#তুমিময়_আসক্তি
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্ব___০৫
গালে দাবাং মার্কা চড় খেয়ে ভরা ক্যাম্পাসে সবার সামনে মান-সম্মানের বারোটা বেজে গেছে গুঞ্জনের। হতভম্ব হয়ে চড়ের উৎস দাতা ব্যক্তির দিকে তাকালো সে। নির্জন অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে হুংকার ছেড়ে বললো,
— এখানে কি পড়াশোনা করতে আসো, নাকি প্রেম বিনিময় করতে? অন্য কারো সাহস কী করে হয় তোমাকে প্রেম নিবেদন করার?
সবার দৃষ্টি তাদের দিকে। গুঞ্জনের সামনে হাঁটু মুড়ে বসে থাকা ছেলেটা অবাক চোখে তাকিয়ে সবটা বোঝার চেষ্টা করছে। ধীরে ধীরে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
— নির্জন ভাই, আপনি গুঞ্জনকে বকছেন কেন? ওর তো কোনো দোষ নেই! আমিই ওকে………
— জাস্ট শাট আপ! তোকে কিছু জিজ্ঞেস করেছি আমি? তোর থেকে গুঞ্জনের দোষটা বেশি।
ছেলেটা ঢোক গিলে দু’পা পিছিয়ে গেল। গুঞ্জন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশে দাঁড়িয়ে সারা বললো,
— নির্জন ভাই তোকে কীভাবে চেনে? তোর কোনো কাজিন-টাজিন হয় নাকি!
গুঞ্জন শুধু না বোধক মাথা নাড়ালো। নির্জন জোরে শ্বাস নিয়ে গুঞ্জনের দিকে এক অনাকাঙ্ক্ষিত প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,
— এই ছেলেটাকে ভালোবাসো?
গুঞ্জন চোখ বড়বড় করে তাকালো। অতি বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে গেছে সে। বললো,
— আপনি এসব………..
কথা শেষ হওয়ার আগেই নির্জন দাঁতে দাঁত ঘষে বললো,
— স্যয় ইয়েস অর নো। ড্যাম ইট!!
ধমক খেয়ে গুঞ্জন ভয়ে ভয়ে ডানে-বামে মাথা নাড়িয়ে জানান দিলো, সে ভালোবাসে না!
— তাহলে ও যখন তোমায় সবার সামনে ‘আই লাভ ইউ’ বলল, তখন খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে ছিলে কেন? ডিরেক্টলি না বলে দিতে পারলে না?
অতিশয় ক্রোধে বারংবার গর্জে উঠছে নির্জন। গুঞ্জন আমতা আমতা করে বললো,
— আ্ আসলে আমি অবাক হ………
— চলো আমার সাথে।
নির্জন হুট করে গুঞ্জনের হাতের কব্জি চেপে ধরলো। সবার মাঝখান থেকেই গুঞ্জনকে টেনে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে সে। কেউ এগিয়ে এসে কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না, কারণ কমবেশি সবাই ওকে চেনে।
.
গাড়ি একটা জনমানবশূন্য রাস্তায় এসে থামলো। গুঞ্জন সারা রাস্তায় একটা কথাও বলেনি। অপরিচিত রাস্তা দেখে জিজ্ঞেসও করেনি কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তাকে নির্জন। এখনো কিছু বলছে না! চুপচাপ বাইরে তাকিয়ে আছে। কোনো এক অজানা কারণেই নির্জনের ওপর সে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস রাখতে পারে। কেন যেন মনে হয় নির্জন তার পাশে সবসময়ই থাকবে। মস্তিষ্ক বারবার নির্জনকে তার কাছে অপরিচিত ব্যক্তি হিসেবে জানান দিলেও মন স্বভাবতই বিপরীত নির্দেশনা দেয়। সবচেয়ে বেশি আপন মনে হয় তাকে। এমনকি নির্জনের শাসন গুলোতেও রাগ করতে পারে না গুঞ্জন। তবে সামান্য কারণেই অভিমান জমে উঠে মনে। কিন্তু কেন এমন হয়? নির্জনের সাথে তো সে কোনো সম্পর্কে এখনো আবদ্ধ হয় নি! তাহলে এসব অদ্ভুত অনুভূতির পৃষ্ঠে কোন যুক্তি মেলাবে সে?
গভীর ভাবনায় মগ্ন থাকা অবস্থায় গালে ঈষৎ উষ্ণ স্পর্শ পেতেই কেঁপে উঠে পাশ ফিরে নির্জনের দিকে তাকালো গুঞ্জন। কিসের স্পর্শ ছিলো এটা? দ্বিতীয় বারের মতো তার গালে ঠোঁটের স্পর্শ এঁকে দিয়ে হাত ছুঁইয়ে দিতে দিতে নির্জন বললো,
— খুব লেগেছে, তাই না? এই নিয়ে দুবার তোমায় আঘাত করলাম। আ’ম সরি, শ্যামাঙ্গিনী। থার্ড টাইমের জন্য আর কখনো আঘাত করবো না। দেখে নিও। তৃতীয় চড়টা যেন তোমার গালে না পড়ে আমার গালে পড়ে।
গুঞ্জন শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নির্জনের কাছাকাছি থাকায় তার ভেতরে এক অন্য রকমের ঝড় চলছে, যার তান্ডবে মস্তিষ্কে নানান কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। সেই চিরপরিচিত স্মেল! নির্জনের স্পর্শটাও অনেক পরিচিত অনুভূত হচ্ছে। যেন বহু আগেও এরকমভাবে কেউ ছুঁয়েছিল তাকে! কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব?
— রাগ করো না, প্লিজ। আসলে ঐ ছেলেটা তোমায় প্রপোজ করলো আর তুমি রিজেক্ট করছিলে না। ওর ওপর রেগে গেলেও তোমায় সাইলেন্ট থাকতে দেখে রাগটা আলটিমেটলি তোমার ওপরই ঝেড়ে ফেলেছি। সবার সামনে ওই রকম বিহেভ করাটা উচিত হয়নি। তোমায় আবারও চড় দিলাম! নিজের ওপরই রাগ লাগছে!!
নির্জনের কথা শুনে ভাবনার সুতো ছিঁড়ে গেল গুঞ্জনের। প্রকৃতস্থ হতেই নিজের গালে নির্জনের হাত দেখে ভ্রু কুঁচকে গেল তার। এতোক্ষণ চিন্তামগ্ন থাকায় একটা ঘোরের মধ্যে ছিল সে। নিজেকে প্রচন্ড অদ্ভুত মনে হচ্ছে। আচ্ছা, সে কি নির্জনের প্রতি দূর্বল হয়ে পড়ছে? নাকি নির্জন তার পূর্বপরিচিত? হয়তো এটা দূর্বলতা! গুঞ্জন নিজেকে দূর্বল হতে দিবে না। এখন একে একে সবটা মনে হতেই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তার। ঝামটা মেরে হাত সরিয়ে সপাটে এক চড় বসিয়ে দিলো নির্জনের গালে। বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে বললো,
— নাটকে করছেন আমার সাথে? সবার সামনে আমায় অপমান করে এখন এসব বলে কী প্রমাণ করতে চাইছেন আপনি? আর আমায় এভাবে স্পর্শ কেন করছেন? সাহস কোত্থেকে পেলেন? ভুলে যাবেন না বিয়েটা এখনো হয়ে যায়নি। আপনি আমার কাছে একটা পরপুরুষ। আমায় স্পর্শ করার কোনো অধিকার আপনার নেই!
একদমে এতো গুলো কথা বলে একটা শ্বাস নিয়ে নির্জনের দিকে তাকালো গুঞ্জন। নির্জনের চোখের দৃষ্টি কেমন যেন অদ্ভুত! হঠাৎ ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো তার। বেদনা মিশ্রিত হাসি! হেসেই মাথা ঘুরিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো নির্জন। সেই হাসির মর্মার্থ গুঞ্জন বুঝে উঠতে পারলো না।
.
শায়ন্তী বাড়ি থেকে বেরিয়েছে বিকেলের দিকে। শুভ্রব তার বাবার রুমে গিয়ে সোফায় বসে বললো,
— কী ভাবলে, ড্যাড? পলিটিক্সে যোগ দিবে আবার?
শৌভিক আফনাদ চশমাটা ঠিক করে নাকে বসিয়ে বললেন,
— নাহ্! তোমার মা রাজনীতিটা কোনো কালেই পছন্দ করতেন না। তাই তার কথা ভেবেই আর ওসবে জড়াচ্ছি না! অন্তত ওর এই এই ইচ্ছেটা অপূর্ণ রাখতে চাই না আমি।
— কিন্তু আমি চাই। আই ওয়ানা হ্যাভ মাই ওউন পলিটিক্যাল ক্যারিয়ার, ড্যাড! মাঝখান থেকে নির্জন আমার জায়গাটা নিয়ে নিল।
শুভ্রবের কন্ঠে আক্রোশ। নির্জনের প্রতি শুভ্রবের মনোভাবটা যে শায়ন্তী বিষিয়ে দিয়েছে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। শৌভিক আফনাদ থমথমে গলায় বললেন,
— নির্জন নিজের যোগ্যতার তার জায়গা করে নিয়েছে। এই দেশে রাজতন্ত্র চলে না যে, বাবার মৃত্যুতে সন্তান ক্ষমতা পাবে। তাছাড়া তোমার জীবনে নির্জনের অবদান কতোটা সেটা কি ভুলে গেছ?
শুভ্রব রাগান্বিত স্বরে বললো,
— ভুলিনি আমি। পাশাপাশি ও আমার কতোটা ক্ষতি করেছে সেটাও ভুলিনি! ওর জন্য, শুধু মাত্র নির্জনের জন্য আজ গুঞ্জনকে আমি নিজের করতে পারলাম না!
— ঐ মেয়েটার সাথে আগেই নির্জনের বিয়ে হয়ে গেছে। মেয়েটাও ওকে ভালোবাসে! ওদের মাঝে থার্ড পারসন হয়ে গিয়েছিলে তুমি।
শুভ্রব গর্জে উঠে বললো,
— আমি কোনো থার্ড পারসন নই! আমার জীবনটা গুছিয়ে দিয়ে আবার সেটা সুন্দর ভাবে এলোমেলো করে দিয়েছে নির্জন। ধ্বংসের স্বাদ আমি যেমন পেয়েছি, ওকেও তেমনটা ফিরিয়ে দিবো!
শুভ্রব হনহনিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। শৌভিক আফনাদ চশমা খুলে একটা হতাশার নিঃশ্বাস ফেললেন। এদিকে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে শায়ন্তী তৃপ্তির হাসি দিলো।
.
বাড়ি ফেরার পর থেকেই অনবরত হাসফাস করছে গুঞ্জন। নিজের প্রতি বিতৃষ্ণা বোধ হচ্ছে। কেন নির্জনকে মারতে গেল? নির্জনের শ্লেষের হাসিটা মনে পড়তেই কান্না পাচ্ছে তার। নিজের হাতটাই রাখতে ইচ্ছে করছে না! এমন কষ্টবোধ কেন হচ্ছে? ভেতরে থাকা সুপ্ত অনুভূতিগুলো জেগে উঠছে যেন!
অনেকক্ষণ নিজের সাথে যুদ্ধ করলেও এখন আর পেরে উঠতে পারছে না গুঞ্জন। ফোন বের করে সেটা অন করলো। সারা অনেকগুলো কল দিয়েছে! কিন্তু এখন নির্জনের সাথে কথা বলাটা বেশি ইম্পর্ট্যান্ট। তাই কল দিয়েই দিলো। প্রথম বার রিসিভ হলো না। দ্বিতীয়বারেও রিং হতে হতে কেটে গেল। নির্জন কি রাগ করলো? চাপা অপরাধবোধ কাজ করছে গুঞ্জনের মধ্যে।
হঠাৎ ফোন বেজে উঠতেই কেঁপে উঠে দেখলো নির্জন কল ব্যাক করেছে। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা নিয়ে কল রিসিভ করলো। কানে ধরতেই ওপাশ থেকে ব্যস্ত স্বরে নির্জন বললো,
— হ্যাঁ, বলো। অফিসে আছি এখন। তাই ফোন ধরতে পারিনি।
নির্জনের কথা শুনে কান্নাগুলো গলায় পুঞ্জীভূত হচ্ছে গুঞ্জনের। কান্না কেন পাচ্ছে? অদ্ভুত তো! এমন ছিঁচকাঁদুনে কবে থেকে হলো গুঞ্জন? জানা নেই!
— কী হলো, গুঞ্জন? কথা বলছো না কেন? এখনো রেগে আছো আমার ওপর?
গুঞ্জন এবার শব্দ করেই কেঁদে দিলো। ওপাশ থেকে ক্রমাগত ফোঁপানোর শব্দ কানে আসতেই নির্জন উত্তেজিত হয়ে বললো,
— কাঁদছো কেন? কী হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে?
এমন নানা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেও গুঞ্জন কোনো উত্তরই দিলো না। নির্জন মুখে এক টুকরো হাসি ঝুলিয়ে বললো,
— পাগলি মেয়ে! একটুও বদলাওনি দেখছি। তোমার বারান্দার দরজাটা খোলো! পা দুটো ব্যথা করছে তো!!
#চলবে……
©Written by Mahfuza Akter