তিমিরে ফোটা গোলাপ পর্ব-২৬+২৭+২৮

0
1079

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব-২৬
Writer Taniya Sheikh

প্যালেসে ফিরে যাওয়ার পথ রুদ্ধ। ওদিকটাতে নাৎসি সৈন্যরা টহল দিচ্ছে। অন্য কোনো দিক দিয়ে ফেরার আর উপায় নেই। নিকোলাস একা হলে সমস্যা হতো না। ধোঁয়া হয়ে বাতাসে মিশে সে যে কোনোখানে চলে যেতে পারে। কিন্তু ইসাবেলা মানুষ। লোকচোখে সে পড়বেই। এদিকে রাতও শেষ হওয়ার পথে। ভোরের সূর্যোদয়ের আগেই অন্ধকার নির্জন স্থান খুঁজতে হবে। হাতে সময় কম।

“পিঠে ওঠো।”

“আবার!”

“হ্যাঁ।”

“না, আর উঠব না। হেঁটে যেখানে যাওয়ার চলুন।”
ইসাবেলা রুষ্ট মুখে বলে হাঁটা ধরলো। চাঁদের আলোতে ঝোপেঝাড় পাশ কাটিয়ে সামনে এগোয়। নিকোলাস রাগটা দমিয়ে শুধায়,

“ওদিকে কোথায় যাচ্ছ শুনি?”

“জানি না।” এদিক ওদিক তাকিয়ে আগাথাকে খোঁজার চেষ্টা করল ইসাবেলা। দেখা দিয়ে একটু সংকেত টংকেতও তো দিতে পারে। এই পিশাচটার সাথে থাকতে ওর একটু ইচ্ছে করছে না। বিড়বিড় করে বারকয়েক ডাকল,”আগাথা, আগাথা।”

না! কোনো চিহ্নই নেই তাঁর। রাগে জোরে জোরে পা ফেলে এগোয়। পেছন থেকে নিকোলাস ধমকে ওঠে,

“বেলা, থামো বলছি।”

ইসাবেলা উপেক্ষা করল সেই ধমক। নিকোলাস মুহূর্তে ওর সামনে এসে দাঁড়ায়। রেগে আছে। মুখটা আর হুডির আড়ালে ঢাকা নেই। জ্বলন্ত লাল চোখ দুটো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে। শ্বদন্ত বেরিয়ে এসেছে এবার। ইসাবেলার বাহু সজোরে চেপে ধরে মুখটা খুব কাছে এনে বলল,

“তোমাকে থামতে বলেছিলাম আমি, বেলা। কেন শুনছ না আমার কথা তুমি? বার বার অসম্মান করছ আর বার বারই তোমাকে ক্ষমা করতে হচ্ছে। ধৈর্যের একটা সীমা আছে।”

“কে চেয়েছে ক্ষমা? মেরে ফেলুন। শেষ করে ফেলুন আমাকে।” শান্ত স্বরে বেশ স্বাভাবিক মুখে বলল ইসাবেলা। পরস্পরের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ওরা। নিকোলাসের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে ইসাবেলার চোখের স্থিরতা দেখে। ভয় নেই তাতে। নিকোলাস কিছুতেই এই ঔদ্ধত্য বরদাস্ত করবে না। বাহু ছেড়ে ইসাবেলার চোয়াল চেপে ধরে।

“মরার খুব শখ তোমার তাই না? হবেও বা না কেন? বিয়ের দুদিন আগে যার হবু স্বামী পালিয়ে যায় সে বেঁচে থাকতে চাইবে কোন মুখে? তোমাকে কেন মারছি না জানো বেলা? বড্ড করুনা হয় তোমার ওপর। যাকে মনপ্রাণ উজাড় করে ভালোবাসলে সেই ছেড়ে পালিয়ে গেল। বেচারী!”

ঠিক হৃদয়ের পুরোনো ক্ষতটাতে ফের একচোট খোঁচা দিলো নিকোলাস। ইসাবেলার চোখ আগুনের ফুলকি ন্যায় জ্বলছে। দু’হাতের শক্তি দিয়ে নিকোলাসের বুকে আঘাত করে সরিয়ে দিতে চায়। কিন্তু পারে না। চোয়াল শক্ত করে ধরেছে নিকোলাস। এই ব্যথা কিছুই না ওর কথার আঘাতের চেয়ে। ভীষণ কান্না পাচ্ছে ইসাবেলার। দাঁতে দাঁত কামড়ে কান্না চেপে রেখেছে। কোনো কথায় আর বলবে না নিকোলাসের সাথে। কীভাবে বলবে? কান্না ছাড়া আর যে কিছু আসছে না। শত চেষ্টার পরও ওর চোখ দুটো বেঈমানী করল। অশ্রু বিসর্জন দিলো আঁখিজোড়া। নিজেকে আজ সেই দুর্বল ইসাবেলা মনে হলো, যে পিটারের নিরুদ্দেশ হওয়ার পর বিরহে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিল।ভগ্নহৃদয়ের সেই ব্যথা পুনরায় আজ একইভাবে ফিরে এলো। ইসাবেলার বন্ধ ভেজা নেত্রপল্লবের দিকে চেয়ে নিকোলাসের ভেতরের পিশাচসত্ত্বার পৈশাচিক হাসি উবে যায়। ছেড়ে দিলো ওর চোয়াল। ঠিক সাথে সাথে ধপ করে হাঁটু ভেঙে নিচে বসে পড়ে ইসাবেলা, নিকোলাসের পায়ের কাছে। দু’হাতে মুখ ঢেকে উবু হয়ে কাঁদতে লাগল। ভালো যে বেসেছে সেই জানে ব্যর্থতায় কত জ্বালা! কত গভীর এর ব্যথা। ইসাবেলাকে নত করতে সেই ব্যথা নিয়ে উপহাস করেছে নিকোলাস। ভালো তো কোনোদিন কাওকে বাসেনি, বুঝবে কী করে বিরহের ব্যথা কতখানি! ইসাবেলার কান্না নিকোলাসের পিশাচসত্ত্বাকেও স্তব্ধ করে দেয়। নিজের ওপর খুব রাগ হলো নিকোলাসের। নির্দয়, পাষাণ! তিরস্কার করল নিজেকে। ইসাবেলার সোজাসুজি বসল সে। ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো পরম আদরে। ইসাবেলা চুপচাপ ওর বুকে মাথা রেখে কাঁদছে। নিকোলাস অনুতাপের সাথে নরম গলায় বলল,

“আ’ম সরি বেলা। আ’ম সরি।”

ইসাবেলার যেন ঘোর কাটল। সাথে নিকোলাসেরও। ছিটকে সরে বসল দুজন। রাগে ফর্সা মুখটা লাল হয়ে উঠেছে ইসাবেলার। তাকাচ্ছে না নিকোলাসের দিকে। নিকোলাসের ছায়াও দেখতে রাজি না এই মুহূর্তে। নিকোলাস উঠে দাঁড়ায়। আ’ম সরি বলেছে! শব্দ দুটো ফিরিয়ে নেওয়া গেলে তাই করত হয়তো। দূর্ভাগ্য তা আর সম্ভব না। ওরা এই মুহূর্তে জঙ্গলের কোনদিকে আছে ঠিক জানে না। আশেপাশে কোথাও ঝরণা আছে। রাতের নিস্তব্ধতার সাথে বড়ো ভাব করে ঝরছে ঝরনার জল। সকরুণ তার সুর। গাছ, গুল্মলতায় ছড়াছড়ি চারিদিক। থেকে থেকে দু একটা পেঁচার ডাক শোনা যাচ্ছে। ইসাবেলা উঠে কাপড় ঝেড়ে নেয়। এখনও কেঁপে কেঁপে উঠছে ওর দেহ। নিকোলাস শান্ত গলায় বলল,

“ভোর হতে বেশি সময় নেই। আমাকে নির্জন অন্ধকার একটা জায়গা খুঁজতে হবে। চলো আমার সাথে।”

