তিমিরে ফোটা গোলাপ পর্ব-৪১+৪২+৪৩

0
1040

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৪১
Writer তানিয়া শেখ

ভোরে মোরগ ডাকতেই আগাথার প্রেতাত্মা অদৃশ্য হয়ে গেল ইসাবেলার সামনে থেকে। যাওয়ার পূর্বে তিনি সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন। কাজটা দিনের বেলা এবং দুপুরের আগেই করতে হবে। সেই সময়টাতে আগাথা থাকবে না। সুতরাং যা করার ইসাবেলাকেই করতে হবে। বেশ ভয় করছে ইসাবেলার। প্লানে সামান্য বিচ্যুতি হলেই মহা বিপদ। প্রাণের ঝুঁকি তো শতভাগ আছেই।
বাইরে তখনো আলো ফোটেনি। আগাথা সতর্ক করেছেন আলো ফোটার পরই যেন বের হয় সে। ইসাবেলা সংগ্রহীত হাতিয়ারগুলো আরেকবার দেখে নিলো, কাঠের সূচালো টুকরো, রসুন, ধারালো ছুরি, মোম আর দিয়াশলাই। এই হলো পিশাচ বধের হাতিয়ার। এই অল্প সময়ে এই জিনিসগুলো সংগ্রহ করা ইসাবেলার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আগাথা জোগাড় করেছে মিনিট খানেক সময়ের মধ্যে। কৃতজ্ঞ তাঁর কাছে ও। জিনিসগুলো একটা থলেতে ভরে রাখল। আলো ফোটার অপেক্ষায় বসে রইল বিছানার ওপর। অপেক্ষা করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম ভাঙল মাদাম আদলৌনার আহাজারিতে। কোনোরকমে হুড়মুড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। মাদাম আদলৌনার কান্নার শব্দ বাড়ির পেছনের ফার্ম থেকে আসছে। ইসাবেলা নেমে সেদিকে গেল। নিষ্প্রাণ ঘোড়া আর ভেড়িগুলোর দেহের পাশে বসে কপাল চাপড়ে কাঁদছেন মাদাম। ওদের এই আকস্মিক মৃত্যুতে ইসাবেলাও হতবিহ্বল। মাদামকে জড়িয়ে ধরে ও।

“শান্ত হোন মাদাম।”

“ইসাবেলা, আমার সব শেষ।”

চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন মাদাম। ইসাবেলার চোখে জল চলে এলো। আশপাশের প্রতিবেশিদের কয়েকজন এসে দাঁড়িয়েছে। সান্ত্বনা দিলো মাদামকে তারা। মাদামকে বসার ঘরে নেওয়া হলো। ইসাবেলা পানি এনে দেয়। মাদামের কান্না এখন থেমেছে। একদম গম্ভীর হয়ে আছেন। মুখজুড়ে হতাশা আর বিষাদ। প্রতিবেশিনী তিনজন ভদ্রমহিলা মাদামের পাশে বসে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। তাঁদরেই একজন হা হুতাশ করে বললেন,

“কী যে হয়েছে গাঁয়ে বুঝতে পারছি না! এই তো গতসপ্তাহ থেকে শুরু হয়েছে এই অদ্ভুত মৃত্যুর ঘটনা। সেদিন ও পাড়ার জেভিয়ারের ছোট্ট ছেলেটা মরে গেল। ঘুমানোর আগেও ছেলেটা না কি দিব্যি সুস্থ ছিল। সকালে ওর মা ডাকতে গিয়ে দেখে মরে পড়ে আছে বিছানায়। শরীর সাদাটে হয়ে ছিল। ডাক্তার দেখে বলল, রক্তশূন্যতায় মরেছে। চোখ খোলা ছিল। মৃত্যুর পরেও আতঙ্ক খেলা করছিল ওই চোখে। এরপর প্রতিদিনই কারো বাড়ির সদস্য মরছে নয়তো পশু। আমার বাপু বেজায় ভয় করছে।”

গলার রোজারি(খ্রিস্টানদের জপমালা) আঙুলে নিয়ে বিড়বিড় করে প্রার্থনা করলেন বৃদ্ধা। তারপর বুকে ক্রুশ এঁকে বললেন,

“আজ একবার চার্চে গিয়ে ফাদারের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলে আসি। তিনি যদি এর একটা হাল করতে পারেন। আদলৌনা, তুমিও সাথে চলো।”

সাথের কয়েকজনও তাঁর সাথে সম্মতি জানালেন। ইসাবেলার এখন মনে হলো মাদামের পালিত এই প্রাণীর হঠাৎ মৃত্যুর কারণ ও বুঝেছে। এই কাজ যে ইভারলি আর গ্যাব্রিয়েল্লার তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। ওদের প্রতি রাগটা যেন আরো বাড়ল।

মাদাম আদলৌনা গাঁয়ের এই অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা শুনেছেন আগে। কিন্তু সেভাবে গুরুত্ব দেননি। আজ তাঁর মনে হলো এই গৃহপালিত প্রাণীগুলোর মৃত্যুর পেছনে অশুভ কোনো শক্তির হাত আছে। নয়তো এক রাতের ব্যবধানে এভাবে মরবে কেন প্রাণীগুলো?

প্রতিবেশিনীরা উঠে দাঁড়ালেন। মাদাম সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁদের সাথে যাওয়ার। অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়তে নয়, একটুখানি মনের শান্তির জন্য তিনি চার্চে যাবেন। মাদাম ইসাবেলাকে এদিকটা দেখতে বলে বাড়ি বাইরে বেরিয়ে এলেন প্রতিবেশিনীদের সাথে। প্রাণীগুলোর সৎকার সেড়ে তারপর চার্চের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন।

বাইরে রোদ উঠেছে। প্রচণ্ড শীতের সকালে এই রোদ বড়ো আকাঙ্ক্ষার, প্রশান্তির। আজকের রোদটা কিন্তু সেই অনুভূতি নিয়ে এলো না। বিষণ্ণ আজকের এই সকাল। অস্থিরতায় ভরপুর এর আলো। উপরে উঠে এলো ইসাবেলা। এতকিছু হয়ে গেল মাতভেইর কোনো সাড়াশব্দ নেই। কেন নেই সেটার কারণ ইসাবেলা জানে। ধীর পায়ে মাতভেইর দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। দরজা সামান্য খুলে উঁকি দিলো ভেতরে। গলা পর্যন্ত কম্বলে ঢেকে ঘুমিয়ে আছে মাতভেই। জানালায় পর্দা টানা। ঘরের ভেতরে পর্যাপ্ত আলো এসে পৌঁছেনি। মাতভেইর মুখটা স্পষ্ট দেখতে পেল না। ও ঠিক আছে কি না দেখতে নিঃশব্দে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল। মাতভেইর মুখটা এখন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। ত্বক সাদাটে, ঠোঁট শুকিয়ে গেছে, চোখের নিচে বসে গেছে অনেকখানি। ইসাবেলা যেন নিজেকে দেখছে। সেই যে মাদামের বাড়িতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখেছিল নিজেকে। আজ যেন তেমনই জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে মাতভেই।
নিজের রুমে ফিরে এলো ইসাবেলা। গলায় পরে নেয় রোজারি। হুডি পরে থলেটা কাঁধে তুলে নিচে নামে। দেওয়াল ঘড়িতে পৌনে নয়টা বাজে। ইসাবেলা দরজা বাইরে থেকে এঁটে দিয়ে পেছনের রাস্তা ধরে এগিয়ে গেল। আগাথা বলে দিয়েছে পুব দিকের জঙ্গল পেরোলেই লেক। এককোণের ঝোপের আড়ালে একটা নৌকা বেঁধে রেখেছেন তিনি। ওটা দিয়ে লেকটা পেরিয়ে ওপারে গিয়ে উত্তর দিকে মিনিট পাঁচেক হাঁটলে একটা পুরোনো প্রাসাদ চোখে পড়বে। প্রাসাদের পেছনের দরজা আগে থেকে খুলে রাখবে আগাথা। সেই দরজায় ঝুলিয়ে রাখা থাকবে একটি ম্যাপ। ডাইনি দুটোর কফিন কোন কক্ষে আছে সেটা ভেতরে ঢুকে ম্যাপ দেখলেই বুঝতে পারবে ইসাবেলা।

জঙ্গল পেরিয়ে লেকের সামনে এসে থামল ইসাবেলা। বেশ প্রসস্থ লেকটি। লেকের চারপাশে জমে আছে শুভ্র বরফ। বরফ আবৃত গাছগুলো। সেই ঘন বৃক্ষের এককোণে উঁকি দিচ্ছে সূর্য। বড়ো ম্লান আজকের শীতের সকালে সূর্যের তেজ। ইসাবেলা ঝোপগুলোর ভেতর নৌকা খুঁজতে শুরু করে। কিছুক্ষণ খোঁজার পরই নৌকাটা পেয়ে গেল। কাঁধের থলেটা ওর ওপর রাখল। তারপর ঝোপ থেকে বের করে বরফের ওপর দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে লেকের পানিতে ভাসাল নৌকা। কাজটা করতে গিয়ে বেশ বেগ পেতে হলো। নৌকা চালানোর অভিজ্ঞতা ইসাবেলার নেই। বৈঠা জলে ফেলে চালাতে গিয়ে বুঝল এ কাজ বড়ো শক্ত। হাত ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছে। দাঁতে দাঁত লেগে যায়। কিন্তু হার মানল না। লেক পার হতে ওর অনেক সময় লেগে গেল। ওপারে গিয়ে প্রথমে নৌকাটা বাঁধল তীরে। থলে কাঁধে তুলে পথ চলতে শুরু করল ও৷ দূর থেকেই প্রাসাদের খানিকটা চোখে পড়তে দৌড় পায়ে এগোলো সেদিকে। পলেস্তারা পড়া, আগাছায় জড়ানো প্রাসাদটি। বহু বছর আগের রূপসৌন্দর্য্য হারিয়ে প্রাসাদটি বর্তমানে শ্রীহীন হয়ে গেছে। শ্রী হারালেও এর দর্প এখনো বজায় আছে শক্ত ইটের ভাঁজে।

ইসাবেলা ঘুরতে ঘুরতে প্রাসাদের পেছনের দিকে এলো। অনেকগুলো দরজার মধ্যে আগাথার বলা দরজাটা খুঁজে পেল সহজে। লাল কাপড়ে মোড়া সাদা কাগজটা দূর থেকেই দেখতে পায়। কাগজটা খুলে ম্যাপটা একবার দেখে নিলো৷ তারপর দরজায় আস্তে করে ধাক্কা দিতে সেটা ক্যাচ ক্যাচ শব্দ তুলে খুলে যায়। বহুদিনের পুরোনো জংধরা দরজাটা যে এভাবে শব্দ তুলবে তা অপ্রত্যাশিত ছিল ইসাবেলার কাছে। এতক্ষণে নীরবতার পর এই শব্দে ওর চেপে থাকা আতঙ্ক দপ করে মাথায় উঠে যায়। ত্রস্ত পায়ে প্রাসাদের ভেতরে ঢুকলো। ভ্যাপসা বিশ্রী গন্ধে পেট গুলিতে যায়। হাতটা সাথে সাথে নাক চেপে ধরে। নিকোলাসের প্রথম প্রাসাদটার মতোই এর অবস্থা। বহুদিন হয়তো কোনো মানুষের পদচিহ্ন এখানে পড়েনি। সর্বত্র ধুলো আর ঝুলে ভরা। কিছু আগাছা ভেতরেও অধিকার জমিয়ে নিয়েছে। দরজার এইটুকু ছাড়া সামনের সবটাতে আঁধার। সাথে আনা মোমটা জ্বালিয়ে নেয় ইসাবেলা। ম্যাপে দেখানো হয়েছে বা’দিকে গিয়ে পাঁচ নম্বর কক্ষটির ভেতরে ঢুকতে হবে। কক্ষের এককোণে রাখা কাঠের বাক্সের নিচের কার্পেট সরালেই গুপ্ত রাস্তার দরজা। সিঁড়ি বেয়ে গুপ্ত রাস্তার শেষে নেমে এলেই সংকীর্ণ একটি স্থান। সেখানেই রয়েছে ডাইনি দুটোর কফিন।

ইসাবেলা পাঁচ নম্বর দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে বেশ অবাক হলো। ঝকঝকে পরিষ্কার কক্ষটি। কক্ষের মাঝে আছে বড়ো একটি খাট। চাদর বালিশ সবই নতুন। খাটটা ছুঁয়ে দেখল। আঙুলে একটুও ধুলো লাগেনি। এই রুমে আরো আছে একটি টেবিল, একটি চেয়ার আর আলমিরা। টেবিলে এখনো দোয়াতে চাপা দেওয়া কিছু সাদা কাগজ পড়ে আছে। টেবিলের সামনে থেকে ঘুরে দাঁড়াতে ম্যাপে আঁকা বাক্সটা চোখে পড়ল। তালাবন্ধ বাক্স। খুব ভারী ওটা। সরাতে কষ্ট হলো ইসাবেলার। বাক্সটা সরিয়ে লাল রঙের কার্পেট তুলতেই কাঠের গুপ্ত রাস্তার দরজাটা পড়ল। দরজা একপাশে সরিয়ে দিতে এঁকেবেঁকে নেমে যাওয়া সিঁড়িটা দেখতে পায়। কাঁধের থলেটা শক্ত করে ধরল। লম্বা শ্বাস নিয়ে ডান পা রাখল সিঁড়িতে। একহাতে মোমের আলো। দুরুদুরু বুকে সিঁড়ির এক একটা ধাপ বেয়ে নিচে নামছে। ভয়কে যতই দূরে ঠেলছে সেটা যেন ধীর পদে ওরই দিকে ফিরে আসছে পুনরায়। এই শীতেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের সৃষ্টি হয়েছে। সিঁড়ির শেষ ধাপে নেমে থমকে দাঁড়ায়। নিচের এই সংকীর্ণ জায়গাটাতে ভূতূড়ে আঁধার জমে আছে। নিজের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ গুমোট এই স্থানের দেওয়ালে দেওয়ালে বাড়ি খেয়ে যেন বিকট গর্জন তুলছে। অজান্তেই শ্বাস থেমে যায় ইসাবেলার। হাতের আলোটা কেঁপে ওঠে। ভয় কাটতে কিছু সময় লেগে যায়। মোমের আলো তুলে চোখ বুলিয়ে নিতে কফিন দুটো চোখে পড়ে। থলেটা কাঁধ থেকে নামিয়ে হাতে নিয়ে এগিয়ে যায়। এইটুকু আসতে অনেক সময় চলে গেছে। আর বিলম্ব করলে বিপদ হবে। নিজের ভীরু মনে সাহস সঞ্চয় করে প্রস্তুতি নিলো চূড়ান্ত কাজের। মোমটা একপাশে রেখে থলে থেকে একে একে সব বের করল। তারপর প্রথম কফিনটার মুখ খুলে ফেলে। ইসাবেলা ভয়, আতঙ্ক মুহূর্তে রাগে রূপ নেয়। দৃষ্টি স্থির কফিনে শুয়ে থাকা ইভারলির দিকে। দেখে যেন মনে হচ্ছে পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে ও। হঠাৎ ওর ঘুমন্ত মুখের ভাব বদলে গেল। ইভারলির নিদ্রিত চোখের ওপরের ভ্রু কুঁচকে গেছে। লাল টুকটুকে ঠোঁটের পাশ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে সাদা দাঁত। ইসাবেলা কফিনে ঝুঁকে মুচকি হেসে বলে,

“ইভারলি, আমায় মনে আছে ডার্লিং? ইসাবেল। হ্যাঁ, আমি ইসাবেল। সিস্টার ভ্যালেরিয়ার ভাগ্নি। যাকে খুব মেরেছিলে। তোমার সাথে অনেক হিসেব বাকি আমার। আজ ভাবছি সব হিসেব চুকিয়ে দেবো।”

রাগে লাল হয়ে উঠেছে ইভারলির মুখ। ইসাবেলা ওর মুখে চেয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। অসহায়ত্ব কাকে বলে মর্মে মর্মে বোঝাবে আজ ইভারলিকে। থলে থেকে একটা রসুন বের করে ইভারলির ঠোঁটের মাঝে গুঁজে দিলো। মুহূর্তে ইভারলির রাগ আতঙ্কে রূপ নেয়। করুণ হয়ে যায় মুখটা। ইসাবেলার ওর প্রতি একটুও করুণা হলো না। এই সুন্দর করুণ মুখের মুখোশের আড়ালের রয়েছে এক ভয়ংকর ডাইনি। জাগামাত্রই যে ইসাবেলাকে শেষ করে ফেলতে এক সেকেন্ড দেরি করবে না। গভীর শ্বাস নিয়ে কাঠের টুকরোটা তুলে নেয় ইসাবেলা। বসিয়ে দেয় ইভারলির হৃদপিণ্ড বরাবর। ইভারলির নিথর দেহ ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে সাথে সাথে। দ্রুত ছুরিটা দিয়ে ধড় থেকে মাথাটা আলাদা করে ফেলে। মোমটা তুলে এনে ওর ছিন্ন দেহের দিকে নিতে ইভারলির মুখটা যেন দয়া ভিক্ষা করে। ইসাবেলা ক্ষণিকের জন্য থেমে যায় ওই অসহায় মুখে চেয়ে। পরমুহূর্তে মনে পড়ে ইভারলির নিষ্ঠুরতা। মোমের আগুন ইভারলির সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। এই আঁধার সংকীর্ণ জায়গাটা আগুনের লেলিহান শিখায় আলোকিত হয়ে ওঠে। পুড়ে ছাইয়ে রূপান্তরিত হয় ইভারলি। ইসাবেলা পরের কফিনের মুখ সরিয়ে নিরাশ হয়, সাথে ভীত। এই কফিন শূন্য। গ্যাব্রিয়েল্লা তবে কোথায়?

চলবে,,,

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৪২
Writer তানিয়া শেখ

প্রচন্ড উত্তেজনায় কাঁপছে ইসাবেলার সর্ব শরীর। যে মেয়েটি ক্ষতিকর মশা-মাছি ছাড়া কোনো প্রাণী হত্যা করেনি, আজ সে কি না এক ডাইনি বধ করে এসেছে! ডাইনি হলেও তো ওর রূপ মানবীয়। শক্ত করে মুষ্টিযুদ্ধ দু-হাতের দিকে তাকাল। ইসাবেলার পবিত্র মন এই ঘটনা কিছুতেই সহজভাবে নিতে পারছে না। অনুভূতিরা সব জমে আছে বরফের ন্যায়। জীবন ওকে এ কোন মোড়ে এনে ছাড়ল? এই মোড়ে না আনলেই কি হতো না? ইভারলিকে ওকেই কেন মারতে হলো? ইসাবেলার কান্না আসছে না। বুকের ভেতর ভার হয়ে আছে। বারবার চোখে ভাসছে ইভারলিকে মারার ঘটনা। এখনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, ওমন নিষ্ঠুরভাবে কাওকে ও শেষ করেছে। মনটা স্তব্ধতায় ঢেকে আছে। হাতদুটো পেছনে আড়াল করে নিলো। উদভ্রান্তের মতো বেরিয়ে এলো প্রাসাদ থেকে। গ্যাব্রিয়েল্লার কথা সেই মুহূর্তে আর মনে পড়ল না। একপ্রকার দৌড়ে গেল লেকের দিকে। ওর দমবন্ধ হয়ে আসছে এখানে৷ থলে নৌকায় ফেলে নৌকা লেকের জলে ভাসালো। বৈঠা চালাতে গিয়ে বার বার হাত ফসকে যায়। কোনোরকমে লেকের এ পাশে এসে থলে কাঁধে তুলে দৌড়াতে লাগল সামনে৷

মাদাম আদলৌনা চার্চ থেকে ফিরছিলেন। হাতে ফাদারের দেওয়া পবিত্র জলভর্তি পাত্র। বাড়ির কাছাকাছি আসতে থেমে দাঁড়ালেন ইসাবেলার ফ্যাকাশে, বিপন্ন মুখ দেখে। ইসাবেলা অন্যমনস্ক হয়ে বাড়ির দিকে এগোচ্ছিল। মাদামকে প্রথমে খেয়াল করেনি।

“ইসাবেলা?”

নিকটে আসতে মাদাম আদলৌনার ডাকে চেতনা ফেরে। ক্ষণিক থমকে দাঁড়িয়ে রইল। ক্রমেই ওর মুখের ভাব বদলে যেতে লাগল। আতঙ্কিত হয়ে ওঠে ও। দৌড়ে এলো মাদামের কাছে। তাঁকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হাত ধরে টেনে বাড়ির ভেতর নিয়ে এলো। দরজা ভেতর থেকে এঁটে দিয়ে ছুটল কিচেনে। মাদাম ওর এই আচরণে বিস্মিত হলেন। কিছুক্ষণ পরেই বেরিয়ে এলো ইসাবেলা। হাতে এক ঝুড়ি রসুন। ঝুড়িটা মেঝেতে রেখে হড়বড়িয়ে বলল,

“মাদাম, সুই আর সুতো নিয়ে আসুন।”

বিস্ময় পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠেননি মাদাম। সহজ গলায় জিজ্ঞেস করলেন,

“কেন? আর এই রসুন দিয়ে কী করবে?”

“পরে বলছি, আগে সুই সুতো আনুন প্লিজ।”

সুই সুতোর বাক্সটা বসার ঘরের এককোণে রাখা সেলফেই ছিল। পবিত্র জলের পাত্রটা টেবিলে রেখে মাদাম এনে দিলেন সুই সুতো। পালিত প্রাণীগুলোর আকস্মিক মৃত্যুতে তাঁর মনটা এমনিতেই ভীষণ খারাপ। খানিকক্ষণ একা, নীরবে থাকতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু
এখন ইসাবেলার এই অদ্ভুত আচরণে বিরক্তই হচ্ছেন। ইসাবেলা সুই সুতো নিয়ে রসুনের মালা তৈরি করছে। তাড়াহুড়োতে ওর আঙুলে সুই ঢুকে রক্ত বের হলো। ব্যথায় “উহু” করে উঠল। মাদাম চুপচাপ দাঁড়িয়ে এই পাগলামি দেখতে পারলেন না। ওর হাত থেকে রসুনের মালাটা টেনে নিয়ে রাগত গলায় বললেন,

“কী করছ এসব? হয়েছে কী?”

ইসাবেলা মাদামের মুখের দিকে কিছুসময় ভাবলেশহীন চেয়ে রইল। তারপর হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠল দুহাতে মুখ ঢেকে। মাদাম আদলৌনার দৃষ্টি নরম হলো। কাছে এসে ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দিলেন।

“মাদাম, আমার ভয় করছে।”

ইসাবেলার এই ভয় কেবল মৃত্যুকে ঘিরে নয়। নিজের পবিত্র সত্ত্বাকে হারিয়ে ফেলার ভয়, মাদাম আর মাতভেইর জীবনে করুণ পরিণতি দর্শনের ভয় ওকে কাতর করে তুলেছে। ভয়কে জয় করতে গিয়েও পরাজিত হয়ে ফিরেছে। এই পরাজয়ের গ্লানি ওকে কাঁদিয়ে ছাড়ে। দুর্বল হয়ে পড়ে আগের চাইতে বেশি। মাদাম আদলৌনা ভাবলেন প্রতিবেশিনীর কথাতে বুঝি ভয় পেয়েছে মেয়েটা। যে সান্ত্বনা নিজেকে দিতে পারেননি তাই ওকে দিলেন,

“ওসব শোনা কথায় ভয় পেলে হয় না কি? ভয় পেয়ো না। ওগুলো ভিত্তিহীন কথা। ওসবের সত্যতা নেই।”

ইসাবেলা মাদামকে বুঝাতে চাইল নিজের ভয়ে কারণ, কিন্তু এই মুহূর্তে ওর মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোলো না। মাদাম ওর চোখ মুছিয়ে দিলেন।

“নাস্তা করেছে?”

দুদিকে মাথা নাড়ায় ইসাবেলা।

“মাতভেই?” পুনরায় প্রশ্ন করলেন মাদাম।

“না।”

মাদাম উঠে কিচেনে গেলেন। ইসাবেলা একদৃষ্টে চেয়ে রইল মেঝের দিকে। ঘড়ির পেন্ডুলামের ঢং ঢং শব্দে চমকে ওঠে। ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল ফের। অর্ধেক বানানো রসুনের মালাটা হাতে তুলে নিলো। মাদাম নাস্তার ট্রে হাতে ওর সামনে এসে বসলেন। টোস্ট, ডিম পোচ আর কফির দিকে ফিরেও তাকাল না ইসাবেলা। মাদাম রসুনের মালার দিকে চেয়ে বললেন,

“এটা দিয়ে কী হবে?”

“ডাইনির পথ রোধ হবে।”

মাথা না তুলে থমথমে গলায় জবাব দিলো ইসাবেলা। মাদাম ভুরু কুঁচকালেন।

“ডাইনি?”

ইসাবেলা সে-কথার জবাব না দিয়ে মালা তিনটে থলেতে ভরে নিলো। হাতে নিলো কিছু রসুন আর থলেটা। দাঁড়িয়ে বলল,

“আসুন আমার সাথে।”

“নাস্তা করবে না?”

“এখন ওসবের সময় নেই।”

ইসাবেলা সিঁড়ির দিকে পা বাড়ায়। মাদাম বড়ো বিভ্রান্তবোধ করছেন আজ। কিচেনে গিয়ে মাতভেইর নাস্তার ট্রে হাতে করে ওপরে এলেন। মাতভেইর রুমে এসে তাঁর হৃদপিণ্ড থেমে যাওয়ার উপক্রম। বিছানায় শুয়ে থাকা ছেলের মুখে চেয়ে স্তম্ভিত। গতকালও মাতভেইকে তিনি সুস্থ দেখেছেন। একরাতের ব্যবধানে ছেলের স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছে, মুখ সাদাটে হয়ে গেছে। ট্রে’টা টেবিলে রেখে ছেলের পাশে বসলেন মাদাম।

“মাতভেই, মাতভেই।”

পিটপিট করে দুর্বল চোখের পাতা খুললো মাতভেই। অস্ফুটে জবাব ডাকল,

“মা, মা।”

“বাছা আমার! এ কী হয়েছে তোর?”

কাঁদো কাঁদো হয়ে গেলেন মাদাম আদলৌনা। মাতভেই উঠে বসার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। মাদাম বসতে সাহায্য করলেন। মাতভেইর নজর তখন গেল জানালায় দাঁড়ানো ইসাবেলার দিকে৷ জানালার কাচে কিছু ঘষছে ও।

“কী করছ বেল?” ইসাবেলা শুনতে পেল না ওর ভগ্ন গলার স্বর। মায়ের দিকে তাকাল মাতভেই। মাদাম আদলৌনার মনে পড়ে জেভিয়ারের ছেলের কথা। পুত্রহারানোর ভয় পেয়ে বসল তাঁকে। হাওমাও করে কাঁদতে শুরু করলেন এবার। মাতভেই কিছুতেই মাকে শান্ত করতে পারছে না। অন্যদিকে ইসাবেলা জানালায় কী সব করছে। এত যে ডাকছে মেয়েটা সাড়া দিচ্ছে না। ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে এলো শরীর। মায়ের হাতটা কোলে নিয়ে চোখ মুদে বিড়বিড় করে বলে,

“কেঁদো না মা, কেঁদো না।”

জানালা আর দরজায় রসুন ঘষে মাতভেইর কাছে এসে দাঁড়ায় ইসাবেলা। মাদাম আদলৌনা সিক্ত চোখে তাকালেন ওর মুখে তারপর ওর হাতের রসুনের মালার দিকে। ইসাবেলা হাতের মালাটা গলায় পরিয়ে দিতে চকিতে তাকাল মাতভেই।

“এ কী!” বিরক্তি এবং বিস্ময় দুটোই স্পষ্ট মাতভেইর গলার স্বরে। টেনে ছিঁড়ে ফেলতে গেলে ধমকে ওঠে ইসাবেলা,

“খবরদার ওটা যদি ছিঁড়েছ! এটা গলায় থাকলে ডাইনিটা তোমার ধারের কাছে আসবে না।”

মাতভেইর চোখ বড়ো হয়ে যায়।

“কীভাবে জানলে?”

“গতরাতে সব দেখেছি। তাছাড়া আমিও একদিন তোমার জায়গায় ছিলাম মাতভেই। আমার গল্পটা অন্যদিন একদিন বলব। আজ আমাকে বিশ্বাস করে যা বলি শোনো প্লিজ। শুনবে তো?”

মাতভেইর চোখ ছলছল করে। মাথা নাড়িয়ে বলে,

“হ্যাঁ, শুনব। আমি মরতে চাই না বেল। আমাকে প্লিজ বাঁচাও।”

ইসাবেলা হাঁটু মুড়ে বিছানার পাশে বসে। ওর হাতটা ধরে বলে,

“আমাকে বিশ্বাস করো মাতভেই?”

“হ্যাঁ।”

“তবে বিশ্বাস রাখো, তোমাকে আমি মরতে দেবো না। তোমাদের আমি মরতে দেবো না।” মাদামের সিক্ত চোখে চেয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে বলল ইসাবেলা।

সারাটাদিন উদ্বিগ্নতায় কেটেছে তিনজনের। ইভারলিরকে শেষ করার ঘটনা শুনে মাতভেই এবং মাদাম আদলৌনা কিছুটা স্বস্তি পেয়েছেন। কিন্তু বিপদ এখনো মাথার ওপর। ইসাবেলা প্রাসাদের নিচটা ভালো করে খুঁজেও গ্যাব্রিয়েল্লার কফিন পায়নি। ইসাবেলা জানে গ্যাব্রিয়েল্লা আজ আবার আসবে মাতভেইর রুমে। প্রথমে ভেবেছিল ওরা বুঝি কেবল মাতভেইকে মারতে চায়। কিন্তু না, ওরা মাতভেইকে ওদের অন্ধকার জগতে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। গ্যাব্রিয়েল্লা যে কোনো মূল্যে এই পরিকল্পনা সফল করতে চাইবে। ইসাবেলা রাত হওয়ার অপেক্ষা করছে। বসার ঘরের পেন্ডুলাম বেজে ওঠে আবার। জানান দেয় মধ্যরাত হওয়ার। বসে বসে ঝিমুনিভাব এসেছিল ইসাবেলার। পেন্ডুলামের শব্দে সজাগ হয়। বিছানায় ঘুমিয়ে আছে মাতভেই। মাদামও বসে ঢুলছেন। তাঁর গলায় দ্বিতীয় রসুনের মালাটা। শেষটা এখনো থলেতে। সারাদিন কিছু খায়নি ও। পেট গুড়গুড় করছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। সারাদিন কেউ ই এই রুম ছেড়ে বেরোয়নি। মাতভেইর জন্য আনা খাবার দুপুরেই শেষ করেছে ও। এক ফোঁটা পানি নেই গ্লাসে। ইসাবেলা উঠে দাঁড়ায়। দরজার কাছে গিয়ে আবার ঘুরল। কী ভেবে থলেটা কাঁধে নিলো। সাহস বাড়ল এতে। মাদামকে আস্তে করে ডাকল,

“মাদাম, মাদাম।”

ধড়ফড়িয়ে উঠতে গেলেন মাদাম। ইসাবেলা চট করে তাঁকে শান্ত করল।

“হুঁশ। মাতভেই জেগে যাবে মাদাম।”

“কী হয়েছে?” আর্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন মাদাম। ইসাবেলা বলল,

“আমি নিচ থেকে পানির জগটা আনতে যাচ্ছি। আপনি ভেতর থেকে দরজা দিয়ে বসুন। আমি না ডাকলে খুলবেন না কিন্তু।”

ইসাবেলা দরজা খুলে মাথা বাড়িয়ে করিডোর দেখে নিলো। আজ কড়িডোরে আলো জ্বালানো হয়নি। ঘুটঘুটে আঁধার জমে আছে। মোমটা জ্বালিয়ে নিলো। মনে মনে ঈশ্বরের নাম নিয়ে বেরিয়ে এলো কড়িডোরে। মাদাম আদলৌনা দরজা লাগাবেন তখনই ইসাবেলা বলল,

“গলা থেকে রসুনের মালা খুলবেন না ভুলেও। আর হ্যাঁ, জানালাও খুলবেন না।”

“ঠিক আছে। তুমি তাড়াতাড়ি এসো মা।”

“আমি যাব আর আসব। দরজা লাগিয়ে দিন এখন।”

মাদাম দরজা লাগিয়ে দিতে ইসাবেলা মোমের আলো হাতে সাবধানে নেমে এলো নিচে। প্রথমেই হ্যাজাকটা জ্বালালো। তারপর কিচেনে থাকা সকালের তৈরি টোস্ট আর ডিম গপাগপ গিলে পানি পান করে। জগটা ভরে হ্যাজাক হাতে কিচেন থেকে বেরিয়ে আসতে দপ করে সদর দরজা খুলে গেল। প্রবল বেগে দমকা হাওয়া ঢুকল খোলা দরজা দিয়ে। ইসাবেলার বিপদ টের পেয়ে দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে পা বেঁধে হুড়মুড়িয়ে পড়ল। হাতের হ্যাজাকটা গড়িয়ে পড়ে নিচে। জগটা পড়ে পানি ছড়িয়ে পড়ল সিঁড়িতে। ব্যাগটা কাঁধ থেকে খসে পড়ে। ইসাবেলা উঠে দাঁড়ায় সিঁড়ির রেলিং ধরে। হ্যাজাকটা নেবে বলে ব্যাগটা রেখে নিচে আসতে হাতটা গলার কাছে গেল। গলা শূন্য। রোজারি নেই। ভয়ে ওর জানটা লাফ দিয়ে গলায় কাছে চলে এলো৷ দ্রুত ঘুরে দাঁড়ায়। ওই তো সিঁড়িতে ছিঁড়ে পড়ে আছে রোজারি। সিঁড়ির দিকে পা বাড়াতে কেউ পেছন থেকে ওর চুলের মুঠি চেপে ধরে শূন্যে তুলে ছুঁড়ে ফেলে সদর দরজার মুখে।

“আহ!”
আর্তনাদ করে ওঠে ইসাবেলা। ওর আর্তনাদের শব্দ ঢাকা পড়ে যায় গ্যাব্রিয়েল্লার হাসির খিলখিলানিতে। ইসাবেলা মুখ তুলতে সামনে একজোড়া পলিশ করা জুতো দেখতে পায়। ভেবেছিল নিকোলাস, কিন্তু নিকোলাস নয় ওর সামনে দাঁড়িয়ে রিচার্ডের ভয়ংকর পিশাচমূর্তি।

চলবে,,,

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৪৩
Writer তানিয়া শেখ

হঠাৎ থেমে গেল দমকা হাওয়া। অশান্ত প্রকৃতি এখন শান্ত। নির্মম নীরবতা ভাঙল ইসাবেলার ক্লেশিত কাতরানিতে। ওর ঘাড় ধরে টেনে তুললেন রিচার্ড। তারপর গলা চেপে ধরে কর্কশ গলায় বললেন,

“বড্ড সাহস দেখিয়েছো মেয়ে। কী ভেবেছিলে আমরা টের পাব না ইভারলিকে তুমি শেষ করেছ?”

ইসাবেলার মুখটা আরো ভীত হয়ে ওঠে। প্রাণপণে চেষ্টা করে রিচার্ডের হাত থেকে নিজেকে ছাড়াতে। রিচার্ড ওর গলা আরো জোরে চেপে ধরেন। দম বন্ধ হয়ে আসে ইসাবেলার।

“আমার ছেলেকে পইপই করে বলেছিলাম, মেরে ফেল এই মেয়েকে। শোনেনি আমার কথা। তোর মতো তুচ্ছ মেয়ের জন্য ও আমার কথা অমান্য করেছে।”

“ভালোবাসে আমাকে ও। নিকোলাস ভালোবাসে আমাকে।”
সাহস করে মিথ্যে কথা বলল ইসাবেলা। কথাগুলো কিন্তু পুরোপুরি মিথ্যা নয়। ওর প্রতি নিকোলাসের ফিলিংস আছে। নিজে মুখে স্বীকার করতে শুনেছে ইসাবেলা। আজ সেই কথাগুলোকে আশ্রয় করে বিপদমুক্ত হতে চাইল। ভেবেছিল ছেলে ভালোবাসে জানার পর রিচার্ড ওর ক্ষতি করতে দু বার ভাববে। কিন্তু হলো উলটো। প্রচন্ড রেগে গেলেন রিচার্ড। পেছনে গ্যাব্রিয়েল্লার হাসি থেমে যায়। ফোস ফোস করছে ও। রিচার্ড গলায় আরো জোরে চাপ দিতেই মুখ নীলচে হয়ে উঠল ইসাবেলার। চোখের সামনে অন্ধকার দেখে। রিচার্ডের হাত হঠাৎ ঢিলে হয়। ছেড়ে দেয় ইসাবেলাকে। মেঝেতে উবু হয়ে পড়ল।
খুক খুক করে কাশছে। স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে শ্বাস-প্রশ্বাস। রিচার্ড ওর দিকে ঝুঁকে বলে,

“নিকোলাস তোমাকে ভালোবাসে?”

মাথায় নাড়ায় ইসাবেলা। হো হো করে হেসে ওঠেন রিচার্ড। ওর হাসি দেখে গ্যাব্রিয়েল্লাও হাসে। রিচার্ড হাসতে হাসতে বলে,

“আমার জীবনে শোনা বেষ্ট জোকস।”

“বোকার স্বর্গে বাস করছিস। কোথায় নিকোলাস আর কোথায় তুই। তোর মতো মেয়েকে বড়োজোর একরাত বিছানায় রাখবে, কিন্তু ভালোবাসবে? হা হা হা, ভেরি ফানি।”

গ্যাব্রিয়েল্লার বিদ্রুপ দাঁতে দাঁত কামড়ে সহ্য করে ইসাবেলা। রিচার্ডের দিকে চেয়ে বলে,

“আমার কথা বিশ্বাস না হলে নিকোলাসকে ডাকুন। ও নিজেই স্বীকার করবে আমাকে ও ভালোবাসে।”

কথাগুলো বলে মনে মনে পস্তালো। এখন যদি সত্যি নিকোলাস আসে তখন কী হবে? কিন্তু এটাই ও চাচ্ছে। ওর বিশ্বাস নিকোলাস এলে অন্তত প্রাণে বেঁচে যাবে।

“বোকা তুমি। নিকোলাস কাওকে ভালোবাসে না, বাসতে পারে না। ওর মধ্যে সেই ফাংশনই নেই।” রিচার্ড বললেন। ইসাবেলা জোর গলায় বলে,

“এটা আপনার ভুল ধারণা। হতে পারে জীবন্মৃত কিন্তু ওর হৃদয় আছে। প্রতিটি হৃদয়ই কারো না কারো জন্য স্পন্দিত হয়। কাওকে না কাওকে ভালোবাসে। নিকোলাস হৃদয়হীন নয়।”

“নিকোলাস হৃদয়হীন। এই যে তোমার সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি এটাই তার প্রমাণ। তোমাকে মারতে ও আমাদের পাঠিয়েছে। ইভারলির হত্যার প্রতিশোধ নিতে পাঠিয়েছে আমাদের নিকোলাস।”

ইসাবেলা উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

“মিথ্যা কথা। আপনি মিথ্যা বলছেন।”

“সত্যি বলছে রিচার্ড। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে এ কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করবি তুই। বিশ্বাস করিয়েই ছাড়ব। নিকোলাস তোকে ভালোবাসে এই ভ্রম তোর মরণকালে কাটবে।”

গ্যাব্রিয়েল্লার ঠোঁটে ক্রূর হাসি। সাদা চকচকে শ্বদন্ত বেরিয়ে এলো। রিচার্ড সদম্ভে বসল বসার ঘরের সিঙ্গেল সোফাটাতে। মাথা নাড়িয়ে ইশারা করতে গ্যাব্রিয়েল্লা ইসাবেলার কাঁধে সমস্ত চাপ দিয়ে বলে,

“হাঁটু মুড়ে বস।”

ব্যথায় ককিয়ে উঠলেও সে কথা মানে না ইসাবেলা। গ্যাব্রিয়েল্লা রাগে হিসহিসিয়ে ওঠে।

“বস হারামজাদি, বস।”

“না।” শির উন্নত করে জবাব দেয় ইসাবেলা। রিচার্ডের চোয়াল শক্ত হয়। পরক্ষণেই ঠোঁটের কোণা বেঁকে যায় কপট হাসিতে।

“তোমার নামটা যেন কী মেয়ে?”

ইসাবেলা জবাব দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করে না। গ্যাব্রিয়েল্লা ওর উন্নত শির সজোরে চেপে ঝুঁকিয়ে দিয়েছে, কিন্তু হাঁটু মুড়ে বসাতে পারেনি। এত জোর ইসাবেলা হঠাৎ কোথা থেকে পেল কে জানে!রিচার্ড দুচোখ বন্ধ করেন। ইসাবেলা লক্ষ্য করে সেই সময় তাঁর বা’হাতের তর্জনী চক্রাকারে ঘুরছে। সেকেন্ড খানিকের মধ্যে রক্তিম চোখজোড়া মেলে তাকালেন ওর দিকে। একটু ভাবুক হলেন। তারপর বললেন,

“ইসাবেলা, ইসাবেলা, চমৎকার নাম তোমার। তবে নামের মতো তোমার ভাগ্য চমৎকার না। এই অল্প বয়সে দুনিয়ার মায়া ছাড়তে হবে। আমার বড্ড খারাপ লাগছে তোমার জন্য। একটু করুণা করতে ইচ্ছে করছে। বাঁচতে চাও ইসাবেলা?”

“আমাকে ছেড়ে দিন প্লিজ।”

“বাঁচতে চাও ইসাবেলা?” আবারো একই প্রশ্ন করলেন রিচার্ড। সম্মোহনী তাঁর গলার স্বর। মরতে কে চায় এই ভুবনে? শত কষ্টেও মানুষ বাঁচতে চায়। এই রঙিন দুনিয়ার মোহমায়া কাটানো বড়ো শক্ত।

“হ্যাঁ, আমি বাঁচতে চাই। ছেড়ে দিন আমাকে।” জড়ানো গলায় জবাব দেয় ইসাবেলা। রিচার্ড বললেন,

“আমার সামনে হাঁটু মুড়ে প্রাণ ভিক্ষা চাও। বলো, ‘আমার প্রাণ ভিক্ষা দিন প্রভু।’ নত করো তোমার মাথা।”

ইসাবেলা রাজি হয় না। রিচার্ড হাসলেন।

“গ্যাবি, যা তোর শিকার ধরে আন। ওই রাঁধুনিকেও সাথে নিয়ে আসবি। প্রথমে ওদের রক্ত পান করব তারপর এই মেয়ের। আগামীকাল তিনটে লাশ দেখবে এই গাঁয়ের লোক।”

গ্যাব্রিয়েল্লা মুচকি হেসে ইসাবেলাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে অদৃশ্য হয়ে যায়। ইসাবেলার হাঁটুর চামড়া ছিঁড়ে রক্ত পড়ছে। রিচার্ড বুভুক্ষু চোখে চেয়ে রইল ওর পায়ের দিকে। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,

“এখনো সময় আছে আমার কথা শোনো ইসাবেলা। আমি তোমাকে নতুন জীবন দেবো। যে জীবনে ভয় নেই, মৃত্যু নেই। যে জীবনে তুমি পাবে অসীম ক্ষমতা। মেনে নাও আমার দাসত্ব।”

“না না, ওই অভিশপ্ত জীবন আমি চাই না। আপনার মতো পিশাচের দাসত্ব করার চেয়ে মরণ ভালো।”

“কিন্তু আমি যে তোমাকে সেই মরণ আর দেবো না ইসাবেলা। তোমাকে আমি আমার অন্ধকার জগতে চাই। আমার দাসী হওয়ার সৌভাগ্যকে অবজ্ঞা করো না বোকা মেয়ে।”

ঘৃণায় নাক কুঁচকে ফেলে ইসাবেলা।

“আমি এক ঈশ্বরের দাসত্ব ছাড়া আর কারো দাসত্ব করি না করব না।”

ব্যথা গিলে উঠে দাঁড়াল। রিচার্ড কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন। গ্যাব্রিয়েল্লার দৃশ্যমান ক্ষুব্ধ চেহারা দেখে থেমে গেলেন।

“কী হয়েছে?”

“এই হারামজাদি ওদের গলায় রসুনের মালা পরিয়ে দিয়েছে। ওদের ধারের কাছে যেতে পারছি না। আজ আমি একে শেষ করে ফেলব।” গ্যাব্রিয়েল্লা হাওয়ার বেগে ছুটে আসতে ইসাবেলা দৌড়ে সিঁড়িতে ওঠে। কিন্তু বেশিদূর যেতে পারে না। ওর পা টেনে ধরে গ্যাব্রিয়েল্লা। হুমড়ি খেয়ে সিঁড়ির ওপর পড়ে ইসাবেলা।

“ছেড়ে দাও আমাকে।”

“ছেড়ে দেবো? ইভারলির পাশে আমাকে পেলে ছেড়ে দিতি? ভাগ্যিস রিচার্ডের কক্ষে ছিলাম। নয়তো ইভারলির মতো আজ আমাকেও মেরে ফেলতি। আবার আমার শিকারকে বাঁচিয়ে দেওয়া প্লান করেছিস, হুম? দেখে তো মনে হয় ভাজা মাছ উলটে খেতে পারিস না৷ এমন ন্যাকা সেজে নিকোলাসের মন ভুলানোর চেষ্টা করেছিলি? মনে রাখ, নিকোলাস আমার। আমি ওর সহচরী। তুই কেবল একটা মানুষ যাকে ও খাবার হিসেবে চায়, সঙ্গী হিসেবে না।”

ইসাবেলার পা ধরে শূন্যে ছুঁড়ে ফেলে দিলো। কিচেনের পাশের দেওয়ালে আছড়ে পড়ে চিৎকার করে উঠল ইসাবেলা। গ্যাব্রিয়েল্লা চূড়ান্ত আক্রমণ করতে যাবে তখনই রিচার্ড বলে ওঠেন,

“ওকে একেবারে মারবি না গ্যাবি।”

রিচার্ডের জ্বলন্ত চোখে চেয়ে হাঁপ ছেড়ে অসন্তোষের সাথে বলে,
“ঠিক আছে, ঠিক আছে। এক ইভারলি যেতে না যেতে আরেকটার আগমন। আবার সবকিছুতে ভাগ বাটোয়ারা করতে হবে। এই মেয়ের সঙ্গে ভাগাভাগি ঘৃণা করি আমি। ঘৃণা করি একে।”

ইসাবেলা উপুড় হয়ে পড়ে আছে দেয়ালের পাশে। গ্যাব্রিয়েল্লা ভাবল জ্ঞান হারিয়েছে। রাগত মুখে ঝুঁকে ওর চুল টেনে ধরে মুখোমুখি আনে। কপাল ফেটে রক্ত গড়াচ্ছে। লোভে জিহবা লকলক করছে গ্যাব্রিয়েল্লার। ইসাবেলার রক্তাক্ত কপাল জিহবা দিয়ে চাটতে শুরু করে। ঠিক সেই সুযোগে ইসাবেলা চোখ মেলে তাকায়। হাতে লুকানো কাঠের টুকরোটা বসিয়ে দেয় ওর হৃদপিণ্ড বরাবর। আর্তনাদ করে ওঠে গ্যাব্রিয়েল্লা। দূরে ছিটকে যায়। ইসাবেলা কালক্ষেপণ করে না৷ রসুনের মালাটা পরে নেয়। ব্যাগের পাশে পড়ে থাকা রসুন আর ছুড়ি হাতে দৌড়ে যায় গ্যাব্রিয়েল্লা দিকে। গ্যাব্রিয়েল্লা সিঁড়ির ওপর থেকে ছুঁড়ে ফেলার পূর্বে ব্যাগটা তুলে নিয়েছিল বুকের সাথে। গ্যাব্রিয়েল্লাকে ছাড়বে না ও। যন্ত্রণা ছটফট করছে গ্যাব্রিয়েল্লা। ইসবেলার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে৷ রক্তে মুখ ভিজে গেছে। মাথা ঝাঁকিয়ে টলতে টলতে এসে থামে গ্যাব্রিয়েল্লার পেছনে। ওর চুলের মুঠি চেপে হাঁটু ওপর বসায়। তারপর গলা পেঁচিয়ে ধরে বা’বাহু দ্বারা। ওর এই রূপ দেখে রিচার্ড লাফিয়ে ওঠেন সোফা থেকে। চিৎকার করে বলেন,

“খবরদার ইসাবেলা, ভালোই ভালোই বলছি ছেড়ে দাও ওকে।”

ইসাবেলা যেন কিছুই শুনতে পায়নি৷ অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফটরত গ্যাব্রিয়েল্লার ঠোঁটের মধ্যে পুরে দেয় রসুনটা। ছুড়ি চালিয়ে দেয় ওর গলায়। রিচার্ড বার বার নিষেধ করছে৷ ইসাবেলার গলার রসুনের মালা তাঁকে কাছে আসতে বাধা দেয়। এই অসহায়ত্বে গর্জন করতে লাগলেন। ইসাবেলার কোনো দিকে যেন হুঁশ নেই। যতদূত আশ্রয় নিয়েছে বুঝি ওর মধ্যে। চোখ দু’টো স্থির, মুখ কঠিন। গ্যাব্রিয়েল্লার শিরশ্ছেদ করে চুল ধরে শিরটা তুলে রিচার্ডের দিকে চেয়ে বলে,

“আমি বাঁচতে চাই, কিন্তু ভিক্ষার জীবন নিয়ে নত হয়ে না। আমি বাঁচতে চাই শির উন্নত করে।”

রিচার্ডের কুপিত মুখে দৃষ্টি অনড় রেখে অপ্রকৃতস্থের মতো মুচকি হেসে গ্যাব্রিয়েল্লার ছিন্ন মাথাটা ছেড়ে দেয়। দপ করে ওটা মেঝেতে পড়ে। হাঁটু মুড়ে বসে আছে গ্যাব্রিয়েল্লার মাথা বিহীন শরীর। রিচার্ডের দিকে চেয়ে গ্যাব্রিয়েল্লার দেহের সামনে এসে দাঁড়ায়। পা দিয়ে আঘাত করে ফেলে দেয় মাথা বিহীন গ্যাব্রিয়েল্লার দেহ। অপমানে দুচোখ বন্ধ করে রিচার্ড। চোখ মেলতে দেখে ইসাবেলার হাতে দিয়াশলাই। ওটাতে আগুন জ্বালাতেই সদর দরজায় উপস্থিত হয় উদ্বিগ্ন চেহারার নিকোলাস। ইসাবেলাকে জীবিত দেখে উদ্বিগ্নতা খানিক কাটলেও মেঝেতে পড়ে থাকা ছিন্ন দেহ ওকে বাকরুদ্ধ করে দেয়। পাশে দাঁড়ানো রিচার্ড চেঁচিয়ে ওঠেন,

“দেখো নিকোলাস, দেখো তোমার দয়ায় বেঁচে যাওয়া এই মেয়ে কী করেছে। নিষেধ করেছিলাম ওকে বাঁচিয়ে রাখতে। শোনোনি তুমি। তোমার ভুলে ইভারলি আর গ্যাব্রিয়েল্লাকে হারাতে হলো আজ। একদিন আমাদের সবাইকে ও এভাবে শেষ করবে। প্রমাণ করে দিয়েছে ও সিস্টার ভ্যালেরিয়ার ভাগ্নি। এখনো সময় আছে মেরে ফেলো এই মেয়েকে, মেরে ফেলো।”

পিতার কথা শুনে ক্রোধে জ্বলতে লাগল নিকোলাসের দৃষ্টি। ইসাবেলা সেই দৃষ্টিতে চেয়ে কেঁপে উঠল কিন্তু একচুল পিছু হটল না। নিকোলাসকে আজ ও শিক্ষা দেবে। বুঝিয়ে দেবে ও আর দুর্বল নেই। ভয় পায় না ওকে। বুঝিয়ে দেবে ওর কারণে ইসাবেলা বদলে গেছে। ওর কারণে আজকে ওকে এমন নিষ্ঠুর হতে হলো। চোখ পুড়ছে, কিন্তু কাঁদবে না ইসাবেলা। দিয়াশলাইয়ের আগুন গ্যাব্রিয়েল্লার দেহে ধরিয়ে দিতে যাবে অমনি বাধা দেয় নিকোলাস,

“বেলা, না।”

ইসাবেলা উপেক্ষা করে সেই কথা, যেমন করে নিকোলাস ওকে উপেক্ষা করেছে এতদিন। দুজনের মাঝে দাউদাউ করে জ্বলে উঠল আগুনের শিখা। আগুনের শিখার স্ফুরণে স্থির দুইজোড়া অগ্নিকল্প চোখ।

চলবে,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে