর সামনে গিয়ে বলে,
“আমি আপনার প্রস্তাব মেনে নিলাম। প্রেরণাকেই আমি বিয়ে করবো।”
খোদেজা চৌধুরীর চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। অবশেষে তার স্বপ্নই সত্যি হলো। তার মেয়ে এখন রাজরাণী হবে।
✨✨
দিশাকে নিয়ে নিজের বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়েছে সোহাগ। কলিং বেল বাজানোর কিছুক্ষণ পর সোহাগের মা এসে দরজা খুলে দেয়। সোহাগের পাশে একটা মেয়েকে কনের সাজে দেখে তিনি অবাক হয়ে বললেন,
“এই মেয়েটা কে সোহাগ?”
“ও আমার স্ত্রী। তোমার বৌমা।”
সোহাগের মা হতবাক হয়ে গেলেন। তার ছেলে যে হঠাৎ এভাবে বিয়ে করে নতুন বৌ নিয়ে বাড়িতে ফিরবে সেটা তার ধারণার বাইরে ছিল। সোহাগ তার মায়ের উদ্দ্যেশ্যে বলল,
“কি হলো চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলে কেন? যাও বরণডালা নিয়ে এসো। আমাদের বরণ করে ঘরে তুলবে না?”
সোহাগের মা সালমা বেগম তার বাবাকে ডাক দিলেন। সোহাগের বাবা রাজ্জাক মন্ডল এসে উপস্থিত হলেন। এসে বললেন,
“কি হলো সোহাগের মা? আমায় ডাকছিলে?”
“তোমার ছেলের কাণ্ড দেখে যাও! একটা মেয়েকে বিয়ে করে এনেছে।”
রাজ্জাক মন্ডল দিশাকে ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করে তাকে জিজ্ঞেস করেন,
“তোমার নাম কি মা?”
দিশা রুডলি উত্তর দেয়,
“দিশা চৌধুরী।”
রাজ্জাক মন্ডল নিজের স্ত্রীকে বলেন,
“যাও। গিয়ে বরণ ডালা নিয়ে এসো। বিয়ে যখন হয়েই গেছে এখন তো আর কিছু বলে লাভ নেই। আগে ওরা ঘরে আসুক তারপর ঠান্ডা মাথায় কথা বলা যাবে।”
সালমা বেগম বরণ ডালা এনে হাজির হোন। দিশাকে বরণ করতে যাবেন ঠিক তখনই দিশা বরণ ডাকা ছুড়ে ফেলে বলে,
“বরণ ডালা মাই ফুট। আমি মানি না এই বিয়ে। আপনাদের ছেলে আমার সাথে প্রতারণা করেছে। আপনাদের ফুল ফ্যামিলি প্রতারক। আপনাদের সবাইকে আমি জেলের ভাত খাওয়াবো।”
সোহাগ রেগে চিৎকার করে বলে,
“দিশা…”
তারপর দিশাকে ঠাস.. করে একটা চ*ড় বসিয়ে দেয়। দিশা নিজের গালে হাত দিয়ে রাগী চোখে সোহাগের দিকে তাকায়।
✨✨
টংয়ের দোকানের সামনে বসে পা দোলাচ্ছিল স্নেহা। একটা সিগারেট নিয়ে সেটা জ্বালিয়ে খাওয়া শুরু করেছে সবেমাত্র। আশেপাশে দু একজন তার দিকে অদ্ভুত নজর দেখছে। একেই তো পুরুষের মতো বেশভূষা তার উপর আবার সিগারেট খায়! ক’জন স্নেহাকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করল। এসবে অবশ্য স্নেহার কিছু যায় আসে না। সে কল লাগালো কাউকে। ফোনটা রিসিভ হতেই বললো,
“কোন ব্যবস্থা হলো?”
বিপরীত দিক থেকে উত্তর এলো,
“চৌধুরী এন্টারপ্রাইজে দীপ্র চৌধুরীর জন্য একজন নতুন পিএ দরকার। ওনার আগের পিএ জব থেকে রিজাইন করেছে।”
স্নেহা নিকোটিনের ধোঁলয়া উড়িয়ে জোরে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,
“মেক শিওর, এই জবটা যেন আমি পাই।”
তারপর কল কেটে আধপোড়া সি*গারেট টা ফেলে দিয়ে পায়ের তলায় পিষে বলে,
“আই উইল সি ইউ সুন মিস্টার দীপ্র চৌধুরী।”
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