#ধারাবাহিক গল্প
#তুমি আমার প্রণয়িনী
পর্ব-তিন
মাহবুবা বিথী
বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে ওর ছোটো মামা এসেছিলো। জোবায়দার মেডিকেলে চান্স পাওয়ার কথা শুনে ওর মাকে বললো,
—-মেয়েকে অতদূরে পাঠাসনে আপু। কি হবে ডাক্তারী পড়ে? কত এমবিবিএস ডাক্তার ডিসপেন্সারী গুলোতে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকে। কোনো রোগী তো ওদের কাছে আসে না। এর থেকে ঢাকা ভার্সিটিতে ভালো করে ভর্তি পরীক্ষা দিতে বল। এখানে চান্স হয়ে গেলে ঢাকার বাইরে গিয়ে পড়াশোনা করার কি দরকার?
জোবায়দার সেদিন ওর মামার উপর খুব রাগ হয়েছিলো। কত কষ্ট করে দিনরাত এককরে পড়াশোনা করে ও সরকারী মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। কোথায় আরো এপ্রিসিয়েট করবে। অথচ সেটা না করে সমানে নেগেটিভ কথা বলে যাচ্ছে। আর ওর ফুফু তো আরএক কাঠি উপরে। ওর বাবাকে দেখতে এসে জোবায়দাকে দু,কথা শুনিয়ে গেল। বলে কিনা ওর বাপের রক্ত পানি করা পয়সা ও নাকি পানিতে ফেলেছে। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ একটা কলেজ হলো নাকি? ঢাকা মেডিকেলে তো চান্স পেলো না। সুতরাং ডাক্তারী পড়ে কোনো লাভ নেই। অন্য মেডিকেলে পড়াশোনা করলে নাকি ডাক্তার না কসাই হয়ে বের হতে হবে। একমাত্র ঢাকা মেডিকেলেই নাকি ডাক্তার হওয়ার জন্য ভালো পড়াশোনা হয়।
এছাড়াও ওর মাকে উপযাচক হয়ে ওর ফুফু বললো,
—-শোনো ভাবি,একটা কথা বলি। তুমি আবার অন্য কিছু ভেবে বসো না। জোবায়দা দেখতে বেশ সুন্দর। বয়সও কম আছে। তুমি বরং একটা ভালো অবস্থাপন্ন ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দাও। এতে তোমার মেয়েরও একটা গতি হবে আর তোমার সংসারটার দেখভালও ঐ ছেলে করবে। যদি বলতো আমার হাতে একটা ছেলে আছে। ওদের তিনটে চালের আড়ত আছে। সাভার বাজারে দুটো বড় দোকান আছে। ইটের একটা ভাটা আছে। তোমার মেয়ে সারাজীবন বসে খেলেও ঐ সম্পদ ফুরোবে না। কি হবে বলো ডাক্তার ইন্জিনিয়ার হয়ে? জন্মেছে তো মেয়েমানুষ হয়ে। সেইতো দিনশেষে হাড়ি ঠেলতে হবে।
যদিও ওর মা একটু দোটানায় ছিলো। কিন্তু জোবায়দা ওর মাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে। ও এখন বিয়ে শাদি করবে না।
বিপদে পড়লে আত্মীয়স্বজনের চেহারাটা ভালো করে চেনা যায়। অথচ ওর বাবার একটাই বোন। সুস্থ থাকা অবস্থায় আলতাফ সাহেব বোনকে সবসময় চোখে হারাতো। ফলের সিজনে ঝুড়ি ভর্তি করে ফল বেনের বাড়িতে পাঠাতো। ঈদের সময় নতুন কাপড় পাঠিয়ে দিতো। কুরবানী ঈদে মাংস পাঠিয়ে দিতো। জোবায়দার ফুফুর শ্বশুরবাড়ির অবস্থাও বেশ ভালো। সাভার বাজারে ওদের দুটো সোনার দোকান আছে। তারপরও বোনের মুখটা উঁচু রাখার জন্য আলতাফ সাহেব নিজের দায়িত্বটুকু সুচারুরুপে পালন করতো। অথচ ওর বাবার এতোবড় একটা চিকিৎসার ধাক্কা গেল সেখানে দুপয়সা দিয়ে ওর ফুফু একটু সাহায্য করলো না।
অনেক রাত হলো। বেশ গুমোট গরম পড়েছে। ও উঠতে যাবে এমন সময় মনে হলো কেউ ওর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। এযে হিমেল ছাড়া কেউ নয় তা জোবায়দা ভালোই বুঝতে পারছে। হিমেল যে পারফিউম ব্যবহার করে সেই সুবাসটা জোবায়দার ভালোই পরিচিত। কিন্তু ও যতটুকু জানে হিমেলের তো আজ হলে থাকার কথা। কারণ ওর তো পরীক্ষা চলছে। কিন্তু জোবায়দার পিছন ঘুরে দেখার সাহস হলো না। ও দ্রুত ছাদ থেকে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতেই হিমেল বলে উঠলো,
—-একটু দাঁড়া,তোর সাথে কথা আছে।
—-আমার সাথে তো আপনার কোনো কথা থাকতে পারে না।
—–কেন এমন অবুঝের মতো আচরণ করছিস?
আসলে এছাড়া যে জোবায়দার আর কোনো রাস্তা খোলা নাই। ওর কাঁধে যে অনেক দায়িত্ব। ও কিভাবে এই দায়িত্বকে অস্বীকার করে শুধু নিজের সুখের কথা ভাববে? মাঝে মাঝে মানুষের হাতে কিছু করার থাকে না। তখন সময়ের উপর সব ছেড়ে দিতে হয়। যদিও হিমেলের কাছ থেকে সরে যেতে জেবায়দার বুকটা ব্যথায় টনটন করছে। অন্ধকারে ওর দুচোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরছে। কোনোরকমে নিজের গলার স্বরটা পরিস্কার করে বললো,
—-আমাকে আপনি যত তাড়াতাড়ি ভুলে যাবেন ততই আমাদের দু’জনের জন্য মঙ্গল হবে।
—তুই কি পারবি আমাকে ভুলে যেতে? আর বারবার আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে তুই খুব আনন্দ উপভোগ করিস তাই না? আর আমিও বোকার মতো মরীচিকার পিছনে ছুটে চলেছি।
জোবায়দাকে নিরব দেখে হিমেল আবারও বলে উঠে,
—–আমার প্রশ্নের উত্তর কিন্তু এখনও পাইনি।
—-এই প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। আম্মু ডাকছে। আমাকে যেতে হবে।
জোবায়দা হিমেলকে আর কথা বাড়ানোর সুযোগ না দিয়ে দ্রুত নীচে চলে গেল। এছাড়াও হিমেলের বাবার এভাবে বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেওয়াতে জোবায়দার আত্মসম্মানে খুব আঘাত লেগেছে।
জোবায়দা চলে যাবার পর মুষলধারে বৃষ্টি নামলো। সেই বৃষ্টির জলে হিমেলের চোখের জল মিলে মিশে একাকার হলো।
দু,দিন পরেই জোবায়দারা এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। তাই হিমেল আর হলে বসে থাকতে পারলো না। বাড়িতে চলে এসেছে। হিমেলের মায়েরও খুব মন খারাপ। তবে হিমেলের বাবা খুব খুশী। হিমেল যে জোবায়দাকে পছন্দ করে সেটা উনি ভালোই বুঝতে পারেন। কারণ হিমেলের মতো বয়স একদিন উনারও ছিলো। উনি চান না জোবায়দা বউ হয়ে এ বাড়িতে আসুক। উনার ধারনা জোবায়দাকে যে ছেলে বিয়ে করবে তার ঘাড়েই ওদের পরিবারের পুরো দায়িত্ব চেপে বসবে।
বাড়ী শিফটের দিন জোবায়দা ওর অসুস্থ বাবাকে নিয়ে বেশ সকালেই নতুন ভাড়া বাড়ীতে উঠে যায়। আগের দিন বাসার সব মালপত্র গুছিয়ে বেধে রাখে। ওমর আর জাফরের উপর সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে ও চলে যায়। আসলে ও আর হিমেলের মুখোমুখি হতে চায় না।
জোবায়দা নতুন ভাড়া বাড়িতে উঠে গিয়ে সবার আগে মিস্ত্রী ডেকে চুলাটা লাগিয়ে নেয়। এরপর একচুলায় ভাত আর একচুলায় ডাল বসিয়ে দেয়। ভাত আর ডাল হয়ে গেলে ডিম ভুনা করে নেয়। এরমাঝে আলতাফ সাহেবকে ভাত খাইয়ে দিয়ে ওষুধ ও খাইয়ে দেয়। ওদিকে সমস্ত মালপত্র নিয়ে দুটো ভ্যানে করে দুপুরের মধ্যে ওমর নতুন বাসায় উঠে যায়। আসলে তাজমহল রোড থেকে শিয়া মসজিদ খুব একটা দূর না হওয়াতে বাসা বদলানোর কাজ দ্রুতই সেরে ফেলা গেলো। জাফর আদিবা আর জোবায়দা মিলে সন্ধার আগেই পুরো ঘর গুছিয়ে ফেলে।
শুরু হলো জোবায়দার নতুন জীবন। প্রতি সপ্তাহে ছুটির দিনে বাড়িতে চলে আসে। শুক্র শনি দুদিন সারাদিন বাড়িতে তিনটে কোচিং এর ব্যাচ পড়ায়। যারফলে আলতাফ সাহেবের পেনশন আর জোবায়দার কোচিং এর টাকা দিয়ে শেফালী বেগম কোনো রকমে সংসারটা চালিয়ে নেয়। তবে আলতাফ সাহেব অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকাতে ওমর আস্তে আস্তে বখে যেতে থাকে। জিপিএ ৩.৫ পেয়ে এইচএসসি পাশ করে। যারফলে কোনো সরকারী ভার্সিটিতে ও চান্স পায় না। অতঃপর ও মা শেফালী বেগমের কাছে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির বায়না ধরে। কিন্তু জোবায়দা বেঁকে বসে। ওর কথা হচ্ছে প্রাইভেটে পড়ার মতো অবস্থা ওদের নেই। তাই ওকে ঢাকা কলেজে ভর্তির চেষ্টা করতে বলে। কিন্তু ওমর ওর মায়ের কাছে গিয়ে বলে,
—–তোমার বড় মেয়েকে তো ডাক্তার বানিয়ে ওর জীবনটা গুছিয়ে দিলে। আর আজ তোমার মেয়ে আমাকে ইন্জিনিয়ারিং পড়ার খরচ দিতে রাজী হচ্ছে না। দেখলে তোমার মেয়ে কতো স্বার্থপর!
ওমরের এই কথাটা শেফালী বেগম মাথায় নেয়। জোবায়দা ছুটিতে বাড়ী আসলে ওকে বলে,
—-তোর বাবা তোকে কতো কষ্ট করে ডাক্তারী পড়ানোর ব্যবস্থা করলো। অথচ তুই আজ ওমরের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করলি না। স্বার্থপরের মতো শুধু নিজেরটাই ভাবলি।
মায়ের এই কথায় জোবায়দা ভীষণ কষ্ট পেলো। পাঁচদিন একটানা ক্লাস করে এমনিতেই ও হাঁপিয়ে উঠে। তারপর ছুটির দিনগুলোতে রেস্ট না নিয়ে কোচিং এর ব্যচ পড়ায়। তারপর ও আজ ওকে শুনতে হলো, “ও স্বার্থপর।”
মাকে ও কি করে বোঝাবে ও যে দিনরাত এককরে পড়াশোনা করে মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। এখানে পড়া শুরু করার পর ওর বাবা মায়ের একটা কানা পয়সা ওর পিছনে খরচ হয়নি। অথচ প্রাইভেটে ইন্জিনিয়ারিং পড়াতে গেলে কম করে হলেও ছয় সাত লক্ষ টাকা খরচ হবে। ও কি করে এতো টাকা ম্যানেজ করবে। আর ও রাজী হচ্ছে না বলে মা ওর সাথে কথা বন্ধ করে দিয়েছে। ওমরও কথা বলে না। শুধু সেদিন রুমে একলা বসে প নিরবে চোখের জল ফেলছিলো। তখন বাবা আলতাফ সাহেব লাঠিতে ভর দিয়ে ওর পাশে এসে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ওর খুব ইচ্ছা হয় বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদতে। কিন্তু বাবার সুস্থতার কথা ভেবে নিজেকে সামলে নেয়।
চলবে