তুমি অপরূপা পর্ব-৩৫+৩৬+৩৭

0
708

তুমি_অপরূপা(৩৫)

রূপকের প্রচন্ড জ্বর।মাঝরাতে রূপাকে কল দিলো রূপক।ফ্যাসফ্যাসে স্বরে বললো, “রূপা,একটু আসবে?”

রূপা ঘড়িতে সময় দেখলো।রাতে ১২.৩৪
ইতস্তত করে রূপা বললো, “এখন? ”

রূপক আচ্ছন্নের মতো বললো, “হ্যাঁ। ”

রূপা থম মেরে বসে রইলো কিছুক্ষণ। এতো রাতে রূপকদের বাসায় যেতে রূপার মন সায় দিচ্ছে না। ওদিকে রূপক একা বাসায়। কখন কি লাগে কে জানে?

গা ঝাড়া দিয়ে উঠে গেলো রূপা।এখন ভুল ঠিক ভাবার সময় না।রূপক অসুস্থ এবং একা বাসায়। সেটাই ভাবার বিষয় এখন।
রূপা গায়ে ভালো করে ওড়না জড়িয়ে উঠে গেলো। রূপকদের ফ্ল্যাটের দরজা ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেলো।
রূপা ভেতরে ঢুকে দেখে পুরো বাসায় লাইট অন করা।রূপা সব রুমের লাইট অফ করলো। ডাইনিং এর লাইট রেখে রূপকের রুমে গেলো। রূপক বিছানায় শুয়ে কাৎরাচ্ছে। রূপা রূপকের কপালে হাত দিয়ে দেখলো প্রচন্ড জ্বর।
রূপার মনটা ছোট হয়ে গেলো। তার জ্বরের সময় এই মানুষটা তার অনেক সেবা যত্ন করেছে। অথচ তার জন্য রূপা কিছু করতে পারছে না।

বালতিতে করে রূপা পানি নিয়ে আসলো। তারপর রূপকের মাথায় মগে করে পানি ঢালতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর রূপক বললো, “আমার ভীষণ ক্ষিধে পেয়েছে রূপা।”

রূপা সাথে সাথে উঠে গেলো। কিচেনে গিয়ে দেখে তার জন্য আনা স্যুপের প্যাকেট আছে চারটি। তাই দিয়ে রূপা একটা স্যুপ বানালো রূপকের জন্য।
রান্না শেষ করে রূপকের জন্য নিতে গিয়ে দেখে রূপকের রুমের দরজা বন্ধ।
বাহিরে থেকে রূপা ডাকতেই রূপক বললো, “টেবিলের উপর ঢেকে রেখে তুমি চলে যাও রূপা।”

রূপা বুঝতে না পেরে আবারও জিজ্ঞেস করলো, “কি করবো? ”

রূপক শান্ত স্বরে বললো, “রেখে যাও রূপা,চলে যাও তুমি। ”

রূপা দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে। এদিকে রূপকের আকাশ পাতাল জ্বর, অন্যদিকে রূপক দরজা বন্ধ করে তাকে চলে যেতে বলছে।আগে না হয় জানতো না, এখন তো জানে রূপক তার মামাতো ভাই। একটা দায়িত্ব তো তার আছে এখন রূপকের প্রতি।
সম্পর্কের কি এক অসীম টান!
এই যে দুদিন হলো জেনেছে এরা তার আত্মীয়, এখন মনে হচ্ছে কতো দায়িত্ব তার।নয়তো কখনো কি রূপা এতো রাতে এখানে আসতো?
অসম্ভব!
অথচ এখন রূপক চলে যেতে বলার পরেও যেতে পারছে না।

কিছুক্ষণ পর রূপক ডেকে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি আছো রূপা?”

রূপা চুপ করে বসে রইলো ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে।মিনিট দুয়েক পর খুট করে শব্দ হলো। রূপা তাকিয়ে দেখলো রূপক বের হয়ে আসছে রুম থেকে। ক্লান্ত দেহ,এলোমেলো চুল,টলমল পায়ে রূপক এগিয়ে এসে একটা চেয়ার টেনে ধপ করে বসে পড়লো রূপার সামনে । তারপর মৃদু হেসে বললো, “গেলে না কেনো?”

রূপা জবাব দিলো না।
রূপক কাতর চোখে বললো, “আমার ভীষণ কষ্ট হয় রূপা।তুমি জানো না,এই দুনিয়ায় কেউ জানে না আমার ভীষণ যন্ত্রণা। আমার বোন দুটো না থাকলে আমি বোধহয় সব ছেড়ে সন্নাসী হয়ে যেতাম।এই সংসার, এই জীবন সবই কঠিন রূপা।
জীবন আমাকে বারবার, বারবার আঘাত দিয়েছে, কষ্ট দিয়েছে। আমার প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির হিসাব করতে গেলে দেখেবে প্রাপ্তির খাতায় লিখা আছে অনাদর, আবহেলা,আঘাত,প্রতারণা।অথচ আমি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা প্রদান করেছি সবাইকে।
কেউ তা ফিরিয়ে দেয় নি রূপা।
এই বুকের ভেতর কি ঘূর্ণিঝড় বয়ে বেড়াই কেউ খবর নেয় নি।
আমিও তো মানুষ। একটা মানুষকে ঠিক কতটা কষ্ট দেওয়া যায় রূপা?”

রূপার চোখ টলমল করছে অশ্রুতে।নরম গলায় বললো, “কিসের এতো কষ্ট রূপকদা?”

রূপক হেসে বললো, “বালিকা,কি হবে সেসব জেনে?
তুমি বরং জেনে নিও এক বুক যন্ত্রণা আর আঘাতের ভীড়ে তোমার জন্য সন্তপর্ণে ভালোবাসা জমিয়ে রেখেছিলাম।
তুমি বরং জেনে নিও আরেকবার স্বপ্ন দেখার সাহস পেয়েছি তোমার হাসি দেখে।
বালিকা, তুমি বরং জেনে নিও, তুমি আমার সেই শখ,যাকে পাওয়ার জন্য আমি আমাকে বাজি ধরতে পারি।”

রপা জড়সড় হয়ে গেলো রূপকের এসব কথা শুনে। তার মাথা কাজ করছে না। কেমন আচ্ছন্নের মতো লাগছে তার।
রূপক উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “যাও,তোমার বাসায় যাও।”

রূপা আর দাঁড়ালো না। ছুটে পালিয়ে এলো।রুমে এসে রূপা কাঁদতে লাগলো। কেনো কাঁদছে সে জানে না।শুধু জানে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার।
মায়ের ভালোবাসা না পেলে কেমন লাগে তা তো রূপা জানে,অথচ সেখানে রূপক এতো বছর মায়ের ভালোবাসা পায় নি।কিভাবে আছে রূপক?

সকালে কলিং বেল বাজতেই রূপক বিছানায় উঠে বসলো। শরীর এখন কিছুটা ভালো লাগছে।ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে গেছে। তবে শরীর দুর্বল।
উঠে এসে দরজা খুলতেই দেখে রেখা দাঁড়িয়ে আছে।

রূপকের ভীষণ অবাক লাগলো। রেখাএখানে?
সমুদ্র বললো, “তোমার মা কোথায়?”

রূপক গম্ভীর হয়ে বললো, “কেনো এসেছেন?”

রেখা বিরক্ত হলো। কঠিন গলায় বললো, “তোমার মতো বেয়াদব মনে হয় দ্বিতীয় কেউ নেই। না হলে নিজের ফুফাতো বোনকে লেলিয়ে দিতে না আমার ছেলের পেছনে। কি ভেবেছ,সমুদ্রর চাচার ছন্নছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয়ে আমি সমুদ্রের সব আর্জি মেনে নিয়ে সালমার মেয়েকে ছেলের বউ বানাবো?
সমুদ্র আমার একমাত্র ছেলে,আমি বেঁচে থাকতে অন্তত কিছুতেই তা হবার নয়। যতই তোমরা ওই মেয়েকে লেলিয়ে দাও না কেনো!”

রূপকের মাথায় রক্ত উঠে গেলো শুনে। লেলিয়ে দিয়েছে তারা রুপাকে?
রূপা কে নিয়ে এভাবে কেউ বলতে পারে কখনো?

রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়লো রূপক।চেঁচিয়ে বললো, “কি ভেবেছেন আপনি, আমার ফুফাতো বোন বানের জলে ভেসে আসা কেউ?
আপনার ছেলের পেছনে আমরা লেলিয়ে দিই নি বরং আপনার ছেলে ওর জন্য দিওয়ানা হয়ে ঘুরছে।আর একটা কথা কান খুলে শুনে রাখুন,রূপাকে আমি ভালোবাসি।
আমার সবটা দিয়ে রূপাকে আমি ভালোবাসি। আমি যদি রূপাকে না ও পাই না তবুও জেনে রাখবেন, কিছুতেই রূপা সমুদ্রের হবে না।
দরকার হলে নিজে দাঁড়িয়ে রূপাকে অন্যত্র বিয়ে দিব।আপনার আঁচল ধরে ঘুরঘুর করা ছেলের কাছে রূপার বিয়ে হবে না। ”

রূপা নিজের বাসার মেইন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সবটা শুনলো।
নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না রূপা।
রেখাকে দেখার বড্ড ইচ্ছে হলো তার। কে সেই মহিলা যিনি তাকে এতো অপছন্দ করেন?
কোন অপরাধে?

দরজা খুলে রূপা বাহিরে বের হলো। রেখা পেছনে তাকিয়ে দেখলো ছিপছিপে মিষ্টি দেখতে একটা মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। রূপকের ততক্ষণে মাথায় আগুন জ্বলছে দাউদাউ করে।
রেখার সামনে রূপার হাত টেনে ধরে বললো, “এই যে রূপা,কান খুলে শুনে রাখ আজকে।আমি তোকে ভালোবাসি।আমার জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসি।তুই ভালোবাসিস বা না বাসিস তোর ইচ্ছে সেটা। তবে এটুকু মনে রাখবি দুনিয়ার যেকোনো ছেলেকে তুই ভালোবাসতে পারিস নির্দ্বিধায় শুধু সমুদ্রকে ছাড়া। ”

রূপা চুপ করে রইলো। চোখের সামনে ভাসছে সহজ সরল দেখতে, একটা ছেলের মুখ।যার দুই চোখ ভর্তি ভালোবাসা।
রূপা মনে মনে ভাবলো, কি কপাল তার!
মানুষ ভালোবাসা পায় না,আর সে পেয়েও গ্রহণ করতে পারছে না।
কতো দ্বিধা, কতো জটিলতা,কতো বাঁধা!
রেখা আড়চোখে রূপার দিকে তাকিয়ে বললো, “গাই ভালো তার বাছুর ভালো, দুধ ভালো তার ঘি।বাপ ভালো তার বেটা ভালো, মা ভালো তার ঝি।
মায়ের মেয়ে, মায়ের মতো ছোঁকছোঁকানিতে ওস্তাদ। এজন্যই তো আমার ছেলের মাথা খেয়ে নিয়েছে, যেভাবে মা খেয়েছিলো আমার দেবরের মাথা। ”

রূপক তেড়ে যেতে নিলো রেখার দিকে,রূপা হাত ধরে থামালো রূপককে।
রেখা আর দাঁড়ালো না। লিফট দিয়ে নামতে নামতে মুচকি হাসতে লাগলো। আজকের ডোজ কাজে লাগবে। ওই মেয়ের যদি সমুদ্রের জন্য কোনো টান থাকে ও তাও আজকে রেখার ব্যবহার দেখে কেটে যাবে।
তার কিছু করতে হবে না আর।এবার ছেলের হ্যাঁ তে হ্যাঁ মিলাবেন আর না তে না।ছেলের কথাতে রাজি হয়ে যাবেন।এখনই বাসায় গিয়ে জানাবেন তিনি রাজি রূপাকে ছেলের বউ বানাতে।

আচমকা রূপা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। রূপার কান্নায় রূপক হতভম্ব হয়ে গেলো। তারপর এগিয়ে গিয়ে রূপাকে নিজের বাহুর উপর টেনে নিলো।

রূপা বিড়বিড় করে বললো, “প্রয়োজন হলে আজীবন চিরকুমারী থাকবো রূপকদা,তবুও সমুদ্রর ছায়া ও মাড়াবো না।আমার মায়ের কি দোষ, কেনো আমার মা’কে এভাবে অপমান করলো উনি?”

রূপক চোয়াল শক্ত করে বললো, “এর জবাব সমুদ্রের থেকে নিবো আমি। আল্লাহ আল্লাহ করে ফুফু সুস্থ হয়ে উঠুক আগে রূপা,তারপর জানা যাবে অনেক কিছু। অনেক কিছুই আমি সন্দেহ করি সব নিশ্চিত হব ফুফুর থেকে জানার পর।
ফুফুকে দেখতে যাবি?”

রূপা মাথা নিচু করে বললো, “না,মা আমাকে দেখলে আরো উত্তেজিত হয়ে যাবেন।মা সুস্থ হয়ে নিক।তারপর যাবো।”

রূপক চুপ করে রইলো। বুকের ভেতর জ্বলতে থাকা সব আগুন যেনো নিভে গেছে রূপাকে বুকে পেয়ে।এভাবেই থাকবে তো রূপা?

চলবে…..

রাজিয়া রহমান

#তুমি_অপরূপা (৩৬)

গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সমুদ্র। সকালে ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমিয়েছে। সারারাত এক প্রকার জেগেই ছিলো।
দুচোখে ঘুম ছিলো না। সকাল বেলায় তাই শুয়েছে।

ঘুম ভেঙে গেলো ফোনের ভাইব্রেশনে। সমুদ্র লাফিয়ে উঠে বিছানায় বসলো।মাহি টেক্সট করেছে।

টেক্সট পড়ে মুহুর্তেই সমুদ্রের মন হতাশ হয়ে গেলো। মা তাহলে এতো কিছু করে ফেলেছে!
অথচ সে মা’কে বিশ্বাস করেছিলো।

সমুদ্র উঠে মায়ের রুমে গিয়ে দেখে রুম ফাঁকা। মায়ের রুমে বিছানার উপর উঠে বসলো সমুদ্র।
রেখা এলো কিছুক্ষণ পর। সমুদ্রকে তার রুমে দেখে কিছুটা অবাক হলো।
ছেলেকে তা বুঝতে না দিয়ে বললো, “উঠে গেছিস ঘুম থেকে? চা খাবি?”

সমুদ্র নরম স্বরে বললো, “খাবো মা।বেশি করে দুধ দিয়ে এক কাপ দুধ চা বানিয়ে দাও।তোমার প্রিয় কাপে করে দিও মা।”

সমুদ্রের অত্যধিক শীতল ব্যবহার রেখার নজর এড়ালো না।রেখা চা বানিয়ে আনলো। সমুদ্র চা’য়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললো, “কোথায় গিয়েছিলে মা?রূপকদের বাসায়?”

রেখা চমকালো।সমুদ্র কি জেনে গেছে সে রূপকদের বাসায় গিয়েছিল যে!

গলার স্বর যথেষ্ট পরিমাণ শান্ত রেখে বললো, “আমি? কে বললো তোকে এই কথা?
ওই বাসায় আমি কেনো যাবো?আমি দোকানে গিয়েছিলাম।আচ্ছা শুন বাবা।
আমি সারারাত ভেবেছি।তোর চাচা একবার যে কাজ করেছে আমি চাই না তুই ও সেই কাজ করিস।
তুই আমার একমাত্র ছেলে।এই বংশের প্রদীপ তুই।আমি তোর বাবার সাথে কথা বলেছি।তোর বাবা বলেছে তুই যা চাস তা যেনো হয়।আমি ও ভেবে দেখলাম তোর বাবা ভুল কিছু বলে নি।
রাগ,জেদ,ইগো নিয়ে থেকে তোর জীবন নষ্ট করতে দিতে পারি না আমি। তুই যাকে পছন্দ করিস তার সাথেই তোর বিয়ে হবে।”

সমুদ্র মুচকি হাসলো মায়ের কথা শুনে। চা শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে এক আছাড়ে কাপটা ভেঙে ফেললো।
রেখা চমকে উঠলো। সমুদ্র কেমন হিংস্র হয়ে উঠলো মুহূর্তে। চিৎকার করে বললো, “আমার সাথে অভিনয় করতে এসো না মা।আমি নিজে ও থিয়েটার অভিনেতা ছিলাম তুমি জানো ভালো করে। তোমার এই অভিনয় ভীষণ কাঁচা।কেনো গিয়েছিলে তুমি ওই বাসায়?
কার কাছে গিয়েছিলে?
রূপার কাছে?
কি বলেছ তুমি রূপাকে?
বলো আমাকে?”

রেখা বিস্মিত হলো। সমুদ্র কিভাবে জানলো রেখা ওই বাসায় গিয়েছিলো?
রূপক তো ওর সাথে কথা বলে না, ওই মেয়ের সাথে ও সম্পর্ক নেই। তাহলে কিভানে জেনে গেলো তিনি বাসায় না আসতেই?

সমুদ্রের চিৎকারের সামনে রেখা চুপ করে থাকতে পারলো না।সে-ও সমান তালে চিৎকার করে বললো, “হ্যাঁ গিয়েছি,গিয়েছি বেশ করেছি।আমাদের একটা লেভেল আছে,একটা ক্লাস আছে,রেসপেক্ট আছে।ফকিরের মেয়ে এনে তো সেই সম্মান নষ্ট করতে পারি না।তুমি চোখে রঙিন চশমা পরেছ তাই বলে তো আমি পরি নি তোমার বয়সটা এমন তাই তুমি বুঝতেছ না। তাই বলে আমি তো তোমার মতো বোকামি করতে পারি না।
আর যাকে তুমি পছন্দ করেছ সে কোনো ভাবেই যোগ্য না এই বাড়ির বউ হওয়ার। ”

সমুদ্র হেসে উঠে বললো, “ভালোবাসার কি ক্লাস হয় মা?
ভালোবাসা ফার্স্ট ক্লাস,থার্ড ক্লাস মেনে হয় বুঝি?
আমি রূপাকে ভালোবাসি,এটাই সবচেয়ে বড় সত্য আমার কাছে। তুমি যদি মানতে পারো মানবে আর যদি মানতে পারো তবে আজকেই আমাকে ভালো করে দেখে নাও মা।আজকেই এই বাসায় আমার শেষ দিন।আমি আবার ফিরবো বাসায়,সাথে করে বউ নিয়ে। তুমি ভেবো না চাচার মতো আমি চিরকুমার থাকবো।
যেই ক্লাস,সোসাইটি,রেসপেক্ট এর জন্য তুমি আমার ভালোবাসা মেনে নাও নি আমি সেই সব ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে ফিরবো। লজ্জায় সেদিন তোমার মাথা হেট হয়ে যাবে।আমি সেদিন বিজয়ীর হাসি হাসবো। ”

রেখা ছেলের হাত ধরে বললো, “পাগল হয়ে গেছ তুমি? ”

সমুদ্র ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো। শান্ত স্বরে বললো, “হ্যাঁ মা,আমি পাগল হয়ে গেছি।ভাবতে পারো তুমি, আমি কতটা পাগল হয়ে গেছি। একটা মেয়েকে আমার ভালো থাকা,আমার শান্তি, আমার স্বাচ্ছন্দ্য সব কেড়ে নিয়েছে। নিজেকে কেমন নির্জীব, অসাড় মনে হয় আমার।
আমি যেনো আমার না।আমি পুরোটা রূপার।ও মা,আমি পারবো না ওরে ছেড়ে থাকতে। আমি মরে যাবো মা।”

রেখার মন টললো না মোটেও।এক দলা থুথু ফেলে বললেন,”একবার ফেলে দেওয়া থুথু যেমন পুনরায় মুখে তুলে নেওয়া যায় না সমুদ্র, তেমনই একবার যাকে অপছন্দ করেছি,মেনে নিবো না বলেছি দুনিয়া এসপারওসপার হয়ে গেলে ও তাকে আমি এই বাড়ির বউ করবো না। ওই মেয়ে আমার কাছে ছুড়ে ফেলা থুথুর দলা।”

সমুদ্র হতবাক হলো মায়ের এরকম নিষ্ঠুর আচরণে। সমুদ্রর হতবাক দেখে রেখা বললো, “ভালো কথা শুনে যাও,তোমার ওই মাস্তান, বেয়াদব বন্ধুটা তো ওই মেয়ের কাজিন হয়।সে বলে দিয়েছে দরকার হলে ওই মেয়েকে কেটে সমুদ্রে ভাসিয়ে দিবে তবুও তোমার সাথে বিয়ে দিবে না।আর মোস্ট সারপ্রাইজিং ব্যাপার হলো তুমি হয়তো জানো না,ওই মেয়ের প্রেমে তোমার বন্ধুও হাবুডুবু খাচ্ছে। আর তুমি তো জানো তোমার বেয়াদব বন্ধুটা কেমন বেয়াড়া তোমার কি মনে হয় ও তোমার সাথে ওই মেয়ের বিয়ে হতে দিবে?”

সমুদ্র আকাশ থেকে পড়লো যেনো। রূপক!
রূপক রূপাকে ভালোবাসে?
সমুদ্র বিছানায় বসে পড়লো। রেখা মুচকি হাসতে লাগলো দাঁড়িয়ে। সমুদ্র কিছুক্ষণ পর উঠে দাঁড়ালো। যএই ব্যাগটা সবসময় গুছিয়ে রাখতো ট্যুরের জন্য, সেই ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বের হয়ে গেলো।
মাথার ভেতর প্রলয়ঙ্কারী ঝড়।বুকের ভেতর আগুনের দহন।
ভালো নেই সমুদ্র। সমুদ্রের জীবন কেমন রংহীন হয়ে গেছে। ভালোবাসা এমন হিংস্র ও হয়?
এভাবে সব শান্তি কেড়ে নেয়?
অথচ সে জানতো ভালোবাসা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর আর শান্তির শব্দ।

বিক্ষিপ্তভাবে হাটছে সমুদ্র। হঠাৎ করে টের পেলো একটা শক্ত হাত তাকে এক ঝটকায় টেনে সরিয়ে এনেছে। টাল সামলাতে না পেরে সে লোকটার বুকের উপর গিয়ে পড়েছে। তাকিয়ে দেখলো একটা মাইক্রো যাচ্ছে, আর একটুর জন্য সে গাড়ির নিচে পড়তে যাচ্ছিলো।
যে তাকে সরিয়ে এনেছে তার দিকে তাকানোর আগেই মানুষটা বাইকে উঠে গেলো।
অশ্রুসজল চোখে সমুদ্র তাকিয়ে বাইকটা দেখতে লাগলো।
এই বাইক তার চেনা,তার চিরচেনা। এটা রূপকের বাইক।হেলমেট মাথায় দিয়ে যেই ছেলেটা বাইক নিয়ে যাচ্ছে সে তার প্রাণের বন্ধু ছিলো। অথচ কি হয়ে গেলো!

হুট করে সমুদ্রের মনে হলো সে আসলে কখনোই বন্ধু হিসেবে রূপকের জন্য কিছু করতে পারে নি ।
রূপক সবসময় তার জন্য করেছে সে সবসময় সুবিধা ভোগ করে গিয়েছে। অথচ রূপকের ও তো তার থেকে অনেক কিছু পাওনা ছিলো।

হাসপাতালে সালমার চিকিৎসা পুরো দমে চলছে। কিছুক্ষণ পর পর সালমা মেয়েদের জন্য কেঁদে উঠে। অন্তরা তখন মাকে সামলে নেয়।
ডাক্তাররা আশা দিলেন সালমা যেভাবে রেসপন্স করছে,এভাবে রেসপন্স করলে ১ মাসের মধ্যে রিকভারি সম্ভব। অন্তরাকে ডাক্তার বললো, “আপনারা যত বেশি পারেন ওনাকে মা বলে ডাকবেন। বারে বারে ডাকবেন। ”

অনামিকা ভিডিও কলে মা’কে দেখে মায়ের সাথে কথা বলে। অন্তরা,অনিতা দুজনেই কথা বলে সমানে।
সিরাজ হায়দার গুমরে মরেন রূপার জন্য।
ভয়ে রূপা আসতে চায় না যদি তাকে দেখে সালমা অশান্ত হয়ে যায় আবার।
সিরাজ হায়দার ভাবেন মেয়েটার বুঝি কপাল পুড়লো।সবাইকে অবাক করে দিয়ে ৫ম দিন সালমা উঠে বসে সোজা জিজ্ঞেস করলো, “রূপা কই গেলো?”

সিরাজ হায়দার আনন্দে কাঁদলেন আজ সাথে সাথে রূপককে কল দিলেন।রূপক বাসায় ছিলো । ফুফার কথা শুনে তখনই রূপাকে নিয়ে হাসপাতালে এলো।

সালমা কতো দিন পর রূপার হাত চেপে ধরলো। রূপা কাঁদবে না, কাঁদবে না বলে ও কেঁদে দিলো।সালমা ভেবে পেলো না মেয়ের কান্নার কারন কি
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কেনো কান্দস?”

রূপা জবাব না দিয়ে মা’কে জড়িয়ে ধরলো। রূপকের চোখ ভিজে উঠলো। কোনো দিন মা তাকে এভাবে জড়িয়ে ধরেছে বলে তার মনে পড়ে না।
কেনো মা এভাবে তার থেকে দূরে সরে গেলো!
ক্যারিয়ার শুধু!
ক্যারিয়ারের জন্য কি মানুষ এরকম নিষ্ঠুর হতে পারে?
রূপক তো তার প্রথম সন্তান ছিলো, অথচ কখনো কি এভাবে ছেলেকে জড়িয়ে ধরেছেন তিনি?

১ মাস পর……..

সালমাকে আজ হাসপাতাল থেকে রিলিজ দিয়ে দিয়েছে। সালমার কন্ডিশন এখন ৮০% ভালো। এখন শুধু প্রপার কেয়ার করতে হবে তার।
রূপক বাসায় কিছু জানালো না।একটা উবার নিয়ে সবাইকে নিয়ে বাসায় চলে এলো।
শুক্রবার হওয়ায় তানিয়া আজ অফিসে যায় নি।বাসায় ছিলো। কলিং বেল বাজতেই বিরক্ত হলো। দরজা খুলতেই দেখে সালমা দাঁড়িয়ে আছে। সালমার পেছনে রূপক,রূপা,সিরাজ হায়দার, অন্তরা,অনিতা।

তীব্র ঝাঁকুনি খেয়ে তানিয়া পড়ে যেতে নিলো। টেবিল ধরে নিজেকে সামলে নিলো।
রূপক হেসে বললো, “তারপর, ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরে এসেছে আজ।আফসোস আজ আমার দাদা দাদী নেই।তারা যদি দেখতো তবে হয়তো তাদের মন শান্ত হতো। ”

তানিয়া চুপ করে রইলো। রূপক সমুদ্র কে টেক্সট দিয়ে বললো,”একটু আমাদের বাসায় আসতে হবে এখনই। ”

চলবে……

রাজিয়া রহমান

#তুমি_অপরূপা(৩৭)

নিরব,নিস্তব্ধ পরিবেশ। সবাই চুপ করে বসে আছে। সালমা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে শুধু। এই বাড়ি ছেড়ে একেবারেই তো চলে গিয়েছিলো, ভাগ্য আবারও তাকে এই বাড়িতে ফিরিয়ে এনেছে।
ভাগ্য যখন ফিরিয়ে আনবেই তাহলে কেনো আরো আগে আনলো না?
তাহলে তো বাবা মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে পারতো।

সমুদ্র এসে রূপকদের খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে এসে দাঁড়ালো। আজকে একটা হিসেব মেলাতে হবে তার।

সময় কেটে যাচ্ছে, সালমার কান্না শেষ হচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর রেখা ও এসে হাজির হলো। একটু আগে রূপক তাকে কল দিয়ে বলেছিলো সমুদ্র এই বাসায় এসে পাগলামি করছে তাই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো রেখা।
কিছুক্ষণ পর রূপকের ছোট চাচা,চাচী ও এসে হাজির হলো।
সালমা ফিরে এসেছে এই খবর শুনে তারা ও ছুটে এসেছে সালমাকে দেখতে।

ছোট ভাইজানকে দেখে সালমা কান্নায় ভেঙে পড়লো আবারও। সিরাজ হায়দার অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে আছে বিব্রত হয়ে।
সেদিন যদি তিনি সালমাকে নিয়ে পালিয়ে না যেতেন তবে এই মুহূর্ত আসতো না।আচ্ছা, সালমা কে কি তিনি সুখী করতে পেরেছেন?
হয়তো পারেন নি।কখনো মুখ ফুটে কিছু বলে নি সালমা।তবুও তিনি বুঝেন অনেক কমতি ছিলো, অনেক না পাওয়া ছিলো।
অনেক সময় রাগে,ক্রোধে অন্ধ হয়ে সালমার গায়ে হাত তুলতে ও দুই বার ভাবেন নি তিনি।
আজ এতো লজ্জা লাগছে কেনো তার এসব ভেবে?
রাজকন্যাকে নিয়ে মাটির ঘরে রেখেছেন অথচ তার যাওয়ার কথা ছিলো অন্যের রাজপ্রাসাদে।

এসব ভেবে সিরাজ হায়দার লজ্জায় নত হয়ে রইলেন।

রূপকের ছোট চাচা সেলিম খান দোদুল্যমানতায় ভুগছেন।একদিকে বোন ফিরে এসেছে বলে যেটুকু আনন্দ হচ্ছে অন্যদিকে ভেতরে ভেতরে রাগ ও হচ্ছে একটা সোনার টুকরো জমি হাতছাড়া হয়ে যাবে বলে। রূপক ঠিকই জমিটা ফুফুর নামে করে দিবে।
এরকম একটা জমির মালিকানা হারিয়ে ফেলার কষ্টে হারানো বোনকে ফিরে পাবার আনন্দ ও ফিকে হয়ে এলো তার।
সেলিম খান বুঝতে পারলেন না কেনো এমন হচ্ছে। অথচ এক সময় এই ছোট বোনটার জন্য দুনিয়া এফোঁড়ওফোঁড় করে দিতে ও দ্বিতীয় বার ভাবতেন না।অথচ আজ তার সম্পদের জন্য মন কেমন করছে।

নিরবতা ভেঙে তিনি বললেন, “কিভাবে পারলি তুই এভাবে আমাদের মান ইজ্জত নষ্ট করে পালিয়ে যেতে সালমা?
একবারও মনে পড়লো না আমাদের কথা? আব্বার কথা ও কি তোর মনে পড়ে নি?”

এতো গুলো বছর পর,সন্তানেরা যখন এতটা বড় হয়ে গেছে সেই সময় তাদের সামনে এসব প্রশ্ন ভীষণ বিব্রতকর। রূপক এগিয়ে এসে বললো, “চাচা কি হয়েছে না হয়েছে সেসব এখন বলে লাভ নেই।ফুফুর যা ঠিক মনে হয়েছে তাই করেছেন।এখন সেসবের বিচার করতে যাওয়ার মতো বোকামি দ্বিতীয় কিছু নেই।বড় কথা হচ্ছে দাদা দাদী দুজনেই ফুফুকে ক্ষমা করে দিয়েছেন, মন থেকেই ফুফুকে মেনে নিয়েছেন সেই সময়। দুর্ভাগ্য এটাই যে ফুফুর সন্ধান দাদা পান নি।”

সেলিম খান বললেন, “এখন ফিরে এসেছে কেনো তাহলে? আব্বা মা ওর জন্য যেই কষ্ট পেয়েছেন তা আমরা জানি।সবার কাছে আমাদের ছোট হতে হইছে।এখন কি সংসার চালাতে পারে না?
এজন্য বাবার বাড়িতে ফিরে আসছে?”

রূপক চমকে গেলো চাচার কথা শুনে। আজকের দিনে,এরকম আনন্দের দিনে চাচা এভাবে কথা বলছেন!
এতো লোভ তার!

রূপক চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। সেলিম খান আর কি বলে সেসব শোনার জন্য, তারপর জবাব দিবে।ফুফুও বুঝুক এই জগৎ সংসারে তার জন্য কেউ আপন নেই আর। যাতে ভাইয়ের মিষ্টি কথায় পরে জমি ভাইয়ের নামে লিখে দেওয়ার মতো ভুল না করে।

সালমার চেহারা থমথমে হয়ে গেলো লজ্জায়। কি বলছে এসব তার আপন ভাই?

সেলিম খান আবারও বললো, “বড় ভাবী ঠিকই বলতো।একদিন ঠিকই ফিরে আসবো জায়গা জমির লোভে।কথা তো আজ দেখি সত্যি।”

তানিয়া নিজেই চুপ হয়ে রইলো। কেঁচো খুড়তে গিয়ে সাপ যাতে বের না হয় তার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করছে।

সিরাজ হায়দার এবার আর চুপ রইতে পারলো না। এগিয়ে এসে বললো, “আমার টাকা পয়সা না থাকতে পারে কিন্তু মান ইজ্জত আছে।আল্লাহ আমারে টাকা পয়সা দেয় নাই সেই সাথে লোভ ও দেয় নাই।তাই এসব নিয়ে ভাবিয়েন না আপনি। ”

সেলিম খান হেসে বললো, “গরীবের আবার নীতিজ্ঞান!
তুমি তাইলে সেই লোক!তোমারে তো আমি পুলিশে দিমু।”

অন্তরার ভীষণ রাগ হলো এবার।এগিয়ে এসে মামার সামনে দাঁড়িয়ে বললো, “মুখ সামলে কথা বলিয়েন। আমার বাবার দিকে আঙুল তুলে কথা বলার আগে একবার ভালো করে ভেবে নিয়েন।নয়তো পরে দেখবেন হাতে আঙুলই থাকলো না।”

সেলিম খান থতমত খেয়ে গেলেন অন্তরার কথা শুনে। এইটুকু মেয়ের এতো বড় বড় কথা!

নিজেকে সামলে সেলিম খান প্রসঙ্গ বদলে বললেন, “তোর বাবার কথা শুনে তোর যেমন খারাপ লাগছে আমাদের ও সেই সময় এরকম লাগছে আমাদের আব্বার জন্য। আব্বা মৃত্যু শয্যায় কতো খুঁজেছে সালমাকে।কখনো একটা চিঠি ও কি লিখতে পারিস নি?”

সালমা চকিতে তানিয়ার দিকে তাকালো। তানিয়া পারে না এখান থেকে পালিয়ে যায়। মাথা নিচু করে তানিয়া দাঁড়িয়ে আছে।
সালমা তানিয়ার সামনে গিয়ে বললো, “বড় ভাবী,তোমার কাছে আমি কতো চিঠি পাঠাইছি তুমি কি জানাও নাই বাড়িতে? ”

তানিয়ার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়লো। চুপ করে মাথা নিচু করে রইলো তানিয়া।সেলিম খান,সেলিম খানের স্ত্রী রুবি,রত্না,পান্না,সমুদ্র,রূপা,অন্তরা সবাই বিস্মিত হলো এই কথা শুনে।
রূপক হাসতে লাগলো মুচকি মুচকি।

সেলিম খান আচমকা তানিয়ার সামনে গিয়ে বললো, “সালমা কি বললো এটা ভাবী?ও কি তোমাকে চিঠি পাঠাইছিলো?”

