#তুমিময়_আসক্তি
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্ব___০৬
কান্নাগুলো গলায় এসে দলা পাকিয়ে যাচ্ছিলো বারংবার। হঠাৎ নির্জনের বলা কথাটা কানে প্রতিধ্বনিত হতেই হেঁচকি তোলা মুহুর্তেই থামিয়ে দিলো গুঞ্জন। প্রচন্ড বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বললো,
— ম্ মানে! আপনি এখানে এসেছেন?
— হ্যাঁ! এখন কি আমায় ভেতরে ঢুকতে দিবে নাকি চলে যাবো?
— এই না, না! আমি দরজা খুলছি।
গুঞ্জন চট করে বসা থেকে দাঁড়িয়ে মুহুর্তেই দরজা খুলে দিলো। নির্জন সত্যি সত্যিই দাঁড়িয়ে আছে! বরাবরের মতো ভ্রু জোড়া বাঁকিয়ে সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। গুঞ্জনের গাল বেয়ে বড়ো বড়ো দুই ফোটা অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পড়লো। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের গাল দুটো সিক্ত, চোখের পাতায় বেষ্টিত ঘণ পল্লবগুলো দলা পাকিয়ে গেছে, সরু নাকটাও রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে।
নির্জনের চোখ জুড়ে এক প্রাপ্তিময় আনন্দের ঝিলিক! এটাই সেই গুঞ্জন! এতোদিন কৃত্রিম খোলসে আবৃত সত্তাটি আজ পূর্বের রূপধারণ করেছে। মায়ের বলা কথা গুলো কতটা সত্য তা এখন নির্জনের বোধগম্য হলো! তাদের জীবনের প্রেমময় মুহুর্তগুলো গুঞ্জনের স্মৃতির পাতা থেকে মুছে গেলেও অনুভূতির প্রখরতা আজও বিদ্যমান। নিজে শত আঘাত সহ্য করতে পারলেও নির্জনের ব্যথায় ব্যথিত হবেই।
নির্জন পা বাড়িয়ে এগিয়ে গিয়ে গুঞ্জনের চোখের পানি মুছিয়ে দিতেই গুঞ্জন তার বুকে কপাল ঠেকায়। নির্জন ওর মাথায় হাত রেখে বললো,
— এভাবে কাঁদছো কেন? আর এতো কাছাকাছি এসে দাঁড়ানোর মানে? তোমায় স্পর্শ করার কোনো অধিকার তো আমার নেই!
— কষ্ট পেয়েছেন আমার কথায়? আমি আপনার গায়ে হাত তুলতে চাইনি। ওসব বলতেও চাইনি। কিন্তু কীভাবে কী বলে ফেলেছি! মানসিকভাবে দোটানার মধ্যে ছিলাম আমি।
— আমায় মেরেছো তাতে আমার কোনো আক্ষেপ নেই। কিন্তু মারার কারণটা আমায় কষ্ট দিয়েছে। তোমার গায়ে আমিও হাত তুলেছিলাম। প্রথমবার তোমার উদ্ভট কাজের জন্য। তুমি নিজের শাড়িতে হাত দিয়েছিলে সেদিন! রাগ উঠে গিয়েছিল আমার। আর আজকে! চুপ কেন ছিলে তুমি? মুখের ওপর বলে দিতে পারলে না যে তুমি বিবাহিত? ওহ্, তোমার কাছে তো এটাই সত্য যে, আমাদের বিয়েটা এখনো হয়নি! বরাবরই তুমি এক্সট্রা এডভান্টেজ পাও, গুঞ্জন। এই যে, তোমার কষ্টটা তুমিও ফিল করছো আমিও ফিল করছি। কিন্তু আমার বেলায় শুধু আমি একাই কষ্ট পাই। কারণটা কি জানো? মেয়েরা মন খুলে কেঁদে কষ্টটা কমাতে পারে, কিন্তু ছেলেদের প্রকাশ্যে কাঁদার কোনো অধিকার নেই।
কন্ঠ বারবার রূদ্ধ হয়ে আসছে। যতই নিজেকে কঠোর ও শক্ত রাখতে চাক না কেন! আবেগের কাছে স্বভাবতই ব্যর্থ হচ্ছে নির্জন।
— ভালোবাসেন আমায়?
এমন পরিস্থিতিতে গুঞ্জনের সম্পূর্ণ অযাচিত ও অযৌক্তিক প্রশ্ন শুনে নির্জন থমথমে গলায় বললো,
— সব প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইতে হয় না। নিজেই খুজে নিতে হয়। দিনদিন ডাফার হয়ে যাচ্ছো তুমি! নয়তো এই প্রশ্নটা করতে না!!
— এখনো প্রপোজ করেননি!
— করেছিলাম বহু আগেই, কিন্তু তুমি ভুলে গেছ!
গুঞ্জন অবাক চোখে নির্জনের দিকে তাকিয়ে বললো,
— মানে?
আনমনে কী থেকে কী বলে ফেললো ভাবতেই নির্জন নিজেকে গালাগাল দিতে দিতে কৃত্রিম হেসে বললো,
— আব্ আমি বলতে চাইছিলাম যে, প্রপোজ করাটা তো ম্যানডেটরি না! মাত্র তিনটি শব্দের মাধ্যমে নিজের অনুভূতিগুলো প্রকাশ করা কি কখনো সম্ভব? আমার জন্য তো পুরো কম্পোজিশন আকারে বললেও সম্ভব নয়! আপাতত থাক না সবটা না বলা!! অনুভব তো করতে পারছো তুমি সবটা। এটা কি যথেষ্ট নয়?
গুঞ্জন মলিন হাসলো। উপর-নীচ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জ্ঞাপন করলো। নির্জন নিজের দুই হাতে গুঞ্জনের দুই গাল আগলে ধরতেই বললো,
—*তুমিময় আসক্তি* তে আক্রান্ত আমি, গুঞ্জন। সেটার ট্রিটমেন্ট যে শুধুই তুমি করতে পারো! আমার শ্যামাঙ্গিনীতে আমি আজীবন আসক্ত থাকতে চাই!!
গুঞ্জন চমকে উঠলো। সেই কথাগুলো! সেই সুর! আর একই কণ্ঠস্বর! নিজের গাল থেকে হাত সরিয়ে দিয়ে বললো,
— কী বললেন? এই কথা গুলো কেন বললেন আপনি? এই বাক্যগুলো এই টোনেই আমার কানে হুটহাট বেজে ওঠে। মনে হয় খুব কাছের কেউ আমায় এভাবে বলছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সেটা আপনি! আপনাকে কি আমি আগে কখনো দেখেছি?
এমন প্রশ্নে নির্জন খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল। থতমত খেয়ে নিজেকে সামলে বিষয়টা এড়িয়ে যেতে বললো,
— ওসব নিয়ে ভেবো না। হ্যালুসিনেশন হয়তো! কিন্তু তুমি হঠাৎ আমার মুখ থেকে ‘ভালোবাসি’ শোনার জন্য এতো উদগ্রীব হলে কেন বলো তো? যেই তুমি বিয়ে করবে না বলে এতো কাহিনী করলে, সেই তুমি এমন আচরন করছো!
— আমি তো এমনি জিজ্ঞেস করলাম! কিন্তু আমার সাথে কী হচ্ছে আমি কিছু বুঝতে পারছি না। প্রথম থেকেই আপনার ওপর আমার বিরক্ত হয়ে থাকার কথা। কিন্তু আমি সেটা পারছিই না। বারবার মনে হয়, আপনি আমার খুব কাছের, অনেক পরিচিত, আমার সবচেয়ে আপনজন। সবাই বলে, আমি নাকি অনেক কঠিন মনের মানুষ। লাস্ট কবে কেঁদেছি আমার মনে পড়ছে না। কিন্তু আজ আপনাকে আঘাত করে আমি নিজেই কাঁদছি। এসব কী হচ্ছে আমার সাথে? আপনাকে তো আমি চিনি না! একটা অপরিচিত মানুষের প্রতি হঠাৎ এমন অনুভূতি আসার কারণ কী?
দুই হাতে মাথার চুল খাবলে ধরে বিছানায় বসে পড়লো গুঞ্জন। নির্জন সব কিছুর সমীকরণ মেলাতে পারলেও গুঞ্জনকে সেসব বলতে পারবে না। এদিকে গুঞ্জনের মনে জমে থাকা প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। ওর মাথায় হাত রেখে নির্জন আশ্বাস দিয়ে বললো,
— এতো ডেস্পারেট হয়ে যেও না! প্রথম দিনেই বলেছিলাম, এমন অনেক কিছু আছে যা তুমি জানো না। সেগুলো নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে নিজের প্রতি কনসেন্ট্রেইট করো। তোমায় সেলফিশ হতে হবে, গুঞ্জন। শুধু মাত্র নিজেকে নিয়েই ভাববে তুমি। তবে তোমার পাশে ছায়া হিসেবে একজন সবসময়ই থাকবে।
.
শৌভিক আফনাদ নির্জনের দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত স্বরে বললেন,
— গুঞ্জন নামের মেয়েটাকে তুমি নিজের কাছে রাখছো না কেন? ও তোমার স্ত্রী! এভাবে বাইরে ছেড়ে দিচ্ছো যেখানে ওর কোনো প্রটেকশন নেই!
নির্জন সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে দিয়ে বললো,
— ওর জন্য এতো ভাবার কিছু নেই! শুভ্রবের এতো সাহস নেই যে, আমার কাছ থেকে ওকে কেঁড়ে নিবে।
— আমার ছেলে-মেয়ে দুজনেই মেয়েটার শত্রুর মতো। শুভ্রব ওর কোনো ক্ষতি করবে না। কিন্তু শায়ন্তী! ও সবকিছু করতে পারে।
— যেমন? আপনি আমার কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছেন বহু আগে থেকেই। আমি বুঝেও কিছু বলিনি।
শৌভিক আফনাদ হেসে বললেন,
— সত্যি বলতে, আ’ম রিয়েলি গ্রেটফুল টু ইউ। তুমি আমাকে অনেক সাপোর্ট দিয়েছো। তোমার জন্যই এখনো বেঁচে আছি আমি। কিন্তু সব সত্য জানার জন্য কখনো ফোর্স করোনি আমায়!
নির্জন সিগারেটটা জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে বললো,
— মি. আফনাদ! আমি একদমই স্বার্থান্বেষী নই। কিন্তু গুঞ্জনের স্বার্থে সবকিছুই করতে পারি। আপনাকে প্রটেকশন দিচ্ছি শুধু মাত্র ওর জন্য। আফ্রান জোহায়ের নির্জন পলিটিক্সে নিজেকে জড়িয়েছে শুধু মাত্র গুঞ্জনের জন্য।
— আমি জানি সেটা। তোমরা দুজন এক থাকো সেটাই আমি চাই।
বলেই প্রসন্নের হাসি দিলেন শৌভিক আফনাদ।
.
বিকেলে ছাদে বসে বসে ‘সেদিন চৈত্রমাস’ বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছিলাম। কিন্তু উপন্যাসে মন বসছিলো না একদমই। এক সপ্তাহ যাবৎ বাসায় বন্দী করে রেখেছি নিজেকে। পড়াশোনায় ডুবে ছিলাম যেন মাথায় ওসব চিন্তা না আসে। কিন্তু এখন আবার মনের ভেতর প্রশ্ন গুলো জেগে উঠছে। হঠাৎ ফোনের ভাইব্রেশনে কেঁপে উঠলাম। তাকিয়ে দেখলাম সারার কল। রিসিভ করে কানে লাগাতেই,
— ফাইনালি তোকে পেলাম। এতোদিন কই ছিলি? যখনই কল দেই সুইচড অফ বলে। আমি তো কাল তোর বাড়ি যাওয়ার প্ল্যান করছিলাম!
— তাহলে তো ফোন ধরে লস হয়ে গেল!
— ফাইজলামি বাদ দিয়ে আসল কথা বল!
— আসল-নকল কিছুই না। স্টাডি নিয়ে পড়ে ছিলাম এ কয়দিন। শুধু রাতে নির্জনের সাথে কথা বলার জন্য ফোন অন করতাম।
আমার কথায় সারা সন্দিগ্ধ কন্ঠে বললো,
— এই নির্জন ভাইয়ের সাথে তোর সম্পর্কটা কী? কেসটাই বুঝে উঠতে পারছি না, ইয়ার! ওনার মতো নেতা টাইপ মানুষ!
— তোকে ইচ্ছে করেই একটা কথা জানাইনি। কারণ বিষয়টা মেনে নিতে পারছিলাম না। কিন্তু এখন মাইন্ড চেঞ্জ হয়ে গেছে আমার। কীভাবে হলো জানি না আমি। হয়তো ভাগ্যের খেলা এটা! আমার অনেক অজানা বিষয়ও এর পেছনে দায়ী।
সারা অনেকটা বিরক্ত হয়ে বললো
— কী হয়েছে সেটা তো বল!
— নির্জনের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে, সারা। আমিও মেনে নিয়েছি ওনাকে।
এহেন কথায় সারা চিল্লিয়ে উঠে বললো,
— কীহ্? পাগল হয়ে গিয়েছিস তুই? নির্জন ভাই বিবাহিত। ওনার বউ আছে। আর তুই কিনা তাকেই বিয়ে করতে চাইছিস! একটা বিবাহিত ছেলের সাথে তোর বাবা কী করে বিয়ে ঠিক করলেন তোর??
#চলবে…..