#তুমিময়_আসক্তি
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্ব_____১৬
গোধূলির হলুদ আভায় ছেয়ে গেছে সম্পূর্ণ আকাশ। এই সময়টা এখন আমার বড্ড প্রিয়। কারণ এই সময়টা অনেক রঙ্গিন বলে মনে হয় নিজের কাছে। জীবনটা যে প্রচন্ড রঙহীন, নীরস হয়ে গেছে আমার। সেই রঙহীন জীবন থেকেই চলে গেছে পাঁচ-পাঁচটা বেরঙ বসন্ত।
পাঁচটা বছর কি অনেক বেশি হয়ে গেল না, নির্জন? এতোটা পাষাণ না হলেও পারতে! প্রতিটা দিন এখন এক-একটা যুগের মতো মনে হয়। প্রতিটা মুহূর্ত বিষাক্ত লাগে। তবুও বেচে আছি এক টুকরো আশা নিয়ে। তুমি ফিরবেই!
নির্জনের গিটারটা ছুঁয়ে ছুঁয়ে এসব আকাশ-পাতাল ভাবছিলাম। এমনসময় কানে কারো বাক্যস্রোত ভেসে এলো,
-আর কতদিন এভাবে চলবে তোর? কী শুরু করেছিস তুই?
ভ্রূ বাকিয়ে পেছন ফিরে তাঁকাতেই বাবাকে গম্ভীর চাহনিতে তাকিয়ে থাকতে দেখলাম। কপালে ভাজ ফেলে বললাম,
-আমি আবার কী শুরু করলাম?
বাবা থমথমে গলায় বললেন,
-সবারই একটা নিজস্ব জীবন থাকে। একটা ভবিষ্যৎ থাকে। অতীতকে আঁকড়ে ধরেই জীবন পার করে দেওয়াটা কি খুব বুদ্ধিমানের কাজ? এখনো সময় আছে। নিজের জীবনটাকে গোছাও। বাবা হিসেবে নিজের মেয়েকে এভাবে বাঁচতে দেখতে কারোরই ভালো লাগবে না নিশ্চয়ই।
অবাক হলাম। বিস্মিত কন্ঠে বললাম,
-জীবন গোছাবো মানে? আমার জীবনে কি আমি প্রতিষ্ঠিত হইনি? তোমাদের কথামতো সবকিছুই তো করলাম! পড়াশোনা কমপ্লিট করে সাইকিয়াট্রিস্ট হিসেবে এপোয়েন্ট হলাম। ক্যারিয়ার তো সেট হয়েই গেল!
বাবা বিরক্তি নিয়ে বললেন,
-আমি তোমাকে সেসব বলিনি। পৃথিবীতে কোনো মানুষ একা বাঁচতে পারে না। আমাদের কিছু হয়ে গেলে তোমার হাত ধরার মতো কেউ থাকবে না। তাই সব এবার অন্তত বিয়ের জন্য রাজী হও।
বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে বললাম,
-বিয়ে! তুমি কি ভুলে গেছো আমি বিবাহিত? এই মুহুর্তে আমার থেকে এসব কিছু আশা করো না। ইভেন ভবিষ্যতেি না। নির্জন ছাড়া অন্য কারো সাথে আবদ্ধ হওয়া আমার জন্য আদৌ কখনো সম্ভব না।
-পাঁচ বছর তো পেরিয়ে গেছে, গুঞ্জন! এখনো আশা রেখেছিস তুই? একবার ভেবে তো দ্………
-ফারদার আমায় এই বিষয়ে কিছু বললে আমি কিন্তু এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।
বাবা হতাশা মিশ্রিত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গেলেন। হয়তো বুঝে গেছেন এ জীবনে আমায় বিয়ের ব্যাপারে কনভেন্স করা সম্ভব না। চোখ ঘুরিয়ে আবার গিটারটার দিকে তাকালাম। এটা নির্জনের সবচেয়ে প্রিয় গিটার ছিল। কতো গান যে ওর গলায় শুনেছি! এই গিটার সে প্রতিটা মুহুর্তের সাক্ষী।
গিটারটা কোলে নিয়ে বসে সুর তুললাম। চোখ দুটো জলভর্তি হয়ে গেল মুহুর্তেই।
চেনা শহরে,
অচেনা ভীড়ে,
তোমাকে পেয়েছি খুঁজে!
কিছু অভিমান,
কিছু পিছুটান,
ছেড়ে যাবে না সহজে!
চাইনি আমি, হারাও তুমি!
বাড়াও মনের দুরত্ব!
তবুও দুজন দূরে হারাই
জিতেও দুজন হেরে যাই।
তবুও দুজন দূরে হারাই
জিতেও দুজন হেরে যাই।
কী দরকার?
মিছে আবদার;
ভুলের পাল্লা ভারী!
জানি নয়-ছয়,
সবই অভিনয়,
তাই দুজনের আড়ি!
তোমার হাসির জন্য আমি সব করে যাই,
ভালোবেসে দিয়েছি তোমায় আমার পুরোটাই।
চাইনি আমি, হারাও তুমি!
বাড়াও মনের দুরত্ব!
তবুও দুজন দূরে হারাই
জিতেও দুজন হেরে যাই।
তবুও দুজন দূরে হারাই
জিতেও দুজন হেরে যাই।
তবুও দুজন দূরে হারাই
জিতেও দুজন হেরে যাই!!!
গাল গড়িয়ে একের পর এক অশ্রু কণা বেয়ে পড়ছে। মাথা নিচু করে হু হু করে কেঁদে দিলাম। কান্নার তোড়ে হেঁচকি উঠতেই মাথার ওপর কারো হাতের স্পর্শ পেলাম। চোখের পানি গুলো কোনে রকমে মুছে মুখ তুলে তাকাতেই শুভ্রবকে দেখতে পেলাম। গায়ে এখনো অ্যাপ্রোন। হাসপাতাল থেকে সরাসরি এখানে এসেছে নাকি! অবাক কন্ঠে বললাম,
-আপনি? এখন এখানে?
শুভ্রব আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই হালকা হাসলো। মাথা থেকে হাত সরিয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
-খুব সুন্দর গানের গলা তোমার!
-নির্জন কেমন আছে?
শুভ্রব আমার দিকে একপলক তাকালো। হতাশ গলায় বললো,
-যেমন ছিল, তেমনই আছে। তোমাকে একটা কথা বলার জন্য এখানে এলাম।
উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,
-হুম, বলুন।
শুভ্রব দাঁতে দাঁত খিঁচে চোখ বন্ধ করে ফেললেন। হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে পেছন ফিরে অনেকক্ষণ নিজের সাথে যুদ্ধ করলেন। খানিকটা অবাক হলাম। ভীত দৃষ্টিতে তাকাতেই শুভ্রব বলে উঠলেন,
-তোমায় এতো কষ্ট পেতে আর দেখতে পারছি না। আমি বোধ হয় আমার কথা রাখতে পারবো না, গুঞ্জন। সব দিক থেকেই হতাশা ঘিরে ধরেছে আমায়। পাঁচ বছর তো চলেই গেল! তুমি প্লিজ মুভ অন করো। ফর গড সেক, তোমার বাবার কথা মেনে নাও।
ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। শান্ত ভঙ্গিতে বললাম,
-আপনার আদৌ মনে হয়, আমি অন্য কাউকে নিয়ে ভাবতে পারবো? এটা ভাবতেই তো শরীর কাটা দিয়ে উঠে আমার! যেমন আছি, বেশ তো চলে যাচ্ছে। এভাবেই যাক।
-তুমি তো নির্জনের সাথে কথাও বলো না! রোজ দূর থেকে দেখে চলে আসো। ওর কাছেও যাও না।
-ওনার ওপর যে আমার অনেক অভিমান। অনেক অভিযোগ। সেগুলো সহজে মিটবার নয়! দূরত্ব যখন উনি সৃষ্টি করেইছেন, তাহলে সেটা বজায় থাকুক যতোদিন না তিনি দূরত্ব মিটাচ্ছেন।
শুভ্রব কথার পৃষ্ঠে কিছু বললেন না। একমনে কিছু একটা ভাবছেন হয়তো! আমি হাতের কাছ থেকে একটা রুবিক্স কিউব নিয়ে ওনাকে দেখিয়ে বললাম,
-এটা দেখেছেন? এটাতে কিন্তু নির্জনের স্পর্শ আছে! কীভাবে জানেন?
শুভ্রব আমার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালো। আমি হেসে বললাম,
-ছোট ছিলাম তখন অনেক। এক ফ্রেন্ডের হাতে এরকম কিউব দেখে আমিও কিনেছিলাম। কিন্তু এটা কীভাবে মিলাতে হয়, সেটা জানতাম না। একদিন অনেক চেষ্টা করছিলাম। এমনসময় নির্জন এসে বললেন,
‘ তোমার মতো পুচকি মেয়েদের খেলনা এটা না। এটা এমন পেঁচালে সারাজীবনেও মিলবে না।’
রাগী গলায় বলেছিলাম,
‘আমি একদম পুচকি না, বুঝেছো? আমার বয়স ছয় বছর। ক্লাসে একমাত্র আমিই নিজের নাম ইংলিশে লিখতে পারি।
নির্জন এক গাল হেসে বলেছিলেন,
‘তাই! ওরে আমার ছয় বছরের মনীষিণী রে! দেও ওটা আমার কাছে। আমি শিখিয়ে দিচ্ছি কীভাবে মিলাতে হয়!’
সেদিন আমাদের বাসায় প্রথম এসেছিল নির্জন। তারপর থেকে প্রায়ই আসতো। ছোট বেলা থেকেই শুরু, ইউ নৌ।
কাহিনী শুনে শুভ্রব মলিন হাসলো শুধু। কিছু বললো না। আমি আবার কিউবটা দেখিয়ে বললাম,
-এটা এখন যদি আমি অর্ডিনারি কারো হাতে দেই, সে এটা নিয়ে হাজারো বার প্যাঁচ দিতে থাকবে। কিন্তু আমি তো জানি এটা মাত্র চারটা মোচড় দিলেই মিলে যাবে। নির্জন নাকি এটা একা-একাই শিখেছিল। নির্জন অনেক বিচক্ষণ। সেই ছোটবেলা থেকেই। এটা তারই প্রমাণ।
শুভ্রব আনমনে বললেন,
-অনেক ভালোবাসো ওকে, তাই না? নির্জন অনেক লাকি। ওকে এভাবেও কেউ ভালোবাসে।
-এজন্যই তো এতো ভরসা ওনার ওপর আমার! প্রণয় হলো, পরিণয় হলো, অথচ পূর্ণতা পেল না। এমনটা কি কখনো হয়, বলুন?
শুভ্রব মাথা নাড়িয়ে বললো,
-এমনটা হবে না। আই উইশ, সব ঠিক হয়ে যাবে। সব ঠিক হতেই হবে।
শুভ্রব চলে গেল। অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে অনেকক্ষণ আগেই। এখন আবার চেম্বারে গিয়ে বসতে হবে আমার। এপ্রোনটা হাতে ঝুলিয়ে বেরিয়ে এলাম বাসা থেকে। পার্কিং এরিয়ার কাছে যেতেই শুভ্রবের কর্কশ কন্ঠস্বর কানে ভেসে এলো। ভ্রূ কুঁচকে সামনে তাকাতেই অবাক হয়ে গেলাম। শুভ্রব নিজের গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সারার সাথে কথা বলছে। কী চলছে ওদের ভেতর?
শুভ্রবের রাগী চাপাস্বর শুনতে পেলাম,
-তোমাকে আমার পেছন পেছন ঘুরতে নিষেধ করেছি না! কেন এসেছো এখানে?
সারা আঙুলে নাক ঘষে ভাব নিয়ে বললো,
-আপনাকে তিন বছর আগে থেকেই তো বলে আসছি, আমি কেন আপনার কাছে আসি। আপনিও তো মানতে চাইছেন না!
শুভ্রব দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
-আজেবাজে বকা বন্ধ করে এখান থেকে যাও। রেগে গেলে থাপ্পড় কিন্তু একটাও মাটিতে পড়বে না!
সারা একটা শুকনো ঢোক গিললো। ভয় চেপে রেখে সাহসী গলায় বললো,
-না, এই ঘড়িটা আপনাকে না পরিয়ে এখান থেকে আমি যাবো না। আমি আপনাকে এই ঘড়িটা পরাতে এসেছি। আপনিই তো বলেছিলেন আমার বরকে এটা পরাতে। তাই আপ্…………
কথা শেষ হওয়ার আগেই শুভ্রব সারা দুই বাহু চেপে ধরলো। অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
-আমি জাস্ট একজনকেই ভালোবাসি আর তাকেই ভালোবেসে যাবো আজীবন। সে জায়গাটা কাউকে দেওয়া সম্ভব নয়। তুমি সবকিছু জানো, তবুও এমন অবুঝের মতো আচরণ কেন করছো? হোয়াই? আমাকে নিয়ে জল্পনাকল্পনা করা বন্ধ করো।
সারা আহত দৃষ্টিতে তাকালো শুভ্রবের দিকে। কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
-তাহলে গুঞ্জনকে বিয়ে করলেই তো পারেন! এখন তো আর নির্জন……..
-জাস্ট শাট আপ। আমি কোনোদিন ওকে বিয়ে করবো না। মরে গেলেও না। নেভার! ওর সুখটা আমি দেখতে চাই। আজীবন ওর ঠোঁটের কোণে হাসি দেখতে চাই। ঐ উজ্জ্বল শ্যাম মায়াবী মুখটাতে আনন্দের ঝিলিক দেখতে চাই। আর এসবের একমাত্র রিজন হলো নির্জন। সেজন্যই এই এপ্রোন আর স্টেথোস্কোপ আবার হাতে তুলে নিয়েছি আমি। গুঞ্জনকে চাই না আমি, ও সুখী হোক এটাই চাই! আর আমি এটাও চাই যে, তুমি আমার থেকে দূরে থাকো। ইউ ডিজার্ভ আ বেটার গায় দ্যান মি।
শুভ্রব গাড়িতে উঠে চলে গেল। একমুহূর্তের জন্যও দাঁড়ালো না। সারা হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছতেই এলোমেলো পায়ে হেঁটে চলে গেল।
হাতে হাত ভাজ করে এতোক্ষণ এদের কাহিনী দেখছিলাম। চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আপনমনে বললাম,
-ভালোবাসার সংজ্ঞাটা আপনার কাছ থেকেই শেখা উচিত, শুভ্রব। শায়ন্তীর প্রভাবে আপনার মধ্যে হিংস্রতা এসেছিলো। কিন্তু আপনার মন যে এতো স্বচ্ছ, সেটা এভাবে কাছ থেকে না দেখলে জানতাম না। কিন্তু আমি এখানে কী করতে পারি? মানব মন যে একটাই! সেটা একজনকেই দেওয়া যায়। চাইলেও দুজনকে দেওয়া সম্ভব নয়!
#চলবে…..