#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৩৫
Writer তানিয়া শেখ
রৌদ্রদগ্ধ আকাশে হঠাৎ রোদটা বুঁজে এলো। কৃষ্ণ কালো মেঘের আনাগোনা শুরু হলো সেখানে। নিকোলাস উঠে দাঁড়ায়। বন্য ঔষধি গাছ সম্পর্কে ওর জ্ঞান খুব বেশি নেই। নোভা এসব ব্যাপারে খুব পটু। এখন যেহেতু নোভা নেই ওকেই কিছু একটা করতে হবে। ইসাবেলার সারা শরীরে আচর আর আঘাতের চিহ্ন। নিকোলাস যতবার দেখে ততবার নিজের স্বার্থপর সত্ত্বাকে তিরস্কার করে। এই স্বার্থপর স্বভাবের কারণে সে আরও বেশি করে চায় ইসাবেলাকে দূরে সরাতে। কারণ ইচ্ছেতে হোক কিংবা অনিচ্ছায় সে কষ্ট দেবে ইসাবেলাকে। পিশাচদের কাছে কোনো মানুষ নিরাপদ নয়। কতক্ষণ নিজের সেই সত্ত্বাকে ভুজুংভাজুং বুঝিয়ে রাখবে? একসময় না একসময় নিজের স্বরুপে ফিরবেই পিশাচ।
দ্রুত বনের মধ্যে হারিয়ে গেল নিকোলাস। ফিরল কিছুক্ষণ পরে। তখন ওর হাতে ঔষধি গাছ-গাছরা। ধুয়ে একটা বড়ো পাতার মধ্যে করে নিয়ে এসে বসল ইসাবেলার পাশে। মেয়েটা এখনো কী শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। ওর মুখের দিকে অপলক চেয়ে রইল নিকোলাস। একদম এই প্রকৃতির মতো হৃদয় কাড়া মুখশ্রী। দেখলেই প্রশান্ত হয় মন। ইসাবেলার মুখের ওপর কিছু অবাধ্য চুল এসে উড়ো উড়ি করছে। সাবধানে আঙুলের ডগা দিয়ে সেগুলোকে সরিয়ে দিলো। অকারণেই এক চিলতে হাসি দেখা দেয় নিকোলাসের ঠোঁটে।
ঔষধি পাতার কয়েকটা হাতের তালুতে রেখে দু’হাতে পিষতে লাগল। একটু আগের গরম বাতাসে খানিক ঠাণ্ডা ভাব এসেছে। নিকোলাস হাতের তালু পিষতে পিষতে আকাশটার দিকে তাকাল। সুউচ্চ গাছের ফাঁকে ফাঁকে আকাশটা ভালো করে দেখার উপায় নেই। তবুও যতটুকু দেখা যায় তাতে বোঝা গেল আজ হয়তো বা বৃষ্টির সাক্ষাৎ মিলবে। ইসাবেলা গরমে এই কদিন বেজায় কষ্ট করেছে। বৃষ্টি হলে মেয়েটার জন্য ভালো হয়। মুখটা ফিরিয়ে আনল ইসাবেলার দিকে। ভুরু কুঁচকে গেল। ঘুমের মধ্যে কেমন যেন করছে ও। একটু পর অস্ফুট গোঙানির শব্দও বের হলো ওর মুখ দিয়ে। হাতদুটো মাটি খামচে ধরে আছে। নিকোলাস উদ্বিগ্ন হয়ে কাছে গেল।
“বেলা, বেলা।”
“উহ! উহ!” ওর শরীর কাঁপুনি দিয়ে ওঠে। নিকোলাস হাতের ঔষধ পাতার ওপর ফেলে ইসাবেলার বাহু ধরে ফের ডাকে,
“বেলা, বেলা।”
“ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না আমাকে।” আতঙ্কে বিড়বিড় করে। নিকোলাসের হাতটা থাপ্পড় দিয়ে সরিয়ে দেয় ঘুমের মধ্যে। ওর চোখ দিয়ে অশ্রু গড়াচ্ছে। ঠোঁট কাঁপছে থরথর করে। সেই কাঁপা ঠোঁটের ফাঁক গলে বেরিয়ে এলো,
“পিটার, পিটার।”
কাওকে না দেখেও যে অপছন্দের লিস্টে ফেলা যায় এই পিটার নামটা না শুনলে নিকোলাস জানত না। ইসাবেলার বাহু ধরে ঝাঁকুনি দিলো। ঘুম ভাঙল ইসাবেলার। দুঃস্বপ্ন থেকে বেরিয়ে এলেও ওর ভয় কিছুতেই কাটল না। ঝাঁপিয়ে পড়ল নিকোলাসের বুকের ওপর। শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।
“পিটার, ও আবার এসেছে পিটার। ড্যামিয়ান ফিরে এসেছে।”
পিটারের নামটা শুনে জ্বলছিল নিকোলাস, কিন্তু দ্বিতীয় নামটা শোনামাত্র জ্বলা, পুড়ার সিস্টেমই যেন থমকে গেল। দু’হাতে ইসাবেলার বাহু ধরে সরিয়ে মুখোমুখি এনে অবাক কণ্ঠে বলে,
“ড্যামিয়ানকে তুমি চেনো?”
এবার ঘোর কাটল ইসাবেলার। ভয়ার্ত মুখটা স্তম্ভিত। ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে নিকোলাসের মুখের দিকে। পিটার নয় নিকোলাস ওর সামনে। ধাতস্থ হতে সময় লাগল। পুরাতন সেই দুঃস্বপ্ন আজ হঠাৎ ফিরে এসেছে ড্যামিয়ানকে দেখে। ইসাবেলার মনে পড়েছে জানালায় দাঁড়ানো লোকটি কে ছিল! ড্যামিয়ান ছিল। অতীতের সেই দুঃসহ ঘটনা আবার ওর স্মৃতিতে ফিরে এসেছে। ড্যামিয়ান আবার ফিরে এসেছে!
“বেলা?”
“হুঁ?”
“ড্যামিয়ানকে তুমি কী করে চেনো?”
হাত ছাড়িয়ে মুখ ঘুরিয়ে বসে ইসাবেলা। ড্যামিয়ান ওর অতীতের এক গোপন অধ্যায়। যা কেবল ভুলে থাকতে চায় ইসাবেলা। ভুলে যেতে চায় ওই অসহ্য নামটা। দুহাতে চোখ মুছে বলে,
“কে ড্যামিয়ান? আমি ড্যামিয়ান নামে কাওকে চিনি না।”
নিকোলাস শতভাগ সিওর এই মেয়ে মিথ্যা বলছে। ও স্পষ্ট শুনেছে ইসাবেলা একটু আগে ড্যামিয়ানের নাম নিয়েছে। ইসাবেলার চোয়াল ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে গম্ভীর গলায় বলে,
“মিথ্যা বলবে না বেলা। আমি স্পষ্ট শুনেছি ড্যামিয়ানের নাম নিয়েছ। সত্যি করে বলো ওকে তুমি কী করে চেনো? ও কি তোমাকেই খুঁজতে লিভিয়ার গৃহ পর্যন্ত এসেছিল?”
আর্ত হয়ে ওঠে ইসাবেলা। বিড়বিড় করে,
“আমাকে খুঁজতে? আমাকে?”
ভয়টা যেন আরও বাড়ে ওর। নিকোলাস দেখতে পায় সেটা। চোয়াল ছেড়ে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বসায়। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে,
“আমি থাকতে ভয় কীসের তোমার?”
“আপনি তো সব সময় থাকবেন না আমার সাথে নিকোলাস, তখন?”
ইসাবেলার সিক্ত চোখ জোড়া নিকোলাসকে আনমনা করে তোলে। সত্যি তো ও চিরজীবন থাকবে না ইসাবেলার পাশে। তখন কী হবে ওর? এই না থাকতে পারার যন্ত্রণা ওকে একটু কেমন করে দিলো। কিন্তু ড্যামিয়ানের ভাবনা সব ভুলিয়ে দেয় পরক্ষণেই।
“ড্যামিয়ানের সাথে তোমার সম্পর্ক কী? কেন এত ভয় ওকে তোমার?”
ইসাবেলা ঘাবড়ে যায়। অস্থিরতা প্রকাশ পায় হাবভাবে। নিকোলাসের কপালে একটার পর একটা ভাঁজ পড়ে।
“বেলা?”
“ও আমার দূর সম্পর্কের মামা।” আস্তে আস্তে বলল ইসাবেলা। নিকোলাসের কপালের ভাঁজ মিলিয়ে গেল। সেখানে দপ করে ওঠে রগ। বিস্মিত শোনাল গলা।
“তোমার দূর সম্পর্কের মামা!”
“মায়ের মুখে শুনেছি নানুর এক চাচাত ভাই ছিলেন। অন্যসব ভাইদের থেকে চারিত্রিক দিক দিয়ে আলাদা ছিলেন তিনি। খুব উচ্ছৃঙ্খল স্বভাবের ছিলেন। ঘর -সংসারের প্রতি আগ্রহ ছিল না। রোজ পতিতালয়ে যাতায়াত ছিল। ওই পতিতালয়ের এক মেয়ের সাথে তাঁর সম্পর্ক তৈরি হয়। ড্যামিয়ান ওই মেয়েটার গর্ভে এলে উনি ওকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেন। এরপর আস্তে আস্তে ওখানে যাতায়াত বন্ধ করে দেন। পরিবারের সকলের জোরাজুরিতে একসময় বিয়ে করতে রাজি হন মায়ের সেই চাচা। সময়ের আবর্তে আগের জীবনের সব ভুলে যান। এক ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে বেশ ভালোই চলছিল তাঁর সংসার। কিন্তু হঠাৎ একদিন নানু বাড়ির দরজায় পনেরো বছরের এক কিশোর এসে হাজির হয়। তখনও আমি মায়ের গর্ভে। মা সাক্ষী ছিলেন সেই ঘটনার। নানু ছিলেন তখন পরিবারের কর্তা। নানু কিশোরের নাম জিজ্ঞেস করলে চুপ থাকে সে। বাড়িয়ে দেয় সঙ্গে থাকা একটি চিঠি। যেন সেটাই ওর পরিচয়। নানু চিঠিটি পড়ে জানতে পারেন কিশোরটি তাঁর ছোটো ভাই ভলকোভের ঔরসজাত সন্তান। যার মা ছিল ওই পতিতা মেয়েটি। কঠিন রোগে ভুগে মেয়েটির মৃত্যু হলে কিশোরের আর যাওয়ার কোনো স্থান থাকে না। মৃত্যুর পূর্বে মেয়েটি ভলকোভকে উদ্দেশ্য করে একটি চিঠি লিখে যায়। সন্তানকে স্বীকৃতি না দিলেও যেন একটু আশ্রয় দেন সেই অনুরোধ করেন চিঠিতে। কিন্তু তিনি সেদিনও সন্তান বলে অস্বীকার করেন কিশোরটিকে। গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয় বাড়ির বাইরে। পরিবারের বড়োরা তাঁকে বুঝায়। হাজার হোক তাদের বংশের রক্ত বইছে ওর শরীরে। সুতরাং সকলে সিদ্ধান্ত নিলো কিশোরকে বাড়িতে রাখার। কিন্তু ভলকোভ বেঁকে বসলেন। তিনি কিছুতেই নিজের নাম ওকে দেবেন না। নানুকে বললেন হয় ওই কিশোর থাকবে নয়তো তিনি। কিশোরের মুখ চেয়ে নানুর করুণা হলো। ভাইকে বুঝালেন কিন্তু বুঝলেন না ভলকোভ। রাগে সপরিবারে বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন মস্কোতে। এদিকে কিশোরের নাম পরিচয় নিয়ে ক্রমে ক্রমে কথা উঠল। অনন্যোপায় এবং দয়াপরবশ হয়ে নানু ওর নাম রাখলেন৷ সাথে বংশের নামও ওকে দিলেন। নামহীন কিশোরের হলো- ড্যামিয়ান ম্যাক্সওয়েল পেট্রভ । কিন্তু __”
ইসাবেলার কথা অসম্পূর্ণ রয়ে যায় নিকোলাসের প্রশ্নে।
“কী নাম বললে?”
“ড্যামিয়ান।”
“মিডেল নেম কী বললে?”
“ম্যাক্সওয়েল। কেন?”
নিকোলাসের চেহারার রঙ বদল ইসাবেলাকে কৌতূহলী করে। নিকোলাস বজ্রাহতের ন্যায় বসে রইল কিছুক্ষণ। আকাশে বজ্রনির্ঘোষ বেজে ওঠে। গাছের শাখায় শাখায় লাগে ঝড়ো হাওয়ার ঝাঁকুনি। বাতাসে বেপরোয়া ভাব। উড়িয়ে নেয় শুকনো পাতা আর খড়কুটোদের। ইসাবেলা দু’হাত চোখের ওপর রাখে। ঝড় ওর চোখের কৌতূহল মুছে দেয়।
“নিকোলাস ঝড় উঠেছে। চলুন উঠা যাক।”
“তোমার নানুর নাম কী?” কাঁপা মৃদু গলায় বলল নিকোলাস। ঝড়ো হাওয়ার শো শো শব্দে ইসবেলা শুনতে পায় না ওর কথা। নিকোলাসের হাত ধরে বলে,
“চলুন উঠা যাক।”
“তোমার নানুর নাম কী বেলা?”
মন্দ্রকণ্ঠে বলে উঠল নিকোলাস। ইসাবেলা কেঁপে ওঠে ওর গলার স্বরে। ওর দিকে ভালো করে তাকায়। হিংস্র হয়ে উঠেছে নিকোলাসের চেহারা। দু কদম পিছিয়ে যেতে নিকোলাস ওর বাহু ধরে কাছে নিয়ে এলো।
“জবাব চাই আমার, বেলা। বলো?”
“আমার হাতে ব্যথা লাগছে নিকোলাস। প্লিজ ছাড়ুন।”
নিকোলাসের শ্বদন্ত বেরিয়ে এসেছে। দুচোখে সেই ভয়ানক পৈশাচিকতা। পিশাচ ফিরে এসেছে স্বরুপে। এক হাত বাহু ছেড়ে ইসাবেলার ঘাড় চেপে ধরে কর্কশ গলায় বলে,
“নাম বলো তোমার নানুর বেলা। নাম বলো?”
আঁতকে ওঠে ভয়ে ইসাবেলা। ভীত কণ্ঠে বলে,
“মার্কোভিক ম্যাক্সওয়েল পেট্রভ ।”
ক্রুর হাসি জেগে ওঠে নিকোলাসের ঠোঁটে। ভাগ্যের পরিহাসে উন্মাদের মতো হাসতে লাগল। ইসাবেলা ভয় পেয়ে যায়। নিকোলাস রক্তিম চোখে তাকায় ওর দিকে। ম্যাক্স! যে নাম নিকোলসের এই অভিশপ্ত জীবনের কারণ, যে নাম ওর সকল ভালোকে মন্দতে পরিণত করেছে, নিকোলাসের সকল যন্ত্রণার কারণ যে নাম, বহু বছরের সুপ্ত আগ্নেয়গিরি আজ ফুঁসে ওঠে সেই নাম শুনে। ক্রোধে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে নিকোলাস। সামনে যেন ইসাবেলা নয় ম্যাক্সের সেই রূপ দাঁড়িয়ে আছে যাকে ও ঘৃণা করে। ছুঁড়ে ফেলে দেয় ইসাবেলাকে অদূরে। ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠল ইসাবেলা। নিকোলাস হাওয়ায় উড়ে গিয়ে ওর গলা চেপে শূন্যে তোলে। আতঙ্কে বিস্ফোরিত ইসাবেলার চোখ। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ছটফট করছে শ্বাস নেওয়ার জন্য।
“ম্যাক্সওয়েল, হুম? দ্য গ্রেট ধোঁকাবাজ ম্যাক্সের বংশধর তুমি? তুমি জানো বেলা তোমার নানুর বংশের প্রতিষ্ঠা পুরুষ কে? জানো?”
নানুর বংশের প্রতিষ্ঠা পুরুষের নাম মনে নেই ইসাবেলার। ছোটো বেলায় বেশ যাতায়াত ছিল সেখানে। তারপর অনেক বছর যাওয়া হয় না। কেউ যে এখন আর বেঁচে নেই। নানু বাড়িতে তাঁদের পূর্ব পুরুষদের পোট্রের্ট আছে। এর মধ্যে প্রথম জনই ছিলেন পেট্রভদের প্রতিষ্ঠা পুরুষ। তাঁকে মহান ব্যক্তিত্ব বলে মনে করে ওর নানুরা। প্রতি বছর তাঁর জন্মদিন পালন করা হতো আগে। চার্চে বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হতো। এটাই বংশ পরম্পরায় চলে এসেছিল। সেই সম্মানীয় ব্যক্তির নাম শুনে কেন এমন নিষ্ঠুর হয়ে উঠল নিকোলাস? নামটা মনে করার চেষ্টা করল ও। পোট্রের্টের নিচে নামটা লেখা আছে। ইসাবেলা চেষ্টা করল স্মরণ করার। অনেক চেষ্টার পর ওর স্মৃতিতে ভেসে উঠল পোট্রের্টের নিচে লেখা নামটা। মনে পড়ল নানুর মিডেল নামই তাঁর বংশের প্রতিষ্ঠা পুরুষের নামে। ম্যাক্সওয়েল পেট্রভ। কিন্তু এই নামটাকে নিকোলাস ম্যাক্স কেন বলল? ধোঁকাবাজই বা কেন বলল?
ওর প্রশ্ন গুলিতে যায় নিকোলাসের হাতের চাপ গলায় বাড়তে।
“নিকোলাস আমার কষ্ট হচ্ছে। নিকোলাস!”
“কষ্ট হচ্ছে, হুম? কতটা?” নিকোলাস আরো জোরে চেপে ধরে ওর গলা। মৃত্যু সামনে দেখছে ইসাবেলা। চোখের সামনে ঝাপসা এসে আসে। গলা কাটা মুরগির ন্যায় ছটফট করতে লাগল।
“এতটা?” ঝুঁকে এসে চাপা গলায় বলল নিকোলাস। তারপর ইসাবেলার গলা ছেড়ে দিলো। খুব কাশতে লাগল ইসাবেলা। শ্বাস নিচ্ছে জোরে জোরে। নিকোলাস ঘুরে দাঁড়ায়। আজ ইসাবেলার স্থানে অন্য কোনো পেট্রভ বংশীয় থাকলে বিনা দ্বিধায় শেষ করে ফেলত। কিন্তু ইসাবেলাকে ও মারতে পারল না। এই ব্যর্থতা ওকে আরও বেশি কুপিত করে। ইসাবেলা দিকে ফিরে কর্কশ গলায় বলে,
“ব্লাডি ম্যাক্স অ্যান্ড ম্যাক্সওয়েল ফ্যামিলি। পৃথিবীতে এত জায়গায় থাকতে আমার সামনে কেন এসে পড়ো তোমরা? কেন?”
ইসাবেলার নিষ্পাপ ব্যথাতুর দৃষ্টি নিকোলাসের পিশাচ সত্ত্বাকে চুপ করিয়ে দেয় ক্ষণিকের জন্য। একটু আগে যা করেছে তা ভেবে মুষ্টিবদ্ধ করে। সে আবার ব্যথা দিয়েছে ইসাবেলাকে। আবার! নিকোলাসের অপরাধবোধ ম্লান হয় ম্যাক্সের সাথে ইসাবেলার সম্পর্ক মনে করে। ম্যাক্সের কারণে ইসাবেলাকে আজ ও ত্যাগ করবে। অবশ্যই করবে। ম্যাক্সকে নিকোলাস ঘৃণা করে। ওর বংশের প্রতিটি জীবকেই সে ঘৃণা করে। ওদের সানন্দে হত্যা করতে রাজি কিন্তু ভালোবাসতে নয়। নিকোলাস একদন্ড সেখানে আর দাঁড়াল না। হারিয়ে গেল হাওয়ায় মিশে। ইসাবেলা যেন এতক্ষণে কিছু বুঝল।
“ম্যাক্স! ম্যাক্স!”
নামটা কয়েকবার নিতে সব পরিষ্কার হয়ে এলো। মনে পড়ল আগাথার জীবন কাহিনি। হতবুদ্ধি হয়ে অস্ফুটে বলল,
“আগাথা, ম্যাক্স, ম্যাক্স, আগাথা?”
আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল জমিনে। সেই কাঁদা মাটির মধ্যে ভিজে বসে রইল স্তব্ধ মুখে ইসাবেলা। ও যেন এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না এই সত্যি।
“নিকোলাসের কোথাও ভুল হবে। ওর ম্যাক্স বাবা আমার মায়ের বংশের প্রতিষ্ঠা পুরুষ কী করে হয়? সে তো নেকড়ে আর আমরা মানুষ। অবশ্যই ভুল আছে।”
ইসাবেলা উঠে দাঁড়ায়। চিৎকার করে ডাকে,
“নিকোলাস, নিকোলাস।”
কোথাও নেই নিকোলাস। ইসাবেলা কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ে আবার।
“আপনার ভুল হয়েছে নিকোলাস। ম্যাক্স আর ম্যাক্সওয়েল এক ব্যক্তি নয়। আপনার ম্যাক্স বাবা আমাদের কিছু না, কেউ না। নিকোলাস ফিরে আসুন, নিকোলাস।”
নিকোলাস আর ফিরবে না এই ভাবনা ওর মনকে ক্ষত বিক্ষত করে তোলে। শরীরের ব্যথা মনের ব্যথাকে ছাড়িয়ে যায় তখন৷ ভাগ্য কেন বার বার বিরূপ হয় ওর প্রতি? কোন পাপে এমন করে ছেড়ে যায় ভালো লাগার মানুষগুলো?
চলবে,,,
#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৩৬
Writer তানিয়া শেখ
১৩৪৯ সাল,
সুরঙ্গের যত ভেতরে ঢুকছে ততই অবাক হচ্ছে নিকোলাস। প্রাসাদের পূর্বদিকের জঙ্গলঘেরা স্থানে যে এমন একটি ভূতুরে সুরঙ্গ থাকতে পারে এ ওর ভাবনার বাইরে ছিল। এই প্রাসাদে আছে বেশ কয়েক বছর হয়। বাইরে থেকে দেখলে প্রাসাদের রহস্য উদ্ঘাটন সম্ভব নয়। আজ অন্তত তাই ই মনে হলো নিকোলাসের। সুরঙ্গের সামনে ঘন অন্ধকার। মশালের আলোতে এর গায়ে জন্মানো নানান জীব চোখে পড়ে। গা ছমছম করে ওঠে সেসব দেখে। পায়ের নিচটা স্যাঁতসেঁতে। পিচ্ছিল পিচ্ছিল ভাব আছে। সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে আলো ধরে। অবাধে বেড়ে ওঠা বন্য আগাছা -পরগাছা সরিয়ে যেতে হচ্ছে সামনে। পথিমধ্যে দুটো সাপের সাথে দেখা হয়ে গেল। ওর দিকেই যেন শিকারী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। জিহ্বাটা বার বার বেরিয়ে আসছিল গা শিউরানো শব্দ করে। সুরঙ্গের গা বেয়ে আগাছার সাথে জড়িয়ে আছে একটা, ঠিক ওর বাম পাশে। কিশোর নিকোলাসের পা দুটো ঠকঠক করে কাঁপছে। আতঙ্কিত দু’জোড়া চোখ। মন বলছে এখানে আসা ওর উচিত হয়নি। কিন্তু এসে তো পড়েছে! ওর বয়সী ছেলেরা হয় সাহসী, দুরন্ত, কিন্তু ও একেবারে উলটো। ভীষণ শান্ত, বয়সের বেমানান ভীতু আর সরল। মায়ের আজ্ঞাকারী ভদ্র ছেলে। এতটা ভদ্র যে লোকে নির্বোধ বলে বেশ মজা নেয়। রিচার্ডের এখানেই আপত্তি। তাঁর সাথে যেন পুত্রের সাদৃশ্যের বড়ো অভাব। এই অভাবেই ক্ষোভ বাড়ে, ক্রোধ জাগে। আপাতত সেটা চেপে গিয়ে হাতের মশাল সমেত ঘুরে দাঁড়িয়ে বলেন,
“আবার কেন থামলে?”
“সা-আ-প।” নিকোলাস আঙুল তুলে দেখায় কয়েক কদম দূরের লতায় জড়ানো ফণা তোলা সাপটাকে। রিচার্ডের ঠোঁটের কোণ বেঁকে গেল। নিজের ভাগ্যের ওপর পরিহাস করল যেন। সৃষ্টিকর্তা তাঁকে এমন ভিতু সন্তান দিলো? গায়ে গতরে তাল গাছ অথচ মেরুদণ্ড দুর্বল! এই ফাঁপা মেরুদণ্ডি পুত্র দিয়ে কী লাভ তাঁর? কোনো লাভ নেই, কেবল লোকের বিদ্রুপ জুটবে এমন পুত্র লাভের কারণে। রিচার্ডের পুরোনো সন্দেহ ফের মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে৷ নিকোলাস কি আদৌ ওর ঔরসজাত? এই একটা সন্দেহ রিচার্ডকে আমূল পরিবর্তন করে দিয়েছে। ওর হৃদয়ে হেমলকের বিষ ঢেলে সমস্তটা করেছে বিষাক্ত। নিকোলাস ওর চেয়ে প্রায় ছয় ইঞ্চি লম্বা। তা সত্ত্বেও ওর বাহু সজোরে চেপে ধরে টেনে সাপটার মুখোমুখি দাঁড় করায়। ভয়ে সরে যেতে চাইলে বাধা দেয় রিচার্ড। নিস্পৃহ গলায় বলে,
“সামান্য একটা সাপকে এত ভয় তোর? নিজেকে আর ওটাকে দেখ। বল শক্তিশালী কে? বল?”
“ও বিষাক্ত। ওর নিঃশ্বাসে পর্যন্ত বিষ আছে। ওটাই ওর হাতিয়ার, ওটাই ওর শক্তি। কিন্তু আমি তো নিরস্ত্র, সাধারণ মানুষ। দেহের দীর্ঘতাকে শক্তি ভেবে কাছে গেলেই ও ছোবল দেবে। মরে যাব আমি।”
নিকোলাস সরল কিন্তু বোকা নয়। ওর আর্ত মুখে চেয়ে কথাগুলো ভেবে একটু ভাবুক হলো রিচার্ড৷ তারপর সাপের কাছ থেকে সরিয়ে এনে বলল,
“চল।”
প্রাণে পানি পেল যেন নিকোলাস। ত্রস্ত পায়ে পিতার একটু আগে আগে চলতে লাগল এবার। সাপটা ওর দৃষ্টি সীমার বাইরে যেতে হাঁপ ছাড়ে। রিচার্ডের মুখে তখনো ভাবনার ছাপ। কী যে ভাবছেন তিনিই জানেন। নিকোলাস বারেক ফিরে পিতাকে দেখল। রিচার্ডের গম্ভীর মুখ ওর ভীতি আরো বাড়িয়ে দেয়। মায়ের নিষেধ অমান্য করে, না জানিয়ে রিচার্ডের সাথে এসেছে। ওর মা আগাথা জানতে পারলে রাগ করবেন। কী এক কারণে মা ওকে রিচার্ডের থেকে দূরে দূরে রাখে। নিকোলাসের নিজেরও ভালো লাগে না রিচার্ডের সান্নিধ্য। কৈশোরে পা রেখেছে। অনেক কিছুই বুঝতে পারে এখন। আর সবার বাবা-মায়ের মতো সম্পর্ক নয় ওর বাবা-মায়ের। তাতে অবশ্য একটুও খারাপ লাগা নেই। রিচার্ডকে ও পিতা হিসেবে আগাগোড়াই অপছন্দ করে। যে পিতা প্রহার, ধমক আর তিরস্কার ছাড়া কখনো কথা বলেনি তাঁকে পছন্দ করার তো কথা নয়। তবুও হয়তো পিতাকে ও শ্রদ্ধা করত। হাজার হোক জন্মদাতা, কিন্তু মায়ের ওপর পিতার অকথ্য নির্যাতন নিকোলাসকে করেছে রুষ্ট। মা’কে ও সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। মা’ই ওর দুনিয়া। সেই মা’কে প্রতি মুহূর্তে অপমানিত হতে দেখে কোনো সন্তান ঠিক থাকতে পারে না। নিজের ওপর করা সকল নির্যাতন নিকোলাস মুখ বুঁজে সহ্য করেছে। টু শব্দটি করেনি পিতার বিরুদ্ধে, ঘৃণাও না। কেবল মা’কে ও নির্যাতিত হতে দেখতে পারে না। শৈশব থেকে রিচার্ড ওর কাছে ভীতির নামান্তর ছিল। এখন অপছন্দও এসে মিশেছে। অন্যদিকে ম্যাক্স ওর পছন্দের মানুষ। তাঁকে ও বাবা বলেও স্বীকার করবে অকপটে। পিতৃস্নেহের অভাব তিনি পূরণ করেছেন। মায়ের পরে নিকোলাসকে যদি কেউ ভালোবেসেছে তবে তিনি ম্যাক্স। নিকোলাস ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে না ম্যাক্স ওর হৃদয়ের কতখানি জুড়ে আছে। সেই শৈশব থেকেই দুজনের সম্পর্ক নিবিড়। ম্যাক্স বরাবরই ওকে বলেছেন,
“তোর সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক নেই নিক। তবে জেনে রাখিস আমার আত্মার পরম আত্মীয় তুই৷” বালক নিকোলাসের বুকের বা’পাশে হাত রেখে বলেছিলেন,
“এই যে হৃদয়, এখানে আমি আজীবন থাকব। এই রূপে না হোক অন্যরূপে, তবুও থাকব দেখিস। তোর আর আমার নিয়তি একই সূত্রে গাঁথা। চন্দ্রদেবী আমাকে কথা দিয়েছেন রক্তের এই বৈষম্য তিনি ঘুচাবেন। তোর আর আমার হৃদয় যেমন এক হয়েছে, তেমনই দুজনের রক্তও একই মোহনায় গিয়ে মিশবে। আমি সেই দিনটির প্রহর গুনছি।”
নিকোলাসও প্রহর গুনেছে সেই দিনের। যখন জেনেছিল ওর মা আর ম্যাক্স বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, খুব খুশি হয়েছিল। ভেবেছিলাম ম্যাক্সের কথা বুঝি এবার সত্যি হবে। কিন্তু ভাগ্য এবারো বিরূপ হলো। ম্যাক্স নিখোঁজ হলেন। রিচার্ডের কাছে ফিরতে হলো ওর মাকে। নিকোলাস জানে ওর মা আগাথা কতটা ভালোবাসে ম্যাক্সকে। মাকে সুখী দেখতে চায়। সুখী একটা পরিবার চায়। ঠিক যেমনটা ওরা ম্যাক্সের সাথে ছিল বছর খানেক আগে। তাই তো ম্যাক্সকে ওর মন বার বার খুঁজে ফেরে। আজ যখন রিচার্ড বলল সে ম্যাক্সের কাছে নিয়ে যাবে, নিকোলাস কোনোকিছু না ভেবেই চলে এসেছে। কতদিন পর ম্যাক্সের সাথে দেখা হবে। ও ঠিক করেছে দেখা হওয়ামাত্রই তাঁর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে খুব কাঁদবে। অনুযোগে অনুযোগে ম্যাক্সকে নাজেহাল করে ছাড়বে। কথাগুলো ভেবে আনমনেই হাসল। ওর হাসি উবে যায় কাঁধে ভারী হাতটা পড়তে। পেছন ফিরে তাকাতে রিচার্ডের রাশভারি মুখ দেখতে পায়। সামনে দৃষ্টি রেখে ইশারায় করছেন। পিতার দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে ফেরে। সুরঙ্গের শেষ মাথায় গুহার মতো ছোট্ট গোলাকার জায়গা। এখান থেকে বেশ খানিকটা ঢালু হওয়ায় গাছের গুঁড়ি কেটে সিঁড়ি মতো করা হয়েছে। রিচার্ডকে অনুসরণ করে নামল নিকোলাস। সুরঙ্গের মতোই অন্ধকার এখানেও। মনটা কেমন যেন করছে নিকোলাসের। এমন অন্ধকার, অনিরাপদ স্থানে ম্যাক্স রয়েছে? কিন্তু কেন? নিচে নামতে উৎকট গন্ধ এসে লাগে নাকে। ভেজা মাটিতে পা প্রায় দেবে যায়। তারপরেই থমকে গেল। সাপের বিষাক্ত শ্বাস প্রশ্বাসে পুরো গুহার ভেতরটা কাঁপছে যেন। নিকোলাস সতর্ক হয়ে শুনল- একটা নয় অসংখ্য সাপের বিচরণ। রিচার্ডের হাতের মশালের আলোতে ক্রমশ সাপগুলো ওর চোখে পড়ল। শান্ত অথচ শিকারী দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ওরা। মাথা সামান্য তুলে এঁকেবেঁকে চলছে সদর্পে। সাপের প্রকারভেদ সম্পর্কে খুব একটা জ্ঞান নেই নিকোলাসের, তবে এই সরীসৃপগুলোকে দেখে ওর মনে হলো পৃথিবীর সকল সাপের জাতই এখানে উপস্থিত। একটা ব্যাপার ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। সাপগুলোর সামনে গোরু থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রাণীর অর্ধগলিত মরদেহ পড়ে আছে। গা গুলিয়ে এলো। রিচার্ড নির্ভয়ে মশাল হাতে সামনে এগোচ্ছে। ওর সামনে থাকা সাপগুলো কুর্নিশের ভঙ্গিতে স্থান ছেড়ে সরে যায়। বেশ অবাক করে নিকোলাসকে এসব। হঠাৎ খেয়াল করল রিচার্ডের বা’হাতের তর্জনীর দিকে। কোমরের নিচে ঝুলে থাকা তর্জনী ছাড়া সব কটা আঙুল ভাঁজ। ওই একটা আঙুল চক্রাকারে ঘুর্নায়মান। নিকোলাস সাপগুলোর দিকে ফের তাকাল। এবার যেন আরো চমকে উঠল। প্রতিটি সরীসৃপের দৃষ্টি স্থির ওই আঙুল দিকে। ভয়ে থেমে গেল আবার নিকোলাস। আর সাথে সাথে গর্জনের ভঙ্গিতে ফোঁস করে উঠল কালোর রঙের ব্লাক মাম্বাটা। ঠিক নিকোলাসের বা’পাশের মরা গাছের ডালে জড়িয়ে ছিল সেটা। ফণা তুলে মাথা এগিয়ে আনতে রিচার্ড তর্জনী তাক করেন। পিছিয়ে যায় ওটা আগের স্থানে। নিকোলাসের হাঁটু কাঁপছে রীতিমতো।
“থেমো না। চলতে থাকো।” বড়ো অদ্ভুত আর অচেনা লাগল রিচার্ডের গলা। আর নিকোলাস চুপ করে থাকতে পারল না। ভীত কণ্ঠে বলে উঠল,
“এখানে ম্যাক্স থাকে! আপনি আমাকে মিথ্যা বলছেন, তাই না?”
“একটু পরেই সব প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাবে নিকো।”
“এই বলেই এই পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন। কিন্তু কোথায় ম্যাক্স? আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না এমন একটা জায়গায় ম্যাক্স কেন থাকবে? এখানে কি কোনো মানুষ থাকতে পারে?”
রিচার্ড হঠাৎ খ্যাঁক করে হেসে উঠলেন। বিড়বিড় করে বললেন,
“মানুষ!”
নিকোলাস ঠিক বুঝল না। কিন্তু পিতার মুখের ভাব ওর পছন্দ হলো না। ম্যাক্সকে নিয়ে কোনো কটুক্তি ও সহ্য করবে না। তাতে এই বয়সে যদি পিতার হাতে মার খায় খাবে। রিচার্ড অবশ্য এরপরে চুপ রইল। ওরা আরো খানিক হাটতে সামান্য আলোর দেখা পেল। গুহার এই মোড়ে শুয়ে আছে বিশালাকার পাইথন। রিচার্ডকে দেখে সেটার ভারী শরীর সরে যায়।
“সাপগুলো আপনার বশীভূত?”
নিকোলাসের প্রশ্নে হাসলেন আবার রিচার্ড। ঘাড়ের ওপর দিয়ে চেয়ে বলেন,
“তুমি চাও?”
“হু?”
“এদের বশীভূত করতে চাও?”
সজোরে মাথা ঝাকায় নিকোলাস। সাপকে ওর ভীষণ ভয়। ভয়ের জীবকে বশীভূত করে করবে কী? তাছাড়া কাওকে বশীভূত করে তার জীবনের ছন্দ নষ্ট করা এক ধরনের অপরাধ। নিকোলাস নির্ঝঞ্ঝাট জীবন বেশি পছন্দ করে। রিচার্ড ছেলের মুখে কিছুক্ষণ চেয়ে গম্ভীর হয়ে যান। চলতে চলতে বলেন,
“এসো।”
গুহার মোড় ঘুরতে লোহার বন্দিশালা। রিচার্ডের পা থামে। সেই সাথে থামে নিকোলাস। সামনে আঙুল তুলে রিচার্ড বলেন,
“ওই যে তোমার ম্যাক্স বাবা?”
আনন্দে জ্বলে ওঠে নিকোলাসের চোখজোড়া। কিন্তু কোথায় ম্যাক্স? এখানে দাঁড়িয়ে কাওকেই দেখল না। রিচার্ড ইশারা করল সামনে এগিয়ে যেতে। নিকোলাস সানন্দে এগিয়ে গেল। বন্দিশালার এককোণের আবছা আঁধারে দু’টো মানুষকে দেখতে পেল। নিকোলাসের আনন্দ ম্লান হয়ে যায় সামনের দৃশ্য দেখে। এক যুবতীর কোলে শুয়ে আছে ম্যাক্স। পরনে পুরোনো ময়লা কাপড়। দুজন দুজনের দৃষ্টিতে এতটাই হারিয়ে গেছে যে সামনে নিকোলাসের উপস্থিতি টের পাননি। যুবতীর মুখটা এক সময় ঝুঁকে এলো কোলে থাকার ম্যাক্সের মুখের দিকে। ম্যাক্সও এক হাতে যুবতীর মাথার পেছনে হাত রেখে মুখ তুললেন। দুজনের ঠোঁট নিবিড় আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়। নিকোলাসের মনে হলো কেউ যেন ওর বুক বরাবর শরবিদ্ধ করেছে। অসহ্য যন্ত্রণায় নিঃশ্বাস আঁটকে আসার উপক্রম। সেই মুহূর্তে কেবল একটা অনুভূতিই ওর সমস্ত কিছুর ওপর আধিপত্য করে বসল, আর তা হলো প্রতারিত হওয়ার বিষম জ্বালা। পেছনে দাঁড়ানো রিচার্ড তখন মহাখুশি। যা দেখাতে চেয়েছিল তাই তিনি দেখাতে পেরেছেন। ছেলের অন্তরের জ্বালাকে বিষে পরিণত করতে এগিয়ে এলেন।
“দেখো তোমার ম্যাক্স বাবাকে, প্রেমিকা নিয়ে বেশ মজেই আছে সে। তোমাকে এবং তোমার মাকে বেমালুম ভুলে গেছে আজ।”
রিচার্ডের উঁচু গলায় চমকে তাকান ম্যাক্স এবং যুবতীটি। নিকোলাসের ব্যথাতুর মুখটা দেখে ম্যাক্স ভূত দেখার মতো চেয়ে রইলেন। রিচার্ড নিকোলাসের কাঁধে হাত রেখে বললেন,
“ও একটা ধোঁকাবাজ, মিথ্যাবাদী। তোমার মা আর আমার সংসার ভাঙতে এতদিন মিথ্যা ভালোবাসার নাটক করেছিল তোমাদের সাথে। কার্যসিদ্ধির পর তোমাদের ছেড়ে নতুন প্রেমিকা জুটিয়ে সংসার পেতেছিল। ধরে এনে এখানে বন্দি করে রেখেছি দুটোকে। এবার প্রতিশোধ নাও নিকো।”
“ও মিথ্যা বলছে নিক, ওর কথা তুই বিশ্বাস করিস না বাবা।”
ম্যাক্স উঠে এসে দাঁড়ালেন নিকোলাসের সামনে। নিকোলাসের অনিমেষনেত্রের কার্ণিশে জল টলমল করে। ঠোঁট দুটো কেঁপে ওঠে। অস্ফুটে বলে,
“এমন কেন করলে তুমি ম্যাক্স বাবা? আমার মাকে কেন ধোঁকা দিলে? আমাদের সুখী সংসারের স্বপ্ন তুমি কেন ভেঙে দিলে? এখন আমি মাকে গিয়ে কী বলব? মা যে তোমার ফেরার আশায় পথ চেয়ে আছে।”
“নিক, বাবা আমার।” ম্যাক্স হাত বাড়িয়ে ওকে ছুঁতে গেলে সরে দাঁড়ায় নিকোলাস। আহত চোখে তাকালেন ম্যাক্স। যুবতী অপরাধী মুখ করে পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। ম্যাক্স রিচার্ডের দিকে জ্বলন্ত চোখে চেয়ে বলেন,
“সব এই রিচার্ডের কারসাজি বিশ্বাস কর নিক। ও আমাকে __”
ম্যাক্সের কথা শেষ করতে দেন না রিচার্ড। বলেন,
“তুই আমার ছেলে আর আগাথাকে ধোঁকা দিয়ে ভেবেছিস বেঁচে যাবি? তোকে আর তোর প্রেমিকাকে ভয়ংকর মৃত্যু দেবো আমি।”
রিচার্ডের ডাকে পাইথন হেলতে দুলতে এগিয়ে যায় ম্যাক্সের খাঁচার দিকে। যুবতী আঁতকে ওঠে। পাইথনকে এগিয়ে আসতে দেখে যুবতী আতঙ্কে চিৎকার করে,
“ম্যাক্স, ম্যাক্স।”
ম্যাক্স ফিরতে নিকোলাস ওর হাত চেপে ধরে।
“আমি সব ভুলে যাব। তুমি ওকে ফেলে চলো আমার সাথে। মা আর নোভা অপেক্ষা করছে তোমার জন্য। চলো ম্যাক্স বাবা।”
যুবতীর আতঙ্কিত মুখ দেখে খারাপ লাগছে নিকোলাসের। কিন্তু মায়ের খুশির জন্য সে এই মুহূর্তে খারাপ লাগাটাকে ঠেলে সরিয়ে দিলো, স্বার্থপর হলো। পাইথন একেবারে কাছাকাছি চলে গেছে। যুবতী কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“ম্যাক্স, ম্যাক্স আমাদের বাচ্চাকে ও মেরে ফেলবে।”
নিকোলাসের হাতের মুঠ খুলে ম্যাক্সের হাতটা মুক্ত হয়। যুবতীর বড়ো পেটটাতে দৃষ্টি স্থির হলো ওর। ঈর্ষার অনল একটু একটু করে শান্ত মস্তিষ্ক, পবিত্র হৃদয়কে পুড়াতে লাগল। ম্যাক্স কিছু বলবে তার পূর্বে যুবতি পুনরায় আর্তনাদ করে ওঠে। সেদিকে ছুটে যান ম্যাক্স। মনুষ্য রূপে পাইথনটার সাথে পেরে উঠবে না জেনে নিজের নেকড়ে রূপ ধারণ করেন। চোখের পলকে পাইথনটার দেহ টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে বন্দিশালার এদিকে ওদিকে। যুবতী অচেতন হয়ে পড়ল সেখানে। ম্যাক্স মানুষ রূপে ফিরে যুবতীর মাথাটা কোলে নিয়ে জাগানোর চেষ্টা করেন। হঠাৎ পেছন ফিরে তাকাতে নিকোলাসের বিবর্ণ মুখ, বিস্ফোরিত চোখ দেখতে পায়। কোল থেকে যুবতীর মাথা নামিয়ে আবার এগিয়ে এলো নিকোলাসের কাছে। সবটা ব্যাখ্যা করতে গেলে ভয়ে সরে যায় নিকোলাস। রিচার্ড ওকে বুকে জড়িয়ে বলেন,
“নিকো, দেখলে তো চোখের সামনে এই বহুরূপীর আসল চেহারা। ও তোমাদের ক্ষতি ছাড়া কোনোদিন ভালো কামনা করেনি, করবে না। কে জানে তোমার ওপরও হয়তো জাদুটোনা করে রেখেছে।”
শিউরে ওঠে নিকোলাস। পিতার মুখের দিকে তাকায় তারপর ম্যাক্সের পানে। একরাশ ঘৃণা আর ভয় দেখতে পায় নিকোলাসের চোখে ম্যাক্স। বিমর্ষ হলো তাঁর মুখ।
“ওকে মেরে ফেলো নিকো, নয়তো ও আমাদের সবার পরিণতি করবে ওই পাইথনের মতো। মেরে ফেলো ওই প্রতারক, মিথ্যাবাদী আর বহুরূপীটাকে।”
নিকোলাসের হাতে ধারালো তলোয়ার তুলে বন্দিশালার দরজা খুলে দেয় রিচার্ড। নিকোলাস নড়ে না। ম্যাক্সকে ও কিছুতেই মারতে পারবে না। পিতাকে মাথা নাড়িয়ে, করুণ মুখে অসম্মতি জানায়। রিচার্ড তাতে অসন্তুষ্ট হলেন। বললেন,
“তবে ওর প্রেমিকাকে মেরে আয়। ওই মেয়ের জন্য ম্যাক্স তোর মাকে ছেড়েছে। ওকে মেরে শিক্ষা দে ম্যাক্সকে। মার, মার, মার।”
কানের কাছে অদ্ভুত আওয়াজে চেঁচাতে লাগল রিচার্ড। বদলে যায় নিকোলাসের শান্ত মুখ। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তলোয়ার তুলে যুবতীর অচেতন দেহের দিকে এগিয়ে যায়। যেন চাবি দেওয়া কলের পুতুল। বিড়বিড় করে বলে,
“এ আমার ম্যাক্স বাবাকে কেড়ে নিয়েছে, এ আমার মায়ের ভালোবাসা কেড়ে নিয়েছে, আমাদের সুখী সংসারের স্বপ্ন ভেঙেছে ওর কারণে। মৃত্যু হোক আজ ওর, মৃত্যু হোক।”
নিকোলাস তলোয়ার শূন্যে তুলতে ম্যাক্সের যেন ঘোর কাটে। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। যুবতীর বুকে ঢুকিয়ে দেয় তলোয়ারের সূঁচালো অংশ নিকোলাস। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটে। গর্জন করে ওঠে ম্যাক্স। নেকড়ে রূপে নিকোলাসকে আক্রমণ করে বশে। ওর বুকে ঢুকিয়ে দেয় ধারালো নখ। কামড়ে ধরে নিকোলাসের গলা। সংবিৎ ফেরে নিকোলাসের। ব্যথায় নীলচে হয় ওর মুখ। মাকে চিৎকার করে ডাকে,
“মা, মা, বাঁচাও।”
রিচার্ড ছুটে এসে জাদু বলে ম্যাক্সকে নিকোলাসের দেহের ওপর থেকে সরিয়ে দেয়। নিকোলাসের রক্তাক্ত আহত শরীর দেখে হুঁশ ফিরল ম্যাক্সের। নিজের সন্তানের প্রতি প্রতিটি জীবই আবেগি এবং তাদের সুরক্ষায় হয় ঢাল। ম্যাক্সের ক্ষেত্রেও তেমনই হয়েছে। ঔরসজাত সন্তানের বিপদ দেখে তিনি নিকোলাসকে আক্রমণ করে বসেছেন। কিন্তু এখন যখন নিকোলাসের রক্তাক্ত আহত শরীর দেখলেন, অনুশোচনা আর আক্ষেপে পাগলপ্রায় হয়ে উঠলেন।
“নিক, আমার বাবা, আমাকে মাফ করে দে। এ আমি কী করেছি?” দুহাতে চুল মুঠ করে পাগলের মতো কাঁদতে লাগলেন ম্যাক্স। রিচার্ডের ঠোঁটে পৈশাচিক হাসি। তিনি আজ সফল। নিকোলাস এবার সম্পূর্ণ তাঁর, পুরোটাই তাঁর। নিকোলাসের চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে এলো। ম্যাক্স কাঁদছেন অথচ, এখন আর নিকোলাসের খারাপ লাগছে না সেই কান্না শুনে। এই এত ব্যথার মধ্যেও হাসল। অদূরে যুবতীর রক্তাক্ত দেহ পড়ে আছে। নিকোলাসের দৃষ্টি পাথর হয়ে গেল। ভেতর থেকে কেউ একজন বলল,
“তুই খুনী, তুই পাপী। প্রতিহিংসার বশে দুটো প্রাণ শেষ করেছিস। নরকে যাবি তুই, বিধাতা তোকে ঘৃণা করে। পৃথিবীর সকল জীব তোকে ঘৃণা করবে, তোর মা তোকে ঘৃণা করবে।”
ভীতসন্ত্রস্ত নিকোলাস কাঁদতে লাগল চিৎকার করে। রিচার্ডের কোলে জবুথবু হয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলে,
“আমি ওকে মারতে চাইনি। ওকে বাঁচাও কেউ। ওকে বাঁচাও।”
“তুমি আজ প্রমাণ করেছ তুমি আমার ছেলে নিকো।”
রিচার্ড ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। নিকোলাস সিক্ত চোখে তাকায় পিতার দিকে। নিষ্ঠুর আর নির্মমতায় ভরা ওই মুখ। মা কি এ থেকেই দূরে রাখতে চেয়েছিল ওকে? আজ মায়ের সব চেষ্টা বিফল হলো। পিতার যোগ্য ছেলে বলে প্রমাণিত হলো নিকোলাস। কিন্তু এমনটা হতে তো চায়নি ও। দুর্ভাগ্য আজ ওকে অন্ধকারে ঠেলে দিলো।
পাপের বোঝা বুকে নিয়ে একটু একটু করে অন্ধকারে তলিয়ে যায় নিকোলাস। ওর সামনে এখন কেবলই অন্ধকার। যেখান থেকে ও আর আলোতে ফিরতে পারবে না। আজ যেন ওই যুবতীকে মারেনি, নিকোলাস নিজে মরেছে। এখন মনেপ্রাণে চাইছে সত্যি সত্যি মৃত্যু হোক ওর। হত্যাকারী হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়।
রিচার্ড ডাকছেন। নিকোলাসের শক্তি নেই জবাব দেওয়ার। হঠাৎ ওর মনে হলো শীতল কিছু ওর পা বেয়ে আস্তে আস্তে উঠে আসছে ওপরে। কাঁপুনি দিয়ে উঠল সর্ব শরীর। ম্যাক্সের ক্রন্দনরত অসহায় মুখ ক্রমশ পরিবর্তন হতে লাগল। ১৩৪৯ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে এসে থামল। নিকোলাসের সর্ব শরীর অস্বাভাবিক রকমের শান্ত। ম্যাক্সের মুখের আদল বদলে ইসাবেলার মুখে রূপ নিয়েছে। ইসাবেলা! বিস্ময়াহত হয়ে চোখ মেলল নিকোলাস। ওর হৃৎস্পন্দনের গতি তীব্র গতিতে বাড়ছে। সেই শীতল স্পর্শটা বুকের বা’পাশে উঠে আসতে খপ করে ধরে ফেলে। ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দিতে খিলখিল হাসির শব্দে পুরো কক্ষ ভারী হয়ে ওঠে। এ যেন হাসি নয় সেই বিষাক্ত সাপের নিঃশ্বাস। গলা চেপে ধরে সামনে দাঁড়ানো সুশ্রী তরুণীর। কোনোরকম ভয়ের চিহ্ন নেই তরুণীর চেহারায়। সম্মোহনী হাসি হেসে আরো ঢলে পড়তে চায় নিকোলাসের গায়ের ওপর। ওর উষ্ণ জিহ্বা নিকোলাসের গ্রীবা, চোয়াল বেয়ে ঠোঁটের কোণে আসতে থেমে যায়। নিকোলাস ওর শরীর আছড়ে ফেলে অদূরের দেয়ালে। মুহূর্তে সোজা হয়ে দাঁড়ায় তরুণী। কামুক চাহনীতে দেহটাকে আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে হেলে দুলে পুনরায় নিকোলাসের পেছনে এসে দাঁড়ায়। চাপা গলায় বলে,
“চলো না প্রিয়, একটু মজা করি দুজনে মিলে। রাতের নেশায় তোমাকে নিয়ে ডুবে যাই।”
নিকোলাসের কাঁধে শ্বদন্ত ছুঁয়ে লম্বা আঙুল চোয়াল বেয়ে বুকে নেমে যায়। নিকোলাস ঘুরে ওর চুলে মুঠি চেপে ধরে বলে,
“গ্যাব্রিয়েলা, এই শেষ বার বলছি, আমার চোখের সামনে থেকে চলে যাও।”
“এমন আনরোমান্টিক কেন তুমি বলো তো? আমি তোমার সহচরী এখন, তবে একটু আদর সোহাগ করো না কেন? একটুখানি ভালোবাসো না, প্রিয়।”
গ্যাব্রিয়েলা ওর গলায় দু’বাহু জড়িয়ে গলায় চুমু দিতে লাগল। নিকোলাস চুলের মুঠি চেপে দূরে সরিয়ে বলে,
“সহচরী? তুমি আমার সহচরী নও গ্যাব্রিয়েলা। তুমি আর সবার মতোই আমার দাসী। দাসীদের ঔদ্ধত্য আমি মোটেও বরদাস্ত করি না। শাস্তি পাবে তোমার এই আচরণের জন্য।”
গ্যাব্রিয়েলা ভড়কে গেল নিকোলাসের কথায়। ওর ঘাবড়ে যাওয়া মুখ দেখে বিদ্রুপ করে হাসে নিকোলাস,
“ভয় পেলে? আদর সোহাগ নেবে না? আজ তোমাকে আমার আদর সোহাগের নতুন রূপ দেখাব। বিশ্বাস করো বেজায় পছন্দ হবে সেটা তোমার।”
ওর চুলের মুঠি ধরে হাওয়ায় উড়ে নিয়ে নিলো প্রাসাদের নিচের কবরস্থানে। সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল পল। ওর হাতে ছোট্ট একটা ক্রুশ আর শুকনো গোলাপ। গ্যাব্রিয়েলার মুখ সাদা হয়ে গেল।
“আমার ভুল হয়েছে প্রভু, আমি আর ওমন আচরণ করব না। ক্ষমা করুণ আমাকে।”
“পল!” মালিকের ডাকে নত মাথায় এগিয়ে এলো পল। নিকোলাস গ্যাব্রিয়েলাকে কফিনে ছুঁড়ে ফেলতে পল ওর গায়ের ওপর ক্রুশটা ছুঁড়ে দেয়। চিৎকার করে ওঠে গ্যাব্রিয়েলা। কফিনের মুখ টেনে ওর ওপর শুকনো গোলাপ রেখে দূরে গিয়ে দাঁড়ায় পল।
“প্রভু, আমাকে ক্ষমা করুন। ভুল হয়েছে। এমনটা আর হবে না। মুক্ত করুন এখান থেকে।”
গ্যাব্রিয়েলার আর্তনাদ উপেক্ষা করে রুমে ফিরে আসে নিকোলাস। চেয়ারে দুচোখ বন্ধ করে আগের মতো বসে। শান্ত গলায় পলকে বলে,
“আগামীকাল সকাল পর্যন্ত নির্ধারিত গ্যাব্রিয়েলার শাস্তি। তারপর সরিয়ে ফেলিস ক্রুশ আর গোলাপ।”
“জি, মালিক।”
“নতুন কোনো খবর আছে?”
“জি, বাল্টিক সাগরের পার্শ্ববর্তী একটি গ্রামে আগামীকাল আপনাকে যেতে হবে। সেখানকার অনুসারীরা খুব করে আশা করছে আপনাকে।”
মাথা নাড়াতে পল বিদায় হয়। নিকোলাসের কপাল কুঁচকে যায় হঠাৎ। বিড়বিড় করে বলে,
“বাল্টিক! লিথুনিয়া!”
মুহূর্তে ইসাবেলার মুখটা ভেসে ওঠে। ইসাবেলা কী এখনো লিথুনিয়া আছে? ও কী ঠিক আছে? হয়তো এতদিনে কোনোভাবে পৌঁছে গেছে রাশিয়াতে। তাই হবে। চারমাস গত হয়েছে কিন্তু ইসাবেলাকে স্মৃতি থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারেনি নিকোলাস। ও যেন কাছে না থেকেও আরো কাছে থিতু হয়েছে। মনে মনে ক্ষিপ্ত হয় নিজের ওপর। কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায় শিকারের খোঁজে। ইসাবেলাকে নিয়ে ভাবার সময় কিংবা অবসর নিজেকে দেবে না।
চলবে,,,,
#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৩৭
Writer তানিয়া শেখ
ডিসেম্বর মাস, বরফে মোড়া পুরো গাঁ। পায়ের নিচ, গাছের শাখা, পত্র আর বাড়ির ছাঁদে পুরু বরফের আস্তরণ পড়েছে। ঘরে ঘরে চলছে ক্রিসমাসের প্রস্তুতি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ক্রিসমাসের আমেজে খানিক ভাটা ফেলেছে। গ্রামের অনেক গৃহের কর্তা যুদ্ধে, কেউ বা যুদ্ধাহত হয়ে কষ্টে পার করছে দিন। তাদের সংসারের বেহাল দশা। অনেকে আবার প্রিয়জন হারিয়ে শোকে কাতর। শোকটাকে বুকে করে প্রতিবাদ জানাতে ছোটে হিল অফ ক্রসেসে। মাদাম আদলৌনা যুদ্ধে শহিদ হওয়া স্বামী এবং আহত পুত্রের স্মরণে বাড়ি থেকে মাইল খানেক দূরে এই হিল অফ ক্রসেসে এসেছেন। শুধুমাত্র স্বামী শোকেই নন, আর সবার মতো তিনিও মৌন প্রতিবাদ জানান এখানে এসে। পুরোটা স্থান জুড়ে বড়ো বড়ো ক্রস। মাদাম আদলৌনা সাথে আনা ক্রসটা বেঁধে দেন সেখানে। এরপর নীরবে দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। টের পান পেছনে দাঁড়ান মেয়েটার স্থির দৃষ্টি তাঁরই দিকে। বিনয়ী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। মাদাম আদলৌনা বসা থেকে উঠতে গিয়ে সমস্যায় পড়েন। বয়স হয়েছে তাঁর। হাড় দুর্বল, সহজে উঠতে বসতে পারেন না এখন। মেয়েটি এগিয়ে এসে হাতটা ধরে তাঁকে দাঁড়াতে সাহায্য করে। খুব কম হাসেন মাদাম আদলৌনা। কিন্তু এই মেয়েটির আদব তাঁকে বড়ো বিমুগ্ধ করে। বিমুগ্ধতা ঠোঁট হাসি এনে ছাড়ে। দুজন পাশাপাশি হেঁটে অন্যদিনের মতো বাড়ি ফিরছে। ক্রিসমাসের আগে আগে প্রয়োজনীয় বাজার করে নেবেন বলে ভাবলেন মাদাম আদলৌনা। মেয়েটার জন্য একটা ভালো পোশাক কেনার ইচ্ছে হলো তাঁর। হাঁটতে হাঁটতে বললেন,
“কোন রঙটা পছন্দ তোমার ইসাবেল?”
ইসাবেলা হয়তো বুঝল পছন্দের রঙ জানতে চাওয়ার কারণ। বলল,
“আমার তো যথেষ্ট পোশাক আছে মাদাম আদলৌনা। অযথা নতুন পোশাকের দরকার কী?”
“ক্রিসমাসে পুরোনো পোশাক পরতে দেবো তোমাকে আমি? না!”
“ওগুলো তো অতটাও পুরোনো নয় মাদাম আদলৌনা। আমার বেশ চলবে।” মুচকি হাসল ইসাবেলা। মাদাম আশাহত গলায় বললেন,
“তবে নেবে না নতুন পোশাক?”
মাথা নাড়ায় ইসাবেলা। তারপর বলে,
“একটা অনুরোধ রাখবেন মাদাম আদলৌনা?”
“আগে শুনি তো।”
“নতুন পোশাকের টাকা দিয়ে আমরা কিছু খাবার কিনি। গাঁয়ের অনেকে এই সময় না খেয়ে আছে। খাবারগুলো পেলে ওরা বরং খুশিই হবে।”
মাদাম আদলৌনা থেমে যান। ইসাবেলা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। কথাগুলো বলে ঠিক করল কি না তাই ভাবছে। মাদাম আদলৌনা মুচকি হাসতে ঠিকবেঠিকের হিসেব চুকে গেল। হাসল ও। মাদাম আদলৌনা ইসাবেলাকে আশ্রয় দিয়ে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগেছিলেন একসময়। বড্ড করুণ অবস্থায় ওকে জঙ্গলে পেয়েছিলেন তিনি। ছেলের জন্য প্রায়ই জঙ্গলে বিশেষ এক ঔষধি পাতা সংগ্রহ করতে যান। বাড়ির পাশের জঙ্গলের পাতাগুলো প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। একজন বলল মাইল কয়েক দূরের দক্ষিণের বড়ো জঙ্গলে অনেক রয়েছে পাতাগুলো। মাদাম চাইলে কয়েকটা গাছও এনে লাগাতে পারেন। চারিদিকে তখন সোভিয়েত সৈন্যের টহল। কিন্তু একমাত্র সন্তানের সুস্থতার জন্য যে কোনো রিস্কই তিনি নিতে পারেন। আত্মরক্ষা করে জঙ্গলে গিয়েছিলেন। খুব ঝড়-বৃষ্টি ছিল সেদিন। ছাতাটা ঝড়ের দাপটে উড়ে যায়। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে বেশ বড়ো একটা গাছের নিচে আশ্রয় নেন। ঝড় থামল। বৃষ্টিও কমে গিয়েছিল। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে পাতাগুলো খুঁজে কয়েকটা গাছ সমেত তুলে নিলেন। বাড়ি ফিরবেন এমন সময় কান্নার শব্দ কানে এলো। কৌতূহলে সাবধানে এগিয়ে গেলেন। কাঁদায় মাখামাখি করে পড়ে ছিল ইসাবেলা। সাহস করে কাছে গিয়ে দেখলেন ততক্ষণে মূর্ছা গেছে ও। ওই অবস্থায় তো আর বাড়িতে আনতে পারতেন না। জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করলেন। ইসাবেলার জ্ঞান ফিরতে মাদাম আদলৌনাকে দেখে প্রথমে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যায়। ঠাণ্ডায় থরথর করে কাঁপছিল ও। চোখ- মুখ ছিল ফ্যাকাশে। মাদাম আদলৌনা ওকে অভয় দিয়েও কোনো কথা মুখ থেকে বের করতে পারলেন না। বেশ মায়াও হলো ওর ওই দুরবস্থা দেখে। সঙ্গে নিতে চাইলে রাজি হলো না। মাদাম আদলৌনা বুঝলেন, কারো অপেক্ষা করছে ও। তিনি অনেকক্ষণ বসলেন ওর পাশে। অথচ, তিনি নিজেও সন্দিহান ছিলেন মেয়েটাকে সাথে নেওয়ার ব্যাপারে। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এলো। কেউ এলো না দেখে মাদাম ওকে বুঝিয়ে রাজি করলেন। একা জঙ্গলে থাকাটা নিরাপদ নয়। ইসাবেলা নিরুপায় হয়ে রাজি হলো। ওকে দাঁড় করাতে গিয়ে মাদাম আদলৌনা টের পেলেন এক পা আহত ওর। কোনোরকমে ধরে রাস্তা পর্যন্ত নিয়ে এলেন। সেখানে মাদামের ঘোড়া গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। ইসাবেলা গাড়িতে উঠেও পেছনে ফিরে তাকাচ্ছিল। মাদাম কারণ জিজ্ঞেস করলে মাথা নত করে ফুঁপাতে লাগল। তিনি ভাবলেন ওর পায়ের কারণে হয়তো আপনজন ফেলে চলে গেছে। সান্ত্বনা দিলেন। তাঁর সন্তানের কষ্ট ইসাবেলার মধ্যে দেখে করুণা আরো যেন বেশি হলো। বাড়িতে আনার কিছুদিন পরেই মাদাম আবিষ্কার করলেন ইসাবেলা রাশিয়ান। কিছু কারণে লিথুনিয়া আর রাশিয়ার সম্পর্ক ভালো নয়। দু দেশের জনগনের মধ্যেও এর প্রভাব পড়েছে। মাদাম আদলৌনা একবার ভেবেছিলেন ইসাবেলাকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলবেন। কিন্তু তাঁর ছেলে মাতভেই মায়ের মনের খবর টের পেয়ে নিষেধ করে এমন কাজ করতে। একটা অসহায় মেয়েকে কেবল ওর জাতিগত কারণে এভাবে বিপদের মুখে ছেড়ে দেওয়া অন্যায় এবং নিষ্ঠুরতা বলে মনে করে মাতভেই। তাছাড়া ইসাবেলার প্রতি ওর বিশেষ মায়া আছে বলে ধারণা মাদাম আদলৌনার। দুজনের মধ্যে ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। পঙ্গু ছেলের মন রক্ষার্থে ইসাবেলাকে বাড়িতে রেখে দিয়েছিলেন। মাতভেই প্রায় ইসাবেলা নিয়ে বলে,
“ইসাবেল, খুব ভালো মনের মেয়ে মা। খুব সরল আর পবিত্র ওর মন। ঠিক একটা ফুল যেন। ওর সান্নিধ্যে গেলে অপবিত্রতা দূর হয়ে যায়। ওকে তুমি তাড়িও না মা। আমি কথা দিয়েছি আমার পা’টা একটু ভালো হলে রাশিয়া পৌঁছে দিয়ে আসব ওকে।”
ছেলের কথা শুনে প্রথম প্রথম বিরক্ত হতেন। কিন্তু এখন তিনি নিজেও মানেন ইসাবেলা ভালো মেয়ে। নিজেকে রেখে অন্যকে নিয়ে যে ভাবে সে খারাপ হয় কী করে?
দুজনে হাঁটতে হাঁটতে বাজারের পার্শ্ববর্তী রাস্তায় এসে দাঁড়ায়।
“চলো কিছু বাজার করে নিই।” বললেন মাদাম আদলৌনা। ইসাবেলা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। বাজার ঘুরে ঘুরে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে বাড়ির পথে রওনা হলেন। মাদামের হাতে একটা ব্যাগ আর ইসাবেলা নিয়েছে দুটো। ক্রিসমাস উপলক্ষ্যে অনেক কিছু কিনেছেন মাদাম। ইসাবেলার অনুরোধে অতিরিক্ত ময়দা এবং বাটারও কেনা হয়েছে। সাথে কিছু মাংস। উদ্দেশ্য অনাহারে থাকা মানুষগুলোকে অন্তত একবেলা খাওয়ানো। বাড়ির কাছাকাছি ব্রিজের কাছে এসে থেমে গেল ইসাবেলা। সূর্যের তেজ বাড়াতে বরফ গলতে শুরু করেছে। ঝিলের পাড়ের বরফ গলে দুটো হলুদ টিউলিপ দেখা যাচ্ছে।
“মাদাম, আপনি বাড়িতে যান আমি আসছি।” হাতের জিনিসগুলো রেখে দৌড়ে গেল সেদিকে। ফুল দুটো দেখে ওর হৃদয় এবং চোখ প্রশান্তিতে ভরে যায়। ছিঁড়বে কি না ভাবতে লাগল। পেছন ফিরে বলল,
“মাদাম?”
“হ্যাঁ, বলো।”
“ফুলদুটো ভীষণ সুন্দর।”
“ছিঁড়ে আনো।”
“সত্যি ছিঁড়ব?”
“তাই তো করতে ছুটে গেছো।”
“না, থাক।” মনমরা হয়ে উঠে দাঁড়ায় ইসাবেলা। ফুল গাছেই সুন্দর। হাতে এলে মূর্ছে যাবে। মাদাম ব্রিজের ওপর থেমে ওর দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ছাগলে খেয়ে নেবে দেখলে। তুমি বরং ছিঁড়েই আনো ইসাবেলা।”
“এত সুন্দর ফুল ছাগল খেয়ে নেবে!”
“ছাগলের তো আর তোমার আমার মতো সৌন্দর্য জ্ঞান নেই। ওরা যা দেখে খাদ্য হিসেবেই দেখে। আর কথা বাড়িও না। চলে এসো তাড়াতাড়ি। ঘরে অনেক কাজ পড়ে আছে। মাতভের গোসলের সময় হলো।”
ফুল ছিঁড়া নিয়ে এতক্ষণ দোনোমোনো ছিল। মাতভেইর কথা মনে পড়তে ফুলগুলো ছিঁড়ে নিয়ে রেখে যাওয়া ব্যাগ তুলে চললো বাড়ির দিকে। মাদাম আদলৌনা হাতের ব্যাগ সহ কিচেনে ঢুকেছেন। পরনের সোয়েটার খুলতে খুলতে বললেন,
“মাতভেই কী করছে দেখে এসো তো ইসাবেলা।”
“এক্ষুনি যাচ্ছি।”
হাতের ব্যাগ নামিয়ে সোয়েটার খুলে ফুলদুটো নিয়ে চলে এলো দোতলায়। মাতভেইর দরজায় নক করতে ভেতর থেকে জবাব এলো,
“এসো ইসাবেল।”
আহত পা মেলে বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসেছিল মাতভেই। হাতে নতুন বই। ইসাবেলা উচ্ছ্বসিত হয়ে ওর সামনে বসে বলল,
“দেখো কী এনেছি!”
হাতের বইটা কোলের ওপর রাখল মাতভেই। গোল চশমা নাকের ওপরে ঠেলে ইসাবেলার হাতের ফুলগুলোর দিকে তাকাল।
“হলুদ টিউলিপ!”
“সুন্দর না?”
“খুব। তা কোথায় পেলে এই সুন্দরীদের?”
খিলখিল করে হেসে উঠল ইসাবেলা।
“ব্রিজের পাশে। তোমার পছন্দ হয়েছে?”
“অনেক।”
মাতভেই বইটা পুনরায় খুললো। ইসাবেলা উঠে বেডের পাশের ছোট্ট টেবিলের ফুলদানির পাশে রাখল টিউলিপ দুটো। ফুলদানির ফুলগুলো নেতিয়ে পড়েছে। ওগুলো নিয়ে নিচে এলো। মাদাম কিচেনে নেই। ইসাবেলা ফুলদানি পরিষ্কার করে নতুন পানি ভরে আবার ওপরে উঠে এলো। আগের স্থানে ফুলদানিটা রেখে টিউলিপ দুটো ওতে রাখল। মাতভেই বই থেকে মুখ তুলে ওর হাসিমুখ দেখে মুচকি হাসল। ইসাবেলা ওর দিকে ফিরতে দৃষ্টি নামিয়ে নিলো মাতভেই। মুখোমুখি বসল ইসাবেলা।
“কী পড়ছ?”
“বই।” বিদ্রুপের সুরে বলল মাতভেই। ঠোঁট উলটে ফেলে ইসাবেলা। ওর গাল টেনে দিয়ে মাতভেই বলল,
“তুমি এত কিউট কেন?”
“উঁহু, মাতভেই!” গাল ডলতে ডলতে রেগে তাকাল ইসাবেলা। মাতভেই বইটা রেখে পাশ থেকে নতুন একটা বই বের করে বলল,
“এটা ধরো।”
“আমার জন্য?”
“হুম, এটা পড়লে বাল্টিক ভাষা আরো ভালো বলতে পারবে। যদিও অনেক স্পষ্ট এখন তোমার উচ্চারণ। তবে আরো চর্চা করতে হবে। কোথাও সমস্যা হলে আমাকে জিজ্ঞেস করবে, ঠিক আছে?”
“ইয়েস, স্যার।” স্যালুট করতে মাতভেই হাসল আবার। ওর সাথে ইসাবেলাও। ইসাবেলার হাসি মুখে মুগ্ধ নয়নে চেয়ে রইল মাতভেই। এই মেয়েটার মুখ কারো কথা মনে করিয়ে দেয়। কত স্মৃতি তখন ভাস্বর হয় হৃদয়পটে! ইসাবেলার মাথার স্কার্ফ থেকে কয়েকটা চুল বেরিয়ে এসে কপালে পড়েছে। ঝুঁকে তর্জনী দিয়ে ছুঁয়ে কানের পাশে গুঁজে দিলো মাতভেই। ইসাবেলার হাসি থেমে যায়। একদৃষ্টে চেয়ে আছে মাতভেইর চোখে।
“বেল?” ইসাবেলার গালের একপাশে হাত রাখল মাতভেই। ইসাবেলা জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে। এই নৈকট্য ওকে অস্বস্তি দেয়। সরে বসতে গিয়েও জড়তা জাগে।
“বেল?”
“হুঁ?”
“তুমি আমাকে বিশ্বাস করো?”
“হ্যাঁ।”
মাতভেই মুচকি হেসে ওর কপালে চুমু দিয়ে আগের মতো সরে বসল। ইসাবেলা কিছুই যেন বুঝল না। ভুরু কুঁচকে বলল,
“কেন বললে ওকথা?”
“কোন কথা?” বইয়ে ফের মনোযোগ দিলো মাতভেই।
“বিশ্বাস করি কি না।”
“আমি কাছে যাওয়াতে অস্বস্তি হচ্ছিল তোমার। ভেবেছিলে কিছু বোধহয় করে ফেলব, তাই না?”
লজ্জিত হয় ইসাবেলা। মাতভেই শব্দ করে হাসল।
“তোমাকে মাস দুই আগে কী বলেছিলাম মনে আছে?”
“হ্যাঁ, তুমি আমাকে বন্ধু ভাবো।”
“এক্সাক্টলি, তাহলে আমার সাথে এখনো সহজ হও না কেন তুমি? এত জড়তা কীসের? তুমি কি অন্যকিছু ভাবো__”
“না, না। আমি বন্ধু আর বড়োভাই ছাড়া আর কিছু ভাবি না তোমাকে। কসম করে বলছি।”
গলা ছুঁয়ে বলল ইসাবেলা। ওর আতঙ্কিত মুখ দেখে না হেসে পারে না মাতভেই।
“বোকা মেয়ে, আমি তো এমনিতেই বলেছি। আয়নায় তাকাও কেমন আতঙ্কিত হয়ে আছে তোমার মুখ। সামান্যতেই ঘাবড়ে গেছো। এসব কিন্তু ভালো লক্ষণ নয় ইসাবেল।” দুষ্টু চোখে ভুরু নাচাতে লাগল মাতভেই। ইসাবেলা রুষ্ট মুখে উঠে দাঁড়ায়। হাতের বইটা দিয়ে মাতভেইর বাহুতে বাড়ি দিয়ে বলে,
“তুমি সবসময়ই এমন ফাজলামো করো মাতভেই। ধ্যাৎ! ভালো লাগে না। আর কখনো ফুল এনে দেবো না তোমাকে।”
“আচ্ছা, সরি। এই নাকে ধরেছি।”
“লাগবে না তোমার সরি। অসভ্য কোথাকার।”
গাল ফুলিয়ে বেরিয়ে যায় মাতভেইর ঘর থেকে। মাদাম আদলৌনা কিচেনে দুপুরের খাবার তৈরি করছিলেন। চুলায় মাতভেইর গোসলের পানি গরম হচ্ছে। ইসাবেলার গোমড়া মুখ এসে বসল চুলার পাশে।
“আবার কী হয়েছে?” জানতে চাইলেন মাদাম আদলৌনা। ইসাবেলা বলল,
“কিছু না।”
হাঁপ ছেড়ে আটা গুলতে লাগলেন মাদাম।
“তোমার কারণে ছেলেটার মুখে একটু হাসি দেখি। না হলে পায়ের কারণে ছেলে আমার ডিপ্রেশনে ভুগছিল। বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছিল মাতভেই। দিনরাত বন্ধ ঘরে বসে দুশ্চিন্তা করত। কথা বলাও ছেড়ে দিয়েছিল। তোমার কারণে ছেলেটা আমার আবার আগের মতো হয়েছে। কোনোদিন ওর পা ঠিক হবে কি না জানি না, কিন্তু ও বাঁচার আশা আর ছাড়বে না। তুমি ওকে সেই মনোবল জুগিয়েছ। কৃতজ্ঞ আমি তোমার কাছে ইসাবেলা।”
“এসব বলে আমাকে লজ্জা দেবেন না মাদাম। কৃতজ্ঞ তো আমি আপনাদের কাছে। অচেনা একটা মেয়েকে আপন সন্তানের মতো গৃহে আশ্রয় দিয়েছেন। মাতভেই ছোটোবোনের মতো ভালোবাসা দিয়েছে। আপনাদের এই ঋণ আমি কিছুতেই পূরণ করতে পারব না।”
মাদাম হাত ধুয়ে ইসাবেলাকে কাছে ডাকেন। ওকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বলেন,
“সৃষ্টিকর্তা তোমার দুঃখ কষ্ট লাঘব করে দিন। সুখী হও জীবনে মা।”
ইসাবেলা সরে এসে মাদামের হাতটা ধরে অশ্রুসজল চোখে বলে,
“মাতভেই আবার হাঁটবে। আবার আগের মতো স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরবে ও। আপনি চিন্তা করবেন না ওকে নিয়ে।”
“হুম, তাই যেন হয় মা।”
মাদাম আবার ব্রেড বানানোর কাজে লেগে যান। ইসাবেলা স্যুপ তৈরির প্রস্তুতি নেয়। স্যুপ তৈরির সামগ্রীর মধ্যে গাজর খুঁজে পেল না।
“মাদাম গাজর তো আনা হয়নি।”
“আহ! ভুলে গেছি।”
“এখন গিয়ে নিয়ে আসব?”
“ঠিক আছে। সাথে দু হালি ডিমও এনো।”
পার্স থেকে টাকা বের করে দিলেন ইসাবেলাকে। ব্রিজের পথে গেলে সময় বেশি লাগে। সময় বাঁচাতে পুব দিকে জঙ্গলঘেরা হাঁটু সমান বরফের ওপর দিয়ে রওনা হয়। এই পথে যেতে ওর ভালোয় লাগে। পাখির কূজন শুনতে শুনতে এগিয়ে যায়। দুপুর হতেই সূর্যের তেজ ম্লান হয়। মৃদু বাতাসে উড়ে আসা বরফের ছাঁট বাড়িয়ে দেয় ওর গায়ের কাঁপুনি। শ্বাস প্রশ্বাসের সাথে মুখ থেকে ধোঁয়া ওড়ে। বাজারে পৌঁছে কেজি খানেক গাজর আর দু হালি ডিম নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হয় আবার। ডিম আর গাজর একটা ব্যাগে ভরে বা’বাহুর সাথে বুকে জড়িয়ে নিয়েছে। ডান হাতে চিকন লম্বা একটা গাজর। ওটা এক এক কামড়ে চর্বণ করতে করতে জঙ্গলের পথ ধরে এগোচ্ছিল। হঠাৎ একটা পরিচিত গন্ধে পা জমে গেল। সেই সোঁদা মাটির গন্ধ! ডান হাতের অর্ধ খাওয়া গাজর ঠোঁটের কাছের থেমে আছে। বা’বাহু শক্ত হয় ব্যাগের ওপর। ঘুরে তাকায় বা’দিকে। না কেউ নেই। ধীরে ধীরে ডান দিকে ঘুরতেই চমকে ওঠে। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিকোলাস। পরনে সেই কালো আলখেল্লা। হুডি ঘাড়ের ওপর পড়ে আছে। চট করে দৃষ্টি সরিয়ে নেয় ইসাবেলা। কান্নার তরঙ্গ ওর বুকে আছড়ে পড়ে। চোখ দু’টো ভীষণ জ্বলছে। হাত- পা জমে যাওয়ার উপক্রম। ডান হাতের গাজর মাটিতে পড়ে যায়। ব্যাগটাও হয়তো পড়ত, ইসাবেলা বাহু শক্ত করে। এতদিন বাদে নিকোলাসকে দেখে বুকের বা’পাশে গোপন ব্যথাটা নড়ে উঠল। প্রকাশ্যে আসার জন্য বেপরোয়া। আর দুর্বল হতে চায় না ইসাবেলা। যে নির্দয়ভাবে ছেড়ে গেছে তার প্রতি কোনো আবেগ জাহির করবে না। দ্রুত পদে হাঁটতে লাগল সামনে। যত এগোচ্ছে সেই পরিচিত গন্ধটা ততই হারিয়ে যাচ্ছে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ইসাবেলার। চেপে রাখা কান্নাটা বানের জলের মতো ফুঁসে ফেঁপে বেরিয়ে এলো চোখ দিয়ে। চোখ মুছতে মুছতে ছুটল বাড়ির দিকে। পেছন ফিরে তাকাবে না ও। নিকোলাসের জন্য ওর মনে আর কোনো স্থান নেই। কিন্তু মন যে সেকথা মানতে চাইল না। এত উপেক্ষা আর ব্যথার পরেও নিকোলাসকে আরেকবার দেখার সাধ জাগে। থেমে যায় ইসাবেলা। ঘুরে দাঁড়ায় জঙ্গলের দিকে। নিকোলাসের ছায়াও এখন আর নেই সেখানে। ঠোঁট শক্ত করে চেপে ব্রিজে ওঠে। বিড়বিড় করে অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলে,
“কেন নিকোলাস? কেন? আর যে সহ্য হয় না আমার। হৃদয় ভাঙার ব্যথা কত সাংঘাতিক যদি জানতেন আপনি নিকোলাস! যদি বুঝতেন সেদিন কতটা আঘাত আমায় দিয়েছেন! বোকা আমি, ভুলে যাই কারো দুঃখে আপনার কিছু এসে যায় না। ভুলে যাই আপনার কাছে কিছু আশা করা বোকামি। এত কিছু জেনেও আমার মন বার বার একই ভুল, একই বোকামি করে। কী করব এই মনকে নিয়ে আমি? কী করব!”
চলবে,,,