#তি_আমো❤
#পর্ব_৯
Writer: Sidratul muntaz
🍂
সকাল দশটা। বিছানায় বসে আছি। কিছুক্ষণ আগে ঘুম ভাঙল। তাও উদ্ভট শব্দের অত্যাচারে। এতো শব্দ কোথ থেকে আসছে বুঝতে পারছি না। মাথায় অজস্র চিন্তা ভর করে আছে আমার। গতকাল ঈশানের সাথে আলাপের শেষ সিদ্ধান্ত জানা হয়নি। উনি খুব দ্রুতই প্রস্থান করেছিলেন বাসা থেকে। মা-ভাইয়াকে কি বলে মেনেজ করলেন কে জানে? তবে উনার মিথ্যে বলার কৌশল টা ব্যাপক ছিল। এতো নিখুঁতভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে বিষয়টা হ্যান্ডেল করেছেন, যে মা ভাইয়া কিছু বুঝতেও পারেনি। এইজন্য উনাকে একটা ধন্যবাদ তো দেওয়াই যায়। ঈশানকে ধন্যবাদ দেওয়ার কথা ভাবছিলাম। এরই মধ্যে ফোন বেজে উঠল। মোহনা আন্টির নম্বর। একটু অবাক হলাম। অবাক হয়েই রিসিভ করলাম ফোন। আমি কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে আন্টি উচ্চারণ করলেন,
তারিন! কেমন আছো?
জি আন্টি ভালো। আপনি ভালো আছেন?
ভালো আর থাকলাম কই বলো! ছেলেটা যা শুরু করেছে।
কেনো আন্টি? ঈশান ভাইয়ার কথা বলছেন?
হুম। হুটহাট প্ল্যান করে ফ্রেন্ড দের নিয়ে ট্যুরে যাচ্ছে। বান্দরবান। হোটেলও বুক করে ফেলেছে। আর আমি কিছুই জানিনা। আজ সকালে জানতে পেরে তো আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পরেছে।
বান্দরবান ট্যুরে যাচ্ছেন? হঠাৎ এমন পরিকল্পনা কেনো?
সেটাই তো বুঝতে পারছি না মা! কি বাতাস লেগেছে কে জানে? আচ্ছা শোনো, তোমাকে যে কারণে ফোন করেছি। ওই ছেলেটা কি তোমাকে এখনো জ্বালায়?
ক কোন ছেলে আন্টি?
আরে ওইযে, পার্টির ওই অসভ্যটা।
না আন্টি। এখন আর তেমন প্রবলেম করে না।
হুম। কিন্তু করলেও তুমি একদম ভয় পাবেনা। শুধু তোমার এই মোহনা আন্টির কথা একবার মনে করবে।সাথে সাথে আমাকে ফোন করবে। তারপর আমিই ব্যবস্থা করবো। কত ধানে কত চাল বুঝিয়ে দিবো শালাকে। আমার একটা পরিচিত গ্যাং আছে বুঝেছো তারিন? ওদের কাছে গিয়ে কিছু পয়সা খসালেই কাজ হয়ে যাবে। এমন টাইড দিবে, জীবনে আর কোনো মেয়েকে অসম্মান করা তো দূরে থাক। প্রতিটা মেয়েকে বোনের চোখে দেখবে। তোমার ধারে কাছে ঘেষারও আর সাহস পাবে না। বুঝতে পারছো আমি কি বলছি?
জি আন্টি। বুঝতে পারছি।
ওই ছেলে আর কিছু করলে তৎক্ষণাৎ আমাকে জানাবে। মনে থাকবে?
জী আন্টি। মনে থাকবে।
হুম। গুড গার্ল। মিষ্টি একটা মেয়ে। আমার এই মিষ্টি মামনিটাকে যে এইভাবে জ্বালায়! তাকে আমি ছেড়ে দিবো ভেবেছো? ওই বদের আসলে একটা শিক্ষা প্রাপ্য।। আচ্ছা তারিন? তুমি কি ওই ছেলেটার নাম- ঠিকানা কিছু জানতে পেরেছো?
জি না আন্টি। সেরকম কিছু তো জানতে পারিনি।
জানতে পারলে ভালো হতো। আমি নিশ্চিত লো ক্লাস ফ্যামিলির কোনো ছেলে হবে। পারিবারিক শিক্ষার অভাবে এই হাল হয়েছে। ছেলের মাকে পেলে না, আমি সবার আগে জিজ্ঞেস করতাম। কিভাবে মানুষ করে এসব ছেলেদের? একেকটা কুলাঙ্গার পয়দা করে সমাজে ছেড়ে দেয়। এসব মা-বাবাকে আসলে সন্তান মানুষ করা শিখিয়ে দেওয়া উচিৎ। মা-বাবার শাসন থাকলে ছেলেমেয়ে এমন হয় বলো? কই আমার ঈশান তো কখনো কোনো মেয়েকে অসম্মান করেনি। তুমি বিশ্বাস করবে না তারিন! এ যুগের ছেলে হয়েও আমার ঈশান আজ পর্যন্ত একটা রিলেশনও করেনি, ২৪ বছর হতে চলল ছেলেটার। আর আজকালকের ছেলেমেয়েরা তো এ বি সি ডি শেখার আগেই প্রেম করা শিখে যায়। কিন্তু আমার ঈশান? সেই তুলনায় যথেষ্ট ভালো। এই যুগের তুলনায় তো হাজার গুণে ভালো। নিজের ছেলে বলে বাড়িয়ে বলছি না। তুমি তো নিজেই দেখেছো। আর নিহার কাছেও নিশ্চয়ই শুনেছো? আমি কি একটুও বাড়িয়ে বলছি?
না আন্টি। একদমই বাড়িয়ে বলছেন না। ঈশান ভাইয়া তো আসলেই খুব ভালো মানুষ।
হুম! এভাবেই মানুষ করেছি ছেলেকে। চ্যারিটি, ম্যানার্স সবই শিখিয়েছি। ঈশান সব আমার গুণ পেয়েছে। আচ্ছা শোনো তারিন, এখন রাখছি হুম? ঈশানকে বিদায় দিতে হবে। ব্যাগপ্যাক করে সব গুছিয়ে ওয়েট করছে হয়তো আমার জন্য। তুমি বাসায় এসো মা?
জী আন্টি। আপনিও আসবেন একদিন আমাদের বাসায়। ঘুরে যাবেন। সত্যি খুব ভালো লাগবে।
মোহনা আন্টি হাসলেন। বললেন,
ঠিকাছে মা! অবশ্যই আসবো। রাখি তাহলে? বায়।
জি আন্টি। আল্লাহ হাফেজ।
আমি ফোনটা কেটে দিলাম। মোহনা আন্টির জন্য মায়া লাগছে। এতো বড় মুখ করে ছেলের গুণগান করলেন। কিন্তু যখন জানতে পারবেন, উনার আদরের ছেলেই নাটের গুরু! তখন কি করবেন আল্লাহ মালুম। অতিরিক্ত শকে স্ট্রোক না করলেই হলো। ছাদের উপর ঠক ঠক শব্দটা বেড়েই চলেছে। কি এমন হচ্ছে জানা দরকার। আমি ওরনাটা গলায় জড়িয়ে ছাদের দিকে পা বাড়ালাম। চিলেকোঠার ঘরটা মেরামতের কাজ চলছে। কিন্তু হঠাৎ এসব কেন? তাও আবার সকাল সকাল? কৌতুহল মেটাতে ছুটে গেলাম রান্নাঘরে। মায়ের কাছে। মা চুলার পাশে দাড়িয়ে সবজি কাটছিলেন। আমি মায়ের পাশে গিয়ে দাড়ালাম। বললাম,
মা? ছাদে এসব কি হচ্ছে?
কি হচ্ছে?
ঘর মেরামত করানো হচ্ছে হঠাৎ?
ভাড়া দিবো তাই। আজকে নতুন ভাড়াটে আসবে।
মানে?? কাকে ভাড়া দিয়েছো ঘর?
কাকে আবার? তোর স্যারকে! কোচিং এর ম্যাথ স্যার!
মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল আমার। মোহনা আন্টির বলা কথা গুলো এবার বুঝতে পারছি। বান্দরবানে ট্যুর দেওয়া তো শুধু একটা বাহানামাত্র। ভদ্রম্যান আসলে ভদ্রতার সহিত তার মায়ের সাথে মিথ্যে কথা বলে আমাদের বাড়িতে আসছে। এবার কি হবে? পেছন থেকে বুড়ির কণ্ঠ শুনে ঘুরে তাকালাম। দুই হাত কোমরে গুজে বুড়িটা বলছে,
পোলারে এমনে এমনে বেশিদিন বাসায় রাহন যাইবো না। মাইনসে আ- কথা কু- কথা কইবো। তার চেয়ে যত দ্রুত সম্ভব বিয়াডা আগে সারতে হইবো। তারিফের লগে আলাপ টা পারসিলা?
বুড়ির কথা শুনে আমি বিস্মিতচোখে তাকালাম। মা সবজি কাটা বাদ দিয়ে আপত্তিকর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। আমার সামনে বুড়ি এই কথাটা বলুক, এটা হয়তো চায়নি মা। তার মানে আমার দৃষ্টির অগোচরে আসলে অনেক কিছুই হচ্ছে। আর আমি তো ঘুমিয়ে আছি। ভাইয়াও কি বিয়েতে মত দিয়ে দিলেন? মা বুড়িকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,
আমি তারিফের সাথে পরে কথা বলবো মা। তারু? তুই ঘরে যা এখন।
এই মুহুর্তে মাকে অনেক কিছুই বলতে ইচ্ছে করছে আমার। বিষয়টা মহামারী আকার ধারণ করার আগেই সব আটকাতে হবে। প্রয়োজনে মায়ের কাছে সত্যিটা স্বীকার করে নিবো। তাও ভালো।কিন্তু বুড়ির সামনে কিছু বলা যাচ্ছে না। মাকে একলা পেলে সবটা বুঝিয়ে বলতে হবে। এই কথা মাথায় রেখেই টলমল চোখ নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসলাম। ঘরে গিয়ে ধপ করে বিছানায় বসতেই ফোনটা বেজে উঠল তীক্ষ্ণ শব্দে। আমি ফোন হাতে নিলাম। নিহার ফোন। রিসিভ করে ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে উচ্চারণ করলাম,
হ্যালো।
কেমন আছিস?
ভালো। তুই?
আমি তো ভালোই আছি দোস্ত! তুই খবর পেয়েছিস?
কিসের খবর?
ঈশান ভাইয়া তো কিছুদিনের জন্য ঢাকার বাহিরে যাচ্ছে। ট্রিপে। তোকে বলেনি?
তুই ভুল জানিস। উনি কোনো ট্রিপে যাচ্ছে না। আমাদের বাসায় উপরতলার ভাড়াটে হয়ে আসছেন।
কি??
.
.
ছাদের কার্নিশে হাত রেখে দাড়িয়ে আছি আমি। পেছনে মা আর ভাইয়া ঈশানের সাথে কথা বলছেন। পাশের বাড়ির বুয়া বাসন্তী খালা এসেছেন ঘরটা পরিষ্কার করার জন্য। উনি ডেটল দিয়ে সম্পুর্ন ঘর ধোয়ামোছার কাজ করছেন। আমি দাড়িয়ে দেখছি, মা, ভাইয়া আর ঈশানের আলাপ শুনছি। ভাইয়া ঈশানের কাধে হাত ঠেকিয়ে বলছেন,
দেখো ভাই। তুমি নিজের বাড়ি মনে করে যতদিন ইচ্ছে থাকতে পারো এখানে। তুমি না আসলে কিন্তু এই ঘরটা আমরা কখনো ভাড়া দিতাম না। তাই তোমার জন্য নির্দিষ্ট কোনো অ্যামাউন্ট ফিক্সড করলাম না। তোমার সুবিধামতো তুমি ভাড়া দিবে। কোনো সমস্যা নেই।
মা বললেন, হ্যা বাবা। আর খাওয়া দাওয়ার বিষয় নিয়ে একদম সংকোচ করবে না। আজ থেকে আমাদের পরিবারের তুমিও একজন। তাই নিজের মায়ের মতো নিঃসংকোচে যখন যেটা লাগবে আমাকে জানাবে।
ভাইয়া বললেন, আর আমি ভাইয়ের মতো। কোনো সাহায্য লাগলে বলবে।
ঈশান বললেন, আন্টি, আপনাদের অনেক ধন্যবাদ। আসলে একা বাসায় থেকে থেকে একাকিত্বের প্রতি বিতৃষ্ণা চলে এসেছিল। এখানে এসে তাও একটা ফ্যামিলি পেয়েছি। এটা ভেবেই সবথেকে বেশি ভালো লাগছে।
মা বললেন, তোমার মাকে কিন্তু আমার সালাম জানিও। আর এটাও বল, এখন থেকে একটা নতুন মা পেয়েছো। উনার ছেলের দায়িত্ব আমার উপর ছেড়ে দিয়ে উনি যেন নিশ্চিন্তে থাকেন।
ঈশান বললেন, মা জানলে আসলেই খুব খুশি হবেন।
তারিফ ভাইয়া ঈশানের পিঠ চাপড়ে বললেন, তাহলে তুমি এখন রেস্ট নাও? আমরা আসছি। সন্ধ্যায় নিচে এসো। আড্ডা হবে।
ঈশান উত্তরে একটা হাসি দিল। মা আর ভাইয়া চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর বাসন্তী খালাও কাজ শেষ করে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় বলে গেলেন, ঘর শুকানোর জন্য পাচ দশমিনিটের মতো অপেক্ষা করতে। বর্তমানে আমি আর ঈশান ছাড়া ছাদে কেউ নেই। আমি ঈশানের দিকে ঘুরে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাড়ালাম। উনি আগে থেকেই আমার দিকে ঘুরে আমার বরাবর সামনের দেয়াল ঘেষে দাড়িয়ে আছেন। আমি ভ্রু নাচিয়ে তাকালাম ঈশানের দিকে। উনি মুচকি হাসলেন। আমি এবার উনার কাছে গিয়ে দাড়ালাম। বললাম,
আচ্ছা? মিথ্যে বলার সময়, মানুষের তো একটু হলেও ভোকাল কর্ড কাপে। আপনার কি তাও হয়না? আপনি কি দিয়ে তৈরি?
উনি সায় দিলেন না। আশেপাশে তাকিয়ে উত্তর রেডি করছেন। এই সুযোগে আমি আরেকবার বললাম,
কৌশলে মিথ্যে বলার জন্য যদি কোনো খেতাব থাকতো, তাহলে সেই খেতাবে আমি আপনাকেই ভুষিত করতাম সন্দেহ নেই। আপনি আমার দেখা সর্বশ্রেষ্ঠ মিথ্যেবাদী। কিভাবে পারেন এতো সাজিয়ে গুছিয়ে মিথ্যে বলতে? ছোটবেলায় প্রশিক্ষণ নিয়ে মিথ্যে বলা শিখেছিলেন বুঝি? আচ্ছা আপনি একটা কাজ করুন না? মিথ্যেবাদীদের জন্য একটা ট্রেনিং সেন্টার খুলে বসুন। নাম হবে ” মিথ্যে বলার তালিম কেন্দ্র”। আর আপনি হবেন মিথ্যেবাদীদের মধ্যপন্থী।
বলতে বলতে ঈশানের দিকে আঙুল তাক করলাম আমি। উনি খপ করে আমার আঙুলটা ধরে ফেললেন। সোজা হয়ে দাড়িয়ে আমার দিকে সরু চোখে তাকালেন। বললেন,
যার জন্য মিথ্যে বলি সেইই বলে মিথ্যেবাদী?
পেছন থেকে গুণ গুণ আওয়াজ শোনা গেল। “বোঝেনা হেতে বোঝেনা। কিল্লাই বোঝেনা??” উদ্ভট কন্ঠের গানের আওয়াজ শুনে পেছন ফিরে তাকালাম আমি। বুড়িটা ছাদে কাপড় নিতে এসে গান গাইছে।মাঝে মাঝে আমার আর ঈশানের দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে। তারপর আবার গুণগুণিয়ে বলছে, বোঝেনা, বোঝেনা হেতে বোঝেনা”!
ঈশান ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলেন, কে উনি?
আমি কটমট চোখে ঈশানের দিকে তাকালাম। আর বললাম,
শুনুন! আপনি না, এই বুড়িটাকে লাফিং গ্যাস খাইয়ে দিন প্লিজ!
🍂
চলবে