#তুমি_অপরূপা (১৪)
শুক্রবারের এক অলস দুপুর।জুয়েল ছেলের সাথে রুমের মধ্যে ক্রিকেট খেলছে ছোট প্ল্যাস্টিকের খেলনা বল এবং ব্যাট দিয়ে।
বাচ্চাদের নিয়ে কোথাও যাবার কথা ভাবলেই প্রথমে মাথায় আসে চিড়িয়াখানার কথা অথবা শিশু পার্কের কথা।
জুয়েলের ও ব্যতিক্রম নয়।খেলতে খেলতে জুয়েল রানাকে বললো, “বাবা,ঘুরতে যাবা?”
রানা উৎসুকভাবে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কোথায়? ”
জুয়েল হেসে বললো, “চিড়িয়াখানা? ”
রানার মুখে হাসি ফুটে উঠলো সাথে সাথে। ছেলের মুখে হাসি দেখে জুয়েলের ও মন হালকা হয়ে গেলো। বুকের ভেতর কেমন আনন্দের জোয়ার বইতে লাগলো। অন্তরাকে ডেকে জুয়েল বললো, “অন্তরা তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও,আজ ঘুরতে যামু আমরা।”
অন্তরা তখন রাতের রান্নার জন্য আলু কা/টছে।জুয়েল রানাকে বললো, “যাও বাবা,তোমার মা’রে গিয়ে বলো তৈরি হইতে।”
রানা মুখ কালো করে বললো, “উনি কি আমার মা?না তো।মা তো এরকম দেখতে ছিলো না। ”
ছেলের কথা শুনে জুয়েলের বুকের ভেতর দুঃখের আগুন আবার ও জ্ব/লে উঠলো। ছেলেটা এখনো নিজের মা’কে ভুলতে পারছে না।কি অদ্ভুত পৃথিবী!
পৃথিবীর মানুষ এমন কেনো?
কেউ একটা সন্তানের জন্য দিনরাত আল্লাহর কাছে আহাজারি করে আবার কেউ সেই সন্তানকে ফেলে রেখে অন্য কারো হাত ধরে সব ছেড়ে দেশান্তরি হয়।
জুয়েলের মনে পড়ে যায় রানার মা রেশমা যেদিন চলে যায় তার ফুফাতো ভাই জাবেদের সাথে সেই দিনের কথা।জুয়েল অফিসের কাজে বের হবার আগে ছেলে এবং ছেলের মা দুজনের কপালেই চুমু খেলো।রানার মায়ের থুতনির ছোট কা/টা দাগে হাত বুলিয়ে দিয়ে যাবার আগে জিজ্ঞেস করলো কিছু লাগবে কি-না ফেরার সময় আনার জন্য।
তখনও তো সে বুঝতে দেয় নি তার মনে কি চলেছে। কতো নিখুঁত অভিনয় ছিলো তার!
একটুও টের পেলো না জুয়েল।কি দুর্দান্ত অভিনয় দক্ষতা দিয়ে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো সবাইকে।জুয়েলকে বলেছিলো রানার জন্য ফেরার সময় কালো আঙুর নিয়ে আসার কথা এবং তার জন্য ছোট এক পাতা কালো টিপ।
জুয়েল অফিসে যাবার পথে আগেই টিপ কিনলো।
রেশমা ছেলেকে দুপুরে খাইয়ে দিয়ে ঘুম পাড়ালো।তারপর নিজের ব্যাগ গুছিয়ে নিলো।বিকেলে ছেলেকে নিয়ে বের হয়ে গেলো। বাড়ির পাশের দোকান থেকে ছেলেকে একটা চিপস কিনে দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে রেশমা নিরুদ্দেশ হয়ে গেলো।
সন্ধ্যা থেকে রানার কান্না শুরু হলো তার মায়ের জন্য। এক প্যাকেট চিপস আর কতোক্ষণ মায়ের চিন্তা থেকে তাকে দূরে রাখতে পারে!
জুয়েল রাতে ফিরলো যখন তখন শুনলো রেশমা বিকেলে বের হয়েছে এখনো ফিরে নি।সেই রাতেই খুঁজতে বের হলো জুয়েল।পাশের গ্রামে শ্বশুর বাড়ি, সেখানে গিয়ে ও খোঁজ নিলো।কারো ভাবনাতেও ছিলো না ৭ বছরের বিবাহিত জীবন, ৫ বছরের ছোট ছেলে,অন্ধের মতো ভালোবাসতে পারা স্বামীকে ফাঁকি দিয়ে রেশমা ঘর ছেড়ে চলে যাবে কখনো।
রাত ধরে এখানে সেখানে খোঁজাখুঁজির পর সকালে রেশমার বড় ফুফু হামিদা রুদ্রমূর্তি হয়ে রেশমাদের বাড়িতে এলো।তখনই সবাই জানতে পারলো জাবেদ গতকাল বিকেলে তার মায়ের আলমারি থেকে ২৪ হাজার টাকা নিয়ে বের হয়েছে। রাতের ১ টায় কল দিয়ে হামিদা বেগমকে বলেছে সে আর রেশমা এই মাত্র বিয়ে করেছে।সবাইকে জানাতে, সবাই যেনো তাদের জন্য দোয়া করে।
উদভ্রান্তের মতো হয়ে গেলো জুয়েল এই খবর শুনে।বাড়ি এসে আলমারি হাতড়ে দেখে রেশমার কোনো গহনা আলমারিতে নেই,সেই সাথে নেই জুয়েলের মায়ের গহনা,ক্যাশ টাকা।
পরকীয়া!
