তুমি অপরূপা পর্ব-২০+২১+২২

0
915

#তুমি_অপরূপা(২০)

জুয়েল টেবিলে খেতে বসে অন্তরাকে ডাকলো।অন্তরা ওয়াশরুমে ছিলো, অন্তরা বের হতে হতে দেখতে পেলো রেশমা প্লেটে করে জুয়েলের জন্য খাবার আনছে।
এতোটা বাড়াবাড়ি ও অন্তরার পছন্দ নয়।অন্তরা ভেবেছিলো জুয়েলকে সে রেশমাকে থাকতে দেওয়ার কথা বলবে,কিন্তু রেশমা জুয়েলের জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছে দেখে অন্তরার বুকে যেনো কাঁটা বিধলো।

সামনে না এসে ওয়াশরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো অন্তরা।
রেশনা খাবার প্লেট এনে রাখতেই জুয়েল উঠে দাঁড়ালো। অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললো, “আমার খাবার আমি তোর কাছে চেয়েছি?তুই কেনো খাবার দিতে এলি?”

রেশনা বেশ কাঁচুমাচু হয়ে বললো, “আমি তো শুধু এনে সামনে দিলাম,বিশ্বাস করুন আমি আপনার খাবার ধরে ও দেখি নি,আমার হাতের যে আপনি খাবেন না তা আমি জানি।আপনার বউ খাবার বেড়ে রেখেছে আমি তো শুধু এনে দিলাম।”
।জুয়েল রাগতস্বরে বললো, “না,তুই এনে ও দিবি না।তোর হাতে যা ছুঁবি তাই নোংরা হয়ে যাবে।তুই নিজেই তো নোংরা মেয়েমানুষ। ”

রেশমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে জুয়েল অফিসের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বের হয়ে গেলো। অন্তরা দৌড়ে গিয়ে জুয়েলকে ধরে বললো, “না খেয়ে কোথায় যাচ্ছেন। আমি এনে দিচ্ছি খাবার। আসুন।”

জুয়েল এলো না,দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললো, “আমি খাবো না।আমি যেনো অফিস থেকে এসে ওকে না দেখি।আমি নয়তো খু//ন করে ফেলবো ওরে।”

জুয়েল চলে গেলো। অন্তরা এসে রেশমার সামনে দাঁড়িয়ে বললো, “আপনি চলে যান,উনি চান না আপনি থাকেন। ”

রেশমা শক্ত হলো এবার কিছুটা। কঠিন ভাবে বললো, “আমার অধিকার ছাইড়া আমি যামু না। আমাগো এহনো ছাড়াছাড়ি হয় নাই।আমি রানার বাপেরে ছাড়মু না,সই দিমু না আমি। কি করতে পারে কে দেখমু।”

রানা ঘুমে ছিলো, মায়ের এরকম জোরে কথা শুনে জেগে উঠলো ঘুম থেকে। তারপর ঘুমঘুম স্বরে বললো, “মা,ও মা,আমারে কোলে লও।”

রেশমা ছুটে গিয়ে ছেলেকে কোলে নিয়ে বসলো। রানা তার মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে রাখলো।

এতো স্নিগ্ধ, এতো মায়ার এই দৃশ্য দেখে অন্তরার দুই চোখ ভিজে গেলো আপনাতেই।কতো দিন কেটে গেছে মা’য়ের গায়ের গন্ধ পায় না। বাবাকে দেখে না কতো দিন!
ভীষণ ইচ্ছে করে তাদের দেখতে। কিন্তু হায় ভাগ্য!
কোনো দিন ও হয়তো তা সম্ভব হবে না।

বাবা মা যদি তাড়িয়ে দেয় সেই যন্ত্রণা তো অন্তরা কিছুতেই সহ্য করতে পারবে না তখন।

রেশমা বেশ আটঘাট বেঁধে নেমেছে এবার।জুয়েলকে সে অন্তরার চাইতে বেশি চেনে। জুয়েলের দুর্বলতা অন্তরার চাইতে বেশি জানে।তাই জুয়েলকে কিভাবে হ্যান্ডেল করতে হবে তা রেশমা জানে।তবে বেশি তাড়াহুড়া সে করবে না।আস্তে আস্তে সামনে এগুবে।

————–

শাহেদ বিদেশ যাবার পর মাত্র এক দিন অনামিকার সাথে কথা বলেছে।অনামিকার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে শ্বশুর বাড়িতে।হাসানুজ্জামান এবং রোজিনা দুজনেই অনামিকাকে বেশ ভালোভাবেই খাটিয়ে নিচ্ছে।
ঘুম থেকে উঠেই অনামিকা নামাজ পড়ে ছুটলো রান্নাবান্নার যুদ্ধে। ভয় নিয়ে রান্না করে অনামিকা,আজকাল রোজিনা বেগম কথায় কথায় অনামিকাকে চড় থাপ্পড় দেন।বিশেষ করে রান্নার কোনো ত্রুটি হলে তো আর কথা-ই নেই।

শাহেদ কল দিলো ১১ টার দিকে, অনামিকা তখন পুকুর ঘাটে হাড়িপাতিল ধুচ্ছিলো। শাহেদ অনামিকার কথা জিজ্ঞেস করতেই রোজিনা বেগম বললেন, “বাবা রে,আমার কথা তো আর বিশ্বাস করস না।এখন কতো বেলা হইছে দেখ,তোর বউ সকালে উইঠা নাশতা খাইয়া আবারও গিয়া শুইছে। তুই যতদিন দ্যাশে আছিলি তোর বউ ও ভালো মতো চলছে,এখন কি হইছে কে জানে,তোর লগে কথা কওয়ার জন্য ডাকলেও আসে না,সারাদিন রুমের ভেতর দরজা বন্ধ করে বইসা থাকে। ”

শাহেদ কিছুটা চিন্তিত হলো। অনামিকার থেকে এরকম ব্যবহার প্রত্যাশিত নয়।কিন্তু রোজিনা বেগম যেভাবে কেঁদে বলছেন তাতে কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।
রোজিনা নাক টেনে বললেন,”বাবারে,মনে করছি তুই নাই,বউরে নিয়া থাককু,পোলার বউরে মাইয়ার মতো যত্ন করমু কিন্তু এখন দেখি কপালে এতো সুখ নাই।বউ তো আমাগো লগে কথাও কইতে চায় না। ”

শাহেদ ডিউটির জন্য রেডি হয়েছে,গাড়ি এসেছে নেওয়ার জন্য। মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে শাহেদ ফোনে রেখে দিলো। গাড়িতে বসে বসে শাহেদের দুই চোখ আপনাতেই জ্বলতে লাগলো। যার কথা শুনে রাজি হয়েছিলো সব ছেড়ে এই প্রবাসে আসতে,সেই কি-না আজ!

অনামিকা ভেবেছিলো আজকে হয়তো শাহেদ তার সাথে কথা বলবে।কিন্তু আজকেও শাশুড়ির সাথে কথা বলে ফোন রেখে দেওয়ায় অনামিকার ভীষণ কষ্ট হলো।
বিমানে উঠলে কি মানুষ এভাবেই বেঈমান হয়ে যায়?

রোজিনা ঠোঁট ফুলিয়ে কান্না করতে করতে বললেন, “আমার পোলার কপাল খারাপ। এমন বউ বিয়া করছে এখন না পারে গিলতে না পারে ফেলতে।গলায় কাঁটার মতো বিইধা আছে পোলার। ”

অনামিকা হতভম্ব শাশুড়ির কথা শুনে। এতোটাই অপ্রিয় হয়ে গেলো সে শাহেদের!
কেনো!
কি দোষ করেছে সে!
অনামিকা এখানে কি অবস্থায় আছে তা জানতে তো চাচ্ছেই না,উল্টো অনামিকাকে গলার কাঁটা বলছে শাহেদ!

মন শক্ত করলো অনামিকা। বেশ,শাহেদ যদি তাকে এতোই অপ্রিয় ভাবে,কথা বলার দরকার ও মনে না করে তবে অনামিকা ও শাহেদের সাথে কথা বলবে না।

————–

রূপার সাথে রত্না পান্নার ভীষণ ভাব হয়ে গেলো। এই আত্মকেন্দ্রিক শহরে বন্ধু পেয়ে রূপা ও যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো।
কলেজ থেকে ফিরে দুই বোন মিলে রূপাদের ফ্ল্যাটে গেলো। মাহি রত্না,পান্নাকে দেখে বিগলিত বদনে এগিয়ে এসে বললো, “আরে তোমরা! গরীবের দরজায় হাতির পা দেখছি আজ!
কি মনে করে এলে!”

পান্না মুচকি হেসে বললো, “রূপার কাছে এসেছি আমরা।”

বাংলার ৫ এর মতো হয়ে গেলো মাহির চেহারা মুহূর্তেই।আবারও সেই গেঁয়ো মেয়েটা!
অপরূপা গোসল করে বের হয়েছে মাত্র,চুল বেয়ে জলকণা টুপটুপ করে ফ্লোরে পড়ছে।
রত্না বললো, “জামা কাপড় ছাদে দেবে শুকাতে? চলো, আমরা ও যাবো ছাদে।তোমাকে আমার একটা গোলাপ গাছ দেখাবো,এমন আনকমন গোলাপ তুমি এর আগে কখনোই দেখো নি আমি শিওর। ”

ফ্ল্যাটের সবাই যার যার মতো ব্যস্ত থাকে সর্বদা,অপরূপা স্বস্তি পেলো। অন্তত অবসর সময়ে এই দুই বোনের সঙ্গ তো পাবে সে।
জামা কাপড়ের বালতি নিয়ে রূপা ছাদে গেলো, কিছুটা যেতে রত্না বললো, “আরে,আমার কাপড়ের বালতি তো বাসায়,তুমি উঠো,আমরা আমাদের বালতি নিয়ে আসি। ”

রূপা মাথা নাড়িয়ে সায় দিয়ে উঠে গেলো ছাদের দিকে। নিচে এসে দুবোন হাই ফাইভ দিয়ে হাসতে লাগলো।

ছাদে এসে রূপা আপনমনে গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে কাপড় মেলতে লাগলো। রূপক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অপরূপাকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। হাতের জ্বলন্ত সিগারেট একটু একটু করে জ্বলছে।
সমুদ্র কেনো এই মেয়েটাকে পছন্দ করলো!
কি বিশেষত্ব আছে এই মেয়েটার!

কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে লাগলো রূপক।কোমর সমান লম্বা তেলতেলে বিনুনি করা চুলগুলো আজ ছেড়ে দেওয়া। ভেজা চুল বেয়ে পড়তে থাকা জলকণা রোদের কারণে চিকচিক করছে। যেনো চুল বেয়ে মুক্তোদানা ঝরে পড়ছে।
রূপকের রূপকথার গল্পের কথা মনে পড়লো, সেই বন্দিনী রাজকন্যা, যার চোখের জল মুক্তো হয়ে পড়ে।

মেয়েটার ফর্সা মুখখানায় কোনো কৃত্রিমতা নেই,সার‍্যলতা আছে।হালকা গোলাপি সুতির জামা পরনে।
এতো স্নিগ্ধ লাগছে কেনো!
এই যান্ত্রিক শহরের,সব কৃত্রিমতার ভীড়ে,সকল নকলের ভীড়ে মেয়েটা যেনো চোখের শান্তি।

সিগারেট পুড়তে পুড়তে রূপকের হাত পুড়তে লাগলো। চিৎকার করলো না রূপক। মেয়েটা যদি বুঝতে পারে রূপক আড়ালে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে তবে রূপককে ভুল বুঝতে পারে। পানির ট্যাংকের পেছনে সরে দাঁড়ালো রূপক।

রূপা রত্না পান্নার অপেক্ষা করতে লাগলো আর গুনগুন করে গাইতে লাগলো, “ধরো যদি চেনা গন্ধে
মেতে উঠি চেনা ছন্দে
যদি ছুঁতে চাই আবারও
জানি ছোঁয়া তবু বারণ……”

রূপক মুগ্ধ হলো গান শুনে। রূপা কলেজের সামনে দোকান থেকে খাতা কিনতে গিয়ে গানের এইটুকু শুনেছিলো। শুনেই মুখস্থ হয়ে গেছে। সেই থেকে গেয়েই চলেছে।

রত্না পান্না এলো আরো কিছুক্ষণ পর। হাতে করে আচার নিয়ে এলো।
গল্প করতে করতে ওরা ছাদের অন্যদিকে যেতেই রূপক ছাদ থেকে নেমে গেলো।

রুমে এসে রূপক অস্থির হয়ে পায়চারি করতে লাগলো। কি করতে যাচ্ছে সে!
সমুদ্রকে কষ্ট দিতে যাচ্ছে!
অথচ এক সময় সমুদ্রের কষ্ট ছিলো রূপকের ও কষ্ট।

কিন্তু কি করবে রূপক!
এই সমুদ্র,সমুদ্রের মা কি বাজেভাবে সেদিন আঘাত করেছে কথা দিয়ে রূপককে।ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিলো রূপকের অন্তর।
যার কোলে কোলে থেকেছে শৈশবের অনেকটা সময়, মায়ের মতো যার আদর পেয়েছে সেই মানুষকে অপমান করে কথা বলেছে ওরা।

না,মনকে কিছুতেই আস্কারা দিবে না রূপক।কষ্ট দিবে সমুদ্রকে।সমুদ্র বুঝুক তাহলে আসল প্রেমের কি জ্বালা।কেনো মানুষ ভালোবাসার জন্য ঘরছাড়া হয় হাড়ে হাড়ে টের পাক সমুদ্র।

চলবে……!

#তুমি_অপরূপা (২১)

শাহেদ বাড়িতে কল দিলো ৭ দিন পর।রোজিনা বেগমের ছোট বাটন ফোন ক্রিংক্রিং করে বেজে উঠতেই অনামিকার বুকের ভেতর একটা সুখের পাখি ডানা ঝাপটাতে লাগলো। পরক্ষণেই সেই সুখ বিষাদে রূপ নিলো।
শাহেদ এখন আর অনামিকার কথা জিজ্ঞেস করে না,বরং রোজিনা বেগম কিছু বলতে গেলেও বিরক্ত হয়ে বলে, “ওর খবর নেওয়ার জন্য কল দিই নাই মা।তোমার, আব্বার খবর নিতে কল দিছি।ওর ব্যবস্থা আমি কিছুদিনের মধ্যে করবো। ”

ছেলেকে আবারও তার আগের মতো হতে দেখে রোজিনার আনন্দ হয়।বিয়ের পর ছেলেরা বদলে যাওয়ার শংকা সব মায়ের থাকে,রোজিনা ও ব্যতিক্রম নয়। বদলে যাওয়া ছেলেটা আবারও আগের মতো হচ্ছে এটাই তো স্বস্তি।

শাহেদদের বাড়ির দুই বাড়ি পরে মিলনদের বাড়ি।গত কয়েকদিন ধরেই ছেলেটাকে বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করতে দেখা যায়,প্রায় সময় অনামিকার দিকে তাকিয়ে থাকে ছেলেটা।
রোজিনা বেগম ও লক্ষ্য করেছেন ব্যাপারটা। প্রথম দিন বুঝতে পেরেই হাসানুজ্জামানকে জানান রাতে।হাসানুজ্জামান ভেবে বললো, “তুমি ওই পোলারে খেদাইও না বুঝলা।এইটাই সুযোগ। তুমি একটু দূরে দূরে সইরা থাইকো।ওগোরে সুযোগ দিও।তাইলে এইভাবেই ওই বেজন্মা মাইয়ারে বাড়ি থেইকা খেদামু।পিরিতি করন আমার পোলার লগে,এমন বদনাম উঠামু আমার পোলা তো ডিফোজ দিবোই,আর অইন্য কোনো পোলা ও বিয়া করবো না।”

স্বামীর যুক্তি রোজিনার পছন্দ হলো। না হলে এই মেয়েকে তাড়ানোর মতো শক্ত কারণ তো দেখাতে পারবেন না।

মিলন কেমন চোরা চোখে অনামিকার দিকে তাকাচ্ছে।

রোজিনা মিলনকে দেখে হাসিমুখে বললেন,”মিলন না-কি! বও বাবা,বও।কি খবর তোমাগো? আহো না তো এহন আর।তুমি একটু বও,আমি একটু আইতাছি রাস্তার মাথা থাইকা। ”

ওদের সুযোগ করে দিতে রোজিনা সরে গেলো। ফিরলো অনেকটা সময় পর। ফিরে এসে দেখে মিলন অনামিকার সাথে রান্নাঘরের সামনে পিড়িতে বসে হেসে হেসে কথা বলছে অনামিকা ও হাসছে।

রোজিনা মনে মনে হাসলেন।বোকা মাইয়া বুঝে নাই ক্যান তারে এতো সুযোগ দিতাছে।
চাচীকে ফিরতে দেখে মিলন কিছুটা অপ্রতিভ হয়ে উঠে গেলো, অনামিকা ও গম্ভীর হয়ে গেলো। রোজিনার থেকে বিদায় নিয়ে মিলন চলে গেলো।

রোজিনা আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো অনামিকার ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির রেশ লেগে আছে।
বিড়বিড় করে রোজিনা বললেন,”নষ্টা মহিলা,উড়তে থাক যত পারস।মুখ থুবরাইয়া এমনভাবে পড়বি,সেদিন আর মুখ তুইলা কারো দিকে চাইতে পারবি না।”

মিলন আসার পর অনামিকার কেমন যেনো আনন্দ আনন্দ লাগছে।এভাবে মুখবন্ধ করে এখানে থাকতে থাকতে অনামিকা মনে হয় দম বন্ধ হয়ে মরে যেতো। এটা বাড়ি নয়,যেনো কোনো শ্মশান।

————–

অন্তরার সাথে জুয়েলের মান অভিমান হয়ে গেলো গতরাতে। ইদানীং রেশমা সবসময় বাসায় শাড়ি পরে, সাজগোজ করে ঘুরঘুর করে। অন্তরা জানে শাড়ি জুয়েলের ভীষণ পছন্দ। রেশমা যে জুয়েলকে ইমপ্রেস করতে এসব করছে তা অন্তরার বুঝতে বাকি নেই।

প্রথম দিন অফিস থেকে ফিরে জুয়েল চমকে গেলো রেশমাকে আগের সাজে দেখে।বুকের ভেতর কেমন ধড়ফড় করতে লাগলো ওর। এই বিশেষ সাজ কিসের জন্য জুয়েল জানে।মাঝেমাঝে মধ্যরাতে রেশমা এভাবে সাজতো।বিশেষ মুহুর্তের আগে এভাবেই সেজে দাঁড়াতো জুয়েলের সামনে।
সেভাবে অনেক দিন পরে রেশমাকে দেখে জুয়েলের বুকের ভেতর ধুকপুক করতে থাকে।রেশমা মুচকি হেসে সরে যায় সামনে থেকে।

জুয়েল খেয়াল করলো টিপ পরে নি রেশমা।পরক্ষণেই মনে পড়ে তার ওয়ালেটে রেশমার জন্য কেনা এক পাতা টিপ আছে।
ফ্লোরে একটা কাথার উপর বিছানার চাদর বিছিয়ে রেশমা ঘুমায়।জুয়েল জানে না কেনো সে তখন এমন বিহ্বল হয়ে টিপের পাতাটা বের করে রেশমার বিছানার উপর রেখেছিলো। তারপর মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় রুমে ঢুকে যায়।

অন্তরা এই টিপের পাতাটা আসার পর থেকেই জুয়েলের ওয়ালেটে দেখছে।হঠাৎ গতকাল রাতে জুয়েলের ওয়ালেটে না দেখে জিজ্ঞেস করলো জুয়েলকে।
বিব্রত হয়ে জুয়েল বললো, “রানার মায়ের জন্য কেনা,তাই তাকে দিয়ে দিয়েছি।”

মুহূর্তেই অন্তরার হাসিমুখে আষাঢ়ের মেঘ জমে গেলো, দুচোখ জলে ভরা নদীর ন্যায় ভরে উঠতে লাগলো।
এতটা তো আশা করে নি অন্তরা।জুয়েলের রেশমার প্রতি এখনো পিছুটান রয়ে গেছে!

ভালো মন্দ,ঠিক ভুল কোনো কিছু না ভেবেই যার আশায় সব ছেড়ে এসেছিলো সে ও অন্তরাকে ঠকাচ্ছে!
পরমুহূর্তে অন্তরার মনে পড়লো সে জুয়েলের জন্য নয়,বরং বাড়ি থেকে মুক্তি পেতে,আব্বাকে চিন্তা থেকে মুক্তি দিতেই জুয়েলের সাথে এসেছে। তখন জুয়েলের প্রতি ভালোবাসার চাইতে মুক্তি পাওয়া বেশি দরকার ছিলো অন্তরার।কিন্তু সে কি জুয়েলকে ভালোবাসে নি!
এই যে এতো দিন সংসার করছে,জুয়েল অফিসে যাওয়ার আগেই উঠে গরম ভাত তরকারি রান্না করে দেয় দুপুরে লাঞ্চের জন্য, সকালের নাশতা করে। রাতে জুয়েল আসার আগেই গরম ভাত রেঁধে ফেলে। জুয়েল ঠান্ডা ভাত খেতে পছন্দ করে না বলে। এসব কি ভালোবাসা নয়!
শুধুই কি দায়িত্ব?
ভালোবাসার কি ছিঁটেফোঁটা ও দেখে নি জুয়েল!

সে হয়তো রেশমার মতো পরিপাটি হয়ে থাকে না,শাড়ি পরে ঘরের কাজ করতে পারে না বলে শাড়ি পরে না।
তাছাড়া অন্তরার শাড়ি মোটে দুটো। একটা শাড়িতে তেলাপোকা কেটেছে।

ভালো শাড়ি একটাই আছে,তুলে রাখা।একটা মাত্র শাড়ি দিয়ে তো এসব রংঢং করা যায় না।
বাবার বাড়িতে বাবার আর্থিক অবস্থার দিকে তাকিয়ে কতো শখ আহ্লাদ ত্যাগ করেছে। একটা ভালো জামা গায়ে দিতে গেলে ১০ বার ভেবেছে অন্তা,,অপরূপা,অনিতার কথা।
বাবার টাকা পয়সার সংকটের কথা।
আর এখন স্বামীর স্বল্প বেতনের টাকা থেকে সেভিংসের কথা চিন্তা করে নিজের একেবারে খুব প্রয়োজনীয় কিছু কিনতে হলে তবেই কেনে।এমনকি চেষ্টা করে প্রতি মাসে ন্যাপকিনের টাকা জমিয়ে রাখছে।
অথচ সেই স্বামী কি-না প্রথম স্ত্রীর প্রতি মুগ্ধ হচ্ছে।

অন্তরা সেই রাতে জুয়েলের সাথে আর কথা বললো না, খাবার বেড়ে দিয়ে বসে রইলো টেবিলে। জুয়েল খেতে বসে একবার আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো রানা আর রেশমাকে।
রেশমার অনাবৃত পিঠের দিকে না চাইতে নজর গেলো। নিজেকে সংবরণ করলো জুয়েল।কি করছে সে!
রেশমা একটা মোহ জুয়েল জানে।রেশমা এসব তাকে ভুলানোর জন্য করছে,পুরোটা একটা ফাঁদ।তবু কেনো জুয়েল জেনে শুনে ফাঁদে পা দিতে যাচ্ছে!

মনে মনে ঠিক করলো যেভাবেই হোক রেশমাকে বের করে দিবে।নয়তো অন্তরার প্রতি অবিচার হবে।

সেই রাতে অন্তরা আর জুয়েলের গা ঘেঁষে ঘুমালো না।অন্তরার কোঁকড়া এলোমেলো চুল পিঠের উপর ছড়িয়ে আছে,উপুড় হয়ে শুয়ে আছে অন্তরা।
জুয়েল কি করবে!
অন্তরাকে ডাকতে ও পারছে না অপরাধবোধের কারণে। কেনো সে রেশমাকে টিপের পাতাটা দিতে গেলো!

পানি বেশি খাওয়ায় জুয়েলের প্রস্রাবের বেগ পেলো।একটাই কমন ওয়াশরুম বাসায়,যেতে হলে বাহিরে যেতে হবে।কিন্তু না গিয়েও পারছে না জুয়েল।
তাই কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা বের হয়ে ওয়াশরুমে গেলো।
বের হয়ে আসার সময় ছেলের দিকে তাকিয়ে চমকে গেলো জুয়েল।রেশমার পরনের শাড়ি-ব্লাউজের কোনো কিছুই ঠিক নেই।মুগ্ধতা নয়,চিন্তা হলো জুয়েলের।রানা উঠে যদি মা’কে এভাবে দেখে তবে ব্যাপারটা খুব খারাপ হবে।
রেশমাকে ডাকতে ও ইচ্ছে করছে না। উপায় না পেয়ে জুয়েল রেশমার শাড়ি নামিয়ে দিলো। রেশমার মুখের দিকে তাকালো জুয়েল।এই মুখ দেখে কেউ কি বুঝবে এই মুখের আড়ালে লুকিয়ে আছে কতো কদর্য!
রেশমা ঘুমাচ্ছে, রানা ঘুমাচ্ছে,অন্তরা ঘুমাচ্ছে। জুয়েল পারছে না ঘুমাতে। কি করবে সে!
রেশমাকে তাড়িয়ে দিলে তো রানা কে ও হারিয়ে ফেলবে। কিন্তু রানার কথা ভাবতে গেলে অন্তরাকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।

অন্তরা রুমের দরজার সামনে এসে দেখলো জুয়েল কেমন করে তাকিয়ে আছে রেশমার দিকে। অন্তরা তীর্যক হাসি হেসে বললো, “প্রিয়তমার প্রিয় মুখ!
গভীর রাতের মধুর সব স্মৃতিচারণ!”

জুয়েল চমকে উঠলো অন্তরার কথা শুনে। কিন্তু অন্তরাকে বুঝাইয়া গেলো না কিছু।অন্তরা এখন কিছুই বুঝবে না,অযথা অশান্তি হবে ভেবে জুয়েল চুপ করে রইলো।
জুয়েলের এই মৌনতা অন্তরাকে আরো বেশি কষ্ট দিতে লাগলো। বিছানার এক কোণে বসে ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে লাগলো অন্তরা।

অন্য দিকে ফিরে জুয়েল ভাবছে কোন দিকে যাবে!
এতো জটিলতা সহ্য করতে পারছে না জুয়েল।

রেশমা শুয়ে শুয়ে হাসলো। ভয়ংকরভাবে আঘাত দিবে সে অন্তরা কে,সংসার ফিরে পেতে হলে অন্তরাকে ভেঙে চুরমার করে দিতে হবে।

চলবে…..

#তুমি_অপরূপা(২২)

সময় কিভাবে যেনো কেটে যায়, রূপা টের পায় না। রত্না পান্না কিভাবে কিভাবে যেনো ওর সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু হয়ে গেছে রূপা বুঝতে ও পারলো না। ওরা দুই বোন রাউপাকে এমনভাবে মায়ায় জড়িয়ে নিয়েছে রূপার মনে হয় যেনো ওরা ওর আত্মার আত্মীয়। অনেক দিন পরে যেনো অন্তরা আর অনামিকাকে ফিরে পেয়েছে রূপা।

রূপা একটা ব্যাপার বুঝে না।ওদের সাথে ওদের মায়ের তেমন কোনো ভালো সম্পর্ক নেই। কেমন গা ছাড়া ভাব মা মেয়েদের সাথে। কিন্তু ওদের দাদার সাথে সম্পর্ক ভীষণ ভালো।
রূপার হিংসে হয় মাঝেমাঝে, কি সুনিপুণভাভে ওদের ভাই ওদের সব আবদার পূর্ণ করে দেয়। তার ও যদি একটা ভাই থাকতো তবে হয়তো এভাবে আদর,ভালোবাসা,শাসনের বেড়াজালে জড়িয়ে রাখতো বোনদেরকে।তাহলে হয়তো অন্তরা,অনামিকা ভুল পথে পা বাড়াবার আগে একবার হলেও ভাবতো।
হয়তো জীবনটা অন্যরকম হতো।
বাবার কাঁধে হাত রেখে বলতো,”আজকে তোমার শরীর ভালো নেই,তুমি বাড়ি থাকো বাবা,আমি দোকানে বসছি।”

অথচ মেয়ে বলে কখনো বাবাকে এই কথাটা বলতে পারে নি।
ভাবতে ভাবতে রূপার হঠাৎ করে মনে হলো, কেনো পারে নি কখনো বাবাকে এই কথাটা বলতে?
কি ক্ষতি হতো যদি বলতো!
লোকলজ্জার ভয়ে?
তাতে কি লাভ হয়েছে এখন?
যেই সমাজের ভয়ে বাবাকে এই কথাটা বলার কথা ও কখনো মাথায় আসে নি,সেই সমাজ কি বাবাকে এক মুহূর্তের জন্য সুখ এনে দিয়েছে?
যে কখনো সুখী করতে পারে না, তার ভয়ে কেনো কষ্ট পাবে তাহলে মানুষ!
রূপা বুঝতে পারে তার মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে। গ্রামের সেই শান্ত, ভীতু রূপা এখন দিন দিন বদলে যাচ্ছে। শহরের হাওয়া গায়ে লাগলে কি এমনই হয়?
রূপা ঠিক করে এবার বাড়িতে গেলে বাবার দোকানে বসবে।ছেলে হলে যেভাবে বাবার দোকানে বসতো,বাবাকে সাহায্য করতো সেভাবেই করবে।
শহরে এসেই রূপা দেখেছে মেয়েরা ও দোকান চালায়।সেই থেকেই মাথায় ঘুরছিলো।

রূপার এসব ভাবনার মাঝেই রত্না এলো।শুক্রবারের এক তপ্ত দুপুর।ভ্যাপসা গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত। এই গরমের মধ্যে ঘেমে বসে আছে রূপা।ভাবনায় মগ্ন থাকায় বুঝতে পারে নি কখন যে ঘেমে তার গোসল হয়ে গেছে।

রত্না এসে বললো, “রূপা,চল তেঁতুল মাখা খাবো।আজকে তুই মাখবি কিন্তু।”

রূপার তখন বড় আপার কথা মনে পড়ে গেলো। বাড়িতে আম,তেঁতুল,বড়ই,পেয়ারা যখন যা-ই মাখানো হতো বড় আপাকে দায়িত্ব দেওয়া হতো মাখানোর।তিন বোন মিলে সব কেটেকুটে রেডি করে দিতো,আপা শুধু তার হাত দিয়ে মাখাতো।ইস,যেনো অমৃত!
রূপা জানে আপা মেখেছে বলেই এতো বেশি ভালো লাগছে।কেননা চুপি চুপি অনামিকা আর সে ও এক দিন মাখিয়ে খেয়ে দেখেছে কিন্তু বড় আপা মাখালে যেমন স্বাদ হয় তেমন হয় নি।

রূপা হেসে বললো, “আমি মাখালে ভালো লাগে না রে,তোরা মাখাবি।”

রত্না বললো, “হবে না।আজকে তোকেই মেখে খাওয়াতে হবে।চল না,পানা সব রেডি করতেছে।”

ঘেমে জবজবে শরীরে রূপা রত্নাদের বাসায় গেলো। রূপক তখন ল্যাপটপে কাজ করছে। রূপাকে দেখে একবার চোখ তুলে তাকালো।
চোখ নামিয়ে নিতেই পরেরবার আবারও কিসের এক অনিবার্য কারণে তাকালো তা রূপকের জানা নেই।তাকিয়ে দেখলো ঘামে মেয়েটার কপালের চুলগুলো ওর কপা,গালের সাথে আটকে আছে।মোটা করে বিনুনি করা কোমর সমান চুল,কেমন কালো তেলতেলে।
সুতি কচুপাতা রঙের একটা জামাতে মেয়েটাকে কেমন নির্মল লাগছে।
কোনো প্রসাধনী নেই,কোনো চাকচিক্য নেই,কোনো কৃত্রিমতা নেই, তবুও সাধারনের মধ্যে মেয়েটা অসাধারণ।
রূপক অনুভব করে এই মেয়েটার ব্যক্তিত্ব প্রবল ধারালো। সে নিজেও যে দুর্বল হয়ে পড়ছে বুঝতে পারছে।
আশ্চর্য হচ্ছে এই ভেবে,কখনো কি ভেবেছে এরকম সাধারণ একটা মেয়ে ও তার মনে দোলা দিয়ে যাবে?

রূপা তাকালো না রূপকের দিকে। রত্নাদের রুমের বারান্দায় গিয়ে দেখে পান্না তেঁতুল আর টমেটো রেডি করে রেখেছে, ধনেপাতা ও আছে সাথে।বাকি সব উপকরণ নিয়ে পান্না বসে আছে।

বিসমিল্লাহ বলে রূপা মাখতে বসলো। তেঁতুল, টমেটো, ধনেপাতা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। কেমন লাল একটা রঙ এসেছে।
পান্না হামলে পড়লো বাটির উপর। একটু তুলে মুখে দিয়ে আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেললো। এতো স্বাদ,এতো শান্তি লাগছে পান্নার।
কাড়াকাড়ি করার আগেই রত্না একটা ছোট বাটিতে তুলে নিয়ে বললো, “খবরদার, তোরা এখন খাবি না কিন্তু,আমি দাদাকে দিয়ে আসি এটা।দাদা ভীষণ পছন্দ করে এসব খেতে।”

পান্না মিটিমিটি হেসে বললো, “যা,যা আপা।”

রত্না রাগ হয়ে বললো, “না না,আমি জানি আমি এখান থেকে দুই পা যেতেই তুই খাওয়া শুরু করবি।নে,তুই যা।তুই দিয়ে আয় দাদাকে।”

পান্না পিছনে সরে গিয়ে বললো, “অসম্ভব আপা।তুই তো আমাকে দুই পা যাওয়ার ও সুযোগ দিবি না।খাওয়া শুরু করে দিবি তুই।আমি যাবো না।”

দুই বোনের এই তর্কযুদ্ধ দেখে রূপা উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “উফ,ঝগড়া বন্ধ কর।আমাকে দে,আমি দিয়ে আসছি।”

রত্না রূপার হাতে বাটি দিলো।রূপা যেতেই এক বোন অন্য বোনকে হাই ফাইভ দিয়ে হাসতে লাগলো।
পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে রূপক কাজ করছে। রূপা এসে পাশে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করে বললো, “এটা আপনার জন্য দিয়েছে রত্না।”

রূপক মাথা না তুলে বললো, “একটা চামচ দাও,আমি হাত দিয়ে খেতে পারবো না। ”

রূপা ঠোঁট উল্টে বললো, “চামচ আমি কোথায় পাবো।”

মনে মনে ভাবলো, “এই লোক কি ভাবে সবাইকে?আমাকে সরাসরি আদেশ দিচ্ছে চামচ এনে দিতে! অনুরোধ করতে পারে বড়জোর, তা না একেবারে আদেশ,চামচ এনে দাও।যেনো আমি তার হুকুম তামিল করার অপেক্ষায় আছি।”

রূপক মাথা নেড়ে বললো, “তাহলে নিয়ে যাও।আমার সময় নেই এখন,ব্যস্ত আছি।”

রূপা বিরক্ত হয়ে বললো, “ঠিক আছে নিয়ে যাচ্ছি। ”

রূপা যেতে নিতেই রূপক পেছন থেকে বললো,
“হে আল্লাহ,এক ক্ষুধার্ত মানুষের সামনে থেকে যে খাবার নিয়ে যেতে পারে, তার মনে মায়াদয়া বলতে কিছু নেই তা প্রমাণিত। এজন্যই কবি লিখেছেন, হাশরের দিনে বলিবেন খোদা,হে আদম সন্তান,
আমি চেয়েছিনু ক্ষুধায় অন্ন, তুমি কর নাই দান।
মানুষ বলিবে- তুমি জগতের প্রভু,
আমরা কেমনে খাওয়াব তোমারে, সে কাজ কি হয় কভু?
বলিবেন খোদা- ক্ষুধিত বান্দা গিয়েছিল তব দ্বারে,
মোর কাছে তুমি ফিরে পেতে তাহা যদি খাওয়াইতে তারে।”

রূপা হতভম্ব হয়ে গেলো রূপকের কথা শুনে। এই লোক তো মহা ত্যাঁদড়!
বাটি নিয়ে রূপা রত্নাদের রান্নাঘরে গিয়ে চামচ এনে দিলো। তারপর ঝড়ের বেগে প্রস্থান করলো সেখান থেকে।

রূপক মুচকি হেসে এক চামচ নিয়ে মুখে দিলো।মুখে দিতেই তার চোখ বন্ধ হয়ে গেলো। কতো দিন পর এরকম কিছু খাচ্ছে!

রূপা যেতেই রত্না বললো, “উফ,তাড়াতাড়ি আয়।জিবে পানি এসে তো মহাসাগর হয়ে যাচ্ছে। খেতে পারছি না তোর অপেক্ষায়। নে শুরু কর।”

তিনজন গল্প করতে করতে খেতে লাগলো। ওদের খাওয়ার মধ্যে রূপক গিয়ে হাজির।একপাশে দাঁড়িয়ে বললো, “এই অল্প একটু কি দিয়েছিস আমাকে,বাটি এদিকে দে।”

বাটি তুলে নিয়ে রূপক হাত দিয়ে খেতে শুরু করলো। রূপকের হাত দিয়ে খাওয়া দেখে রূপা মুচকি হাসতে লাগলো। খেয়ে রূপক বললো, “ভীষণ মজা হয়েছে, কি মেখেছিস?তার হাতটা স্বর্ন দিয়ে বাধাই করে দিই।”

পান্না বললো, “রূপা মেখেছে দাদা।”

রূপক সহজভাবে বললো, “রূপা,কাল আবারও মেখো তো।আচ্ছা, শুনো শুধু কাল না,প্রতিদিনই মাখবে আমি বাসায় থাকলে বুঝলে।খবরদার,আমি না থাকলে কখনোই এই দুইজনকে মেখে খাওয়াবে না।আমাকে ছেড়ে যে খাবে তার পেটে অসুখ হবে বলে দিলাম।”

রূপকের কথায় তিনজনই হাসতে লাগলো। রূপক ফিরে গেছে অনেক বছর আগের স্মৃতিতে।যখন সবাই একসাথে ছিলো। ফুফু এভাবে দুপুর হলে বড় এক ডিশ নিয়ে বসতো।বাড়ির সবাই মিলে কি আনন্দ করে খেতো। তারপর ফুফু হারিয়ে গেলো। সেই সাথে হারিয়ে গেলো রূপকের সব আনন্দ। হারিয়ে গেলো যৌথ পরিবার।

রূপার রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাস্তা দেখা যায়। রুমে এসে গায়ের জামা পালটে রূপা বারান্দায় এসে দাঁড়ালো।
সমুদ্রকে দেখতে পেলো দাঁড়িয়ে আছে। রূপা এখন জানে ওর নাম সমুদ্র,এ ও জানে এই ছেলেটা রূপাকে ভীষণ বিরক্ত করতে চায়।

দেখতে ভীষণ ইনোসেন্ট যেনো ভাজা মাছ ও উলটে খেতে জানে না অথচ মনে মনে এসব অসভ্যতা!
বিরক্ত হয়ে রূপা রুমে চলে গেলো। রুমের মেয়েরা রূপার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।রূপা দুচোখ সবার উপর ঘুরছে।
একজন হেসে বললো, “কেমন পাগলা, দিওয়ানা হয়ে আছে ছেলেটা রে রূপা,কিভাবে এমন পাগল করলি?”

রূপা কঠিন স্বরে বললো, “বাজে কথা না বললে খুশি হবো।”

মাহি এসে বললো, “কেনো,ভালো লাগছে না সত্যি কথা শুনতে? রাগ করছো কেনো এতে?আমাকে ও একটু শেখাও না কিভাবে শহরের ভালো ঘরের ছেলেদের পটাতে হয়?দেখো না,এতো দিন ধরে চেষ্টা করে ও রূপকের মন পেলাম না অথচ তুমি এসে দু দিনেই সমুদ্রের মন কেড়ে নিলা।”
মাহির কথা শুনে মাহির দুই বন্ধবী হেসে উঠলো। রূপা দমে গেলো না তাতে।তীর্যক হাসি হেসে বললো, “অবশ্যই আপা,তবে আমি তোমাকে আগামীকাল প্রাকটিক্যাল দেখাবো কিভাবে ছেলেদের ইমপ্রেস করতে হয়।”

মাহি কিছুটা থমকে গেলো রূপার এরকম চটপট জবাব শুনে।সে ভেবেছিলো রূপা লজ্জা পাবে।

পরদিন দুপুর বেলা রূপা পেয়ারা, কাঁচাপেপে,লেবু মেখে ভর্তা বানালো।
মাহি ‘কে হেসে বললো, “মাহি আপা,আমার সাথে এসো।”

রূপক গ্যারেজে গাড়ির বনেট খুলে কাজ করছিলো। মাহি হতভম্বের মতো রূপা পিছু পিছু এসেছে। কেনো এসেছে সে নিজেও বুঝতে পারছে না।
মাহি নিচে এসে রূপকের পাশে দাঁড়িয়ে বললো, “আপনার জন্য এনেছি,নিন।”

রূপকের দুই হাতে কালি লেগে আছে।পেছনে মাহিকে দেখে বললো মাহিকে জ্বালানোর জন্য বললো , “আমার হাতে তো কালি,খাইয়ে দিতে পারো যদি তবে খাবো।”

রূপা মুচকি হাসলো, তারপর হাতে তুলে রূপককে খাইয়ে দিলো। মাহি অবাক এই দৃশ্য দেখে। রূপা মনে মনে বললো, “খুব জ্বলছে এবার?আবারও লাগতে আসবে আমার সাথে? ”

চলবে…..

রাজিয়া রহমান

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে