তুমি অপরূপা পর্ব-৩+৪

0
917

#তুমি_অপরূপা(০৩)
“আল্লাহ মেঘ দে,পানি দে ছায়া দে রে তুই,আল্লাহ মেঘ দে……”

দূর থেকে ভেসে আসা কথাগুলো কানে বাজছে রূপার।আজকে স্কুলে যায় নি রূপা।তিন বোন মিলে নিজেদের ক্ষেতে পানি দিতে এসেছে। ক্ষেত থেকে অনেক দূরে খাল।কলসি করে পালাক্রমে পানি আনছে দুই বোন,অনিতা এমনিই দাঁড়িয়ে আছে। মাঝেমাঝে বোনদের মাথা থেকে কলসি নামাতে সাহায্য করছে যখন কলসি মাথায় নেয় তারা।তবুও যাতে বাবার উপর একটু চাপ কমে এই চেষ্টা তিন বোনের।বাবার উপর রূপার আগে যেই অভিমান ছিলো তা বড় আপা চলে যাওয়ার পর থেকে বিলুপ্ত হতে লাগলো। রূপার মনে হতে লাগলো হাতে টাকা পয়সা থাকলে বাবা হয়তো এরকম করতেন না।
সত্যিই তো,এতো বড় সংসারের সম্পূর্ণ ভার বাবার একার কাঁধে।সবসময় এটা নেই,সেটা নেই বলে মনে মনে আক্ষেপ করেছে কিন্তু কখনো কি ভেবেছে বাবার কতোটা কষ্ট হচ্ছে এতো গুলো মানুষের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে।
মাসে মাসে না হলেও দু-মাসে,তিন মাসে একটা নতুন জামা ঠিকই পায়।আর দুই ঈদে তো পায়-ই।খুব দামি না হোক তবুও নতুন জামা তো।অথচ বাবার সাথে এতো দিন এতোটাই দূরত্ব ছিলো যে কখনো ভালো করে তাকিয়ে দেখেই নি বাবা যে ঈদের দিন দশেক আগে তার পুরনো পাঞ্জাবি লন্ড্রিতে পাঠিয়ে ধুয়ে এনে প্রতি ঈদে গায়ে দেয়।অথবা বাবার প্রতিদিনের গায়ে দেওয়া টিশার্টের হাতার নিচে মায়ের সেলাই করে দেয়ার চিহ্ন।

নিজেকে বড় অকৃতজ্ঞ মনে হয় রূপার।একটা মানুষের একটা খারাপ দিকে দেখে তাকে নিয়ে এতো দিন খারাপ ধারণা পুষে রেখেছে মনে সে।
অনামিকা কলসি এনে দিয়ে বললো, “এমনে দাঁড়াইয়া আছস ক্যান?তাড়াতাড়ি হাত লাগা না।রোইদের যেই ত্যাজ,মাথা ফাটতে আর দেরি নেই।”

মিতা ও এসেছে ওদের সাথে। রাস্তার পাশে রাখা গাছের গুড়ির উপর বসে থেকে তিন বোনের কাজ দেখছে আর একটা কোণ আইসক্রিম খাচ্ছে। পাশেই অবহেলায় পড়ে আছে হাফ লিটার একটা সেভেন আপের বোতল।ফ্রিজের অবশ্যই বোতলটা।আসার সময় নানীর থেকে একটা ১০০ টাকার নোট এনেছে সে।তা দিয়েই এসব কিনেছে।
অনিতা ক্ষেতে দাঁড়িয়ে মিতার খাওয়া দেখছে।মিতার খাওয়া দেখে তার ভীষণ লোভ লাগছে,গলা শুকিয়ে গেছে। অবশ্য যেই রোদ,গলা না শুকিয়ে উপায় কি?

রূপা পানি এনে ক্ষেতে ঢালতে ঢালতে বললো, “তোর আর থেকে কাজ নেই অনি।যা বাড়ি যা। খুব গরম।”

অনিতা চুপ থেকে বললো, “আপা,ওই আইসক্রিম খেতে কি অনেক মজা?মিতা আপা কেমন মজা করে খাচ্ছে দেখছো আপা?”

রূপার খুব অসহায় বোধ হলো হঠাৎ করেই। সেই সাথে রাগ ও হলো মিতার উপর। কেনো লোভ লাগাচ্ছে ছোট মেয়েটাকে। মিতার দিকে তাকাতে তাকাতে অনিতা জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালো।রূপা বোনের কাঁধে হাত রেখে বললো, “ভাবিস না,একদিন আপা তোকে অনেকগুলো আইসক্রিম কিনে দেবো দেখিস।অন্যের খাওয়া দেখে লোভ করতে নেই।”

অনামিকা আরেকটা কলসি নিয়ে এসে বললো, “কিরে,এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?পুরোটা পথ আমাকে আনা লাগছে কলসি।”

তারপর অনিতার মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, “কি রে,ওর কি হইছে রে?”

রূপা বললো, “দেখতাছো না মিতা ওরে দেখাইয়া দেখাইয়া আইসক্রিম খাইতেছে।”

অনামিকা বিরক্ত হয়ে বললো, “ইচ্ছে করে হারা/মির বাচ্চারে দুইটা থাপ্প/ড় বসাই।নাটক দেখতে আইছে এইখানে আমাদের? আমরা গাধার মতো খাটতেছি আর সে আমাগো খাটুনি দেখে মজা নিতেছে?”

রূপা বললো, “থাক আপা।কলসি দাও এবার আমি আনি।তুমি জিরাও”

অনামিকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “আপার খোঁজ কবে পাবো জানি। ভীষণ অশান্তি লাগে বুকের ভেতর জানস।”

রূপা জবাব না দিয়ে কলসি নিয়ে গেলো খালের দিকে।খালের পাড় থেকে নিচে নামার পথটা এবড়োখেবড়ো। নিচে দুই টুকরো ইটের উপর দাঁড়ানোর ব্যবস্থা আছে শুধু।তাও ভীষণ নড়বড়ে। রূপা পানির জন্য নামতে যেতেই দেখলো একটা ছেলে ও নামছে।রূপা দাঁড়িয়ে গিয়ে ছেলেটাকে যাবার সুযোগ করে দিলো।

বন্ধুর সাথে বন্ধুদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে সমুদ্র।সমুদ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। নিজেরা ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ায় এবং গ্রামে কোনো আত্মীয় স্বজন না থাকায় সুযোগ পেলেই বন্ধুদের সাথে তাদের গ্রামের বাড়ি চলে যায় বেড়াতে।গ্রামের মাঠঘাট, গ্রামের মানুষের জীবনযাপন সবকিছুই সমুদ্রকে আকর্ষণ করে তীব্রভাবে। সমুদ্রের ইচ্ছে পড়ালেখা শেষ করে গ্রামে এসে একজন শিক্ষিত কৃষক হবে সে।চাকরি নামক সোনার হরিণের পিছনে ছুটতে সমুদ্রের কোনো ইচ্ছে নেই।
গ্রামে কতো সম্ভাবনা রয়েছে, অথচ মানুষ তা না বুঝেই শহরমুখী হচ্ছে। এই যে গ্রামে এতো বিশুদ্ধ বাতাস,তাজা সবজি,তাজা মাছ,নিজেদের গরুর দুধ,নিজেদের ক্ষেতের ধানের চালের মোটা ভাত।আহ!কি অতুলনীয় স্বাদ!
শহরে থেকে বাজার থেকে কেনা চিকন চালের সেই ভাতে সমুদ্র এই তৃপ্তি পায় না।

তিন বন্ধু মিলে এসেছে গতকাল রাতে বন্ধু জামিলদের বাড়ি।সকাল হতেই চারজন হাটতে বের হয়েছে। হাটতে হাটতে সমুদ্র নেমে গেছে ক্ষেতে,সমুদ্রের এই স্বভাব বন্ধুদের জানা আছে। গ্রামের ফসলের মাঠ যে সমুদ্রকে টানে তা কারো অজানা নয়।কিন্তু এই কাঠফাটা রোদে বাকিরা খোলা মাঠে নামতে আগ্রহী হলো না।তাই অপেক্ষা করতে লাগলো রাস্তায় দাঁড়িয়ে। সমুদ্র একা একাই বিস্তৃত ফসলের মাঠের অনেক দূর হেটে এসেছে।
ফেরার সময় অঘটন ঘটে গেলো। গোবরে পা এবং জুতা মাখামাখি হয়ে গেলো অসচেতনতায় পা দেওয়ায়।তার জন্যই সমুদ্র খালে নামলো পা ধুতে। খালে কোনো সিড়ি দেওয়া না থাকায় অনভিজ্ঞ সমুদ্র উঁচুনিচু জায়গা দিয়ে নামতে গিয়ে টাল সামলাতে পারলো না। ফলস্বরূপ কাঁটার সাথে লেগে নিজের শার্ট এবং লুঙ্গি দুটোই ছিঁড়ল এবং নিজের টাল সামলাতে না পারায় নিজে গিয়ে পড়লো কোমর পানিতে।অবশ্য খালে পানি আছেই কোমর সমান।

একটা মেয়ের সামনে এই লজ্জা সমুদ্র মানতে পারলো না। শ্যামলা মুখে লজ্জার ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠলো। রূপা নিজেও অবাক হয়ে গেলো। প্রথমে তার হাসি এলেও নিজেকে সামলে ফেললো রূপা চট করে। কারো এরকম বিপদে হাসা অনুচিত।

পায়ের দিকে একটা মাছের ঠোকর খেয়ে সে দিকে হাত দিতেই সমুদ্র টের পেলো লুঙ্গি ছিঁড়ে গেছে। তাও আবার হাটুর দেড় বিগত উপর দিয়ে ছিঁড়েছে।এরকম লজ্জায় সমুদ্র কখনো পড়ে নি।
রূপা নেমে এসে বললো,”উঠে আসেন।”

সমুদ্র কি করবে ভেবে পেলো না।এই ছেঁড়া লুঙ্গি পরে জামিলদের বাড়ি পর্যন্ত যাওয়া অসম্ভব। তার চেয়ে ভালো পানিতে দাঁড়িয়ে থাকবে।
পরক্ষণেই মনে হলো কতক্ষণ এভাবে থাকবে?অনন্ত কাল তো আর থাকা যাবে না।আর তার এই স্বভাব বন্ধুরা জানে এজন্য তারা হয়তো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বাড়িতে চলে যাবে।সমুদ্র নিজের ফোন জামিলদের বাড়ি চার্জে রেখে এসেছে। বন্ধুদের কল দেওয়ার সুযোগ ও নেই।
রূপা ছেলেটাকে কোনো জবাব দিতে না দেখে পানি নিয়ে উঠে গেলো উপরে। সমুদ্র তাকিয়ে দেখলো কতো সহজভাবে মেয়েটা উঠে গেছে এই অসমান পথএ পানি ভর্তি কলসি নিয়ে। রূপা চলে যেতে নিতেই সমুদ্র বললো, “শুনুন,আমি একটা বিপদে পড়ে গেছি।আমাকে একটু সাহায্য করুন প্লিজ।”

কলসি নামিয়ে রেখে রূপা ঘুরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কি বিপদ? ”

সমুদ্র ইতস্তত করে বললো, “নামতে গিয়ে ওই বুনো কাঁটা গাছটির সাথে লেগে আমার লুঙ্গি ছিঁড়ে গেছে। আমি এসেছি জামিলদের বাড়ি। এখান থেকে ওদের বাড়ির ভালোই দূরত্ব। ভেজা শরীরে এই ছেঁড়া লুঙ্গি পরে আমার পক্ষে যাওয়া অসম্ভব। আপনার বাড়ি কি আশেপাশেই? আপনি কি আমাকে একটু লুঙ্গির ব্যবস্থা করে দিতে পারেন?”

রূপা জামিলকে চিনে,কম করে হলেও ১৫ মিনিট লাগবে জামিলদের বাড়ি যেতে।রূপাদের বাড়ি যেতে লাগবে ১০ মিনিট। কিন্তু বড় কথা হলো বাড়িতে রূপার বাবার ভালো কোনো লুঙ্গি নেই।অথচ এই লোকটার বিপদ।রূপা নিজেই অস্বস্তিতে পড়ে গেলো।
একদন্ড ভেবে বললো, “আমার বাড়ি তো কিছুটা দূরে। তাছাড়া বাবা ছাড়া আর কোনো পুরুষ নেই।তাই ভালো লুঙ্গির ব্যবস্থা করা সম্ভব না।”

সমুদ্রর মনে হলো সে নিজেই এবার অথৈ সমুদ্রে পড়েছে। এখন কি করবে সে?এই মেয়েটা চলে গেলে এই পথে যদি কেউ না আসে তবে?সারাদিন কি এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে?
লজ্জাশরম বাদ দিয়ে সমুদ্র বললো, “প্লিজ কিছু একটা করুন।”

রূপা খানিক ভেবে নিজের খোঁপা খুলে দিলো। কোমর সমান লম্বা চুলগুলো মুক্ত হয়ে বাতাসে উড়তে লাগলো। দুই ভাগ করে সেই চুল সামনে এনে রূপা জামার সাথের ওড়নাটা সমুদ্রর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, “এছাড়া সাহায্য করার মতো আমার কাছে আর কিছু নেই পথিক।”

সমুদ্রর পথিক সম্বোধনটা বেশ ভালো লাগলো। মেয়েটাকে মনে হলো কপালকুন্ডলা।রূপা ওড়নাটা ছুড়ে মারতেই সমুদ্র ক্যাচ নিলো।রূপা আর না দাঁড়িয়ে কলসি নিয়ে চলে এলো। পেছন থেকে সমুদ্র ডেকে জিজ্ঞেস করলো, “আপনার নাম কি?”

সমুদ্রের প্রশ্নের আগেই রূপা অনেক দূর চলে গিয়েছে। তাই আর জবাব এলো না।সমুদ্র জবাব না পেয়ে বললো, “আপনি কপালকুন্ডলা।”
আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে না দেখে পানি থেকে উপরে উঠে ওড়নাটাকে লুঙ্গির ভেতর দিয়ে পেঁচিয়ে গিঁট দিয়ে নিলো।এবার ছেঁড়া অংশ টুকুতে শুধু রূপার সাদা গোলাপি ওড়নার কিছুটা দেখা যায়। ভেজা লুঙ্গি পরে সমুদ্র চলে এলো। এসে দেখে বন্ধুরা কেউ নেই।

অনামিকা বললো, “এতো সময় লাগাইয়া দিলি?তোর ওড়না কই?”

রূপা কি বলবে?
একটু ভেবে বললো, “কাঁটার সাথে লেগে ছিঁড়ে গেছে অনেকখানি আপা।এজন্য রাগ করে ফেলে দিয়েছি।”

অনামিকা আফসোস করে বললো, “আহারে, এই জামাটা তো নতুন জামা ছিলো তোর।ওড়না ও নতুন। ”

অনিতার মাথার স্কার্ফটা মাথায় দিয়ে রূপা বললো, “এবার বাড়ি চলো আপা।আর ভালো লাগছে না।”

অনামিকা বললো, “আচ্ছা চল।আবার আগামীকাল আসবো।আমার পড়তে হবে।”

ক্ষেত থেকে উঠে আসতেই মিতা এগিয়ে এলো। সেভেন আপের বোতলটা খুলে ঢকঢক করে খেতে লাগলো। তারপর রুপাকে উদ্দেশ্য করে বললো, “খুব গরম পড়ছে না রে রূপা?মা’গো এরকম গরম হইলে বাঁচা কষ্ট হইয়া যাইবো।এখন একটু শান্তি লাগতাছে কোক খাইয়া।”

তিন বোনের কেউ-ই কোনো জবাব দিলো না।

চলবে…….

রাজিয়া রহমান
#তুমি_অপরূপা (০৪)
২৩ বছর পর আজ সালমা ঢাকা শহরে যাচ্ছে। গাড়ি যতো সামনে যাচ্ছে সালমা বুক তত ধুকপুক করছে । বুকের ভেতর চাপা আনন্দ,উত্তেজনা, ভয় সব অনুভূতি বিদ্যমান। ২৩ বছর আগে দেখে যাওয়া শহরের সাথে আজকের শহরের কোনো মিল নেই।এই সেই শহর যেই শহরে সালমা জন্মেছে। যেই শহর তার নিজের শহর ছিলো। যেই শহরের পিচঢালা পথ ও তার চিরচেনা ছিলো। সময়ের ব্যবধানে সেই শহরের সাথে জন্ম জন্মান্তরের দূরত্ব হয়ে গেলো।
বাসের সিটে হেলান দিয়ে বসে সালমা ভাবতে লাগলো ২৩ বছর আগের কথা।
সালমা তখন অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে আর সিরাজ হায়দার ফাইনাল ইয়ার।সালমাদের বাসায় ৩ বন্ধুর সাথে ভাড়া থাকতো সিরাজ হায়দার। আর ওভাবেই পরিচয়। পরিচয় কখন প্রণয়ে রূপ নিলো তা টের পেলো না কেউ-ই। তবে প্রণয়ের পরিণতি কারোরই সুখকর ছিলো না। সিরাজ হায়দার গ্রামে এসে মা’কে সালমার কথা জানাতেই সুরাইয়া বেগম তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেন।ছেলের বউ করবেন তিনি গ্রামের ১২-১৩ বছর বয়সী একটা মেয়ে,এরকম বুড়ি,ধামড়ি,শহরের লেখাপড়া করা মাইয়া কিছুতেই বউ করবেন না বলে সাফ জানিয়ে দিলেন।
ছেলেকে বশ করতে ওঝার শরণাপন্ন হতেও বাদ রাখেন নি।কিন্তু ভালোবাসার শক্তির কাছে কোনো বিধিনিষেধ কিছুই টিকলো না।
বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে সালমা।দুই ভাইয়ের আদরের বোন।সালমার বাবা সিকান্দার খান সালমার বিয়ে ঠিক করলেন প্রতিবেশী, বন্ধু হাশেম চৌধুরীর ছেলে কবির চৌধুরীর সাথে।
বাবা মা ভাই কারো পায়ে ধরতে সালমা বাদ রাখে নি সিরাজ হায়দারের জন্য। অথচ কারো মন এতটুকু টলে নি তাতে।উপায়ন্তর না পেয়ে বিয়ের তিন দিন আগে সিরাজ হায়দারের হাত ধরে সালমা শহর ছেড়ে যায়।

যদিও তার পর বাবা ভাই সবাই সালমাকে খুঁজেছে কিন্তু সালমা কোনো ঠিকানা রেখে আসে নি।

স্টেশনে বাস থেকে নেমে সালমা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। এই সেই চেনা স্টেশন যেখানে সালমা আর সিরাজ হায়দার বাসের জন্য অপেক্ষা করতো। সেই স্টেশন আজ চেনাই যাচ্ছে না। বুকের ভেতর কেমন কেঁপে উঠলো সালমার।বাবা মা ভাইদের খুঁজে পাবে তো সালমা?
যদি না পায় তবে?

সিরাজ হায়দারের হাত ধরে সালমা হাটতে লাগলো। এই সেই হাত,যেই হাত ধরে একদিন এই শহর ছেড়ে চলে গিয়েছে আজ আবার সেই হাত ধরেই শহরে ফিরেছে। যাদের ছেড়ে গিয়েছে এক সময় আজ তাদের খুঁজতে এসেছে। শুধু মাঝখানে কেটে গেছে অনেক বছর।

পথে পথে ঘুরতে ঘুরতে কেটে গেছে অনেক সময় কিন্তু যেই উদ্দেশ্যে শহরে এসেছে সেই উদ্দেশ্য পূরণ হয় নি। সারাদিন পথে পথে ঘুরে সন্ধ্যায় দুজনে শাহবাগে একটা হোটেলে উঠলো।
হোটেলের সাদা বিছানায় শুয়ে সিরাজ হায়দার চিন্তা করতে লাগলেন জীবনের কতো রঙ হতে পারে!
কখনো কি ভেবেছেন তিনি স্ত্রীকে সাথে নিয়ে পথে পথে ঘুরবেন নিজের শ্বশুরালয় খোঁজার জন্য?

সালমা তখনও বিছানায় পিঠ লাগান নি।এতো গুলো বছর বুকের ভেতর সযত্নে যেই কষ্ট লুকিয়ে রেখেছেন, আজ তা প্রকাশ হতে চলেছে। বাবা মায়ের সাথে দেখা করার জন্য মনটা অস্থির হয়ে থাকতো কিন্তু ভয় ছিলো বাবা মা’কে খুঁজতে এলে যদি না পান খুঁজে।
আজ সেই ভয় সত্যি হতে চলছে।

————–

অনামিকা কলেজের উদ্দেশ্যে বের হয়েছে সকাল সকাল।বাবা মা বাড়িতে নেই আজ।এই সুযোগ অনামিকার শাহেদের সাথে দেখা করার।শাহেদের দেওয়া ফোনটা লুকানো স্থান থেকে বের করে অনামিকা কল দিলো শাহেদকে।
কলেজের সামনে দোকানে বসে শাহেদ চা খাচ্ছিলো।মন মেজাজ বিগড়ে আছে তার ভীষণ। সকাল সকাল বাবার সাথে একচোট লেগে গেছে তার।
সকালে ঘুম থেকে উঠে শাহেদ খেতে বসছিলো।হাসানুজ্জামান তার চালের দোকানে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে বের হচ্ছিলেন সেই মুহুর্তে ছেলেকে দেখে তার রাগ উঠে গেলো। শাহেদের হাত থেকে খাবার প্লেট উঠানে ছুড়ে ফেলে গালি দিয়ে বললেন,”..*র পোলা,আজাইরা বাপের হোটেলে বইসা বইসা খাইতে খুব ভালা লাগে?নিজে গতরে বাতাস লাগাইয়া ঘুরে।দা/মড়া পালতেছি আমি।নিজে কামাই কইরা যেদিন টাকা দিতে পারবি সংসারে সেদিন খাবার খাবি।পড়ালেখা করবো সে,আমি বিদ্যাশ পাঠাইতে চাইছি গেলো না।পাশের বাড়ির ইদ্রিসের পোলা কুদ্দুস সৌদি গেছে সেই সময়। এখন সে প্রত্যেক মাসে ৩০ হাজার টাকা বেতন পায়।ইদ্রিসের দুই চালার ঘর এখন চারচালা হইছে।
আর আমার জন লেখাপড়া করবো,চাকরি করবো।তোর চাকরির মায়েরে আমি **।”

বাবা ছেলের ধুন্ধুমার ঝগড়া শুনে শাহেদের মা রোজিনা এসে ছেলেকে টেনে ঘরে নিয়ে গেলো। শাহেদ ঘরে আর দাঁড়ালো না। বের হয়ে গেলো ঘর থেকে।

অনার্স পাস করে বেকার ঘুরে বেড়াচ্ছে বলে ছেলের উপর হাসানুজ্জামানের প্রচন্ড ক্ষোভ।ইন্টার পাস করার পর হাসানুজ্জামান শাহেদকে সৌদি আরব পাঠিয়ে দিতে চেয়েছেন।শাহেদ আর তার মা রোজিনা কিছুতেই রাজী হয় নি তার সিদ্ধান্তে। শাহেদ পড়তে চেয়েছিলো,একমাত্র ছেলেকে রোজিনা ও দূরে যেতে দিতে চান নি।যার কারণে সময়ে অসময়ে হাসানুজ্জামান কথা শোনান তাদের।রোজিনা ও কম কথা শোনান না এখন ছেলেকে।
ঘরে তিন মেয়ে উপযুক্ত হয়ে উঠছে অথচ সংসারে উপার্জন নেই।আদর করে ছেলেকে দেশে রেখে দিয়ে এখন নিজেও পস্তাচ্ছেন।

অনামিকার কল পেয়ে শাহেদ বললো, “আমি কলেজের সামনেই আছি,তুমি আসো।”

অনামিকা দুরুদুরু বুকে গেলো কলেজের উদ্দেশ্যে। দূর থেকে শাহেদকে দেখে অনামিকার মন খুশিখুশি হয়ে উঠলো। ফর্সা,গোলগাল ছেলেটাকে দেখলেই অনামিকার মন খুশিতে ভরে উঠে ।

শাহেদ আগে আগে হাটছে,পিছন পিছন অনামিকা হাটতে হাটতে কথা বলতে লাগলো। থু করে এক দলা থুথু ফেলে শাহেদ বললো, “বিদেশে চইলা যাওনের সিদ্ধান্ত নিয়া নিছি অনামিকা।কি কও তুমি? এই দ্যাশে থাইকা কি করমু?কোনো ভবিষ্যৎ নাই।চাকরির পিছনে তো কম ছুটি নাই।মামু খালু ও নাই আমার, চাকরিও আমার ভাগ্যে নাই।”

অনামিকা মন খারাপ করে বললো, “আপনি বিদেশ চলে গেলে আমাদের সম্পর্কের কি হইবো?”

শাহেদ বিরক্ত হয়ে বললো, “ক্যান?সম্পর্ক কি বিদ্যাশ চলে গেলে থাকে না?”

অনামিকা চুপ করে থেকে বললো, “আপনি একবার গেলে আসতে তো অনেক দেরি হইবো।তো,ততদিনে যদি আমারে আব্বায় অন্য কোথাও বিয়ে দিয়ে দেয়?”

শাহেদ হেসে বললো, “এই চিন্তা নি করো?সেই চিন্তা আমি করে রাখছি।সেসব তোমার ভাবা লাগবে না।চলো নাশতা করবা।”

অনামিকা আৎকে উঠে বললো, “না না,আমার বাড়িতে যাওন লাগবো। আমি যাই।”

শাহেদ হেসে বললো, “ভয় পাও না-কি আমারে?ভয় পাইও না।আজকে আর চুমু খামু না।”

অনামিকা লজ্জায় লাল হয়ে গেলো শাহেদের কথা শুনে। গতবার শাহেদ আচমকা চুমু খেয়ে বসেছে অনামিকার ঠোঁটে।
আমতাআমতা করে অনামিকা বললো, “না তা না।বাড়িত আব্বা মা নাই,অনিতা একলা আছে।আমার যাওন লাগবো। ”

শাহেদ হেসে বললো, “রিকশা ঠিক কইরা দিই চলো।”

একটা রিকশা ডেকে শাহেদ অনামিকাকে উঠিয়ে দিলো।রিকশা ভাড়া দিয়ে বললো, “কাকা,সাবধানে নিয়া যাইয়েন।আপনাগো বৌমা কিন্তু,আস্তেধীরে গাড়ি চালাইয়া নিয়েন।”

লজ্জায় অনামিকা মুখ লুকালো।এই ছেলেটার এসব কথা অনামিকাকে ভালো লাগায় ভাসিয়ে দেয়।এতো ভালো লাগে কেনো?

সেই ভালোবাসার কাছে,ভালো লাগার কাছে মুহুর্তেই বিলীন হয়ে গেলো বাবার কান্না।অথচ অন্তরা পালিয়ে যাওয়ার পর অনামিকা ভেবেছিলো আর যোগাযোগ করবে না শাহেদের সাথে। এই সম্পর্ক ভেঙে দিবে শীঘ্রই। বাবাকে দ্বিতীয় বার যাতে এই কষ্ট পেতে না হয়

সব কিছু ভুলে শাহেদকে ভাবতে লাগলো অনামিকা।

চলবে…..

রাজিয়া রহমান

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে