তি আমো পর্ব-৩৬ এবং শেষ পর্ব

0
1807

#তি_আমো❤
#শেষ_পর্ব
Writer: Sidratul muntaz

🍂
রেলগাড়ীর ঝিকঝিক শব্দে নতুন জীবন শুরু হওয়ার এক আগমনী বার্তা কানে বেজে উঠছিল বারবার। সেই নতুন জীবনের স্বপ্নজাল বুনতে বুনতে কখন যে গন্তব্য চলে এলো, তার খেয়ালও হয়নি। কেনো জানি দুশ্চিন্তা গুলো নিমেষেই মিলিয়ে যেতে লাগলো, তার বদলে জেগে উঠল একরাশ ভরসা। ঈশানের প্রতি ভরসা। হয়তো ভালোবাসার ভরসা। ট্রেন থেমে গেলে যখন আমরা একে-অপরের হাত ধরে নামলাম, তখনি ঘটল একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা। অপ্রীতিকর পরিস্থিতি। এমনটা ধারণার বাহিরে ছিল আমাদের। মা, ভাইয়া, বুড়ি, সাফিন ভাইয়া, নিহা, ফারায আঙ্কেল, মোহনা আন্টি আর পিচ্চি মেয়ে কুইন। সবাই একসাথে জড়ো হয়ে দাড়িয়ে আছে। ঈশানের মুঠোয় ধরে রাখা আমার হাতটা আরো একটু শক্ত করে চেপে ধরলেন ঈশান। এমন ঘটনায় মোটেও খুশি হননি তিনি। সেটা চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে উনার। কিছুক্ষণ পিনপতন নিরবতা বিরাজ করল সবার মাঝে। হঠাৎই পিচ্চি মেয়েটা দৌড়ে এসে ঈশানের কোলে উঠার জন্য হাত উঠালো। ঈশান বাচ্চা মেয়েটিকে কোলে তুলে বলল,

“রানি! কেমন আছো তুমি?”

আমি ভ্রু কুচকে বললাম, “রানি?”

ঈশান বললেন, “রাকিবের ছোট্ট বোন। রানি।”

“তাহলে রাকিব কোথায়?”

ঈশান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “নেই।”

আমার ভেতরটা হালকা কেপে উঠল। অচিরেই এক অজানা ভার চেপে বসল মনে। ঈশানকে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম রাকিব কেনো নেই ? এমন সময় তারিফ ভাইয়া হাত ভাজ করে ঈশানের সামনে এসে দাড়ালেন। আর বললেন,

“এই মেয়েটি তোমার নিজের মেয়ে নয়। এই কথা কেনো বললে না সেদিন?”

ঈশান রানিকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে বললেন, “জিজ্ঞেস করলে অবশ্যই বলতাম। তুমি জিজ্ঞেসই করোনি।”

তারিফ ভাইয়া দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। ঈশানের কাধে হাত রেখে বললেন,” যা হওয়ার হয়েছে। এবার বাড়ি ফিরে যাওয়া উচিৎ তোমাদের।”

ঈশান ফারায আঙ্কেলের দিকে তাকালেন। ফারায আঙ্কেল চোখের ইশারায় ঈশানকে কাছে ডাকলেন। ঈশান কাছে যেতেই মোহনা আন্টি ঈশানের কাধ বরাবর তিনচারটা কিল মেরে বললেন,

“বউ নিয়ে পালিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো? মমের কথা একবারও মনে পড়েনি? কিভাবে থাকবে মম! তুই একটা সেলফিশ ছেলে। ”

মোহনা আন্টি চোখে হাত দিয়ে কেদে ফেললেন। ঈশান আন্টিকে বুকে জড়িয়ে বললেন,

“সরি মম।”

ফারায আঙ্কেল বললেন, “সায়রাকে তোমার পছন্দ না সেটা বললেই হতো। হুটহাট বাড়ি ছেড়ে চলে আসার কি মানে?”

মোহনা আন্টি অনেকটা ধমকের সুরে বললেন, “তুমি চুপ করো। তোমার জন্যই হয়েছে সব। প্রথমে ছেলেটা বাড়িও ছেড়েছে, আর এখন শহর ছেড়ে পর্যন্ত চলে যাচ্ছে তোমার স্টুপিড জেদের জন্য।”

ফারায আঙ্কেল বললেন, “আমি কাউকে বাড়ি ফিরতে নিষেধ করিনি।”

মোহনা আন্টি বললেন, “নিষেধ করোনি ঠিকাছে। কিন্তু বাড়ি ফেরার জন্য একবারও ছেলেটাকে বলেছো? আমার ছেলে কি এতোই ফেলনা যে তোমার না বলা সত্ত্বেও বাড়ি এসে পড়ে থাকবে? সেল্ফ রেসপেক্ট আছে না?”

সাফিন ভাইয়া ঈশানের কাধে হাত রেখে বললেন, “চল। মান-অভিমান বাদ দিয়ে এবার বাড়ি ফেরার পালা। আরে আঙ্কেল সবকিছু মেনে নিয়েছে তো!”

ঈশান আঙ্কেলের দিকে তাকাতেই আঙ্কেল বললেন, “গাড়িতে ওঠো। ”

বলেই সামনের দিকে ঘুরে হাটতে লাগলেন আঙ্কেল। ঈশান আঙ্কেলকে ডাকলেন,

“বাবা! ”

আঙ্কেল ঘুরে তাকাতেই ঈশান বললেন, “সরি। ”

আঙ্কেল মুচকি হেসে চশমা ঠিক করে বললেন, “লেটস কাম।”

ঈশান আঙ্কেলের পেছন পেছন গেলেন। মা আর বুড়ি আমাকে ঘিরে দাড়ালো। মা আমার হাত ধরে বললেন,

“এভাবে কেউ পালায়? ”

বুড়ি আমার কানে ঠুয়া মেরে বললেন,” পাখনা গজাইছে মাইয়ার। বিয়া দিয়া দাও। তয় সব ঠিক হইবো।”

আমি কানে হাত রেখে বিস্ফোরিত চোখে বললাম, “আবার বিয়ে? ”

মা বললেন,” কেনো? হলেই বা কি সমস্যা? দুইবার যখন বিয়ে হয়েই গেছে। তৃতীয়বারও না হয় হবে? আগের কাজী দিয়েই হবে। বেচারা কাজী মিথ্যে বলছিল না।”

আমি কি বলবো উত্তর খুজে পেলাম না। নিহা পেছন থেকে আমার গলা জড়িয়ে বলল,

“দোস্ত, তোরা এই তৃতীয় বিয়েটা আরো ছয়মাস পরে কর। তাহলে এনিভারসেরি আর বিয়ে একসাথে হয়ে যাবে। আর আমার পুচকুটাও বিয়ে খেতে পারবে।”

বলেই পেটে হাত রাখল নিহা। আমি চোখ বড় করে বললাম,

“নিহু? তোর পুচকু? ”

নিহা উৎফুল্লকর হাসি দিয়ে মাথা ঝাকালো। আমি খুশির চোটে নিহাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।

.

বিছানায় শুয়ে একনিষ্ঠতার সাথে বই পড়ছিলাম। হঠাৎই শরীরে খুব ভারী কিছুর আবেশ অনুভব হল। বইটা মুখের সামনে থেকে সরাতেই ঈশানের মুখটা দেখতে পেলাম। প্রথমেই ভয়ে বুকের ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেল।ঈশান ছোট্ট করে আমার গালে একটা চুমু দিয়েই আমার হাত থেকে বইটা ছিনিয়ে নিয়ে বললেন,

“কি বই এটা?”

আমি ভ্রু কুচকে বললাম, “উপন্যাস। দিন আমাকে। এটা আমি পড়ব।”

ঈশান বইটা দিলেন না। টেবিলের উপর রেখে দিয়ে বললেন,

” এখন উপন্যাস পড়া যাবেনা। আর সামনে না তোমার এক্সাম? এসব উল্টা-পাল্টা বই পড়ে সময় নষ্ট করবে কেনো? কাল থেকে মেইন বই পড়বে তুমি। পড়তে বসবে বুঝেছো!”

বলেই আমার নাক টিপে দিলেন ঈশান। আমি বিস্মিত হয়ে বললাম,

“মানে? আপনাকে কে বলল আমার এক্সাম? অলরেডি আমার নাম এটেন্ডেন্সের খাতা থেকে কাট। পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ আছে আমার?”

“কাট মানে? কি কাট? কে কাটবে তোমার নাম?”

“ক্লাস টিচার। ফাহমিদুল স্যার।”

“ওই বেটার এত্তোবড় সাহস যে আমার বউয়ের নাম কাটবে! বরং আমি তার হাতের সবকয়টা আঙুল কেটে দিবো। ”

“তাই নাকি?”

“অবশ্যই। ”

“আচ্ছা আপনি একটা কথা বলেন তো।”

“কি কথা?”

“রাকিব কোথায়?”

“রাকিব! সে তো চলে গেছে।”

“কোথায় গেছে?”

“আমেরিকা।”

“মানে?”

“ছেলেটা খুব ব্রিলিয়ান্ট বুঝেছো! ইন্টারন্যাশনাল ডিবেট কম্পিটিশনে অডিশন দিয়েছিল। সিলেক্ট হয়ে গেছে। তাই আমিও ব্যবস্থা করে আমেরিকা পাঠিয়ে দিয়েছি। চার বছরের ইংলিশে একটা কোর্স করবে। তারপর চলে আসবে। ওর সমবয়সী আরো বাচ্চারা আছে সেখানে। ভালো না?”

“ভালো মানে? খুব ভালো। কিন্তু আপনি তখন এমনভাবে বললেন, আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”

ঈশান “চিক” টাইপ শব্দ করে লাইট অফ করতে যাচ্ছিলেন।কিন্তু আমি বাধ সাধলাম,

“লাইট অফ করবেন না। আজকে আমরা লাইট জ্বালিয়েই ঘুমাই প্লিজ!”

“সিওর?”

“হুম।”

“তুমি সিওর আমরা লাইট জ্বালিয়েই ঘুমাবো।”

“হ্যা! সিওর।কেনো?”

“ওকে। আমার তো কোনো প্রবলেম নেই। ”

বলতে বলতে আমার কোমর দুইহাতের বাহুডোরে জড়িয়ে নিলেন উনি। আমি চোখ বড় করে বললাম,

“লাইট অফ করে দিন প্লিজ।”

“কেনো? তুমিই তো বললে লাইট জ্বালিয়ে রাখতে। ”

“না! আমি কিন্তু চিৎকার দিবো প্লিজ লাইট বন্ধ করেন।”

ঈশান ভুবন কাপানো হাসিতে মত্ত হলেন। আর আমি আতঙ্কে জড়োসড়ো।কয়েক মিনিটের মধ্যেই আলো নিভে গেলো। কিন্তু অন্ধকার নামলো না। চাঁদের আলোটাও আজ নির্লজ্জের মতো জ্যাতি ছড়াচ্ছে। সর্বানাশা এই জোৎস্নার আলোটাও কি নিভিয়ে দেওয়া যায়না! মুহুর্তেই আমার শরীর স্থবির হয়ে আসলো। অসীম ভালোবাসায় ঘেরা এক মৃদু মধুর উষ্ণতা প্রবাহিত হতে লাগল সম্পুর্ণ শরীর জুড়ে। আমি চোখ বন্ধ করে নিলাম। এবার তো সব অন্ধকার….

সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে