#তুমি_অপরূপা(২৩)
মানুষের মন কচুপাতার পানির মতো। নয়তো যেই মেয়ে শাহেদের হাত ধরে সব ছেড়ে এসেছে সেই মেয়ে কিভাবে অন্য ছেলের সাথে এতো দ্রুত সখ্যতা গড়ে তুলতে পারে!
মনের মানুষের এতো দ্রুত পরিবর্তন হয় কিভাবে?
ইদানীং প্রতিদিন মিলন এই বাড়িতে আসে।যখন তখন চলে আসে।এসেই ভাবী,ভাবী করে অনামিকার খোঁজ করে।রোজিনা বেগম ব্যাপারটা বুঝেও না বুঝার মতো থাকেন।নির্লিপ্ত ব্যবহার করেন।দুজনকে সময় দেয়ার জন্য সরে যান সেখান থেকে।
দুজনে আরো ভালো করে যাতে সম্পর্কে মজে যায়।
এরমধ্যে অনামিকা তিন দিন কলেজের কথা বলে মিলনের সাথে বের হয়েছে। হাসানুজ্জামান দেখেছেন দুজনকে রিকশায়।
সব জেনেও দুজন চুপ করে আছে উপযুক্ত সময়ের।মোক্ষম সময়ে জাল গোটাবেন। যেই জাল হাসানুজ্জামান আর তিনি মিলে সযত্নে বিছিয়েছে এতো দিন ধরে। মাঝেমাঝে কথআর ফাঁকে শাহেদের কানে ও কথাটা তুলেছেন তিনি।শুনে শাহেদ বিরক্ত হয়ে বলতো,এসব শুনতে চাই না মা আমি।রোজিনা বেগম স্বস্তি পান।এটাই তো চেয়েছেন তিনি।তার কোলেপিঠে করে মানুষ করা ছেলে অন্য মেয়ে বিয়ে করবে তাদের মতামত ছাড়া, সেই মেয়ের জন্য তাদের সাথে মুখেমুখে তর্ক করবে এটা কিছুতেই সহ্য করার মতো না।
বারান্দায় বসে এসব ভাবতে লাগলেন রোজিনা বেগম। অনামিকা রান্না করছে রান্না ঘরে। সেই সময় মিলন এলো আবারও। রোজিনার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। মিলন রোজিনাকে দেখে ইতস্তত করে বললো, “কেমন আছেন চাচী,অনামিকা ভাবী কই?”
রোজিনাও সহজভাবে বললো, “আমি ভালা আছি বাবা,যাও ও রান্না করে। ”
রোজিনা বেগম বের হয়ে গেলেন বাড়ি থেকে।
দুপুরে হাসানুজ্জামান খেতে এলো।খাবার খেতে গিয়ে টের পেলেন আজকে রান্নায় লবণ একটু বেশি হয়েছে।
রোজিনা রণমুর্তি ধারন করলো।রেগে বললেন,”মন দিল কই দিয়া রান্না করতে বসছ হারা//মজা//দি, তোর বাপের মাথা রানছস।”
অনামিকার ভীষণ খারাপ লাগলো বাবাকে নিয়ে এভাবে বলায়।শান্তস্বরে বললো,”আমারে যা কওওনের কন আম্মা,আমার আব্বা আম্মা নিয়ে কথা কইয়েন না।”
আগুনে ঘি ঢেলে দিলো অনামিকার এই কথা।রোজিনার চিৎকার চেঁচামেচি শুনে আশেপাশের সবাই ছুটে এলো।অনামিকার নির্লিপ্ততা রোজিনার মেজাজ সপ্তমে উঠে গেলো।
চোখের পলকে ছুটে গিয়ে অনামিকার চুলের মুঠি ধরে কয়েকটা চড়থাপ্পড় লাগিয়ে দিলেন তিনি।অনামিকা হতভম্ব!
রোজিনার এমনে রাগ করবেন অনামিকার উপর। তাই সুযোগ পেলেই অনামিকার গায়ে হাত তোলেন তিনি।অনামিকা সেটা মেনে নিয়েছে।কিন্তু এভাবে এতো মানুষের সামনে ব্যাপারটা অনামিকা মানতে পারলো না। ছুটে গিয়ে নিজের রুমে উপুড় হয়ে কাঁদতে লাগলো।
রোজিনা বেগম হাসানুজ্জামানকে বললেন,”অনেক হইছে,এবার একটা ব্যবস্থা নেন।আমার আর সইয্য হইতেছে না এই ফকিন্নির মাইয়ারে।”
হাসানুজ্জামান ভেবে বললেন, ঠিক আছে।আগামীকাল মিলন যখন আইবো তখনই ধরমু দুইটারে।”
কিন্তু বিধি বাম। বিকেলেই ঘটে গেলো আরেক ঘটনা। অনামিকার বাবা সিরাজ হায়দার এলেন বিকেলে শাহেদদের বাড়িতে।অনামিকা তখনও নিজের রুমে।
হাসানুজ্জামান বারান্দায় বসে সিগারেটে সুখটান দিচ্ছেন।
সিরাজ হায়দার এসে গম্ভীর স্বরে বললেন,”অনু,অনু মা।”
হাসানুজ্জামান আগের মতো ভঙ্গিতে বসে আছেন।যেনো উঠানে কেউ নেই,অথবা কুকুর বেড়াল কিছু এসে দাঁড়িয়েছে তাই তাকানোর দরকার নেই।
অনামিকা ছুটে এসে বাবার বুকে ঝাপিয়ে পড়লো। মনের আগল খুলে বাবাকে ধরে কাঁদতে লাগলো। এই কান্না আনন্দের কান্না,বাবার মুখে নিজের আদুরে নাম শোনার কান্না।
রোজিনা ঘ্র থেকে বের হয়ে এলেন।সিরাজ হায়দার মেয়ের কান্না থামতেই বললেন,”চল,আমি তোকে নিয়ে যেতে আসছি।”
রোজিনা হুঙ্কার দিয়ে বললো, “আপনে কে ওরে নেওনের?
কার অনুমতি নিয়া ওরে নিতে কন।ও কোনোখানে যাইবো না।”
সিরাজ হায়দার বললেন, “ক্যান,ফিরিতে কামের মাইয়া পাইছেন এখন চইলা গেলে বিপদে পইরা যাইবেন?”
রোজিনা চিৎকার করে বললো, “কি কইলেন আপনে?
আপনার মতো ফকিরের মাইয়া আমার বাড়িতে আইছে এইডাই তো আপনের সৌভাগ্য। আপনের মাইয়ারে যে দুই লাত্থি মাইরা আমার পোলা এখনো বাড়ি থাইকা বাইর করে নাই তার লাইগা শোকর করেন।”
আশেপাশের মানুষ আবারও ছুটে এলো রোজিনার চিৎকারে।
সিরাজ হায়দার শান্ত স্বরে বললেন,”আমার মাইয়ারে আপনে কোন কারনে বাড়ির বাইওর করবেন।মুঝ সামলাইয়া কথা কন।নয়তো যেই মুখ আমার মাইয়ারে নিত্যদিন গালিগালাজ করে সেই মুখ আর যেই হাত আমার মাইয়ার গায়ে উঠে সেই হাত ভাঙতে আমি এক মুহূর্ত দেরি করমু না।”
সিরাজ হায়দারের রক্তচক্ষুর দিকে তাকিয়ে রোজিনা কিছুটা ভয় পেয়ে গেলেন।বারান্দায় উঠে গিয়ে বললেন,”নিবেন ই তো,নষ্টা মাইয়া পয়দা করছেন।শিখাইছেন পোলাগো মাথা খাওন,আমার পোলার মাথা খাইছে এখন আবার পরকীয়া শুরু করছে পাশের বাড়ির পোলার লগে।এক সপ্তার মধ্যেই আমার পোলা ডিফোজের কাগজ পাঠাই দিবো।”
সিরাজ হায়দার বললেন, “অপেক্ষায় থাকলাম,আপনে ও অপেক্ষায় থাকেন। ”
আর না দাঁড়িয়ে মেয়ের হাত ধরে বের হয়ে গেলেন।অনামিকা বাড়িতে গিয়ে দেখলো সালমা ঘরের এক কোণে গুটিশুটি মেরে বসে আছে। অনামিকা মা বলে ডাকিতেই আরো গুটিয়ে গেলো।আপনা আপনি বলতে লাগলো, “নাই নাই,অন্তু নাই,অনু নাই কেউ নাই।রূপা মইরা গেছে।নাই নাই।”
অনামিকার কি যেনো হলো।মায়ের দুই পা জড়িয়ে ধরে ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো, “আমারে মাফ কইরা দাও গো মা,ও আল্লাহ আমারে মাফ কইরা দেন।আমার ভুলের লাইগা আমার মা এতো কষ্ট পাইতাছে।আমার সুস্থ মা অসুস্থ আইজ আমার কারনে।আমারে আপনি লইয়া যান তাও আমার মা’রে সুস্থ করেন।”
সিরাজ হায়দার মেয়েকে রেখে দোকানে চলে গেলেন।
অনামিকা চলে যেতেই রোজিনা স্বামীর পাশে বসে বললেন, “কি হইলো এইডা?এতো দিন ধইরা ভাইবা রাখছি কি,অথচ শেষ সময়ে আইসা এমনে নিয়া যাইতে দিলেন আপনে?
এই মাইয়ারে জুতার মালা পরাইয়া আমি বিদায় দিতাম।কি হইছে আপনার, আপনে একটা কথাও তো কইলেন না।”
হাসানুজ্জামান বললেন,”পাগল নি,দুইজন মিইল্লা কথা কইলে গেরামের সবাই আমাগো বিরুদ্ধে চইলা যাইতো। পরবর্তীতে কিছু হইলে সবাই আমাগো দোষ দিতো। তাছাড়া ওই মাইয়ারে বাইওর করন আমাগো উদ্দেশ্য আছিলো, যেমনেই হোক গেছে তো।পোলার লগে এখন মধুর ব্যবহার করবা।পোলারে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসা লাগবো। ”
————–
কলেজে যাওয়ার আগে রূপা বাবার সাথে কথা বলে জানতে পারলো, গতকাল মেজো আপা এসেছে। শুনে রূপা কিছুটা স্বস্তি পেলো। বড় আপা মেজো আপা একজন থাকলেও মা একটু সুস্থ হতে পারে।
শুধু রূপাকেই যেনো তিনি সহ্য করতে পারেন না।
ঢাকায় আসার আগে সালমার অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যায়। রূপাকে দেখলেন তেড়ে যেতেন খু/ন করার জন্য । বটি নিয়ে ছুটতেন।রূপা ভেবে পায় না কোনো দোষ না করেও সে কেনো দোষী!
কলেজে আজকে শুক্রবারে একদিনের ট্যুরে যাবার ঘোষণা দিলো।জনপ্রতি ফি ১২০০ টাকা।শুনে রূপার গলা শুকিয়ে গেলো। ১২০০ টাকা ওর কাছে ১২০০০ টাকার মতো।ট্যুরের নাম শুনে মনে জ্বলে উঠা উচ্ছ্বাস মুহূর্তে ফাটা বেলুনের ন্যায় চুপসে গেলো।
কলেজ ছুটি হতেই পান্না বললো, “রূপা,যাবি তো ট্যুরে? উফফ,ভীষণ আনন্দ করবো আমরা তিনজন মিলে।আমার তো আর সহ্য হচ্ছে না।”
রূপা হেসে বললো, “হ্যাঁ, অনেক আনন্দ হবে।”
মনে মনে বললো, “সবার সব শখ পূর্ণ হতে নেই। ”
কলেজ ছুটি হবার দুই ঘন্টা আগে এসে সমুদ্র দাঁড়িয়ে আছে কলেজের একটু দূরে। আজকে যাই হয়ে যাক সে রূপার সাথে কথা বলবেই।না হলে প্রাণ যায় যায় তার।রূপা মাথার ভেতর কেমন উদ্দাম নৃত্য করে বেড়াচ্ছে। সমুদ্রের সহ্য হচ্ছে না আর এতো ব্যথা।রূপা ছাড়া কিছুই ভাবতে পারছে না।রুটিন মতো চলা মানুষটির সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেলো শুধু একটি মেয়ের জন্য।
সমুদ্রের মা ও টের পেলেন ছেলের পরিবর্তন। যেই ছেলে ঘড়ি ধরে ঘুমাতে যায় আবার এলার্ম শুনে জেগে উঠে। রোজ নিয়ম করে মর্নিং ওয়াক করে। ডায়েট চার্ট ফলো করে খাবার খায়,সর্বদা হাস্যোজ্জ্বল থাকে সেই ছেলেটা কেমন ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। তার চোখের নিচে কালো দাগ,খাবারে অনিয়ম,গালভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি, উষ্কখুষ্ক চুল।
এ যেনো অন্য মানুষ, তার ছেলে সমুদ্র নয়।
রেখার ভেতরে ভেতরে ভীষণ ভয় হয়।সমুদ্রের মধ্যে তিনি কবিরের ছায়া খুঁজে পাচ্ছেন।কবির তার একমাত্র দেবর।যে একজনকে ভালোবেসে তাকে না পেয়ে সব ছন্নছাড়া হয়ে গেছে।বিয়ে নামক শব্দটা যে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে।
নয়তো কতো বছর কেটে গেলো কবির বিয়ে করলো না।দেশে ও আসে না।তার এক কথা, মনে একজনকে রেখে অন্য কারো সাথে সংসার সংসার খেলা সে খেলতে পারবে না।
রেখার ভীষণ ভয় হয়,সমুদ্র ও সেই পথের পথিক নয়তো!
কলেজ ছুটি হতেই সমুদ্র হাটতে শুরু করে। কিছুটা পথ গিয়ে রাস্তা পার হয়ে রূপার পিছনে গিয়ে নরম স্বরে বললো, “রূপা,তোমার সাথে একটু কথা বলার ছিলো। রতজা,পান্না একটু সামনে যাও তোমরা। ”
রত্না সমুদ্রকে দেখে পান্নার হাত ধরে দ্রুত পা চালাতে লাগলো। দাদা যাকে অপছন্দ করে, তারা দুই বোনও তাকে অপছন্দ করে। দাদার চাইতে বেশি অপছন্দ করে।
রূপা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। সমুদ্র নরম হয়ে বললো, “আর কতো পোড়াবে আমাকে তোমার বিরহে?
এতো পুড়লে সোনা ও আরো আগে খাঁটি হয়ে যেতো। আমার ভেতর বাহির সবটা পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে রূপা।আমি আর পারবো না।একটু কথা বলো, আমি তোমার কথার তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে মরে যাচ্ছি। আমাকে এভাবে আর কষ্ট দিও না।কবে যেনো তোমাকে নিজের চাইতে বেশি ভালোবেসে ফেলেছি রূপা।”
রূপার মায়া হলো সমুদ্রের এই করুণ আকুতি শুনে। বড় আপা, মেজো আপা কি এরকম কথা শুনেই ভুল পথে পা বাড়িয়েছে!
রূপার ভাবনার মধ্যেই চমকে উঠলো বাইকের তীব্র হর্ণ শুনে।রূপক রূপার পেছনে দাঁড়িয়ে হর্ণ দিচ্ছে।
চমকে উঠলো রূপা রূপককে দেখে,সেই সাথে কিছুটা ভয় ও পেলো।রূপকের সাথে রূপার সম্পর্ক অনেকটা বন্ধুর মতো। বিশেষ করে মাহির সামনে দুজন একেবারে রসগোল্লার মতো মিষ্টি মধুর ব্যবহার করে।
রূপকের ভীষণ রাগ হলো রূপাকে সমুদ্রের সাথে কথা বলতে দেখে।রূপক জানে না কেনো সে প্রতিদিন আড়ালে থেকে রূপাকে পাহারা দেয়।রূপক এটুকু জানে একমাথা তেল দেওয়া দুই বিনুনি করা মেয়েটাকে খোলা চুলে দেখলে রূপকের কাছে গ্রীক দেবীর মতো লাগে।যখন মেয়েটা রিনরিনে সুরে হেসে উঠে, রূপকের তখন হাসির ঝঙ্কারে কেমন নেশা নেশা লাগে।দুচোখ ভর্তি কাজল দেখলে রূপকের মনে হয় কাজল নয় তা,দুচোখ ভর্তি মায়া যেনো।
সমুদ্র যে বাসার নিচে,কলেজের বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকে সবই রূপক জানে।এভাবে রূপাকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে কথা বলতে যাওয়ায় রূপক এগিয়ে এসেছে।
গম্ভীরমুখে বললো, “বাইকে উঠে বসো অপরূপা।”
রূপার এই মুহূর্তে সমুদ্রের সামনে থেকে সরে যাওয়া ভীষণ প্রয়োজন। সেজন্য রূপকের সাথে যাওয়ার চাইতে বেটার অপশন রূপা পেলো না।
আস্তে করে বললো, “আমি বাইকে কখনো উঠি নি,কিভানে উঠবো। ”
রূপক বললো, “বাইকে উঠে বসা ভীষণ সহজ,মাঝরাস্তায় অচেনা কোনো ছেলের সাথে কথা বলার চাইতে ও সহজ।”
রূপা ভীষণ লজ্জা পেলো এই কথা শুনে। রূপক কি ভাবছে রূপাকে!
রূপা প্রতিদিন ছেলেদের সাথে এভাবে দাঁড়িয়ে কথা বলে এরকম ভাবছে না তো রূপক!
কথা না বাড়িয়ে রূপককে ধরে উঠে বসলো রূপা বাইকে।চিলের মতো ছোঁ মেরে রূপক রূপাকে সমুদ্রের সামনে থেকে নিয়ে গেলো।অপমান আর হতাশা নিয়ে সমুদ্র দাঁড়িয়ে সবটা দেখতে লাগলো।
বাসার দিকে না গিয়ে রূপক অন্য দিকে যাচ্ছে দেখে রূপা উৎকণ্ঠিত হয়ে বললো, “কোথায় যাচ্ছেন আপনি?”
রূপক শান্ত স্বরে বললো, “সমুদ্রের সাথে কিসের কথা তোমার?আর কখনো যাতে না দেখি কোনো ছেলের সাথে কথা বলেছো।আমার এসব পছন্দ না।”
রূপা ভ্রুঁ কুঁচকে বললো, “কেনো?আপনার ভালো লাগে না কেনো?আপনার ভালো না লাগলে আমার কী?”
রূপক জবাব না দিয়ে হঠাৎ করে ব্রেক কষলো, ব্রেক করায় রূপা তাল সামলাতে না পেরে রূপকের পিঠের উপর এসে পড়লো। রূপক গান ধরলো, “এই পথ যদি না শেষ হয়……”
বাইক স্টার্ট দিতেই রূপা সরে বসলো। রূপক হেসে আপনমনে বললো, “তুমি সুখ না হইয়া দুঃখ হও!
তাও-অন্যের না হইয়া আমার হও।”
চলবে……
রাজিয়া রহমান
#তুমি_অপরূপা(২৪)
রাতের আকাশে উজ্জ্বল তারারা কেমন মিটিমিটি হাসছে আজ।রূপক অস্থির হয়ে পায়চারি করছে।
মন অশান্ত হয়ে আছে।কিছুতেই নিজেকে শান্ত করতে পারছে না সে।
বারবার বিবেকের দংশনে দংশিত হচ্ছে। বিবেক বারবার বলছে,সে ভুল করছে।প্রিয় বন্ধুর ভালোবাসা ছিনিয়ে নেওয়ার মতো ন্যাক্কারজনক কাজ দ্বিতীয় কিছু নেই।
কিন্তু বেহায়া মন কিছুতেই তা মানতে চাচ্ছে না।মন বারবার বুঝাতে চাচ্ছে যে না এটা কোনো ভুল না।এমন তো নয় রূপা সমুদ্রকে ভালোবাসে,যদি এমন হতো রূপাও সমুদ্রকে চায় সেখানে রূপক মাঝখানে ঢুকে পড়ছে তাহলে মন মেনে নিতো।কিন্তু এখন ব্যাপারটা তেমন তো নয়।রূপা পদ্মবিলের কাঁটাযুক্ত পদ্ম,কাঁটার আঘাত সহ্য করে যে তাকে তুলতে পারবে সে-ই পাবে তাকে।সেখানে সমুদ্রের অগ্রাধিকার কিসের!
রূপকের অসহ্য লাগছে সব।কি করবে সে?এতো টানাপোড়েন কেনো তার!
সমুদ্র কে তার?কেউ না সমুদ্র।প্রাণের বন্ধুত্ব বলতে কিছু হয় না এই দুনিয়ায়, সবাই স্বার্থপর।
সবাই নিজেকে নিয়ে ভাবে।অযথা সে কেনো সমুদ্রের কথা ভাবতে যাবে!
সমুদ্র কি ভেবেছিলো সেদিন রূপকের কথা?
————–
পাশের মতো মহল্লার সাথে ফুটবল খেলে ফিরছিলো রূপকদের টিম। ৩-১ গোলে রূপকেরা জিতেছে। এর মধ্যে ২ টা রূপক দিয়েছে। টিমের বেস্ট খেলোয়াড় না শুধু,আশেপাশের মহল্লার মধ্যে বেস্ট খেলোয়াড়ের নাম জিজ্ঞেস করলে সবার আগে সবাই রূপকের নাম নিবে।ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন,বাস্কেটবল,ক্যারাম সব কিছুতেই রূপক সেরা।
সমুদ্র এসবের মধ্যে নেই।তার শুধু একটাই প্রিয় খেলা।তা হচ্ছে দাবা।
সেদিন ও সমুদ্র দর্শকের আসনে বসে প্রিয় বন্ধুকে উৎসাহ দিচ্ছিলো।চশমা পরা শান্তশিষ্ট, গোলগাল ছেলেটা যখন দর্শকের আসনে বসে বন্ধুকে উৎসাহ দিচ্ছে সেই মুহুর্তে তার সাইলেন্ট থাকা ফোনটা বেজেই চলেছে। একবার, দুইবার, তিনবার….
পরপর ১৬ টা কল এলো সমুদ্রের মা রেখার ফোন থেকে।
অত্যন্ত রাগান্বিত হয়ে রেখা ছেলেকে বারবার কল দিয়ে যাচ্ছে। আজকে সমুদ্রকে বাসায় ভীষণ প্রয়োজন তার।
কবির কল করেছিলো বহুদিন পর।প্রায় ৭ মাস পর কবিরের কল পেয়ে রেখা ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়ে। এক কথা, দুই কথায় রেখা জানতে পারে কবিরের নানে থাকা সব সম্পদ কবির একটা বৃদ্ধাশ্রমে দান করতে চায় এবং শেষ বয়সটাও সেই বৃদ্ধাশ্রমে কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
কবিরের একমাত্র দুর্বলতা সমুদ্র।কেননা এই ছেলেটাকে তিনি কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন।
সমুদ্র ফোন হাতে নেয় খেলা শেষ হবার পর।মায়ের এতো কল দেখে কিছুটা ভড়কে যায় সমুদ্র।
ঘেমে-নেয়ে রূপক এসে শক্ত করে সমুদ্রকে জড়িয়ে ধরে বললো, “জিইত্তা গেছি দোস্ত! ”
সমুদ্র মুখ পাংশু করে বললো, “আমার খবর আছে দোস্ত। আজকে বাসায় গেলে মায়ের হাতের মার মিস হবে না।দেখ,কতো কল দিয়েছে। নিশ্চয় ইমারজেন্সি কিছু ছিলো। ”
রূপক নিজের মুখের ঘাম মুছতে মুছতে বললো, “তাড়াতাড়ি বাসায় যা তাহলে। ”
সমুদ্র একটু চুপ থেকে বললো, “তুই ও আয় না আমার সাথে। মনে হচ্ছে কোনো ঝামেলা হয়েছে। ”
রূপকদের টিম সহ সবাই নিজেদের মহহল্লার দিকে গেলো বিজয় উল্লাস করতে করতে।সমুদ্রের চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে রূপক হেসে মনে মনে বললো, “বেচারা,এখনো স্কুলে পড়ে ছোট বাচ্চা রয়ে গেছে। এখনো মা’কে কেমন ভয় পায়!”
বাসায় গিয়ে দেখলো রেখা অস্থির হয়ে পায়চারি করছে। সমুদ্রের কেমন যেনো পরিস্থিতি থমথমে মনে হলো। রূপকের ও মনে হলো কিছু একটা হয়েছে।
রেখা ছেলেকে দেখে রেগে বললো, “কোথায় ছিলে তুমি সমুদ্র!তোমাকে আমি কতোবার কল করেছি তোমার কোনো আইডিয়া আছে?
বাউন্ডুলে ছেলেদের সাথে সবসময় ঘুরে বেড়াও,তোমার এতো অধঃপতন কিভাবে হলো! ”
রেখার কথাগুলো রূপকের গায়ে ভীষনভাবে বিঁধলো।বাউন্ডুলে কাকে বলছে উনি!
তবুও হেসে রূপক বললো, “আসলে আন্টি,আমাদের ফুটবল ম্যাচ ছিলো তাই সমুদ্র ও ওখানে গিয়েছিলো। আর এতো হইহট্টগোল ছিলো যে ও শুনতে পায় নি রিংটোন।”
রূপকের কথা শুনে রেখার মেজাজ সপ্তমে উঠে গেলো। ভীষণ রেগে গিয়ে বললো, “বেয়াদব ছেলেদের সাথে ঘুরাঘুরি করে বেড়াও বলেই এতো অধঃপতন হচ্ছে দিনদিন তোমার। আমার এতো কল দেখে তুমি কল ব্যাক করার প্রয়োজন ও মনে করলে না!
করবে কেনো,চলাচল তো করো সেইসব থার্ডক্লাশ ছেলেদের সাথে যারা নিজের বাবা-মাকে রেস্পেক্ট করে না।তোমার থেকে রেস্পেক্ট আশা করাও বৃথা।”
মায়ের কথা শুনে সমুদ্রের কান ঝাঁঝাঁ করে উঠলো লজ্জায়।রূপককে যে উদ্দেশ্য করে মা এসব বলছে তা সমুদ্র বুঝতে পারছে।হঠাৎ কি হল মায়ের!
রূপককে এভাবে কথা বলছে কেনো মা!
ভেবে পেলো না সমুদ্র।
রেখার ততক্ষণে ঠিক বেঠিক চিন্তাভাবনা লোপ পেয়েছে। আগের মতো উত্তেজিত হয়ে বললো, “আর তুমি, তোমার সাথে তো আমি কথা বলছি না।আমি আমার ছেলেকে আস্ক করছি তুমি মধ্যে ইন্টারফেয়ার কেনো করছো!
তোমাদের জন্য আমাদের একটা ফ্যামিলি শেষ হয়ে গেলো। ”
রূপকের এসব অপমান হজম করতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।কিন্তু প্রিয় বন্ধুর দিকে তাকিয়ে এসব হজম করা তার জন্য কোনো ব্যাপার না।
কিবতু রেখার শেষ কথাটা কেমন খটকা লাগলো রূপকের।তাই জিজ্ঞেস করলো, “আমাদের জন্য মানে?আমরা কি করেছি আপনাদের?”
রেখা তখন ভেবে চিনতে কথা বলার সিচুয়েশনে নেই,এতো টাকার প্রপার্টির চিন্তায় সে মশগুল। তাই ক্রুদ্ধ স্বরে বললো, “কেনো তুমি জানো না?তুমি জানো না সমুদ্রের চাচা কবির যে কেমন ছন্নছাড়া হয়ে গেছে। কার জন্য হয়েছে এরকম ছন্নছাড়া ও?
কে করেছে তাকে এইরকম?
তোমার ফুফু সালমা করেছে। কবির শুধু ওকে ভালোবেসেছে। আর সেই এক তরফা ভালোবাসা তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সালমার সাথে ওর বিয়ে ও ঠিক হয়।কিন্তু সালমা পালিয়ে যায়। এরপর থেকে কবির গৃহত্যাগী হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কতো বড় দুশ্চরিত্র হলে একটা ছেলের সাথে পালিয়ে যাওয়ার সাহস করে তোমার ফুফু।আমি যদি জীবনে কোনো দিন ওই মহিলার দেখা পাই তবে ওর মুখে থুঃ দিয়ে বলবো, ভীষণ অহংকার ছিলো রূপের,রূপ দিয়ে আমার দেবরের মাথা খেয়েছিস সেই রূপে আমি থুঃ ফেলি।”
রূপকের কাছে তার ফুফু শব্দটা একটা ইমোশন।এক সময় ফুফুর ভীষণ আদর পেয়েছে সে।যদি খুবই ছোট্ট ছিলো কিন্তু তার সাক্ষী দেয় বাসার পুরনো ছবির এলবাম। সব ছবিতে দেখা যায় রূপক তার কোলে।যখন রূপক বুঝতে শিখেছে ততদিনে ফুফু হারিয়ে গেছে, ভীষণ মিস করে রূপক ফুফুকে।রূপকের ফুফুর প্রতি এই অগাধ মায়া, ভালোবাসা দেখেই রূপকের দাদা সালমার ওয়ারিশি সম্পদ রূপকের নামে দিয়ে যায়। তিনি জানতেন তার নাতি কখনো বেইমানি করবে না।
না রূপক করে নি বেইমানি। কার সাথে করবে?নিজের রক্তের সাথে!
নিজের রক্তের সাথে যে বেইমানি করে, নিঃসন্দেহে পৃথিবীর নিকৃষ্ট মানুষ সে।
রেখার কথায় রূপকের ততক্ষণে মাথা গরম হয়ে গেছে। রেখার কথার জবাবে রূপক ও নিজেকে সংযত করে বললো, “আন্টি,আমার ফুফুকে নিয়ে আর একটা যদি বাজে কথা বলেছেন তবে ভীষণ খারাপ হবে।আমার ফুফু তো কাউকে মাথার দিব্যি দেয় নি যে তাকে না পেলে সব ছেড়েছুড়ে যেতে হবে।যে গিয়েছে সেটা তার ব্যাপার।আমার ফুফুর না।
আপনি সমুদ্রের মা বলে আমি এখনো চুপ করে আছি আন্টি,তা না হলে আপনার জায়গায় অন্য কেউ হলে আমি এতক্ষণে তার জিহবা টেনে ছিড়ে ফেলতাম।আমার মাথা গরম করবেন না আন্টি প্লিজ।”
রূপক যে এরকম বেয়াদব রেখা আগে বুঝেন নি,তার মুখেমুখে তর্ক করছে এই ছেলে!
