তুমিময় আসক্তি পর্ব-০২

0
1944

#তুমিময়_আসক্তি
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্ব___০২

নিদ্রাচ্ছন্ন গুঞ্জনের দ্বারপ্রান্তে মৃত্যু এসে কড়া নাড়ছে। ছায়ামূর্তিটা ঝাপসা আলোয় অতি সতর্কে গুঞ্জনের দিকে পা এগোচ্ছে। একদম কাছাকাছি পৌঁছেই পা থামিয়ে দিলো সে। একবার হাতে থাকা ছুরির দিকে, আরেকবার গুঞ্জনের ঘুমন্ত মুখের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো এক পৈশাচিক হাসি, চোখে মুখে খেলা করছে হিংস্রতার আনন্দ। হিসহিসিয়ে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বললো,

— এই তাহলে দাবা খেলার ব্ল্যাক কুইন, যাকে সরিয়ে দিলেই চেক-মেট হওয়ার পথ চিরতরে রূদ্ধ হয়ে যাবে! আজ তোমাকে কে বাঁচাবে?

ছুরিটায় দুই হাত মুঠো করে ধরে সর্বশক্তি দিয়ে গুঞ্জনের পেটের মাঝ বরাবর গেঁড়ে দিতে যাবে এমনসময় এক বলিষ্ঠ হাত এসে খপ করে তার হাত দুটো আঁকড়ে ধরলো। ব্যক্তিটা হতবিহ্বল দৃষ্টিতে হাতের দিকে তাঁকিয়ে পাশে ফিরতেই অন্য এক আগন্তুককে আবিষ্কার করলো। তার রক্তবর্ণের জ্বলন্ত অক্ষিদ্বয় দেখে চিনতে একবিন্দুও ভুল হলো না। ভীতিকর পরিস্থিতিতে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে লোকটা। ঢোকের পর ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে অস্ফুটস্বরে বললো,

— আফ্রান….. জোহায়ের…… নির্জন…

নির্জন নিজের হুডির পকেট থেকে ক্লোরোফর্ম বের করে গুঞ্জনের মুখে স্প্রে করে দিলো। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানেই গুঞ্জন ঘুমের মধ্যেই সেন্সলেস হয়ে গেছে। স্প্রের ক্যানটা আবার পকেটে গুঁজে অজ্ঞাত লোকটার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো সে। ঘনঘন শ্বাস নিয়ে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজছে লোকটা। কিছু বুঝে উঠার আগেই চেপে ধরা হাত দুটো মুচড়ে ধরে ছুরিটা নিজের হাতে বাগিয়ে নিলো নির্জন। সাথে সাথেই মুখে ফুটে উঠে এক তৃপ্তিমাখা হাসি।

ভীতিকর পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়ংকর ও ভয়াবহ হয়ে উঠছে লোকটার জন্য। আত্মরক্ষা অসম্ভব জানা সত্ত্বেও পা দুটো পিছিয়ে যাচ্ছে তার। বারান্দার দরজা দিয়ে বের হওয়ার আগেই নির্জন তার দ্বাররোধ করে দাঁড়ায়। মাস্কের ওপর দিয়েই গাল চেপে ধরে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে,

— তোর বসের প্ল্যানে যে বরাবরই ত্রুটি থাকে, সেটা আজও প্রমাণ হলো। কাল তোর লাশটা পাঠিয়ে দিয়ে আরিয়ান শুভ্রবকে সেটা জানিয়ে দিবো।

বলেই একটা কাপড় দিয়ে লোকটার মুখ শক্ত করে বেঁধে দিতেই বারান্দা দিয়ে দোতলা থেকে এক ধাক্কায় নিচে ফেলে দিলো নির্জন। নিচ থেকে কয়েকজন লোক এসে লোকটাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। নির্জন ঘাড় ঘুরিয়ে গুঞ্জনের দিকে একপলক তাকালো। আজ একদম ঠিক সময়ে পৌঁছাতে পেরেছে বলেই মেয়েটাকে বাঁচাতে পেরেছে- ভেবেই স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো সে।

.

