তিমিরে ফোটা গোলাপ
পর্বঃ ১৭
Writer Taniya Sheikh
ভালো সময় চোখের পলকে শেষ হয়ে যায়। আজ রাত পোহালে নিকোলাসের বেঁধে দেওয়া দুটো দিন শেষ হবে। ইসাবেলার ভাগ্যে আগামীকাল সকালে কী অপেক্ষা করছে জানা নেই। আশ্চর্য ব্যাপার হলো, এই নিয়ে সামান্য উদ্বিগ্ন হলেও ভীত নয় সে। এ ক’মাসের অতি ভীতিকর পরিবেশে থাকতে থাকতে বুঝি ভয়টাকে আজ আর তেমন ভয় করছে না। মনে হচ্ছে যা হয় হোক। মৃত্যু হবে? সে একদিন সবারই হবে। আফসোস চিরনিদ্রায় শায়িত হওয়ার আগে পরিবারের কারো মুখদর্শন হবে না। তখনই ভীষণ কষ্ট হয়। জীবনটা কেমন বদলে যায়! এই বদল কখনও আশা করেনি। এই বদলে যাওয়া সময়, পরিস্থিতি ইসাবেলার কতটা ক্ষতিসাধন করেছে তা যদি কেউ জানত! বুকের গভীর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
“ইসাবেল, ঘুমিয়ে পড়েছ?”
“না, তোমার অপেক্ষা করছিলাম শুয়ে শুয়ে।”
নোভা দরজার মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। মেয়েটা অনিন্দ্য সুন্দরি। ভাইদের মতোই ওর রূপ। কিন্তু হিংস্র আর নিষ্ঠুর নয়। ইসাবেলা সারাক্ষণ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর এমনই তাকিয়ে থাকা দেখে নোভা মাঝেমাঝে হাসে। মেয়েটা যতটা না সুন্দর ওর হাসি তারচেয়ে বেশি সুন্দর।
“আবার ওমন ভ্যাবলার মতো চেয়ে আছো?”
“তোমার রূপই যা, ভ্যাবলা না হয়ে পারি না। আচ্ছা, তোমার রূপের রহস্য কী?”
নোভা হেসে কুটিকুটি হয়। বলে,
“আমার রূপের রহস্য জেনে কী করবে?”
“আমিও একটু সুন্দর হতাম। শ্রী ছাড়া মুখ আমার।”
মুখটা শক্ত হলো নোভার। রাগ রাগ গলায় বলল,
“তোমায় কে বলেছে তোমার মুখে শ্রী নেই?”
“কত লোক বলেছে। আমাদের মহল্লার মেয়েরা সব সময়ই টিটকারি মারত। তারপর পিটার ছেড়ে চলে গেল। আমি অসুন্দর বলেই তো চলে গেল। আমি নিজেও জানি, আমি অসুন্দর।”
“সুন্দর বলতে কী বোঝো তুমি ইসাবেল? গায়ের উজ্জ্বল রং, নিখুঁত চেহারা, নিখুঁত গড়ন এই তো?”
ইসাবেলা একটু ইতস্তত করে। নোভা ওর হাতটা ধরে বলে,
“তোমার কি এসবে কমতি আছে? কোথায় কমতি আছে?”
ইসাবেলা মুখ নিচু করে ফেলে। ওর কমতি কী ও জানে না। আয়নায় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খুব দেখেছে। সরু ছোটো নাক, ডাগর চোখ, ভ্রমর কালো ভ্রু, গোলাপি পাতলা ঠোঁট।
“লোকে বলে আমি সেকেলে।”
“লোকের কথাকে এত গুরুত্ব কেন দাও ইসাবেল? তোমার জীবনে অন্যের মতামত কেন প্রাধান্য পাবে। নিজেকে ভালোবাসতে শেখো। দেখবে বাকিরাও ভালোবাসবে। তুমি যদি নিজেকে ভাবো অসুন্দর, অন্যদের বলতে বাধবে কেন? ভুল বললাম?”
ইসাবেলা মাথা নাড়ায়,
“না”
“দেহের সৌন্দর্য ক্ষয়ে যায়, নিঃশেষ হয় একসময়। কিন্তু এই মন, এই আত্মার সৌন্দর্য অক্ষয়, চিরস্থায়ী। তোমার সৌন্দর্য এখানেই বেশি ইসাবেল। তোমার মনটা বড়ো বেশি সুন্দর, সরল। শুধু মন নয়, তোমার রূপও সুন্দর। তবে আমাদের মতো নয়। তোমার রূপ ঠিক প্রকৃতির শুদ্ধতায় ফোটা গোলাপের ন্যায়। তুমি গোলাপের মতো কোমল, পবিত্র। গোলাপের সৌন্দর্যের কোন কাল নেই। সে সবকালেই একই রকম সুন্দর। বোধহয় জানো না, সাধারণের মধ্যে অসাধারণ তুমি। তোমার জন্য আমি আমার বড়ো ভাইয়ের বিপক্ষে কথা বলেছি। অথচ, তখন তোমাকে আমি চিনতামও না। কেন ওইদিন নেকড়ের হাত থেকে বাঁচিয়েছি জানো?”
“আমাকে তোমার নিষ্পাপ মনে হয়েছে বলে।”
নোভা মাথা নাড়ায়,
“শুধু ওই এক কারণ না।”
“তবে?”
“তোমার মাঝে আমি আমার মৃত মাকে দেখেছি ইসাবেল।”
“তোমার মৃত মা?”
“হ্যাঁ, আমার আর নিকোলাসের মা।”
নোভার মুখ বিমর্ষ। ইসাবেলা ওর হাত ধরে মৃদু চেপে জিজ্ঞেস করে,
“তিনি কি তোমাদের মতো নয়?”
“না, তিনি পবিত্র আত্মা। তোমার মতো সাধারণ কিন্তু মনের দিক থেকে, নীতির দিক থেকে অসাধারণ ছিলেন। আমরা সকলে যখন অস্তিত্ব রক্ষার্থে এই জীবনকে বেছে নিয়েছি, মা তখন নাকচ করেছেন এই জীবন। তিনি স্বাভাবিক মৃত্যুর পথ বেছে নিয়েছিলেন। আমাদের বাবা সবসময়ই ক্ষমতালিপ্সু ছিলেন। ক্ষমতার লোভ তাকে অমানুষ করে তুলেছিল। কিন্তু আমাদের মা ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন। যদিও তিনি ভীষণ ভালোবাসতেন বাবাকে। তাই বলে ধর্ম এবং মনুষ্যত্ব ত্যাগ করেননি। মায়ের প্রিয় এবং আদুরে ছিল নিকোলাস। মা সবসময়ই নিকোলাসকে বাবার খারাপ ছায়া থেকে আগলে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। বাবার আদেশ এবং কমিনিউটির কথা ভেবে মায়ের নিষেধ উপেক্ষা করতে হয় নিকোলাসকে। মায়ের চোখের সামনে পাপের জীবনে পর্দাপন করে। আমার আজও সেদিনের কথা মনে পড়ে, মা চিৎকার করে কাঁদছিলেন। ভয়, আতঙ্ক তাঁর চোখে মুখে ছিল। বুকে আগলে বসে ছিলেন আমার অসুস্থ শরীর। বাবা জোর করে মায়ের কোল থেকে টেনে নিয়ে গেলেন আমাকে। তুলে দিলেন নিকোলাসের সামনে। মায়ের সামনেই তাঁর আরেক সন্তান সেদিন রক্তপিপাসুতে পরিণত হয়। মায়ের কান্না থেমে গেল। সকলের মতো মহামারীতে অসুস্থ ছিলেন তিনিও। নিকোলাস তার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে। মা মুখ তুললেন৷ চোখ দুটো রাগে জ্বলছিল। এলোপাতাড়ি চড় মারতে লাগলেন প্রিয় সন্তানের গালে। একসময় তাঁর শ্বাসে টান ওঠে। নিকোলাস শ্বদন্ত বের করে ঝুঁকে পড়বে তখনই মা বাইবেলের কয়েক লাইন আওড়াতে শুরু করেন। ভীষণ কষ্টে ছিটকে সরে যায় নিকোলাস। মা থামলেন। অগ্নিদৃষ্টিতে বললেন,
“আমি স্বাভাবিক মৃত্যু চাই। স্পর্শ করবে না তোমরা কেউ আমাকে। তোমাদের সবার হাত পাপের রক্তে রঞ্জিত। ঘৃণিত পিশাচ তোমরা। তুমি নিকোলাস, তুমি আমার সন্তান নও। তুমি আমার নিকো নও। তুমি একটা পিশাচ। স্বার্থ আর ক্ষমতার লোভের আগুনে তুমি আমার নিকোকে, আমার নোভাকে ভস্মীভূত করেছ। ঘৃণা করে এই মা তোমাকে। একদিন পস্তাবে এই জীবন গ্রহণ করায়। অভিশাপ দেবে নিজেকে। স্মরণ করো সেদিন আমাকে তুমি। আজ আমাকে মুক্তি দাও। ওই পাপের জীবনে নিয়ো না। ঘৃণা করি ওই জীবন আমি। আমার অনুরোধ তুমি রাখো নিকোলাস। মরতে দাও আমায়। আমার কসম লাগে মরতে দাও।”
বাবা নিকোলাসকে জোর করেন। কিন্তু নিকোলাস মায়ের কথা রেখেছিল। সবার বিপক্ষে গিয়ে মাকে মরতে দিয়েছিল স্বাভাবিক ভাবে। চোখের সামনে মায়ের মৃত্যু দেখেছি আমরা। ওইদিনই শেষবার আমি কাঁদতে দেখেছিলাম নিকোলাসকে। এরপরে সে কেমন যেন হয়ে যায়। যদিও আমরা কেউ ই আর স্বাভাবিক নেই। কিন্তু ও যেন একটু বেশিই হিংস্র আর নির্মম হয়ে ওঠে। অনুভূতি শূন্য, নির্দয়। কারো পরওয়ার করেনা, কারো ভালো ভাবে না।”
হাঁফ ছেড়ে থামে নোভা। উঠে গিয়ে সামনের একটা টেবিলের ড্রয়ার খোলে। সাদা সিল্কের কাপড়ে মোড়ানো একটা বস্তু হাতে। আবার বসল ইসাবেলার সামনে। কাপড়টা সরাতে ইসাবেলা মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইল। ভিক্টোরিয়ান ড্রেস, মাথায় স্কার্ফ পরনে। খুব সাদামাটা সাজে দাঁড়ান এক নারী মূর্তির স্থিরচিত্র। তার চোখ দুটো ঠিক নিকোলাসের মতো। নোভা আর ওর মায়ের হাসিতে যথেষ্ট মিল আছে। ভদ্রমহিলার মুখখানা বড্ড মায়াবী।
“খুব মায়াবী মুখটা, না?” নোভা সিক্ত কণ্ঠে বলল। ইসাবেলা জবাব দেয়,
“হুম।”
“ঠিক তোমার মতো। তাইতো তোমাকে আমার এত আপন লাগে।”
ইসাবেলা সলজ্জিত হাসি হাসে। নোভা ওর থুতনি তুলে বলে,
“এসো বাইরে যাই।”
দুজনে অন্য রাতের মতো নৈশ ভ্রমনে বের হলো। রাতের জ্যোৎস্নায় নোভার সাথে বনমধ্যে ঘুরতে বেশ লাগে ইসাবেলার। নোভা নিকোলাসদের মতোই রক্তপিপাসু। কিন্তু মায়ের প্রতি ভালোবাসা আর শ্রদ্ধায় সে বছরের পর বছর সাধনা করে মানুষের রক্ত পান ছেড়ে দিয়েছে। পশুর রক্ততে সন্তুষ্ট হতে শিখেছে এখন। রাতে জেগে শিকারে বের হয়। ইসাবেলা পাশেই থাকে। কোনোদিন বনমোরগ, কোনোদিন শেয়াল কিংবা সাপ, এসবেই ওর পিপাসা মেটে। মাঝেমধ্যে পশুর মাংসও সে খায়। নোভার শিকার ধরার দৃশ্য যতটা না কৌতূহলী মনে হয়। শিকার ভক্ষণ করার দৃশ্য ততটায় ভয়ংকর ইসাবেলার কাছে। পেট ভরে গেলে ইসাবেলাকে সাথে করে রাতটা উপভোগ করে। এই জঙ্গলে বিশেষ বিশেষ ফুল রয়েছে। যা কেবল রাতের বেলাতেই ফোটে। ভোর হতে মূর্ছে ঝরে যায়। ওই ফুলগুলো না কি অসম্ভব সুন্দর হয়। আলাদা রকম জ্যোতি বের হয় যখন ফোটে। নোভা ওয়াদা করেছে ইসাবেলাকে একদিন দেখাবে সেই সব ফুল পরিস্ফুটিত হতে। ইসাবেলা মনে মনে হাসে। রাত পোহালেই নিকোলাস নিয়ে যাবে। তারপর কী হবে কে জানে? আর কোনো রাত ওর জীবনে হয়তো আসবে না। নোভার সাথে ঘুরে ঘুরে রাতটা কখন সে শেষ হলো টেরই পেল না। ভোর হতে নোভা ফিরে গেল নিজের কফিনে। আর ইসাবেলা রুমে ফিরে এলো। ঘুম সহজে আসে না। নোভাকে কী বলা উচিত ছিল নিকোলাসের পরিকল্পনার কথা? তাতে কী কোনো লাভ হতো? বাঁচাতে পারত সে ইসাবেলাকে? এসব নানান কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল। যখন ঘুম ভাঙল চারিদিকে পরিষ্কার আলো। ঘুম ঘুম চোখে বিছানার ওপর উঠে বসল। এই ঘরের দেয়াল ঘড়ি জানান দিচ্ছে দুপুর পৌনে বারোটা বাজে। যে কোনো সময় নিকোলাসের আগমন ঘটবে। সে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে রইল। কেন যেন এই মুহূর্তে ভীষণ কান্না পাচ্ছে। কিন্তু কাঁদল না। বাইরের দরজায় নক পড়তে অলসভাবে সোজা হয়ে বসল।
“আসুন।”
নিকোলাস আসেনি। দাসীকে ফাঁসীর মঞ্চে নিয়ে যেতে রাজা আসতে যাবে কেন? ভৃত্যটিকে পাঠিয়েছে। সকালের নাস্তার ট্রে পাশে রেখে ভৃত্যটি বলল,
“খাওয়া হলে নিচে নেমে এসো। আমি অপেক্ষা করব সেখানে। বেশি দেরি যেন না হয়।”
ভৃত্যটি চলে যাবে তখনই ইসাবেলা বলল,
“আমার খিদে নেই। চলুন যাওয়া যাক।”
ভৃত্যটি ওর মুখের দিকে তাকাল। আজ এতদিন বাদে লোকটার নির্বিকার মুখে কিছু যেন দেখতে পেল। দয়া? উদ্বিগ্নতা? মনে মনে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল ইসাবেলা। ভৃত্যটিকে পাশ কাটিয়ে সামনে এগোয়। নোভার কফিন রাখা রুমের দিকে যেতে ভৃত্যটি বলল,
“রাজকুমারী সেখানে ইতোমধ্যে পৌঁছে গেছেন।”
“ওহ!”
নোভা তবে সবটা জানে! ইসাবেলা ভৃত্যকে অনুসরণ করে চলল। হলঘর পেরিয়ে ওরা থামল বড়ো এক লোহার দরজার সামনে। পুরোনো আমলের কারুকার্য দরজায় গায়ে। ঝুলকালির চিহ্ন নেই। এদিকটার সব কটা কক্ষের মেঝে, দেয়াল এবং দরজা ঝকঝকে পরিষ্কার। ভৃত্য দরজা ঠেলতে খুলে গেল। সে ঢুকল না। ইসাবেলাকে ইশারা করল ভেতরে ঢুকতে। লোকটা ওর যথেষ্ট খেয়াল রেখেছে। মৃত্যুর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে এক চিলতে হাসি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ উপহার দিলো। ভৃত্যটি দুঃখভরাক্রান্ত মুখে মাথা নত করে। ইসাবেলা পা রাখল কক্ষের ভেতর। এই কক্ষে সূর্যের আলো প্রবেশ করেনি। গুমোট অন্ধকার কক্ষের ভেতর। ইসাবেলা টের পাচ্ছে ওর হাত- পা কাঁপছে। মৃত্যু ভয় একটু একটু করে স্পর্শ করছে। দুটো মশাল জ্বলে আছে সরু এক খোলা দরজার সামনে। ইসাবেলা সেই দরজার সামনে দাঁড়ায়। ভেতরে পুরুষালি গলায় কে একজন বলছে,
“একটা মেয়ে মানুষের জন্য এতবড়ো রিস্ক নিতে গেছো তুমি? এর পরিণাম কত ভয়াবহ হতে পারে ভাবতে পারো? গায়ের লোকে এ নিয়ে কথাবার্তা বলছে। নেকড়ের রূপে ওরা তোমাকে দেখে ফেলেছে নিকোলাস। আমাদের শত্রুদের কানে গেলে কী হবে ভাবতে পারো? তোমার বোকামিতে আমরা শেষ হয়ে যাব।”
“বাবা! আপনি ভুলে যাচ্ছেন কাকে প্রশ্ন করছেন, কার কাজের কৈফিয়ত চাচ্ছেন। আমি যা করেছি তার কৈফিয়ত কাওকে দেবো না। এই কমিউনিটির রাজা আমি, আপনি নন। কোনটাতে ভালো হবে আর কোনটাতে মন্দ হবে তা আপনার চাইতে ভালো করেই জানা আছে আমার।”
“তাহলে ওকে বাঁচাতে নেকড়ের রূপ ধারণ করলে কেন?”
“আবার বলছি, আমি আমার কাজের কৈফিয়ত দিইনা কারো কাছে। শুধু এটুকু সবার জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, যা করেছি আমার নিজের কারণে। লোকটা আমাকে অসম্মান করেছিল। অসম্মান কিছুতেই বরদাস্ত করি না আমি। ব্যস, শিক্ষা দিয়েছি। ওই মেয়ে বাঁচল কী মরল তাতে আমার কিছু আসে যায় না। আর কোনো কথা হবে না এই বিষয়ে। বুঝাতে পেরেছি?”
রাগত মুখে পিতার দিকে তাকায়। রিচার্ড রাগ চেপে মাথা নাড়িয়ে বসে নিজের চেয়ারে। নিকোলাসের দৃষ্টি বাকি সবার দিকে যায়। সকলে মাথা নাড়ায়। অতঃপর ইসাবেলার পায়ের শব্দে সবার দৃষ্টি যায় দরজার দিকে। ভেতরে ঢুকে নিকোলাসের কঠোর, হিংস্র দৃষ্টির সম্মুখীন হয় ইসাবেলা। দাম্ভিকতার সাথে কারুকার্য শোভিত সিংহাসনে আসীন নিকোলাস। পরনে সাদা কালো পুরিতান। দৃষ্টি নমনীয় করতে ইসাবেলা অন্যদিকে তাকায়। নোভা ছাড়া দুই সারিতে বসা পিশাচদের রক্তিম চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে। শ্বদন্ত বেরিয়ে আসে লাল টুকটুকে ঠোঁটের পাশ থেকে। ঘর ভর্তি রক্তপিপাসুর মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। রক্ত হিম হয়ে এলো ইসাবেলার। নোভা আন্দ্রেইর হাত চেপে ধরতে আন্দ্রেই লোভ সংবরণ করে। নিকোলাসের ভয়ে বড়ো কষ্টে বাকিরা চেয়ারে বসে আছে। নিকোলাসের ভয় না থাকলে এতক্ষণে ইসাবেলাকে লুটেপুটে খেত। নোভা মলিন মুখে জোর পূর্বক হাসল। ইসাবেলাও তাই করে। নিকোলাসের দৃষ্টি এড়িয়ে যাচ্ছে যথাসম্ভব সে।
“আন্দ্রেই”
নিকোলাসের গলার স্বর ঠাণ্ডা অথচ প্রচণ্ড। আন্দ্রেই দাঁড়ায়।
“জি, ভাই।”
“তোমার অপরাধী উপস্থিত। বলো কীভাবে শাস্তি দিতে চাও?”
কক্ষ জুড়ে কিছুক্ষণ পিনপতন নীরবতা নেমে এলো। আন্দ্রেই মুখ খুলল,
“এই মেয়েকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দাসী হিসেবে চাই। তবে__”
“আন্দ্রেই!” ছেলের কথা শেষ হওয়ার আগেই সোফিয়া প্রতিবাদ করে। রিচার্ড রেগে বলেন,
“ও মানুষ। একটা মানুষকে তুমি আমাদের মাঝে রাখতে পারো না। আমাদের সকলের বিপদ ডেকে আনবে এই মেয়ে। এক্ষুনি মেরে ফেলে ঝামেলা শেষ করো।” রিচার্ড হিংস্র মুখে উঠে দাঁড়াতে নিকোলাস থামিয়ে দেয়,
“বাবা, আন্দ্রেইকে কথা শেষ করতে দিন।”
গজগজ করতে করতে পুনরায় বসল রিচার্ড। আন্দ্রেই ইসাবেলা পাশে দাঁড়াতে সরে গেল ইসাবেলা। আন্দ্রেই মুচকি হাসল। নিকোলাস ভ্রু কুঁচকাতে গম্ভীর মুখে বলল,
“আমরা সকলে জানি নোভা নিজেকে বদলে ফেলেছে। মানুষের রক্তের বিপরীতে পশুর রক্তে অভ্যস্ত করেছে নিজেকে। যা আমাদের কমিউনিটির জন্য মোটেও শোভনীয় না। আমরা সকলেই এক। ও কেন আলাদা হবে? মানুষের প্রতি ওর কেন মায়া-মমতার সৃষ্টি হবে। এসব তো দূর্বল মানুষের প্রকৃতি। আমরা সকলে জানি মানুষদের থেকে ভ্যাম্পায়াররা শক্তিশালী। এক নোভা আজ মানুষের প্রকৃতি ধারণ করে বদলে যাচ্ছে। কাল ওর সান্নিধ্যে এসে আরেকজন বদলাবে। এমন চলতে থাকলে ভ্যাম্পায়ার কমিউনিটি আর মানুষের মধ্যে পার্থক্য কী থাকবে?”
“মূল কথায় এসো আন্দ্রেই” নিকোলাস বিরক্ত গলায় বলল। আন্দ্রেই গলা পরিষ্কার করে বলতে শুরু করে,
“আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি সে করেই হোক নোভাকে আবার আগের মতো মানুষের রক্তে অভ্যস্ত করব। কিন্তু সেই জন্য মানুষের রক্তের স্বাদ, গন্ধে আকৃষ্ট করতে হবে ওকে। এই মেয়েটি হবে নোভার দাসী। ওর সাথে সর্বক্ষণ থাকবে। মানুষ আর ভ্যাম্পায়ার আগুন আর জলের মতো। আবার চুম্বক আর লোহার মতোও। একসাথে মিশবে না ঠিকই কিন্তু নিজস্ব চাহিদায় আকৃষ্ট হবে। এই মেয়ের শরীরে প্রবাহিত রক্তকে নোভা বেশিদিন উপেক্ষা করতে পারবে না। নিজের নীতি থেকে বেরিয়ে আসবেই।”
“আমি এই মেয়েকে দাসী হিসেবে কিছুতেই রাখব না।”
নোভা প্রতিবাদ করে। আন্দ্রেই জোর গলায় বলে,
“অবশ্যই রাখবে।”
“কিছুতেই না। বাবা আন্দ্রেইকে নিষেধ করুন। আমি যেমন আছি বেশ আছি। আমার ব্যাপারে নাক গলালে খারাপ হয়ে যাবে বলে দিলাম।”
“আন্দ্রেই ঠিক বলেছে। তোমার স্বভাব পরিবর্তন আমাদের ছোটো করেছে নোভালি আগাথা ওয়াল্টার। নিজের কাজে লজ্জা হওয়ার বদলে গলা উঁচু করছ? লজ্জা হওয়া উচিত তোমার। ডারলিং, কিছু বলো মেয়েকে।”
রিচার্ড অন্যমনস্ক হয়ে ছিল। স্ত্রীর ডাকে মৃদু গলা ঝেড়ে বলল,
“ভাইয়েরা যা বলে তাই করো নোভা। তোমার মায়ের মতো লজ্জিত করো না আমাকে।”
নোভা প্রতিবাদ করতেই যাচ্ছিল কিন্তু নিকোলাসের কর্কশ গলার স্বরে থেমে গেল।
“ব্যস! আন্দ্রেই, তুমি তাহলে এই মেয়েকে মারতে চাচ্ছ না?”
“না”
“নোভা তুমি কি এই মেয়েকে দাসী হিসেবে রাখবে?”
“বড়ো ভাই মানে__”
“হ্যাঁ অথবা না?”
নোভা পরাজিত মুখে মাথা নত করে রইল।
“হ্যাঁ অথবা না নোভা?”
“হ্যাঁ। রাখব ওকে।”
পুরো কক্ষে এবার ফিসিরফিসির শুরু হলো। একজন তো বলেই ফেলল,
“এই মেয়ের কারণে কোনো বিপদ নেমে এলে? বিশ্বাস কী এই মেয়ের, সে আমাদের মাঝে থেকে আমাদের ক্ষতি করবে না? তাছাড়া ও এখানে থাকলে একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে।”
নিকোলাস উঠে দাঁড়াতে চুপ হয়ে যায় সকলে। নোভার দিকে তাকায় নিকোলাস।
“জবাব দাও নোভা।”
আন্দ্রেই ছোটো বোনের পক্ষ হয়ে বলে,
“আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি তেমন কিছুই হবে। আর হ্যাঁ, একটা বোকা, তুচ্ছ মেয়েমানুষকে নিয়ে এতটাও ভয় পাওয়া উচিত নয় আপনাদের।”
সকলে আন্দ্রেইর কথাতে পুরোপুরি সম্মত না হলেও আর প্রতিবাদ করে না। নিকোলাস ইসাবেলার দিকে তাকায়। ইসাবেলার দৃষ্টি পায়ের দিকে। ভাইয়ের অনুমতিতে নোভা ওর হাত ধরে বেরিয়ে এলো। কী যে হলো মাথামুণ্ডু বুঝল না ইসাবেলা। আন্দ্রেই কেন এমন সিদ্ধান্ত নিলো? এসব যখন ভাবছিল তখনই ফিসফিসিয়ে আন্দ্রেই নোভাকে বলল,
“তুমি যে কী করতে চাইছ বুঝতে পারছি না। ভাই আসল ব্যাপার টের পেলে রক্ষে থাকবে না আমাদের।”
নোভা প্রত্যুত্তরে মুচকি হাসল। ইসাবেলা এবং আন্দ্রেই ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল।
চলবে,,,,
#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব-১৮
Writer Taniya Sheikh
কদিন ধরে ইসাবেলার মনের মধ্যে উশখুশ করছে ঝরণার ওপরের দিকটা ঘুরে দেখার ইচ্ছায়। পাহাড়ের যে স্থান থেকে ঝরনার পানি নিচে গড়িয়ে পড়ছে সেটা বেশ উঁচুতে। ওই পর্যন্ত যাওয়াও রীতিমতো কষ্টসাধ্য। তবু কৌতূহলের বশে সিদ্ধান্তটা নিয়ে নিলো। সাথে আনা শুকনো কাপড় পাথরের ওপর রেখে গভীর দম নিয়ে পা বাড়ায়। পাহাড়ের গা বেয়ে ওঠা সহজ ব্যাপার নয়। পা পিছলে পড়ল কয়েকবার। ব্যথাও পেল। কিন্তু হার মানল না। এক মন সতর্ক করে ফিরে যেতে। আরেকমন বেশ জোরের সহিত তাকে উৎসাহ দেয় ওপরে উঠতে। দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে জোরওয়ালা মনকে শুভাকাঙ্ক্ষী ভেবে পুনরায় চেষ্টা করে। না, এভাবে বেয়ে বেয়ে ওঠা সম্ভব নয়৷ আবার বিপদও আছে। উঁচু থেকে পড়লে মেরুদণ্ড ভেঙে যাওয়া কিংবা পটল তোলারও সম্ভবনা প্রবল। ইসাবেলা একটু দূরে পাহাড়ের গায়ে জড়ানো ঝোপঝাড়ের মধ্যে পথ খুঁজতে থাকে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর নিবিড় ঝোপের মধ্যে দিয়ে সহজে ওঠার একটা রাস্তা পেল। এদিকটা তেমন পিচ্ছিল ঢালু নয়।একটু ওপরে কয়েকটা মাঝারি বুনো গাছ। ওদের ধরে ধরে পথ টুকু হাঁফাতে হাঁফাতে উঠে এলো। মাথার ওপর দিগন্ত বিস্তৃত খোলা আকাশ। মুক্ত বাতাসের সাথে মিশে এলো পরিশুদ্ধ মিষ্টি ঘ্রাণ। নিচের মতো অত ঘন বন নয় এখানে। দূরে দূরে কয়েকটা ম্যাপেল আর বীচবৃক্ষ। শরৎ বোধহয় এখনও আসেনি। ম্যাপেল ট্রির পাতাগুলো সবুজ। শরতে এই পাতার সৌন্দর্য স্বর্গীয় রূপ ধারণ করে। সূর্যটা পূর্ণ তেজে জ্বলছে। গাছের ফাঁক গলে পানিতে সেই তেজ পড়তে ঝিলিমিলি করছে পানি। ঝরনার ওপরের জলের উৎসের পাশে এসে দাঁড়ায় ও। স্বচ্ছ জলের পুষ্কনি যেন। সেটাই আস্তে আস্তে ঝিরির রূপ নিয়ে বনের ভেতর ঢুকে গেছে। স্বচ্ছ জলের কোল ঘেঁষে জানা -অজানা রং-বেরঙের ফুল আর ফল গাছের মেলা যেন। একঝাঁক প্রজাপতি উড়ছে ফুল গাছের ওপর। পাখির কূজনে মুখর চারিপাশ। সাথে ঝরনার অবিরাম ঝরে পড়ার শব্দ তো আছেই। ইসাবেলার মন প্রাকৃতিক এই সৌন্দর্য অবলোকন করতে করতে বর্তমান ব্যথা, বেদনা ভুলে গেল। একটু হাঁটলে ঝিরিটা সরু হয়ে বনের ভেতর হারিয়ে গেছে। এদিকটা ছায়াঘেরা সুনিবিড়। বেশ ঠাণ্ডা। ঝিরিপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে সামনের মনোরম পরিবেশ উপভোগ করে। ঝিরির ওপাশটা ঘন সবুজ ঘাসে ছাওয়া। ওরই মধ্যে একটা খরগোশ ঘাস মুখে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। ইসাবেলার বেজায় আনন্দ হলো শ্বেতশুভ্র খরগোশটা দেখে। সাবধানে ঝিরি পেরিয়ে খরগোশটার কাছাকাছি যায়। ইসাবেলাকে দেখতে পেয়ে ওটা ঘাসের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। হতাশ মুখে দাঁড়িয়ে পড়ে ইসাবেলা। কিন্তু একটু পরেই ফের মাথা তুলে উঁকি দেয় খরগোশটা। দীর্ঘ হাসি ইসাবেলার ঠোঁটে। ওটাকে ওর চায়। ছুটল খরগোশ ধরবে বলে। মাটি, কাঁদা মাখামাখি করে শেষমেশ ধরতে পারে। ওর হাসির শব্দ ঝরনার ঝরে পড়ার শব্দকেও ক্ষণিকের তরে বুঝি স্তব্ধ করে দেয়। হাঁফাতে হাঁফাতে শুয়ে পড়ল ঘাসের ওপর। খরগোশটাকে দু’হাতে বুকের ওপর ধরে রেখেছে। আতঙ্কিত চোখে চেয়ে আছে ওটা। ইসাবেলা পরম মমতায় ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“ভয় পাস না। আমি তোকে মারব না বরং অনেক অনেক আহ্লাদ করব। আজ থেকে তুই আমার সাথে থাকবি। তোকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে।”
খরগোশটাকে বুকের সাথে ধরে নেমে এলো নিচে। ঝরনার কাছে এসে বলল,
“তোকে ছেড়ে দিলে ফের পালাবি। তোকে এভাবে নিয়ে গোসলও তো করতে পারব না। কী করি বলতো?” একটুখানি ভেবে সহাস্যে বলল,
“চল তোকে আগে রুমে রেখে আসি। তুই কিন্তু একটুও ভয় পাস না বুঝলি? আজ থেকে তুই আর আমি বন্ধু। জানিস আমি এখানে বন্দি জীবনযাপন করছি। আমার চারপাশে রক্তচোষার দল। হুট করে ওরা একদিন মেরে ফেলবে আমাকে। মরার আগে মা-বাবা কাওকে দেখতে পারব না। তুই কি আমার কষ্ট বুঝতে পারছিস? আচ্ছা, তোর পরিবার আছে?”
ঘরে এসে বিমর্ষ মুখে বলল,
“তোকেও বুঝি বন্দি করলাম তাই না? এটা ঠিক হলো না। ছেড়ে দেবো তোকে। আমি চাই না আমার মতো তোরও বন্দিজীবন কাটুক। কিন্তু একটুখানি সময় আমার সাথে থাক না, একটুখানি। সন্ধ্যার আগে আমি তোকে রেখে আসব ওখানে। থাকবি?”
খরগোশটা কী বুঝল কে জানে? ওটার চোখের আতঙ্কিত ভাব আর নেই। ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে ইসাবেলার মুখের দিকে।
“সত্যি বলছি। আচ্ছা দ্যাখ, এই ওয়াদা করলাম সন্ধ্যার আগে আগে রেখে আসব। ততক্ষণ আমার সাথে থাক। তোকে পেয়ে আমি অনেকদিন পর খুশি হয়েছি। অনেক অনেক খুশি।”
খরগোশটাকে বিছানায় বসিয়ে বলল,
“চুপটি করে বসে থাক। আমি যাব আর আসব। তারপর দুজনে মিলে অনেক মজা করব, হুম।”
দরজা বাইরে দিয়ে বন্ধ করে সানন্দে নাচতে নাচতে সিঁড়ি বেয়ে নামে। নিচের সিঁড়িতে পা দিতে নিকোলাসের মুখোমুখি হয়। ইসাবেলার মুখের এই হাসি আগে দেখেনি নিকোলাস। অপলক চেয়ে রইল। অস্বস্তিতে হাসি নিভে গেল ইসাবেলার ঠোঁটে। পাশ কেটে যেতে নিকোলাস বলে,
“হঠাৎ এত আনন্দের কারণ?”
ইসাবেলা থামল তবে জবাব দিলো না। এক মাস হতে চলল নোভার দাসী হিসেবে আছে। নিকোলাসের সাথে এরমাঝে দেখা হলেও এড়িয়ে গেছে। কী দরকার সেধে বিপদ ডেকে আনার। ও বেশ বুঝেছে নিকোলাস ওর জন্য সঠিক কেউ না। বিপদের নামান্তর। সুতরাং যতটা পারা যায় এড়িয়ে গেলেই বাঁচে। প্রথম প্রথম ব্যাপারটা নিকোলাস আমলে নেয়নি। কিন্তু ইদানীং ইসাবেলার এই উপেক্ষা, এড়িয়ে যাওয়া মোটে পছন্দ হচ্ছে না। আজও যখন ঠিক একই কাজ করল রাগে ওর বাহু চেপে ধরে।
“কানে খাটো? কথা বলেছি শোনোনি? আমাকে অসম্মান করার শাস্তি কতটা ভয়ানক হয় জানো তো?”
ইসাবেলা মাথা নিচু করে জোরপূর্বক বাহু ছাড়িয়ে নিলো। তারপর মুখ তুলে একপলক নিকোলাসের রাগত মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করে। এই লোকটার সমস্যা কী? ইসাবেলা তাকে এড়িয়ে যায় সে বোঝে না? ইচ্ছে করে ইসাবেলাকে বিপদে ফেলতে চাইছে বোধহয়। নির্লিপ্ত মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে পা চালিয়ে বেরিয়ে গেল সদর দরজা দিয়ে। নিকোলাসের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। কত বড়ো স্পর্ধা এই মেয়ের! নিকোলাসের কথাকে উপেক্ষা করে!
“এক্ষুনি গলা টিপে ধর। ওর দেহের রক্ত চুষে মেরে ফেল। শিক্ষা দে এই অসম্মানের।” নিকোলাসের ভেতরের শয়তানটা রাগে গজগজ করে। নিকোলাস চোখ বন্ধ করে মাথা নাড়ায়,
“না, নির্বোধ এই মেয়ে। মাফ করে দিলাম এবারকার মতো।”
দ্রুত গোসল সেরে ইসাবেলা ফিরে আসে প্রাসাদে। একপ্রকার দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এলো। দরজার কাছাকাছি আসতে থ মেরে দাঁড়িয়ে যায়। ওর স্পষ্ট মনে আছে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে গিয়েছিল। তাহলে খোলা কেন? রুমের ভেতর ঢুকতে চিৎকার করে ওঠে,
“নোভা, এ কি করলে?”
রক্তমাখা মুখে ভ্রু কুঁচকে তাকায় নোভা। হাতে এখনো খরগোশটার অর্ধ খাওয়া রক্তাক্ত দেহটা। ইসাবেলা কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ল দরজার গোঁড়ায়।
“কী হয়েছে ইসাবেল?”
“কী হয়েছে? পিশাচিনী, ডাইনি কোথাকার। কেন খেলি খরগোশটাকে? কেন?”
ক্রন্দনরত গলায় চেঁচিয়ে ওঠে ইসাবেলা। নোভা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইল। তারপর অপরাধী মুখে বলল,
“আমি ভেবেছি তুমি আমার জন্য এনেছ।”
ইসাবেলা সেকথা শুনেও শুনলো না। কপাল চাপড়ে বলল,
“সব দোষ আমার। কেন নিয়ে এলাম ওকে এখানে আমি? কেন আনলাম? আমার জন্য নিষ্পাপ প্রাণীটা মারা পড়ল। আমি ওকে ওয়াদা করেছিলাম রেখে আসব। ওয়াদা ভঙ্গ হলো তোমার কারণে। মেরে ফেললে তুমি ওকে। এমন কেন করলে? তোমাকে আমি ক্ষমা করব না নোভা। কক্ষনো না।”
ইসাবেলা দৌড়ে বেরিয়ে যায় প্রাসাদের বাইরে। ঝরনার পাশে হাঁটু মুড়ে বসে সশব্দে কাঁদতে লাগল। নিকোলাস পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। ইসাবেলাকে কাঁদতে দেখে থেমে যায়। মনে মনে কৌতূহল জাগলেও সেটা দমন করে নিজের কাজে চলে গেল। সন্ধ্যার পর ওই পথেই ফিরছিল। ঝরনার ওদিকটাতে চোখ যেতে একইভাবে বসে থাকতে দেখল ইসাবেলাকে। ক্রন্দনে কেঁপে কেঁপে উঠছে ওর দেহ। নিকোলাস পাশে এসে দাঁড়ায়।
“পিটার মরেছে।”
লাফ দিয়ে ওঠে ইসাবেলা। আর্ত চোখে তাকায় নিকোলাসের মুখপানে। নিকোলাস এবার বিরক্তি চেপে সঠিকভাবে বলল,
“এভাবে ভর সন্ধ্যাবেলা এই নির্জনে বসে কাঁদছ কেন? তোমার পিটার মরেছে?”
ইসাবেলা কোনো কথায় বলল না। রাগে ব্রহ্মতালু জ্বলে উঠল। সাধ্যি থাকলে এই মুহূর্তে নিকোলাসকে খুন করে ফেলত ও। সাধ্য নেই বলেই দাঁতে দাঁত কামড়ে চুপ করে রইল। নিকোলাস জবাব না পেয়ে ধমকে ওঠে,
“বাচ্চাদের মতো কাঁদছ কেন?”
ভয় পেল ইসাবেলা। কিন্তু রাগও কম হলো না। আগের স্থানে মুখ ঘুরিয়ে বসল। চোখ, নাক মুছে মনে মনে বলল,
“এই তো সেদিন ফাঁসির ঘোষনা দিয়েছিলি। এর আগে নেকড়ের সামনে ছেড়ে দিয়েছিলি। আজ হঠাৎ আমার কান্না শুনে দরদ উতলে পড়ল কেন? হারামজাদা, আমি তোর এই আলগা দরদ বুঝি না ভেবেছিস? আমাকে বেঁচে থাকতে দেখে সহ্য হচ্ছে না। ইচ্ছে করে রাগাচ্ছে যেন উলটো পালটা বলি। আর উনি নিয়ে গিয়ে নেকড়ের সামনে ছেড়ে দিক। ইতর, বদমাশ। সে ইচ্ছে তোর কোনোদিন পূরণ হবে না।”
নিকোলাস নিশ্চিত জানে ইসাবেলা মনে মনে বকছে। ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে ঝুঁকে বলল,
“যদি সাহস থাকে মুখ ফুটে বলো।”
না, এখানে আর বসে থাকা যাবে না। ইসাবেলা রেগে তাড়াহুড়ো করে উঠতে গিয়ে নিকোলাসের নাকে লাগে ওর মাথা। ব্যথা না লাগলেও ইসাবেলার এহেন আচরণে বিরক্ত হয় নিকোলাস,
“নির্বোধ, দেখেশুনে উঠতে পারো না?”
ইসাবেলা ঠোঁট শক্ত করে গলা দিয়ে বেরিয়ে আসা প্রতিবাদকে রুখে নিলো। এদের সাথে কথা বলার চেয়ে বোবা হয়ে থাকায় উত্তম। কারো সাথেই আর কথা বলবে না। খরগোশটার কথা মনে পড়তে ফের চোখ ভরে এলো অশ্রুতে। কাঁদতে কাঁদতে ঘুরে দাঁড়িয়ে হনহন করে অন্যদিকে চলে গেল। নিকোলাসের ভেতরের শয়তানটা ক্ষিপ্ত হয়ে বলল,
“দেখলি আবার অসম্মান করল। এবারও ছেড়ে দিবি?”
“এবার আর ছাড়াছাড়ি নেই। চরম শিক্ষা দেবো।”
শয়তানটা খুশি হয়। কিছুক্ষণ পরেই নিকোলাস বলে,
“নির্বোধ মেয়েমানুষকে মেরে বীরত্ব বা মজা নেই। বরঞ্চ সময়ের অপচয়।”
চলবে,,,
#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব-১৯
Writer Taniya Sheikh
“আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
“গরলিটজ শহরে।”
“সেটা কোথায়?”
“বললে কি চিনবে?”
নোভা একপলক তাকাল ইসাবেলার মুখের দিকে। তারপর আবার আগের মতো টমটমের বাইরে মুখ করে বসে রইল। ইসাবেলা কোলের ওপর রাখা হাত দুটোর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। খরগোশটার জন্য এখনও মন খারাপ ওর। কিন্তু রাগের বশে নোভাকে ওভাবে বলাটা উচিত হয়নি ভেবে অপরাধবোধে ভুগছে। সেই ঘটনার তিনদিন হতে চলল। নোভা যথাসম্ভব এড়িয়ে যাচ্ছে। খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া কথা বলছে না। ইসাবেলার কথাতে ব্যথা পেয়েছে সে। কিন্তু তারচেয়েও বেশি খারাপ লাগছে স্বভাবের বশে খরগোশটা খেয়ে ফেলায়। ইসাবেলার চোখে খরগোশটি ছিল সৌন্দর্যের, ভালোবাসার। আর নোভার চোখে তা ছিল কেবল আহার। মৃত্যুর আগে মা ঠিকই বলেছিল ওদের। এই জীবন অভিশপ্ত। স্রষ্টার অমোঘ নিয়ম লঙ্ঘন করে অভিশপ্ত ওরা। যেই মৃত্যুকে ফাঁকি দিয়েছিল, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে রোজ সেই মৃত্যুকে দেখে। যে প্রাণীগুলোকে হত্যা করে, মৃত্যু ওদের মধ্যে দিয়ে বিদ্রুপ করে। জানান দেয় কতটা ঘৃণ্য, বর্বর জীবনযাপন বেছে নিয়েছে। স্বাভাবিক মানুষের মতো বেঁচে থাকতে যে নোভা একটা প্রাণীকেও মারেনি। আজ পিশাচী ক্ষুৎপিপাসার তাড়নায় বাছ-বিচার ছাড়াই প্রাণী হত্যা করতে হয়। পিশাচীয় জীবনের প্রথমে মানুষের রক্ত ছিল ওর একমাত্র আহার। তখন প্রতিনিয়ত মৃত্যুকে দেখতে হতো। মানুষকে সমগোত্রীয় বলে নয়, শিকার বলে জ্ঞান করত। সে জীবন্মৃত, কোনো প্রাণীর প্রতি মায়া-মমতার স্থান থাকার কথা নয়। অন্তত মানুষের প্রতি তো নয়ই। কিন্তু আশ্চর্য! কালান্তরে দাঁড়িয়ে সে অনুভব করেছে সেই অনুভূতি। শিশুর মরণ কান্না, সন্তান হারা মায়ের আহাজারি আর রক্তশূন্য মানুষের চোখের সেই জল নোভার মৃত বিবেকটাকে সহসা নাড়া দেয়। এমনটা হওয়ার কথা নয়। সে ভ্রম ভেবে হেসেছে মনে মনে। কিন্তু অনুভূতিটা ভ্রম ছিল না। যত দিন গেল নোভার অস্বস্তি বাড়তে লাগল। এক সময় বাধ্য হয়ে বদলাতে হলো নিজেকে। ভ্যাম্পায়ার কমিউনিটির সকলের কাছে আজ তাই দূর্বল সে। রিচার্ড সবসময় বলেন, এই জীবন্মৃত হয়ে থাকার কারণে ওরা শক্তিধরে পরিণত হয়েছে। ঈশ্বরকেও টক্কর দেওয়ার ক্ষমতা আছে ওদের। সমস্ত পৃথিবী শাসন করবে একদিন। কিন্তু নোভার একসময় মনে হয়েছে ক্ষমতা টমতা কিছু নয়, এই জীবন্মৃত হয়ে থাকা একপ্রকার অসহায়ত্ব। মানুষের রক্তের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হয়। ঈশ্বর কারো ওপর নির্ভরশীল নয়। তাহলে তাঁর সাথে টক্কর কী করে হয়?
“আমাকে মাফ করে দাও নোভা।”
নোভা বিস্মিত মুখে বলল,
“তা কেন?”
“সেদিন তোমাকে যা বলেছি তা বলা উচিত হয়নি আমার। আমি সত্যি অনুতপ্ত ওই আচরণে।”
“তুমি তো ভুল কিছু বলোনি। যা আমি তাই বলেছ। তবে অনুতাপ কীসের?”
“নোভা! সত্যি বলছি রাগের মাথায় ভুলভাল বলেছি। মন থেকে বলিনি।”
“ইসাবেলা, যেভাবেই বলো সত্যিটা বলেছ।”
“না, সত্যি না ওসব কথা।”
“কোনটা সত্যি না? আমি ডাইনি না? আমি পিশাচী না? বলো?”
রেগে গেল নোভা। না সূচক মাথা নাড়ায় ইসাবেলা। ক্ষিপ্ত হয়ে ইসাবেলার চোয়াল চেপে ধরেছে নোভা।রক্তিম ঠোঁটের দু’পাশে চকচক করছে শ্বদন্ত। ধারালো দীর্ঘ নখগুলো ইসাবেলার চোয়ালের ত্বকে গেঁথে যায়। ব্যথায় নীল হয়ে ওঠে ইসাবেলার মুখ।
“নোভা, ব্যথা লাগছে ছাড়ো।”
“আমি পিশাচী, ডাইনি। তোমাকে এক ফোঁটা করুনা করেছি বলে ভেবে নিয়েছ আমি তুমি এক? আমি আর তুমি এক নই। আমার, আমাদের চোখে তোমরা মানুষ কেবল খাদ্য এবং একসময় হবে আমাদের অনুগত দাস। তোমাদের প্রতি মায়া মমতার রেশ মাত্র নেই। মায়ের কথা স্মরণ করে তোমাকে বাঁচিয়েছিলাম। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি ওই আমার চরম ভুল ছিল। আমার বাবা ঠিকই বলেন, মা বোকা ছিলেন তাই পৃথিবীসুদ্ধ মানুষকে নিজের মতো ভেবেছিলেন। অবশ্য, মৃত্যুর আগে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন বাস্তবতা। বুঝতে পেরেছিলেন সকলে তাঁর মতো নয়। তুমি আর তিনি একই রকম। বোকা। বোকাদের সংসর্গ যত দ্রুত ত্যাগ করা যায় ততই ভালো।”
ইসাবেলার গাল বেয়ে তপ্ত অশ্রুপাত হয়। নোভা ওর গাল ছেড়ে কোচওয়ানের আসনে বসা ভৃত্যটিকে বলে,
“পল, গাড়ি এক্ষুনি থামাও।”
গাড়ির চাকা থামতে হাওয়ায় মিশে কোচওয়ানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
“আজ রাতেই এই মেয়ের রাশিয়া যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবে। ওর ছায়াও যেন আর না দেখি আমি।”
“জি, রাজকুমারী।”
“কতবার বলব রাজকুমারী বলে ডাকবে না।”
“বেয়াদবি মাফ করবেন। মালিকের আদেশ আমি অমান্য করতে পারব না।”
দাঁত খিটমিট করে হাওয়ার সাথে মিশে গেল নোভা। সে আর কারো প্রতি মায়া দেখাবে না। তুচ্ছ মানুষের জন্য সমগোত্রীয়দের কথা শুনবে না। একদিন ইসাবেলাকে মুক্তি দিতো৷ আজই বা ক্ষতি কী? বরং যত তাড়াতাড়ি ইসাবেলার সান্নিধ্য ত্যাগ করবে ততই মঙ্গল। আন্দ্রেই ঠিকই বলেছিল, মানুষ নয় ওরা। মানুষের মতো অনুভূতিগুলোকেও স্থান দেওয়াটা উচিত নয়।
নখের আচরে ইসাবেলার গালের ত্বক ভীষণ জ্বলছে। নীরবে কাঁদছে। ব্যথিত হয়েছে নোভার এই আচরণে। আবার বাকরুদ্ধ ওর সিদ্ধান্ত শুনে। সামনে টমটমের ঘোড়া ছুটিয়ে হাঁক ছাড়ে কোচওয়ান। রাতের অন্ধকার আর নিস্তব্ধতা বিদীর্ণ করে এগিয়ে যায় অশ্বরব।
ট্রেনে তুলে দিয়ে বিদায় নিয়েছে পল। ইসাবেলা কেবিনের জানালার বাইরে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। বাড়ি ফিরবে আজ। সত্যি কি ফেরা হবে শেষমেশ? সন্দিগ্ধ মনে তাই খুব বেশি আনন্দ হয় না। ট্রেন ছাড়তে এখনও বেশ কিছুক্ষণের বিলম্ব হবে। প্লাটফর্ম লোকারণ্য। ইসাবেলার এই লোকারণ্য ভালো লাগে। আবার ভয়ও হয় হঠাৎ হঠাৎ। প্লাটফর্মে দাঁড়ানো কিংবা হেঁটে যাওয়া কোনো মানুষ ওর দিকে তাকিয়ে থাকলে বুক দুরুদুরু করে। ভাবে এই বুঝি ওদের কেউ এসে আক্রমণ করবে। দৃষ্টি সরিয়ে ভেতরে তাকাল। এই বগিতে আস্তে আস্তে যাত্রী উঠছে। নিজেদের আসনে বসে আছে কেউ কেউ, কেউ-বা সহযাত্রীদের সাথে আলাপে মেতেছে। ইসাবেলা একাই একটি কেবিনে। একা সফরের কারণে ভীষণ উত্তেজনা কাজ করছে ভেতরে। এই উত্তেজনা কাটাতে চোখ বন্ধ করে ঈশ্বর নাম জপতে লাগল। মা বলত পজেটিভ ভাবলে পজেটিভ হয়। কিন্তু যার জীবনে এত কিছু ঘটে গেছে তার মধ্যে পজেটিভিটি যে সহজে আসে না।
“হ্যালো, মেয়ে।”
সচকিত হয়ে চোখ মেলল ইসাবেলা। সামনে দাঁড়িয়ে আছেন মধ্যবয়সী একজন সুশ্রী রমনী। পরনে সাদা ভিক্টোরিয়া গাউন, মাথায় স্কার্ফ। সুহাসিনী রমনী সামনের সিটে মুখোমুখি বসলেন। ইসাবেলার কেন যেন তাঁর মুখটা বেশ পরিচিত মনে হলো। রমণী মমতা সুলভ হাসি হেসে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে পুনরায় বললেন,
“হ্যালো, আমি আগাথা ওয়াল্টার।”
“ইসাবেলা আলেক্সিভ।”
আগাথার করপুটে চুম্বন করে ইসাবেলা। হঠাৎই আগাথার মুখটা ম্লান হলো। ঝুঁকে ইসাবেলার থুতনি তুলে বললেন,
“কীভাবে আচর লাগল এমন সুন্দর মুখে?”
অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে ইসাবেলা। মনের ব্যথাটা যেন ফের ফিরে এলো। নোভার ওমন নিষ্ঠুর আচরণে যথার্থ ব্যথিত হয়েছে। কিন্তু কেন যেন ওর প্রতি একবিন্দুও রাগ হলো না। শুধু একটু মন খারাপ। জোরপূর্বক হেসে আগাথাকে বলল,
“ও কিছু না।” আগাথা কিন্তু ওর থুতনি ছাড়ল না। বিমর্ষ মুখে একটুখানি হাসল। আঙুল ছুঁয়ে দিলো আচরের স্থানে। কিছু অনুভব করল ইসাবেলা। এতক্ষণ ওখানটাতে যে যন্ত্রণা হচ্ছিল, এই মুহূর্তে তা আর নেই। বিস্মিত মুখে তাকাল আগাথার দিকে। তখনই মনে পড়ল ওঁর মুখটা পরিচিত লাগার কারণ। তারপর নামটাও খেয়ালে এলো। ‘আগাথা ওয়াল্টার’ নোভার পুরো নাম ‘নোভালি আগাথা ওয়াল্টার’ ওর বাবার নাম রিচার্ড ওয়াল্টার। হতবুদ্ধি হয়ে ভীত গলায় বলল,
“আ-আপনি নোভার মা?”
আগাথা হাসলেন। বেশ দীর্ঘায়িত হাসি তাঁর ঠোঁটে। সিটে পিঠ লাগিয়ে মাথা নাড়ালেন হ্যাঁ সূচক। হা হয়ে যাওয়া মুখের ওপর হাতটা চেপে বেরিয়ে চিৎকার দমন করে কিছুক্ষণ পর বলল,
“কীভাবে সম্ভব?”
“কীসের কথা বলছ তুমি ইসাবেল? আমার উপস্থিতির? না আমার বেঁচে থাকার?”
“দুটোই।”
“আমি তোমার সামনে বসে আছি ঠিকই তবে আজ আর আমি জীবিত নই।”
“কিন্তু এই তো বসে আছেন। কথা বলছেন, হাসছেন! মৃত মানুষের দ্বারা এসব কি সম্ভব?”
“না, আবার হ্যাঁ।”
“আপনিও কী!”
“না, ইসাবেল, আমি ওদের মতো নই।”
“তবে কী আপনি?”
“হুঁশশ, আস্তে ইসাবেলা। আমি সব বলছি।”
আশেপাশের কিছু বিরক্ত মুখ দেখে নিজেকে শান্ত করে বসে ইসাবেলা। আগাথা বলতে শুরু করলেন,
“আমার জন্ম জার্মানির একটি ছোট্ট গ্রামে। জন্মের পর থেকে কৈশোর পর্যন্ত জেনেছিলাম আমার বাবা নেই। কুমারী মায়ের সন্তান ছিলাম আমি। এ নিয়ে অনেক কথায় শুনতে হয়েছিল। মা’কে সহ্য করতে হয় গঞ্জনা। আমার মায়ের সাথে সকল বন্ধন ছিন্ন করে তাঁর পরিবার। আমাকে নিয়ে একাই কোনোমতে জীবন কাটাচ্ছিলেন। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? মা নতুন করে জীবন শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন। আমি রয়ে গেলাম একা। একপ্রকার না পেরে আমার দায়িত্ব নেন আমার নানী। খুবই ধর্মপরায়ণা ছিলেন তিনি। মানুষ হিসেবেও খারাপ ছিলেন না। আমার জারজ হয়ে জন্মানোটাতেই ক্ষোভ ছিল তাঁর। ওই এক কারণে একটু শক্ত আচরণ করতেন আমার সাথে। তাই বলে স্নেহের ঘাটতি ছিল না আমার প্রতি। তার সান্নিধ্যে এসে রোজ শনি, রবিবার চার্চে যাওয়া আসা হতো। ধর্মের প্রতি আমার অনুরাগ দেখে তিনি আরো ভালোবাসতে লাগলেন। সতেরো বছর বয়সে নানিমার দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক হলো। পরিচয় হয় এক সুদর্শন পুরুষের সাথে। রিচার্ড! যাকে আমি মনপ্রাণ দিয়ে একসময় ভালোবেসেছিলাম।” এইটুকু বলে ম্লান হাসলেন আগাথা। ইসাবেলার ধারণা এই ম্লান হাসির কারণ সোফিয়া। আন্দ্রেই নোভার বড়ো। সুতরাং সোফিয়া আর রিচার্ডের সম্পর্ক যে কীরূপ ছিল তা খানিকটা আন্দাজ করে নিলো। আগাথা পুনরায় বলতে আরম্ভ করলেন,
“রিচার্ডকে প্রথম দেখেই ভালো লেগেছিল। তাই বিয়েতে না করিনি। যথা সময়ে ধর্মাচার পালন করে বিয়েটা সম্পন্ন হয়। রিচার্ড আমাকে নিয়ে নতুন বাড়িতে উঠল। সবই ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু আমার আঠারোতম জন্মদিনে প্রথম বিপত্তি ঘটল। শরীরে অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। তখনও জানতাম না ইতোমধ্যে নিকো আমার গর্ভে এসেছে। আঠারো তম জন্মদিনে আমি উপলব্ধি করলাম আমার ঘ্রাণ শক্তিতে পরিবর্তন এসেছে। আর পাঁচটা মানুষের মতো নয় সেই পরিবর্তন। বিশেষ করে রাতে একটা মিষ্টি গন্ধ টের পেলাম। ঠিক শিওরের পাশের জানালার ওপার থেকে যেন গন্ধটা আসত। আস্তে আস্তে আরো কিছু পরিবর্তন টের পেতে লাগলাম। সেদিন ছিল চন্দ্রিমা রাত। কেন যেন ঘরে মন টিকল না। ছুটে বেরিয়ে এলাম। বাইরে হাড় কাঁপানো শীত তবুও গরমে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে শরীর। একটা সুতো গায়ে রাখা গেল না। আর তখনই কানে আসত ভয়ংকর সেই গোঙানির আওয়াজ। কিন্তু ভয় হলো না মোটেও। চিত্ত চঞ্চল হয়ে উঠল। দেহ কুঁজো হয়ে যায়। অসহ্য পীড়া হতে লাগল। আর তারপরেই সেই ভয়ংকর সত্যের মুখোমুখি হই। একটা শ্বেতকায় নেকড়েতে রূপান্তরিত হয়ে যাই আমি।”
“নেকড়ে!”
উচ্চৈঃস্বরে বলে ওঠে ইসাবেলা। আশেপাশের যাত্রীরা বিস্ফোরিত চোখে তাকাতে মৃদু হেসে বলে,
“গল্পের নেকড়ে, হে হে।” ওর বোকা হাসিতে যাত্রীরা বিরক্ত হয়ে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। কয়েকজন তো ফিসফিস করে কিছু বলে হাসল। ইসাবেলা ঝুঁকে বসে। আগাথার প্রসন্ন মুখে চেয়ে ফিসফিস করে বলল,
“তারপর?”
“প্রায় রাতেই লুকিয়ে বেরিয়ে যেতাম। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে রিচার্ড গভীর ঘুমে তলিয়ে যেত তখন। নৈশ ভ্রমন কেবল আর ভ্রমণ রইল না। বনের পশু-পাখি শিকার করতে শুরু করলাম। শুধু শিকার করেই ক্ষান্ত দিতো না আমার নেকড়ে রূপ। ওগুলোর রক্ত মাংস খেয়ে তবে শান্ত হতো। নিজের ওমন অবস্থাতে ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়েছিলাম। একটা ভয় আমাকে সর্বদা ঘিরে রাখত। মনে হতো এই বুঝি সত্যিটা কেউ জেনে যায়। মানুষ রূপে ফিরে এলে ঘৃণা হতো নিজের ওপর। কিন্তু কী ই বা করার ছিল? এদিকে গর্ভবতী হওয়ার সকল লক্ষণ প্রকাশিত হতে লাগল। আমি গর্ভবতী জেনে রিচার্ড খুব খুশি হলো। আমি কিন্তু মোটেও খুশি হতে পারলাম না৷ স্বাভাবিক মানুষের মধ্যে থেকে এ কী অস্বাভাবিক রূপ আমার? কতই না কেঁদেছি তখন। নিজের ধোঁয়াশাচ্ছন্ন জীবন সম্পর্কে জানার আগ্রহ একসময় আরো দৃঢ় হলো। এক রাতে সিদ্ধান্ত নিলাম সেই গন্ধটাকে অনুসরণ করব। তাই করলাম। নেকড়ের রূপে গন্ধটা পর্যন্ত পৌঁছাতে সমস্যা হলো না। নিবিড় অরণ্যের মধ্যে এক পাল নেকড়ের আস্থানা। গোল হয়ে বৈঠকে বসেছিল যেন। আমাকে দেখতে ওগুলো যেন অবাক হয়ে রইল। তারপর নেকড়ের ভীর ঠেলে এগিয়ে এলো আমারই রঙের এক শুভ্র গাত্রবর্ণের নেকড়ে। গন্ধটা ঠিক ওঁটার গা থেকেই আসছিল। ওঁর চোখে আমি স্পষ্ট জল দেখতে পেয়েছিলাম। আমাকে দেখে খুশি হয়েছিল যেন। কাছে এসে কপালে কপাল রাখল। বিশ্বাস করো, ওইদিন মনে হয়েছিল সবচেয়ে আপনজনকে কাছে পেয়েছি। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে ইশারা করল অনুসরণ করতে। আমি করলাম। কিছুদূর বনের মধ্যে গিয়ে ওঁটাকে আর দেখলাম না। পাশ থেকে খচখচ আওয়াজে সতর্ক হতে মানুষ রূপে প্রথম দেখেছিলাম তাঁকে। আমার পিতাকে।”
“আপনি তবে অর্ধ মানবী অর্ধ নেকড়ে?”
আগাথা সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়ালেন।
চলবে,,,