কোনো উচ্চবাচ্য না করে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল ইসাবেলা। নিকোলাস একদৃষ্টে ওর অবনত মুখটা দেখল। তখন চোয়াল চেপে ধরায় আঙুলের ছাপ পড়ে আছে ওর সুন্দর মুখে। খারাপ লাগল বড্ড নিকোলাসের। ঘুরে দাঁড়ায় সে।

“পায়ে হেঁটে জায়গাটা ভোরের আগে খুঁজে বের করা অসম্ভব। পিঠে চড়ো।”

এবারো নিকোলাসকে অবাক করে একটু ইতস্তত করে পেছন থেকে গলা জড়িয়ে ধরে ইসাবেলা। মুচকি হাসল নিকোলাস। ওর গায়ের ঘ্রাণ লম্বা শ্বাস টেনে নিলো। ইসাবেলা অবশ্য তা টের পেল না। খুব অস্বস্তি হচ্ছে ওর। চিৎকার করে আবার কাঁদতে ইচ্ছে করছে অথবা এক ছুটে নিকোলাসের কাছ থেকে পালিয়ে যেতে পারলে শান্তি পেত।

“পা তোলো।”

ইসাবেলা সময় নেয় পা তুলতে। পা দিয়ে নিকোলাসের কোমড় জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে দু ফোটা অশ্রু ফেলে। না, এ কষ্টের অশ্রু নয়। ক্রোধ ক্ষয়ে ক্ষয়ে নোনাজল গড়াচ্ছে। দূর্ভাগ্য! ও পিশাচ শেষ করার কৌশল জানে না। জানলে আজ এই মুহূর্তে নিকোলাসকে শেষ করত। এই অসহায়ত্বের অবসান ঘটাত। ঘৃণা করে নিকোলাসকে, প্রচণ্ড ঘৃণা করে। নিকোলাস ইসাবেলাকে পিঠে করে বনের ওপরের দিকে যেখান থেকে ঝরনার জল পড়ার শব্দ আসছে সেদিকে ছোটে। ঝরনার আশেপাশে তেমন নিরাপদ স্থান খুঁজে পেল না। ওরা আরো ওপরে উঠল। রাত শেষ হতে বেশি সময় বাকি নেই। নিকোলাস বিচলিত হয়ে পড়ে। ইসাবেলা এখনও বুঝে উঠছে না কেন এখানে নিকোলাস? সেই তাকে প্যালেস ছেড়ে যেতে বলেছিল। তাহলে আবার কী চাই? খুব ইচ্ছে করছে প্রশ্নটা করতে। কিন্তু না, সে ওর সাথে কোনো কথায় আর বলবে না। মুখ খুললেই আঘাত করবে নিকোলাস তাকে। হয় শরীরে নয় মনে। একেবারে মেরে ফেলে না কেন?

“বলল না তোকে করুনা করে। বেচারী ভাবে।”

দ্বিতীয় সত্তা বলল। আবার কান্না পায় ইসাবেলার। ক্রোধ বাড়ে নিকোলাসের ওপর। কাঁধে ইসাবেলার হাতের চাপ বাড়তে গতি শ্লথ করে নিকোলাস। কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই ইসাবেলা বলে ওঠে,

“ওই যে একটা গুহা দেখা যায়।” বলেই জিহবা কামড়ে ফেলল। নিকোলাসকে সাহায্য করছে সে! ইচ্ছে হলো নিজের গলা নিজে টিপে ধরতে। নিকোলাস ওর অবস্থা বুঝে মুচকি হাসল। গুহার সামনে যেতে তাড়াতাড়ি গলা ছেড়ে দেয়। কোমর ছেড়ে মাটিতে পা রাখে ইসাবেলা। নিকোলাস একপলক তাকালেও কিছু বলল না। গুহার দিকে এগোতে থেমে গেল। বলল,
“তুমি এখানেই দাঁড়াও। আগে গিয়ে ভেতরটা দেখে আসি। এসব গুহার ভেতরটা সচরাচর নিরাপদ হয় না।”

ইসাবেলা মাথা নাড়িয়ে আশপাশে তাকানোর ভান করে। নিকোলাস চোখের পলকে গুহার ভেতর ঢুকে গেল। গুহার সামনে বেড়ে উঠেছে ঝোপঝাড়। চাঁদের আলো স্নাত এদিক। ঝোপঝাড় থেকে আগত ঝিঁঝিপোকার ডাক থেমে গেল হঠাৎ। ভীত চোখে এদিক ওদিক তাকায় ইসাবেলা।

“ইসাবেলা”

ডাকটা ঠিক বা’পাশ থেকে এলো। আগাথা ডাকছেন। বেঁটেমতো অজানা এক বুনো গাছের আড়াল থেকে। গাছটাকে জড়িয়ে ধরেছে অনেকগুলো গুল্মলতা। আগাথা গুহার দিকে চেয়ে একটু যেন ভেবেচিন্তে এগিয়ে এলেন।

“আগাথা! কোথায় ছিলেন এতক্ষণ? নিকোলাস আমাকে_”

“হুশ, আমি সব দেখেছি।”

“এখন আমি কী করব? কিছু একটা উপায় করুন এখান থেকে যাওয়ার।”

“এখান থেকে যাবে না তুমি।”

“কী বলছেন? ওই পিশাচটার সাথে গুহায় থাকতে বলছেন আমাকে?”

“হ্যাঁ”

“তবে ওকে শেষ করার কৌশল বলে দিন।”

“এখনই না।”

“এখনই না?”

আগাথা মাথা নাড়ায় দুদিকে।

“মনে নেই আমি কী বলেছি? আগে সেসব করতে হবে তোমাকে। তারপর__” আগাথা থেমে গেলেন। সতর্ক হয়ে তাকালেন গুহার মুখের দিকে। ইসাবেলা অধৈর্য হয়ে বলল,

“তারপর?”

“আমি পরে আবার আসব ইসাবেলা। এখন আর কোনো কথা নয়। নিকোলাস যেভাবে বলবে তাই করবে। আপাতত এই তোমাকে উপদেশ দিলাম। চলি।”

চোখের নিমেষে উধাও হলো আগাথা। ইসাবেলা হতাশ, বিরক্ত গলায় বলল,

“আবার উধাও হলো।”

“কে আবার উধাও হলো?”

নিকোলাসের গলা শুনে চকিতে তাকায়। আগাথার উধাও হওয়ার কারণ তাহলে এই! প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিকোলাস। ইসাবেলা দৃষ্টি সরিয়ে মাথা নাড়িয়ে বুঝাতে চাইল, কেউ না। নিকোলাস অপলক চেয়ে রইল। হঠাৎ ওর ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ হাসি জেগে ওঠে। গুহার মুখের দিকে ঘুরে বলল,

“ভেতরে সব ঠিক আছে। এসো।”

মাকড়সার অভয়ারণ্য, শ্যাওলা ধরা গুহার চতুর্দিক, বন্য প্রাণীর বিষ্ঠাভরা উৎকট গন্ধ গুহার ভেতরে। পেট উগলে বমি আসার উপক্রম হলো ইসাবেলার। এ পর্যন্তই চাঁদের আবছা আলো পৌছেছে। গুহার আরো ভেতরে ঘুটঘুটে আঁধার। থেমে দাঁড়ায় ওরা। নিকোলাস ঘুরে বলল,

“তুমি দুপুর পর্যন্ত এখানেই থাকবে। এখানে মানে এখানে।” তর্জনী তুলে ওদের দাঁড়ানোর স্থানটা নির্দেশ করে। এই বিশ্রী গন্ধভরা, পোকামাকড়ের অভয়ারণ্যে কী করে থাকবে ইসাবেলা? সবাইকে নিজের মতো অমানুষ, জানোয়ার ভেবেছে নিকোলাস? দেখছে নাক মুখ চেপে আছে সে তারপরও বলছে এখানেই থাকতে হবে। নেহাৎ কথা বলবে না বলে পণ করেছে নয়তো ঝগড়া হয়ে যেত।

“হুম, তারপর আবার তোমাকে আচ্ছা মতো দিতো।”

“সেই কারণেই চুপচাপ সয়ে যাচ্ছি।” দাঁত কিড়মিড় করে মনকে জবাব ইসাবেলা। একবার নিকোলাস ঘুমিয়ে যাক। তারপর গুহা থেকে বেরিয়ে যাবে। দুপুরে ও জেগে ওঠার আগে এখানে ফিরে আসবে। আগাথার পরামর্শে মনের বিরুদ্ধে গিয়ে থাকতে হচ্ছে নিকোলাসের সাথে। ভ্যালেরিয়ার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবে সে। এর জন্য যা সহ্য করা হয় করবে, মরতে হয় মরবে।

নিকোলাস অন্ধকারে মিলিয়ে যাবার আগে পুনরায় ফিরে আসে। ভেবেছিল খুব কড়া করে চূড়ান্তভাবে সাবধান করবে। ভয় দেখাবে যেন ওর অনুপস্থিতিতে গুহা ছেড়ে না বেরিয়ে যায়। এই মেয়ের ভরসা নেই। দেখা গেল আবার নতুন একটা বিপদের মুখে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। সকল কথায় নিকোলাস ভুলে গেল ইসাবেলার ঠোঁটে তাকাতে। ভাবুক মুখে নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে আছে ইসাবেলা। গুহার ছোট্ট ছিদ্র গলে চাঁদের আলো পড়েছে ওর মুখে। নিজের ওপর যেন নিয়ন্ত্রণ হারালো নিকোলাস। প্রসঙ্গ ভুলে গেল। ইসাবেলা ভুরু কুঁচকে তাকাতে ঝুঁকে যায় ওর মুখের দিকে। এতটা ঝুঁকে যায় যে ওদের ঠোঁটের মাঝে অতি সামান্য ফাঁক থাকে। ইসাবেলা সম্মোহিত হয় নিকোলাসের চোখে চোখ রাখতে। চাপা সম্মোহনী গলায় নিকোলাস বলে,

“তোমার পাতলা গোলাপি ঠোঁটদুটো বড়ো প্রলুব্ধ করে আমায়। যেন বলে, এসো প্রিয়, দখল করো আমাকে। স্বৈরাচারের মতো অধিকার করো আমায়।” থামে নিকোলাস। গভীর নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো নাক টানে। আরো ঝুঁকে আসে। ইসাবেলা টের পাচ্ছে ওর বুকের বা’পাশ উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। সে সরে দাঁড়াতে চায়, ঠেলে সরাতে চায় নিকোলাসকে। কিন্তু কীভাবে করবে? সমস্ত শরীর ওই নীল সিন্ধু আঁখির মোহে মোহাচ্ছন্ন। চেতনা থেকেও তা যেন অসাড়। আজ যদি নিকোলাস ওকে চুমু খায় ও ছাড়বে না নিকোলাসকে। কঠিন শাস্তি দেবে। ভেতরটা ক্রোধে ফেটে পড়ছে। প্রার্থনা করছে নিকোলাস দূর হয়ে যাক, এই মোহে কেটে যাক। কিন্তু তা এত সহজে নিকোলাস হতে দেবে না বোধহয়। ঠোঁট দু’টো ঈষৎ ফাঁক করতে ওর মুখের শীতল বায়ু আছড়ে পড়ে ইসাবেলার ঠোঁটে। না চাইতেও ঠোঁট জোড়া খুলে যায়। দুজনের শ্বাসবায়ু একসাথে জড়াজড়ি করে দু’জোড়া ঠোঁটের মাঝে। ইসাবেলা সব ভুলে যায়। চোখ মুদে ফেলে। বশীভূতের ন্যায় সমর্পণ করে। ঠিক তখনই উপলব্ধি করে মুখে আর সেই শীতল বায়ু পড়ছে না। নেমে এসেছে কানের লতিকায়। চাপা স্বরে নিকোলাস ওর কানে কানে বলল,

“আমাকে প্রলুব্ধ করার শাস্তি কত ভয়ানক হয় জানে না তোমার ওষ্ঠ জোড়া। সাবধান করে দিয়ো তাকে। অঘটন ঘটে গেলে দোষী করতে পারবে না তোমার প্রথম চুমু চুরির দায়ে।”

ইসাবেলা স্তম্ভিত। মুখে রা নেই। নিকোলাস ঘুরে দাঁড়াতে দু’হাতে ঠোঁট ঢেকে ফেলল। সত্যি কী ওর ঠোঁট প্রলুব্ধ করেছে? কখন? কীভাবে? হতবুদ্ধি হয়ে গেল। একটু আগে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যা বলেছিল তা কতকটা নিকোলাসের দূর্বলতাকে প্রকাশ করে। নিজের সেই দুর্বলতা ঢাকতে বলল,

“বেলা, আমি চোর নই ডাকাত। ডাকাতেরা বড়ো নিষ্ঠুর হয়। কোনো দায়ের ধার ধারে না। সুতরাং এমন কিছু করবে না যেন ডাকাতির পর্যায়ে নামতে হয় আমাকে। ক্ষতি কিন্তু তোমারই হবে। তাই ভালো মেয়ের মতো যা বলেছি শুনবে আশা করি।”

ইসাবেলা কিছু বলার বা ভাবার আগেই নিকোলাস সামনের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

চলবে,,,

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব-২৭
Writer তানিয়া শেখ

গত দুদিন টানা বর্ষণের শেষে আজ একটুখানি রোদ উঠেছিল। সেটাও কোথায় যেন মিলিয়ে গেল বেলা বাড়তে। ধোঁয়াটে মেঘলা আকাশ জানান দিচ্ছে যে কোনো সময় আকাশে ধুম্বল তুলে আবার শুরু হবে বৃষ্টি। একে বুঝি শীত আগমনী বৃষ্টি বলে। কেমন ঠাণ্ডা ভেজা বাতাস বইছে। পাতলা ফ্রকে শীতটা বেশ লাগছে ইসাবেলার। গত দুদিন একই কাপড় পরে আছে সে। নিকোলাস জাগার পূর্বে ফ্রক ছেড়ে গুহার মুখের কাছে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজেছে। তারপর আবার ওই ছেঁড়া ফাটা ফ্রক পরেছে। ঠাণ্ডা বসে সর্দি লেগে গেছে তাতে। একটু পরপরই নাক টানছে। হাতে হাত ঘষে একটু উঞ্চতা জন্য। নিকোলাস চুপচাপ সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। পেছন ফিরে এক নজর দেখছেও না ইসাবেলাকে। ইসাবেলা যদি টুপ করে কোথাও লুকিয়ে পড়ে ও কি টের পাবে? একটুখানি দাঁড়িয়ে গেল এই ভেবে। সর্দি লাগলে ভেতরটা কেমন নিস্তেজ হয়ে আসে। অল্পতেই কাহিল মনে হয়। এতক্ষণ হেঁটে খুব ক্লান্ত লাগছে। কাঁচা রাস্তার পাশে দু’হাটু তুলে বসে পড়ল। গতদিনের বৃষ্টিতে জায়গাটা স্যাঁতসেঁতে। শরীর ছেড়ে বসা গেল না। হাঁটু জড়িয়ে মাথাটা রাখল। কদিন ভালো ঘুম হয়নি ইসাবেলার। ক্লান্তিতে চোখটা লেগে এসেছিল। হঠাৎ গান ফায়ারিং-এর শব্দে চমকে ওঠে। নিকোলাস ওকে বলেছে গরলিটজ থেকে অনেক দূর চলে এসেছে ওরা। তাছাড়া এখন যে বনে আছে সেটাও খুব গহীন। জার্মান সৈন্যদের এই পর্যন্ত আসার সম্ভবনা তেমন নেই। তাহলে গান ফায়ারিং এর শব্দ কোথা থেকে এলো?

“বেলা!”

সামনে উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে নিকোলাস। ফিরে এসেছে ও। ইসাবেলা উঠে ওর কাছাকাছি গিয়ে আর্ত কণ্ঠে বলল,

“গান ফায়ারিং শুনেছেন?”

নিকোলাস সে কথার জবাব না দিয়ে এগিয়ে এলো। রাগত গলায় বলল,

“এখানে কী করছিলে? বলেছিলাম না অনুসরণ করতে? সব সময় আমার কথা অমান্য করতে হবে তোমার? মন তো চাচ্ছে ফেলে চলে যাই এক্ষুনি।”

নিকোলাসের ধমকে ইসাবেলার চোখ ছলছল করে। সে ভয় পেয়েছিল। নিকোলাস সেটা বুঝেও তাকে ধমকাচ্ছে। রাগ হলো খুব। আবার আগের স্থানে গিয়ে বসে পড়ে।

“আবার বসলে যে?”

“আমি আপনার সাথে কোথাও যাব না। চলে যান।”

“বেলা!”

“ধমকাবেন না আমাকে আপনি।”

নিকোলাসের চাইতে দ্বিগুণ জোরে চেঁচিয়ে ওঠে ইসাবেলা।

“আমি আপনাকে বলেছি সাহায্য করতে? আপনি স্বেচ্ছায় করছেন। কেন করছেন? বলেন কেন করছেন? আমাকে সাহায্য করার পেছনে কী স্বার্থ লুকিয়ে আছে আপনার? এমনিতে তো আপনার মতো পিশাচ কাওকে সাহায্য করে না। তাহলে?”

নিকোলাসের চোখে চোখ স্থির ইসাবেলার। রাগে কাঁপছে শরীর। ওর জীবনের এই দশার কারণ হিসেবে পরোক্ষভাবে নিকোলাসকেই দায়ি করে। কত সয়েছে সে ওর জন্য। সেদিন ওই পোকামাকড়ের বসতিস্থল, দুর্গন্ধময় গুহায় থাকতে বাধ্য করেছে। কোনোরকমে খেয়ে না খেয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা অতিক্রম করেছে পদব্রজে। পায়ের তলা অসাড়। শীতে কাঁপছে। নিকোলাস দেখেও যেন দেখে না। তার উচিত ছিল একজন জেন্টেলম্যানের মতো নিজের কোর্টটা অফার করা। এত কিছুর পরও এমন কিছু আশা করাতে ক্ষোভ জন্মেছে নিজের ওপর। চেপেই রাখত সেটা। কিন্তু নিকোলাসের রুক্ষ ব্যবহারে প্রকাশ পেয়ে গেল। নিকোলাস ইসাবেলার অগ্নিদৃষ্টিতে চেয়ে একদমই রাগ করতে পারল না। কান্নার জলে টইটম্বুর চোখের কার্নিশ। অভিমানি সেই টলমল জল নিকোলাসকে রাগ করতে দেয় না। সে একদৃষ্টে চেয়ে আছে ওর চোখে। কতটা ঘৃণ্য, বর্বর সে! ইসাবেলার চোখে জল এনে দিয়েছে। নিজের দুরন্ত মনটাকে বশে আনতে মেয়েটাকে একপ্রকার উপেক্ষা করেছে, রুক্ষ ব্যবহার করেছে কথায় কথায়। একবারো ভাবেনি এতে ওর মনে কী প্রভাব পড়বে! যথার্থই বলেছে ও স্বার্থপর। কিন্তু ওর মুখে বারংবার ঘৃণা মেশানো পিশাচ শব্দটা নিকোলাসকে বড়ো আঘাত দেয়। দারুন কষ্ট হয় মনে। অল্প ক্ষণের জন্য ওর চোখে-মুখে স্পষ্ট ফুটে ওঠে সেই কষ্ট। ইসাবেলা টের পাবার আগেই ঘুরে দাঁড়ায়।

“তুমি সামনে হাঁটবে এবার। চলো।”

ইসাবেলা তাচ্ছিল্যের সাথে হাসে। নাক টেনে বলে,

“দেবেন না আমার প্রশ্নের জবাব? ঠিক আছে দিয়েন না। আমিও যাব না আপনার সাথে।”

“পাগলামি করো না বেলা। এই স্থান নিরাপদ মনে হচ্ছে না। চলো।” নিকোলাস আবার ঘুরে ওর হাত ধরতে গেলে হাত ওপরে তোলে।

“নাহ! এবার জোর করতে এলে চিৎকার করব আমি। বলেছি চলে যান। যান।”

চেঁচিয়ে ওঠে ইসাবেলা। তারপর উলটো দিকে ভোঁ দৌড় দেয়। দুহাত মুঠ করে রাগ নিয়ন্ত্রণ করে নিকোলাস।

“বেলা, থামো বলেছি, বেলা!”

ইসাবেলা দৌড়াতে দৌড়াতে বনের ভেতর ঢুকে পড়েছে। লম্বা গাছ আর বুনো লতায় ভরা বন। গা থমথমে নীরবতা। কোনদিকে যাবে বুঝতে না পেরে হাঁটতে লাগল বনের মধ্যে দিশাহীন। ওর রাগটা বড়ো বাজে। হুশ হারিয়ে ফেলে রাগলে। নচেৎ, চতুর্দিকে বিপদ জেনেও এভাবে একা বনে দৌড়ে আসে? ভয় ভয় করছে ইসাবেলার। কোথায় যাবে এখন? আগাথাকেও দিনের বেলা পাবে না।

“বেলা” নিকোলাসের গলা শুনে স্বস্তিতে হাঁফ ছাড়লেও নত হলো না।

“আমার পিছু নেবেন না নিকোলাস। চলে যান।”

নিকোলাস নিজের নাম ওর মুখে শুনে মুচকি হাসল। রাগ উবে যায়। হাওয়ায় মিশে ওর সামনে দাঁড়ায়। ইসাবেলা পাশ কাটতে নিকোলাস আবারও সামনে থামে। ইসাবেলার পথ রুদ্ধ করে দাঁড়ায়। কটমট করে ইসাবেলা বলে,

“আমি কিন্তু চিৎকার করব এবার।”

“রিয়েলি?” এগিয়ে আসে নিকোলাস। ইসাবেলা পিছিয়ে যায়।

“সত্যি বলছি আমি চিৎকার করব।”

“আমি শুনছি।”

ইসাবেলা চিৎকার করবে বলে মুখ খুলতে নিকোলাস ওর মুখটা হাতে চেপে ধরে। ইসাবেলার পিঠ লেগে আছে পেছনের গাছে। নিকোলাসের শরীরের ভরে খানিকটা আরো চেপে যায় গাছের সাথে। স্যাঁতসেঁতে ভেজা গাছের গা। পিঠে ভেজা ঠাণ্ডা অনুভব করল। মুখের ওপর নিকোলাসের ভারী নিঃশ্বাসের উষ্ণতা পড়ে। হৃৎস্পন্দনের গতি অস্বাভাবিক হতে লাগল। নিকোলাস এত নিকটে এলেই এমন হয়। দু’হাতে ঠেলছে নিকোলাসের বুক। নিকোলাসের হাতের নিচ থেকে গোঙানি বের করছে। নিকোলাস জানে ওই গোঙানির অর্থ। এত সহজে ছাড়বে না এই মেয়েকে। অবাধ্য হওয়ার শাস্তি পেতে হবে ওকে।

“সেদিন গুহার ভেতর দাঁড়িয়ে কি বলেছিলাম ভুলে গেছ?”

ইসাবেলার নড়াচড়া থেমে যায়। বিস্ফোরিত চোখে শুকনো ঢোক গিললো। ভারি মজা পাচ্ছে নিকোলাস ওকে নার্ভাস হতে দেখে। মজা আরেকটু বাড়ালে মন্দ হয় না। ইসাবেলার ঠোঁটের ওপর থেকে হাত সরিয়ে মুহূর্তে ওর দুহাত মাথার ওপর গাছের সাথের চেপে ধরে। ঝুঁকে বলে,

“তুমি ইচ্ছে করে এমন করছ তাই না?”

ইসাবেলা ভয়ে ভয়ে সজোরে মাথা ঝাকায়। নিকোলাস যে সে কথা বিশ্বাস করল না বেশ বুঝতে পারছে ও। আরো ঝুঁকে আসছে নিকোলাসের মুখ। চাপা গলায় বলল,

“ইচ্ছে করে ঠোঁট দ্বারা প্রলুব্ধ করছ আমায়, হুম? আমার ভেতরের স্বৈরাচারীকে জাগিয়ে তুলছ যেন সে তোমার ঠোঁটকে শাস্তি দেয়, দখল করে নেয়? তবে শোনো, তোমার ঠোঁটের শাস্তির ফরমান জারি করলাম। আমার ঠোঁট এবার চুমুর শাস্তি দেবে তোমার ঠোঁটকে।”

নিকোলাসের স্বৈরাচারী ঠোঁট শাস্তি দিতে নেমে আসার আগে নিজের ঠোঁট দুটোকে চেপে ধরে মাথা নামিয়ে ফেলে ইসাবেলা। এতদ্রুত করে যে নিকোলাসের নাকে প্রচন্ড জোরে বাড়ি খায় ওর কপাল। জীবন্মৃত শরীরে রক্ত বেরোয় না। ব্যথাও লাগল না। কিন্তু এই মজা এমন ভাবে নষ্ট হওয়ায় বিরক্ত হলো নিকোলাস। দু কদম পিছিয়ে নাকে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,

“বেকুব একটা!”

ইসাবেলা ততক্ষণে গাছের আড়ালে লুকিয়েছে। বুকের বা’পাশ দুহাতে ধরে গভীরভাবে শ্বাস নিলো। এখনও বুক কাঁপছে।

“ড্রেস সেন্সও নেই তোমার। নীল ফ্রকের নিচে সাদা অন্তর্বাস কে পরে?”

তড়াক করে ঘুরে দাঁড়ায় ইসাবেলা। নিকোলাস বিরক্তি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ইসাবেলা এখন নিশ্চিত এই লোকের মাথায় সমস্যা আছে, গুরুতর সমস্যা। একেক সময় একেক মুডে থাকে। আর নয়তো ইসাবেলাকে জ্বালাতে এমন করে। একটু আগে ঠোঁট নিয়ে পড়েছিল। এখন আবার অন্তর্বাস নিয়ে! ধরিত্রী দু’ভাগ হয় না কেন? এক্ষুনি মাটির তলে লুকিয়ে পড়ত সে।

“অসভ্য, নির্লজ্জ!” বিড়বিড় করে বলল সে। নিকোলাস শুনল কিন্তু এমন ভাব করল সে শোনেনি। ইসাবেলা এক হাতে ঠোঁট ঢেকে রেগে বলল,

“আমি যা ইচ্ছে পরব তাতে আপনার কী? নির্লজ্জ, অসভ্য।”

ইসাবেলা পাশ কেটে হাঁটতে শুরু করে। আচমকা নিকোলাস ওকে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরে। একহাতে ইসাবেলার কোমর জড়িয়ে আছে শক্ত করে।

“ভালো হচ্ছে না নিকোলাস। ছাড়ুন আমাকে।”

নিকোলাসের অন্য হাত ওর কাঁধে নেমে এসেছে। ইসাবেলার চুলগুলো ডান কাঁধে সরিয়ে ঝুঁকে পড়ল আরো। ইসাবেলা এবার কেঁদে দেয়। নিকোলাসের হাত ওর পিঠের জামার ভেতর প্রবেশ করেছে।

“প্লিজ! ছাড়ুন আমাকে।”

“দুই মিনিট শান্ত হবে।” মৃদু ধমক দেয় নিকোলাস। ইসাবেলা ফুঁপাতে লাগল। নিকোলাস সরে দাঁড়ায়।

“ড্রেস খোলো।

” প্লিজ! আমাকে ছেড়ে দিন। আমি আর অবাধ্য হব না।”

“তোমাকে কিছু বলায় বৃথা।”

নিকোলাস এগিয়ে এসে ওর ফ্রক নিচ থেকে তুলতে ইসাবেলা হাত চেপে ধরে।

” প্লিজ! আমার সতিত্ব নষ্ট করবেন না। প্লিজ নিকোলাস।”

ইসাবেলা কেঁদে মুখ ভিজিয়ে ফেলেছে। নিকোলাস কাপড় ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। ইসাবেলা বুকে দুহাত জড়িয়ে অসহায় মুখে বলল,

“আপনাকে আমি ভালো ভেবেছিলাম। শেষমেশ আপনিও আর সব পুরুষের মতো__” কান্নার তোড়ে ওর কণ্ঠরোধ হয়ে এলো। নিকোলাস ওর মাথায় গাট্টা মারতে চকিতে তাকায়। ব্যথা লেগেছে মাথায়। হাতটা মাথায় বুলাতে বুলাতে ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদছে। মহাবিরক্ত নিকোলাস হাত মেলে ধরে ওর সামনে। কালো কুচকুচে জোঁক। ইসাবেলার রক্ত খেয়ে মোটাতাজা হয়ে গেছে।

“এটা কী?” চোখ মুছে আর্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করে ইসাবেলা।

“জোঁক।”

“এ-এ_”

ইসাবেলা কাঁধে হাত রেখে কথাটা শেষ করার আগে নিকোলাস বলল,

“জি, এটাই ওখানে বসে আরামসে রক্ত চুষছিল। এই মহাশয়কে তুলতে আপনাকে জড়িয়ে ধরতে হয়েছে, এবং_”

“এবং?”

“এবং এই জোঁক মহাশয় একা আপনার রক্ত পান করছে না। তার জ্ঞাতি গুষ্টি সকলেই বোধহয় এসেছে। এই মুহূর্তে তারা আপনার পিঠে আরামসে বসে রক্ত মহাভোজ সারছে।”

আর্তচিৎকার করে লাফিয়ে ওঠে ইসাবেলা। পিঠে হাত দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু হাত পিঠ পর্যন্ত পৌঁছে না। ভ্যাঁ করে কাঁদতে লাগল। মাথা ঘুরে ওঠে আতঙ্কে। নিকোলাসের বড্ড খারাপ লাগল। ওর তখনকার মজার মাশুল ইসাবেলাকে দিতে হচ্ছে। যেই গাছটাতে ঠেসে ও দাঁড়িয়েছিল ওটাতে ছিল জোঁকের বসতি। প্রথমে খেয়াল করেনি নিকোলাস। ইসাবেলার হাতটা ধরে কোমল গলায় বলল,

“শান্ত হও।”

“আমি আজ মরে যাব।”

“যদি আমার কথা শোনো কিছু হবে না তোমার। শুনবে আমার কথা?”

এ ছাড়া আর উপায় কী? হ্যাঁ সূচক মাথায় নাড়ায় ইসাবেলা। নিকোলাস শব্দ করে দম ফেলে ওর মুখটা আঁজলা ভরে তোলে,

“তুমি আমার কাছে পবিত্র, বেলা। তোমাকে কিছুতেই অপবিত্র করব না আমি।”

ইসাবেলা ওর চোখে চেয়ে সে কথা বিশ্বাস করে। আজ আবিষ্কার করল নিকোলাসকে ও বিশ্বাস করে। চোখ বন্ধ করে গভীর শ্বাস নিয়ে সরে দাঁড়ায়। পরনের ফ্রক একটু একটু করে ওপরে তোলে। ভীষণ লজ্জা করছে। কোনো পরপুরুষ দেখেনি এভাবে। নিকোলাস ওর অস্বস্তি বুঝে বলল,

“ঘুরে দাঁড়াও।”

নিকোলাসের কথামতো ঘুরে দাঁড়ায় ইসাবেলা। আস্তে আস্তে মাথার ওপর দিয়ে খুলে ফেলে ফ্রক। অর্ধ নগ্ন শরীরে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বহু নারীর নগ্ন শরীর নিকোলাস দেখেছে, কিন্তু ইসাবেলার দেহ দেখে যেমন অনুভব করছে তেমনটা আগে করেনি। নিখুঁত গড়ন, মাখনের মতো কায়া। এতটা আকৃষ্ট কোনো নারীর দেহই করেনি। সর্ব শরীরে উষ্ণ স্রোত বয়ে যায়। নিকোলাস নিজেকে সামলে নিলো। ইসাবেলার পিঠ থেকে তাড়াতাড়ি জোঁকগুলো ছাড়ায়। রক্ত গড়িয়ে পড়ছে সেখান থেকে। নিকোলাসের শ্বদন্ত বেরিয়ে এলো তাজা রক্ত দেখে। রক্তের নেশা চেপে যায় মাথায়। কিন্তু নিজের পিশাচসত্ত্বাকে বড়ো কষ্টে দমালো। ইসাবেলার রক্ত আর পান করবে না সে।

