#তি_আমো❤
Writer: Sidratul muntaz
পর্ব- ৮
🍂
বেসিনে দাড়িয়ে দাতব্রাশ করছি। মা আমার আশেপাশেই ঘুরাঘুরি করছে। কালরাতে মা আর বুড়ির আলাপের শেষ সিদ্ধান্ত কি ছিল জানা হয়নি। জানতে চাওয়ার দুঃসাহসও দেখাইনি। তবে মনে হচ্ছে ঈশানকে বাসায় দাওয়াত করার ভুতটা মায়ের মাথা থেকে বিদায় হয়েছে। তাই এই নিয়ে আর কিছু বলে নি মা আমায়। নাহলে তো এতোক্ষণে কান কামড়ে খেতো স্যারের বাসার ঠিকানা চাইতে চাইতে। যাক, ভালোই হয়েছে। আমি মুখ ধুয়ে নাস্তা খেতে বসলাম। শক্ত শক্ত রুটি চিবাচ্ছি। অবশ্য শুক্রবারে শক্ত রুটি ছাড়া কপালে ভালো কিছু জোটে না। এটাও আমার নিজের দোষ। বেলা বারোটায় ঘুম থেকে উঠেও যে নাশতা খেতে পারছি, এইতো অনেক। মা হঠাৎ টেবিলে আমার পাশে এসে বসলেন। মুখটা মলিন করে বললেন,
শোন না মা! তারিফকে একটা মেসেজ পাঠাতে পারবি?
ভাইয়াকে মেসেজ? কেনো? কি হয়েছে ভাইয়ার?
আরে সেই ভোরবেলা বেরিয়েছে। কি বলে জরুরি কাজ ছিল। এখন যে রাস্তা দিয়ে ফিরবে ওই রাস্তায় নাকি এক্সিডেন্টের কারণে বড় গাড়ি চলা বন্ধ। বাস, ট্রাক কিচ্ছু পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু রিকশা আর কয়েকটা সি এন জি চলে। এখন এতোটা পথ কি রিকশায় আসা সম্ভব? আর সি এন জি তে উঠার মতো ভাড়াও নাকি নেই ছেলেটার কাছে। কি একটা অবস্থা বল তো?
এখন কি তাহলে বিকাশে টাকা পাঠাবে?
হ্যা সেজন্যই ফোন করছি। কিন্তু নেটওয়ার্ক বিজি। তাই মেসেজ পাঠিয়ে একটু জিজ্ঞেস কর তো, বিকাশে টাকা পাঠালে তুলতে পারবে কিনা?
মা আমার দিকে ফোন এগিয়ে দিল। আমি ফোনটা হাতে নিয়ে বললাম,
আচ্ছা দাড়াও, আমি আরেকবার ফোন করে দেখি। তারপর মেসেজ দিবো।
আমি ফোনই করতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু ডায়াল লিস্টে ঢোকার আগেই তীক্ষ্ণ হর্নের শব্দ কানে আসলো। শব্দের উৎস বরাবর আমি আর মা সদর দরজার দিকে তাকালাম। বড় একটা গাড়ি দাড়িয়ে আছে। সেই গাড়ি থেকে নামছে ভাইয়া। আমি টেবিল ছেড়ে উঠে দাড়ালাম। ভাইয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। মাও আমাকে অনুসরণ করে আসলেন। ভাইয়াকে এমন গাড়িতে দেখে প্রথমেই একটু হকচকিত হলাম আমি। তার থেকেও বেশি অবাক হলাম, যখন আবিষ্কার করলাম গাড়ির মালিক ঈশান।ঈশানকে ভাইয়ার সাথে নামতে দেখে আক্কেল গুড়ুম অবস্থা আমার। হা করে তাকিয়ে আছি। ভাইয়া প্রীতিকর হাসি দিয়ে ঈশানকে বলছেন,
ভেতরে আসলে খুশি হতাম। প্লিজ এসো একবার?
ঈশানের মুখ দেখে মনে হচ্ছে সেও যথেষ্ট বিস্মিত। তারিফ ভাইয়া যে আমার বড়ভাই, এটা হয়তো ঈশান জানতেন না। আর এখন জানতে পেরেই বিস্ময় প্রকাশ করছেন। মা হঠাৎ উচ্চারণ করলেন,
তারিফ, ছেলেটা কি তোর পরিচিত।
হ্যা মা। বলতে পারো আমার বন্ধু। বিপদের বন্ধু। মাঝরাস্তা থেকে নিজের গাড়িতে তুলে বাসা পর্যন্ত পৌছে দিল। তুমি যে কি উপকার করেছো ভাই? তোমাকে আজ লাঞ্চ ট্রিট না দিতে পারলে আমার মন শান্ত হবে না।
তারিফ ভাইয়া বড় করে হাসলেন। ঈশান জোর পুর্বক হাসার চেষ্টা করে ইতস্তত গলায় বললেন,
থ্যাঙ্কস। কিন্তু আজকে মনে হয় তোমার কথাটা আমি রাখতে পারবো না। তবে নেক্সট টাইম অবশ্যই আসবো।
মা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, না। কোনো নেক্সট টাইম না। তুমি সবসময় একই কথা বলো। এবার আর তোমার কথা শুনব না। ভেতরে এসো বাবা।
তারিফ ভাইয়া ভ্রু কুচকে তাকালেন, সবসময় একই কথা বলে মানে? মা তুমি কি ওকে চেনো নাকি?
মা চোখ বড় করে হাসলেন। আর বললেন,
চিনি না মানে? ওইই তো তারুর কোচিং এর স্যার। আমাদের এলাকাতেই তো থাকে। সামনের গলিতে। সেদিন তারুকে বাসায় পৌছে দিল৷ তোকে বলেছিলাম না?
ভাইয়া আরো একটু ভ্রু কুচকে আমার দিকে তাকালেন। আমি মাথা নিচু করে রেখেছি। ঈশান ভাইয়াও যথেষ্ট অপ্রস্তুত বোধ করছেন। ভাইয়া কি একটা মনে করে ঈশান ভাইয়ার কাধে হাত রাখলেন। আরেকবার মুখে অমায়িক হাসি এনে বললেন,
এবার তো তোমাকে ছাড়ার প্রশ্নই আসছে না। বাসায় তোমাকে ঢুকতেই হবে। আমার বোনের স্যার বলে কথা! সম্মান আরেকটু বেড়ে গেলো। চলো ভেতরে গিয়ে কথা বলি।
মা উৎসাহ নিয়ে বললেন,
হ্যা এসো বাবা। তুমি আমার ছেলেমেয়ে দুজনেরই উপকার করেছো। তোমার কাছে তো আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। একবেলা নিজ হাতে রান্না করে না খাওয়াতে পারলে তারিফের মতো আমিও মনে শান্তি পাবো না। ভিতরে চলো।
ঈশান যথেষ্ট দ্বিধা নিয়েই ভেতরে ঢুকলেন। আর আমি দুশ্চিন্তায় মরে যাচ্ছি। ভেতরে গিয়ে আর কি কি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় কে জানে?
.
.
বসার ঘরে আড্ডা দিচ্ছে ঈশান আর ভাইয়া। মা আমার হাতে ট্রে ধরিয়ে দিলেন। ট্রে তে শরবত আর কিছু মিষ্টি। ঈশানদের কাছে নিয়ে যেতে বললেন। আমি পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকেই ঈশানের দিকে তাকালাম। উনার ঠোটের সেই কাটাচামচের আঘাতটা এখনো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। আর এই আচড় টা যেন উনার কিউটনেসের পরিমাণ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। আমি ট্রে টা টেবিলে রাখলাম। ভাইয়া আমায় জিজ্ঞেস করলেন,
মা কোথায় রে?
রান্নাঘরে।
আচ্ছা ঠিকাছে তুই যা। মাকে আসতে বলিস।
ভাইয়ার শেষ কথাটা শুনে আমার বুকের ভেতর কেমন জানি ধুকপুক করছে। আমি রান্নাঘরে ঢুকে মায়ের কাছে ভাইয়ার বার্তা পৌছে দিলাম। মা আমাকে চুলায় বসানো মাংসের হাড়িতে নজর রাখতে বলে ড্রয়িং রুমের দিকে ছুটলেন। এদিকে আমার মনও রান্নাঘরে টিকছে না। ওদিকটায় কি নিয়ে আলাপ হচ্ছে সেটা না জানতে পারলে অস্থিরতা কমবে না। শেষমেষ মিথ্যে বলার জন্য ধরা পড়ে যাবো না তো? ঈশান যদি মুখ ফসকে কিছু বলে দেয় তাহলেই যে শুরু হবে এলাহী কান্ড। তার উপর বুড়িটা যদি একবার জানতে পারে সেদিন আমি কোচিং এ না গিয়ে পার্টিতে গিয়েছিলাম, তাহলে তো কালবৈশাখী শুরু হবে। মায়ের সাথে সাজিয়ে গুছিয়ে মিথ্যে বলার জন্য মাও আমায় আস্তো ছাড়বে না। উফফ,, টেনশনে টেনশনে মাথা ধরে আসছে। আমি আর দাড়িয়ে থাকলাম না। গুটি গুটি পায়ে হেটে বসার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। পর্দার আড়ালে দাড়িয়ে আছি। এক কথায় আড়ি পাতছি। মায়ের গলার আওয়াজ ভেসে আসল,
আচ্ছা ঈশান! তুমি যে বাসায় একা থাকো, তোমার খাওয়া দাওয়া নিয়ে কোনো অসুবিধা হয়না?
তারিফ ভাইয়া বললেন, ঈশান বাসায় একা থাকে? তোমাকে এই কথা কে বলল?
কেনো তারিন বলেছে। ওর বাবা-মা তো মফস্বলে থাকে। আর ও লেখাপড়ার জন্য এইখানে একা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে। কি ঈশান? ঠিক তো?
ঈশান সংকীর্ণ গলায় বললেন, হ্যা। ঠিক।
তারিফ ভাই বললেন, তাহলে তুমি যে তখন ফোনে মায়ের সাথে কথা বলছিলে। জলদি বাসায় ফেরার কথাই তো বলছিলে। সেটা কি ছিল?
হ্যা। আমি বাড়ি ফেরার কথাই বলছিলাম। মফস্বলে।
ও! কোথায় তোমার বাড়ি? কোন জেলায়?
ঈশান আমতা আমতা করে বললেন, তারিন.. যেখানে বলেছে। সেখানেই।
তারিফ ভাই বললেন, তারিন কোনখানে বলেছে?
মা বললেন, তারিন তো জায়গার নাম বলেনি।
ঈশান দ্রুত গলায় বললেন, ও বলেনি? কিশোরগঞ্জ। আমার বাড়ি কিশোরগঞ্জ।
তারিফ ভাই বললেন, আচ্ছা! তা এখান থেকে বেরিয়ে কি তুমি কিশোরগঞ্জ যাবে?
ঈশান বললেন, হ্যা। প্রত্যেক শুক্রবারেই যাই আর কি। মা বাবার সাথে দেখা করতে।
মা বললেন, এতোটা দুর প্রতি সপ্তাহে যাওয়া আসা করো? খুব কষ্ট হয়ে যায়না?
তারিফ ভাই বললেন, কষ্টের কি আছে? গাড়ি নিয়ে যায়। তাই হয়তো প্রবলেম হয়না।
মা দ্বিধান্বিত স্বরে বললেন, তোমার নিজের গাড়ি?
ঈশান বললেন, জি? না। আমার নিজের গাড়ি না। গাড়িটা আসলে আমার ফ্রেন্ডের।
তারিফ ভাই বললেন, তোমার ফ্রেন্ডের গাড়ি তুমি চালাও?
ঈশান অনেক বিভ্রান্তি নিয়ে বললেন, হ্যা… আসলে শুধু কোচিং আর টিউশনির টাকায় আমার পোষায় না। দিনশেষে কোনো সেভিংস থাকে না তো!তাই একটু এক্সট্রা ইনকাম সোর্স হিসেবে উবার ড্রাইভিং করি। ফ্রেন্ডের সাপোর্টে।
তারিফ ভাই ঈশানের কাধে হাত রেখে বললেন, ও। তুমি উবার ড্রাইভার? তাহলে তো আমি আজকে তোমার বিরাট লস করে দিলাম ভাই! আমার জন্য তুমি যাত্রী পেলে না।
ঈশান বললেন, না ইটস ওকে। এটা সমস্যা না।
মা বললেন, আহারে। সত্যিই তোমাকে দেখে আমার অবাক লাগছে। লেখাপড়ার পাশাপাশি এতো কষ্ট কিভাবে করো? আচ্ছা বাবা শোনো তোমাকে একটা অনুরোধ করি।
ঈশান বললেন, জি আন্টি।
মা বললেন, তুমি যদি চাও, তাহলে কিন্তু আমাদের বাসাতেই থাকতে পারো। আমাদের ছাদের উপরে একটা ছোট ঘর খালি আছে। তুমি সেখানে থাকলে আমাদের খুব ভালো লাগবে। খাওয়া দাওয়াটাও না হয় আমাদের সাথেই করলে? নিজের পরিবারের মতো? আর তারিনের জন্যও বাসায় একটা টিচার দরকার।
তারিফ ভাই বললেন, মা তুমি একদম ঠিক বলেছো। ঈশান, প্লিজ তুমি আমাদের সাথে থাকো। এইটা খুব ভালো হয়। তোমারও প্রয়োজন মিটবে, আর আমাদেরও।
ঈশানের উত্তর শোনার আগেই আমি দৌড়ে রান্নাঘরে চলে আসলাম। বেচারা আমার জন্য এইভাবে ফেসে গেল। এখন ইচ্ছে করছে কচু গাছের সাথে গিয়ে নিজের গলায় ফাস লাগাতে। ধুর! একটা মিথ্যাকে ঢাকতে আরো কত শত মিথ্যার জন্ম দিতে হচ্ছে। এই ঘটনাটা একবার শেষ হয়ে যাক, তারপর আর জীবনে মিথ্যা বলবো না।
🍂
চলবে