যেখানে তার ছেলে তার দিকে তাকিয়ে কথা ও বলে না। রাগান্বিত হয়ে হাত তুললেন রূপককে থাপ্পড় দেওয়ার জন্য। রূপক ও রেখার হাত ধরে ফেললো, রাগের মাথায় রেখার হাত ঝাড়া দিতেই রেখা দুই পা পিছনে চলে গেলেন তাল সামলাতে না পেরে।
সমুদ্র কখনো মায়ের সাথে তর্ক করার সাহস ও করে নি, সেখানে রূপককে তার মায়ের সাথে এরকম অভদ্রতা করতে দেখে সমুদ্রের ভীষণ রাগ হলো। রূপকের শার্টের কলার চেপে ধরে বললো, “তোর এতো বড় সাহস রূপক,আমার মায়ের সাথে বেয়াদবি করছিস?”তোর এতো সাহস কিভাবে হলো রূপক?তুই তোর মা’কে অসম্মান করিস বলে ভাবিস না আমি ও আমার মা’কে অসম্মান করি।সবাইকে তোর মতো গুন্ডা, বদমাস ভাবিস না-কি তুই?
এতো দিন বাহিরে গুন্ডামী করতি আর আজ আমার সামনে আমার মায়ের সাথে? তোর জায়গায় অন্য কেউ হলে আমিও এই হাত ভেঙে দিতাম।”
রূপক ভীষণ অবাক হলো সমুদ্রের কথা শুনে। সমুদ্র তাকে গুন্ডা বলছে!
অথচ রূপক সবচেয়ে বেশি গুন্ডামী করেছে সমুদ্রকে প্রটেক্ট করতে গিয়ে। স্কুলের ছেলেরা যখন সহজ সরল, শান্ত সমুদ্রকে নিয়ে মজা করতো, ক্ষেপাতো তখন কে দাঁড়াতো ওদের সামনে বুক ফুলিয়ে?
রূপক-ই তো দাঁড়িয়েছে বুক ফুলিয়ে। কি করে নি সে সমুদ্রের জন্য? পরীক্ষায় সেকেন্ড পজিশন হলে সমুদ্রের মন খারাপ হয়,বাসায় মায়ের বকাবকি শুনতে হয় বলে নির্দ্বিধায় কতো পরীক্ষা রূপক খারাপ দিয়েছে তা কেউ কি জানবে কখনো?
সমুদ্র তো জানতো রূপক ফুফুর জন্য সবসময় কতো আফসোস করে, সমুদ্র কি বুঝে নি তার মায়ের কথাগুলো রূপকের বুকের কতো গভীরে গিয়ে লেগেছে!
শান্ত স্বরে রূপক বললো, “আজকের পর থেকে তোর সাথে আমার কোনো বন্ধুত্ব নেই।আমি জেনে নিবো আমার কোনো বন্ধু ছিলো না। ”
সমুদ্রের ও রাগ হলো। সেও বলে দিলো,”আমার মা’কে যে সম্মান করতে পারে না, আর যাই হোক আমার বন্ধু হবার যোগ্যতা তার নেই।আমার আফসোস হচ্ছে আমি এতো দিন ধরে যাকে বন্ধু ভেবেছি তার আসল রূপটা আরো আগে দেখি নি বলে। আর যেনো তোকে আমার আশেপাশে না দেখি।”
————–
রূপকের চোখ জ্বালা করছে। কেনো ভাবছে এসব সে!
কেনো সে রূপাকে ভালোবেসে ও সরে যাবে!
কেনো সবসময় তাকেই স্যাক্রিফাইস করতে হবে?
না পারবে না। কিছুতেই না।
বিবেক যতোই বলুক,যতোই খারাপ লাগুক,নিজের ভালোবাসা রূপক এভাবে ছেড়ে দিবে না।সে রূপাকে সত্যি ভালোবাসে।
চলবে…..
রাজিয়া রহমান
#তুমি_অপরূপা (২৫)
অনামিকা আসার পর থেকে সালমার অবস্থার কিছুটা উন্নতি হতে লাগলো। সারাক্ষণ অনামিকা মা মা করে ব্যস্ত রাখে সালমাকে।প্রথম প্রথম সালমা লুকিয়ে যেতো, পালাতে চাইতো অনামিকার থেকে।কিন্তু মাতৃত্বের টান,বড় টান।
মা বলে ডাকার মধ্যে একটা অদ্ভুত শক্তি আছে।অনামিকা আর অনিতা দুজন মিলে যখন দুই পাশ থেকে ঝাপটে ধরে সালমা কে তখন অদৃশ্য কোনো বন্ধনে সালমা বাঁধা পড়ে যায় বুঝতে পারে না। তার মনে হয় এরা তার খুব আপন কেউ।
দিন যায় আর অনামিকার চিন্তা বাড়ে।সে যখন চলে যাবে মা’য়ের কাছে কে থাকবে তখন?
১ সপ্তাহ পর…….
শাহেদ ভিডিও কল দিলো বাবা মা’কে। গতমাসে বাবার জন্য একটা স্মার্ট ফোন পাঠিয়েছে শাহেদ।তারপর থেকে বাবা মায়ের সাথে ভিডিও কলে কথা হয়।ইতোমধ্যে শাহেদের ফুফাতো বোনকে ও নিয়ে আসা হয়েছে। রোজিনা বারবার ভিডিও কলে তাকে দেখায়।শাহেদ স্বতঃস্ফূর্তভাবে কথা বলে।
কথা বলতে বলতে রোজিনা পুরনো কাসুন্দি ঘাটতে বসেছেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “বাবারে,কি কান্ড ঘটাইছে তোর বউ গেরামের সকল মানুষ সাক্ষী আছে। মিলনের লগে কেমন ঢলাঢলি তা সকলে জানে।আমাগো মান ইজ্জত আর নাই।বাপধন তুই ডিফোজ কইরা দে ওই মাইয়া আর আমরা ঘরে তুলমু না।
আযাব নামছে তোর কাঁধ থাইকা। ওই আযাব আর আনার দরকার নাই। ”
শাহেদ মুচকি হেসে বললো, “মা,আমার ক্যান জানি ওই আযাব কান্ধে তুলতে ইচ্ছা করে। এর লাইগা তো এখন ওই আযাব সৌদি আরব লইয়া আইছি।খারাও দেখাই তোমারে।”
অনামিকা বলে দুইবার ডাকতেই কিচেন থেকে ছুটে এলো অনামিকা। ভিডিও কলে রোজিনা কে দেখে সালাম দিয়ে বললো, “কেমন আছেন আম্মা?আব্বা কেমন আছে?”
রোজিনা থরথর করে কাঁপতে লাগলো অনামিকাকে দেখে।ভূত দেখলেও এরকম ভয় পেতেন না যতটা এখন অনামিকাকে দেখে পেয়েছেন।এরকম শক শাহেদ বিয়ে করার পরেও পান নাই তিনি।
শাহেদ হেসে বললো, “আসলে হইছে কি মা শুনো,মিলনরে আমিই পাঠাইতাম আমগো বাড়ি।অনামিকার লগে তো তুমি কথা কইতে দিতা না,তোমার ছোট্ট ছোট্ট কিউট কিউট মিথ্যা কথা আমি বুইঝা ফালাইতাম সহজে। মা’গো, এই অনামিকা আমার প্রাণ। আমার অনামিকা আমার লগে কথা কইতে চাইবো না এইটা তাইলে পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য হইবো বুঝলা।
তবে তুমি একখান ভালা কাম করতা,মিলন গেলে বাড়ি থাইকা বের হইয়া যাইতা।আমি শান্তি মতো অনামিকারে ভিডিও কলে দেখতাম।অপটু হাতে ও ঘরের সব কাম করতো।কিন্তু তোমার লগে কথা কওনের কালে তুমি সবসময় কইতা অনামিকা কোনো কাম করে না ঘরের।আমার খুব খারাপ লাগতো মা।আমার ইচ্ছা করতো আমার বউয়ের একটু প্রশংসা শুনতে। কিন্তু পারতাম না।তখনই বুঝলাম অনামিকারে তোমরা শান্তি দিবা না।মিলনের লগে আমি ওরে যাইতে কইছে সদরে।পাসপোর্ট, ভিসার সকল কিছু করনের লাইগা।আমার মালিক অনেক ভালা।আমি তারে অনামিকার কথা কওনের পরের দিনেই কইলো বউ নিয়া আইতে।এইখানে থাকার লাইগা মালিকে বাসা দিবো।
আমিও আর দেরি করি নাই। শুধু তোমাগোরে জানাই নাই।দুইদিন আগে অনামিকা এই দেশে আসছে।আর আরেকটা কথা কই মা,তোমরা দাদা দাদী হইবা।আমি বিদেশে আসার পর থাইকা অনামিকার শরীর খারাপ হওয়া বন্ধ হই গেছে। আরো ১ মাস আগেই টেস্ট করে জানছি আমরা। তোমরা জানলে যেকোনো ভাবে কিছু খাওয়াইয়া আমার সন্তানরে দুনিয়ায় আসতে দিতে না।
একটা কথা মনে রাইখো মা আমি এই জীবনে আর বউ,সন্তান লইয়া বাড়ি যামু না।আমার বউরে যেই অপমান কইরা বাড়ি থেকে বাইর করছো তা শুধু আমার বউয়ের অপমান না,আমার অনাগত সন্তানের ও অপমান।
তোমরা আমার বাবা মা তোমাগো সব দায়িত্ব আমার। আমি তা পালন করমু।তবে এক সাথে তোমাগোরে লইয়া আর থাকমু না।”
শাহেদের কল কাটার পর পরই রোজিনা অজ্ঞান হয়ে গেলো।
————–
রেশমা মোটামুটি স্থায়ী হয়ে গেলো বাসায়।অন্তরা ও মেনে নিলো বাধ্য হয়ে। সে জানে জুয়েলের অবস্থার কথা। কাবিনের টাকা দেওয়ার মতো অবস্থা জুয়েলের নেই।তাই এক প্রকার বাধ্য হয়ে মেনে নিতে হলো অন্তরাকে।
ইদানীং রেশমা রান্নাবান্না করা ও শুরু করে দিয়েছে বাসায়।প্রথম প্রথম জুয়েল অকথ্য ভাষায় গালাগালি করার পরেও রেশমা দমে যায় নি।অন্তরা অবাক হয়ে দেখতে লাগলো একটা মানুষের কি পরিমাণ গন্ডারের চমড়া হতে পারে গায়ে।এতো গালাগালি যেনো তাকে ছুঁতে ও পারে না।
অন্তরার দিন দিন মনে হয় সংসার যেনো রেশমার,সে এখানে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে এমন কিছু।রেশমার ভাবভঙ্গি তেমনই মনে হয়।
জুয়েলের প্রতি এক প্রকার মতো মনঃকষ্ট নিয়ে অন্তরা দিন দিন সব কিছু থেকে হাত গুটিয়ে নিতে শুরু করে।
বুকের ভেতর অভিমানের পাল্লা ভারী হতে থাকে দিন দিন।
কি পেলো জীবনে?
সুখ পাখি কি কখনোই ধরা দেবে না তার কাছে?
আজীবন কি এভাবে মানিয়ে নিতে নিতেই কাটাতে হবে?
সবকিছু ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিলো অন্তরা।
আজ অন্তরা সাতসকালে ঘুম থেকে উঠেছে। জুয়েল তখনো বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। বাহিরে বের হতেই দেখলো রেশমা থম মেরে বসে আছে বিছানায়। অন্তরা পরোটা বানানোর জন্য রান্নাঘরে ঢুকলো। কিছুক্ষণ পর বাহিরে এসে দেখে রেশমা গোসল করে বের হয়েছে। ভেজা চুল বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে।
অন্তরার বুকের ভেতর কেমন ছ্যাৎ করে উঠে। তবে কি জুয়েল…..
রেশমা অন্তরার দিকে তাকিয়ে কেমন লাজুক ভঙ্গিতে হাসলো। তাড়াহুড়ো করে মাথায় গামছা পেছিয়ে ঘোমটা টেনে দিলো।
অন্তরার সারা শরীর অবশ হয়ে আসতে লাগলো। হাত পা ঠান্ডা হয়ে অন্তরার মাথা ঝিমঝিম করছে।
এতো দিন অন্তরা বুঝতে পারে নি সতীনের সাথে সংসার কেমন হয়।এতো দিন ধরে রেশমা আছে এতোটা কষ্ট লাগে নি অন্তরার।তবে আজ কেনো বুকের ভেতর ব্যথার ঢেউ আছড়ে পড়ছে!
কিসের শূন্যতা, কিসের এতো হাহাকার!
তাকে ডিঙিয়ে রাতে জুয়েলের রেশমার কাছে যেতে হয়েছে!
কিছুতেই মানতে পারছে না অন্তরা।
শেষ এটুকুই তো ওর সম্বল ছিলো। সেটুকুও বুঝি আজ রেশমার হাতে চলে গেলো। সতীনের সংসার মানুষ কেনো করতে চায় না আজ ভীষণ ভাবে বুঝতে পারছে অন্তরা।
এই মানুষটা তার বদলে অন্য কাউকে ভীষণ গভীরভাবে আদর করছে এর চাইতে যন্ত্রণা মনে হয় আর কিছুতে নেই।
টলতে টলতে অন্তরা রুমে গেলো।তারপর কোনো কথা না বলে চুপ করে শুয়ে পড়লো।
জুয়েক উঠলো কিছুক্ষণ পরে। অন্তরার দিকে তাকিয়ে দেখলো অন্তরা ঘুমে।অপলক অন্তরাকে দেখে জুয়েল উঠে গেলো হাত মুখ ধোয়ার জন্য।
রেশমা পরোটা বানিয়ে, ডিম চা দিয়ে জুয়েলকে খেতে দিলো।জুয়েলের মাথায় অনেক চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। রেশমার দেওয়া নাশতা খেয়ে রুমে গিয়ে দেখলো অন্তরা একই ভঙ্গিতে এখনো শুয়ে আছে।
অন্তরার গায়ে হাত রাখতেই অন্তরা হাত সরিয়ে দিলো।জুয়েল বুঝতে না পেরে আবারও হাত রাখলো।অন্তরা আবারও সরিয়ে দিলো। জুয়েল বুঝতে পারলো অন্তরা কোনো কারণে রেগে আছে। রুমের দরজা বন্ধ করে জুয়েল শক্ত করে অন্তরাকে জড়িয়ে ধরে বললো, “কি হইছে বউ?
আমারে কও।মন খারাপ তোমার? ”
অন্তরার কেমন অভিনয় মনে হলো আজ জুয়েলের এরকম আদুরে কথা। ধাক্কা দিয়ে জুয়েলকে সরিয়ে দিয়ে বললো, “খবরদার, আমাকে ছোঁবেন না।সারা রাত যার সাথে ছিলেন তার কাছে যান।”
জুয়েল হেসে বললো, “কি বলো এসব পাগলের মতো কথা?
আমি তো তোমার সাথেই ছিলাম।”
অন্তরার তখন মাথা ঠিক নেই।চিৎকার করে বললো, “হ্যাঁ, আছিলেন তো আমার কাছে। লজ্জা লাগে নাই আমার পাশ থেকে উঠে গিয়ে অন্য কারো সাথে থেকে আসতে!
এতো অভিনয় কিভাবে করেন?
ভেতরে চিৎকার শুনে রেশমা দরজার পাশে এসে দাঁড়িয়ে কান পাতলো। মুখে মুচকি হাসি ফুটে উঠলো। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই হাসি মিলিয়ে যেতে লাগলো।
জুয়েলের ভীষণ রাগ হলো। অন্তরা কিছুতেই বুঝতে চাইছে না।রেগে গিয়ে জুয়েল রুমের লাইট অফ করে দিয়ে অন্তরাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। অন্তরার মুখ চেপে ধরে বললো, ” বলেছি না আমি কারো কাছে যাই নি।আমার কারোর প্রতি আকর্ষণ নেই। অন্য কেউ যেভাবেই আমাকে প্ররোচিত করতে চায় অন্তত এই অন্তরঙ্গতা তার সাথে আমার হয় নি অন্তরা।আর হবে ও না।আমার শুধু তুমি আছো।”
প্রবল আদরে অন্তরাকে ভাসিয়ে দিলো জুয়েল।দরজার এপাশে দাঁড়িয়ে রেশমার দুই চোখ ভিজে উঠতে লাগলো।
এতো পরিকল্পনা সব বৃথা গেলো!
সেই মুহুর্তে জুয়েল সিদ্ধান্ত নিলো এভাবে আর চলতে পারে না। এক মাসের মধ্যে রেশমাকে ডিভোর্স দিবে সে।দরকার হলে গ্রামের জমি বিক্রি করে ডিভোর্স দিবে।তবুও এই মেয়েটাকে সে আর ঠকাবে না।এই মেয়েটা তাকে ভরসা করে সব ছেড়ে এসেছে তার ভরসা ভাঙ্গবে না।কিছুতেই না।
————–
বারান্দায় একটা ঢিল এসে পড়লো। একটু পর আরেকটা।
নিপা বারান্দায় গিয়ে দেখলো দুইটা কাগজ জড়িয়ে ইটের টুকরোতে।কাগজ খুলে দেখলো রূপার নাম লিখা।রূপা বসে পড়ছে।নিপা গিয়ে রূপার হাতে দিলো।রূপা দেখলো লিখা আছে, “মানুষ এমন কেনো অপরূপা!
নিজেকে উজাড় করে দিয়ে তাকেই ভালোবাসে, যাকে সে সাত জনমেও পাবে না।
ভীষণ অদ্ভুত মানব মন।পাথরে ফুল ফোটানোর জন্য চেষ্টা করে যায়।”
অন্য কাগজে লিখা,” পর জন্মে তুমি ও কারো প্রেমে পড়িও,তারপর তাকে না পাওয়ার যন্ত্রণায় তিলে তিলে কষ্ট পেও।যেভাবে আমি পাচ্ছি। ”
এক কোণে ছোট্ট করে সমুদ্র লিখা।রূপা ভেবে পেলো না এরা কি পাগল না-কি!
কেনো এমন করছে!
রূপা বিরক্ত হয়ে কাগজ দুটো ছিড়ে ফেলে দিলো। ভাবলো আরেকটা বাসা খুঁজে নিবে।এসব পাগলের সংস্পর্শে থাকা যাবে না আর।
চলবে….
রাজিয়া রহমান