“বাকি কাপড় খুলে এটা পরে নাও।”

নিজের পরনের লম্বা কোর্ট খুলে ওর হাতে দিয়ে ঘুরে দাঁড়ায় নিকোলাস।

নিকোলাস কম করে হলেও ইসাবেলার চেয়ে এক ফুট বেশি লম্বা। ওর গায়ের কোর্ট ইসাবেলার পায়ের গোড়ালি ছাড়িয়ে নেমে গেছে। হাঁটতে সমস্যা হচ্ছে তাতে। নিকোলাস ওর সাথে তাল মিলিয়ে এবার ধীরে ধীরে হাঁটছে। কয়েকবার পেছন ফিরে জিজ্ঞেসও করেছে,

“ঠিক আছো?”

ইসাবেলা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলেছে। নিকোলাস মনে মনে আশা করছে ইসাবেলা বলুক তার সমস্যার কথা। কিন্তু এই জেদি নির্বোধ মেয়ে সাহায্য চাইলে তো? সেধে সাহায্য করতে গেলে দোষ ধরবে। নিকোলাস ওর চেয়ে ঢের জেদি। যতক্ষণ সাহায্য না চাইবে করবে না সাহায্য। হাঁটুক ওভাবে। ওরা আবার সেই কাঁচা রাস্তার পাশে এসে দাঁড়ায়। নিকোলাসের লম্বা কোর্টের খানিকটা তুলে ধরে রেখেছে ইসাবেলা। বাকি পথ ও ওভাবেই হাঁটতে প্রস্তুত তবু সাহায্য চাইবে না। নিকোলাস হার নামল। শুধাল,

“চাইলে পিঠে উঠতে পারো।”

“না, আমি হেঁটে যেতে পারব।”

ইসাবেলা নিচু গলায় মাথা নুয়ে জবাব দিলো। ওর লজ্জা করছে নিকোলাসের চোখে চোখ রাখতে। নিকোলাস আরো কিছু বলবে তার পূর্বে রব তুলে ছুটে এলো দুটো ঘোড়া। তাতে বসা সওয়ারি দুজন বন্দুক তাক করে আছে ওদের দিকে। নিকোলাস কিছু করবে তখনই একজন বলে উঠল,

“খবরদার যদি একচুল নড়েছ। যা আছে সব বের করে দাও।”

মুহূর্তে ওদের ঘিরে ধরে একদল ইহুদি রিফিউজিরা।

চলবে,,,,

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব-২৮
Writer তানিয়া শেখ

নাৎসি সৈন্যদের হাত থেকে জীবন বাঁচাতে ইহুদিরা শহর ছেড়ে পালিয়ে এই বনের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছে। প্রতি মুহুর্তে চলছে জীবন বাঁচানোর লড়াই। এই বিপৎসংকুল বনে খেয়ে না খেয়ে বৃষ্টি মাথায় করে তারা জীবন অতিবাহিত করছে। প্রায় পঞ্চাশ জনের একটা দল গড়েছে তারা। একজন লিডারও আছে। আজ দুদিন হয় সেখানে খাবার শেষ হয়েছে। খেতে না পেরে কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে শিশুরা। বাকিদের অবস্থাও করুন। লিডারের কথা মতো তাই আজ বের হয়েছিল খাবার সংগ্রহের সন্ধানে। পথিমধ্যে নিকোলাস আর ইসাবেলাকে ওরা দেখতে পায়। ভেবেছিল এরা জার্মান। কাছে খাবার না থাকলেও অর্থ থাকবে। ক্ষুধা মানুষের হিতাহিত জ্ঞানবুদ্ধি লোপ পাইয়ে দেয়। এদের বেলায়ও ব্যতিক্রম হয়নি। খাবারের জন্য আজ এরা মানুষকে মারতেও কুণ্ঠিত হবে না। জার্মান খ্রিস্টান জানলে তো কথায় নেই। এক হিটলারের কারণে আজ সমস্ত জার্মানির লোক খারাপ বনে গেছে। নিকোলাস জানে সে কথা। ইসাবেলাকে পেছনে লুকিয়ে লিডারকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“আমরাও জার্মান সৈন্যদের হাত থেকে বাঁচতে বনে ঢুকেছি। কিছুই নেই আমাদের সাথে।”

“ইউরো, অলঙ্কার কিছুই না?” লিডার প্রশ্ন করে।

“তাড়াহুড়োতে তেমন কিছু আনতে পারিনি। তবে সামান্য কিছু ইউরো আছে সাথে।” পকেট হাতড়াতে গিয়ে মনে পড়ল কোর্টটা ইসাবেলার গায়ে। পেছন ফিরে ফিসফিসিয়ে বলল,

“ডান পকেটে দ্যাখো কিছু ইউরো আছে। ওগুলো বের করে দাও আমার হাতে।”

ইসাবেলা তাই করল। ইউরোগুলো পেয়ে খুশি হতে দেখা গেল না লিডারকে। খুব সামান্য ওই অর্থে তিনটে মানুষের একদিনের আহারও যোগাড় হবে না।

“এবার তাহলে আমরা আসি।”

“কোথায় যাবে তোমরা?” প্রশ্নটা করল লিডারের পাশের ঘোড়াতে বসা যুবক। নিকোলাস বলল,

“দেখি সামনে কোনো নিরাপদ আশ্রয় পাওয়া যায় কি না।”

যুবক ঘোড়া থেকে নেমে এলো। বলল,

“এই বনের বাইরে সর্বত্র নাৎসি সৈন্যরা। দেখামাত্রই গুলি করে দেবে ওরা তোমাদের। আমাদের আশ্রয়স্থল কাছেই। চাইলে যেতে পারো।”

নিকোলাস সরাসরি না করে দিলে সন্দেহ করবে ওরা। একটু ভাবতে লাগল। ওদের সকলের চোখ নিকোলাসের দিকে। কয়েকজন অখুশি যুবকের প্রস্তাব শুনে। দুটো লোক বেড়ে যাওয়ার মানে খাদ্য কমে যাওয়া। ইসাবেলা সকলের মুখ দেখে পেছনে দাঁড়িয়ে চাপা গলায় শুধায়,

“কী বলছে ওরা?”

নিকোলাস সংক্ষেপে সবটা বলার পর ইসাবেলা বলল,

“আমাদের উচিত ওদের সাহায্য করা।”

“মাথা খারাপ তোমার? তোমাকে নিয়ে চিরজীবন এভাবে বনজঙ্গলে ঘোরার ইচ্ছে কিংবা পরিকল্পনা কোনোটাই আমার নেই। তাড়াতাড়ি রাশিয়া পৌঁছাতে পারলে বাঁচি।”

ওর চোখের দিকে চেয়ে রইল ইসাবেলা। নিকোলাস ওকে রাশিয়া পৌঁছে দিতে যাচ্ছে এ কথাটা এখনই জানল। ইসাবেলা ওর কাছে সব সময়ই ছিল আপদ। আপদ ঘাড়ে করে কে ঘোরে? মনটা খারাপ হলো কেন ওর? খুশি হওয়ার কথা সে রাশিয়া পৌঁছাবে। পরিবারের কাছে যাবে। কিন্তু ভ্যালেরিয়ার শেষ কাজ? ওর মৃত্যুর প্রতিশোধ? এসব হবে না বলেই কি মন খারাপ হলো? তাই ই হবে।

“আমার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। তাকে এখানে রাখা উচিত হবে না। দশ মাইল দূরের গ্রামটিতে আমার শ্বশুরালয়। সেখানে এখনও নাৎসি বাহিনি আক্রমণ করেনি। আমরা সেখানেই যাচ্ছি।”

সকলের দৃষ্টি স্থির ইসাবেলার দিকে। বিশেষ করে যুবকটি ওকে আপাদমস্তক দেখল। অস্বস্তিতে পুরোপুরি আড়াল হলো নিকোলাসের পেছনে। সাথে থাকা কিছু লোক নিকোলাসের দিকে এগিয়ে যায়। এখানে খাবার,পরার এবং থাকার কষ্ট। ওই গ্রামে গেলে সকলে ভালো থাকবে। নিকোলাসকে ওরা অনুরোধ করে সাথে নেওয়ার জন্য। নিকোলাস এই বিড়ম্বনা আশা করেনি। লিডার হুঙ্কার করে উঠল,

“থামো বলছি। কোথাও যাবে না তোমরা। আর তুমি।”

লিডার আঙুল তাক করে নিকোলাসের দিকে।

“তুমি যেখানকার কথা বলছ গত পরশু রেড আর্মি দখল করে নিয়েছে সে স্থান। ওদের হাতে নিষ্ঠুরভাবে মরতে চাইলে যেতে পারো।”

এই খবর নিকোলাসের জানা ছিল না। কীভাবে জানবে গত তিনদিন তো ইসাবেলার সাথে আছে। এবার আর কোন অজুহাতে এদের থেকে নিস্তার পাবে? যুবক বলল,

“আমাদের আশ্রমে দুজন নার্স আছেন। ওঁরা তোমার স্ত্রীর খেয়াল রাখবে। ইতোমধ্যে দুটো শিশুর জন্ম ওখানে হয়েছে। এ নিয়ে চিন্তা নেই। চলো।”

নিকোলাস উপায় না দেখে এদের সাথে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। রাতে সকলে ঘুমিয়ে পড়লে ইসাবেলাকে নিয়ে উধাও হবে সে। ও পারত এদের মেরে এখান থেকে চলে যেতে, কিন্তু কেন যেন ইসাবেলার সামনে আজ ওর নৃশংস হতে ইচ্ছে করল না।

জঙ্গলের একেবারে ভেতরে ইহুদি রিফিউজিদের আশ্রয়স্থল। কোনোরকমে বাঁশ, কাঠ আর পাতার ছাউনি দিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই করেছে। আবালবৃদ্ধবনিতার দল খাদ্যের অপেক্ষায় বসেছিল। ওদের দেখে ঘিরে ধরল ওরা। হতাশ হলো যখন শুনল খাদ্যের যোগাড় এখনও হয়নি। মায়েরা সন্তান বুকে নিয়ে ক্রন্দনে ভেঙে পড়ে। বৃদ্ধ নারী পুরুষ দু তিনজন হতাশ মুখে ফিরে গেল ছাইনির নিচে। আশ্রয়স্থলে নতুন দুটো মুখকে ওরা খেয়াল করেনি প্রথমে। ওদের এই করুন অবস্থা দেখে খুব খারাপ লাগল ইসাবেলার। মা এবং তাদের কোলের সন্তানদের অনাহারী কান্না চোখে জল এনে দিলো। যুবক ওদের দুজনকে নিয়ে চলল পাশের এক পাতা ঘেরা গৃহে। নার্স দুজনকে খবর দেওয়া হলো। ইসাবেলা জানে না ওদের নিকোলাস কী বলেছে। নার্সদের সৌজন্যের হাসি দিয়ে করমর্দনের জন্য যাচ্ছিল ওমনি নিকোলাস ওর হাত চেপে ধরে।

“যেয়ো না।”

চোখের ইশারায় ইসাবেলা কারণ জিজ্ঞেস করতে বলে,

“ওরা টের পেয়ে যাবে তুমি গর্ভবতী নও।”

ইসাবেলার চোখদুটো বড়ো হয়ে যায়। গর্ভবতী আর সে! নিকোলাসকে রেগে কিছু বলত কিন্তু তার আগে নিকোলাস বলল,

“পরে সব বলছি আপাতত এমন ভান করো তুমি শুনতে এবং বলতে পারো না।”

প্রথমে গর্ভবতী তারপর বোবাকালা! করছে কী নিকোলাস ওর সাথে? অন্য সময় হলে বিরোধ করত, কিন্তু এই মুহূর্তে চুপচাপ শুনল নিকোলাসের কথা। এত সহজে ইসাবেলা মানল দেখে একটু যেন অবাক হয়। পরক্ষণেই হাঁফ ছাড়ে নিকোলাস। তারপর নার্সদের উদ্দেশ্যে বলে,

“আমাদের একটু সময় দেবেন প্লিজ।”

নার্স দুজন মুখ চাওয়াচাওয়ি করে মাথা নাড়িয়ে বেরিয়ে যায়। ওরা যেতে ইসাবেলা তেতে ওঠে,

“আপনার বোধবুদ্ধি লোপ পেয়েছে নিকোলাস? কেন ওসব বলেছেন ওদের?”

“উপায় ছিল না। ভেবেছিলাম মিথ্যা বললে ওরা আমাদের যেতে দেবে।”

“কিন্তু দিলো না।”

“হুম।”

“এখন কী করবেন? নার্স পরীক্ষা করতে এলেই তো ধরা খাব দুজন। আজ মৃত্যু নিশ্চিত আমাদের।”

“আমার ভয় নেই। আমাকে মারবে সাধ্য কার? তবে তোমাকে ওরা সহজে মেরে ফেলবে।”

এই পরিস্থিতিতেও ইসাবেলার সাথে মজা করতে ইচ্ছে হলো ওর। ইসাবেলা বুঝল। এই ক মাসে বেশ চিনেছে সে নিকোলাসকে। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল,

“আপনি আবার ওই বাজে মজা করছেন আমার সাথে? সিরিয়াসলি এবার আমার ভয় করছে কিন্তু।”

“ভয় নেই। যা বলি মন দিয়ে শোনো। খবরদার যদি পাকামো করেছ?”

ইসাবেলা রেগে তাকায়। পাকামো করেছ মানে কী? ও কি সব সবসময় পাকামো করে? নিকোলাস গা এলিয়ে বাঁশের খুঁটিতে পিঠে লাগিয়ে এক হাতে ইসাবেলার কাঁধ টেনে কাছে নিয়ে এলো।

“ছাড়ুন।”

“হুশ, এই বাঁশ, পাতারও কান আছে। যা বলব কানেকানে। আরো সরে এসো।”

উপায়ন্তর না দেখে আরো সরে বসে ইসাবেলা। নিকোলাসের কথা শুনতে ওর সমস্যা হচ্ছে। একে তো এত নিকটে ওরা। তার ওপর নিকোলাসের হাত কাঁধ শক্ত করে জড়িয়ে আছে। একটু পর নার্সদের সাথে করে যুবকটি আবার ফিরল। যুবক বলল,

“আমরা শহরে যাচ্ছি খাদ্য সংগ্রহের জন্য। তুমিও চলো।”

“আমার স্ত্রীকে একা রেখে যাওয়া সম্ভব না। তোমরা বরং যাও।”

যুবক ভুরু কুঁচকাল। নিকোলাসের এই স্ত্রৈণতা এবার বেশ বিরক্ত করল যুবককে। কটাক্ষের সুরে বলল,

“তোমার বউকে কেউ নিয়ে যাবে না। চলো।”

নিকোলাস উঠল না। যুবক রেগে বলল,

“প্রথমে ভেবেছিলাম তুমি সাহসী পুরুষ। এখন দেখছি সেই ভাবনা ভুল ছিল। খামোখা তোমাকে এখানে আনলাম। থাকো বউকে কোলে করে। ভীরু, কাপুরুষ কোথাকার।”

নিকোলাস বেজায় লাগল। ইচ্ছে হলো ছুটে গিয়ে ওর দেহ খন্ড বিখন্ড করতে। ইচ্ছেটা দমাল ইসাবেলার মুখ চেয়ে। যুবক বেরিয়ে যেতে নার্স দুজন এগিয়ে গেলেন ইসাবেলার দিকে। ভীত হওয়ার ভান ধরে নিকোলাসের গলা জড়িয়ে ধরে আছে সে। মুখটা লুকিয়েছে ওর কাঁধে। নার্স অভয় দেওয়ার পরও ইসাবেলা নিকোলাসের গলা ছাড়ল না।

“এমন করলে পরীক্ষা করব কীভাবে?” মধ্যবয়সী নার্সটি অভিযোগ করে। নিকোলাস তখন বলল,

“চোখের সামনে অনেক ভয়াবহ দৃশ্য দেখেছে আমার স্ত্রী। খুব কোমল মন ওর। এখনও আতঙ্ক পুরোপুরি কাটেনি। নতুন কারো কাছে যেতে ভয় পাচ্ছে তাই হয়তো। আপনারা কিছু মনে না করলে ওকে একটু সময় দেবেন? এই ধরুন আজকের দিনটা।”

কম বয়সী নার্সটি সাথে সাথে সম্মতি জানায়। ক্ষুধা পেটে কারো সেবা করতে ইচ্ছে করছে না ওর। অন্যজনও আর কিছু বলেন না। দুজনে বেরিয়ে যেতে ইসাবেলা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। তারপর জিজ্ঞেস করল,

“আচ্ছা, ওই ছেলেটা ওমন রেগে গেল কেন? কী বলল ও আপনাকে?”

“বউ পাগলা।” মুচকি হেসে ইসাবেলাকে এক চোখ টিপল। তৎক্ষনাৎ ইসাবেলার খেয়াল হলো নিকোলাসের গলা জড়িয়ে ধরে আছে এখনও। গলা ছেড়ে দূরে বসল লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে। নিকোলাস নিঃশব্দে হাসছে। নিজেকে সামলে অন্যদিকে মুখ করে ইসাবেলা বলল,

“কেন ওই কথা বলল ও? কিছু বলেছেন আপনি ওকে?”

যুবকের কথাগুলো বলতে ইসাবেলা বলল,

“আপনার যাওয়া উচিত ওদের সাথে। স্রষ্টার সৃষ্টিকে সাহায্য করলে স্রষ্টাও আপনাকে সাহায্য করবে। যান না প্লিজ।”

“একদম না। স্রষ্টাকেই যখন মানি না তখন তাঁর সৃষ্টির সাহায্য করব এটা কী করে আশা করলে? ওসব সাহায্য ফাহায্য নিকোলাস করে না। চুপচাপ মুখবন্ধ করে রাতটুকু বসে থাকো।”

নিকোলাসের এই স্বার্থপরতা, কাঠিন্য ইসাবেলাকে আবার মনে করিয়ে দেয় সে কোনো মানুষের সাথে নেই। নিকোলাস আর সবার মতো সাধারণ মানুষ নয় একজন পিশাচ।

“ব্লাডি ব্লাড সাকার কোথাকার!” আস্তে বললেও নিকোলাস শুনল সে কথা। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। জ্বলন্ত চোখে চেয়ে বলল,

“কী বলেছ?”

“বলেছি আপনি একটা হৃদয়হীন, পাষাণ রক্তচোষা। ঘৃণা হয় আপনাকে দেখলে।”

নিকোলাস ওর চোয়াল চেপে ধরে।

“এতকিছু করলাম তবুও আমার প্রতি তোমার এই ঘৃণা কমলো না? তবে তো হৃদয়হীনা তুমিও, বেলা।”

দুজনের দুজনের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। ইসাবেলা হঠাৎ ওর বুকে সজোরে দুহাত ঠেলে সরিয়ে উঠে দাঁড়ায়।

“কোথায় যাচ্ছ?”

নিকোলাসের প্রশ্নের জবাব ইসাবেলা দেয় না। গৃহ ছেড়ে বেরোতে গেলে নিকোলাস ওর হাত টেনে ধরে পুনরায় শুধায়,

“কোথায় যাচ্ছ?

“ওদের সাথে খাবার সংগ্রহে। আপনি ঈশ্বরে বিশ্বাস না করলেও আমি করি। আর আজ আমি প্রমাণ করে দেবো কে হৃদয়হীন।”

“পাগলামি করো না। নাৎসি বাহিনির হাতে পড়লে রাশিয়া আর ফেরা হবে না তোমার।”

“আমার মা যখন শুনবেন এই ক্ষুধার্ত মানুষগুলোকে দেখেও আমি চুপচাপ রাশিয়া ফিরে গেছি কষ্ট পাবেন। তিনি আমাকে প্রশ্ন করবেন এই কি শিক্ষা ছিল তাঁর? কোন মুখে জবাব দেবো তখন? নিকোলাস, আমি ওই অসহায় মা, শিশু আর বৃদ্ধদের মুখে একটু অন্ন তুলে দিতে মৃত্যুঝুঁকিও নিতে প্রস্তুত।”

ইসাবেলা হাত ছাড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। যুবক এবং লিডার সহ কয়েকজন তৈরি হয়েছে শহরে যাওয়ার জন্য। ইসাবেলা সেদিকে হাঁটতে লাগল। সকলে ওর দিকে তাকিয়ে আছে কৌতূহলে। যুবক আর লিডারের সামনে দাঁড়িয়ে বার কয়েক শ্বাস নিলো। তারপর ইশারা ইঙ্গিতে বোঝাল ও সাথে যেতে চায়। লিডার মাথা নাড়িয়ে না করে দেয়। বাকিরাও তাই করে। ইসাবেলা এবার একাই চলতে লাগল সামনে। যুবক দৌড়ে ওর হাত চেপে ধরে,

“এই অবস্থায় একা কোথাও যাওয়া নিরাপদ নয়। এসো আমার সাথে।”

ইশারা করে কথাটা বুঝিয়ে দিলো ইসাবেলাকে। ইসাবেলা মাথা নাড়ায়। সে কারো কথা শুনবে না। যুবক ওর হাত ছেড়ে কাঁধ ধরে বলে,

“তুমি খুব ভালো মেয়ে। তোমাকে প্রথম দেখে সেটা বুঝেছি আমি। কিন্তু এভাবে বিপদের মুখে একা যেতে দেবো না তোমাকে।” এবার সে ইশারা করেনি। সুতরাং ইসাবেলা বুঝল না।

“ওর কাঁধ ছাড়ো।”

পেছনে দাঁড়িয়ে চাপা ক্রোধের সাথে বলল নিকোলাস। যুবক ঘুরে দাঁড়ায়। ইসাবেলা রেগে আছে এখনও। নিকোলাসের রাগকে আমলেও নিলো না। যুবকের হাত কাঁধ থেকে ছাড়িয়ে সে আবার হাঁটতে লাগল। নিকোলাস দৌড়ে ওর হাত টেনে ধরে,

“তুমি জিতেছ আমি হেরেছি এবার থামো।”

“তার মানে আপনি যাবেন ওদের সাথে?”

অনিচ্ছাকৃতভাবে মাথা নাড়ায়,

“হ্যাঁ, যাব।”

ইসাবেলা খুশি হয়। নিকোলাস লিডারকে নিজের যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে আবার ফিরে আসে ইসাবেলার কাছে।

“আমাকে কথা দাও কোনো প্রকার বোকামি করবে না তুমি। আমি না ফেরা পর্যন্ত চুপচাপ ঘরে বসে থাকবে।”

নিকোলাসের হাতে হাত রেখে ইসাবেলা বলে,

“কথা দিলাম। আপনি না আসা অব্দি নিজেকে নিরাপদ রেখে অপেক্ষা করব।”

ইসাবেলার কপালে চুমু দিয়ে কিছুক্ষণ ওর চোখে চেয়ে রইল। নিকোলাস ওকে ছেড়ে যুবকের পেছনে ঘোড়ায় চড়ে বসল। বিদায়ের পূর্বে শেষবার একে অপরকে দেখল ওরা। নিকোলাস চোখের আড়াল হতে ইসাবেলার মনটা কেমন যেন করে। ঠিক ভাষায় প্রকাশ করা যায় না তা।

চলবে,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে