তুমি আমার ভালোবাসা পর্ব-১৫

0
1979

#তুমি_আমার_ভালোবাসা
#পর্ব_১৫
#লেখিকা_Munni_Akter_Priya
.
.
অফিসে গেলে এখন আর প্রিয়ার ততটা খারাপ লাগেনা। তার দুইটা কারণও অবশ্য রয়েছে। প্রথমত পৃথা আগামী মাস থেকেই অফিসে জয়েন করবে আর দ্বিতীয়ত আজকাল প্রিয়াও চুপিচাপি ফাহাদকে দেখে। কেন দেখে তা জানেনা প্রিয়া। প্রিয়া নিজেই নিজেকে বারবার সংযত করার চেষ্টা করে কিন্তু বেহায়া মন সেটাতে পাত্তা দেয়না।
মাত্রই গোসল সেরে ছাদে জামা-কাপড় রোদে দিতে যায় প্রিয়া। মৃদু মৃদু রোদ ভালোই লাগছিল। তাই নিচে না গিয়ে ছাদেই দাঁড়ায়। একা একা থাকলে মনটা খারাপ হয়ে যায়। এজন্য প্রিয়া সবসময়ই নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চায়। আজ ইচ্ছে হলো কিছু সময় একলা থাকা দরকার।একটাবার হয়তো অতীত থেকে ঘুরে আসা দরকার। তাহলেই হয়তো এই বেহায়া মন ফাহাদের দিক থেকে ঘুরে আসবে। চোখজোড়া বন্ধ করতেই পেছন থেকে প্রিয়ার খালাতো বোন আপু আপু বলে দৌঁড়ে কাছে আসে। প্রিয়ার আর অতীতের দরজায় কড়া নাড়া হলো না। হয়তো প্রকৃতি চাচ্ছেনা স্বল্প কষ্টও প্রিয়ার মনে দাগ কাটুক!
“কি হয়েছে?”
“আপু ঐ ভাইয়াটা এসেছে।”
“কোন ভাইয়া?”
“ঐযে ঐদিন এসেছিল। কি যেন নাম? ফ..ফা..”
“ফ ফা না ফাহাদ।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ। ঐ ভাইয়াটা এসেছে।”
“তো কি হয়েছে?”
“নানু তোমায় ডাকছে।”
“তোর নানুকে গিয়ে বল তার আদরের ফাহাদকে কোলে নিয়ে বসে থাকতে।”
“অত বড় ছেলেকে নানু কোলে নিবে কিভাবে?”
“এটা নিয়ে তোর এত মাথাব্যথা কেনো রে?”
“আমার তো মাথাব্যথা করছেনা আপু।”
“ঐ তুই যা তো।”
“আমি তোমাকে নিয়েই যাবো।”
“আমার সাথে তো তুই কখনো জেদ ধরিস না। এই সত্যি করে বলতো কি ঘুষ খেয়েছিস?”
“ঘুষ খাবো কেন? যারা ঘুষ খায় ওদের পেট তো অনেক বড় দেখেছি। আমার পেট কি বড়? দেখো আমার পেট কি স্লিম! একদম দীপিকার মত।”
“যা ভাগ! আসছে আমার দীপিকা।”
“ও আপু চলো না প্লিজ।”
“ঠিক আছে চল।”
নিচে নেমে প্রিয়া সোজা নিজের রুমে গেলো। ফাহাদ আর নানুর আড্ডাখানা এখন প্রিয়ার রুমটাকেই ঘিরে। পিচ্চিটা প্রিয়ার টেবিলের ওপর থেকে পাঁচ বক্স চকোলেট পেটের ওপর রেখে নিয়ে যাচ্ছে। প্রিয়া জিজ্ঞেস করলো,
“এত চকোলেট তুই কোথায় পেলি? আর আমার রুমে কেন?”
“তোমায় বলবো কেন?”
“কত্ত বড় সাহস! বেয়াদব।”
ফাহাদ হেসে বললো,
“শালিক পাখি চকোলেট কি আরো লাগবে?”
“নেক্সট টাইম দুই বক্স বাড়িয়ে দিলেই হবে।”
বলেই চকোলেটগুলো নিয়ে চলে গেলো। প্রিয়া আগামাথা কিছুই বুঝলো না। নানু বললো,
“এত পাখি থাকতে তুমি আমার নাতনীরে শালিক পাখি ডাকলা?”
“ওহ নানু! এজন্যই তো বলি তুমি বুড়ি হয়েছো বাতাসে। তোমার মনের বয়স তো এখনো ১২ বছরের বাচ্চার মত। কিচ্ছু বুঝোনা। শালিক পাখি বলেছি আদর করে। শালিকা থেকে শালিক পাখি বুঝছো?”
প্রিয়া দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“এসব আদিক্ষেতা বন্ধ করেন তো।”
“তোমার হিংসে হচ্ছে?”
“আমার হিংসে হবে কেন?”
“এইযে তোমার বোনকে আদর করে শালিক পাখি ডাকলাম বলে। আচ্ছা আজ থেকে তোমাকে আমি কৈতরী বলে ডাকবো কেমন?”
“এই এই একদম আজেবাজে নামে ডাকবেন না বলে দিলাম।”
“রাগ করেনা আমার কৈতরী।”
“ধ্যাত!”
“এত রাগ করো কেন? রাগ করলে তোমায় দারুণ লাগে জানো?”
“জানি।”
“কে বলেছে? আমি ছাড়া আর কার সাথে তুমি রাগ করো?”
“আপনাকে কেন বলবো?”
“আচ্ছা বলতে হবেনা। এখন রেডি হও।”
“কেন?”
“আমার মায়ের সাথে দেখা করতে নিয়ে যাবো তোমায়।”
“আপনার মায়ের সাথে আমি কেন দেখা করবো?”
“মাকে তোমার কথা বলেছি। মা তখনই তোমায় দেখতে চেয়েছিল।”
“তখন আর এখন কি? তখনও কোনো সম্পর্ক ছিলোনা আর এখনো নেই।”
“নেই তো কি? হতে কতক্ষণ?”
“হবেনা।”
“বেশ! কিন্তু মায়ের সাথে প্লিজ দেখা করো।”
“আমি পারবো না।”
“কেন?”
“আনইজি লাগে।”
“আমি পাশে থাকলে সবই ইজি লাগবে। তাছাড়া আমার মা এত্ত ভালো মানুষ যে তোমার মনেই হবেনা সে অপরিচিত।”
“না, আমি যাবো না।”
“প্লিজ!”
.
.
ফাহাদের রুমে বসে আছে প্রিয়া। একটা ছেলে মানুষের রুম এতটা সাজানো-গোছানো হতে পারে সেটা ফাহাদের রুম না দেখলে বুঝাই যাবেনা। একদমই ইচ্ছে ছিলনা এই বাসায় আসার। কিন্তু বাড়িতে সবার জোড়াজুড়িতে আসতে বাধ্য হয়েছে। ফাহাদের মা বাসায় নেই। মেয়েকে নিয়ে একটু বাহিরে গিয়েছে। একটু পরই এসে পড়বে। ফাহাদের বাবা অফিসে। প্রিয়া ড্রয়িংরুমেই বসে অপেক্ষা করতে চেয়েছিল কিন্তু ফাহাদ শোনেনি। টেনে নিজের রুমে নিয়ে এসেছে। পুরো বাড়ি ফাঁকা। শুধু দুইজন কাজের লোককে দেখলো কিন্তু তারা নিচে কাজে ব্যস্ত। এক রুমে ফাঁকা বাড়িতে ফাহাদের সাথে প্রিয়া। প্রিয়ার একটুও ভয় করছেনা। কেন জানি প্রিয়ার মন বলে এই ছেলেকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যায়। সত্যি বলতে মেয়েরা এমনই একজন জীবনসঙ্গী চায় সবসময়। ফাহাদ এতক্ষণ ওয়াশরুমে ছিল। চুলগুলোতে হালকা পানি দিয়েছে। হাত দিয়ে ঠিক করতে করতে ওয়াশরুম থেকে বের হয়। প্রিয়া এক পলক তাকিয়েই অন্যদিকে তাকায়। ফাহাদের প্রিয়ার সামনে এসে একই স্টাইলে হাত দিয়ে চু্ল ঠিক করতে করতে বললো,
“একা একা বসে থাকতে বোরিং লাগছে?”
প্রিয়া কিছু বললো না। ফাহাদের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো,
“আমার কথা শুনে নাকি তার বুকের বাম পাশে লাগে। আর এখন তার চুল ঠিক করার এই দৃশ্যটা যে আমার বুকের বাম পাশে লাগছে সেটা কি মিষ্টার আয়মান চৌধুরী ফাহাদ জানে!”
“কি হলো?”
“হাত দিয়ে চুল ঠিক করছেন কেন? বাসায় চিরুনি নেই?”
“আছে। কিন্তু আমার এভাবেই চুল ঠিক করতে ভালো লাগে।”
“একদম বাজে লাগে বিষয়টা।”
“সত্যিই?”
“হু।”
“তোমার কাছে বাজে লাগলে আর করবো না।”
“হু।”
“হু হু করছো কেন? মুখে কি হয়েছে?”
“কিছুনা।”
“আচ্ছা তোমার ভয় লাগছেনা?”
“কেন?”
“এইযে আমার সাথে একা রুমে আছো।”
“এখানে ভয় পাওয়ার কি হলো? আপনি বাঘ নাকি ভাল্লুক?”
“তা নয়। কিন্তু একা ঘরে একটা ছেলে একটা মেয়ের কাছে কিন্তু বাঘ, ভাল্লুকের চেয়েও কম ভয়ংকর নয়।”
“সেটা আপনার মনে হতে পারে। আমার নয়।”
“কেন? যদি কিছু করে ফেলি?”
“বিশ্বাস আছে।”
“কার ওপর?”
“এখানে আপনি ছাড়া আর কেউ আছে নাকি?”
“তার মানে তুমি আমায় বিশ্বাস করতে শুরু করেছো?”
“জানিনা।”
ফাহাদ আর কিছু বললো না। মিটমিট করে হাসছে। প্রিয়া বললো,
“হাসির কিছু হয়েছে?”
“নাহ্ তো।”
“তাহলে হাসছেন কেন?”
“একটা কথা ভেবে।”
“কি কথা?”
“তুমি কি জানো তুমি প্রেমে পড়েছো?”
“নাহ্ জানিনা। কারণ আমি তো প্রেমেই পড়িনি।”
“তুমি প্রেমে পড়েছো এবং সেটা নিজের অজান্তেই।”
“বাজে বকবেন না।”
“একদম সত্যি বলছি।”
“তাই? তা কার প্রেমে পড়লাম শুনি?”
ফাহাদ চোখ টিপ দিয়ে বললো,
“এই আয়মান চৌধুরী ফাহাদের।”
“আপনার বেশি বুঝার স্বভাবটা আর গেলো না।”
ফাহাদ হোহো করে হেসে দিলো। কিছুক্ষণ পরই ফাহাদের বাবা-মা আর বোন আসে। বোনটা টেনে পড়ে। ফাহাদের মা আর বোন তো প্রিয়ার ব্যাপারে সবই জানে। তাই প্রিয়াকে দেখে চিনতে একটুও কষ্ট হয়নি ওদের। ফাহাদের ছোট বোনের নাম ফুল। দেখতেও ফুলের মতই সুন্দর। টেনে পড়ে এবার। ফুল দৌঁড়ে এসে প্রিয়াকে জড়িয়ে ধরে।
“তুমি এসেছো! ভাইয়া তো ঠিকই বলেছে। তুমি একদম সাদা পরী। আর এই সাদা শাড়িটায় তোমায় দারুণ লাগছে।”
প্রিয়ার লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে। যাদের কখনো দেখেনি, চিনেনা তাদের কাছে এসব প্রসংশা সত্যিই লজ্জাজনক। লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছে প্রিয়া। ফাহাদের মা এগিয়ে এসে প্রিয়ার গালে হাত দিয়ে চুমু খেয়ে বললো,
“মাশআল্লাহ্।”
ফাহাদ চোখের ইশারায় সালাম করতে বললো। প্রিয়ার কি হলো কে জানে! ফাহাদের কথামত পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো। তিনি এবার প্রিয়ার হাত ধরে বললেন,
“আমার ছেলের পছন্দ আছে।”
প্রিয়া কিছু বলতে পারছেনা। শুধু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ফাহাদের মা বললো,
“ওকে তো কিছু খেতেও দিসনি তাইনা?”
ফাহাদ মাথা চুলকালো।
“ইয়ে….”
“হয়েছে বুঝছি। ফুল তুই ওকে নিয়ে একটু গল্প কর। আমি খাবারের ব্যবস্থা করছি।”
“ওকে মম।”
ফুল প্রিয়াকে নিয়ে বিছানায় বসতে বসতে বললো,
“আচ্ছা ভাবী তোমার প্রিয় খাবার কি?”
“তুমি আমায় ভাবী ডাকছো কেন?”
“ভাইয়ের বউকে তো ভাবীই ডাকে তুমি জানো না?”
“আমি তো তোমার ভাইয়ের বউ নই।”
“এখন নও কিন্তু হয়ে যাবে।”
ফাহাদ ফুলের কোলে মাথা রেখে বললো,
“তোর ভাবী আমার বউ হতে ভয় পায় বুঝলি?”
“বুঝাবুঝি পরে। আগে তুমি ভাবীর কোলে মাথা রাখো। বউ আছে তাও খালি আমার কোলে মাথা রাখবে।”
“বাবারে! তুই তোর ভাবীকে এখনো চিনিসইনা। আমাকে ধাক্কা দিয়েই ফেলে দিবে।”
দুই-ভাই বোনের কথোপকথন চুপচাপ গিলে যাচ্ছে প্রিয়া। আনইজি লাগছে খুব আবার ভালোও লাগছে ভাই-বোনের খুনসুটি।

পাশের রুমেই ফাহাদের বাবা ফাহাদের মাকে জিজ্ঞেস করলো,
“মেয়েটা কে?”
“তুমি জানোনা?”
“নাহ্ তো।”
“ফাহাদ তোমায় বলেনি?”
“এমন কিছু কি যেটা বলতে হবে আমায়?”
“তার চেয়েও বেশি কিছু।”
“কি সেটা?”
“মেয়েটাকে ফাহাদ অনেক ভালোবাসে।”
“কিহ্?”
“হ্যাঁ।”
“কবে থেকে?”
“এক বছরের কাছাকাছি তো হবেই।”
“মেয়েটাও ভালোবাসে।”
“জানিনা শিওর। তবে ভালো না বেসে আর যাবে কোথায়!”
“নাম কি? কোথায় থাকে, কি করে?”
“নাম প্রিয়া। পড়াশোনা+জব করে।”
“কোথায় জব করে?”
“ফাহাদের অফিসেই।”
এবার ফাহাদের বাবা একটু উত্তেজিত হয়ে বললেন,
“হোয়াট? অফিসের সাধারণ একজন ওয়ার্কারকে ভালোবাসে ফাহাদ? ওর মাথা কি ঠিক আছে?”
“ওয়ার্কার তাতে কি হয়েছে?”
“স্ট্যাটাস বলে একটা কথা আছে সেটা কি ভুলে যাচ্ছো?”
“ভালোবাসার কাছে আবার স্ট্যাটাস কিসের?”
“ছেলের মত তুমিও পাগল হইয়ো না। সময় থাকতে ফাহাদকে বুঝাইয়ো এসব ভালোবাসার ভূত যেন মাথা থেকে নামায় বলে দিলাম। আর যদি ভালোবাসতেই হয় তবে এমন কাউকে ভালোবাসতে বলিয়ো যাতে তাকে বাড়ির বউ করতে গিয়ে আমাদের সোসাইটিতে কোনো কথা শুনতে না হয়।”

ফাহাদ আর ফুল খুনসুটিতে মেতে থাকলেও পাশের রুম থেকে কথাগুলো ভেসে প্রিয়ার কানে ঠিকই আসে। না চাইতেও চোখগুলো ঝাপসা হয়ে আসে…..

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে