তুমি আমার প্রিয়তমা পর্ব-১০

0
1350

#তুমি_আমার_প্রিয়তমা
#লেখিকা_Amaya_Nafshiyat
#পর্ব_১০

সৌরভ একটা চেয়ার টেনে চুপচাপ বসে আছে।এখনো সে ঘোরের মধ্যে রয়েছে।একটু আগের ঘটনাটা তার মনে এক অন্যরকম প্রভাব ফেলেছে।জীবনের প্রথম কোনো নারী তাকে এত ক্লোজ ভাবে স্পর্শ করেছে।ভাবতেই তার মাথাটা আউলিয়ে যাচ্ছে।

প্রিয়তা প্রফুল্লচিত্তে এর সাথে ওর সাথে ফটো তুলছে।যেন একটু আগে কিছুই হয় নি।প্রিয়তাকে আগের তুলনায় এখন অনেক বেশিই হাসিখুশি দেখাচ্ছে।সলজ্জ দৃষ্টিতে সৌরভের দিকে তাকাচ্ছে মাঝেমধ্যে যেন সে নতুন বউ।জেসিয়া গোমড়া মুখে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে।লুক লাইক সর্বহারা।

জেসিয়া সৌরভের পাশে গিয়ে বসলো।সৌরভ যেন দেখেও দেখে নি এমন একটা ভাব ধরে বসে আছে।আচমকা জেসিয়ার করা প্রশ্ন শুনে একটু অবাক হলো সৌরভ।

জেসিয়া:-কিছুক্ষণ আগে ওই কর্নারে যে মেয়েটি আপনাকে জড়িয়ে ধরেছিলো সে কে হয়?

সৌরভ বুঝতে পারলো যে আগে যার পদধ্বনি শুনতে পেয়েছিলো সে জেসিয়া ছিলো।সৌরভ খানিক চুপ থেকে জবাব দিলো;

সৌরভ:-গার্লফ্রেন্ড সাথে হবুবউও।

জেসিয়া উত্তরটা শুনে হতাশ হয়ে গেছে পুরোপুরি।সে সত্যিই সৌরভকে অনেক পছন্দ করতো।ইচ্ছা ছিলো আজকে সৌরভের ফোন নাম্বার চেয়ে নিয়ে তার সাথে রেগুলার কন্টাক্ট করার।যাতে সৌরভও তার প্রতি উইক হয়ে যায়।কিন্তু তার আশায় একবালতি পানি ঢেলে দিলো প্রিয়তা।

জেসিয়া:-ওহহ,আগে কখনো বলেন নি তো যে আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে!

সৌরভ কাটখোট্টা জবাব দিয়ে দিলো;

সৌরভ:-গার্লফ্রেন্ড কোনো শো অফ করার বস্তু নয় যে জনে জনে সবাইকে বলে বেড়াবো।আমি তা পছন্দ করি না।

জেসিয়া কিছুক্ষণ নিরব ভূমিকা পালন করলো।সৌরভের কথা শুনে তার ইগো হার্ট হয়েছে।সৌজন্যতার খাতিরে বললো;

জেসিয়া:-প্রে করি আপনারা দুজন অলওয়েজ হাসিখুশি থাকুন।আপনাদেরকে দেখলেই মনে হয় মেইড ফর ইচ আদার।

সৌরভ:-থ্যাংকস।খুব জলদিই বিয়ে করে ফেলবো।অগ্রিম দাওয়াত রইলো।বিয়েতে আসবেন।

জেসিয়া:-আচ্ছা আসবো।

এই বলে জেসিয়া বসা থেকে ওঠে অন্য দিকে চলে গেল।সৌরভ প্রিয়তাকে লক্ষ্য করছে।মেয়েটার কী সাহস বাপরে!একটু আগে কী কান্ডটাই না করলো।সৌরভ ছেলে হয়েও জীবনে এমন কিছু করতে পারবে না।

আবির আর সারার শরীয়ত মোতাবেক ও রেজিস্ট্রি করে বিয়ে সম্পন্ন হলো।অতঃপর দুজন মালাবদল করলো।মালা বদল করতে গিয়ে প্রচুর দুষ্টামি করেছে ওরা।তারপর দুজনের আবারও রোমান্টিক পোজে ফটো তোলা হলো।

সন্ধ্যার একটু পর বিয়ের সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলো।এখন কনে নিয়ে বাসায় চলে যাওয়ার পালা।শুরু হলো কান্নাকাটির পর্ব।সারা তার মাকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কান্না করছে।সারার বাবা কান্না আটকে রেখেছেন কোনোমতে।মেয়েটা ওনার বড়ই আদরের।আজ মেয়েটা শ্বশুর বাড়ি চলে যাবে তাদেরকে ছেড়ে।বিষয়টা যত সহজ মনে হচ্ছে আসলে তা তত সহজ নয়,বরং খুবই হৃদয় বিদারক।একটা মেয়েই শুধু বুঝতে পারবে নিজের পরিবার ছেড়ে অন্য কোনো নতুন পরিবারে যাওয়ার কষ্ট।

মিসেস মিনা ও মিসেস শিলা সারার বাবা মাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন।সারাকে তানিয়া আর প্রিয়তা ধরে ধরে কারে বসালো।সে কান্না করতে করতে কাহিল হয়ে গেছে।আবির সারার বাবা মাকে তাদের মেয়েকে আগলে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গাড়িতে সারার পাশে ওঠে বসলো।সারার সাথে জারাও যাচ্ছে আজ।জারা,ডলি আর তানিয়াদের সাথে অন্য গাড়িতে বসেছে।

সন্ধ্যা যত ঘনিয়ে আসছে,ঠান্ডার প্রকোপও ততোই বাড়ছে।প্রিয়তা ফুলহাতা ব্লাউজ পড়লেও তার ঠান্ডা লাগছে।মুসকান আসার সময় তার জন্য একটা চাদর নিয়ে এসেছিলো।সেটা ভালো করে প্রিয়তার গায়ের ওপর জড়িয়ে দিলো।সবাই বাসায় যাওয়ার জন্য রওনা দিয়েছে।দূরাত্মীয়রা যে যার বাসায় চলে গেছেন।নিকটাত্মীয়রা সৌরভদের বাসার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন।সৌরভ সে তার বাইকে করে রওনা হয়েছে।

আবির সারাকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিলো।সারার কান্না কিছুটা থামলো আবিরের উষ্ণ আলিঙ্গনে।

বাসায় পৌঁছে গেলো সবাই।আবির সারার হাত ধরে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো।প্রিয়তা আগেই ঢুকে গেছে বাসায়।কীসব নিয়ম নীতি পালন করলেন বাড়ির বয়স্করা।সৌরভের কাছে তা আজাইরা কাজ বলে মনে হলো।

প্রিয়তা শাড়ি পাল্টে একটা ড্রেস পড়ে নিচে এসেছে।সৌরভ নিচে একটা সোফায় বসে কয়েকজন ছেলের সাথে কথা বলছে।জুই আর তানিয়া মিলে সবার জন্য চা নাস্তা তৈরি করছে রান্নাঘরে।প্রিয়তা ভাবীদের সাথে সব তদারকি করছে।ডলি আর জারা সারার কাছে বসে আছে।

একটু পর সারাকে আবিরের রুমে নিয়ে গিয়ে রেখে আসলো সব মেয়েরা।প্রিয়তা সারাকে চেঞ্জ করতে সাহায্য করলো।সাথে তো অফুরন্ত গল্প গুজব চলছেই।

সৌরভ নিজের রুমে প্রবেশ করে ওয়ারড্রব থেকে কাপড় চোপড় বের করে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল ফ্রেশ হতে।পরণের শার্ট আর ব্লেজার খুলে বালতিতে রাখলো।উদোম গায়ে ওয়াশরুমের আয়নায় যেই না তাকালো ঠিক তখনই তার নজর গেল গলার কোণে লাল দাগগুলোর পানে।বুঝতে পারলো এই খরগোশের দাঁতের কামড়গুলো প্রিয়তার দেয়া।ফার্স্ট টাইম কারও দেয়া লাভবাইট গুলো জ্বলজ্বল করে তার অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে।

সৌরভ দাগগুলোর ওপর আঙ্গুল বোলালো আলতো ভাবে।প্রিয়তার পাগলামির কথা মনে পড়তেই আনমনে হেসে ফেললো।আর বেশি দেরি করা ঠিক হবে না।আজকেই জানাতে হবে আম্মুকে,ভাবলো সৌরভ।নয়তো প্রিয়তা আবার কোন অঘটন ঘটাবে বলা যায় না!সৌরভও যেন প্রিয়তা কাছে এলে সম্মোহিত হয়ে যায়,কোনো হুঁশ থাকে না।

🖤

প্রিয়তা বেশ কিছুক্ষণ জারার সাথে গল্প করলো।সৌরভের সাথে আজকে কী করেছে তা কাউকে জানালো না।এমনকি নিজের বেস্ট ফ্রেন্ড মিশিকেও না।মিশি তো ফোলা মেরে বসে আছে।কথা বলে না প্রিয়তার সাথে।বিয়ে বাড়িতে গিয়ে প্রিয়তা নাকি তাকে ভুলে গেছে।

আজকে বাসায় মেহমান প্রচুর তাই প্রিয়তা,জারা,তানিয়া,ডলি,জুই,পান্না ওরা সবাই একসাথে একরুমে থাকবে।বিছানা যথেষ্ট বড় আছে তাদের হয়ে যাবে অনায়াসে।ডলি তাদের স্টোর রুমের আলমারি থেকে এক্সট্রা লেপ কম্বল ও বালিশ নিয়ে এসে যাদের দরকার তাদেরকে দিলো।রিসিপশন পরে সব মেহমান চলে যাবেন তাই এই এক-দুইদিন একটু কষ্ট করতে হবে আরকি।

সৌরভের রুমে তূর্য আর মুসকান থাকবে।সৌরভ একটা হুডি পড়ে বিছানায় শুয়েছে।এমনিতেও শীতকাল,সাথে কেউ যাতে ঘুনাক্ষরেও কামড়ের দাগগুলো দেখতে না পায় তাই এই সুব্যবস্থা।

রাতের খাবার রাত বারোটাতে সেরেছে ওরা।তারপর যে যার রুমে চলে গেছে ঘুমাতে।সারাদিনে প্রচুর ধকল গেছে।এখন না ঘুমালেই নয়।

সৌরভ প্রিয়তার কথা না চাইতেও ভাবতে ভাবতে পাগল হয়ে যাচ্ছে।মেয়েটা তার রাতের ঘুম খুব ভালো করেই কেঁড়ে নিয়েছে।এখন ঘুমের ছিটেফোঁটাও চোখের পাতায় ধরা দিচ্ছে না।উফফ,অসহ্য একটা অনুভূতি!

প্রিয়তা বিছানায় শুয়ে মনে মনে আজকের ঘটনা স্মরণ করে লজ্জায় গুটিয়ে গেল।যখন কান্ড ঘটিয়েছে তখন লজ্জা করে নি,অথচ এখন লজ্জায় বিছানার সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে।না জানি সৌরভ তাকে কী ভেবেছে!ফালতু মেয়ে না ভাবলেই হলো!এসব আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতেই রাত পার করলো সে।

🖤

আজ প্রিয়তার কী হলো কে জানে!খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠে অনেকদিন পর ফজরের নামাজ আদায় করলো।নামাজ সে মাঝেমধ্যে পড়ে ঠিকই।তবে তেমন একটা টান নেই বললেই চলে।এজন্য মায়ের কাছ থেকে অনেক বকা খেয়েছে।প্রিয়তা প্রায় সবসময়ই নিজের মর্জি মতো চলতে চাইতো।কিন্তু মুসকানের কারণে তা হয়ে উঠতো না।মুসকান বাসায় থাকলে নামাজ কালাম সব করতো।বাসায় না থাকলে তাকে আর পায় কে?মিসেস প্রমি চিৎকার চেঁচামেচি করে অহেতুক গলা ব্যথা করতেন কিন্তু সে ওনার কথায় থোড়াই কেয়ার করে।দুনিয়াবি কাজকর্মে এতটাই মত্ত ছিলো যে নামাজের প্রতি তার অনীহা চলে আসে।

কিন্তু গত রাতে প্রিয়তা একদম সূক্ষ্মভাবে গভীর থেকে গভীরে গিয়ে চিন্তা করে দেখলো যে এখন যদি সে মারা যায় তবে আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে জবাব দেয়ার মতো তার কোনো আমল নেই।কথায় আছে না রাতের গভীর নিরবতায় মনে মৃত্যু ভয় হানা দেয়,প্রিয়তার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে।সৌরভ তো সত্যি কথাই বলে।দুনিয়ার সুখ তো ক্ষণস্থায়ী,পরকালের শান্তিই হচ্ছে আসল শান্তি।এবং পরকালের শান্তি লাভের জন্য নামাজ রোযা ও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সকল কাজ করতে হবে।প্রিয়তা মনে মনে ঠিক করে,এখন থেকে সে যথাসময়ে ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করবে।অন্যের সন্তুষ্টির জন্য নয়,স্বয়ং মহান আল্লাহ তায়া’লার সন্তুষ্টির জন্য।

ফজরের নামাজ আদায় করে আল্লাহর কাছে যাবতীয় সকল গোনাহর মাফ চাইলো,সাথে সৌরভকে নিজের লাইফ পার্টনার হিসেবে মনেপ্রাণে চাইলো।দেয়ার মালিক তিনি,তিনি যদি উদার হস্তে দান করেন,তবে কেউ তা আটকাতে পারবে না।

সৌরভ সবসময় বাসার সবাইকে নামাজ পড়তে উৎসাহিত করে।সাথে দলিলসমেত হাদিস শোনায়।কেউ তার কথা না শুনলেও সে দায়ী নয় কারণ তার দায়িত্ব ছিলো উপদেশ দেয়া এবং সে তাই দিয়েছে।আসার পর থেকে ডলি,তানিয়া সাথে প্রিয়তাকেও নামাজ পড়ার জন্য তাগিদ দিয়েছে কিন্তু ওরা পড়ছি পড়বো বলে আর পড়ে নি।প্রিয়তা তাও হয়তো পড়তো না কিন্তু মালাকুল মউতের আগমনের ভয়ে সঠিক রাস্তায় ফিরে আসছে।রাতের আঁধারে ও নিরব নিস্তব্ধতায় যখন মৃত্যুর ভয় মনে হানা দেয় তখন কিন্তু যে কারোই কলিজা কেঁপে ওঠতে বাধ্য।

🖤

সবাই সকালের নাশতা করছে ডাইনিং টেবিল ও ড্রয়িং রুম জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে।আজকের সকালের নাশতা হলো মুরগির তেহারি,গরুর মাংসের কষা ভুনা,রুটি-পরোটা,ডাল,ভাজি,মুরগির তরকারি,হরেক রকমের পিঠাপুলি।সাথে চা কফি ও জুস।যার যা খেতে ভালো লাগছে সে তাই নিয়ে খাচ্ছে।মাছের বাজারে যেমন শোরগোল থাকে,সৌরভদের বাসাটাও সেরকম পরিবেশে পরিণত হয়েছে বলা যায়।সবাই একসাথে কথা বলছে,একসাথে হাসাহাসি করছে,এ যেন এক অদ্ভুত গুঞ্জন।

সৌরভ হাসিমুখে সবার সাথে নাশতা করছে।প্রিয়তা মিসেস মিনার কথায় সৌরভকে মগে করে কফি ঢেলে দিলো।কফির মগ হাতে নেয়ার সময় সৌরভ শান্ত দৃষ্টিতে প্রিয়তার দিকে তাকালো।সৌরভের চাহনিতে প্রিয়তার মেরুদণ্ড বেয়ে ঠান্ডা পানির স্রোত বয়ে গেল যেন।কেমন একটা নাম না জানা শিরশিরে অনুভূতি।যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।

সারা সকালে ঘুম থেকে ওঠে এই কনকনে ঠান্ডায় গোসল করে নতুন একটা জামদানী শাড়ি পড়েছে।আবিরও গোসল করে ভালো মতন ফ্রেশ হয়ে বউকে সাথে নিয়ে নিচে নেমে এসেছে নাশতা করতে।পাড়া প্রতিবেশী মহিলারা বিয়েতেও উপস্থিত ছিলেন ঠিকই,তাও সকাল সকাল নতুন বউ দেখতে এসেছেন।তবে প্রতিবেশীদের সাধারণত যেরকম খোঁচা খোঁচির স্বভাব থাকে উনাদের মধ্যে তা নেই।দেখেই বোঝা যায় সম্ভ্রান্ত পরিবারের মহিলা ওনারা।সারাকে গিফট দিতে দিতে বোঝাই করে ফেললেন সবাই।সারাও সবার সাথে খুবই মার্জিত ভাবে কথা বলেছে।

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে