#তুমি_অন্য_কারো_সঙ্গে_বেঁধো_ঘর(২২)
সারা দিন ধরে মেহমান আসতে লাগলো। নবনী শিমলাকে সাহায্য করতে লাগলো নাশতা বানানোতে।মেঘের সামনে পড়ার ভয়েই নবনী কিচেনে নিজেকে আটকে রেখেছে।
শফিক আহমেদ এলেন বিকেলে।শিমলা নবনীকে এক গ্লাস জুস করতে বলে নিজে নাশতা সাজাতে লাগলো।নবনী জুস বানিয়ে ট্রে তে রাখার জন্য নিয়ে যাচ্ছে সে মুহূর্তে নীড় ছুটে এলো। এসেই নবনীকে জড়িয়ে ধরে বললো, “মিস এসে দেখে যান,আমার অ্যাকুরিয়ামে একটা ইলিশ মাছ চাষ করেছি আমি।”
নীড়ের ছুটে এসে জড়িয়ে ধরার জন্য জুস উপচে নবনীর পরনের শাড়িতে পড়লো। পরনের শাড়ি সামনের দিক পুরো ভিজে গেলো। নবনী কিছু বলার আগে শিমলা তেড়ে এলো ছেলেকে মারার জন্য। নবনী গিয়ে নীড়কে আড়াল করে বললো, “আহা,এতো উত্তেজিত হবার কি আছে? ”
শিমলা বললো,”ওর দুষ্টুমি ভীষণ বেড়ে গেছে নবনী। আজ যদি জুসের জায়গায় কফি হতো কি দুর্ঘটনা ঘটতো বলো তো?”
নবনী হেসে বললো, “ঘটে নি তো,তাহলে এখন এতো রাগ হবার কিছু নেই,আমি শাড়িটি ধুয়ে নিলেই হবে।”
শিমলা ভ্রু কুঁচকে বললো,”পাগল হয়েছ তুমি? এই শাড়ি তুমি পড়ে থাকবে?
তাছাড়া গোসল না করলে স্বস্তি পাবে না,জুসের জন্য পুরো শরীর চটচটে হয়ে থাকবে।আসো আমার সাথে,আমার শাড়ি পরবে তুমি গোসল করে। ”
নবনী বললো, “লাগবে না,বাসায় গিয়ে গোসল করে নিবো।এখন এটা ধুয়ে পড়লেই হবে।”
শিমলা মুখ কালো করে বললো, “ভয় পেও না,আমার কোনো ছোঁয়াচে রোগ নেই।আমি সম্পূর্ণ ফিট।আমার মেডিক্যাল রিপোর্ট তোমাকে দেখাতে পারি।তাও যদি তোমার অস্বস্তি হয় বলো,আমি নতুন শাড়ি কিনে আনবো তোমার জন্য। ”
নবনী লজ্জা পেলো ভীষণ। শিমলার হাত চেপে ধরে বললো, “ছি!কি বলছেন এসব।আমি কি এসব ভেবে বলেছি না-কি? আচ্ছা দিন আপনার শাড়ি পরবো।”
শিমলা খুশি হয়ে নবনীকে নিয়ে গেলো নিজের রুমের দিকে। নবনী আড়চোখে চারদিকে তাকিয়ে দেখলো মেঘকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।এখন পর্যন্ত নবনী মেঘের সামনে পড়ে নি।সকালে মেঘের বলা কথাগুলো শোনার পর থেকে নবনীর ভীষণ লজ্জা লাগছে মেঘের সামনে যেতে।নিজেকে ভীষণ তুচ্ছ মনে হচ্ছে। তার জন্য কখনো কেউ এভাবে কষ্ট পাবে তা নবনী কখনো ভাবে নি।কিন্তু তার পক্ষেও তো সম্ভব না এরকম কিছু মেনে নেওয়া।একবার আঘাত পাওয়ার পর থেকে নবনী বিশ্বাস করে সম্পর্ক হতে হয় সমানে সমানে।উঁচু আর নিচুতে কখনো সম্পর্ক টিকে থাকে না।
সেখানে মেঘ হচ্ছে দূর আকাশের চাঁদ। সে বামুন হয়ে চাঁদের দিকে তাকানোর সাহস পায় না,হাত বাড়ানো তো পরের ব্যাপার। তাছাড়া তার পোড়া অতীতের কথা জানতে পারলে মেঘের মনে আর এই ভালোবাসা থাকবে না। ভাবতে ভাবতে শিমলার রুমে চলে গেলো। শিমলা আলমারি খুলে বললো,”তোমার যেটা ভালো লাগে সেটা নাও।”
নবনী হেসে বললো, “আপনিই পছন্দ করে দিন না।”
শিমলা কিছুক্ষণ ভেবে একটা ল্যাভেন্ডার কালার শাড়ি বের করে দিলো। মেঘের প্রিয় রং ল্যাভেন্ডার কালার। আজকের অনুষ্ঠানের জন্য মেঘ আর নীড় ম্যাচিং করে পাঞ্জাবী এনেছে ল্যাভেন্ডার কালারের।শিমলা নবনীকে শাড়ি ব্লাউজ পেটিকোট সব দিয়ে ওয়াশরুম দেখিয়ে দিলো। নবনী ওয়াশরুমে ঢুকে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। নিজেকে মন দিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো নবনী। নিজের কি কি খুঁত আছে তা বের করার জন্য।
খুঁজে পেলো কপালের এক পাশে ছোট একটা কাটা তাছে,নাকে অনেক ব্লাকহেড জমেছে, থুতনিতে একটা ব্রণ,একটা গজদাঁত।
কিছুতেই তাকে নজরকাঁড়া সুন্দরী বলে দাবী করা যায় না।তবে কেনো মেঘ তার প্রেমে পড়লো?
মেঘের পাশে তাকে কিছুতেই মানায় না।হ্যান্ডসাম মেঘ হাজার হাজার মেয়েদের ক্রাশ,কতো ধনীর দুলালি তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে সেখানে নবনী কে?
এ ও কি সম্ভব কখনো? নবনী গুনগুনিয়ে গান গাইতে লাগলো।
মেঘ এসেছে শিমলার রুমে ড্রেস চেঞ্জ করতে।পরনের কাপড় বদলে পাঞ্জাবী পরে নিলো। তারপর চুল পেছনে দিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখতে লাগলো।
কোন দিক দিয়ে সে অসম্পূর্ণ মেঘ তা খুঁজতে লাগলো। কেনো তবে সে নবনীর মন পাচ্ছে না? একটা মেয়েকেই তো সে ভালোবেসেছে।কখনো তো কোনো মেয়ের সাথে ভাব জমাতেও যায় নি।সবসময় মেয়েদের এড়িয়ে চলেছে নিজেকে শুদ্ধ রাখতে চেয়েছে। সে যার,তার জন্য নিজেকে স্বচ্ছ রেখেছে, তবে কেনো নবনী তাকে পছন্দ করছে না?
কি করলে নবনী তাকে পছন্দ করবে!
ভাবতে ভাবতে বাথরুমের দরজা খুট করে খুলে গেলো। চমকে উঠে মেঘ পেছনে তাকালো।মেঘকে দেখে নবনী যেনো জমে গেলো। যার ভয়ে সারাদিন লুকিয়ে ছিলো শেষ পর্যন্ত কি-না তার সামনেই পড়তে হলো!
সদ্য গোসল করে আসা নবনীর দিকে তাকাতেই মেঘের কেমন প্রশান্তি অনুভব হলো।ভেজা মুখের দিকে তাকিয়ে নবনীকে তার কাছে শিশিরে ভেজা সাদা গোলাপের মতো মনে হচ্ছে। কি স্নিগ্ধ মুখখানা!প্রসাধনীবিহীন মুখটা যেনো ভীষণ কোমল।
মেঘ সবচেয়ে বেশি অবাক হলো নবনীর চুল দেখে।এক মাথা ঘন কালো চুল নবনীর কোমর পর্যন্ত। দেখেই মনে হচ্ছে ভীষণ সিল্কি!