তানিয়া ঘামতে লাগলো। জিব দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো, “না,কখনোই না।সালমার সাথে কখনোই আমার যোগাযোগ হয় নি।ও কোনো দিন ও আমারে চিঠি দেয় নি,মিথ্যা কথা বলতেছে।চিঠি দিলে কি আমি সবাইরে জানাতাম না বলেন ছোট ভাই?আপনার মনে নাই আমি সহ তো কতো খুঁজছি ওরে জায়গায় জায়গায়। আমার সাথে যোগাযোগ থাকলে তো আমি নিজেই সবাইকে জানিয়ে দিতাম।”

সালমা হতভম্ব হয়ে গেলো ভাবীর কথা শুনে। তারপর বোমা ফাটানোর মতো বললো, “তুমি আমাকে খুঁজছ ভাবী?
তুমি?
অথচ তুমি নিজেই আমারে পালাইয়া যাওনের বুদ্ধি দিছিলা।তুমি আমার ঠিকানা ও জানতে, চিঠির খামে তো ঠিকানা লেখাই থাকতো।”

পুরো ঘরের সবাই থম মেরে আছে। সেলিম খান ভেবে পাচ্ছে না কি বলবে?
বড় ভাবী নিজে এই বুদ্ধি দিয়েছিলো?

তানিয়া আমতাআমতা করে বললো, “কি বলো এসব তুমি সালমা?”

সালমা এবার শক্ত হলো। কঠোর স্বরে বললো, “হ,এতো দিন আমি সব কথা নিজের মধ্যে লুকাই রাখছি।আমি কোনো দিন চাই নাই বড় ভাবী আমার জন্য ঝামেলায় পড়ুক।এখন যখন বড় ভাবী নিজেই অস্বীকার করতেছে তখন আমি সব সত্যি বলে দিমু।আমাদের সম্পর্কের কথা যখন বাড়িতে সবাই জেনে যায় তখন আব্বা,বড় ভাই,ছোট ভাই কেউ-ই রাজি হয় নাই।
কবিরের লগে আমার বিয়া ঠিক কইরা ফালায় তখন ওনারা।
আমি নিজেও জানতাম না আমার বিয়ে যে ঠিক হয়ে গেছে। বড় ভাবী সেদিন রাইতে আমার রুমে আইসা আমারে কইলো আগামী কাইল আমার বিয়া দিবো জোর কইরা কবিরের লগে।আমি তখন দিশেহারা হয়ে গেছি।বড় ভাবী আমাকে বুদ্ধি দিলো যাতে পালিয়ে যাই।আমি যখন আব্বার কথা কইলাম,ভাবী কইলো কিছুদিন পর সব ঠিক হয়ে যাইবো।এদিক ভাবী সামলাইবো আমি যাতে চিন্তা না করি।আমি তখন ভাবীর কথায় ভরসা করে আমি সেদিন ঘর ছেড়ে যাই।
আমি ভেবেছিলাম ভাবী সবাইকে বুঝিয়ে নিবে।
কিন্তু পরে যখন ভাবীকে চিঠি দিই ভাবী আমাকে বললো যে আব্বা না-কি বলেছেন আমি কোনো দিন যদি ফিরা আসি তাইলে আমারে আব্বা ত্যাজ্য করবেন।আর নয়তো নিজে আত্মহত্যা করবেন।
আমি তখন পুরোপুরি নিজেরে গুটাইয়া নিছি।তারপর আর কারো খোঁজ রাখার দরকার মনে করি নাই।”

সবাই হতভম্ব হয়ে আছে।পুরো বাসায় পিনপতন নীরবতা।

একটা মানুষের জন্য এতো কিছু ঘটে গেলো, বাবা তার আদরের মেয়ের খোঁজ পেলো না,মেয়ে পারলো না বাবাকে শেষ দেখা দেখতে। সবাই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো শুধু একজনের জন্য।

তানিয়া আবারও মিথ্যা বলতে চাইলো কিন্তু রূপকের রক্তচক্ষুর দিকে তাকিয়ে আর সাহস পেলো না।রূপক বজ্রকঠিন স্বরে বললো, “মিথ্যা বলে লাভ হবে না,ফুফুর লিখা দুইটা চিঠি আমার হাতে এসে পড়েছে। তাই ফুফু যে মিথ্যা বলছে না তা পরিষ্কার। ”

তানিয়া উপায় না পেয়ে বললো, “আমার একার দোষ না,আমার সাথে রেখা ভাবী ও ছিলো। উনি আর আমি মিলে এই প্ল্যান করেছি।তাই একা আমাকে কেনো সবাই কথা শোনাবে?”

রেখা আৎকে উঠলো শুনে।সে এসেছিলো ছেলের জন্য, নিজে এভাবে ফেঁসে যাবে তা ভাবে নি।এখন মনে হচ্ছে না আসাই ভালো ছিলো। কিন্তু এসে যখন পড়েছে তখন আর ফেরার পথ নেই।

সমুদ্র অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকালো। তার মা ও এরকম নোংরা চক্রান্তে যুক্ত থাকতে পারে তা কখনোই ভাবনাতেও আসে নি সমুদ্রের। হতবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো সমুদ্র।

চলবে……

রাজিয়া রহমান

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে