#তি_আমো❤
#পর্ব_২৪
Writer: Sidratul muntaz
🍂
মোহনা আন্টি আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালেন, প্রফুল্লকর একটা হাসি দিয়ে ঈশানকে বললেন,
“তারিন এখানে?”
বলেই আমার দিকে এগিয়ে আসলেন। আমিও এগিয়ে গেলাম৷ উনি এক হাত দিয়ে আমার বাহু চেপে ধরলেন। আমার মাথার এক সাইডে হাত বুলিয়ে ঢোক গিলে কান্না থামালেন। আর বললেন,
“ভয় পেয়ো না তারিন। তোমার বিয়ে আমরা কিছুতেই হতে দিবো না। ঈশান আছে না, ও ঠিকই বিয়ে আটকে দিবে। ভেঙে দিবে বিয়ে। টেনশন করো না হ্যা? ”
কথাগুলো বলতে বলতে ঈশানের দিকে তাকালেন, “ঈশান, তুই তারিনের বিয়েটা আটকাতে পারবি তো? তোকে কিন্তু পারতেই হবে। প্রয়োজন হলে ওই অসভ্য ছেলেটাকে পিটিয়ে আধমরা বানিয়ে দিবি। হাত পা ভেঙে গুড়ো করে দিবি। বিয়ে করার অবস্থাতেই যেন না থাকে। দরকার হলে হসপিটালে এডমিট করে দিয়ে আসবি। খরচপাতি আমি বুঝে নিব। তারপর দেখবো বিয়ে কিভাবে হয়। পাত্র না থাকলে কার সাথে কিভাবে বিয়ে দিবে তোমার ভাই?”
ঈশান এগিয়ে এসে বললেন,” আচ্ছা আচ্ছা মা! তুমি আগে নরমাল হও। কাম ডাউন।”
আন্টির দুই কাধ স্পর্শ করে আন্টিকে বেঞ্চের উপর বসালেন ঈশান। চোখের পানি মুছে দিয়ে বললেন,
“এখন প্লিজ তুমি একটু চিল করো। দেখি হাতের কি অবস্থা হয়েছে। নিহা? ফার্স্ট এইড বক্স?”
নিহা মাথা ঝাকিয়ে বলল, “আমার বেডরুমে আছে। আমি এখনি নিয়ে আসছি। ”
নিহা চলে যেতেই মোহনা আন্টি আবার শুরু করলেন,
“ঈশান,চল চল না আমরা এক কাজ করি? আমরা তারিনকে নিয়ে বাসায় চলে যাই। ওর ভাই ওকে খুজেও পাবে না। বিয়েও দিতে পারবে না। ঠিকাছে না তারিন? তুমি চলো আমাদের বাসায়। যাবে?”
ঈশান বললেন, “আচ্ছা যাবে।কিন্তু তুমি এখন সাইলেন্ট থাকো। কথা বলবে না। প্রেশার বেড়ে গেছে নাকি আল্লাহ জানে। এতো হাইপার হলে চলে মম? ”
ঈশান আন্টির আচল দিয়ে ঘাম মুছে দিয়ে আন্টি কপালের একপাশে চুমু দিলেন। আর বললেন,
“পানি খাবে?”
আন্টি জোরে মাথা নাড়লেন। ঈশান আমার দিকে ইশারা করতেই আমি ছোট ফিল্টারের উপর সাজানো ওয়ানটাইম গ্লাস দিয়ে পানি আনলাম। ঈশান আন্টিকে ধরে ধরে পানি খাওয়ালেন। আন্টির হাত পা থরথর করে কাপছে। আমার মনে হয়, উনার হয়তো হুটহাট রেগে যাওয়ার মতো মারাত্মক কোনো রোগ আছে। কোনোকিছু নিজের খেয়ালখুশি মতো না হলেই এই রোগটা প্রকাশ পায়। তাহলে তো ঈশানের বাবা মানে আঙ্কেলের জন্য আমার সিমপ্যাথি লাগছে। চব্বিশ বছর ধরে কিভাবে জেদী বউ সামলেছেন কে জানে? নিহা ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে ভিতরে ঢুকল। ঈশান শুরু করলেন ট্রিটমেন্ট। সাথে প্রেশার মাপার সরঞ্জামও আছে। ঈশান ব্যান্ডেজ শেষে ব্লাড প্রেশারটাও মেপে নিলেন। প্রেশার রিডিং আসলো, ১৪০/৯০ mm Hg। মানে হাই। সাথে ঈশানের মেজাজও হাই। উড়ুম দুড়ুম ধমকাচ্ছেন আন্টিকে। কিন্তু আন্টি নিঃশব্দে বসে আছেন। ঈশানের একটা কথাও উনি কর্ণকুহরে তুলছেন না সেটা ভাবভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ঈশান তবুও আওরাচ্ছেন,
“বসে আছো কেনো? চিল্লাও। আরো জোরে জোরে চিল্লাও। কোনো দরকার নেই কন্ট্রোল করার।
হান্ড্রেড টাইমস ওভার আমি তোমাকে নিষেধ করেছি মাথা গরম করবে না। কন্ট্রোলে থাকবে। নরমালি সবকিছু হ্যান্ডেল করবে। ইটস হাই টাইম। এভাবে চলতে থাকলে কিভাবে হবে আমাকে বোঝাও। যেকোনো সময় বাজে কোনো ইন্সিডেন্ট ঘটে যেতে পারে। তারপর নিশ্চয়ই শান্তি তোমার? আচ্ছা তুমি কি জীবনেও হাইপার টেনশন নিয়ন্ত্রণ করা শিখবে না? বাচ্চা তুমি? আর কিভাবে বুঝাবো তোমাকে? খুব ডেঞ্জারাস বিষয় কিন্তু মম। ইগনোর করলে চলবে না। ডাক্তার কি বলেছিল তোমাকে? সব কি ভুলে গেছো?”
কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থেকে হঠাৎ আন্টি বলে উঠলেন,
“আচ্ছা তারিনের বিয়ে ভাঙার কি প্ল্যান?”
উত্তরের বদলে মায়ের পাল্টা প্রশ্ন শুনে হতাশ হলেন ঈশান। মুখে হাত ঠেকিয়ে কিছু একটা চিন্তা করে নিহার দিকে তাকালেন,
“নিহা! তোমাকে আরেকবার কষ্ট করে উপরে যেতে হবে। আমার রুমের টেবিলের ড্রয়ারে..”
নিহা ঈশানকে থামিয়ে বলল, “ডার্ক চকলেট? আমি এনেছি। জানতাম এটা লাগবে।”
নিহা চকলেট টা এগিয়ে দিতেই ঈশান সন্তোষজনক হাসি দিলেন। বললেন,
“গুড জব। মম! হা করো। ওয়ান বাইট। ”
মোহনা আন্টি তীব্র অনিহা দেখিয়ে মাথা নাড়লেন। যেন উনাকে বিষ খেতে বলা হচ্ছে। ঈশান বললেন,
“প্লিজ মম! এটা খেতে হবে। মেডিসিন।”
মোহনা আন্টি করুন চোখে তাকিয়ে বললেন, অসম্ভব। অনেক বেশি মিষ্টি আমি খেতে পারবো না।
” ট্রাস্ট মি,এটা ডায়েটিং এ কোনো ইফেক্ট করবে না. এটার মেইন ইনগ্রিডিয়েন্টস কোকো। কোকোর পলিফেলনস তোমার প্রেশার কমাতে সো মাচ হেল্পফুল। তাই খাও। নো মোর এক্সকিউজ।”
মোহনা আন্টি অনিচ্ছা সত্ত্বেও চকলেট হাতে নিলেন। একটা বাইট দিয়েই মুখ কুচকে বললেন,
“আর না।”
ঈশান মুচকি হেসে প্যাকেট মুড়িয়ে নিহার হাতে দিলেন। উনি এতোক্ষণ আন্টির সামনে হাটু গেড়ে বসে ছিলেন, এবার উঠে দাড়ালেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“বলো! কি করতে হবে?”
আন্টি নির্দ্বিধায় বললেন, “বিয়ে করতে হবে?”
ঈশান বিস্মিত হলেন, “কি? এক্ষুনি না বললে বিয়ে ভাঙতে হবে? আর এখন বলছো বিয়ে করতে হবে? ”
আন্টি অকুণ্ঠে বললেন, “দুটোই। বিয়ে ভাঙতেও হবে। বিয়ে করতেও হবে। ”
আমি আর ঈশান চোখাচোখি করলাম। নির্বোধের মতো দুজনেই বললাম,” মানে কি?”
আন্টি আমার দিকে একবার তাকিয়ে ঈশানকে বললেন,
“তোদের দু’জনকে বিয়ে দিবো আমি। আজকে এবং এক্ষুণি। নিহা? ফয়সাল ভাইকে বলো গাড়ি বের করতে। বাসায় ফিরবো আমরা।”
নিহা তব্দা লেগে মুখে গোল হা নিয়ে দাড়িয়ে আছে। মোহনা আন্টির আরেকটা ধমকে টনক নড়লো তার।
“কি হলো যাও?”
“জ জী আন্টি যাচ্ছি।”
নিহা বের হয়ে যাওয়ার পর মোহনা আন্টি উঠে দাড়ালেন। দৃপ্ত পায়ে হেটে দরজার সামনে গিয়ে থামলেন। পেছন না তাকিয়েই বললেন,
“কাম অন ঈশান! মায়ের চোখ ফাকি দেওয়া এতোটাও ইজি না। মা সব জানে, সব বুঝে।”
বলেই মোহনা আন্টি দৃষ্টির অন্তরালে চলে গেলেন। আমি ঈশানের দিকে নির্বাক চোখে তাকিয়ে বললাম,
“আন্টি কি বললেন এটা?”
উত্তরে ঈশান বললেন,
“মম আমাদের রিলেশনের বিষয়টা ধরে ফেলেছে।”
আমি মুখে হাত রাখলাম। মুহূর্তেই মুখটা আমার লাল আভাপূর্ণ হয়ে উঠল।
.
.
আমি আর ঈশান গাড়ির পশ্চাত আসনে বসে আছি। তবে পর্যাপ্ত দুরত্ব বজায় রেখে। ঈশান বামপাশের জানালার সাথে মিশে আছেন, আর ডানপাশের জানালার সাথে। সামনে আন্টি আর ড্রাইভার ফয়সাল আঙ্কেল। আমাদের গন্তব্য এখন ঈশানদের বাসা। নিহাদের বাসার কাউকে কিছু না বলেই মোহনা আন্টি আমাদের নিয়ে বেরিয়ে এসেছেন। ভাইয়া হয়তো এতোক্ষণে আমাদের হন্যি হয়ে খুজছে। আন্টির সামনে কিছু বলতেও পারছি না। ঈশানও কিছু বলছেন না। ভীষণ ইচ্ছে করছে ঈশানকে একবার জিজ্ঞেস করতে এ বিষয়ে। কিন্তু এই আবদ্ধ গাড়িতে যেখানে নিঃশ্বাসের শব্দটা পর্যন্ত স্পষ্ট, সেখানে ফিসফিস করে কথা বলার চেষ্টাও নিতান্ত বোকামি। তাই ঈশানকে মেসেজ করলাম আমি।
” ঈশান, কোথায় যাচ্ছি আমরা?”
ঈশান ফোনের ভাইব্রেন্সি টের পেয়ে আমার দিকে তাকালেন, আমি ঈশারা করে বুঝালাম মেসেজ দেখতে। ক্ষণিক সময় পর উত্তর আসল, “বাসায়।” মেসেজের রিপ্লাই দেখে আমার ইচ্ছে করল ফোনটা ঈশানের মাথা বরাবর ছুড়ে মারতে। আমি আবার লিখলাম,
“বাসায় যাচ্ছি সেটা তো বুঝলাম। কিন্তু আন্টি আমাদের বাসায় কেনো নিয়ে যাচ্ছেন? সত্যিই কি বিয়ে দিবে আমাদের?”
“আমি জানিনা। মম জানে।”
ঈশানের এই উত্তর দেখে আমি সরুচোখে তাকালাম। আমার চাহনি দেখে ঈশান নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন,” কি?”
ঈশানের স্বাভাবিক কণ্ঠে উচ্চারিত শব্দটা বেশ জোরেই শোনা গেল। সামনে থেকে আন্টি জিজ্ঞেস করলেন,
“কি হয়েছে? এনি প্রবলেম?”
আমি হাসার চেষ্টা করলাম, “না আন্টি। কোনো প্রবলেম না।”
আন্টি বললেন, “ওকে!”
আমার আবার ঈশানকে মেসেজ করলাম,” ওদিকে ভাইয়া আপনাকে আর আমাকে খুজতে খুজতে পাগল হয়ে যাচ্ছেন নিশ্চয়ই। আমাদের কি ভাইয়াকে সবটা জানানো উচিৎ না?”
ঈশান লিখলেন, “না। পরে বলছি।”
আমি আরো কিছু লিখতে নিলাম,” তখনই আন্টি বললেন, আচ্ছা তারিন তোমার এইজ কত? আঠারো হয়েছে?”
আমি অসামাল কণ্ঠে উত্তর দিলাম, “জী না আন্টি, আঠারো হয়নি?”
আন্টি একটু অপ্রসন্ন হয়ে বললেন,” হয়নি? তাহলে কত?”
“সতেরো বছর চার মাস।”
“ওহহো! ”
মাথায় হাত ঠেকালেন আন্টি। কি একটা চিন্তা করে আবার বললেন, “আমি ভেবেছিলাম তুমি প্রাপ্তবয়স্ক। নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারবে। কিন্তু এবার মনে হচ্ছে ঝামেলা হয়ে যাবে। আচ্ছা তাতেও প্রবলেম নেই, আমি মেনেজ করে নিব। ”
আমি আন্টি জিজ্ঞেস করতে চাইছিলাম, কি মেনেজ করার কথা বলছেন উনি। এমন সময় আসলো নিহার ফোন। আমি দ্রুত রিসিভ করলাম। নিহা বেশ অস্থিরতা নিয়ে বলল,
“তারু! কোথায় তুই?”
“আমি তো গাড়িতে।”
“ও! আচ্ছা শোন, মোহনা আন্টি তোকে কখন ছাড়বে তার ঠিক নেই। এদিকে আমি আর সাফিনও বেরিয়ে পড়েছি। তারিফ ভাইয়া মাত্র ফোন করেছিলেন। তোর কথা জিজ্ঞেস করতে।”
“তুই কি বলেছিস?”
“শোন আমি বলেছি তুই আমাদের সাথে আছিস। কিন্তু অন্য গাড়িতে। আর তোর ফোন আমার ব্যাগে। তাই তোকে ফোনে পাওয়া যাবে না। সন্ধ্যার দিকে তোকে গাড়ি করে বাসায় পৌছে দেওয়া হবে। এভাবেই হেন-তেন বলে মেনেজ করে নিয়েছি।”
“ভাইয়া কিছু বলেনি?”
“প্রথমে একটু মেজাজ দেখিয়েছিলেন, সবাইকে না জানিয়ে তোকে কেনো নিয়ে গেলাম সেজন্য। কিন্তু পরে বললেন তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে যেতে। আর ঈশান ভাইয়াকে বল, উনি যেন তারিফ ভাইকে ফোন দিয়ে বাকিটা মেনেজ করেন। তোরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাসায় চলে যাস ঠিকাছে?”
“আচ্ছা ঠিকাছে।”
“হুম রাখছি। আপডেট বলিস।”
“হুম।”
নিহা বলল,” বেস্ট অফ লাক।” সাথে চাপা হাসির শব্দ পাওয়া গেল। আমি বিরক্ত হয়ে ফোন কেটে দিলাম। এই মুহুর্তে শুধু একটা কথাই মনে হচ্ছে, “কারো পৌষ-মাস তো কারো সর্বনাশ।”
.
.
আমি ঈশানের রুমের উত্তর-দক্ষিণ ক্রমাগত পায়চারি করছি। ঈশান মাথায় হাত ঠেকিয়ে বিছানার একপাশে বসে আছেন। টেনশনে দুজনেই অস্থির। তবে ঈশান অস্থিরতা টা প্রকাশ করছেন না। আর আমি প্রকাশ না করে থাকতে পারছি না। বারবার আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখছি। আয়নার বিপরীত বরাবর কাচের দেয়াল থাকায় হাজার হাজার প্রতিবিম্ব তৈরি হয়েছে আমার। এই সব আমিকে যদি এই মুহুর্তে বের করা যেতো, তাহলে সবাই মিলে পরামর্শ করে একটা ভালো উপায়ও বের করে ফেলা যেতো। সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেতো। কতই না ভালো হতো। ঈশান আমায় ডাকলেন,
“তারিন।”
আমি ভাবলেশহীন ভাবে উচ্চারণ করলাম,” হুম!”
“এভাবে হাটাহাটি করছো কেনো? একটু ঠান্ডা হয়ে বসো!”
“পারছি না ঈশান। আমি পারছি না। আর টেনশনও নিতে পারছি না। ভীষণ ইচ্ছে করছে সবাইকে সবকিছু জানিয়ে দিতে। তারপর যা হবে দেখা যাবে। অন্তত এভাবে টেনশনে থাকতে হবে না।”
“আমি জানাতে চেয়েছিলাম তারিন। কিন্তু দেখলেই তো মমের অবস্থা। একটুতেই প্রেশার বাড়িয়ে ফেলেছে। সবকিছু জানার পরে কি হবে আল্লাহ মালুম।”
আমি চেয়ার ধরে বসে পড়লাম। হতাশ হয়ে বললাম,” হ্যা, আমি সেটা বুঝতে পেরেছি ঈশান। কিন্তু বিষয়টা দিন দিন শুধু ঘোলাটে হচ্ছে। একটা ছোট্ট মিথ্যা কত বিশাল ঝামেলা হয়ে দাড়িয়েছে আমাদের জীবনে। পরে সবকিছু কিভাবে ঠিক হবে ঈশান? এখন আন্টি আর ভাইয়া যেমন আমাদের বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পরে লেগেছেন, সত্যিটা জানার পর উনারাই আবার ডিভোর্স করানোর জন্য উঠে পরে লাগবে না তো?”
আমি বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম। ঈশান নখে কামড় দিয়ে কিছু একটা চিন্তা করে বলে উঠলেন,
“তারিন, টেনশন করলে তোমার মুখটা পুরো রেড পেস্ট্রির মতো লাগে।”
আমি টেবিলের উপর পাফ বলটা নিয়ে ঈশানের মাথা বরাবর ছুড়ে মারলাম। আর ঈশান হো হো করে হেসে উঠলেন। আমি বুঝতে পারছি না এইরকম একটা পরিস্থিতিতেও উনার হাসি কিভাবে আসছে?
🍂
চলবে
#তি_আমো❤
#পর্ব_২৫
Writer: Sidratul muntaz
🍂
ঈশান আর আমি পাশাপাশি সোফায় বসে আছি। আমাদের ঠিক বরাবর মোহনা আন্টি পায়ের উপর পা তুলে বসেছেন। বাম হাতটা হাটুর উপর রেখে ক্রমাগত আঙুল নাড়াচ্ছেন। রাগে কটমট চোখে কাজী সাহেবের দিকে তাকিয়ে আছেন। ড্রাইভার ফয়সাল আঙ্কেল কাজী সাহেবের পাঞ্জাবীর কলার আকড়ে রেখেছেন। কাজী সাহেব ভয়ে কাচুমাচু। উনার অপরাধ হলো, এই সময় অন্য জায়গায় বিয়ে পড়ানোর আমন্ত্রণ ছিল। সেই আমন্ত্রণ রক্ষা করতে উনি আমাদের বিয়ে পড়াতে নাকচ করেছেন। তাই মহামান্য কাজী সাহেবকে এক প্রকার জবরদস্তি তুলে আনা হয়েছে। মোহনা আন্টি বেশ রুঢ় কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন,
“ওরা আপনাকে কত এডভান্স দিয়েছে? আমার থেকেও বেশি? প্রয়োজন হলে ওদের ডবল দিবো আমি।”
কাজী সাহেব নিচু স্বরে বললেন,
“ম্যাডাম কিছু মনে করবেন না। কিন্তু পয়সা বড় কথা না ম্যাডাম। আমার কাছে মুখের জবান বড় কথা। আমি তাদের কথা দিয়েছি। এখন কিভাবে আমি সেটা প্রত্যাখ্যান করি?”
“কি বললেন? পয়সা বড় ব্যাপার না? আরে টাকার থেকে বড় আর কি হতে পারে? পুরো দুনিয়া টাকার উপর। টাকা না থাকলে জবান দিয়ে কি হবে শুনি? জবান রক্ষার জন্য করতে ওদের কাজ করতে গেলে ওরা আপনাকে কি এক্সট্রা কোনো অ্যামাউন্ট দিবে? আপনার জবানের মুল্য হিসেবে? দিবে না! কিন্তু জবান ভেঙে আমার কাজ করলে আপনি পারিশ্রমিকের তিনগুণ পাবেন। না তিনগুণ না, যত বায়না করবেন তত দিব। এবার বলুন জবান ঠিক রেখে লাভ? নাকি জবান ভেঙে লাভ? চয়েস ইউরস!”
ভ্রু নাচিয়ে কথাটা বলেই টেবিলের উপর রাখা কফি মগটা তুলে চুমুক দিলেন মোহনা আন্টি। অতঃপর কাজী সাহেবের দিকে তাকিয়ে উনার উত্তরের অপেক্ষা করতে লাগলেন। কাজী সাহেব খানিক চুপ থেকে ইতস্তত গলায় বললেন,
“মাফ করবেন ম্যাডাম। আমাকে যেতে হবে। আপনি অনুমতি দিলে আমি অন্য কাউকে বলে ব্যবস্থা করাচ্ছি।”
মোহনা আন্টি প্রত্যাশিত উত্তর না পেয়ে ভ্রু কুচকালেন। ফয়সাল আঙ্কেল উচ্চ স্বরে বললেন,
“এই বেটা! কাকে নিষেধ করছো তুমি? তোমার সামনে মোহনা সরকা..”
মোহনা আন্টির হাতের ইশারায় থেমে গেলেন ফয়সাল আঙ্কেল। মোহনা আন্টি বললেন,
“আপনাকে আমার ভালো লেগেছে কাজী সাহেব। আপনার পারসোনালিটি ভালো লেগেছে। সচরাচর এমন দেখা যায়না। কিন্তু কি বলুন তো? আমার যাকে ভালো লাগে, আমি যে তাকে ছাড়ি না! কাজটা আপনাকেই করতে হবে। এবং এখুনি করতে হবে। আমি কোনো এক্সকিউজ শুনতে রাজি নই। ”
কথার মাঝখানেই কাজী সাহেবের ফোন বেজে উঠল। কাজী সাহেব মোহনা আন্টির দিকে তাকাতেই আন্টি মাথা দুলিয়ে বুঝালেন ফোনটা ধরতে। কাজী সাহেব জানালার পাশে চলে গেলেন। ফয়সাল আঙ্কেল বললেন,
“লোকটা খুব ঘাড়ত্যাড়া ম্যাডাম।”
মোহনা আন্টি তাচ্ছিল্যের সাথে বললেন, “যতই ঘাড়ত্যাড়া হোক। ওই ত্যাড়া ঘাড় নিয়েই রাজি হবে দেখবেন। ”
ঈশান বললেন,” মম। ফরগেট হিম। অন্য কাউকে দিয়েও তো কাজটা করানো যায়। আদারওয়াইজ.. আজকেই কেনো করাতে হবে? কালকে না হয়..”
মোহনা আন্টি চোখ বড় করে বললেন,” আর ইউ সিরিয়াস ঈশান? তারিনের ভাই কাল পর্যন্ত বসে থাকবে নাকি? বাসায় ফিরলেই তো ধরে বেধে বিয়ে দিয়ে দিবে ওর। এই রিস্ক নেওয়া যাবে না।”
আমি কোনো উত্তর দিলাম না। মাথা নিচু করে আছি। মনের মধ্যে ঘুর্ণিঝড় হচ্ছে আমার।
কাজী সাহেব ইতিমধ্যে ফিরে এসেছেন। হাসিমুখে বললেন,
“আর কোনো সমস্যা নেই ম্যাডাম। ওরা সময় পিছিয়েছে। তাই এখন আপনাদের কাজ করতে কোনো দ্বিধা নেই। কিন্তু তিনগুণ পারিশ্রমিক লাগবে না ম্যাডাম।শুধু ন্যায্য টা দিবেন। তাহলেই হবে।”
মোহনা আন্টি সন্তোষজনক হাসি দিলেন। বললেন,
“ন্যায্য পাওনা অবশ্যই দিবো। সাথে বাকি যেটা দিবো.. বকশিশ। গ্রহণ করতেই হবে।”
কাজী সাহেব হেসে দিলেন। আর বললেন, “ঠিকাছে ম্যাডাম।”
শুরু হলো বিয়ে পড়ানোর আয়োজন। কাজী সাহেব বড় খাতা খুলে বসেছে। প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন,
“ছেলের নাম?”
ঈশান বললেন,” তারায জোহান ঈশান।”
“মেয়ের নাম?”
আমি তোতলাতে তোতলাতে বললাম,” আশফীয়া তারিন।”
“ছেলের বাবার নাম?”
মোহনা আন্টি বললেন,” ফারায জোহান ইসহাক।”
“ছেলের মায়ের নাম?”
“মোহনা সরকার ইশা।”
“মেয়ের বাবার নাম?”
আমি বললাম, “মরহুম তাজউদ্দিন সাঈদ।”
“মায়ের নাম?”
“আয়েশা তালুকদার। ”
“দেনমোহর কত ধার্য হবে?”
মোহনা আন্টি কিছু একটা ভেবে বললেন, “বিশ লাখ।”
আমি চোখ বড় করে ঈশানের দিকে তাকালাম। ঈশান জোর পুর্বক হাসলেন। মোহনা আন্টি আবার দ্রুত গলায় বললেন,
“না না! পঞ্চাশ লাখ। ”
এবার ঈশানের জোর পুর্বক হাসিটাও মিলিয়ে গেল। কিন্তু আমার হাসি পাচ্ছে খুব। তারপর সময় আসলো কবুল বলার। এই একটা শব্দ উচ্চারণ করা যতটা সহজ আমার আগে মনে হতো, তার চেয়েও হাজার গুণ কঠিন সেটা আমি এখন বুঝতে পারছি। যেন অদ্ভুত এক শক্তি গলার ভিতরটা চেপে ধরে রাখে। সম্পুর্ণ জীবনের মোড়টাই উল্টো দিকে ঘুরে যায় এই একটা শব্দের দরুণ।
.
.
আমি আর ঈশান গাড়িতে বসে আছি। ঈশান মনোযোগের সহিত ড্রাইভ করছেন, আর আমি মনোযোগের সহিত টেনশন। শেষ বিকালটা সন্ধ্যার অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে আসছে। আমার মাথায় ঘুরছে অনেকগুলো প্রশ্ন। বাসায় গিয়ে কি আরেকবার বিয়ে করতে হবে আমাদের? ডাবল রেজেস্ট্রি হবে? তাও আবার মিথ্যে উপর ভিত্তি করে? তারপর যখন সত্যিটা সবার সামনে চলে আসবে, তখন ডাবল ডিভোর্স হয়ে যাবে না তো? আমি ঈশানের দিকে তাকালাম। ঈশান সামনের দিলে দৃষ্টি স্থির রেখেই জিজ্ঞেস করলেন,
“কিছু বলবে তারিন?”
“ভয় লাগছে।”
“ভয় কিসের?”
“কিসের আবার? আচ্ছা আপনি বলেন তো এভাবে কতদিন?টেনশনে মরে যাচ্ছি তো।”
“টেনশন করো বেবি। আরো টেনশন করো। টেনশনে থাকলে তোমাকে কিউটেস্ট লাগে।”
আমি বিস্মিত হয়ে সরুচোখে তাকালাম, “আচ্ছা ঈশান আপনার কি একটুও টেনশন হচ্ছে না? আপনি আসলে ধারণাই করতে পারছেন না ভাইয়া সত্যিটা জানতে পারলে কি কি করবেন। সম্পুর্ণ বিপক্ষে চলে যাবেন আমাদের। এখন আপনার সঙ্গে ঠিক যতটা ভালো বিহেভ করছেন, তখন তার চেয়েও খারাপ বিহেভ করবে। হিংস্র হয়ে উঠবে ভাইয়া।”
ঈশান ভাবলেশহীন হয়ে বললেন,” তাই নাকি? তাহলে সত্যিটা না জানানোই বেটার।”
“সত্যি চেপে রাখা যায়না ঈশান। একদিন না একদিন প্রকাশ পাবেই। আর তাছাড়া মোহনা আন্টিকেই বা আপনি কিভাবে ম্যানেজ করবেন শুনি? আন্টি তো আমাদের পাঠিয়েছেন ভাইয়াকে সবকিছু জানিয়ে বিয়েটা ভাঙার জন্য। এখন যদি আমরা ভাইয়ার কাছে গিয়ে আবারও বিয়ে করতে বসি, তাহলে সবটা ওলট-পালট হয়ে যাবে না? আপনি বাসায় কিভাবে ফিরবেন? আপনাকে তো থাকতে হবে আমাদের বাড়িতে। মোহনা আন্টিকে তখন কি কৈফিয়ত দিবেন? কয়দিন ম্যানেজ করবেন?”
“আমি আইডিয়া ভেবে রেখেছি মিষ্টি! তারিফকে বলবো তোমায় নিয়ে কিশোরগঞ্জ ফিরে যাচ্ছি, আর মমকে বলবো তোমার ভাইয়া বিয়েটা মেনে নিয়েছে। তাই তোমাকে আমার সাথে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়েছে। সিম্পল!”
“বাহ! কি দুর্দান্ত! ”
আমি ঠাট্টা করে তালি বাজালাম। তালি বাজিয়ে বললাম, “তারপর আন্টি যদি ভাইয়ার সাথে কথা বলতে চায়? আমার বাসার সবাইকে নিয়ে গেট টুগেদার এ্যারেঞ্জ করে? তখন? আন্টি তো বলেছেন এটা করবেন।”
“এইটাই তো মেইন পয়েন্ট! তখন সবাই সবকিছু জানবে। কিন্তু কেউ কিছু বলবে না।”
“কেনো কিছু বলবে না কেনো?”
“দেখো তারিন, মম আমাদের বিয়েটা এক প্রকার হুটহাট করে দিয়েছে। সো আমরা এই এক্সকিউজ দিতেই পারি যে মম আমাদের বলার সুযোগ দেয়নি। আর তারিফ, সেও এখন রাগের মাথায় আমাদের তাড়াহুড়ো করেই বিয়ে দিবে। তখনো আমরা সেইম এক্সকিউজ দিবো। আমাদের কিছু বলার সুযোগ হয়নি। তারপর আমরা ঠিক করেছি, সবাইকে একত্র করে ঠান্ডা মাথায় সবকিছু বুঝিয়ে বলবো। ব্যাস! প্রবলেম সোলভ। ”
“ওয়েট ওয়েট! সবকিছু এতোটাও ইজি না যতটা আপনি ভাবছেন।”
“ঈজি ভাবলেই ইজি। গাড়ি থেকে নামো। চলে এসেছি। ”
ঈশান গাড়ি থেকে নামলেন। আমিও আর কিছু বলার সুযোগ না পেয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। বাসায় ঢুকতেই দেখলাম চারদিকে লাইটিং করে, প্যান্ডেল টানিয়ে মোটামোটি জাকজমকভাবেই বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে। আমরা ভিতরে ঢুকতেই অদ্ভুত বাদ্যযন্ত্র বাজতে শুরু করল। আসলে অদ্ভুত না। এগুলো বিয়ের বাজনা। কিন্তু টেনশনের কারণে অদ্ভুত শোনাচ্ছে। মা আমাদের দেখতে পেয়েই দ্রুত ছুটে আসলেন। আমার এক হাত ধরে বললেন,
“এতো দেরি করলে চলে?কাজী সাহেব পর্যন্ত এসে বসে আছেন, বর- কনে আসার নাম নেই।আয়,আয়! ”
মা আমাকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে ঈশানকে বললেন,
“ঈশান, বাবা তুমি তারিফের ঘরে চলে যাও। ”
ঈশান ভাইয়ার ঘরের দিকেই যাচ্ছিলেন। আমি সেই বরাবর উকি দিতেই দেখলাম কাজী সাহেব ভিতরে বসে আছেন। কাজী সাহেবের চেহারা দেখে পিলে চমকে উঠল আমার। আমি অনায়েসে দাড়িয়ে পড়লাম। এই কাজীই তো একটু আগেই আমাদের বিয়ে পড়িয়েছেন। এখন আবার এখানেও আমাদের বিয়ে উনিই পড়াবেন নাকি? মা তীক্ষ্ণ শব্দে বললেন,
“কি হলো তারু দাড়িয়ে গেলি কেনো? চল! আরে তৈরি হতে হবে তো। হাতে বেশি সময় নেই। ”
আমি ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে মায়ের দিকে তাকালাম।
🍂
চলবে