মানুষকে এমনভাবে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায় যে সেই মানুষ তার ভালো, মন্দ,সুখ,দুঃখ কোনো কিছুই মাথায় রাখতে দেয় না।খনিকের মোহে পড়ে মানুষ একটা হালাল সম্পর্ককে অবমাননা করে।
কাউকে কখনো বলতে পারে নি জুয়েল এক বছর আগে কেনা সেই ছোট একটা টিপের প্যাকেট আজও জুয়েলের মানিব্যাগে বিভিন্ন কার্ডের ভেতরে সযত্নে লুকিয়ে রাখা আছে। কাউকে বলা হয় নি অন্তরার আর রেশমার থুতনির কে/টে যাওয়া দাগটা প্রায় একই রকম দেখতে।
যদি কখনো দেখা হয় সেই বেঈমানীর সাথে তবে জুয়েল সেই টিপের প্যাকেট তার হাতে তুলে দিয়ে বলবে,”আমার কাছে করা তোমার শেষ আবদারের জিনিস। ঠিক ততটা ঘৃণার সাথে তোমাকে দিচ্ছি এই টিপ,যতটা ভালোবেসে কিনেছিলাম তোমার জন্য। ”
অন্তরা একটা সুতির মিষ্টি কালার জামা এবং নেটের ওড়না গায়ে জড়িয়ে নিলো। জুয়েল তখন ভাবনার রাজ্যে ছিলো,ততক্ষণে অন্তরা নিজে তৈরি হয়ে নিয়ে রানাকেও তৈরি করে দিলো।
কোনো প্ল্যান ছাড়াই বাহিরে বের হওয়ার মজাই আলাদা। চিড়িয়াখানায় যেতে প্রায় আধাঘন্টা সময় লেগে গেলো। ভেতরে গিয়ে রানা যতটা অবাক তার চাইতে বেশি অবাক হলো অন্তরা।।জীবনের প্রথম বার সে এই চিড়িয়াখানায় এসেছে। কেমন উত্তেজনা কাজ করছে ভেতরে!
এতো পশু,পাখি দেখে কেমন লাগছে অন্তরার।
অন্তরার এক্সাইটমেন্ট দেখে জুয়েলের কিছুটা খারাপ লাগলো। বিয়ের এতো দিনে এই প্রথম সে অন্তরাকে নিয়ে ঘুরতে এসেছে।
বিশাল এড়িয়া জুড়ে গড়ে ওঠা চিড়িয়াখানা দেখে অন্তরার চক্ষু কপালে উঠে গেলো। আজীবন জেনে এসেছে বাং লাদেশের জাতীয় চিড়িয়াখানা মিরপুরে অবস্থিত।ওখানে বিভিন্ন ধরনের পশুপাখি আছে কিন্তু তা নিজের চর্মচক্ষু দিয়ে দেখার সৌভাগ্য হয় নি কখনো।
উল্লুকের খাঁচার সামনে গিয়ে রানা ভীষণ আনন্দ পেলো।ওদের চিৎকার,চেচামেচি মায়হা ধরিয়ে দিচ্ছে যেনো।
সবার দেখাদেখি রানা ও বায়না করলো বানপ্রকে কলা খাওয়াবে সে।অগত্যা তাই হলো।
সিংহ,বাঘ,ভাল্লুক সবাই কেমন অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে সবার দিকে।
শিকলে বাঁধা পড়লে এরকম হিংস্র পশু ও ভীষণ অসহায়, মানুষের হাতের পুতুল হয়ে যায়। অথচ যদি এরা সবাই নিজ নিজ জায়গায় থাকতো তাহলে এই চোখে অসহায়ত্ব নয়,বরং ফুটে উঠতো অন্যরকম একটা তেজ।
সব কিছু ছাড়িয়ে অন্তরার চোখে পড়লো ময়ুর।রূপার ভীষণ পছন্দ ময়ুর।সবসময় বলতো,আপা আমার যদি কখনো অনেক টাকা হয় তবে আমি হাঁস,মুরগী পালবো না মায়ের মতো। আমি ময়ুর পালবো।
কেমন রাজকীয় এক ভাবভঙ্গি নিয়ে হাটাহাটি করছে ময়ুর।
সারা অঙ্গে এক স্বর্গীয় রূপ নিয়ে প্রচন্ড অহংকারীর ন্যায় হাটছে কেউ,কেউ বা বসে আছে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে।
গায়ের উজ্জ্বল নীল আর সবুজ রঙের কাছে পৃথিবীর সব রঙ যেনো ম্লান হয়ে যায়। বেশ খানিকটা জটলা ময়ুরের খাঁচার সামনে। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে সেই বিস্ময়কর দৃশ্য দেখার,কখন ময়ুর তার পেখম মেলে তার রূপের ১৬ আনা প্রকাশ করবে।
চিড়িয়াখানা থেকে বের হওয়ার সময় অন্তরার ভীষণ মন খারাপ হলো। ছোট বোনদের কথা ভীষণ মনে পড়তে লাগলো। যদি চার বোন মিলে একসাথে এই সময়টা কাটাতে পারতো!
জুয়েলের অলক্ষ্যে চোখের জল মুছে নিলো অন্তরা।স্ত্রী, সন্তানকে নিয়ে জুয়েল বাসার উদ্দেশ্যে বাসে উঠে গেলো। সেই সাথে বাসে উঠলো চিড়িয়াখানা থেকে তাদেরকে ফলো করে আসা এক জোড়া চোখ।
————–
সকালে অপরূপা বের হলো কলেজের উদ্দেশ্যে। বাসা থেকে কলেজ খুব একটা বেশি দূরে না।হেঁটে যেতে প্রায় মিনিট বিশেক লাগে তবে আজ রূপার ঘুম থেকে উঠতে দেরি হওয়ায় অন্য দিনের মতো হেঁটে চলে যেতে পারলো না।
রিকশার জন্য রূপা অপেক্ষা করছিলো যখন সেই মুহুর্তে দেখতে পেলো রূপক বাইকে করে তার বোনদেরকে নিয়ে যাচ্ছে।
রূপককে দেখে বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে ফেললো রূপা। বাইকের গ্লাসে দৃশ্যটা দেখে রূপকের ইগো হার্ট হলো।
এরকম একটা সুপুরুষ, হ্যান্ডসাম যেখানে মেয়েদের ক্রাশলিস্টের টপে থাকে সেখানে কি-না গ্রামের একটা মেয়ে তাকে দেখে নাক মুখ কুঁচকে ফেলছে!
তাকে দেখে কি নর্দমার মতো লাগছে যে মেয়েটা এরকম করলো!
পান্না ফিসফিস করে বললো, “আপা,মেয়েটা আমাদের কলেজেই পড়ে। আর্টসের স্টুডেন্ট। ”
রিকশার অপেক্ষা করতে করতে অবশেষে সোনার হরিণের দেখা পেলো রূপা।রিকশায় উঠে বসলো। কিছুটা যেতেই রাস্তার মোড় ঘুরার সময় রিকশা আর একটা চলন্ত বাইক মুখোমুখি লেগে গেলো। ধাক্কা লেগে রূপা রিকশা থেকে রাস্তায় পড়ে গেলো।
মাথায় হেলমেট থাকায় রূপকের তেমন একটা লাগে নি।তবে উঠে দাঁড়িয়ে দেখলো দোতলার সেই মেয়েটা রাস্তায় পড়ে আছে। হাতের চামড়া বেশ অনেকটা উঠে গেছে পিচঢালা রাস্তার সাথে ঘষা লেগে।
কিছুটা মায়া হলো রূপকের মেয়েটার এরকম দুরবস্থা দেখে।এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলো রূপাকে তোলার জন্য।
রূপা রূপকের দিকে এক নজর তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো তারপর নিজে নিজেই উঠে দাঁড়ালো।
রূপকের ততক্ষণে ইগো আরো হার্ট হচ্ছে।
এই মেয়েটা তাকে পাত্তাই দিচ্ছে না!
মেয়েটা কি তাকে উপেক্ষা করতে চাইছে? কেনো উপেক্ষা করতে চাইছে?
সবসময় সবার এটেনশান পাওয়া মানুষকে যখন কেউ তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে তখন তার ইগোতে সবচেয়ে বেশি আঘাত লাগে। তাদের একটা সহজাত ভাবনা থাকে যে সে সবসময় সবার আগ্রহের কারণ হবে,সবাই তার প্রতি আকৃষ্ট হবে,এবং এটাই যেনো চিরন্তন সত্য।তার একটু এদিক ওদিক কখনো হতে পারে,কেউ তাকে অগ্রাহ্য করতে পারে এটা কখনো রূপকের ভাবনায় ছিলো না।
যার কারণে রূপা চোখে মুখে ফুটে ওঠা বিরক্তি ভাব রূপক কে ভীষণ ভাবে পোড়াতে লাগলো। হৃদয় যেনো পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে, নিজের আত্মসম্মানে কেমন একটা তীক্ষ্ণ তীরের ফলা এসে বিঁধেছে।
কেমন যেনো লাগলো রূপকের!
নিজেকে সামলে সে বাসার দিকে গেলো। মনে মনে ঠিক করলো আবার দেখা হলে মেয়েটাকে বেশ কিছু কথা শুনিয়ে দেবে।
একটা পায়ে রূপা ভীষণ চোট পেয়েছে, কিছুটা খুড়িয়ে খুড়িয়ে যখন বাসার দিকে যাচ্ছিলো, সমুদ্র তখন বের হচ্ছে ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে। হলুদ জামা পরা মেয়েটার পাশ কাটিয়ে কিছুটা যেতেই আচমকা সমুদ্রের মনে পড়লো মেয়েটাকে সে আগে কোথাও দেখেছে।
কোথায় দেখেছে কিছুতেই মনে করতে পারছে না।
চলবে……
রাজিয়া রহমান
#তুমি_অপরূপা (১৫)
আগামীকাল শাহেদের ফ্লাইট, সৌদি আরবের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিবে।বিকেলে শাহেদ অনামিকাকে নিয়ে বের হলো। দুজনেই একটু সেজেগুজে বের হলো।
রোজিনা ঘরের বারান্দায় বসে নিষ্পলক তাকিয়ে রইলেন।ভেতরে ভেতরে তার রাগে ক্ষোভে সব পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে।
এতো রঙঢং কিসের এই মেয়ের!
ভ্যাপসা গরমে রোজিনার সারা শরীর জ্বলে যাচ্ছে, ঘামাচি হয়েছে গায়ে।ভেবেছিলেন অনামিকাকে দিয়ে একটা একটা করে ঘামাচি মারাবেন।
যেভাবেই হোক শাহেদ আর অনামিকাকে আলাদা রাখার প্ল্যান।
শেষ সময়ে এসে সব ভেস্তে যাবে এটা হাসানুজ্জামান, রোজিনা কারোরই কাম্য ছিলো না। প্রায় প্রতি রাতেই রোজিনা হাউমাউ করে কান্না করতেন হাটুতে ব্যাথা বলে। কান্না করতে করতে আজরাইল কে অভিশাপ দিতেন কেনো এতো দেরি করছে তার কাছে আসতে।এই কষ্ট তার সহ্য হয় না।
শাশুড়ীর আহাজারিতে অনামিকা রুমে থাকতে পারতো না। বসে বসে পায়ে মালিশ করতো। রুমে যেতে যেতে গভীর রাত হয়ে যেতো।
দিনে ব্যস্ত রাখতো বিভিন্ন কাজে,কথাবার্তায়।
অনামিকার দুচোখ ভীষণ জ্বালা করছে।বুকের ভেতর আছড়ে পড়ছে কষ্টের নীল ঢেউ।আর মাত্র কয়েক ঘন্টা। তারপর!
তারপর শাহেদ চলে যাবে তাকে ছেড়ে হাজার মাইল দূরে। চাইলেই আর ছুঁতে পারবে না সে শাহেদকে।হুটহাট রুমে এসে অতর্কিত চুমু খাওয়া, বাহিরে বের হবার আগে হঠাৎ করে বুকে জড়িয়ে ধরা,কোনো কিছু নিয়ে মনমালিন্য হলে কথার মাঝখানে টেনে নিয়ে ঝাপটে ধরা এসব আর পাবে না।কিভাবে থাকবে অনামিকা তখন?
আফসোস হচ্ছে অনামিকার। ভীষণ ভীষণ আফসোস হচ্ছে। কেনো রাজি হলো সে শাশুড়ীর কথাতে শাহেদকে বিদেশে যাওয়ার জন্য চাপ দিতে!
তার কি সত্যি অনেক টাকা দরকার ছিল?
না-কি শাহেদের সান্নিধ্য দরকার ছিল?
যাকে পাবার জন্য বাবা মা’কে কষ্ট দিতেও দ্বিতীয় বার ভাবে নি অনামিকা, আজ তাকেই কিভাবে দূরে যেতে দিচ্ছে?
ভাবনায় বিভোর হয়ে থাকায় অনামিকা টের পেলো না কখন যেনো নিজেদের বাড়ির সামনে চলে এসেছে রিকশা।
কতো দিন পর বাড়ির সামনে এসেছে অনামিকা। বুকের ভেতর কেমন কেঁপে উঠছে।হঠাৎ করেই নিজেকে ভীষণ স্বার্থপর মনে হলো অনামিকার।
এতোগুলো দিন কেটে গেলো অথচ একবার ও বাড়ির সবার সাথে দেখা করতে এলো না সে।
কেনো এলো না?
ভয়ে?
কিন্তু কার ভয়ে?এতোই যদি ভয় পেতো তবে কেনো বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল সেদিন?
আজ এতোদিন পরে কোন মুখে মা বাবার সামনে দাঁড়াবে?
শাহেদ অনামিকার হাত ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে গেলো। বাড়িতে ঢুকে অনামিকা চমকে গেলো।
সারা বাড়ি কেমন অপরিষ্কার হয়ে আছে। জায়গায় জায়গায় ময়লা জমে আছে, গাছের পাতায় উঠোন ভরে আছে।
মা ঠিক আছে তো!
মা তো এরকম অপরিষ্কার থাকা পছন্দ করে না।
শুকনো পাতার মর্মর শব্দে সালমা চমকে উঠলো। আজকাল দিনের বেলাটা বড্ড ভয়ংকর লাগে তার কাছে,তীব্র আলোতে বড্ড বুক কাঁপে।শান্ত বিকেলের, সুনসান নীরবতা কে যেনো তীক্ষ্ণ শব্দে ভেঙে দিচ্ছে। সালমার মাথার ভেতর সেই শব্দ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।
ঘরের দরজায় কড়া নাড়লো শাহেদ।সালমা ভয়ে গুটিসুটি মেরে টেবিলের নিচে বসে রইলো দুই হাতে মাথা চেপে ধরে। মাথার ভেতর যেনো কোনো পোকা অনবরত চিৎকার করে যাচ্ছে।
কি যে যন্ত্রণা হচ্ছে!
আলতো ছোঁয়া লাগতেই ভেজানো দরজা খুলে গেলো। অনামিকা ভেতরে প্রবেশ করলো। ভেতরে এসে কাউকেই খুঁজে পেলো না।
বাহিরে গিয়ে দাদীর ঘরের দরজায় কড়া নাড়লো।
অলস দুপুরে সবাই ঘুমাচ্ছে।দুপুর গড়িয়ে যে বিকেল হয়েছে এখনো কারো খেয়াল নেই।শব্দ শুনে অনামিকার ফুফু সুরভি বের হলো ঘর থেকে। আড়মোড়া ভেঙে সামনে তাকাতেই অনামিকাকে দেখে হতবাক হয়ে গেলো সুরভি। তারপর চিৎকার করে অনামিকার দাদীকে ডাকতে লাগলো।
সুরাইয়া বেগম অনামিকাকে দেখে যেমন অবাক হলেন তেমনি কিছুটা রাগ ও হলেন।চলে গেছে তো গেছেই,আবার ফিরলো কেনো।
অনামিকা আর শাহেদ দুজনেই দাদী আর ফুফুকে সালাম করলো।
সুরাইয়া বেগম জিজ্ঞেস করলেন, “এতো দিন পরে কি মনে কইরা আসলি?জামাইয়ের বাড়ির শখ মিটছে বুঝি?আর থাকতে দেয় না?বাইর কইরা দিছে?আবারও আমার পোলার ঘাড়ে আইসা বসতে চাস?”
“না দাদী,এগুলো কি কন আপনে?আমি তো আসছি সবার সাথে একবার দেখা করতে।আপনের নাতজামাই আগামীকাল সৌদি আরবের উদ্দেশ্যে বাইর হইয়া যাইবো। তাই সবার লগে দেখা করতে আসছে।কিন্তু আম্মা,অপরূপা,অনিতা সবাই কই?আব্বা কি দোকানে গেছে? ”
সুরভি জবাব দিলো, “এতো দিন পরে বাড়িতে আসার কথা মনে পড়লো?
মা যেমন মাইয়া কি ভালো হইবো নি!তোর মা ও তো সেই যে তোর বাপের লগে এই বাড়ি আইসা উঠছে আর যায় নাই নিজের বাপ মা’র বাড়ি।তোরা ও তেমনই হইবি।”
অনামিকার এসব কথা শুনতে ভালো লাগছিলো না তাই আবারও জিজ্ঞেস করলো, “আম্মা কই ফুফু?”
“আমরা কেমনে কমু হেই পাগল কই,তার কি মাথার ঠিক আছে?
কে জানে কই বইসা আছে? ‘
অনামিকা ভ্রু কুঁচকে তাকালো ফুফুর দিকে,শান্ত দিঘির মতো মেয়েটার চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো মা’কে পাগল বলে সম্বোধন করায়।কঠোর স্বরে বললো, ” ফুফু,সুন্দর ব্যবহার করতে না পারলে কথা বইলেন না,কিন্তু আমার আম্মারে নিয়া যদি খারাপ কথা কন,তবে আমি ও আপনেরে সম্মান দিয়া কথা কমু না।”
সুরভি রাগে ক্ষুব্ধ হয়ে বললো, “খবরদার অনামিকা, আমার লগে ত্যাজ দেখাবি না,তোগো ত্যাজের ধার ধারি না আমি । আইজ মা’য়ের লাইগা আদর বাইয়া বাইয়া পড়তাছে।সেদিন মা বাপের কথা মনে ছিলো না যেদিনে আরেক নাগরের হাত ধইরা বাপ মায়ের বুকে লাথি মাইরা পালাইয়া গেছস?
আইজ শোকে শোকে যখন পাগল হইছে তোড় মা,তারে পাগল কমু না তো কমু কি?”
অনামিকা কিছু বুঝতে পারলো না ফুফুর কথা। কি বলছে এসব ফুফু?
অনামিকার মাথার ভেতর কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে,মাথা কাজ করছে না।
অনিতা স্কুল থেকে ফিরে বাহিরে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো দাদীর ঘরের সামনে কারা দাঁড়িয়ে আছে। পিছনে তাকিয়ে অনামিকা ছোট বোনকে দেখে দৌড়ে বোনের কাছে ছুটে এলো।
অনিতাও অবাক হলো আপাকে দেখে।একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লো । শাহেদ সবকিছুতে নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে।
কাঁদতে কাঁদতে অনিতা বললো, “আপা,তুই কই চলে গেলি আপা?সবাই চলে গেছে আমারে রাইখা। সেজো আপা ও চইলা গেছে শহরে পড়ার লাইগা,মা ও কেমন হইয়া গেছে। সবাই কয় মা পাগল হইয়া গেছে। কারো লগে কথা কয় না মা।কাউরে চিনে না এখন আর। সারাদিন ঘরে থাকে,রাইত হইলে বাইর হয়। আমার অনেক ডর করে আপা।আমার লগে এখন আর কেউ ঘুমায় না।”
অনামিকার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। এসব কি শুনছে সে!
বিকেলের দিকে দোকান বন্ধ করে দেয় সিরাজ হায়দার। বাড়িতে এসে দু মুঠো রান্না বসায় বাপ মেয়ে মিলে।সন্ধ্যায় আবার দোকানে গিয়ে বসে।তেমনি আজও বাড়ি এলো । উঠোনে এসে দাড়াতেই দেখে অনামিকা এসেছে।
বাবাকে দেখে অনামিকার গলা শুকিয়ে গেলো ভয়ে।এতোক্ষণ মনে ছিলো না আব্বার মুখোমুখি হতে হবে সেই কথা। অনামিকার মনে হতে লাগলো তার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে, সেই কোনো গহীনে তলিয়ে যাচ্ছে। কেমন সারা পৃথিবী দুলে উঠলো হঠাৎ করেই, অনামিকার ও মাথা ঘুরতে লাগলো।
শাহেদ এগিয়ে এসে অনামিকার হাত ধরলো। তারপর সিরাজ হায়দারের সামনে এসে তাকে সালাম করলো।
সিরাজ হায়দার সালামের জবাব দিলেন
————–
অন্তরা চুলায় ভাত বসিয়ে আলু কা/টতে বসেছে।সেই সময় দরজায় নক করলো কেউ।একটা পুরনো ন্যাকড়ায় হাত মুছে অন্তরা দরজা খুলে দিলো। একজন অচেনা মহিলা বাহিরে দাঁড়িয়ে ছিলো। অন্তরা চিনতে না পারায় জিজ্ঞেস করলো, “কে আপনি? কার কাছে এসেছেন? ”
ভেতরে উঁকিঝুঁকি মেরে মহিলাটি কোমল গলায় বললো, “রানাবাবু,রানাবাবু কই রে?”
রানা বসে বসে একটা গাড়ি দিয়ে খেলছিলো। মায়ের গলার স্বর শুনতে পেয়ে দৌড়ে বের হয়ে এলো। তারপর রেশমাকে দেখে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো রানা।আকুল হয়ে মা মা বলে কাঁদতে লাগলো রানা।
রানা মা’কে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। বড় আকুল হয়ে কাঁদছে।ভীষণ আমধুর একটা দৃশ্য, অথচ এই দৃশ্য দেখে অন্তরা খুশি হতে পারলো না।
অন্তরার গলা শুকিয়ে গেলো রেশমাকে দেখে। কেনো এসেছে রেশমা!
চলবে……
রাজিয়া রহমান
#তুমি_অপরূপা (১৬)
গিটারের টুংটাং শব্দ আর ধূমায়িত চায়ের কাপের সাথে সমুদ্রের আজকের দিনটি কাটছে।আজকের দিনটা কেমন মন খারাপ করা দিন,কেমন উদাসী হয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করে।
কাপের চা শেষ হতেই সমুদ্র উঠে দাঁড়ালো আরেক কাপ চা আনার জন্য। ঘন ঘন চা খেতে হয় বলে নিজেই নিজের চা বানায়। একটু আগে যদিও মায়ের দেওয়া চা পান করেছে এবার আর মা’কে চা’য়ের কথা বলার মতো রিক্স নিলো না।কেননা সমুদ্র জানে এবার চা চাইলে চায়ের সাথে জুতা ও ফ্রী দিবে মা।
নিজেই দুই কাপ চা বানিয়ে মায়ের রুমে গেলো। তারপর এক কাপ মা’কে দিয়ে নিজে জানালার পাশে বসলো।
রেখা ছেলের গতিবিধি তীক্ষ্ণ নজরে লক্ষ্য করছেন সারাদিন ধরে। ছেলেটা আজ ভীষণ আনমনা হয়ে আছে। চা’য়ের কাপে চুমুক দিয়ে রেখা বললো, “চা তো ভীষণ ভালো হয়েছে রে সমুদ্র।”
সমুদ্র হেসে বললো, “ধন্যবাদ মা।”
রেখা কিছুক্ষণ চুপ থেকে জিজ্ঞেস করলেন, “মন খারাপ বাবা?”
সমুদ্র চমকে তাকালো মায়ের দিকে। মা কিভাবে জানলো তার মন খারাপ যে!
মুচকি হেসে বললো, “না মা,মন খারাপ না।”
“আমার সাথে মিথ্যে বলছিস,ভুলে যাস না আমি তোর মা।তুই আমার পেট থেকে হয়েছিস,আমি তোর পেটে না।”
মায়ের কথা শুনে সমুদ্র হাসতে লাগলো। রেখা অবাক হয়ে দেখছে ছেলের ঠোঁটে হাসি অথচ দুই চোখ দিয়ে অঝোরে জল ঝড়ছে।
হাসতে হাসতে সমুদ্র বিদায় নিলো মায়ের রুম থেকে ।
রুমে গিয়ে ল্যাপটপ অন করে কয়েকটা পিকচার দেখতে লাগলো। বুকের ভেতর থেকে থেকে কেমন একটা ব্যথা উঠছে।যেই ব্যথা মনে করিয়ে দিচ্ছে প্রচন্ড কষ্টের কথা।
আলমারি থেকে ছবির এলবাম বের করতে গিয়ে সমুদ্র থমকে দাঁড়ালো আলমারিতে রাখা একটা ওড়না দেখে । অস্ফুটস্বরে বললো,
“কপালকুন্ডলা!
মাই গুডনেস! কপালকুন্ডলা ঢাকায় এসেছে, অথচ এতো খুঁজেছি আমি তাকে গ্রামে,কিন্তু পাই নি।
শিট!
এখন আমি তাকে আবার কোথায় খুঁজে পাবো! ”
————–
শাহেদকে বিদায় দিলো অনামিকা এক বুক ব্যথা নিয়ে। এতো দিন ধরে শাহেদের সাথে থাকতে থাকতে বাবা মায়ের খবর নেওয়ার কথা তেমন একটা মনে পড়ে নি।কিন্তু গতকাল মা’কে যে অবস্থায় দেখেছে তার পর থেকে অনামিকা নিজেকে নিজে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারছে না।
নিজেকে ভীষণ অপরাধী লাগছে তার।
গতকালের কথা মনে পড়তেই অনামিকার হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেলো ।
সিরাজ হায়দার মেয়ে আর মেয়ের জামাইয়ের সালাম নিয়ে ঘরে চলে গেলেন।অনিতা ও বাবাকে দেখে বোনের পাশ থেকে সরে চলে গেলো বাবার কাছে । বাবা মেয়ে মিলে রান্নাবান্নার কাজে লেগে গেলেন শাহেদ আর অনামিকাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে। যেনো উঠোনে কেউ নেই।
বাবার রাগ সম্পর্কে অনামিকার ধারণা আছে, তাই ভয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারছে না।লজ্জায়,অননুতাপে ম্রিয়মাণ অনামিকার সাহসে দিচ্ছে না বাবার সামনে যেতে আর।
সিরাজ হায়দার ঘরে গিয়ে সালমা কে নিয়ে এলো। বারান্দায় একটা টুলে এনে বসালো পরম যত্নে।সিরাজ হায়দার ছাড়া আর কাউকে চিনে না সালমা।ভুলে যায় সবার কথা বারবার।
অনামিকা মা’কে দেখে শোকে মুহ্যমান হয়ে গেলো। বুকের ভেতর থেকে কান্না দলা পাকিয়ে গলায় এসে আটকে গেছে। ইচ্ছে করছে আকাশ বাতাস ফাটিয়ে চিৎকার করে কান্না করতে।কিন্তু পারছে না কিছুতেই।সারা শরীর যেনো জমে বরফ হয়ে গেছে,চাইলেও নড়াচড়া করতে পারছে না।
শাহেদ পরিস্থিতি থমথমে দেখে প্রথমে চুপ ছিলো। শাশুড়ীকে দেখে শাহেদের নিজের ও বুক কেঁপে উঠলো। এতটা মানসিক আঘাত দিয়েছে সে!
ভেবে পাচ্ছে না কি করবে শাহেদ।তবুও সাহস করে সামনে এগিয়ে গেলো শাহেদ।সিরাজ হায়দার শাহেদ কে এগিয়ে আসতে দেখে রান্নাঘর থেকে ধারালো দা** নিয়ে এসে বসলো বারান্দায়। তারপর বজ্রকণ্ঠে বললো, “আর এক পা ও আগাইবেন না আপনেরা দুইজনে। তাইলে কইলাম আইজ এইখানে র**ক্তের বন্যা বহাই দিমু আমি। আমি কাউরে চিনি না,আমার শুধু দুইটা মাইয়া।বড় দুই মাইয়ারে আমি মনে মনে অনেক আগেই কুরবানি দিয়া দিছি। ”
গতকালের কথা ভাবতে ভাবতে অনামিকা ডুকরে কেঁদে উঠলো। কেনো এমন হলো তার ভাগ্য! কেনো এরকম করলো সে!
আজ কিভাবে নিজেকে নিজে সামলাবে?
রুমে অনামিকা এসব ভেবে কাঁদছিলো,সেই মুহূর্তে রোজিনা রুমে এলো। অনামিকার হাত ধরে টেনে বাহিরে নিয়ে বললো, “নবাবজাদি হইছস তুই?ঘরে বইসা বইসা কান্দনের নাটক দেখাস?দুনিয়ার কাজ বাহিরে,কাজ করবো কে?”
।অনামিকা শাশুড়ীর এরকম ব্যবহার দেখে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
রোজিনা থামলো না,অনামিকার হাত ধরে পুকুর ঘাটে নিয়ে বললো, “এই সব কাপড় ধুইবি, তারপর সব শুকাতে দিবি।ধোয়া হইলে রান্দন বসাইবি ”
অনামিকা তখনও হতভম্ব হয়ে আছে। পুকুর ঘাটে জমে আছে অনেক গুলো কাপড়। রোজিনা আলমারি থেকে তোলা সব কাপড়, ঘরের আনাচে কানাচে থাকা সব কাপড় বের করে এনেছে অনামিকাকে দিয়ে ধোয়ানোর জন্য।
চোখের জল মুছে অনামিকা কাজে লেগে গেলো। নিজের হাতে নিজের বিপদ নিজে যখন ডেকে এনেছে তখন তার মূল্য তো দিতেই হবে।
————–
গতকাল রেশমা এসে চলে যাওয়ার পর অন্তরা কিছুটা স্বস্তি পেলো । কিন্তু সেই স্বস্তিকে আতংকে রূপ দিতেই পরদিন অন্তরা আবারও এসে হাজির সাতসকালে।
জুয়েল অফিসে যাওয়ার আগ মুহূর্তে রেশমা এসে হাজির হলো।
অন্তরা তখন জুয়েলের জন্য ভাত বাড়ছে।
কলিং বেল বাজতেই জুয়েল দরজা খুলে দিলো। জুয়েলকে দেখে রেশমা জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। পলকহীনভাবে অন্তরা সেই দৃশ্য দেখতে লাগলো। বুকের ভেতর তখন কেমন কালবৈশাখী ঝড় উঠেছিলো তা কেউ জানতে পারে নি।
জুয়েল রেশমাকে এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে সরে দাঁড়ালো। তারপর ক্রদ্ধস্বরে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি! কেনো এসেছ এখানে?”
রেশমা আগে থেকেই চিন্তাভাবনা পরিকল্পনা করে এসেছে।সেদিন চিড়িয়াখানায় জুয়েলদের দেখেই পিছু নিয়ে এসেছে এখানে।যার হাত ধরে সাজানো সংসার ছেড়ে গিয়েছিলো,তার কাছে টিকতে পারে নি।
নেশাখোরের সাথে তো জীবন কাটানো যায় না।
রেশমা সহজভাবে জবাব দিলো, “আমি আমার ছেলেকে ছেড়ে কোথাও যাবো না। আমার ছেলেরে নিয়াই যাবো। ”
“ছেলেকে ছেড়ে যেদিন অন্য পুরুষের সাথে পালাইছিলা,সেদিন মনে ছিলো না ছেলের কথা? ”
“এতো কথা বুঝি না আমি, আমি রানারে ছাইড়া যাবো না। তাছাড়া আমাদের এখনো ডিভোর্স হয় নাই।তুমি আমারে ডিভোর্স দিলেও আমি সই করমু না। আর যদি সই করতেই হয় তাইলে দেনমোহরের ৪ লাখ টাকা আর রানা দুইটাই দিতে হবে আমারে।”
জুয়েল থমকে দাঁড়ালো রেশমার কথা শুনে। তারপর হঠাৎ করেই রেশমার গলা টিপে ধরে দাঁত কিড়মিড় করে বললো, “আর যদি তোরে এইখানেই এখন মাই**রা ফালাই তাইলে তো কোনো কিছুই দিতে হইবো না।আমারে জিন্দা লাশ বানাইয়া চইলা গেছস আবার ফিরলি ক্যান?আমি সংসার করতাছি দেইখা কি গায়ে জ্বালা ধইরা গেছে? ”
রানা ছুটে এসে মা’কে জড়িয়ে ধরে মা মা করে কেঁদে উঠলো, অন্তরা টেনে জুয়েলকে ছাড়িয়ে দিলো।
কাশতে কাশতে রেশমা ফ্লোরে বসে পড়লো গলা চেপে ধরে। এরকম অনেক কিছুই হবে সব রেশমা আগেই ভেবে রেখেছে। সব কিছু সহ্য করার মানসিকতা নিয়েই রেশমা এই খেলায় নেমেছে। সাজানো সংসার আবারও ফিরে পেতেই হবে তার।
যেভাবেই হোক তা!
চলবে……
রাজিয়া রহমান