সকালের দিকে ঘুম ভেঙে যেতেই পিটপিট করে চোখ মেলে তাকাঁলো গুঞ্জন। হাই তুলতে তুলতে উঠে বসে আড়মোড়া ভেঙে পাশে তাকালো। টেবিল ক্লকের দিকে নজর যেতেই চোখ দুটো কপালে উঠে গেছে তার। নয়টা বাজতে আর দশ মিনিট বাকি। এতো দেরী করে ঘুম থেকে উঠেছে আজ! ভেবেই ফট করে উঠে দাঁড়ালো। সাথে সাথেই মাথাটা এক প্রকার চক্কর দিয়ে উঠলো।

দুই হাতে কপাল চেপে ধরে আবার বসে পড়ে গুঞ্জন। এমন কেন হচ্ছে আজ? আগে তো কখনো হয়নি! হয়তো বেশি ঘুমানোর কারণে মাথা ভার হয়ে আছে! তাই বিষয়টাকে আর পাত্তা না দিয়ে তাড়াহুড়ো করে রেডি হয়ে না খেয়েই বেরিয়ে গেল। ক্লাস শুরু হবে দশটায়। হাতে একদমই সময় নেই তার।

.

— আবারও হেরে গেলাম আমি! আবার!! আরিয়ান শুভ্রবকে বারংবার ব্যর্থ হতে হচ্ছে ঐ নির্জনের কাছে।

টেবিলে থাকা ফুলদানিটা হাতে নিয়ে সজোরে ফ্লোরে ছুড়ে মারলো শুভ্রব। তার চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরছে! রাগে ক্রমাগত ফোঁপানোর ধ্বনি কর্ণকুহরে বারি খাচ্ছে সবার। সমস্ত শিরা-উপশিরায় উষ্ণ রক্ত স্রোত বয়ে চলেছে। চেহারায় তৃষ্ণার্ত হায়েনার ন্যায় হিংস্রতা।

শুভ্রবের বোন শায়ন্তী বিরক্ত হয়ে হাতের তালুতে হাত ঘষতে ঘষতে বললো,

— ধুররর!!! এই চান্সে ভেবেছিলাম মেয়েটাকে সরিয়ে দিতে পারবো। সবকিছু দোরগোড়ায় এসে ভেস্তে গেল! ড্যাম ইট।

শুভ্রবের রাগী মুখটা মুহুর্তেই অবাকতায় ছেয়ে গেল। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে বোনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

— সরিয়ে দিবে মানে? কিসের কথা বলছো তুমি? কাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলে?

শেষোক্ত প্রশ্নটায় শুভ্রবের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে সে শায়ন্তীর মুখের দিকে। শায়ন্তী আফসোসের তোড়ে বেফাঁস কথা বলে ফেলায় ধরা পড়া চোরের ন্যায় হাসফাস করছে। কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

— আমার কথাটা তুই বুঝতে পারিসনি, শুভ্রব! আমি আসলে গুঞ্জনকে……….

নামটা শুনতেই ঘর কাঁপানো ধ্বনিতে হুংকার ছাড়লো শুভ্রব,

— জাস্ট শাট আপ, আপি! জাস্ট শাট আপ!! যদি গুঞ্জনের গায়ে একটা আঁচড় কাঁটার কথাও তুমি কল্পনা করে থাকো, দ্যান ইউ উইল হ্যাভ টু পে ফর দিস। আমি কিন্তু এক মুহুর্তের জন্য ভুলে যাবো যে, তুমি আমার একমাত্র বোন। মাইন্ড ইট।

শায়ন্তী সচকিত দৃষ্টিতে বিস্মিত হয়ে তাকায় নিজের ভাইয়ের দিকে। একটা বাইরের মেয়ের জন্য নিজের বোনকে এভাবে বলছে! ভিতরে ভিতরে গুঞ্জনের প্রতি চাপা ক্রোধে ফেটে পড়লেও ওপর দিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো,

— মেয়েটাকে তুলে আনার কথাটাই মিন করেছিলাম আমি। তুই উল্টাপাল্টা ভাবছিস!

— যদি এটাই বলতে চেয়ে থাকিস, তাহলে সেটা সবার জন্যই মঙ্গলজনক হবে। আমি গুঞ্জনকে চাই-ই চাই, এট এনি কস্ট!

শায়ন্তী দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

— মেয়েটার মধ্যে কী পেয়েছিস, জানি না! ওর জন্য এতো পাগলামি করার কী আছে? এর চেয়েও সুন্দরী মেয়ে এনে দিবো তোকে।

তৃতীয় বারের মতো বিকট ধ্বনিতে চিৎকার দিয়ে উঠে শুভ্রব,

— চাই না আমার অন্য কোনো মেয়েকে! চাই না। আমার শুধু গুঞ্জনকেই চাই। শি ইজ মাই অ্যাডিকশন, বুঝেছো? ও আমার আসক্তি!

বলেই ফোপাঁতে ফোপাঁতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল শুভ্রব। এদিকে শায়ন্তী এক হাতে নিজের চুল আঁকড়ে ধরে ভাবছে কীভাবে গুঞ্জনকে মারার পরবর্তী প্ল্যান করা যায় আর শুভ্রবের মাথা থেকে ওর ভুত নামানো যায়। ছেলেটা পাগলই হয়ে গেছে।

.

রাজ্যের বিরক্তি চোখে মুখে ফুটিয়ে রাস্তার কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে গুঞ্জন। নাক মুখ কুঁচকে চোখের সামনে দিয়ে শোঁ শোঁ করে চলে যাওয়া রিকশা গুলো দেখছে সে। একটা খালি রিকশাও পাচ্ছে না। এদিকে ঘড়ির কাটাও যেন শত্রুতা করে দ্রুত গতিতে ঘুরছে। হতাশ ভঙ্গিতে শ্বাস ফেলতেই চোখের সামনে একটা গাড়ি এসে সজোরে ব্রেক কষলো। গুঞ্জন ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা ব্যক্তিটি গ্লাস নামিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে বললো,

— কী ব্যাপার, শ্যামবতী? এই সময়ে রাস্তার কুকুরগুলোর সাথে কাবাডি খেলার শখ হয়েছে নাকি তোমার? এভাবে সঙ্-এর মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন?

উদ্ভট ধাঁচের অযৌক্তিক প্রশ্নের কবলে পড়ে গুঞ্জন রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বললো,

— আপনাকে বলতে বাধ্য নই। রাগ না উঠিয়ে নিজের রাস্তা মাপুন।

নির্জন দাঁত কেলিয়ে হেসে বললো,

— নিজের রাস্তাই তো মাপছি! বউ আমার রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রোদে পুড়ছে, আর আমি গাড়ি টেনে চলে যাবো? আমাকে কি এতোটাই ইরেস্পন্সিবল বলে মনে হয় তোমার?

— আপনার সাথে যাবো না আমি।

— কেন যাবেনা? গাড়িটা পছন্দ হয়নি? জানো, আমার গাড়িতে আমার পাশে বসার জন্য কতো কতো মেয়ে লাইন ধরে!!

গুঞ্জন হাতে হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে বললো,

— না, জানি না। জানতে চাইও না। ঐসব মেয়েদের কাউকে নিজের পাশে বসিয়ে ঘোরাঘুরি করুন গিয়ে। আপনার পাশে বসছি না আ……

কথা শেষ করার আগেই নির্জন গাড়ি থেকে বেরিয়ে একটানে কোলে উঠিয়ে নিতেই বাকরুদ্ধ হয়ে গেল নির্জন। অক্ষিগোলক গোল গোল করে তাকিয়ে থাকতেই নির্জন ফ্রন্ট সিটে বসিয়ে ওর সিট বেল্ট বেঁধে দিতে দিতে বললো,

— যেটা আমার চাই, সেটা আমার চাই-ই চাই। কীভাবে আদায় করে নিতে হয়, সেটা আফ্রান জোহায়ের নির্জনের বেশ ভালো করেই জানা আছে। দিস ইজ সাচ আ ব্যাড হ্যাবিট, ইউ নো!! গুঞ্জননন!!!

-চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে