তুমিময় আসক্তি পর্ব-০৪

0
1540

#তুমিময়_আসক্তি
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্ব___০৪

— ‘তুমিময় আসক্তি’ তে আক্রান্ত আমি, গুঞ্জন। আমার ট্রিটমেন্ট করবে, প্লিজ? শ্যামাঙ্গিনী আমার!

শোয়া থেকে ধপ করে উঠে বসে গুঞ্জন! জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজছে সে। সারাদিনের ধকল শেষে বাসায় পৌঁছে খেয়েদেয়ে পরিশ্রান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দমালার প্রতিধ্বনি ঘুমের ঘোরেই কানে বাজতে লাগলো তার।

ঢোক গিলে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো গুঞ্জন। রাত বারোটার কিছু ওপারেই রয়েছে ঘড়ির কাটা। ফোনের দিকে চোখ যেতেই দেখলো সেটা বারংবার কম্পিত হচ্ছে। নাম্বারটা দেখেই চোখে মুখে বিরক্তি নিয়ে আবার শুয়ে পড়লো গুঞ্জন। কল্পনায় ধ্বনিত হওয়া কথাগুলো মাথা থেকেই বেরিয়ে গেল তার।

এদিকে, গুঞ্জনকে ক্রমাগত কল দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে নির্জন। মেয়েটাকে রাগের মাথায় কষ্ট দিয়ে ফেলেছে আজ। এখন কথা না বললে তার মধ্যকার অনুতপ্তবোধটা কমবে না একদমই। ছেলেকে এরকম হাসফাস করতে দেখে পিছন থেকে মিসেস নিহা বললেন,

— এমন ছটফট করছিস কেন, নির্জন? কিছু কি হয়েছে?

মায়ের কথা কানে যেতেই পেছন ফিরে তাকালো নির্জন। বিছানায় দুহাত ছড়িয়ে বসে হতাশা মিশ্রিত কন্ঠে বললো,

— তোমার বউমাকে আজ কড়া কথা শুনিয়ে দিয়েছি, মা। মেয়েটা রাগ করেছে আমার ওপর।

মিসেস নিহা হাসলেন। ছেলের পাশে বসে পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

— এখন কি রাগারাগী করার সময়? মেয়েটার পরিস্থিতিটা একবার বোঝ! ও তো এখন একটা অবুঝ শিশুর মতো! যদি আগের স্টেজে থাকতো, তাহলে অন্য কথা ছিল।

নির্জন আহত দৃষ্টিতে তাকালো মায়ের দিকে। মায়ের কোলে মাথা রেখে ভাঙা গলায় বললো,

— সহ্য হয় না, মা! আমার একটুও সহ্য হয় না। ওর চোখে নিজেকে এমন অপরিচিত হিসেবে দেখাটা কতটা যন্ত্রণাদায়ক, তা এভাবে ফেস না করলে বুঝতেই পারতাম না! আমার শ্যামাঙ্গিনী এখন আমায় আর চেনে না, মা।

মিসেস নিহা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,

— ভাগ্য যেহেতু এমন একটা দিতে দেখিয়েছে, সহ্য করা ছাড়া কি আর উপায় আছে কোনো? তবে ভরসা রাখ। সব ঠিক হয়ে যাবেই।

— গুঞ্জন এই বিয়েটাকে হার-জিতের সাথে কম্পেয়ার করেছে, মা। আমি নাকি ওর সাথে সম্পর্ক বাধছি শুধু মাত্র নিজের জেতার জন্য। তার মধ্যে নাকি কোনো ভালোবাসা নেই! এটা কোনো কথা হলো, মা? বলো! ওকে ভালো না বাসলে কাকে ভালোবাসবো আমি? কাকে?

চোখের কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে নোনাজল। দৃষ্টি ক্রমশ ঘোলাটে হয়ে উঠছে নির্জনের। নিজের ভেতরে জমাট বাঁধা কষ্ট গুলো আজ উথাল-পাতাল করছে বেরিয়ে আসার জন্য। নিজের ছেলের মনের অবস্থা অনুভব করতে চাইছেন মিসেস নিহা। তার চোখও ঝাপসা। আঁচলে চোখ ঘষে বললেন,

— মেয়েটা কি জানে ও তোর বিয়ে করা বউ? তোর ভালোবাসা গুলো তো ওর মনে নেই, তাই না? ও-ও তোকে ভালোবাসে। ভুলে গেছিস ওর পাগলামি গুলো? ওর মনের অনুভূতি গুলোই ওকে বুঝিয়ে দিবে সবটা। সে সময়টুকু অন্তত ধৈর্য ধর।

নির্জন ধরা গলায় বললো,

— ধৈর্য্য ধারণ যে এতোটা কষ্টকর, জানা ছিল না আমার। আমাকে এভাবে পুড়িয়ে গুঞ্জন ঠিকই আরামের ঘুম দিচ্ছে! কিন্তু আমি? আমি চোখের পাতাই এক করতে পারছি না! আমার ভেতরের ক্ষতটা যদি তোমায় দেখাতে পারতাম, মা!! দেখলেও হয়তো বুঝতে না, এজ অনলি দ্য বেয়ারার নৌস হোয়ার দ্য শু পিঞ্চেস।

মিসেস নিহা আপনমনে হাসলেন। ছেলে তার বড় হয়েছে, ভালোবাসতে শিখেছে ঠিকই। কিন্তু সন্তানের দুঃখ বোঝার মতো বোধশক্তি তার এখনো হয়নি। হবেই বা কীভাবে? নির্জনের সংসার সাজানোর আগেই যে তা ভেঙে দু’টুকরো হয়ে গেছে! সেখানে পিতৃসুখ খোঁজ করা নিতান্তই বিলাসিতা ছাড়া কিছু নয়।

— সন্তানের কষ্টটা মায়ের চেয়ে বেশি কেউ উপলব্ধি করতে পারে না। তবে তোর কথাটাও ঠিক। যার কষ্ট, সেই ভালো বুঝে। কিন্তু এখন এভাবে ভেঙে পড়িস না। ধীরে ধীরে আগাতে হবে তোকে।

মায়ের আশ্বাসে কিছুটা স্বাভাবিক হলো নির্জন। চোখ মুছে বললো,

— হ্যাঁ, নজর রাখছি সবদিকে। গুঞ্জনের বাসায় তো আর গেলে কোনো লাভ হবে না! পরশু দিন আবার ওর ভার্সিটিতে যাবো। দেখা করবো। কিন্তু এখন আমার একটা ইম্পর্ট্যান্ট কাজ আছে।

মিসেস নিহা ছেলের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। নির্জন বাঁকা হেসে ‘কিছু না’ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ালো।

.

শায়ন্তী অক্ষিগোলক বড় বড় করে সামনে দাঁড়ানো শুভ্রবের পাশের ব্যক্তিটিকে দেখে চলেছে। এটা কি সত্যি, নাকি সপ্ন? বাস্তব, নাকি কল্পনা? উত্তর খোঁজার চেষ্টাও করছে না শায়ন্তী। অবাকতা ক্রমশ ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলতে লাগলো তাকে। চকিত দৃষ্টিতে ইতস্তত বিচরণ করে চলা ভয়টা শুভ্রবের দৃষ্টিগোচর না হলেও তার পাশের ব্যক্তিটি সবটা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে।

— আপি, এভাবে স্ট্যাচু হয়েই দাড়িয়ে থাকবি নাকি? ড্যাড বেঁচে আছে, আপি। ভাবতে পারছিস তুই? আমার ড্যাড বেঁচে আছে এখনো।

শুভ্রবের কন্ঠে উৎফুল্লতা। অবুঝ শিশুর মতো সবচেয়ে প্রিয় বস্তুটি ফেরত পাওয়ার আনন্দ তার চোখে মুখে। কিন্তু শায়ন্তী সেটা শুনেও শুনলো না! দেখেও দেখলো না! তবে এটা ঠিকই বুঝে গেছে, সে স্বপ্ন দেখছে না। আর এটা কোনো নিছক কল্পনাও নয়। সবটাই সত্যি! এতোদিন নিজের বাবা-মাকে মৃত বলে জেনে আসলেও তার বাবা এখনো বেঁচে আছেন।

শৌভিক আফনাদ দু’পা এগিয়ে এলেন শায়ন্তীর দিকে। একটা নকল হাসি মুখে ঝুলিয়ে বললেন,

— হোয়াট’স আপ, মাই চাইল্ড? আমার এরাইভালে কি খুশি হওনি তুমি? আফটার অল, তোমার বাবা এতো বছর পর তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। একদম জীবিত অবস্থায়! মৃত মানুষ বেঁচে উঠলো!! কেমন হলো ব্যাপারটা?

শায়ন্তী সচকিত ভঙ্গিতে কেঁপে উঠে তাকালো নিজের বাবার দিকে। চক্ষুদ্বয়ে ত্রাসের খেলা চলছে তার। তার মৃত পিতা কীভাবে বেঁচে ফিরলো, জানা নেই। এখন জানার ইচ্ছেও নেই। কিন্তু সব সত্যি কারো কর্ণগোচর হয়ে গেল কিনা, সেটাই এখন শায়ন্তীর কাছে মুখ্য। নিজেকে সামলে জোরে নিঃশ্বাস ছেড়ে আহ্লাদী স্বরে শায়ন্তী বললো,

— আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না, ড্যাড! তুমি এখনো বেঁচে আছো!! আমার খুশি তোমার কাছে কী করে এক্সপ্লেইন করবো, ড্যাড? মম কোথায়?

শেষোক্ত প্রশ্ন কর্ণগোচর হতেই শৌভিক আফনাদের চেহারায় আধার নেমে এলো। বিমর্ষ গলায় বললেন,

— উপরওয়ালা এতোটাও সদয় হননি আমার প্রতি সেদিন। স্বার্থপর হয়ে গিয়েছিলাম, অর্থাৎ স্বার্থপর হতে বাধ্য হয়েছিলাম। তোদের মা নিজে মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছিলেন। তবুও আমায় বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করেছিলো। সেজন্যই আজ আমি এখানে।

কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসছে ক্রমাগত। তবুও ধরা গলায় কথাগুলো বললেন শৌভিক আফনাদ। শায়ন্তী ভ্রুকুটি কুঞ্চিত করে তাকালো। সন্দিগ্ধ কন্ঠে বললো,

— তাহলে এতোদিন কোথায় ছিলে? এতো দেরি করে আমাদের কাছে ফিরলে কেন? অন্তত জানাতে তো পারতে!

শৌভিক আফনাদ হাসলেন। তাচ্ছিল্যমিশ্রিত হাসি! স্বগতোক্তি কন্ঠে বললেন,

— এতোদিন ট্রিটমেন্ট চলছিলো আমার। তাই ফিরতে পারিনি। আর তোদের জানানোর কথা জিজ্ঞেস করলে বলবো, ইচ্ছে করেই জানাইনি। ভালোই তো ছিলি তোরা।

শুভ্রব অভিমানী সুরে বললো,

— দিস ইজ নট ডান, ড্যাড! আমাদের মনের অবস্থাটা একবার ভেবে দেখতে পারতে! ওপর দিয়ে যা দেখায়, ভেতরটা সবসময় তেমনই হয় না।

— এক্সেক্টলি! আমি জানি তুই কষ্ট পেয়েছিস। কিন্তু নিজের সেইফটি নিয়ে তো একবার ভাবতে হবে! বলা তো যায় না, শত্রুপক্ষ কখন কোথায় ওত পেতে থাকে!

শায়ন্তী চমকে তাকালো নিজের বাবার দিকে। শুকনো ঢোক গিলে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

— এতোদিন কোথায় ছিলে তাহলে?

— সেসব কথা পরে হবে। এখন একটু রেস্টের দরকার।

শুভ্রব সম্মতি জানিয়ে বললো,

— হ্যাঁ, অনেকটা ধকল গেছে আজ তোমার ওপর দিয়ে। পরে এসব আলোচনা করা যাবে। এখন চলো যার যার রুমে।

শায়ন্তী তাদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হাতে হাত ঘষতে লাগলো। কৌতূহলী মনে হাজারো প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে তার।

-চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে