“তিমির” পর্ব ১
গায়ে ভারী লাল টকটকে শাড়ি পরা অবস্থায় হাতে ব্যাগ নিয়ে অন্ধকারে বেরিয়ে পড়লাম। যদিও যাওয়ার মতো কোনো জায়গা নেই, আমি এই বিয়ে কোনোভাবেই করব না। মা কখনও যে কাজে প্রস্তুত ছিলেন না, আমি সে কাজ কখনও করব না। অন্তত মা থাকলে তাঁর করা ভুলটা আমাকে করতে দিতেন না। পালানো ছাড়া উপায় নেই। সন্ধ্যায় ডেকোরেশনের কাজ শেষ হওয়ার পর যেভাবে আঁধার নেমে এসেছে, ঠিক সেভাবেই আজ সকালে ছেলেপক্ষের লোকেরা আমায় দেখে যাওয়ার পর আমার জীবনে আঁধার নেমে এসেছে। আমি কখনও এতটা আঁধার চাইনি। মা জীবিত থাকতে একটা কথাই আউরে ছিলেন, আমার মেয়েকে বহুদূর লেখাপড়া করাব। আমি সে সাপেক্ষেই নিজেকে গড়েছি। এখন সে গড়ন কোনোভাবেই ভাঙতে দেবো না। ডেকোরেশনের লাইট কেবল উঠোন পর্যন্তই ছিল। মিনিট কয়েকে পুকুরপাড়ে চলে এসেছি। এখানে কেউ আপাতত আসবে না। কারণ বাসায় খালা বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছেন।
ঘাটের সিটের ওপর বসে পড়লাম। মৃদু ঠান্ডা বাতাস বইছে। শীতে শরীরটা কুঁকড়ানো শুরু করেছে। কোথায় যাব? কী করব? পুকুরের পানির দিকে দীর্ঘক্ষণ চেয়ে রইলাম। না, আমি এতবড় মূর্খ নই যে, আত্মহত্যা করব। সাথে সাথে পানি থেকে চোখ সরালাম। দৌড়নোর সময় মহিম চাচাকে দেখেছিলাম। তিনি তো আমায় খুব ভালোবাসেন। আজ রাতটা কি তাঁর বাসায় থাকতে পারি না? আলো দেখে আমার চিন্তায় ছেদ পড়ল। একটা বড় গাড়ি এসেছে। শিট! ছেলেপক্ষের লোকেরা চলে আসেনি তো? তড়িঘড়ি করে সিটের নিচে লুকিয়ে পড়লাম। গাড়ি থেকে পাঞ্জাবি পরিহিত একজন লোক বেরিয়েছে। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, গাড়িতে ড্রাইভার ব্যতীত কেউই নেই। কালো এই দামি গাড়িটা আগে কোথাও যেন দেখেছি। কোথায় যেন.. ওহ্, মা’কে দাফন করাতে নিয়ে যাওয়ার সময় আমি তাঁর খাটিয়ার পিছুপিছু দৌড় লাগিয়েছিলাম। সে সময় পুকুরের পাশের রাস্তায় ঠিক এখনের ন্যায় বাবার গাড়িটা পার্ক করানো ছিল। তবে এখন বাবা বাড়ির দিকে কেন যাচ্ছেন?
গতবার তাঁর চোখে আমাকে নিয়ে সহমর্মিতা দেখেছিলাম। আমি একা হয়ে পড়ায় তিনি আমাকে তাঁর সাথে করে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। অন্তত সেদিনের কথা ভেবে এটুকু অবশ্য বলা যায়, আমার এই খারাপ দশায় তিনি আমাকে আশীর্বাদ করতে আসেননি। আমি তৎক্ষণাৎ আরও চমকে উঠলাম, তাঁর দিকে মহিম চাচাকে দৌড়ে আসতে দেখে। তাইতো বলি, বাবা আমাদের কথা কীভাবে প্রতিবার জেনে ফেলতে পারেন।
আমার লুকিয়ে থাকা কি ঠিক হবে? অন্তত চাচাকে বিশ্বাস করতে পারি। তিনি আমার সাথে কোনোপ্রকার অনর্থ হতে দেবেন না। তাইতো তাঁকে খালা আমার বিয়ের কথা জানাননি। খালার হুঁশ হয়তো এতক্ষণে ফিরেছে। তাঁর মাথায় লাঠির আঘাত অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করে দেইনি।
আমি সাহস করে উঠে দাঁড়ালাম। গাড়ির আলোর সামনে তাঁরা পৌঁছনোর পর আমাকে দেখে থেমে গেলেন। আমার মন কেন যেন বলছে, বাবার চোখে পানি টলমল করছে। তবু আমার তাঁর প্রতি আকর্ষণ বাড়ছে না। আমি আবেগ লুকিয়ে রাখতে না পেরে দৌড়ে গিয়ে চাচাকে জড়িয়ে ধরলাম। আমার মাথার ওড়নাটা পড়ে গেল। আমার উন্মুক্ত মাথার চুলের অগ্রভাগে চাচা চুমু খেলেন। এখন একদমই স্পষ্ট, আমার কোনো অনিষ্ঠ হবে না।
আমি উঠে হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, “আপনি আজ কোথায় ছিলেন? আমি দুপুরে আপনাকে অনেক খুঁজেছি। জানেন, খালা আরেকটু হলে আমাকে তাঁর দেবরের সাথে…”
চাচা আমাকে থামিয়ে বললেন, “জানি মা। আজ কাজ থাকায় বাইরে ছিলাম। এরই সুযোগ নিয়ে তোর খালা এমনটা করবে আমি কল্পনা করতে পারিনি। আসার পরপরই তোদের বাড়ির সামনে লাইট দেখে খবর নিয়ে সাথে সাথে তোর বাবাকে ফোন দিয়েছি।”
বাবাকে ফোন দেওয়ার বিষয়ে আমার রাগ দেখানো উচিত হলেও রাগ দেখাতে পারলাম না। কারণ চাচার এতো সামর্থ্য নেই যে, এটুকু সময়ে আমার বিয়ে ভাঙাতে পারতেন। তাই বাবাকে ফোন দেওয়া ব্যতীত আর কোনো উপায় বাঁচে না। গতমাসে মায়ের মৃত্যুতে চাচাই হয়তো এভাবে ফোন দিয়ে বাবাকে তাঁর প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর কথা জানিয়েছেন।
বাবা আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি নিচের ঠোঁট কামড়ে বললেন, “মা, অনেক হয়েছে। এবার আমার সাথে চল। আমি অন্তত তোমাকে এতো কম বয়সে বিয়ে দেবো না। তোমাকে স্বাধীনভাবে চলতে দেবো। প্লিজ মা, চল। তোমাকে এভাবে খারাপ লোকের মাঝে রেখে আমি শান্তি পাব না। তুমিও শান্তি পাবে না।”
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।
গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা
◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।
আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share
খারাপ লোকের সংজ্ঞা আমার ভালোভবেই জানা আছে। খারাপ লোকের কথা ভাবলে সর্বপ্রথম বাবার চেহারাই চোখের পর্দায় ভাসে। তিনি খারাপ না হলে মা’কে ছেড়ে যেতেন না। কিন্তু আজ তাঁর চোখে টলমল করা পানি দেখে আমি নিজ অভিমানে আর অটল থাকতে পারছি না। আজ অন্তত এমন একটা জায়গায় আমার থাকতে হবে, যেখানে খালা কিংবা ছেলেপক্ষের লোকগুলো আমার কাছে পৌঁছতে পারবে না। মহিম চাচার এতটুকু সাহস নেই যে, তিনি আমাকে তাঁর বাসায় লুকিয়ে রাখতে পারবেন। আমি নিরুপায় হয়ে গাড়ির দিকে পা বাড়াচ্ছি।
গাড়িতে উঠার পর বাবা নিঃশব্দে আমার পাশে বসলেন। আমার সাইডের গ্লাসটা খোলা রাখলাম, শান্তির এই বাতাসটা উপভোগ করার জন্য। ড্রাইভার গাড়ি চালাতে শুরু করল। গাড়ি মূল রাস্তায় উঠলে আমার স্বস্তি হয়। এখানের চলমান গাড়ির মাঝে ছেলেপক্ষের লোকেরা এলেও এখন আর আমাদের গাড়িকে থামাতে পারবে না। ভাবতে ভাবতেই আমি সামনের দিক থেকে আসা গাড়িটার ড্রাইভারের পাশের সিটে বসা লোকটিকে চিনতে পারলাম। আমাদের গাড়িকে তাদের গাড়ি ক্রস করার সময় লোকটি আমার দিকে তাকানোর আগেই আমি মাথা নিচে নামিয়ে লুকিয়ে পড়ি। সামান্য সময়ের ব্যবধানটা না থাকলে, একটু আগে বাড়ির রাস্তায় বাবার গাড়িটা দেখলে তারা সন্দেহ করে অবশ্য গাড়িটা থামাত। কারণ তারা সকালে খালাকে কথা দিয়েছিল, বাড়িতে প্রবেশ করার সময় তারা চারিদিকে লক্ষ রাখবে। আমি মনে মনে ড্রাইভারকে অজস্র ধন্যবাদ জানাচ্ছি। খেয়াল করলাম, আমার মাথায় কে যেন হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
“ওরাই ছিল।” বাবা বললেন, “তাই না?”
আমি নীরবে চোখের পানি মুছে ফেললাম।
“সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি তোমাকে এরচেয়ে ভালো একটা জীবন দেওয়ার চেষ্টা করব। সত্য বলছি, যদি আরও আগে জানতাম এসবের কথা, তবে তখনই চলে আসতাম। অন্তত এই বিয়ের কাপড়টা তোমার পরতে হতো না।”
তিনি শেষের কথাটা বলার সময় আমার শাড়িটার দিকে তাকিয়ে রয়েছিলেন। তাঁর কুঞ্চিত ভ্রূ দেখে এই মনে হলো, তিনি হয়তো ভাবছেন “হাউ চিপ!” সত্য। আমি খুব সস্তা একটি শাড়ি পরে আছি। কেবল শাড়িটাই নয়, মায়ের যাওয়ার পরের একমাসের এই সময়টাই পুরোপুরি খারাপ। জানি না, কালকের সূর্যটা আমার জীবনে কোন রূপ নিয়ে আলো ফেলবে। গ্লাসের বাইরে তাকিয়ে রইলাম। একসময় চোখগুলো বেঁধে এলো।
মনে হলো, কে যেন আমার হাঁটুর নিচে আর আমার পিটের দিকে হাত দিয়েছে। ক্রমে আমি কার বাহুতে যেন চলে গেলাম। সুগন্ধটা পরিচিত ঠেকছে। বাবা কি তবে আমাকে কোলে নিয়েছেন? আমাকে তিনি জাগাতে পারতেন। যদিও আমার ঘুম পুরোপুরি ভাঙেনি, তাঁর একেক কদম খানিকটা অনুভূত হচ্ছে। আবারও আমি প্রশান্তির দেশে চলে গেলাম। এই দেশে কোনো চিন্তা নেই, কোনো ভয় নেই, কোনো খালা নেই, খালার ভয়ংকর দেবরটা নেই।
আমি যখন চোখ খুললাম, তখন ঘরটা অপরিচিত মনে হলো। সামনের দেয়ালে বড় একটা ঘড়ি আছে। সাড়ে বারোটা বেজেছে। সামনের সোফায় কিছু শপিং ব্যাগ রাখা আছে। এসব ব্যতীত আশেপাশে তাকিয়ে দেখছি, ঘরটা খুব সুন্দর, যেন আমি কোনো হোটেলে উঠেছি। আমার কাপড়ের ব্যাগটা কোথায়? শেষবার.. শেষবার.. পুকুরঘাটেই আমি হাত থেকে রেখেছিলাম। আহ্! ওখানেই ফেলে এসেছি।
সোফার দিকে এগিয়ে গিয়ে ব্যাগগুলো খুলে কিছু কাপড় পেলাম। এসব আমারই সাইজের। বাবা রাখেননি তো? আমার কি তাঁর কেনা জিনিস পরা উচিত? না, পরতেই হবে। আমি আর এক মুহূর্তও খালার দেওয়া এই বীভৎস কাপড়টা পরে থাকতে চাই না। ফ্রেশ হয়ে কাপড় পরে এসে বাইরে বেরুই। এটা কোনো হোটেল নয়। হলের সোফায় আমার বয়সী এক তরুণী বসে পেপার পড়ছে। একটা চাকর তার সামনে পানি এনে রাখছে। হোটেলে সম্ভবত এমনটা হয় না। চাকরটা আমাকে দেখে কাছে এসে বলল, “আপা, সোফায় বসেন। আপনার জন্য এহনই নাস্তা আনতাছি।”
তার কথায় সোফায় বসি। সামনের মেয়েটি আমার দিকে তাকালো। সে বলল, “বাবা তার ঘরে ঘুমুচ্ছে। ঘুমে ব্যাঘাত তাঁর একদমই পছন্দ নয়। তাই চুপচাপ নাশতা খেয়ে নাও। তাঁকে ডাকার চেষ্টা করবে না।”
মেয়েটি সম্ভবত সম্পর্কে আমার বোনই হবে। তার চেহারায় বাবার চেহারার কিছুটা রেশ আছে। সম্ভবত হালকা চ্যাপ্টা এই নাকটাই বাবার মতো। তারা কয় ভাই-বোন? তাদের মা কোথায়? তিনি কি আমার উপস্থিতির কথা জানেন? আমি চায়ের কাপে মুখ লাগাই। চায়ের এই উষ্ণতা ভেতরে ঢুকে আমার অবশিষ্ট ক্লান্তিগুলোও দূর করে দিলো। বাবা ঘুমের দিক থেকে অনেকটাই আমার মতো। আমিও ঘুমে ব্যাঘাত মোটেই পছন্দ করি না। এই ফাঁকে খেয়াল করলাম, মেয়েটি এখনও আমার দিকে চেয়ে আছে। সে অতিরিক্ত ফর্সা। তবে চেহারায় মায়া একটু কম। কপালটা স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বড়। কিন্তু খারাপ নয়। চোখগুলো প্রায় বোজা, ফুলানো। সে কি রাতের বেলায় কান্না করে?
মেয়েটি ঠোঁট টিপে রাখা অবস্থায় ভদ্রভাবে হাসল, “আমি এখানকার কলেজে ফার্স্ট ইয়ারের ফাইনাল দিয়েছি। তোমার কী খবর?”
আমি কিছুটা আশ্চর্যান্বিত হলাম। কিন্তু উপরে তা প্রকাশ পেতে দেইনি। মেয়েটি আমার সাথে মার্জিত ব্যবহার করছে। সৎবোন হয়ে? এখন কেন যেন মনে হচ্ছে মেয়েটির চেহারায় অনেক মায়া আছে।
“সেইম। কিন্তু পরীক্ষা দেওয়ার পরের এই একমাস লেখাপড়া হয়নি। বিয়ের কথাবার্তা.. ”
“ওহ্, let bygones be bygones। বাবা তোমাকে আমার সাথেই ভর্তি করিয়ে দেবে।”
আমাকে? ভর্তি? আমাকে তারা এখানে রাখার কথা আদৌ ভাবছে?
“আপনার মা কিছু বলবেন না?”
মেয়েটি কিছুক্ষণ নীরব রইল। সম্ভবত আপনি সম্বোধনটা পছন্দ হয়নি। ভালোই তো। খুব ভালো।
“আমার মা নেই। এখানে বাবা আর আমিই থাকি। মাঝে মাঝে ফুফিরা আসেন।”
আমি কী বলব ভেবে পেলাম না। এতক্ষণ মনে ভয় ছিল, ঘর থেকে বেরুলে সৎমা’কে দেখব। প্রচলিত ধারার সৎমা’য়ের ন্যায় আমি হব তাঁর দু’চোখের বিষ। কিন্তু তিনি নেই? আর বাবার কি কেবল একটিই সন্তান?
মেয়েটি বিরক্ত বোধ করছে না বিধায় কিছু টুকটাক প্রশ্ন করলাম। পেপারের দিকে চোখ রেখে সে একের পর এক জবাব দিয়ে গেল। উত্তর ব্যতীত অতিরিক্ত কিছু বলার সময় অবশ্য খানিকটা বিরক্তি প্রকাশ করেছে। কিন্তু তার ভঙ্গিমায় বোধ হচ্ছে, এখন থেকে আমি এখানে থাকব বিধায় আমাকে সবকিছু বলা উচিত। আমি অবশ্য ভেবেছিলাম এখানে থাকব না, কারণ এখানের মানুষ হয়তো আমাকে পছন্দ করবে না। কিন্তু সে পুরোপুরি এমনটা নয়। অন্তত আমার এখানে থাকার বিষয়ে তার বিশেষ আপত্তি নেই।
ওর নাম আসিয়া। আমার নামের সাথে অনেকটাই মিল। বাবা কি দু’জনের নাম আসিয়া এবং আলিয়া মিলিয়ে রেখেছেন? কে জানে। আসিয়ার মায়ের নাম লুবনা। বিশ্বাস করতে মন চায় না, তিনি অনেক আগে ব্লাড ক্যান্সারে মারা গিয়েছেন। অথচ আমি আমার ঘরের এককোণের ছোট জানালাটার পাশে বসে ভাবতাম, বাবা হয়তো তাঁর অন্য পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সুখে আছেন।
বাবার জীবন আমার ধারণার বিপরীত ছিল। তিনি খুব মেধাবী একজন ছাত্র ছিলেন। আমার মেধা হয়তো তাঁর কাছ থেকেই উপহার পেয়েছি। তিনি ভার্সিটিতে পড়াশোনা করে ইকনোমিকস ডিপার্টমেন্টে রেকর্ড রেজাল্ট করেছিলেন। সম্ভবত এর বছর খানেক আগেই মা তাঁর সাথে বিবাহ সম্বন্ধে আবদ্ধ হওয়ার ভুলটা করেছিলেন। বাবা ফুল স্কলারশিপ পেয়ে আমেরিকায় পড়তে চলে যান। ওখানের ইউনিভার্সিটিতে পার্টটাইম টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে চাকরিসহ পিএইচডি করলেন। তিনি দশটা বছর ওখানে থেকে আসিয়াদের সাথে থাকার জন্য দেশে এসে এখানে থাকতে শুরু করলেন। এসবকিছু জানার পর বিশ্বাস করতে খুবই কষ্ট হয়, এই লোকটি দ্বিতীয় স্ত্রীর জন্য আমার মা’কে ছেড়ে দিয়েছেন। এসব নিয়ে অবশ্য আমি আসিয়ার কাছে প্রশ্ন করিনি। আমার মায়ের কথা হয়তো ওর ভালো লাগবে না। সে একটিবারও জিজ্ঞেস করেনি, আমি আজ ভোরে বাবার সাথে বিয়ের সাজে কেন এসেছি। একটিবারও বলেনি, তুমি দেখতে সম্ভবত তোমার মায়ের মতোই সুন্দর হয়েছ। বাবার ঠোঁট ব্যতীত কিছুই পাওনি তুমি। এসকল কথা আজীবন মহিম চাচার কাছেই শুনে এলাম। মনে হয়, এই জীবনে আর কেউ বলার আগ্রহ দেখাবে না।
বাবা উঠার পর আমার লেখাপড়ার অবস্থা জিজ্ঞেস করলেন। আমি আমার এই অত্যন্ত দুর্বিষহ মাসটার বর্ণনা তাঁকে দিলাম। বাবা হাসলেন, “তোমার ওই খালা তোমার আপন নয়।”
“জানি, দূর সম্পর্কের।”
তিনি আবারও হাসলেন, “এজন্যই হয়তো মায়া-মমতা তাঁর মনে একটুও ছিল না। শাহানাকে সবসময় বুঝাতাম তাঁর কাছ থেকে যেন দূরে থাকে।” তাঁর মুখে মায়ের নাম শুনে খুব খারাপ লাগল। মা’কে তিনি ডিজার্ব করেন না। “আপসোস। তোমার নানা তোমার মায়ের জন্য যেসবকিছু রেখে গেলেন, তার ওপর তার নজর পড়ল। ব্যস, তোমার মা যাওয়ার পরপর তোমাকে তাড়িয়ে দেওয়ার প্ল্যান করেছে।’
আমি দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেললাম। বাবাকে ভালো না লাগলেও তার মুখের কথাটা আমার সত্য বলেই বোধ হয়েছে। তিনি বললেন, এখন আর ভয় নেই। আমাকে আর কোথাও যেতে দেবেন না। মহিলাটা মায়ের সম্পত্তি ভোগ করুক। আমার জিনিসপত্র, বই, ডকুমেন্ট, কলেজের ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নিয়ে একেবারে চলে আসবেন। খালাকে আমার জীবনে আর হস্তক্ষেপ করতে দেবেন না। আমি বাবাকে প্রশ্ন করতে চেয়েছিলাম, কেন আপনি আমার জন্য এতকিছু করছেন? এতবছর কোথায় ছিলেন? করতে পারলাম না, খালার সেই কুৎসিত ভয়ংকর দেবরের কথা মনে করে। মুখে পোড়ার দাগ থাকা লোকটির ভেটকি হাসির ঝলক আমি কালরাতের দুঃস্বপ্নে দেখেছি।
বাবা আমাকে নিয়ে বেরুলেন নানার বাড়িতে যাওয়ার জন্য। এই বাড়ির সামনে বড় এক উঠান আছে। আশেপাশে বাগান করা হয়েছে। উঠানের শেষে রাস্তা। রাস্তার ওপারে গাছের সারি। গাছ ব্যতীত কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বাবার আদেশে দারোয়ান বাড়ির একপাশে লাগোয়া গ্যারেজটা খুললেন। কালকের সেই কালো গাড়িটা ওখানে রাখা হয়েছে। গ্যারেজের একপাশের দেয়ালে একটা ফটোফ্রেম রাখা আছে। ছবিতে কোন এক মহিলার যেন স্ক্র্যাচ করা হয়েছে। এই ফটোফ্রেম গ্যারেজে কেন রাখা হয়েছে?
বাবা আমার চোখে প্রশ্ন দেখে বললেন, “ওটা লুবনার স্ক্র্যাচ। আমি করেছিলাম। ওর কাছে আঁকাজোকা ভালো লাগত না বিধায় অনেকদিন ফেলে রেখেছিল। আবার বাড়িটার কাজ কম্পলিট হওয়ার পর দেখি ও ফেলে না রেখে গ্যারেজের দেয়ালে আটকে রেখেছে। আমি তা আর নেইনি।”
আমি বাবার সাথে নানার বাড়িতে গেলাম। খালা বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে চেয়ে ছিলেন। আমি আমার যাবতীয় জিনিস গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ি, বাবা তাঁকে অস্ফুট শব্দও করতে দিলেন না। আমি একেবারের জন্য ওখান থেকে আসিয়াদের বাড়িতে চলে আসি। আসিয়াদের বললেও ভুল হবে। বাবা কথার ফাঁকে ফাঁকে অনেকবার বুঝিয়ে দিয়েছেন, ওই বাড়িটা আমারও বাড়ি। তাতে আমার অধিকার আছে। এটা শুনে আরও বেশি অবাক হই যে, তিনি তাঁর সম্পত্তির যেটুকু আসিয়াকে দিয়েছেন, সেটুকু পরিমাণ আমার জন্যও লিখে রেখেছেন। আর এই কথাগুলো মহিম চাচাকে তিনি বুঝিয়ে রেখেছেন। কথাগুলো সত্যিই অবিশ্বাস্য শোনায়। আমি বাবার এই উদার রূপকে কোনোভাবেই স্বীকার করে নিতে পারছি না। তিনি এতটাই উদার হলে আমার মাত্র এক বছর বয়সে মায়ের কোলে আমাকে রেখে মাকে একা ফেলে এখানে আরেকটা সংসার করতে চলে আসবেন কেন? তিনি যতই উদারতা দেখাক, মায়ের কথা মনে পড়লে আমার বুকটা ছ্যাঁত করে উঠে। যেকোনোভাবেই হোক, আমি এই লোককে কখনও ক্ষমা করব না। কখনও শ্রদ্ধা নিয়ে বাবা বলে ডাকব না।
আমি এক সপ্তাহের পর আসিয়ার সঙ্গে কলেজে যেতে শুরু করলাম। আজ আমার প্রথম দিন। ভাবতেই অবাক লাগছে, এক সপ্তাহ আগে আমার বিয়েটা হতে গিয়ে হতে দিলাম না। অক্ষতভাবে ফিরে এলাম। অন্তত সেই লোভী খালা আর ওই ভয়ংকর লোকটির কবল পেরিয়েছি।
এই কলেজ প্রায় আগের কলেজেরই সমতুল্য। তবে এই কলেজের পরিসর এবং উন্নয়ন খানিকটা উন্নতশীল। কলেজের আরেকদিকে নতুন ভবনের কাজ চলছে। আমি যথারীতিতে ক্লাস করতে শুরু করলাম। ছাত্রছাত্রীরা ঠিকই ছিল, কেবল আমিই তাদের ন্যায় এই কলেজে পুরাতন নই। প্রায় সব সহপাঠীর সাথেই আসিয়ার ভালো সম্পর্ক আছে। প্রথমে মেয়েদের সাথে সে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়। প্রতিবার সে যখন কারো সামনে আমাকে বোন বলে সম্বোধন করেছে, আমার মাঝে অদ্ভুত এক ভাবনার তৈরি হয়েছে। এখনও ভাবতে অবাক লাগছে, সে সম্পর্কে আমার বোন।
ছুটি শেষে সে ছেলেদের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতে যায়। আশ্চর্যজনক ভাবে আসিয়া এটেনশন চাইলে সকল ছেলেই তাতে আগ্রহ দেখায়। তবে কি বাবার ঐশ্বর্য আমাকে প্রভাবিত করতে না পারলেও ছেলেদের করতে পেরেছে?
চিকন এবং কিছুটা ব্যাঁটে এক ছেলের সাথে আসিয়া পরিচয় করিয়ে দিলো, “আমাদের ব্যাচের সবচেয়ে ফাঁকিবাজ আর দুষ্টু ছেলের সাথে পরিচিত হও। ওর নাম সাঈদ।”
নার্ভাস হয়ে আশেপাশে তাকিয়ে দেখি যাবতীয় ছাত্রছাত্রী পাশ কাটিয়ে কলেজ খালি করে ফেলেছে। কেবল আমরাই আছি। সাঈদ একগাল হাসে। সে সম্ভবত খুব মিশুক। আমাকে হাসি বিনিময় করতে না দিয়ে ছেলেটি হ্যান্ডশ্যাকের জন্য হাত বাড়ায়। আমি নিঃসঙ্কোচ হওয়ার চেষ্টা করে হ্যান্ডশ্যাক করি। একে একে প্রতিটি ছেলে নাম বলে পরিচিত হয়। মেয়েদের তুলনায় এরাই আমার প্রতি বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। আমি দেখলাম, সবার শেষের ছেলেটি একভাবেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে শুরুতে আসিয়ার কথায় সাড়া দেয়নি, চলে যেতে চেয়েছিল। আবার কী ভেবে যেন বাকি ছেলেদের সাথে দাঁড়িয়ে পড়েছে। সে কেবল ভ্রূ কুঁচকিয়ে আমার দিকেই তাকাচ্ছে। আমাদের ব্যাচে দেখা সবচেয়ে লম্বা এই ছেলেটি। তার ভঙ্গিমার কিছুই আমি বুঝতে পারলাম না। বুঝার সবচেয়ে দুঃসাধ্যকর বিষয় হলো ছেলেটির রূপ। ছেলেটি অতিরিক্ত সুন্দর। একদম অমানবিক। সন্দেহ হচ্ছে, এই ধরনের অতুলনীয় চেহারাধারী মানুষ এই পৃথিবীতে আছে। ছেলেটি একহাত পকেটে ঢুকিয়ে রেখেছে, আরেক হাত দিয়ে কাঁধে নেওয়া স্টাইলিশ ব্যাগের হাতল ধরে রেখেছে। ভেবেছি, সর্বপ্রথম সেই হ্যান্ডশ্যাকের জন্য হাত বাড়াবে। আসিয়া আমাকে তার সাথে মুখোমুখি করানোর পরও সে একইভাবে ভ্রূ কুঞ্চিত করে তাকিয়ে রইল। আমি একটু হাসার চেষ্টা করেও বিব্রত বোধ করলাম। ছেলেটি যেন আমাকে পড়তে চাইছে। কিন্তু আমার সম্বন্ধে কিছুই জানতে না পেরে সে যেন হতাশ হচ্ছে।
“ও ধ্রুব।” আসিয়া গলা খাঁকার দিয়ে বলল, “সবসময় ধ্রুবই থাকে।”
ধ্রুব নামের ছেলেটি এখন আসিয়ার দিকে তাকালো। জিজ্ঞেসও করল না, শেষের কথাটা সে কেন বলেছে।
আসিয়া আমার প্রশ্নবোধক চোখ দেখে বলল, “মানে ও মেয়েদের ব্যাপারে সবসময় একই থাকে। আজ পর্যন্ত মেয়েদের ফ্রেন্ড বানায়নি। ইউ নো, ফিজিক্স ম্যামও ওকে কন্সটেন্ট বলে ডাকে, সবসময় একই অবস্থায় থাকায়। এক জায়গা থেকে সহজে নড়ে না। নিয়মিত ক্লাসও করে। ভদ্র একটা ছেলে।” ধ্রুবকে বলল, “ও আলিয়া সিকদার। আ.. আমার বোন।”
“বোন? সিকদার?” এতক্ষণে ধ্রুব আগ্রহ দেখাল। আমি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলাম, সে সুরেলা কণ্ঠে কথা বলছে। তার স্বরে কর্কশতা নেই, জড়তা নেই। কেবল আছে মিষ্টত্ব আর পুরুষদের মতো গাম্ভীর্য।
আসিয়াও যেন ‘ওকে’ জবাব দিতে বিরক্ত বোধ করছে না, “আমার বাবার প্রথম স্ত্রীর মেয়ে। আমাদের দু’জনের বয়সে একমাসেরই ডিফারেন্স।”
“তোমাদের চেহারায় সিমিলারিটি কিছুটা আছে বলা যায়।” ধ্রুব মৃদু হাসলো।
এই হাসিটা পরক্ষণে আমার হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দিয়েছে। কারো হাসি এতো সুন্দর কী করে হতে পারে? বাজি ধরছি, সে তার এই হাসি দিয়ে অনেক মেয়েকে বেহুঁশ করতে পারবে। ধ্রুব আশ্চর্যজনক ভাবে সুন্দর এবং আকর্ষণীয়। কেউ এরূপ দেবদূত কীভাবে হতে পারে! সে কোনো এক কারণে আমার দিকেই যতসব দ্বিধা নিয়ে তাকাচ্ছে, যেন আমি কে তা জানার চেষ্টা করছে।
আসিয়া আমাকে হাত ধরে বারান্দার বাহিরে কলেজ গেইটে নিয়ে এলো। আমি একবার ফিরে কৌতূহল নিয়ে পেছনে তাকালাম। বিস্ফারিত চোখে চেয়ে দেখলাম, ছেলেটি ওখানে নেই! কয়েক সেকেন্ড আগেই তো সে ওখানে ছিল। আমি জনমানবশূন্য কলেজটার দিকে হা করে চেয়ে রইলাম। আসিয়া কবে গাড়িতে উঠে গেল খেয়ালই করিনি।
(চলবে…)
লেখা: ফারিয়া কাউছার
[আমার রহস্যময় “পরী” উপন্যাসটা পড়ার পর অনেকেই রিকুয়েস্ট করেছিল, যাতে এই সিরিজের পরবর্তী একটা উপন্যাস লিখি। এজন্যই ‘তিমির’ শুরু করা। হ্যাঁ, এখানে আপনাদের পছন্দের চরিত্র আবির, সাবিলা আরও কয়েকজনকে পাবেন। পাবেন এক অসাধারণ চরিত্র আলিয়াকে, যে কিনা এখানের উত্তম পুরুষ। সে এমন সব কিছু লক্ষ করে কিংবা ধরে ফেলতে পারে, যা সাধারণ মানুষ স্বভাবত এড়িয়ে যায়।
এই সিরিজের গল্প হিসেবে ‘আয়নার ওপাশে’ শুরু করেছিলাম। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে চলমান রাখতে পারিনি। মানে উপন্যাসটা আর লিখিনি। মাস দুয়েক পর ধরেছিলাম। কিন্তু ততদিনে স্বাভাবিকভাবে ওটার অনেক থিমই হারিয়ে ফেলেছি। মাঝে মাঝে আমার একটা রোগ হয়, “আর ভাল্লাগে না”। দোয়া করুন, এক্ষেত্রে যাতে রোগটা না হয়, যাতে ‘তিমির’ সফলভাবে আর রহস্যময় ভাবে শেষ করতে পারি। অবশ্য সবার রেসপন্স পেলেই এগিয়ে নিয়ে যাব।]