নবনী কি করবে বুঝতে পারলো না। ইচ্ছে করলো এক ছুটে গিয়ে বাথরুমে লুকিয়ে যেতে।কিন্তু তাতে মেঘের অসম্মান হবে।তাছাড়া সে পা নাড়াতে পারছে না কোনো।
মেঘ দু পা এগিয়ে গিয়ে বললো,”তোমাকে দেখার পর থেকে কীরকম গণ্ডগোল হয়ে গেলো সমস্ত জীবন,
ওলটপালট হয়ে গেলো সবকিছু-
সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেললাম বুঝ খেই, চিন্তাসূত্র হয়ে গেলো
বিশৃঙ্খল, এলোমেলো।”
তারপর বের হয়ে গেলো রুম থেকে। নবনীর জড়তা বুঝতে পেরে মেঘ আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না।মেঘের ভীষণ ইচ্ছে করেছিলো নবনীর ভেজা চুল একবার ছুঁয়ে দিতে। নবনীকে ছোঁয়ার দুঃসাহস মেঘের হয় নি।সে ইচ্ছে ও করে নি। বাহিরে এসে মেঘ আর দাড়ালো না। সোজা বাগানে চলে গেলো সে।
নবনী বের হলে তাকে দেখলে হয়তো বিব্রত হবে।নবনীকে বিব্রত করতে মেঘ চায় না।যাকে ভালোবাসা যায় তার সুবিধার জন্য, স্বস্তির জন্য নিজের ইচ্ছেটা বিলীন করে দেওয়া যায়।প্রচন্ড ইচ্ছে থাকার পরেও তাই মেঘ আর নবনীর সামনে দাঁড়িয়ে থাকলো না।
মেঘ বের হতেই নবনী ছুটে গিয়ে রুমের দরজা বন্ধ করে দিলো।এতোক্ষণ তার যেনো নিশ্বাস বন্ধ হয়ে ছিলো।ভয়ে গলা শুকিয়ে গেলো নবনীর।
নবনী ভেবেছিলো সুযোগ পেয়ে মেঘ হয়তো নবনীকে ভালোবাসার জন্য ফোর্স করবে।
কিন্তু নবনীর বিব্রতভাব দেখে মেঘ চলে যাওয়ায় নবনী ভীষণ কৃতজ্ঞ হলো।মেঘের ব্যবহারে সে মুগ্ধ হলো মেঘের উপর।
চুল খোঁপা করে নবনী বের হলো রুম থেকে। উঁকিঝুঁকি মেরে দেখলো মেঘ কোথাও আছে কি-না।
কিন্তু দেখতে পেলো না বাহিরে।একটা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো নবনী।তারপর বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতেই দেখলো মেঘ স্টেজে দাঁড়িয়ে ডিরেকশন দিচ্ছে।
নবনীর ভীষণ ভালো লাগলো এই ব্যাপারটা। প্রথম বারের মতো নবনীর মনে হলো যতটা খারাপ ভেবেছে সে লোকটা ততটা ও খারাপ নয়।
নবনী আর শিমলার ঘর থেকে বের হলো না বাকী সময়। সন্ধ্যায় কেক কাটার পর গানের অনুষ্ঠান শুরু হলো। নবনী কোণের একটা চেয়ারে বসে রইলো। কিছুক্ষণ পর নবনী চমকে গেলো পুরো বাগান মানুষে ভর্তি হয়ে যেতে দেখে।মেঘের গান শুনতে হাজারের বেশি মানুষ এসেছে। নবনী ভীষণ অবাক হলো।
মেঘলা এসে নবনীর পাশে বসে বললো,”অবাক হচ্ছো ভাবী?ভাইয়া একসময় ভীষণ ভালো গান গাইতো।নিজে একটা দল ও গঠন করেছে।তারপর নিজেই গান ছেড়ে দিয়েছে। শুধু আজকে তোমার জন্য গান গাইবে।”
নবনী ভীষণ লজ্জা পেলো। কারো কাছে সে এতটা স্পেশাল হবে কখনো সে ভাবে নি।মেঘ স্টেজে উঠে দাঁড়াতেই সবাই চিৎকার করে উঠলো। হাত তুলে মেঘ সবাইকে থামতে বললো।তারপর মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বললো,”আজকে আমি একটা গান গাইবো খালি গলায়।একটা মেয়েকে আমি ভীষণ ভালোবাসি।এতোটাই ভালোবাসি যে….. বলতে গিয়ে মেঘের গলা ধরে এলো।তারপর বললো সে আজ এখানে উপস্থিত আছে।
শুধু তাকে উদ্দেশ্য করেই আমি আজ গাইবো।কোনো মিউজিক হবে না।”
তারপর খালি গলায় মেঘ গাইতে শুরু করলো,
“ঢেকে রাখে যেমন কুসুম
পাপড়ির আবডালে ফসলের ঘুম
ঢেকে রাখে যেমন কুসুম
পাপড়ির আবডালে ফসলের ঘুম
তেমনি তোমার নিবিড় চলা
মরমের মূল পথ ধরে
ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে
আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে।
ভাল আছি, ভালো থেকো
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো
ভাল আছি, ভালো থেকো
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো
দিও তোমার মালাখানি
বাউলের এই মনটা রে
ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে
আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে
পুষে রাখে যেমন ঝিনুক
খোলসের আবরনে মুক্তর সুখ
পুষে রাখে যেমন ঝিনুক
খোলসের আবরনে মুক্তর সুখ
তেমনি তোমার গভীর ছোঁয়া
ভিতরের নীল বন্দরে
আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে
আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে।”
গান গাইতে গিয়ে মেঘের গলা বুঁজে এলো,দুচোখ নিজের অজান্তেই ভিজে গেলো।মেঘের কান্না সবাই অনুভব করতে লাগলো। মেঘের একটুও লজ্জা লাগলো না এতে,সে কে,তার স্ট্যাটাস কি কিছুই ভাবলো না।মনের সব আবেগ দিয়ে গাইলো আজ।গান শেষ করতে হাততালির হুড়োহুড়ি পড়ে গেলো। সবাই চিৎকার চেঁচামেচি করে আনন্দ প্রকাশ করতে লাগলো। মেঘের বুকের ভেতর ভীষণ পুড়তে লাগলো। নিজেকে মনে হলো ভীষণ অসহায়। কাউকে কিছু না বলে মেঘ নেমে গেলো স্টেজ থেকে।
মাসুমা বেগম টিস্যু দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে নবনীর পাশে এসে দাঁড়ালো। নবনীর হাত চেপে ধরে বললো,”দেখলে মা,আমার গাধা ছেলেটার কান্ড দেখলে।মানুষ কাউকে এরকম ভালোবাসে না-কি!
আমার ছেলেটা যে সত্যি সত্যি কাউকে এতোটা ভালোবাসে আমি তো আগে বুঝি নি মা।বুঝলে আমার ছেলেকে এতো কষ্ট পেতে দিতাম না আমি।আরো আগেই ওর মেয়ের কাছে গিয়ে তাকে ভিক্ষা চাইতাম আমার মেঘের জন্য।আমার ছেলেটা ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে অথচ মা হয়েও এতোদিন আমি এটা বুঝলাম না।”
নবনীর নিজের ও চোখ ভিজে গেলো মেঘের গান শুনে।নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হলো তার। বুকের ভেতর কেমন একটা ব্যথা হচ্ছে। কি করবে সে?
চলবে……
রাজিয়া রহমান
#তুমি_অন্য_কারো_সঙ্গে_বেঁধো_ঘর (২৩)
ক্যান্টিনে বসে নবনী কফিতে ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছে।এরা কফি বেশ ভালো বানায়।নবনীর আজকাল কফি ছাড়া আর কিছু খেতে ইচ্ছে করে না।নিজের সাথে নিজে যুদ্ধ করে পারছে না আর।কেন জানি সে মেঘের দিকে তাকাতে পারে না কিছুতেই।
তার নিজের কাছেই নিজেকে বিরক্তিকর লাগে।।
একটা জীবনে এতো নাটক কেনো তার সাথেই ঘটলো?
কি হতো যদি বাবা তাদের লেভেলের কোনো পরিবারে তাকে বিয়ে দিতো!
তিন বেলা মাছ ভাত না হলেও ডাল ভাত খেয়ে তো স্বামী সংসার নিয়ে তার জীবন কাটিয়ে দিতে পারতো।
না হয় ঘর খানা আধভাঙ্গা হতো,জানালার শিক ভাঙ্গা থাকতো,ঝড় এলে ঘড়ের চাল উড়ে যাবার ভয় থাকতো,বৃষ্টি এলে চালের ফুটো দিয়ে পানি পড়তো,জোছনা রাতে ঘর ভেসে যেতো বাঁধভাঙ্গা চাঁদের আলোয়।
তবুও মনে সুখ থাকতো। দিন শেষে ক্লান্ত একজন তাকে বউ বলে ডেকে কাছে টেনে নিতো।
জীবনে তামিম নামে কোনো কালো অতীত থাকতো না,মেঘ নামের একটা ভাবনা থাকতো না। মেঘের কথা শুনলেও নবনীর বুক ধড়ফড় করে।
নবনীর সামনের চেয়ারে এসে নিতু বসে পড়লো এক প্লেট নুডলস নিয়ে।তারপর খেতে খেতে নবনীকে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি তো স্যারের পিএ তাই না?আসলে আমার ডেস্ক ৭ তলায় তো। আপনি আসার আগে যদিও একই ফ্লোরে ছিলাম আমি আর আমার হাজব্যান্ড।কিন্তু বিয়ের পর দিন থেকে আমাদের দুজনকে দুই ফ্লোরে দেওয়া হয়েছে,তাই আপনার সাথে ওভাবে কথা বলা হয়ে উঠে নি।আমি আর আমার হাজব্যান্ড এই অফিসেই জব করি।বাই দ্য ওয়ে,আমি নিতু।আপনি?”
নবনী শুকনো হেসে বললো, “নবনী।”
নিতু কিছুক্ষণ নবনীর দিকে তাকিয়ে বললো, “এক সেকেন্ড,আপনাকে মনে হচ্ছে অন্য কোথাও দেখেছি,মনে পড়ছে না। ”
নবনীর হাসি পেলো ভীষণ। ইচ্ছে করলো বলতে,”মনে পড়বে না তো আমি জানি মিসেস নিতু,আমার সংসার আপনার হয়ে গেলো, আমার জীবন আপনার জন্য তছনছ হয়ে গেলো, আপনি তা জানবেন না কিছুতেই।”
নিতু কিছুক্ষণ ভেবে বললো, “আমি ভুল না করে থাকলে আপনি আর আমরা একই বিল্ডিংয়ের একই ফ্লোরে থাকি,এম আই রাইট?”
নবনী হেসে বললো, “হ্যাঁ। ”
নিতু চোখ বড় করে তাকিয়ে বললো, “কি আশ্চর্য বলুন তো,একই ফ্লোরে থাকি আমরা, একই অফিসে জব করি,অথচ কেউ কাউকে চিনি না।দিন দিন আমরা রিয়েল লাইফে কেমন আনসোশ্যাল হয়ে যাচ্ছি দেখেছেন।অথচ আগে পরিচয় থাকলে ছুটির দিনগুলো আমাদের এতো বোরিং লাগতো না।একে অন্যের বাসায় গিয়ে চুটিয়ে আড্ডা দিতাম।”
নবনীর ভীষণ রাগ লাগছে নিতুর সাথে কথা বলতে। নিতুকে মনে হচ্ছে তার সবচেয়ে বড় ভিলেন তার লাইফের।যার এন্ট্রিতে নবনীর জীবন তছনছ হয়ে যেতে দেরি হয় নি।নিতুর সাথে হাসিমুখে কথা বলতে নবনীর ভীষণ রাগ লাগছে। ইচ্ছে করছে এক গ্লাস পানি নিতুর গায়ে ঢেলে দিতে। নিজেকে সামলে নবনী দাঁড়িয়ে বললো, “আমার একটু কাজ আছে,এখন আসি। পরে কথা হবে।”
নিতুর জবাবের অপেক্ষা না করে নবনী চলে গেলো ক্যান্টিন থেকে।
নিতু অবাক হলো নবনীর ব্যবহারে।নবনীর গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর নিতু নিজের খাওয়াতে মন দিলো।
নিজের ডেস্কে এসে বসার পর নবনীর কান্না এসে গেলো।
ইদানীং নবনী সবকিছুর উপর বিরক্ত হয়ে যায় সহজে।নিজেকে বারবার বুঝায় এভাবে বিরক্ত হবে না কিন্তু তাতে লাভ হয় না।
চেয়ারে বসে লম্বা একটা শ্বাস নিলো নবনী।তারপর ভাবলো,নিতুর সাথে এরকম ব্যবহার করা উচিৎ হয় নি তার।মেয়েটার কি দোষ!
মেয়েটা হয়তো এসব কিছু জানেই না,জানলে নিশ্চয় এরকম ইজিলি কথা বলতে পারতো না নবনীর সাথে।নবনীর যেমন অস্বস্তি লেগেছে ওর ও তেমন লাগতো।
আড়চোখে একবার মেঘের কেবিনের দিকে তাকালো। তারপর উঠে গেলো আবার ক্যান্টিনের দিকে।
তামিম আজকে অফিসে আসে নি।তাহেরা বেগমের হাঁটুতে ব্যথা,ডাক্তার দেখাতে গিয়েছে। নিতু ক্যান্টিনে বসে অলস সময় কাটাচ্ছে।লাঞ্চ টাইম এখনো ১৫ মিনিটের মতো বাকি আছে।
নবনী আবার এসে নিতুর সামনে বসে হাসলো। তারপর বললো,”সরি,তখন তাড়াহুড়ো করে চলে গিয়েছিলাম।”
নিতু মুচকি হেসে বললো, “ইটস ওকে।আপনি এর আগে কোথাও জব করেছেন না-কি এটাই ফার্স্ট? ”
নবনী হেসে বললো, “না এটাই ফার্স্ট আমার। ”
নিতু বললো, “আপনার লাক ভীষণ ভালো বলতে হবে তাহলে। ”
নবনী কিছুক্ষণ নিতুর দিকে তাকিয়ে বললো,”আপনার চাইতে ভালো হতে পারে নি। ”
নিতু বুঝতে পারলো না। আবার জিজ্ঞেস করতেই নবনী নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,”এই যে কি সুন্দর স্বামী স্ত্রী একই অফিসে জব করেন,একই সাথে আসা যাওয়া করতে পারেন,তাই বলছি।”
নিতু হাসলো শুনে।তারপর বললো,”সেটা ঠিক বলেছেন।তবে কি জানেন,আমরা তাই ভাবি যা বাহিরে দেখি।ভেতরে কার কি হচ্ছে আমরা তা জানি না তো,তাই বুঝি না কার বুকে কি আগুন জ্বলছে। ”
নবনী চমকালো এই কথা শুনে।অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “বুঝলাম না।”
নিতু হেসে বললো, “আসলে ঠিকই বুঝেছেন,কিন্তু বিশ্বাস করতে পারছেন না মনে হয়। যাই হোক,আপনার সাথে কথা বলে ভীষণ ভালো লাগলো।”
নবনী ও হেসে বিদায় নিয়ে চলে এলো,লাঞ্চ টাইম শেষ হয়ে যাওয়ায়।
শুক্রবার বিকেলে নবনী রাবেয়া বেগমের বানানো সবগুলো কাঁথার ছবি তুললো।সর্বমোট ১৮ টা কাঁথা হয়েছে বিভিন্ন রঙের, বিভিন্ন ডিজাইনের।
ঘরের ভেতর ছবি ভালো আসছে না দেখে সাব্বির বললো,”চল আপা,ছাদে যাই।ওখানে ছবি তুলবো।অনলাইনে বিজনেস করার জন্য এই ছবি তলার ব্যাপারটা কিন্তু সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ছবি আর বাস্তবে ১৯/২০ পার্থক্য হলে তবুও মানা যায় কিন্তু এরকম ১৬/২০ হলে কিন্তু কেউ মেনে নিবে না।”
রাবেয়া বেগম বললেন, “চল তো মা,ছাদডা কেমন দেখি নাই তো কোনোদিন। আইজ একটু দেখি।”
ভাইবোন সবাই মিলে হৈহল্লা করে ছাদের দিকে গেলো। কাঁথা,শীতলপাটি,কিছু রঙিন স্টোন নিয়ে সবাই ছাদের দিকে গেলো।
ছাদে গিয়ে দেখে বিল্ডিংয়ের সব মহিলাই ছাদে আছে।এ যেনো এক মিলনমেলা বসেছে।সবার সাথে তাহেরা বেগম, দিশা,লুবনা ও আছে।
নবনী নিজেকে নিজে চোখ বন্ধ করে বললো, “এরা আমার অচেনা। এদের সামনে আমি মোটেও নিজেকে দুর্বল প্রমাণ করবো না।এদের সাথে আমার এখন আর কোনো সম্পর্ক নেই।তাই কিছুতেই নিজের মন কে অশান্ত করা যাবে না।”
এক পাশে পাটি বিছিয়ে একটা গাঁদা ফুলের গাছ পাশে এনে সেখানে কাঁথা রেখে নবনী ছবি তুলছে।সাব্বির দাঁড়িয়ে বোনকে ডিরেকশন দিচ্ছে।
রাবেয়া বেগম ছাদে তাহেরা বেগমকে দেখে কিছুটা বিরক্ত হলেন যেনো।তার ফুলের মতো মেয়েটার জীবনে এই মহিলা কালবৈশাখী ঝড় হয়ে সব এলোমেলো করে দিয়েছে।এক সময় এই মহিলাকে তিনি প্রচন্ড ভয় পেতেন।নিজেকে তার ভীষণ অপরাধী লাগতো। এর সাথে কথা বলতে গেলে।অথচ এখন সময় পালটে গেছে।আজ তাকে রাবেয়া বেগমের ভয় লাগছে না।বরং বিরক্ত লাগছে এই ভেবে যে এরকম একটা ছোট মনের মানুষের সাথে দেখা হয়ে গেলো।
নবনী ছবি তুলতে তুলতে কয়েকজন অল্প বয়সী মহিলা এগিয়ে এলো নবনীর দিকে। যারা এতোদিন নবনী কে,এটা জানতো না,তারাও অন্যদের থেকে জেনে গেলো একসময় নবনী তাহেরা বেগমের পুত্রবধূ ছিলো,এখন ডিভোর্স হয়ে গেছে।
তারা সবাই তাহেরা বেগমকে ঘিরে ধরলো।
নবনীর পাশে গিয়ে একজন জিজ্ঞেস করলো, “এগুলো কি আপনি বানিয়েছেন? ”
নবনী হেসে বললো, “না,আমরা অল্প অল্প সাহায্য করেছি,আমার মা বানিয়েছেন মূলত। ”
অন্য একজন জিজ্ঞেস করলো, “কি করবেন এত কাঁথা?”
নবনী হেসে বললো, “সেল করবো।”
মহিলাদের মধ্যে ফিসফিস শুরু হয়ে গেলো। প্রায় ৫-১০ মিনিট ফিসফিস করার পর একজন বললো,”আমরা তিনজন,তিনটি কাঁথা কিনতে চাই।”
৩ টা বললেও সেখানেই নবনীর ৪ টা কাঁথা বিক্রি হয়ে গেলো। তাহেরা বেগম বিষদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন নবনীর দিকে। এই নবনীকে তার ভীষণ অচেনা লাগছে।আত্মবিশ্বাসে ভরপুর এই নবনী তো তার ছেলের বউ ছিলো না।
নবনী টাকা মায়ের হাতে তুলে দিয়ে বললো, “তোমার প্রথম উপার্জনের টাকা মা।”
রাবেয়া বেগম চমকে গেলেন। সামান্য একটা কথা,অথচ শুনেই তার বুকের ভেতর কেমন আন্দোলিত হয়ে উঠলো। চোখ টলমল হয়ে গেলো।
নবনী মা’কে জড়িয়ে ধরে বললো, “হুররে,আমার মা নিজে এখন স্বাবলম্বী হয়ে গেছে।”
নবনী বাসায় এসে সবগুলো ছবি বিভিন্ন গ্রুপে শেয়ার করলো।তারপর সোজা হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। সন্ধ্যায় নিতু এলো নবনীদের বাসায়। দরজা খুলে দিলো সাব্বির।নিতুকে দেখে সাব্বিরের মুখ কালো হয়ে গেলো। নিতু হেসে জিজ্ঞেস করলো, “কেমন আছো?নবনী কোথায়? ”
সাব্বির ইশারায় নবনীর রুম দেখিয়ে দিলো। তারপর নিজের রুমে ঢুকে গেলো।
নিতু কিছুটা অবাক হলো এরকম ব্যবহারে,তারপর নবনীর রুমের দিকে গেলো।নবনীরা মা বোন সবাই মিলে গল্প করছে।নিতু গিয়ে সালাম দিল।
নবনী হেসে রাবেয়া বেগমকে বললো,”মা উনি হচ্ছে নিতু,আমরা একই অফিসে কাজ করি।আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের তামিম সাহেবের স্ত্রী উনি।”
মুহুর্তেই সবার মুখ থমথমে হয়ে গেলো,দু এক কথা বলে সবাই চলে গেলো। নিতু সবটা খেয়াল করলো। কিছু একটা সমস্যা হয়েছে নিতু বুঝতে পারলো। তবুও কিছুক্ষণ বসে সবার সাথে কথা বললো।
২০ মিনিট পর নিতু চলে গেলো। নিজেদের বাসায় ঢুকেই নিতু নিজে নিজে তামিমকে বলতে লাগলো, “জানো, আমাদের অফিসে যে কাজ করে নবনী,ওদের বাসায় গিয়েছি আমি।মেয়েটা এতো ভালো! আমার তো ভীষণ ভালো লেগেছে ওকে।”
তামিম চা’য়ে চুমুক দিচ্ছিলো,নবনীর কথা শুনে তামিমের হাত থেকে চায়ের কাপ পড়ে গেলো ফ্লোরে। তাহেরা বেগম নিজেও চমকালেন।নিতু সবার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে? ”
তাহেরা বেগম দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,”ছোটলোকের বাচ্চা,কার অনুমতি নিয়ে তুই বাসার বাহিরে গিয়েছিস,তোকে আমি প্রথম দিনেই বলেছি আশেপাশের বাসায় যাওয়া আমার পছন্দ না।”
নিতু হেসে বললো, “আমি ছোট লোকের বাচ্চা না,বরং আপনি হলেন ফালতু মহিলা,যিনি কি-না নিজে সবার বাসায় গিয়ে মানুষের কাছে নিজের পুত্রবধূর বদনাম করেন।নিজেকে সবার কাছে অসহায়, সহজ সরল প্রমাণ করতে চান।প্রতিদিন অফিসে আসা যাওয়ার সময় আশেপাশের সব মানুষের কথা আমার কানে আসে।মূলত ওদের কথা শুনতেই আমি সিড়ি দিয়ে আসা যাওয়া করি।”
তারপর নিজের রুমে চলে গেলো নিতু।তামিম মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো, “এসব মোটেও ভালো কাজ করো নি তুমি মা।সহ্যের একটা সীমা থাকে,মনে রেখো।”
তামিম চলে যেতেই তাহেরা বেগম বিলাপ শুরু করলেন।ছেলে বউয়ের গোলাম হয়ে গেছে,তাকে দুই পয়সার দাম দেয় না।এসব বলে কাঁদতে লাগলেন।
নিতু বিছানায় শুয়ে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলাতে লাগলো। তবুও খটকা রয়েই গেলো যেনো।
চলবে…..
রাজিয়া রহমান