“তিমির” পর্ব ১৩
সাইকিয়াট্রিস্ট টুকটাক প্রশ্নের পর অবশেষে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কেন জিনিস ভাঙচুর করো?”
“আমি আপনদের ওপর আঘাত করতে চাই না।”
“কেমন আঘাত? আর এই আঘাত তুমি কেন করতে চাও?”
“আমি কেন কাউকে আঘাত করতে যাব?”
“তবে কাল মজিদের গলা চেপে ধরেছিলে কেন?”
“কারণ.. শুনুন, আমি সত্যিই কারও ক্ষতি করতে চাই না। বাবাকে কিছু করব ভেবেও তার পাশে যাই না। মজিদ ভাইকে আমি অনেক সম্মান করি।”
“কেমন? সে তো কাজের লোক।”
“আপনার তা মনে হতে পারে। কিন্তু তিনি আমাদের পরিবারের অংশ।”
মজিদ ভাই এতক্ষণে আমার দিকে তাকালেন। ক্ষমাশীল দৃষ্টিতে, যেন সবকিছুই ভুলে গিয়েছেন।
“তুমি বলেছ তুমি কাউকে আঘাত করতে চাও না…”
“সত্যিই চাই না। আমি এমনটা নই। আমি মায়ের মতো কোমলমনা আর বাবার মতোই… শান্ত। ওসব রাগ, জেদ আমার চরিত্রে নেই। আমার কেবলই মনে হয়, এসব কেউ আমার মাধ্যমে করাচ্ছে।”
“কে করাচ্ছে?”
“আমি জানি না।”
“তোমার চোখের নিচে কালচে হয়ে আছে। রাতে কি ঘুমাও না?”
“না।”
“কেন?”
“আমি দুঃস্বপ্ন দেখি। এক বীভৎস দুর্গন্ধময় লোককে দেখি। স্বপ্নে সে আমায় বারবারই বলে, আমি যাতে সকলকে আঘাত দিয়ে দূরে ঠেলে দেই। এমনটা বললে আমি ওর ওপর আক্রমণ করতে যাই। কিন্তু আমি তার বিরুদ্ধে বেশিক্ষণ লড়তে পারি না। সে জিতে যায়।”
“তোমার কী মনে হয়, বাস্তবে যেসব করছ তা কি ওই লোকটিরই ইশারায়?”
“জানি না।”
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।
গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা
◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।
আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share
“তুমি কি মিষ্টি কিংবা কম ঝাল খাবার পছন্দ কর না?”
আমি তাকে আমার সাদা জিহ্বাটা দেখালাম, “দেখুন, কম ঝালেও পানসে ভাবটা আমি পাই।”
তিনি আমার কম্পমান হাতের দিকে তাকালেন। “এসব বাদ দাও। এটা বলো, তোমার মাইন্ডে এখন কী চলছে?”
সত্যটাই তাকে বললাম, “কেউ যেন বলছে, আমি যাতে আপনাকে লাথি দেই।”
বাকিরা আতঙ্কিত হলেও লোকটি অবাক হলেন, “তোমার হাত-পা আমাকে লাথি দেওয়ার জন্য কাঁপছে। তবে দিচ্ছ না কেন?”
আমি ঠোঁট কামড়ালাম, “কন্ট্রোল করছি। আমি আপনাকে অপছন্দ করি না।”
“ইউ আর সাচ অ্যা স্ট্রং গার্ল।” কথাটি প্রথমবার শুনিনি। মানুষের চেয়ে পঞ্চাশ গুন শক্তিশালী অমানবদের কাছ থেকেও শুনেছি। “তুমি কীভাবে করছ এই কাজটা?”
আমি আর পারছি না। “বাবা, উনাকে এখনই চলে যেতে বলুন।” আমি রাগটার বিরুদ্ধে লড়ার চেষ্টা করছি। আহ্, মাথায় ব্যথা পেলাম, কে যেন আমার মাথার উপর ফুলদানি ভেঙেছে, ব্যথাটা কিছুটা এমন।”
লোকটি হাত দেখিয়ে বাবাকে বলল, “না থাক।”
আমার মস্তিষ্ক লড়তে লড়তে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। কপাল ব্যথা হয়ে গেছে। আমার হাত এখনও কাঁপছে। ওই অসুর শক্তিটি কাঁপাচ্ছে। আমি অবশেষে ভেতরের লোকটির কথাই শুনলাম। সাইকিয়াট্রিস্ট কিছু বলতে যাবে, অমনিই তাকে আমি লাথি মারলাম। তিনি এই ঠেলা সইতে না পেরে আমার মুখোমুখি দেয়ালে গিয়ে ছিটকে পড়লেন। তিনি ব্যথা পেয়েও বাবাকে বললেন, “ইটস ওকে।”
তিনি আবারও আমার কাছে আসতে চাইলে আমি দাঁত বের করে হিসহিস করতে লাগলাম, যেন আমি তাঁকে চিবিয়ে খেতে চাই। আমি এগিয়েও যাচ্ছিলাম। ভাগ্যিস, দুটো লোক দৌড়ে এলো। এর মাঝে বাবাও থাকায় আমার নিজেকে অগত্যা থামাতেই হয়েছে। কিন্তু এই থামানোর কারণেই আমার নিজের মনুষ্য শক্তি লোপ পেল। চেতনা হারিয়ে আমি পড়ে গেলাম….
ঠিক কতক্ষণ আমি ঘুমিয়েছিলাম জানা নেই। তবে সকালে উঠে বড় ঘড়িটায় দেখলাম, দশটা বেজেছে। সম্ভবত একদিন ঘুমিয়েছি! আর আমি বেঁচেও আছি। মনে হচ্ছে মরেই গিয়েছিলাম, পুনরায় জীবন লাভ করেছি। আমার পেট সম্পূর্ণই খালি। মুখে তৃষ্ণা, সেই পানসে ভাব। উঠে ফ্রেশ হয়ে নেই। ফিরে এলে বিছানার পাশে খাবার দেখতে পেলাম। বাবা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে।
“মা, তোমার ভালো লাগছে?” তার পেছনে ধ্রুবও আছে। ওর পরিবারের কেউ সম্ভবত ওর এখানে আসাতে বিরোধ করে না।
“হ্যাঁ।”
আমি খাবার খাওয়ার পরও বাবা একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলেন।
“আজ খাবার কে রান্না করেছে?”
“এগুলো ধ্রুবই রান্না করেছে। হয়েছে তো তোর স্বাদের মতো?”
পারফেক্ট! সে বোধহয় মজিদ ভাইয়ের হাত ধরে ছিল। “হু।”
“জানিস,” বাবা আমাকে খুব আদরের সাথে বললেন, “আসিয়ার খুনিরা ধরা পড়েছে।”
“মাহিন ভাই?”
“কীভাবে জেনেছিস?”
“ইদানীং সন্দেহ হচ্ছে। তিনি কিছুটা মাতাল টাইপ, তারপর ছেলে। আর কে ছিল তার সাথে?”
বাবা বলতে পারলেন না। তবে সুরেলা এক কণ্ঠ শুনলাম, “তোমার ফুফি, আঙ্কেলের চাচাতো বোন। ভেবেছে, আসিয়াকে মেরে ফেললে তার সন্তানদের আঙ্কেল তাঁর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী করবেন।
বাড়িটি বাঁধার সময় তারা প্রায়ই এখানে থাকত। গোপন পথটির সম্বন্ধে তিনিও জানতেন। সম্পদের প্রতি তার লোভ সবসময় ছিল। উপায় না পেয়ে কিছু করেনি। কিন্তু যেই আসিয়ার মা মারা যান, তিনি প্ল্যান আঁটতে শুরু করেছেন, কীভাবে আসিয়াকে সরানো যায়। কিন্তু আসিয়া আগে থেকেই তাদের পছন্দ করত না, মুনতাহার কারণে। আসিয়ার ইচ্ছার কারণেই আঙ্কেল তাদের এখানে আসা-যাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। তারা সুযোগ পাচ্ছিল না। অবশেষে আসিয়ার বার্থডে’তে এবার অনেক গেস্ট দেখে পেয়েছে। ভেবেছে, একবার খুনটা করে লাশ গোপন পথ দিয়ে বাইরে নিয়ে জঙ্গলে ফেলে এলে কেউ খুঁজেও পাবে না। কেসও পড়বে না। কিন্তু তাদের দুর্ভাগ্যক্রমে লাশকে আবির পেয়ে যায়। তারা আসিয়ার বার্থডে অবধি জানতও না, আঙ্কেলের অন্য মেয়ে মানে তুমি ফিরে এসেছ। তারা নির্দিষ্টতই তোমাকেও সরানোর প্ল্যান করেছিল। কিন্তু তোমার অসুস্থতা দেখে ধারণা করেছে তাদের কিছু করার দরকার নেই। এমন সময় গোপন পথের তত্ত্বও বেরিয়ে আসায় তারা ধরা পড়েছে। ব্যস!
আবিরের মতে সেরাত মাহিন আসিয়ার ঘরে লুকিয়ে থেকে মদ খেয়েছিল। সেই বোতল হয়তো গোপন পথ খোলা রেখে ওখানে রাখে। তারপর আসিয়া ঘরে ঢুকেছে। সে অফ করা লাইট আর অন করল না। বসে কাঁদতে লাগল। এমন সময়ই হয়তো আসিয়ার মুখ চেপে ধরে তার খুন করে ওকে গোপন পথে নিয়ে যাওয়া হয়। আসিয়া হয়তো তখনও জীবিত ছিল। লড়ার জন্য সে ওই মদের বোতল ফ্লোরে ফেলেছে কিংবা মাহিনের মাথায় ভেঙেছে। মাহিন অবশ্য ব্যথা পায়নি। এরপর আসিয়ার প্রাণ চলে যায়। তাকে বস্তায় ভরে মাহিন গ্যারেজের কাছে আনে। তার মা হয়তো আগে থেকেই গাড়িতে বসেছিল। ইঙ্গিত পেয়ে তিনি বাঁধাই করা গ্লাসটা সরালেন এবং মাহিন গাড়িতে বস্তাটি ঢোকালে তারা জঙ্গলের দিকে চলে যায়।
এসবের জন্য তারা শাস্তি পেয়েছে। তুমি আর চিন্তা করো না। যা হওয়ার তা হয়েই যায়, কেউ নিয়তিকে পাল্টাতে পারে না। আসিয়া তোমার মনে সবসময় জীবিত থাকবে।”
হু। সে কি মুক্তি পেয়েছে? আমাকে শান্ত দেখে বাবা আমার দিকে এগিয়ে এলেন। তিনি এ কী করছেন!
“বাবা, প্লিজ দূরে থাকুন।” মিনতি করলাম।
বাবা তবু পাশে এসে বসলেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “আমার একটি মেয়েকে আমি হারিয়েছি। আমি তোকে হারাতে চাই না। তোর যাই প্রয়োজন হয় আমায় বল। কেমন ডাক্তারের কাছে তুই সুস্থ হতে চাস? আমি শুনেছি, মানুষ যে লোকটির কাছে গিয়ে সুস্থতা পাবে বলে ভাবে, তার কাছেই পায়।”
“আমাকে বাঁচাতে পারবে এমন কেউই নেই।”
ধ্রুবের দিকে আমি তাকালাম। সে দূরে এককোণায় দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে খুব বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে তার শরীরে যদি একফোঁটাও পানি থাকত, তবে তা এখনই চোখ থেকে অশ্রু হয়ে পড়ত। সে কি আমাকে নিয়ে এতই কষ্ট পাচ্ছে?
“এমনটা বলিস না।”
আমার মস্তিষ্ক গতবারের মতোই ইঙ্গিত দিলো, যাতে আমি বাবাকে আঘাত করি। আমি ব্যাডশিট চেপে ধরলাম। ধ্রুবের দিকে তাকালে সে তৎক্ষণাৎ বুঝে গেল। সে সাথে সাথে এসে বাবাকে আমার কাছ থেকে দূরে নিয়ে যেতে উদ্যত হলো। আমি তবু আক্রমণ করতে গেলাম। ঠিক সেই সময়, ধ্রুব বাবাকে ছেড়ে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আমাকে প্রবল বল প্রয়োগ করে থামাল। কিন্তু তার সেই সাধারণ বল আমার অসুর শক্তির বিরুদ্ধে লড়তে পারছে না। সে নিজের শক্তিও দেখাতে পারছে না। তবে সে এবার আমার দুই ঘাড় ধরে বল প্রয়োগ করল, যেটা বাবা বুঝতে পারবে না। সেই বলে আমি পিছু যেতে লাগলাম। ধ্রুব ওভাবেই ধরে থেকে আমাকে শুইয়ে দেয়।
আমি অনেকটা শান্ত হলাম। কারণ ভেতরের শক্তিটা ধ্রুবের বিরুদ্ধে পারছে না। আমার মাথা বালিশে পড়ার পর ধ্রুবের মুখ আমার চেয়ে ইঞ্চি খানেক উপরেই ছিল। এই প্রথমবার ওকে এতটা কাছ থেকে দেখছি! কি বিষাদ তার চোখেমুখে! দেবদূতরা এটুকু দেবদূতও হতে পারে! আমার হৃদপিণ্ডের কম্পন দ্রুত হয়ে গেল। ধ্রুব আমাকে ছেড়ে দিলো। আমার রাগ অনুযায়ী আমার আরও কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি করার কথা। কিন্তু ধ্রুবের কারণেই করলাম না। ওর স্বর্গীয় চেহারাটা আমাকে সবকিছুই ভুলতে বাধ্য করেছে। তখন দেখলাম, বাবা আর মজিদ ভাই ততক্ষণে আমার হাতগুলো রশি দিয়ে খাটে বেঁধে ফেলেছে। আমি স্বস্তি ফিরে পেলাম। বাবা আবারও দরজার পাশে দাঁড়ালেন।
“বাবা, ধ্রুব ঠিকই বলেছে। তোমার এখানে না থাকাই উচিত। আমার চিন্তা বারবার তোমাকে আমার পাশে আসতে বাধ্য করবে। আমি নিজের ওপর বেশিক্ষণ নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারব না। আমি কখনও তোমার কাছে কিছু চাইনি। আজ চাইছি। এটাই চাইছি, তুমি নিজেকে আমার কাছ থেকে দূরে রাখো। তোমাকে কিছু করে বসলে নিজেকে আমি কখনও ক্ষমা করতে পারব না।’
“কিন্তু তোর খেয়াল কে রাখবে?”
ধ্রুব দ্রুত জবাব দিলো, “আঙ্কেল, আমি রাখব। আমার পরিবারের কেউ কিছু বলবে না।”
“তুমি একা ওকে কীভাবে সামলাবে?”
“ট্রাস্ট মি। এখন যেভাবে পেরেছি, সেভাবেই পারব।”
“ধ্রুব..” সে আমার কথার কর্ণপাতই করল না, যেন এখানে আমার বিষয়ে কথা হচ্ছে না।
সে বলে চলেছে। “আমি কেবল ওর দেখাশোনাই নয়, পারলে ওর সমস্যাটা উদ্ধার করে ঠিক করারও চেষ্টা করব। ব্যস আপনি যোগাযোগ রাখবেন।”
সে বাবাকে আরও অনেক কিছু বলে রাজি করাল। কেন সে এতো কিছু নিজের কাঁধের ওপর নিচ্ছে? আমি তো একসময় শক্তি হারিয়ে মরে যাব, যে হারেই না আমার মস্তিষ্কের ওপর চাপ পড়ছে!
মজিদ ভাইকে ছুটি দেওয়া হলো। বাবা সন্ধ্যার দিকে অগত্যা আমাকে একটি ছেলের সাথে রেখে চলে গেলেন। কারণ তিনি ধ্রুবকে পূর্ণ বিশ্বাসের যোগ্য হিসেবে পেয়েছেন আর আমার ইচ্ছাটাও তাঁকে মানতে বাধ্য করেছি।
ধ্রুব এসে বলল, “মুখ দিয়ে তোমার শ্বাস নিতে হয়তো কষ্ট হয়। আমি বেলকনিতে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেব। তুমি যাস্ট আর কিছুক্ষণ মুখে শ্বাস নাও।” কথাটি বলে সে তার কোমল হাত দিয়ে রশিগুলো খুলে দিলো। “এগুলোর দরকার ছিল না। তুমি তখন কী ভেবে শান্ত হয়ে গেলে বলো তো?”
আমি আমতা আমতা করলাম। কেন শান্ত হয়ে গেলাম? ধ্রুব না হেঁটেই বেলকনিতে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। তাকে থাইগ্লাস দিয়ে পুরোপুরি দেখা যাচ্ছে। আমি নাক দিয়ে শ্বাসও নিতে পারছি। চমৎকার!
“ধ্রুব, তুমি এতো ভালো কেন? আচ্ছা, তোমার নাকে কি আমার দুর্গন্ধটা লাগে না?”
“লাগতে দেই না। ইউ নো, আমার অক্সিজেনের প্রয়োজন হয় না। ঘ্রাণ না নিয়ে থাকতে পারি।” সে দূর থেকে বললেও স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি।
শুয়ে থেকে কেন যেন আমি ওর দিকেই তাকিয়ে রয়েছি। তাকে যতই দেখছি মন ভরছে না। সে কতটা অমায়িক, শান্ত, কেয়ারফুল! আমি কতই না ভাগ্যবতী যে, এমন একটি ছেলে আমার বন্ধু হয়েছে। সে আহতের ভঙ্গিতে আমার দিকে চেয়ে রয়েছে। ইচ্ছে হচ্ছে, তার গালে হাত রেখে বলি, আমায় কি মরতে দেবে? আমার তো মরণ নিশ্চিত। কেন এতো চিন্তা করছ?
ওকে দেখা শেষ হচ্ছে না। আমার হয়েছে কী? ওহ নো নো, আমি প্রেমে পড়েছি। এটা কখন কীভাবে হয়েছে? এমনটা হওয়া উচিত হয়নি। আমি ওকে ভালোবাসতে পারব না। কারণ আমরা কখনও এক হতে পারব না। এর আগে আমি কাউকে মন দিয়ে ভালোবাসার সুযোগ পাইনি। মাই আমার জন্য সবকিছু ছিল। আমি জানি না, কীভাবে এসব হয়। হওয়ার পর কী হয়। কিন্তু আমার নিজের জীবনের কোনো মূল্য আমার না থাকলেও, ওদের নিষেধাজ্ঞা আছে। সে এখানের কাউকে ভালোবাসলে ওকে শাস্তি দেওয়া হবে।
আচ্ছা, এই শাস্তিটা কেমন? তাদের জগতে সম্ভবত মৃত্যু নেই। তবে? যাইহোক, আমি আবেগটাকে প্রকাশ পেতে দিতে পারব না। এতে দু’জনেরই ক্ষতি। ওকে ওদের ভুবনে নিয়ে যাওয়া হলে আমি আর কার মুখটা দেখে এখনের ন্যায় শান্তি পাব!
ধ্রুব বলল, “আমি আমার কাপড়-চোপড় আনতে যাচ্ছি। দশ মিনিটের মধ্যেই চলে আসব।”
আমি উঠে দরজার কাছে গেলাম। সে বেলকনি থেকে লাফ দিলো, ঠিক আদিলের মতো করেই মাটিতে দাঁড়াল। তারপর গ্যারেজ থেকে বাইক বের করে রওনা দেয়। ওহ্, সে বুঝি মজিদ ভাইয়ার চাবিগুলো পেয়েছে। আমি ফিরে এলাম। হঠাৎ এক ঠান্ডা বাতাস বয়ে গেল। আমি নিজেও কম ঠান্ডা নই। কিন্তু বাতাসটা এরচেয়েও অধিক ঠান্ডা। আমি বেলকনিতে আসিয়াকে দেখতে পেয়ে থমকে দাঁড়ালাম। ভাগ্যিস একটু আগে দরজাটা খুলেছিলাম।
“আসিয়া!”
“বাবাকে পাঠিয়ে দিয়ে ভালোই করেছিস। তোর কী হয়েছে তা আমি একবার বুঝতে পারলে… আচ্ছা, ধ্রুব কি মানুষ নয়?”
ওহহো। “সে অন্য ভুবনের।”
“তুই ওকে কি ভালোবাসিস?”
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, “তোর খুনিরা তো ধরা পড়েছে। আমি ভেবেছি…”
“আমি আসব। কারণ আমি খুনিদের জন্য আসিনি। যারা অপরাধী, তারা অবশ্যই একসময় শাস্তি পায়। আমি তোর জন্যই রয়ে গিয়েছি। তুই অনেক সুখই পাসনি, সুখ কিছু দেওয়ার তেষ্টায় হয়তো আমার আত্মা অতৃপ্ত রয়ে গেছে। দেখ, তোর অবস্থা। আমি হয়তো তোকে ঠিক করার জন্যই আছি। কিন্তু তোর সমস্যাটাই ধরতে পারছি না।”
“আমি জানি না, আমার কী হয়েছে।”
এমন সময় ধ্রুব বেলকনিতে লাফ দিয়ে উঠার পর আসিয়াকে দেখে সে হতভম্ব হয়ে গেল।
“তুমি মুক্তি পাওনি?” আসিয়ার বলার আগেই ধ্রুব বুঝে ফেলল, “ওহ্, আই সি।”
আসিয়া নাক কুঁচকিয়ে উধাও হয়ে গেল। হয়তো আমার গন্ধটা সইতে পারছিল না। ধ্রুব অন্য ঘরে ব্যাগ রেখে রান্না করতে চলে যায়। আমি অকর্মার মতো শুয়ে রইলাম। এতো অসুস্থতার পরও আমার খুব খুব ভালো লাগছে। কারণ আমি আগে কখনও প্রেমে পড়িনি। অনুভূতিটা এতোটাই দারুণ তা আমার আগে জানা ছিল না। ধ্রুব.. আমার ধ্রুব.. যতদিন মরব না আমার পাশেই থাকবে। সময় কম হলেও নিজেকে অনেক লাকি ভাবছি অন্তত তাকে দেখার আরও সুযোগ পেয়ে।
আমি খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ি। গভীর রাতে দুঃস্বপ্নের কারণে আমার ঘুম ভেঙে যায়। স্বপ্নে আসিয়া আর ওই লোকটি সামনা সামনি ছিল! উঠার পর দেখলাম, ধ্রুব বেলকনিতে চেয়ারেই ঘুমিয়ে পড়েছে। আহ্! আমার কারণে কত কষ্টই না.. আচ্ছা, আমি সম্ভবত ওকে কোলে নিতে পারব।
ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে নিঃশব্দে দরজা খুললাম। এখনই দরকার মুখ দিয়ে শ্বাস নেওয়ার। আহ্, ধ্রুবের মুখ! শুনেছি, মেয়েরা ঘুমালে তাদের খুব সুন্দর দেখায়। কিন্তু ধ্রুবকে ঘুমন্ত অবস্থায় এতটা সুন্দর দেখাবে তা কখনও কল্পনা করিনি। আবার ভালো লাগার অনুভূতিটার কারণে আমি সবকিছু ভুলে গেলাম। ভুলে গেলাম, আমার মাঝে নোংরা কিছু বাস করছে।
সে হয়তো একটুও বিশ্রাম নেয়নি। নইলে এতটা ঘুম, যে আমার স্পর্শও ও বুঝতে পারছে না! আমি ওর পিঠে এক হাত ও পায়ের নিচে একহাত দিয়ে ওকে উপরে তুললাম। অবিশ্বাস্য। সে এতটা হালকা হবে তা ভাবিনি। তার ভার বোধহয় এক কেজিও হবে না, যেন একগুচ্ছ ফুলন্ত বেলুন। আমি এভাবেই ওর কর্কশিটের ন্যায় হালকা শরীরকে ভেতরে নিয়ে আসি। ওর মাথাটা পেছনে অনেকটুকু হেলে পড়েছে। একটা হাত আমার পিঠের দিকে, আরেকটা হাত নিচে ঝুলছে। সে যে অনেক লম্বা!
এক.. দুই.. পাঁচ.. আট সেকেন্ড হলো। তাড়াতাড়ি তাকে বিছানায় শুইয়ে দেই। ভাগ্যিস দুই-তিনটে সেকেন্ড দেরি করিনি। নইলে এই পবিত্র শরীরের কোনো ক্ষতি করে বসতাম। আমি তাড়াতাড়ি অন্য ঘরে ঘুমাতে চলে গেলাম।
ঘুম ভাঙল পরদিন বিকেল চারটায়।
“বাপরে! এতো ঘুম?”
রোগা মুখে আমি একটু হাসলাম।
“কাল কি আমায় কোলে নিয়েছিলে?”
“হ্যাঁ।”
“আমি ওখানেই ঘুমোতে পারতাম।”
“আমি মানুষ হিসেবে স্বার্থপর নই যে, তোমাকে ওখানেই মশার সাথে ঘুমাতে দেব।”
“ওরা শান্তি পায়নি, কারণ রক্ত পায়নি।”
দু’জনই হাসলাম।
“তুমি যে এখানে থাকছ, কেউ কিছু বলবে না?”
“না। ওই পরিবারে অনেক টাকা থাকায় সবাই বেপরোয়া। ওরা ড্রিংকস এই সেই নিয়ে মেতে থাকে। বুঝতেই পারছ। এমনকি জিসান কয়েকদিন বাইরে থাকলেও কারও কিছু যায় আসে না। ওরা শাসন একদমই করে না। আমরা যাই চাই, তাই করতে দেয়। ওখানে কেবল মা’ই আমাকে পছন্দ করেন, তাও মানুষকে আমার ন্যায় রূপবান একটি ছেলেকে গর্ব সহকারে নিজের করে দেখাতে পারায়।”
“তোমার বাসায় আমার যাওয়া হয়নি।”
“সুস্থ হয়ে উঠ।”
আমি? সুস্থ?…
এক সপ্তাহ কেটে গেল। আমি ঠিক হচ্ছি না। ধ্রুব আমাকে বেশিক্ষণ ছুঁতে পারে না। তার সুগন্ধ কবে নিয়েছি তাই মনে নেই। তবে একটা ভালো দিক হলো, আপন কেউ না থাকায় আক্রমণ করছি না। তবে ভাঙচুর অবশ্য করেছি, ওই বীভৎস লোককে দেখে।
ধ্রুব আজ একটি কেক নিয়ে এলো। টেনে টেনে বলল, “হ্যাপী বার্থডে..”
“ওহ্, আঠারোতে বুঝি পড়ে গেলাম।”
“হ্যাঁ। তোমার বয়স কিন্তু শ্রেণির তুলনায় কম।”
“আমি পড়াশোনা একটু তাড়াতাড়ি শুরু করি।”
“করারই কথা। এতো শার্প যে তোমার মাইন্ড!”
“হা হা হা। আমি কিন্তু কেক খেতে পারব না।”
“স্বাদ না নিয়ে গিলে ফেললে শেষ! এঞ্জয় দ্যা মোমেন্ট।” সে আমাকে খাইয়ে দিলো। আমিও তাকে একপিচ খাইয়ে দেই।
“খেতে পেরেছ!”
সে হাসল, “ওয়েট। বাসায়ও খাই এবং সারি।” সে বাথরুমে গিয়ে ওয়্যাক ওয়্যাক করতে লাগল। আমি এখান থেকেই দেখলাম, কেকগুলো তার হজম হয়নি। এসে সে সহাস্যে বলল, “ঠিক এভাবেই।”
হা হা হা…
আমি ভুলে নাক দিয়ে শ্বাস নিয়ে ফেললাম। সেই ঘৃণিত ধ্রুবের গন্ধ… না, এই গন্ধ আমার খুব প্রিয়। তবে কি সত্যিই আমার মাঝে অন্যকিছু আছে? ধ্রুব তাড়াতাড়ি সরে গেল। তবে আমি কিছু করিনি। সে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমি মূর্তির ন্যায় বসে রয়েছি। ঠোঁট কামড়িয়ে আমি শুয়ে পড়লাম। আমার ভেতরের লোকটিকে দমন করার চেষ্টা করছি। সে বলল, “ছেলেটিকে তাড়িয়ে দাও। তাকে অনেক সইয়েছি।” কথাগুলো সরাসরি বলেনি। সেটি আমার মস্তিষ্ক হয়তো পড়তে পারে না। তাই বিড়বিড় করছি, ওর ক্ষতি আমি করব না। দরকার হলে আমাকে মেরে ফেল, আমার ধ্রুবকে একটা টোকাও দেব না। হঠাৎ ভেতরটা নিস্তব্ধ হয়ে গেল। আমাকে শান্ত দেখে ধ্রুব এখনও দাঁড়িয়ে আছে। তবে আমি কি জিততে পেরেছি? কিন্তু এমন সময়.. আমি ঘর কাঁপিয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম। শোয়া থেকে বসে পড়লাম। সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করলাম। আমার ভেতরে পাকস্থলীতে শক্তিশালী কিছু একটা যেন নখ দিয়ে আঁচড় দিয়েছে।
ধ্রুব ব্যথিত হলো। কী করবে বুঝতে পারছে না। তবে তার সুগন্ধটার কারণে সে তাড়াতাড়ি সরে পড়ল। আমি কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
প্রতিদিনের নিয়মের মতো আমার খাওয়া, পরা, ঘুমানো এসবই চলতে থাকল। আর ধ্রুব কখনও বা বেলকনিতে থাকে, কখনও বা হলের সোফায় বসে টিভি দেখে। আমি অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। আমার স্বাস্থ্যের তো উন্নতি হচ্ছে না। সে কতদিন আমার খেয়াল রাখবে আমি তা জানি না। কেবল আমি মুহূর্তগুলোকে উপভোগ করছি। উপভোগ করছি ধ্রুবকে, এক স্বর্গীয় দেবদূতের ন্যায় ছেলেকে। আমি জানি না, দুইদিন পর আমি থাকব কিনা। কারণ আমার ভেতরের জন ধ্রুবকে পছন্দ করছে না। আর আমি ওকে আঘাত করতে পারব না। তার জন্য ভেতরের জন্য আমাকেই শাস্তি দেবে। জীবন নিয়ে আমার কখনও অন্য মানুষের মতো টান ছিল না। বরং যাই পেয়েছি, তাকে সৌভাগ্য মনে করেছি। তাই মৃত্যু আমাকে ভাবাচ্ছে না।
আমি সকালে ঘুম ভাঙার পর বড় ঘড়িটির দিকে তাকালাম। অনেক অনেক বাজে এক রাত কাটিয়েছি। ঘুমিয়েছি ঠিক, কিন্তু শান্তির নয়। দেখেছি, আমি ছটফট করছি। যত ধরনের যন্ত্রণা থাকতে পারে সবই আমি সইয়েছি। একসময় আমার শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল।
অনেক ভয়ংকর সে স্বপ্ন। কেউ নিজের মৃত্যু অনুভব করতে চায় না। ঘড়ি থেকে চোখ নামালে আমি বিছানায় একটি সুন্দর পা দেখতে পেলাম। অমনিই চোখ ঘুরিয়ে দেখতে পাই, আমার একহাত দূরে ধ্রুব ঘুমিয়ে আছে। কি নিষ্পাপ ওর চেহারা! সে কি আমাকে নিয়ে চিন্তিত ছিল? আমি ওর মুখ ধরতে চেয়েও হাত নামালাম। উঠে কম্বলটা ওর গায়ে তুলে দেই। জানি না, এর প্রয়োজন আছে কিনা।
বারোটার দিকে সে হলঘরে এলো।
“সরি আলিয়া, তোমার পাশে ঘুমিয়ে পড়েছি।”
“ইটস ওকে।”
“তুমি মাইন্ড করোনি?
“কেন?”
“না মানে মানুষ তো এভাবে ছেলে.. মেয়ে.. শোয়া..”
“আমি মাইন্ড করি না। লজিক্যালি পাশে যেভাবে থাকো, সেভাবেই তো শুলে।”
“জানো? তুমি কালরাত একটু বেশিই কষ্ট পেয়েছ। তোমাকে দেখতে দেখতে ওখানেই ঘুমিয়ে পড়েছি।”
“তুমি এতটা দয়ালু কেন বলো তো?”
“দয়ালু! তুমিই একটা মানুষ, যে আমার সত্য জানে, যে আমার বন্ধুর চেয়ে কম নয়। শুনো, আদিল তো তীক্ষ্ণ ক্ষমতাধারী। সে বোধ হয় কিছু আঁচ করতে পারবে। আমি তাকে এখানে আনব। আর কতদিন এভাবে চলতে থাকবে?”
সে সত্যিই আদিলকে নিয়ে এলো। আমি নিশ্চুপভাবে শুয়ে রয়েছি। তিনি আমাকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে আতঙ্কিত হয়ে ভাঙা গলায় বললেন, “She has been possessed.”
(চলবে…)
লেখা: ফারিয়া কাউছার
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।
গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা
◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।
আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share