তুমিময় আসক্তি পর্ব-১৯

0
1312

#তুমিময়_আসক্তি
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্ব_____১৯
✨স্পেশাল পর্ব✨

বজ্রাহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি নির্জনের জিজ্ঞাসু মুখশ্রীর দিকে। এটা কী বলছেন উনি? আমাকে চিনতে পারছেন না? আমি হয়তো ভুল শুনেছি! কাঁপা কাঁপা গলায় প্রশ্ন করলাম,

-কী বললে? আরেকবার বলো!

নির্জন আরেক দফা জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে অতি কষ্টে বললো,

-আ্ আমি এ্ এখানে কী ক্ করছি? আপনি ক্ কে?

অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে ধীর পায়ে পিছিয়ে যাচ্ছি। নির্জন আমাকে চিনতে পারছে না! আমাকে প্রশ্ন করছে? এসব কী হচ্ছে আমার সাথে? পাঁচ বছরের দূরত্বের পর এখন আবার অপরিচিত! এর চেয়ে তো মরণও হাজার গুণ ভালো আমার জন্য। সামনের সবকিছু অন্ধকার লাগছে। মাথাটা হঠাৎ ঘুরে উঠতেই ঢলে পড়লাম ফ্লোরে। চোখ খোলা রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে ধীরে ধীরে তলিয়ে গেলাম আঁধার দুনিয়ায়। তারপর আর কিছু মনে নেই।

.

যখন চোখ খুললাম, তখন নিজেকে হসপিটালের বেডে আবিষ্কার করলাম। সামনে শুধু শুভ্রবকেই দেখতে পেলাম। গালে হাত দিয়ে আমার সামনে বসে বসে ঘুমে ঢুলছে। আশেপাশে তাকিয়ে বুঝলাম, এখন সকাল হয়েছে। শুভ্রব আমাকে উঠে বসতে দেখেই হুড়মুড়িয়ে ভালোভাবে বসলেন।

-কেমন লাগছে এখন? দুর্বল লাগছে? মাথা ঘুরছে?

আরও অনেক প্রশ্ন করতে লাগলেন। তার মানে কাল সারাদিন আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলাম। বাবা, মা, নির্জনের বাবা, মা, সারা সবাই একে একে ভেতরে ঢুকলো কিছুক্ষণের মধ্যেই। কিন্তু যাকে আমি বেশি আশা করেছিলাম সে আসেনি। ফ্যাকাসে মুখে আমার দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো সবাই।

-নির্জনের কি শুধু আমাকেই মনে নেই, শুভ্রব?

অনেকটা রাগী স্বরে বললাম কথাটা। শুভ্রব অবাক চোখে তাকালেন। বললেন,

-শুধু তোমাকে কেন মনে থাকবে না? ও তো কাউকেই চিনতে পারছে না! যেহেতু মাথায় গুলি লেগেছে, এমনটা হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। আমি আগেই এমনটা আশংকা করেছিলাম।

বিস্ফোরিত চোখে তাকালাম শুভ্রবের দিকে। রাগী স্বরে বললাম,

-আপনি তো আমায় আগে এসব কিছু বলেননি! কেন লুকিয়েছিলেন আমার থেকে এতো বড় সত্যটা?

শুভ্রব মাথা নিচু করে ফেললেন। মিনমিনে গলায় বললেন,

-আমার সাহস হয়নি তোমাকে এতো বড় সত্যটা বলার। ইন ফ্যাক্ট, আমি জাস্ট ধারণা করেছিলাম। শিয়র ছিলাম না। তাই এসব বলে তোমায় কষ্ট দিতে চাইনি।

তাচ্ছিল্যের হাসি দিলাম। আমার কথা চিন্তা করে এই পাঁচ বছর কী না করেছে শুভ্রব! আমায় সামলানোর ক্ষেত্রে শুভ্রব আর সারার অবদান সবচেয়ে বেশি। কাল সারারাত জেগে আমায় পাহারা দিয়েছে, সেটাও ওনার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। এই শুভ্রবকে দেখে আমার প্রচন্ড আক্ষেপ হয়। এমন ভালোবাসা পেয়েও আমি গ্রহন করতে পারবো না কোনো দিন। যদিও শুভ্রব কোনোদিন আমায় মেনে নেবে না। অথচ নির্জন! সারাজীবন মানুষের মুখে শুনে এলেও আজ ঠিকই মনে হচ্ছে,

“যাহা পাই, তাহা ভুল করে পাই
যাহা চাই, তাহা পাই না!”

সারা এগিয়ে এসে আমার পাশে ঘেঁষে বসে একহাতে জড়িয়ে ধরলো। আশ্বাস দিয়ে বললো,

-মন খারাপ করিস না, ইয়ার। তোর এই মলিন ফেইস দেখতে দেখতে আ’ম টোটালি বোরড্। এই পাঁচ বছরে তোর ভালোবাসায় বিশ্বাস ছিল না তোর? সেই বিশ্বাসের জোরে নির্জন ভাইয়া ফাইনালি আমাদের মাঝে ফিরে এলেন। আরেকটু বিশ্বাস রাখ, ধৈর্য্য ধর! সব ঠিক হয়ে যাবে। সময় তো লাগবেই একটু, তাই না?

তাচ্ছিল্য ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,

-হ্যাঁ, সেটাই! এতো এতো বছর চলে গেল। আরও অনেক সময় বাকি। তাই না, শুভ্রব? ওনারও আমার মতো তিন-চার বছর লাগবে মেমোরি ফিরে পেতে।

শুভ্রব মুখ কালো করে ফেললেন। হয়তো উনিও নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না নির্জনের জ্ঞান কবে ফিরবে। সত্যি বলতে, আমার জীবনটাই ওলট-পালট হয়ে গেছে। কখন কী থেকে কী ঘটে কিছুরই কোনো লজিক খুঁজে পাই না আমি।

.

কেটে বেশ কয়েকটা দিন। নির্জন এখন একদম সুস্থ। হাঁটা চলা, কথা-বার্তা সবই স্বাভাবিক। নিজের বাবা-মায়ের সাথে নতুন করে পরিচিত হতে হয়েছে তার। কিন্তু আমি নিজের পরিচয় এখনো দেইনি। কাউকে জানাতেও দেইনি। ইচ্ছে করেই ওনাকে জানতে দেইনি যে, আমিই সেই যাকে উনি বহু বছর ভালোবেসে এসেছিল। নির্জনের বাসায় এখন তার বাবার বন্ধুর মেয়ের পরিচয়ে থাকতে হচ্ছে। তবুও থাকি। প্রিয় ব্যক্তিটাকে কাছ থেকে তো দেখতে পাই! এটাই বা কম কিসে?

স্টাডি রুমে বই খোঁজার জন্য ঢুকতেই দেখলাম, নির্জন খুব মনযোগ সহকারে বই পড়ছেন। আমার আগমন ওনার দৃষ্টিগোচর হতেই বই নিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন আর বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলেন। খুব বেশি অবাক হলাম না। একয়দিন যতো বারই ওনার মুখোমুখি হয়েছি, উনি আমায় এড়িয়ে গেছেন। বারবারই অবহেলার গ্লানি সহ্য করেছি বুকে পাথর চেপে।

নির্জন আমায় পাশ কাটিয়ে যেতেই বলে উঠলাম,

-শুনুন!

নির্জন থামলেন। ঘাড় ঘুরিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই ওনার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম। নির্জন থমথমে গলায় বললেন,

-কিছু বলবেন?

শুকনো হেসে ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে বললাম,

-কিছু না। এমনিতেই!

বলেই উল্টো ঘুরে চোখ দুটো আড়ালে মুছে প্রয়োজনীয় বইটা হাতে নিলাম। দরজার দিকে এগোতেই দেখলাম, নির্জন এখনো দাঁড়িয়ে আছে। বেশ অবাক হলাম। ওনার চাহনি টাও অন্যরকম লাগলো। তবুও বিষয়টা অগ্রাহ্য করে চলে এলাম সেখান থেকে।

ঘরে ঢুকতেই হাতের বইটা ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। হাত-পা কাঁপছে ক্রমাগত। এতোক্ষণ দাবিয়ে রাখা কান্না গুলো ঝরঝর করে গড়িয়ে পড়তে লাগলো। খাটে হেলান দিয়ে ফ্লোরে বসে পড়তেই দাঁত চেপে চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে এলো। দুই হাতে মুখ চেপে শব্দ থামানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু কান্নার আওয়াজ আসছেই। এতো কষ্ট দিয়েছিলাম আমি নির্জনকে? ওনি তো শুধু অপরিচিতের মতো আচরণ করছেন আমার সাথে! আর সেটাই আমি সহ্য করতে পারছি না। কিন্তু আমি? আমি যা ইচ্ছে তাই বলেছি ওনাকে! কীভাবে সহ্য করেছেন উনি?

আমি কষ্টের তোড়ে দরজা লাগাতে যে ভুলে গেছি, সেটা আমার খেয়ালই নেই। সেই দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে কেউ যে আমার আহাজারি দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছে সেটাও কান্নার কারণে খেয়াল করিনি আমি।

.

ইদানীং ব্যস্ততা আগের তুলনায় বেড়ে গেছে অনেক। সারাদিনের বেশিরভাগ সময় চেম্বারে রোগী দেখেই কাটিয়ে দেই। ফিরিও বেশ রাত করেই। সত্যি বলতে নির্জনের থেকে পালিয়ে পালিয়ে থাকার চেষ্টা করি। ওনাকে এভাবে অচেনা-অপরিচিত ভাবে ট্রিট করতে দেখলেই বুক ফেটে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে। কিন্তু বাড়ি ফিরে ওনার ঘুমন্ত মুখটা একবার হলেও দেখে আসাটা অভ্যাস আমার।

আজ সাড়ে বারোটায় বাসায় ফিরলাম। গাড়ি পার্ক করে নিজের ঘরে যাওয়ার আগে নির্জনের ঘরের দিকে একবার উঁকি দিলাম। ঘুমিয়ে গেছেন অনেক আগেই। দূর থেকেই ঘুমন্ত মুখটা একবার দেখে চলে এলাম।

ফ্রেশ হয়ে রোগীদের ফাইল গুলো একে একে চেক করতে লাগলাম। সবশেষে প্রেসক্রিপশন এড করে নিজের সাইনটা করতে গিয়ে আজ বরাবরের মতো আবারও কলমটা আটকে গেলো। বুক চিরে ভারি একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে সাইনটা করেই দিলাম ‘আফরাহ্ সেহরীশ জোহায়ের’।

সব টাস্ক শেষ করতে করতে রাত আড়াইটা বেজে গেল। ঘুম আসেনি, তবুও বিছানায় শুয়ে পড়লাম। শরীর ক্লান্ত হওয়ায় ঘুমও চলে এলো তাড়াতাড়ি।

কতক্ষণ ঘুমালাম, জানি না! কিন্তু হঠাৎ মনে হলো কেউ একজন ঘরে প্রবেশ করলো। ইদানীং ঘুম অনেক পাতলা হওয়াও জেগে গেলাম। কিন্তু বুঝতে দিলাম না। এতো রাতে কে আমার ঘরে এলো সেটা এখন আমায় জানতে হলে ঘুমের ভান করেই পড়ে থাকতে হবে। কেউ এগিয়ে আসছে, সেটা পা ফেলার আওয়াজেই বুঝতে পারছি। কে এসেছে ঘরে? অন্ধকার ঘরে চোখ মেললেও চিনতে পারবো না! আলো জ্বালাতে হলে উঠে বসতে হবে। এতে তো সে বুঝে ফেলবে যে আমি জেগে গেছি। ব্যক্তিটা আমার পাশে এসে বসতেই মনে মনে অবাক হলাম। এটাই মোক্ষম সুযোগ। উঠে বসার জন্য মনস্থির করতেই কপালে উষ্ণ স্পর্শ পেলাম। গালের ওপরেও উষ্ণ পানির ফোঁটার বর্ষণ অনুভূত হলো! সেই চিরচেনা স্পর্শ! অতিমাত্রায় বিস্মিত হয়ে গেলাম। চোখ দুটো মুহূর্তেই পানিতে ভরে উঠলো। আমি হালকা কেঁপে উঠতেই সে সরে গেল।

কয়েক পা এগিয়ে যেতেই আমি হুট করে উঠে বসে লাইট অন করে দিলাম। সাদা ফকফকে আলোয় সেই আকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটার পৃষ্ঠভাগ দৃষ্টিগোচর হতেই অবাক দৃষ্টিতে তাকালাম। চোখ দুটো পানিতে ঝাপসা হয়ে এলেও তাকে চিনতে আমার এক সেকেন্ড সময়ও লাগেনি!

হঠাৎ আলো জ্বলে ওঠায় নির্জন অনেকটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে থমকে গেলেন। আজ যে উনি ধরা পড়ে গেছে, সেটা বুঝে গেছেন। ধীর গতিতে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই আমার অবাক ও কান্নারত চাহনি দেখে চোখ বন্ধ করে জোরে একটা শ্বাস নিলেন। চোখ বন্ধ করতেই তার চোখ দিয়ে যে দুই ফোঁটা অশ্রু কণা ঝরে পড়লো সেটা আমার চোখের আড়াল হলো না।

নির্জন কাঁদছেন! আমায় দেখে কাদছেন! তার মানে উনি আমায় চিনতে পেরেছেন। মুহুর্তেই চোখে মুখে থাকা বিস্ময় মুছে গিয়ে সেখানে এসে হাজারো আনন্দেরা এসে ভর করলো। আবেগান্বিত হয়ে হেসে দিতেই আবার ঠোঁট বাঁকিয়ে কেঁদে দিলাম। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়লেও মুখে আনন্দের ঝিলিক। নির্জন দূরে দাঁড়িয়ে হাসলেন। এদিক সেদিক তাকিয়ে চোখের পানি পড়া আটকাতে চেয়েও পারলেন না। নিজের চোখে ও গালে হাত দিয়ে আবার তর্জনী আঙুল নাড়িয়ে ইশারায় কাঁদতে নিষেধ করলেন। ওনার কান্না দেখে আরও দ্বিগুণ গতিতে ফুপিয়ে উঠলাম। গায়ের ওপর থেকে কাঁথা সরিয়ে ছুটে গিয়ে ওনার সামনে দাড়ালাম। নির্জন এগিয়ে এসে আমার দুই গালে হাত রাখলেন। চোখের পানি মুছে দিতেই কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বললাম,

-আমায় চ্ চিনতে প্……..

কথা শেষ করার আগেই নির্জন কাঁদতে কাঁদতেই হাসলেন ও মাথা নাড়িয়ে বললেন,

-আমার শ্যামাঙ্গিনী, তোমাকে ভোলার আগে যেন আমার মৃত্যু হয়! তুমি ভাবলে কী করে আফ্রান জোহায়ের নির্জন তার প্রাণভোমরাকে চিনতে পারবে না? আমার নিউরন গুলোতেও যে তুমি মিশে আছো! ভুলি কীভাবে তোমায়? বলো!

নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে যেন! নিজেকে কতোটা সুখী মনে হচ্ছে, তা বলার ভাষা পাচ্ছি না। নির্জনের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে হাউমাউ করে কেঁদে দিলাম। আমার এভাবে জড়িয়ে ধরায় নির্জন পড়ে যেতে নিলেও নিজেকে সামলে নিলেন। নির্জন আমাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন। চোখের পানিতে নির্জনের টি-শার্ট সিক্ত করে দিচ্ছি। আজ এতো সুখে মরে গেলেও আমার কোনো আক্ষেপ নেই!

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে