তি আমো পর্ব-০১

0
2472

#তি_আমো❤
সূচনা পর্ব
Writer: Sidratul muntaz

🍂
শরীরে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে কেপে উঠলাম আমি। ভ্রু কুচকে আয়নার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করতে যাবো, তার আগেই মুখ চেপে ধরা হল আমার। ছটফট করতে করতে নিজেকে মুক্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছি, কিন্তু কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। বরং নিজেই হাপিয়ে উঠছি। অপরিচিত মানুষটা আমার লেহেঙ্গার ওরনা খুলে নিয়ে আমার মুখ বেধে ফেলল। ঘটনাগুলো এতো দ্রুত ঘটছে যে আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই আমাকে উচু করে ধরে হাটতে লাগলেন উনি। আমি শুধু গোঙাতে পারছি আর নড়চড়া করতে পারছি, এর বেশি কিছুই সম্ভব হচ্ছে না। হঠাৎই নিজেকে একটা অচেনা রুমে আবিষ্কার করলাম। যতটুকু বুঝলাম এটা এই কমিউনিটি সেন্টারের মেকআপ রুম। যেখানে কিছুক্ষণ আগেও মেয়েদের ভীড় জমে ছিল। এখন এই রুমটা সম্পুর্ন নিস্তব্ধ নিরব। ছেলেটার চেহারা দেখার সৌভাগ্য আমার হলো না। তার আগেই পুরো ঘর অন্ধকারে ছেয়ে গেলো। পায়ে কারো হাতের স্পর্শ পাচ্ছি। কি হবে আজ আমার?? কি করতে চাইছে এই ছেলেটা আমার সাথে? ভয়ে যখন বুকের ভিতর ভুমিকম্প শুরু হয়ে গেছে ঠিক তখনি কপালে কারো ঠোটের স্পর্শ পেলাম। সঙ্গে সঙ্গে আরো একবার কেপে উঠলাম আমি। তার কয়েক মিনিট পরেই জ্বলে উঠল লাইট। আশেপাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না এখন। ঠান্ডা বরফ শীতল এসি রুমে বসে থেকেও কপাল দিয়ে অঝোরে ঘাম বের হচ্ছে আমার। ঠোট কাপছে সেই সাথে হাত পায়ের এক্সট্রা কাপুনি তো আছেই। কোনোমতে মুখের কাছে হাতটা এনে ওরনাটা মুখ থেকে খুলে নিলাম আমি। আর তারপরেই চিৎকার শুরু, যাকে বলে আকাশ চুম্বী চিৎকার।

আমার নাম আশফীয়া তারিন। বান্ধবীর অ্যাংগেইজমেন্ট পার্টিতে এটেন্ড করার মহান উদ্দেশ্য নিয়ে ভাইয়ার চোখ ফাকি দিয়ে এসেছিলাম এই আলিশান কমিউনিটি সেন্টারে। ভাইয়াকে বলেছিলাম তিন ঘণ্টার কোচিং ক্লাস আছে। ব্যাগে বই খাতার বদলে লেহেঙ্গা আর সাজগোজের জিনিস ভরে এনেছিলাম, ভাইয়ার চোখ ফাকি দেওয়ার কি দুর্দান্ত কৌশল আমার! এখন নিজের আপন বড়ভাইকে ঠকানোর পরিণামটা হারে হারে টের পাচ্ছি। কি ভয়ানক পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হচ্ছে আমায়। এখনো যে জ্ঞানটা হারাইনি এইতো অনেক বেশি।

জ্ঞান হারানোর প্রয়োজনও হল না। অলরেডি আমার চিল্লাচিল্লির অত্যাচারে মেকআপ রুমে ভীড় জমে গেছে। নিহা দ্রুতবেগে এসে আমার হাত চেপে ধরল। অস্থির গলায় আমার ঘাম মুছে দিতে দিতে বলল,

কিরে তারু। তোর এ অবস্থা কেনো? কি হয়েছে, ভয় পেয়েছিস?

আমি লাল টুকটুকে চোখ করে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি আর ঢোক গিলছি। নিহা আমায় আরেকবার ধাক্কা দিল। ধাক্কা দিয়ে বলল,

এই তারু কথা বলছিস না কেনো? কি হয়েছে বলবি তো? ওইভাবে চিৎকার করছিলি কেনো?

আমি এবার নিহার দিকে ঘুরে বসলাম। নিহার দুই হাত চেপে ধরে কাপা কাপা কণ্ঠে উচ্চারণ করলাম,

দোস্ত একটা ছেলে। একটা ছেলে এসেছিল। আমাকে জোর করে এখানে তুলে এনেছে। দোস্ত আমি ওয়াশরুমে গিয়েছিলাম হাত ধুতে। তখনি পেছন থেকে কেউ একজন আমার মুখ বেধে আমাকে এইখানে তুলে এনেছে। তারপর ঘরের লাইট অফ করে আমার সাথে….

কথা শেষ না করেই মুখ চেপে কেদে দিলাম আমি। সবার দৃষ্টি এখন আমার দিকে স্থির। কেউ ভ্রু কুচকে তাকিয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছে, কেউবা হাসি তামাশা করছে, কেউ আবার শান্তনা দিতে আমার কাছে এসে কাধে হাত বুলাচ্ছে। কিন্তু আপাতত এসব কিছুতেই আমার যায় আসছে না। আমি শুধু এখন বাড়ি ফিরতে চাই। আর কোনো দুর্ঘটনা হওয়ার আগেই বাড়ি ফিরতে চাই। নিহা হয়তো আমার অস্বস্তির কারণটা আন্দাজ করতে পেরেছে। তাই নিজ দায়িত্বে সবাইকে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে বলল সে। একে একে সবাই ঘর খালি করে চলে গেল। নিহা এবার আমার দিকে মনোযোগী হল–

শোন তারু, তুই একদম ভয় পাবি না। তুই শুধু আমাকে ছেলেটার বর্ণনা দিতে পারবি? কে করেছে এমন শুধু একটা ক্লু দে তারপর আমি খুজে বের করছি।

নিহা, আমি না ছেলেটার চেহারা দেখতে পারিনি। তবে আয়নাতে হাত দেখেছিলাম। আর হাতে একটা ঘড়ি পড়া ছিল। একটা এ্যাশ কালার ঘড়ি।

এ্যাশ কালার ঘড়ি তো অনেকেই পড়ে। এখন কিভাবে বুঝবো কে?

দোস্ত হাতটাও ভালোমতো দেখেছি। খুব ফরসা হাত। আর অল্প অল্প লোম আছে। হাতের রগ গুলো কেমন ফোলা ফোলা, জিম করলে যেমন হয়না? সেরকম টাইপ।

রগ ফুলে থাকে? অল্প লোম? ফরসা হাত? এমন তো একজনই আছে।

কে?

আচ্ছা তুই আরেকবার দেখলে চিনতে পারবি।

আমি মাথা দুলিয়ে উত্তর দিলাম,

হ্যা পারবো।

নিহা আমার হাত ধরে উঠে দাড়ালো,

চল তাহলে। আগে সাফিনকে জানাতে হবে ব্যাপারটা।

আমি নিহার সাথে চলতে গিয়েও থেমে গেলাম হঠাৎ। নিহার হাত শক্ত করে চেপে ধরে বললাম,

নিহা, থাক দরকার নেই দোস্ত।

নিহা বিস্ফোরিত চোখে বলল,

কেনো দরকার নেই কেনো? তুই কি ভয় পাচ্ছিস নাকি?

না সেইজন্য না। দেখ, আজকে তোর আর সাফিন ভাইয়ার এ্যাংগেইজমেন্ট পার্টি। কত মেমোরেবল একটা দিন। শুধু শুধু সিন ক্রিয়েট করে পরিবেশটা নষ্ট হোক সেটা আমি চাইনা। তার থেকে ভালো তুই আমাকে বাড়ি পৌছে দেওয়ার ব্যবস্থা কর। অলরেডি দুই ঘণ্টা হয়ে গেছে। আর সময়ও নেই হাতে। পরে দেখা যাবে ভাইয়া আমাকে খুজতে কোচিং এ চলে যাবে।

নিহা ভ্রু কুচকে কিছু একটা চিন্তা করে বলল,

না তবুও। কে এই জঘন্য কাজটা করেছে জানা দরকার।

নিহা প্লিজ। বাদ দে। আমার ভালো লাগছে না। আমি বাসায় যেতে চাই।

নিহা আমার কাধে হাত ঠেকিয়ে বলল,

ঠিকাছে চল। আগে কেক কাটার পর্ব শেষ হোক। তারপর আমি তোকে গাড়ি করে পাঠিয়ে দিব।

আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে মাথা নাড়লাম। নিহার হাত ধরে মেকআপ রুম থেকে বের হতেই সামনে পড়ল এক সুদর্শন ছেলে। ছেলেটা বেশ লম্বা, অনেকটা বাশের মতো, চুল গুলো খাড়া খাড়া, অনেকটা ঘাসের মতো, লম্বা দুর্বাঘাস, কিছু চুল কপালের এক সাইডে পড়ে আছে, আবার কিছু চুল খুব সুন্দর গোছালো ভাবে পেছন দিকে আছড়ানো। ডার্ক ব্ল্যাক চুলগুলো লাইটের আলোয় ঝলকানি দিচ্ছে। সেই সাথে ঘন চোখের পাপড়ি গুলোও প্রতিটি পলকে পলকে ঝিলিক দিচ্ছে। সেই ঝিলিকে চিলিক দিয়ে উঠছে আমার হার্টবিটও। গোলাপী ঠোট ভেদ করে ঝকঝকে সাদা দাতগুলো হালকা বেরিয়ে আসল হঠাৎ। সুদর্শন ছেলেটার হাসির দৃশ্য এটা। মুচকি হাসি। নিহাকে উদ্দেশ্য করে ছেলেটা বলে উঠল,

নিহা, সাফিন তোমাকে খুজছে।

বলতে বলতে আড়চোখে আমার দিকে তাকালো ছেলেটা। আমি এখনো ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে আছি। তাই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম খুব দ্রুত।

নিহা বলল,

ওহ। কেক কাটার পর্ব শুরু হয়ে গেছে?

ছেলেটা কিউট করে আবার হাসল,

হ্যা। তুমি যাও, হোল্ড দ্যা নাইফ উইথ হিম। দ্যা মেইন এট্রাকশন হেজ স্টারটেড।

ওকে ওকে। এই তারু চল। আপনিও আসুন ঈশান ভাইয়া।

নিহা আমায় টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে। আমি পেছন ফিরে আরেকবার ছেলেটাকে দেখলাম। ছেলেটা এখনো ঠাই দাড়িয়ে আছে। আমাদের দিকেই দেখছে। আরেকবার চোখাচোখি হল। কিন্তু এবার আমি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম না। নির্লজ্জের মতোই তাকিয়ে রইলাম। একটা ওয়েটার এসে ছেলেটাকে ডাকল। ডিশে করে জুস অফার করছে। ছেলেটা জুস হাতে নিল। আমার নজর এবার ছেলেটার হাতের দিকে আটকালো। আমি আবার থমকে দাড়ালাম। এই হাত তো সেই হাত। সেইম টু সেইম। ফরসা, অল্প অল্প লোম, ফোলা ফোলা রগ, আর এ্যাশ কালার ঘড়ি। মিলে যাচ্ছে, সব মিলে যাচ্ছে! নিহার ধমকে ভাবনার জগৎ ছিন্ন হল আমার,

এই তারু! আবার দাড়িয়ে পড়লি কেনো? চল!

আমি নিহার দিকে চোখ বড় করে তাকালাম। ছেলেটার দিকে আঙুল ইশারা করে বললাম,

নিহা, ওই ছেলেটা…

আমি আর কিছু বলার আগেই নিহা উৎসাহ নিয়ে হেসে দিল। আমার কাধ খামচে ধরে দুষ্টমী ভাব নিয়ে বলল,

ক্রাশ খেয়েছিস?

আমি চোখ সরু বানিয়ে মুখ ভার করে বললাম,

আমি কখন বললাম ক্রাশ খেয়েছি? এই ছেলেটা কে আগে সেটা বল।

আরে তোকে ঈশান ভাইয়ার কথা বলতাম না? ইনিই তো ঈশান। দ্যা ভদ্রম্যান অফ আওয়ার অভদ্র সোসাইটি।

আমি মুখ কুচকে উচ্চারণ করলাম,

ভদ্রম্যান?

হ্যা, জেন্টালম্যান আর কি। আচ্ছা চল এবার আমরা কেক কাটতে যাই দেরি হচ্ছে দোস্ত! তোরই তো দেরি হচ্ছে চল!

আবার আমার হাত ধরে হাটতে লাগল নিহা। আমিও আর কোনো উত্তর দিলাম। না চুপচাপ নিহার সাথে হেটে যেতে লাগলাম। কি যে হচ্ছে, নিজেই কনফিউশনে পড়ে গেছি।

লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশন, নিহা আর সাফিন ভাইয়া একসাথে ছুরি ধরে কেক কাটছে। সবাই ছবি তুলছে আর হৈ হুল্লোড় করছে। হাত তালি দিচ্ছে। আমি অনেকটা দুরে দাড়িয়ে আছি। হৈ চৈ একদমই ভালো লাগছে না। মাথাব্যথা করছে। ধীর পায়ে কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই চেয়ারে বসে থাকা এক সুন্দরী মহিলার সাথে ধাক্কা খেলাম আমি। মহিলা হালকা হেসে আমায় সরি বললেন। অথচ সরি আমার বলা উচিত। কারণ বেখেয়ালি ভাবে হাটছিলাম আমি। তবুও সরিটা এক্সেপ্ট করে মুচকি হেসে বললাম,

নো প্রবলেম আন্টি।

ভদ্রমহিলা আরেকবার হেসে স্টেজের দিকে দৃষ্টি দিলেন। যেখানে কেক কাটা হচ্ছে। আমি ভদ্রমহিলাকে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করলাম। ভদ্রমহিলার পারফিউমের ঘ্রাণ খুবই প্রখর। তবে সুইট স্মেল। আর ভদ্রমহিলা নিজেও খুব সুইট। হালকা পাতলা সিল্কের শাড়ির সাথে স্লিভলেস ব্লাউজ পড়েছেন। ফিগার ফিটনেস ঠিক থাকায় দেখতে খারাপ লাগছে না। বয়সও মনে হয় বেশি হবে না। চুলগুলো ব্রাউনিশ কালার। কার্ল করে ঘাড়ের এক সাইডে ফেলে রেখেছেন। অন্যসাইড খালি। আমার দিকে আরেকবার তাকিয়ে ভদ্রমহিলা বললেন,

তুমি কি বসবে? চাইলে আমার পাশে বসতে পারো জায়গা খালি আছে।

আমার পায়ে টনটন ব্যথা হচ্ছিল তাই মাথা হেলিয়ে বসে পড়লাম। উনি আমাকে নাম জিজ্ঞেস করলেন,

নাম কি তোমার?

আমি বামসাইডের চুলগুলো কানে গুজে বললাম,

আশফীয়া তারিন।

উনি এবার একটু আগ্রহ নিয়ে বললেন,

তুমি কি নিহার বেস্টফ্রেন্ড? একটু আগে চিৎকার করছিলে যে?

আমি ইতস্তত হয়ে গেলাম উনার প্রশ্নে। ব্যাপারটা কিভাবে ছড়িয়ে পড়ছে ধুর! বিছরি হয়ে যাচ্ছে। ভদ্রমহিলা আমার মুখের অবস্থা খেয়াল করে হাসলেন,

ডোন্ট মাইন্ড। এইখানে তো তোমার কোনো দোষ নেই। দোষ তো ওই ছেলেটার। কি পরিমাণ বাজে ছেলে হলে এমন কাজ করতে পারে বলোতো? আসলে শিক্ষা দীক্ষা বলতে কিচ্ছু নেই এদের। ফ্যামিলি প্রবলেম। একটা পার্টিতে এসেও বংশ পরিচয় দেখিয়ে গেল। ডিসগাস্টিং! মা বাবা কিভাবে মানুষ করে এদের? আমার ছেলে হলে আমি ওকে সঙ্গে সঙ্গে দুই চড় ঠাসিয়ে দিতাম। তারপর ত্যায্য করতাম।এমন ছেলে দরকার নেই আমার। যে মেয়েদের সম্মান দিতে জানে না, সে মাকে কি করে সম্মান দিবে?

ভদ্রমহিলার কথার মাঝখানেই ঈশান নামের ছেলেটা চলে আসল। হাতে সেই জুসের গ্লাস। ভদ্রমহিলার দিকে গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বলে উঠল,

মম! ইউর মোস্ট ওয়ান্টেড, এপেল জুস।

ভদ্রমহিলা গ্লাসটা হাতে নিয়ে একটা প্রীতিকর হাসি দিলেন। ছেলেটার গালে হাত রেখে আহ্লাদী কণ্ঠে বললেন,

দেটস মাইবয়। ( অতঃপর উনি আমার দিকে তাকালেন) এইযে তারিন, এইটা আমার ছেলে।

আমি বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি। আমার চমকানোর কারণ দুইটা। প্রথমত এইরকম একজন মহিলার এমন বিশাল সাইজের একটা ছেলে থাকবে আমি ভাবিনি। আর দ্বিতীয়ত,,, ভদ্রম্যান?
🍂
চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে