তুমিময় আসক্তি পর্ব-০৩

0
1627

#তুমিময়_আসক্তি
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্ব___০৩

— গুঞ্জননন!!!

প্রচন্ড বিস্মযে় হতবাক হয়ে গেছে গুঞ্জন। অক্ষিপট এখনো অস্বাভাবিকভাবে গোল গোল করে তাকিয়ে আছে নির্জনের দিকে। এরূপ পরিস্থিতি উপলব্ধি করতেই নির্জন হতাশামিশ্রিত স্বরে বললো,

— ক্ষিদে পেয়েছে? সকালে কিছু খাওনি? তাহলে বলো, তোমায় খাবার এনে দিচ্ছি। এভাবে চোখ দিয়ে আমায় গ্রাস করলে তো আমারও লজ্জা লাগে। বুঝো না কেন?

স্বগোতক্তি কন্ঠের এমন উদ্ভট বক্তব্য কর্ণগোচর হতেই গুঞ্জন সম্বিত ফিরে পেল। সরু ভ্রুদ্বয়ের মাঝে কিঞ্চিৎ ভাজ ফেলে বললো,

—আপনি কী বলতে চাইছেন, হ্যা? আমি আপনায় চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছি!!

নির্জন গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে এক হাতে নিজের চুলগুলো নাড়িয়ে দিয়ে বললো,

— তুমি করলে দোষ নাই, আর আমি বললেই দোষ!! ইন্ট্রেস্টিং রুল!!!

রাগমিশ্রিত কন্ঠে গুঞ্জন বলে উঠলো,

— আপনার ইন্ট্রেস্ট নিজের পকেটে রাখুন, যত্তসব! আমায় কোলে তুলে গাড়িতে বসালেন কেন? আশেপাশের মানুষেরা কী ভাবলো?

নির্জন ব্যাপারটাকে একদমই তোয়াক্কা না করে বললো,

— কী ভাববে আবার? সবাই তোমার মতো বোকা না। তারা বুঝবে যে, আমাদের মাঝে প্রেম-ভালোবাসা চলছে। ব্যাপারটা অস্থির হয়েছে, তাই না মিস আফরাহ্ সেহরীশ?

বলেই চোখ টিপ মেরে দিলো নির্জন। গুঞ্জন চোখ পাকিয়ে রাগান্বিত ভাবে তাঁকাতেই নির্জন হাসতে লাগলো। গুঞ্জন বিরক্তি নিয়ে পাশ ফিরে খোলা হাওয়া উপভোগ করতে লাগলো। কথা বাড়ালেই কথা বাড়বে। আপাতত কথা কাটাকাটি করার কোনো ইচ্ছাই তার নেই।

পাশে বসে বসে বাজপাখির মতো সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি স্ক্যান করে চলেছে নির্জন। গত রাতের ঘটনা যদি গুঞ্জন জানতো, তাহলে এতো বিরক্তিভাব কোথায় গিয়ে দাঁড়াতো, সেটা নিয়েও তার মনে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। হয়তো কালকের চড়টা গুঞ্জন মেনে নিতে পারেনি! পাশাপাশি ওর অনিচ্ছাসত্ত্বেও নির্জন জোরপূর্বক বিয়েটা করছে। বিরক্ত হওয়াটা কোনো আঙ্গিকেই অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সেসব ভাবনার চেয়ে শুভ্রবকে নিয়ে চিন্তাটাই নির্জনের কাছে মুখ্য। শুভ্রব কেন গুঞ্জনকে খুন করাতে চাইলো যদি ও গুঞ্জনকে নিজের করতেই চায়? নাকি শুভ্রবের অজ্ঞাতসারে তৃতীয় পক্ষের কোনো কারসাজি চলছে যেটা নির্জন বা শুভ্রব উভয়েরই অজানা? বিষয়টা ক্রমশই ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে!

গভীর চিন্তামগ্ন থাকার মাঝেই গাড়ি গিয়ে ভার্সিটির গেইটে থামলো। নির্জন পাশ ফিরে গুঞ্জনের দিকে তাকাতেই দেখলো সে এখনো বসেই আছে। বোঝাই যাচ্ছে, সে কোনো ভাবনার রাজ্যে বিচরণ করছে এখন। কানের কাছে তুড়ি বাজিয়ে নির্জন বললো,

— এই যে মিস. শ্যামবতী! গাড়ির ভেতরেই জীবন পার করে দেওয়ার প্ল্যান আছে নাকি? ইফ ইউ উইশ, আই হ্যাভ নো প্রব্লেম। তোমার মতো একটা বউ পেলে আর কিছু কি লাগে? বলো!

সচকিত ভঙ্গিতে বিস্ফোরিত চোখে তাঁকালো গুঞ্জন। চোখ রাঙ্গিয়ে রাগত স্বরে বললো,

— বিয়েটা এখনো হয়ে যায়নি যে, আমায় বারবার ‘বউ’ ‘বউ’ বলে কানের মাথা খাবেন। আর আমার একটা নাম আছে। এসব শ্যামবতী-টতী না বলে নাম ধরে ডাকলেই খুশি হবো।

— তুমি তো আমার শ্যামবতী! শ্যামাঙ্গিনী! আমার লাইফের স্পেশাল মানুষগুলোকে আমি সবসময় স্পেশাল নামেই ডাকি। ভবিষ্যতেও ডাকবো।

এমন কথা শুনে গুঞ্জন বিস্ময়বিমূঢ় দৃষ্টিতে নির্জনের দিকে তাকালো। কিন্তু নির্জনের বাক-ভঙ্গি ও আচরণ একদমই স্বাভাবিক। ঠান্ডা মাথায় একের পর এক বক্তব্য দিয়ে মানুষের মস্তিষ্ক গ্রাস করতে পারার বিরল যোগ্যতা আছে তার। মাথার নিচে দু-হাত রেখে সিটে হেলান দিয়ে বসে নির্জন বললো,

— কী? ওভাবে তাকিয়ে আছো কেন? হোয়াটেভার! আর বাকি রইলো তোমায় বউ বলে ডাকার কথা। কাল বলেছিলাম না!! বিয়ে আমি তোমাকেই করছি এন্ড দিস ইজ মাই চ্যালেঞ্জ টু ইউ। সো, এটা ম্যাটারিয়ালাইজ আমি করবোই করবো।

নির্জনের কথা শেষ হতে না হতেই গুঞ্জন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

— সুতরাং মানেটা এটাই দাঁড়ায় যে, আপনি বিয়েটাকে নিজের কাছে একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করেন। শুধু মাত্র সেটা জেতার জন্যই আমায় বিয়ে করছেন। আমরা হার-জিতের কবলে পড়ে একটা সম্পর্কে আবদ্ধ হচ্ছি যেখানে কোনো শ্রদ্ধাবোধ নেই। আর না আছে কোনো বিশ্বাস বা ভালোবাসা। তাহলে………..

— তোমার ক্লাসের কিন্তু লেইট হয়ে যাচ্ছে। যাও এখন।

আপনমনে এক নাগাড়ে এতো কথা বলার মাঝেই হঠাৎ নির্জনের মুখে এমন কথা শুনে ভ্রু কুঞ্চিত করে তার মুখের দিকে তাকালো গুঞ্জন। দেখলো, নির্জন থমথমে চেহারায় সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে মুখে একরাশ গাম্ভীর্য। হাসি-ঠাট্টার মাঝেই হঠাৎ নির্জনের এমন গম্ভীর পরিবর্তন দেখে অবাক হলো গুঞ্জন। নানা প্রশ্ন ক্রমাগত উঁকি-ঝুকি দিচ্ছে তার মনে। সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই নির্জনের চেহারার রং পাল্টে গেল কেন? কৌতূহল ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকলে গুঞ্জন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে যাবে এমনসময় নির্জন ঝাড়ি মেরে বললো,

— যেতে বলেছি না এখান থেকে! এখন কি কোলে তুলে ক্লাসে বসিয়ে দিয়ে আসবো?

আকস্মিক ধমকে গুঞ্জন কেঁপে উঠলো। প্রথমে ভীত দৃষ্টিতে তাকালেও মুহুর্তেই রাগে চেহারা লালাভ বর্ণ ধারণ করলো। সজোরে ধাক্কা মেরে গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে আবার ঠাস করে সেটা লাগিয়ে দিলো। হঠাৎ ধুপধাপ শব্দ কানে বাজতেই নির্জন সম্বিত ফিরে পেয়ে বাইরে তাকায়। ততক্ষণে গুঞ্জন অনেকটুকুই এগিয়ে গেছে। হুট করেই এভাবে রেগে গিয়ে গুঞ্জনকে বকা দেওয়ায় এখন নিজের প্রতিই রাগ লাগছে নির্জনের। যা-ই বলুক, ঐভাবে ধমক দেওয়াটা মোটেই উচিত হয়নি।

ভাবনাচিন্তার পাঠ চুকিয়ে পাবলিক প্লেসেই ব্যতিব্যস্ত গাড়ি থেকে বের হয়ে গেল নির্জন। গলা ঝেড়ে গুঞ্জনকে পিছন থেকে ডাক দিলেও সে শুনলো না। নিজের মতো পা চালিয়ে দৃষ্টির পরিসীমার বাইরে চলে গেল। আহত চাহনিতে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সেখান থেকে চলে গেল নির্জন। গাড়ি ড্রাইভ করতে করতেই নিজের এসিস্ট্যান্টকে কল লাগালো নির্জন।

— নিহাল, কোথায় আছিস এখন?

— আমি তো পার্টি অফিসে, ভাই! কেন? কিছু হয়েছে?

— শুভ্রবের পরিবার সম্পর্কে খবর লাগা।

নিহাল এমন কথার মর্মার্থ ধরতে না পেরে বললো,

— পরিবারের খবর কেন, ভাই? না মানে, আপনি তো কখনো কোনো অপ্রয়োজনীয় কাজ করান না! তাই…….

— প্রয়োজন আছে বলেই কাজটা করতে বলছি। বিষয়টা কেমন যেন বিদঘুটে লাগছে! তাই কোনো ক্লু খুঁজছি আমি।

— ভাই, যা-ই বলেন না কেন! শুভ্রব আপনাকে ফলো করছে এটা নিশ্চিত। নয়তো ভাবীর সাথে আপনার বিয়ে ঠিক হওয়ার খবর কীভাবে লিক হলো? আর সেদিনই ভাবীর ওপর আক্রমণ করলো।

নির্জন বাঁকা হেসে বললো,

— তোর এখনো মনে হচ্ছে খুন করার প্ল্যানটা শুভ্রবের। শুভ্রবকে আমার চেয়ে ভালো চেনে এমন ব্যক্তি দ্বিতীয়টি আছে বল আমার জানা নেই। ও কখনো গুঞ্জনকে মারতে চাইবে না, ইভেন মারার কথা চিন্তাও করতে পারবে না কোনোদিন!

নিহাল বোকার মতো তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,

— গুঞ্জন কে, ভাই?

— তোর ভাবী, আফরাহ্ সেহরীশ! ওর ডাক নাম গুঞ্জন।

নিহাল দাঁত কেলিয়ে হেসে বললো,

— বাহ্! ভাই, বাহ্! নির্জন আর গুঞ্জন। মিলটা মনে হয় উপরওয়ালাই সেট করে দিয়েছে। আমি তো আপনার বিয়ে নিয়ে হেব্বি এক্সাইটেড!

নির্জন বিরক্তি নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

— এক্সাইটেডের বাচ্চা!! ইচ্ছে করে কান বাজিয়ে দুটো লাগিয়ে দিতে। যে কাজটা করতে দিয়েছি সেটা আগে কর।

বলেই ফোন কেটে দিলো নির্জন। শুভ্রব নামক প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রতিনিয়ত চক্রান্তের বেড়াজালে ক্লিষ্ট সে। এমন ঝামেলাপূর্ণ জীবনে শান্তির দেখা কবে মিলবে জানা নেই।

.

সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত হয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগেই। তবুও এখনো শুভ্রবের কোনো খবর নেই। চিন্তিত ভঙ্গিতে বারংবার ছটফট করছে শায়ন্তী। রাতে দেরি করে বাড়ি ফেরাটা যে শুভ্রবের জন্য নতুন, তেমনটা নয়। কিন্তু শায়ন্তীর সাথে রাগারাগি করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে এই প্রথমই দেখা গেল শুভ্রবকে। ফোনও বারবার বন্ধ বলছে। ক্রমশ পরিস্থিতি ধৈর্য্য সীমার বাইরে চলে যাচ্ছে শায়ন্তীর জন্য। বাধ্য হয়ে গাড়ির চাবি নিয়ে নিজেই বের হয়ে গেল ঘর থেকে। মেইনডোরের কাছাকাছি যেতেই সামনে তাকিয়ে শায়ন্তী স্থির হয়ে গেল। শিরদাঁড়া দিয়ে শীতল রক্তস্রোত বয়ে গেল তার।

-চলবে……..

( প্রতিক্রিয়া জানানো অব্যাহত রাখবেন সবাই।
হ্যাপি রিডিং 🖤)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে