তুমিময় প্রাপ্তি পর্ব-৪৩

0
452

#তুমিময়_প্রাপ্তি🍁
#পর্ব_৪৩
#মেহরিন_রিম
_আর কতো সাজাবে বলোতো আপু? আচ্ছা তোমরাই তো বলো নাকি,আমি এমনিতেই অনেক সুন্দর। আমিও জানি, আমি এমনিতেই বেস্ট। তাহলে এতো সাজগোজ এর কি দরকার? এতো সাজগোজ করে ওনাদের সামনে গেলে তারা কি ভাববে বলো তো?

এভাবেই একের পর এক কথা বলে চলেছে ইশা। আর ফাইজা তার কথার কোনো পরোয়া না করে তাকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিচ্ছে। একসময় ফাইজার থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে গাল ফুলিয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকে ইশা। বেশ ভালোই লাগছে দেখতে, তবে ইশার নিজেকে কোনো শো পিস মনে হচ্ছে। সাজিয়ে গুছিয়ে মানুষের সামনে প্রদর্শন করবে এমন।

সেইদিনের ঘটনার পর কেটে গেছে আরো দেড় বছরের বেশি সময়। ফাইজা এখন তার শশুর বাড়িতেই থাকে। তাতে অবশ্য ইশার বেশ মন খারাপ হয়, বাড়িটা একদম ফাকা ফাকা লাগে। ফায়াজ আবারো বিদেশে চলে গেছে, কথা আছে নেক্সট টাইম এসে সেও বিয়ে করবে।

ইশার এইচ এস সি এক্সাম শেষ হওয়ার পর এডমিশন এর জন্য বেশ ব্যাস্ত সময় কেটেছে। তবে সেই পরিশ্রম এর ফলও পেয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে খুশিতে গত এক সপ্তাহ নাচতে নাচতেই পার করেছে।
তবে এরই মধ্যে ঘটে যাচ্ছে আরো বড় ঘটনা। কাল রাতে রুকসানা বলেছে আজকে নাকি ইশাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। সেই জন্যই ফাইজা সকাল সকাল এই বাড়িতে চলে এসেছে। বিয়ে করতে ইশার খুব বেশি প্রবলেম নেই, তবে ছেলে পছন্দ হতে হবে। ইশা বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছে ছেলের কথা, ফাইজা বলেছে সে জানেনা।

ইশাও বেশ এক্সাইটেড এই নিয়ে, হতেই তো পারে লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট। চোখে চোখ পড়তেই ইশা লজ্জা পেয়ে যাবে, এমন আরো অনেক ফিল্মি সিন কল্পনা করছে ইশা।

_ফাইজা হলো তোমার? তোমার ছেলেকে সামলাও, আমি আর পারছিনা।
কথাটা বলেই পূর্ণ হাপাতে হাপাতে ঘরে ঢুকলো, কোলে পাঁচ মাসের একটা বাচ্চা। তার নাম প্রজ্জল, পূর্ণ আর ফাইজার ছেলে। পূর্ণর গলার আওয়াজ শুনে ফাইজা যাওয়ার আগেই ইশা উঠে গিয়ে কোলে নিলো প্রজ্জল কে। ওকে আদর করতে করতে বললো,
_এই পুচকু দেখ না তোর মা আমাকে একদম শো পিস বানিয়ে দিচ্ছে,তুই একটু বকে দে তো।

_ইশা ওকে আমার কাছে দে, তোর সাজ নষ্ট করে ফেলবে। কত কষ্ট করে সাজালাম। আর এইযে তুমি, এইটুকু বাচ্চাকে সামলাতে পারোনা?

ফাইজার কথা শুনে পূর্ন কোমড়ে হাত দিয়ে বলে,
_এতক্ষন ধরে তো আমিই সামলাচ্ছি। সে খাবেনা, কোলে থাকবেনা, বসবে না, শুয়েও থাকবে না। তাহলে আমি করবো টা কি?

ইশা প্রজ্জল এর গাল টেনে দিয়ে হাসতে হাসতে বলে,
_তুমি কিন্তু শুধু শুধুই ওর নামে বদনাম করছো ভাইয়া। ওর মতো ভদ্র বাচ্চা দুটো আছে নাকি? তাইনা মিমি, দেখ আমি তোর দলে।

_কি দুষ্টু ছেলে! এতক্ষন আমার কাছে থেকে দুষ্টুমি করছিল। আর এখন তোমার কাছে গিয়ে কি শান্ত!

ফাইজা প্রজ্জল কে ইশার কাছ থেকে নিয়ে বলে,
_থাকবে না আবার, ওনার সঙ্গী কে পেলে আর কাউকে লাগে নাকি? দুজনেই তো সেইম।

_আপু নিয়ে গেলে কেন? দাওনা আমার কাছে..

_উম হু, একদম না। আজ সারারাত তুই ই সামলাস ওকে, আমি ঘুমোবো শান্তিতে। কিন্তু এখন না।

ফোনটা হাতে নিয়ে বিছানায় বসে পড়লো ইশা। ফাইজা আর পূর্ণ বাইরে চলে গেলো প্রজ্জল কে নিয়ে। এখন বেশ বোরিং লাগছে ইশার, জানতে ইচ্ছে করছে ছেলেটা কে! ফাইজা বলেছিল ছেলেটাকে নাকি ইশা চেনে, আর সে ইশাকে অনেক আগে থেকেই পছন্দ করে। এমন ছেলে কে হতে পারে? একবার রিফাত এর কথা মাথায় এলো, পরক্ষণেই মনে পড়লো সে তো আরো ছয়মাস আগেই বিয়ে করেছে। তাহলে কে হতে পারে?

_____
ফাইজা ইশাকে নিয়ে সোফায় বসালো, ইশাও একদম ভদ্র মেয়ের মতো নিচের দিকে তাকিয়েই সোফায় বসলো। সামনে থাকা বাক্তির দিকে এখনো তাকানো হয়নি।
পাশের সোফায় থাকা শাহাদাত সাহেব জহির এর দিকে তাকিয়ে বললেন,
_ইশাকে বোধ হয় আমি আরো দশ বছর আগে দেখেছিলাম একবার। কত বড় হয়ে গেছে ও..

জহির সাহেবও মুচকি হাসলেন। ব্যাবসায়িক সূত্রে শাহাদাত এর সঙ্গে তার আলাপ অনেক আগে থেকেই। তবে আদৃত যে তারই ছেলে এটা জানা ছিলোনা। আদৃত সেদিন ইশাকে ঐ কথাগুলো বলার পর থেকে নিজের মাঝেও কিছু অনুশোচনা হচ্ছিল তার। শাহাদাত সাহেব নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন অনেক আগেই, আর সেই ভুলের শাস্তিও পেয়েছেন। তবে ছেলে হিসেবে বাবার সঙ্গে খারাপ ব্যাবহার করাটা হয়তো আদৃতের উচিৎ হচ্ছে না। তাই এর পর থেকে আদৃতও চেষ্টা করেছে শাহাদাত সাহেবের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করার।

_তা মা আমিতো তোমাকে চিনি। কিন্তু তবুও পাত্রপক্ষ হিসেবে নাম জিজ্ঞেস করা উচিৎ। বলো, নাম কি তোমার?

ইশা মৃদু স্বরে উত্তর দেয়,
_ইসরাত আনজুম ইশা।

_মাশাল্লাহ। আমার আর কিছু জিজ্ঞেস করা নেই, আদি তুই কিছু বলবি?

নামটা শুনে ভ্রুকুঞ্চিত হলো ইশার। এবার আর নিচের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলো না। চোখ তুলে তাকালো সামনের দিকে, সেখানে একজোড়া চোখ আরো আগে থেকেই তার দিকে তাকিয়ে ছিল।
তবে সেই মানুষটিকে দেখার পর ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে ইশা। আদৃত! এখানে! কেন? কি করে? উনি পাত্র! এটা কি করে সম্ভব!

নিজের বর্তমান রূপ মুহূর্তেই ভুলে যায় ইশা। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
_আম্মু আমি তোমাকে বলেছিলাম,ইদানিং চোখে কম দেখছি। কিন্তু এখন তো চোখে ভুলভাল জিনিস দেখছি। আমি ঠিক আছি তো?

সবাই ইশার কথা শুনে একসঙ্গে হাসতে শুরু করে। ফাইজা ইশার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলে,
_তুই যা দেখছিস একদম ঠিক দেখছিস, চোখে কিচ্ছু হয়নি বুঝলি?

ইশা এবার বিস্ফোরিত চোখে আদৃত এর দিকে তাকায়। পূর্ণ সবার উদ্দেশ্যে বলে,
_আমার মনে হয় ওদের একটু আলাদা কথা বলা উচিৎ। বড়রা এখানে আলোচনা করুক ততক্ষণ।

সবাই পূর্ণর সঙ্গে সম্মতি জানালো। ফাইজা আদৃত এর উদ্দেশ্যে বলে,
_ভাইয়া আসুন আমার সঙ্গে..ইশা তুইও আয়।

ফাইজা বোকার মতো প্রশ্ন করলো,
_কোথায় যাবো?

ফাইজা কড়া চোখে তাকায় ইশার দিকে। ইশা ঘোরের মধ্যে ফাইজার পিছন পিছন হাটতে লাগলো।
ফাইজা আদৃত আর ইশাকে ঘরে নিয়ে এসে বলে,
_তোমরা কথা বলো আমি আসছি।

ফাইজা বেড়িয়ে গেলো ঘর থেকে। ইশা এখনো হা করে তাকিয়ে আছে আদৃত এর দিকে। আদৃত এবার ইশার কিছুটা সামনে এসে তার মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলে,
_এভাবে হা করে তাকিয়েই থাকবে?

ঘোর কাটলো ইশার। সঙ্গে সঙ্গে সে আদৃত এর হাতের দিকে তাকায়, আরেকটা আদৃত এর মুখের দিকে তাকিয়ে তার হাতে বেশ জোড়ে চিমটি কাটে।
_আউচ.. এই মেয়ে কি করছো!

ইশা গালে হাত দিয়ে বলে,
_তার মানে এটা স্বপ্ন নয়! এই,আপনি এখানে কেন এসেছেন?

_ঘাস কাটতে..

ইশা বোকা বোনে গিয়ে আদৃত এর দিকে তাকায়। আদৃত এবার মুখে কিছুটা রাগী আভা ফুটিয়ে বলে,
_এমন বোকার মতো প্রশ্ন করলে এমন উত্তর ই পাবে।

_সেটা বড় কথা নয়। কিন্তু আপনি কোন দুঃখে আমাকে বিয়ে করতে চাচ্ছেন?

আদৃত মেকি হেসে উত্তর দেয়,
_মানুষ কেন বিয়ে করে ইশা?

_মানুষ বিয়ে করে…
থেমে যায় ইশা,চোখ বড়বড় করে আদৃত এর দিকে তাকাতেই আদৃত বলে ওঠে,
_এভাবে তাকানোর কি আছে? মানুষ বিয়ে করে একজন লাইফ পার্টনার পাওয়ার জন্য,যার সাথে সে সারাজীবন কাটাবে। আমিও সেই জন্য বিয়ে করতে চাইছি..

_সে আপনি করতেই পারেন,কিন্তু আমাকে কেন?

আদৃত ভাবলেশহীনভাবে উত্তর দেয়,
_বিকজ আই লাভ ইউ.. সিম্পল।

ইশা মাথা ঘুড়ে পড়ে যেতে নিয়েও নিজেকে সামলে নেয়। আদৃত এর দিকে তাকিয়ে বলে,
_আমার কানে মেবি প্রবলেম হচ্ছে। কি বললেন আপনি?

আদৃত ইশার দিকে আরো কিছুটা এগিয়ে বলে,
_বললাম আই লাভ ইউ..শুনেছো এবার?

আবারো আদৃত আগের স্থানে চলে এসে বলে,
_এসব প্রেম ট্রেম আমার পছন্দ নয়। আগেই বলেছিলাম, যাকে ভালোবাসি তাকে সরাসরি বিয়ে করবো। আর সেটাই করছি। আমাকে রিজেক্ট করার কোনো কারণ তোমার কাছে নেই, আর তুমি করবেও না এটাও আমি জানি। সো গেট রেডি টু বি মাই ওয়াইফ মিস ইশা।

আদৃত এবার ইশার কাছে এসে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,
_বাই দা ওয়ে,আই লাইক ইওর নেগেটিভ মাইন্ড ইশা। তুমি যেই কারণটা ভেবেছিলে সেটাও কিন্তু ভুল নয়।

ইশা চোখ বড়বড় করে আদৃত এর দিকে তাকাতেই সে মুচকি হেসে ঘড় থেকে বেড়িয়ে যায়। ইশা শুকনো ঢোক গিলে তাকিয়ে রইলো সেদিকে।
ইশা বুঝতে পারছে না তার এই মুহূর্তে কি রিয়েকশন দেওয়া উচিৎ। আদৃত এত স্বাভাবিক ভাবে তাকে আই লাভ ইউ বলে দিলো! কি করে? আর আদৃত ঠিক ই বলেছে, তাকে রিজেক্ট করার কোনো কারণ ও ইশার কাছে নেই। তাদের মধ্যে সেই আগের ঝগড়ার সম্পর্কটাও এখন বদলেছে, দুজনেই এখন বেশ বন্ধুসুলভ আচরণ করে।

তবে এমন কিছু ইশার কল্পনার ও বাইরে ছিল। তাই পরিস্থিতি বুঝতে বুঝতে তার আরো অনেক সময় লেগে যায়। শাহাদাত সাহেব আজকেই বিয়ের ডেট ঠিক করতে চেয়েছিলেন, তবে জহির সাহেব তাতে আপত্তি জানিয়েছেন। ইশার মতামত না শুনে তিনি কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না।

প্রজ্জল কে কোলে নিয়ে সোফায় বসে আছে ইশা। আর তার সামনে সকলে অতি উৎসাহ নিয়ে তার উত্তর শোনার অপেক্ষায় রয়েছে। ফাইজা এবার গাল থেকে হাত সরিয়ে উঠে দারিয়ে বিরক্তির সুরে বললো,
_আর কতো অপেক্ষা করাবি বল তো..

জহির সাহেব ইশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
_তোর কোনো আপত্তি..

_বাবাই…তোমরা যা ভালো মনে করবে তাই করো। আমার কোনো আপত্তি নেই।

আর এক সেকেন্ড ও সেখানে বসলো না ইশা। প্রজ্জল কে কোলে নিয়ে নিজের ঘরে চলে এলো। হুট করে তার ভীষণ লজ্জা লাগছে,যেটা তার সাধারণ রুপের সঙ্গে একটুও মিলছে না। এটাই কি তবে প্রেমে পড়ার পূর্বাভাস?

#চলব

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে