“তিমির”পর্ব ১৪

0
1300

“তিমির”পর্ব ১৪

আমি ছাড়া ঘরে বাকি সবাই ছেলে। আদিল, ধ্রুব, আবির এবং সজীব স্যার সকলেই বেলকনিতে বসে আছে। আমি বিছানায় হাত দিয়ে হাঁটু জড়িয়ে রেখে বসে রয়েছি। ভাবিনি জীবনে কখনও এমন একটা পরিস্থিতি আসবে, যখন আমাকে রোগী হিসেবে কেউ দেখতে আসবে।
একটু আগে ধ্রুব সাহস করে আমার পাশে বসেছিল। সে আমার গালে হাত রেখে বলেছিল, “নিজেকে রোগী ভেবো না। সবই ঠিক হয়ে যাবে।”
ঠিক তখনই আমার বিবেক কথা বলল, “ছেলেটির গন্ধটা সহ্যের বাইরে। ওকে তাড়িয়ে দে।”
আমি কিছুই করলাম না। দাঁতে দাঁত খিঁচে বসে রইলাম। যে ব্যথাটির অপেক্ষায় ছিলাম, তা সাথে সাথে পেলাম। এবার কে যেন ভেতরেই আমার বুকে ঘুষি মেরেছে। মনে হয়, মুখে রক্ত এসেছে। তবে আমি বাইরে স্বাভাবিক রইলাম। ধ্রুবকে আমি দেখাতে চাইনি কতটা কষ্ট পেয়েছি। কারণ তার বিষাদিত মুখটা আমি সহ্য করতে পারি না।
চোখ বড় বড় করে সে বলল, “কী হয়েছে আলিয়া?”
দাঁতের ফাঁক দিয়ে বললাম, “বমি আসছে।”
তাড়াতাড়ি বাথরুমে গিয়ে রক্তগুলো ফেললাম। আয়নায় তাকিয়ে দেখলাম, আমার চোখে পানি টলমল করছে। স্বপ্নটার মতো আমি এভাবে ছটফট করে মরতে চাই না। আমাকে একেবারে মেরে ফেললে কি ওই পিশাচের কোনো ক্ষতি হবে? সামান্য বমির কথায় ধ্রুব কীভাবে রিয়্যাক্ট করল! না জানি আমার মৃত্যু তাকে কতটা পীড়া দেবে। ওকে কষ্টে আমি একদমই দেখতে পারব না। আমি এতটা ভালো কবে ওকে বেসেছি?
আমি পালিয়ে যাব। নিজেকে শেষ করে ফেলব। এসব আর সহ্য হচ্ছে না। কিন্তু হতাশ হয়ে দেখলাম, আদিল আমাকে রক্ত ফেলতে দেখে ফেলেছে। তিনি ধ্রুবকে নির্দেশ দিলেন, যাতে দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখা হয়, যাতে আমি পালাতে না পারি। ওহহো। তিনি কি ‘সবকিছু’ বুঝে ফেলেছেন?
তিনি যখন আবিরকে ফোন করে আসতে বলেছেন, তখন বুঝতে পারি, তিনি ধরে ফেলেছেন আমি কতটা ব্যথা পাচ্ছি। আর এই ব্যথা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্যই আত্মহত্যা করতে চাইব। ভাগ্যিস, তিনি ধরতে পারেননি আমার মনের ফিলিংসটা।
আমার বিষয়েই ছেলেরা জড় হয়েছে। ধ্রুব আর আদিলকে সমবয়সীর ন্যায় দেখাচ্ছে। ধ্রুব মাত্র উনিশ বছরের হয়েও তাকে আবিরের সমান দেখাচ্ছে। ওখানে সবচেয়ে বেশি পেশিবহুল দেখাচ্ছে সজীব স্যারকে। তার মাসেল এর কারণে তাঁকে অনেক বয়স্ক মনে হয়। কিন্তু তিনি আবিরের সমবয়সী।
আদিল ধ্রুবকে বলল, “ও কি এখন তোমাকে ছুঁতে পারে না?
“আমি পাশেও থাকতে পারি না। দেখলেনই তো, বমি এসেছে।”
“ও তোমাকে বাঁচাচ্ছিল। ওর মুখে রক্ত এসেছে। ওর ভেতরের ছায়াটা ওকে ব্যথা দিচ্ছে।”
ধ্রুবকে যেন কেউ ছুরি দিয়ে আঘাত করেছে, সে এতটা আহতের মতো বলল, “হয়তো আমাদের গন্ধটার কারণেই হয়েছে।”
“ওর অবস্থা ক্রিটিক্যাল হচ্ছে। নিজেকে ও ক্ষতি করছে। ওর পাশে সবসময় শক্তিশালী একজনকে থাকবে হবে, যে ওকে রক্ষা করবে।”
আবির বলল, “আমি কি পারব?”
“না। তুমি ভুলো না, তোমার কাছ থেকেও আমার মতোই সুগন্ধ বেরুয়।”
সজীব ভাইয়াকে আমার পাশে থাকতে বললে ধ্রুব বলল, “ওটার গন্ধ সজীব সইতে পারবে না।”
সজীব ভাই বলল, “আমি ম্যানেজ করব। একবার পরীক্ষা করে দেখা যাক।”
সজীব ভাই আর আদিল আমার সামনে এলো। আদিল দাঁড়িয়ে রইল, সজীব ভাইকে ধরার জন্য। সজীব ভাইয়া আমার কাছে এসে বললেন, “আলিয়া, তুমি অনেক ভালো একটা স্টুডেন্ট। তুমি অনেক দূর এগিয়ে যাবে। নিজেকে এভাবে শাস্তি দিও না।”
আমি মুখে শ্বাস নিতে নিতে বললাম, “অন্য কাউকেও আঘাত করতে পারব না..”
কথাটা শেষ না হতেই আমি সজীব ভাইয়াকে ধাক্কা দিতে তাঁর বাহু ধরলাম। তিনি তিন সেকেন্ডের বেশি আমাকে ধরে রাখতে পারলেন না। আমার বলটা বেশি কাজ করায় তিনি ধাক্কা খেলেনই। কিন্তু পরমুহূর্তে আদিল এসে তাকে ধরে ফেলল। আমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলাম, “কেউই আমাকে বাঁচাতে পারবে না।”
আদিল আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে সজীব ভাইয়াকে নিয়ে বেলকনিতে গিয়ে থাইগ্লাসের দরজা বেঁধে দিলেন। এটি আমার নিকটবর্তী এমনই একটি জায়গা, যেখান থেকে আমার ওপর নজর রাখা যাবে, সে সাথে আমি তাদের স্বর্গীয় সুগন্ধটা পাব না। ধ্রুব মিনতি করল, “আলিয়া, প্লিজ কেঁদো না।”
আহ্, কেউ বুঝছে না। “আমি আমার মায়ের মতো করেই মরে যাব।”
আদিল বলল, “তোমার মায়ের কী হয়েছিল?”
“আমার এখন যে অবস্থাটি হচ্ছে, তা মায়েরও হয়েছিল। তিনি শেষের দিকে আমাকে তাঁর কাছেও ঘেঁষতে দিতেন না, যাতে তিনি আমাকে আঘাত করতে না পারেন। আমার লক্ষণগুলো তার কাছেও দেখেছিলাম। তিনি কাউকে কিছু করতে না পেরে নিজেই সব আঘাত সইয়ে নিতেন। এভাবে শেষ পর্যায়ে ছটফট করে মারা গিয়েছে।”
“তোমারগুলো কবে থেকে শুরু হয়েছে?”
“যদি দুঃস্বপ্নকেও আমার অস্বাভাবিকতার লিস্টে রাখি, তবে মায়ের মৃত্যুর পর থেকেই আমি দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি।”
“তাহলে তোমার মায়ের ওপরও খারাপ কিছু একটার ছায়া ছিল। আমার মনে হচ্ছে, তাকে মারার পর ওটা তোমাকে ধরেছে।” তিনি আগের প্রসঙ্গে বাকিদের বললেন, “যেটুকু ভেবেছি, তারচেয়ে অনেক শক্তি আলিয়ার। আমি আর ধ্রুব ওকে সামলাতে পারব। কিন্তু আমরা ওর আশেপাশে থাকলে সে আমাদের স্থলে নিজেকেই ক্ষতি করবে। কারণ সে আমাদের ছুঁতে পারে না। যাদের ছুঁতে পারে, তাদের আক্রমণ করে। সজীব আর আবির মানুষ। আলিয়ার শক্তি, গন্ধ এসবের বিরুদ্ধে লড়তে পারবে না। কী করা যায়!”
সবাইকে আবারও চিন্তিত দেখাল। হঠাৎ আদিল বলল, “আলিয়া, তুমি কার কাছে বেশি ঠিক থাকো? এই যাবৎ কাকে তুমি আক্রমণ করতে চাওনি?” সে এমনভাবে কথাটা বলেছে মনে হয়েছে যেন আবিরই কথাটা বলেছে। তাদের দু’জনের একই বুদ্ধি, একই চিন্তাধারা, একই কণ্ঠ এবং একই চেহারা কিন্তু আত্মা ভিন্ন।
আমি মনে করতে চেষ্টা করছি। তেমন কিছু মনে পড়ছে না, “নাদিয়া আর নাঈমার সাথে তেমনটা থাকিনি। আরিয়ান স্যারও আমার নিকটে তেমন আসেননি। তবে…” আমার মনে পড়ল, শেষবার যখন ওদের বাসায় ছিলাম, তখন খেতে ডাকা হলে হলঘরে সুগন্ধ বেরুয় এমন প্রাণী পাঁচজন ছিল। আবির, সাবিলা, আদিল, সাবরিনা এবং ধ্রুব। কিন্তু আমি গুনেছিলাম কেবল চারজনকে। “আমার মনে হচ্ছে সাবরিনা আর সাবিলার মধ্যে যেকোনো একজনকে।”
“গ্রেট,” আদিল বলল, “নাঈমাদের দেখার জন্য আরিয়ান বাসায় আছে। আমি সাবরিনা আর সাবিলাকে আসতে বলছি।”
ভেবেছি তিনি ফোন নেবেন। কিন্তু তার পরিবর্তে তিনি তার হাতের কালো ব্যান্ডটিতে অন্য হাত রাখলেন। তিনি কয়েক সেকেন্ড চোখ বন্ধ করে রইলেন। বিষয়টা আমার জন্য নতুন। কিন্তু ধ্রুবের জন্য নয়। সেও কি আগে ওভাবে কারো সাথে কমিউনিকেট করেছে? ইশ, আমি কেন ওই ছোট সুতাটি পরতে পারি না! পবিত্র জিনিসগুলোকে কেন আমার কাছ থেকে দূরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে! কেন? কোন অপরাধে?
পাঁচ মিনিট পর কিছু একটার ঝাপটানোর আওয়াজে বেলকনির দিকে তাকালাম। সাবরিনা ডানা ঝাপটিয়ে নেমেছে। একি! আমার সাবিলার ডানা বড় হয়েছে! সেও উড়ে এসেছে! তার ডানা এখন তার হাঁটুর নিচ পর্যন্ত এসেছে। আহ্, কতদিন পরই না ওকে দেখছি! আমি উঠে ওকে জড়িয়ে ধরতেই যাচ্ছিলাম, আদিল আমাকে থামতে বললেন। পরক্ষণে মাথায় এলো, আমি নিজের জন্য, সবার জন্য ক্ষতিকর।
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।

গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা

◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।

আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share


আমি আবারও আগের ন্যায় বসে পড়ি।
তাদের দু’জনকে আলাদাভাবে কিছুই বলতে হয়নি। তারা নীরবে জেনে নেয়। সর্বপ্রথম দরজা খুলে সাবরিনাই ঘরে ঢুকল।
“দেখি, নাকে শ্বাস নিয়ে দেখ।”
আমি সাহস করে নাকে শ্বাস নেই। সাথে সাথে মাথা ঝিমঝিম করতে শুরু করল। ধ্রুব আর আদিলেরই একই সুগন্ধটিকে আমি ঘৃণা করতে লাগলাম। ভেতর থেকে আমার মস্তিষ্কে নীরবে কে যেন বলল, “এসব কী হচ্ছে? যত্তসব! এগুলো কী? মানুষ নাকি অন্যকিছু? এতো পাক-পবিত্র কেন?” সে আমায় নির্দেশ দিলো, যাতে আমি এই পবিত্র শরীরের ওপর আক্রমণ করি। আমার মস্তিষ্কে চাপ পড়তে শুরু হলে নিরুপায় হয়ে তেড়ে কয়েক সেকেন্ডেই সাবরিনার কাছে চলে গেলাম। দাঁত বের করে এক দানবের ন্যায় হিসহিস করে তার গলা ধরতে যাই। মুহূর্তেই সাবরিনা ডানাকে দৃশ্যমান করে আমার নাগাল থেকে উপরে উঠে গেল। সে নিজেকে রক্ষা করার পর আমাকে কিছু করল না। আমি যেন গাছ থেকে কোনো একটা ফল নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছি, এমন ভঙ্গিমায় সাবরিনাকে ধরার চেষ্টা করছি। আমার ভেতরের জন রেগে অগ্নিশর্মা। সাবরিনা উড়ন্ত অবস্থায়ই দরজা খুলে বেলকনিতে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। আমি স্বাভাবিক হলে তাকে ‘সরি’ বললাম।
সাবরিনা হেসে ক্ষমা করে দেয়। এবার সাবিলা এলো, আমার সাবিলা। ওকে ধ্রুবের চেয়ে কম ভালোবাসি না। ওকে কিছু করতে পারব না। সাবিলা বুঝতে পেরে বলল, “যাস্ট পরীক্ষার জন্যই ভাবো আমি অন্য কেউ, যে তোমার পাশে থাকার যোগ্য কিনা দেখতে এসেছি।”
সাহস করে তার মিষ্টি অর্ধ মানবীয় ঘ্রাণটা নেই। আহ্, কি দারুণ! ভেতরের জন কী ভাবছে জানি না। কিন্তু এই সুগন্ধের তুলনা হয় না। বাকি চারজনের মতো তার গন্ধ কিছুটা একই হলেও, পুরোপুরিই ভিন্ন। সাথে সাথে আমার মনে পড়ল, এর আগে আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাবিলার হাত ধরে থেকেছি। তার বুকে দশ সেকেন্ডেরও বেশি সময় মাথা রেখেছি। আমি তার পাকসাফ ডানাও ছুঁয়ে দেখেছি। কোনো বিকর্ষণ কোনোবার কাজ করেনি! আহ্, সাবিলাই তো সে, অসুস্থ অবস্থায়ও যার পাশে নির্বিঘ্নে আমি থেকেছি। আমার ভেতরের জন তাকে আক্রমণ কখনও করেনি।
খেয়াল করলাম, বেলকনিতে পাতা চেয়ারগুলো থেকে সবাই অবাক হয়ে ইতোমধ্যে দাঁড়িয়ে পড়েছে। আমি সাবিলাকে অনেকদিন পর দেখায় ওর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। সে হেসে হাতগুলো শূন্যে তুলল। আমি দৌড়ে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। ভেতরের জন বলল, “তুই কি কাউকে জড়িয়ে ধরেছিস? জিনিসটা কী? মানুষ নাকি অন্যকিছু? ওটাকে দেখা যায় না কেন?” সে অনবরত প্রশ্ন করে চলেছে। আমার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল।
“আই মিস ইউ সো মাচ সাবিলা।”
“মিস ইউ টু। লাভ ইউ আলিয়া, আমার বোন।” সে আমার কপালে চুমু খেল। আমার চোখের পানি মুছে দিলো। সে বিরস মুখে বলল, “তুমি দেখি সম্পূর্ণই পাল্টে গেছ। চোখ কোটরে ঢুকে গেছে, মুখ শুকিয়ে গেছে, চোখের নিচে কালি পড়েছে। চোখ লাল হয়ে গেছে। ওহ্, আলিয়া।” সে আবারও পরম মমতায় আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমিও ওকে শক্তভাবে ধরলাম। জানি না, আর কখনও ধরতে পারব কিনা। সে বলল, “ব্যস, যতদিন সুস্থ হবি না ততদিন আমিই এখানে থেকে তোর দেখাশোনা করব। কিচ্ছু হবে না আমার আলিয়ার।”
“কিন্তু কতদিন? কতদিন সবাই আমার দেখাশোনা করতে থাকবে?”
সকলে নিশ্চুপ রইল। তার মাঝ থেকে আদিল বলল, “ও ঠিকই বলেছে। এভাবে তাকে কেবলই রক্ষা করার মানে হয় না। তাকে পুরোপুরি ঠিক করা উচিত। কারণ সাবিলা যতই সাথে থাকুক, তার ভেতরের জন চুপচাপ থাকবে না। সে অনেক খারাপ।”
হুম, ইতোমধ্যে সে আমার সাথে কথা বলতে শুরু করেছে। আগে করেনি বিধায় সাবিলার অস্তিত্ব লুকিয়েছিল। সে আবারও জিজ্ঞেস করে আঘাত দিলে আমি কীভাবে বলব, সাবিলা অর্ধ মানুষ আর অর্ধ পরী? তার গন্ধ তার কাছে পৌঁছে না এবং সাবিলার শক্তি বাকি এঞ্জেলের সমতুল্যও বটে। এসব জেনে ভেতরের জন হেরে গিয়ে রাগে ফেটে পড়বে।
আদিলরা চলে গেল। আমার কাছে আবির, সাবিলা আর ধ্রুবই রয়ে গেছে। ইশ, সাবিলার ন্যায় ধ্রুবও যদি আমার পাশে থাকতে পারত! আমি সারাটা রাত সাবিলাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছি, ছটফট করেছি, কষ্ট পেয়েছি। কিন্তু সাবিলাকে জড়িয়ে ধরে থাকায় সে ক্ষতগুলোতে ভরণও হয়েছে।
পরদিন সকাল পাঁচটায় উঠলে ধ্রুব আমার জন্য একগাদা খাবার পাঠায়। অভুক্তের ন্যায় আমি গপাগপ খেয়েও ফেললাম। ধ্রুব সারাক্ষণ বেলকনিতেই ছিল। সন্ধ্যায় বাকিরাও এলো।
ধ্রুবকে বললাম, “একটু রেস্ট নাও। কতক্ষণ একভাবেই ওখানে বসে থাকবে?”
সাবিলা বলল, “সে হয়তো ছোট থেকেই এমন, নড়নচড়নহীন।”
“তবু। আচ্ছা ধ্রুব, তুমি কি তোমার আঙুলের সুতাটি দিয়ে কারও সাথে যোগাযোগ কর? মানে বিজলি.. ”
“নাহ্, কেবল মায়ের সাথে করি। এটি তার ব্যান্ডেরই অংশ। আমি পাওয়ার পর থেকে এতে আমার হৃদস্পন্দনও জুড়েছে। তোমাকে পরানোর পর তুমিও বাবা-মা এবং… আমার সাথে কানেক্টেড ছিলে।” আমি, আকাশের তিনটি প্রাণীর সাথে কানেক্টেড? ভাবতেই পুলকিত হলাম। “সুতাটি ছোট হওয়ায় তুমি তাদের হৃদস্পন্দন অনুভব করনি। তবে তারা করেছে।”
“কিহ্!”
“মাকে অনেক আগেই জানিয়েছিলাম, আমাদের বন্ধুত্বের কথা। এও জানিয়েছি, তুমি আমার সত্য ধীরে ধীরে জেনে ফেলছ। এরপর আমি তোমার নিকটে আসতে থাকলাম। তোমার চিন্তা শুরু হলো। পৃথিবীতে আসার পর আমার প্রথম লং লাস্টিং ফ্রেন্ড একমাত্র তুমিই। তাই আমার সুতাটি থেকে কিছু অংশ দিয়ে তোমার সাথে কানেক্টেড থাকতাম।” ধ্রুব আচমকা বলল, “আসিয়া এখানে আসে না কেন?”
“সে আসলে মনে করে, আমি ওকে ধাক্কা দেবো। আমি শুরুতে ধাক্কা দেওয়ার পর সে আর কখনও আমার পাশে আসেনি। বাবার ওপর বারবার আক্রমণ করতে চাওয়ায় আর কখনও কথাও বলেনি। একবার এসেছিল। তবে আমার রোগটা ধরতে না পারায় চলে গিয়েছে।”
পৃথিবীর ভূমিতে থাকা প্রায় সকল অমানব এই মুহূর্তে আমারই বেলকনিতে। রীতিমতো ভিড়। কেবল সাবিলাই আছে আমার পাশে। সবাই আমাকে অনেক ভালোবাসে। তাইতো, সারারাত এখানেই কাটাচ্ছে। এমন সময় সকলে একসাথে ঠান্ডা অনুভব করল। দেখতে পেলাম আসিয়া এসেছে। সে বাকিদের দেখে হতভম্ব হলো। সে বলল, “আলিয়া, তুই কত লাকি! এতগুলো দেবদূত তুই জীবিত থাকতে একসাথে দেখছিস।”
শুকনো মুখে একটু হাসলাম। আমি সবার সাথে ওর পরিচয় করিয়ে দেই। সে জিজ্ঞেস করল, “সাবিলার সাথে তুই থাকতে পারছিস?”
“হ্যাঁ।”
“তোর রোগটা কী তা নিয়ে অনেক ভেবেছি। কিন্তু পাইনি।”
আবির বলল, “এককথায়, ওর শরীরে একটা খারাপ আত্মা বাস করছে।”
“হোয়াট? আলিয়া, এটা আগে জানাসনি কেন?”
“তুই ছিলিই না।”
“ওকে, এখন আমায় তোর অসুস্থতার লক্ষণগুলো ফার্স্ট টু লাস্ট বল।” ওর উদ্বিগ্নতা দেখে আমরাও অনেকটা উদ্বিগ্ন হলাম।
আমি তাকে প্রতিটি কিছু বললাম। বললাম, কীভাবে লোকটি আমাকে ইঙ্গিত দেয়, কী কী সে এযাবৎ আমাকে নির্দেশ দিয়ে এসেছে, সে দেখতে কেমন, আমার দুর্গন্ধটাই তার দুর্গন্ধ প্রভৃতি কিছুই বাদ না দিয়ে জানাই। এবার আসিয়া আমার সামনে এলো। আসিয়াকে ঘিরে সাবরিনা, আদিল, আবির এবং সজীব ভাই দাঁড়িয়েছে, যাতে তাকে এবার আমি ধাক্কা না দেই।
আসিয়ার কথায় আমি উঠে দাঁড়ালাম। ধ্রুব আমাকে না ছুঁয়ে রক্ষকের ন্যায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। সাবিলা প্রস্তুতি নিয়ে আমায় ধরে রইল, যাতে আমার অকস্মাৎ আক্রমণে সে আমাকে প্রতিহত করতে পারে। এতোগুলো পবিত্র শক্তিশালী শরীরের বিরুদ্ধে ভেতরের জন লড়তে চাইছে না। সে আমাকে ভেতরে উত্তপ্ত করছে। আমি উপরে ব্যথা প্রকাশ করলাম না। আমি যখন আসিয়ার কাছ থেকে একহাত দূরে দাঁড়াই, তখন মনে হলো, আজ এমন একটা কিছু ঘটবে যা আমি কখনও দেখিনি। হয়তো যে সাহসটা নিয়ে আমি এগিয়ে চলেছি, তাই হবে আমার জীবনের শেষ মুহূর্তের সাহস…
হঠাৎ সারা ঘর বরফ ঠান্ডা হয়ে গেল। সবাই কাঁপতে লাগল। কিন্তু কেউ তাদের পজিশন থেকে একবিন্দুও নড়েনি। এতো ঠান্ডা যে, ঠান্ডা আমিও জমতে লাগলাম। ভেতরের জন আমার মনে হচ্ছে ছটফট করছে। আসিয়ার দিকে তাকিয়ে আমি আতঙ্কিত হয়ে গেলাম। তার চোখের মণি অস্বাভাবিক হারে বড় হয়ে গেছে। আমি শুনেছি, একসময় আদিল দেহবিহীন অবস্থায় এমনই ছিল। এই প্রথম, মৃত আসিয়াকে আমি ভয় পেয়েছি। ঠান্ডার প্রভাবটা কি সে ছড়িয়েছে?
সবচেয়ে বেশি আমিই ছটফট করছি। কেন করছি তা জানি না। আগুনের স্পর্শে মানুষ যেভাবে ছটফট করে, ঠিক তেমন করেই আমি ছটফট করতে লাগলাম। ভেতরের জন আমাকে আঁচড় দিচ্ছে। আমি চিৎকার করে কেঁদে উঠে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ি। কে যেন ডুকরে কাঁদল। হয়তো সাবিলাই। আসিয়াকে আমি থামাতে চাইছি। কিন্তু সে অনেক অনেক ঠান্ডা।
সে তার পজিশন একই রাখল। আমার কাঁদার গতি ক্রমে বাড়ছে। দৃষ্টিসীমানার সবকিছুই ঝাপসা হতে শুরু করল। ফ্লোরে আমি কাতরাতে কাতরাতে একসময় মনে হলো, আমার কোনো শরীর নেই। কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেই। দুনিয়ার অস্তিত্বই নেই। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম, আসিয়া ছাড়া সকলে চোখ ঘুরিয়ে রেখেছে, যেন আমি নগ্ন হয়ে গিয়েছি। না তো! অস্পষ্ট চোখে দেখলাম, আমার পায়ে জিন্স আছে। হাঁটুর ওপর পিংক টপস দেখা যাচ্ছে। তবে?
আমার শক্তি যথেষ্ট নেই চারপাশে থাকানোর। তবে অনুভব করছি, বীভৎস এক দুর্গন্ধ ছড়িয়ে আছে। মনে হয়, আমার শরীরের পাশে এমন কেউ দাঁড়িয়েছে, যাকে সবাই ঘিরে ধরেছে। একটু শক্তি জুগিয়ে দেখলাম, এক নগ্ন লোক তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এবারও তাকে দেখার আগে আমি চোখ সরিয়ে নেই। পিশাচটা কি মরার সময় এভাবেই মরেছিল? হাস্যকর!
আসিয়া বলল, “আপনারা তাকে ঘিরে রাখুন। সে আপনাদের ধরতে পারলেও আপনাদের শক্তির বিরুদ্ধে পেরে উঠবে না। আমি আমার কাজটা করে নেবো।”
লোকটি দাঁত বের করে বীভৎসভাবে হিসহিস করছে। কেন যেন, তাকে দেখে চিনেমায় দেখা ধর্ষকদের চেহারা মনে পড়ে গেছে। সে তার জায়গা থেকে নড়তে পারছে না। ঠান্ডায় আমি বরফের ন্যায় শক্ত হয়ে গিয়েছি। আমার চেতনাশক্তি লোপ পাচ্ছে। অতঃপর আমার চোখজোড়া বন্ধ হয়ে গেল….
চোখ খোলার পর গা হাতরিয়ে দেখলাম, আমি জীবিত আছি! শুরুতেই দেখতে পেয়েছি দেয়াল ঘড়িটি। এরপর… এরপর আমাকে ঘিরে থাকা সাবিলা, আবির, আদিল, সাবরিনা, ধ্রুব, আরিয়ান এবং সজীব স্যার, নাঈমা এবং নাদিয়া সবাইকে দেখলাম। আহ্! আমি নাকে শ্বাস কেন নিচ্ছি? তড়িঘড়ি করে মুখ দিয়ে শ্বাস নিতে গেলে খেয়াল করি, আমি একটু আগে ভুলে হলেও দেবদূতদের মিষ্টি সুগন্ধটা পেয়েছি। আমার মাঝে কোনো পরিবর্তন আসেনি। চোখ পিটপিট করে দেখলাম, সবার মুখে মৃদু হাসি। আমি উঠে বসতে গিয়ে পড়ে গেলাম। মনে হয়, আমার পিঠের নিচে দুইদিক থেকে দুটো হাত আমাকে ধরে ফেলেছে।
একটি সুরেলা মিষ্টি কণ্ঠ নিচুস্বরে বলল, “উঠবে না প্লিজ। তুমি অনেক দুর্বল।”
“কী হয়েছিল ধ্রুব?” আমার গলার স্বর ভাঙা কেন?
আমার পাশ থেকে সাবিলা বলল, “নাউ ইউ আর ফাইন।”
আমি হয়তো ভুল শুনছি। দূরে আসিয়াকে দেখতে পাচ্ছি। সে হেসে বলল, “আমি এটার জন্যই অতৃপ্ত রয়ে গেছি। যখনই তোর উপর বিপদ আসবে, আমি সাথে সাথে চলে আসব। আমার শরীর দাফন করার কারণে আমি বাকি আত্মাদের ন্যায় বেশিক্ষণ থাকতে পারছি না। সরি। বাই।” সে উধাও হয়ে গেল।
“আসিয়া!”
সাবিলা বলল, “চিন্তা করো না। সে মুক্তি পায়নি। সে আসতে পারে।”
“সাবিলা, আমার শরীর এতো উত্তপ্ত কেন?”
এবার আদিলের আওয়াজ শুনলাম। “হয়তো তোমার কাছ থেকে খারাপ আত্মাটির প্রভাব পরিপূর্ণভাবে কেটে যাচ্ছে।”
আমার মনে হচ্ছে না। আমি যেন কোনো আগুনের কয়লা। সাবিলারা পাশে বসেও হয়তো উত্তাপটা অনুভব করছে। ইঁদুর-হাতি দৌড়ার আওয়াজ প্রবলভাবে আমার পেট থেকে বেরুল। আমি ঠোঁট কামড়ালাম।
“কয়দিন খাইনি?”
“তিনদিন।”
অতঃপর আমার সামনে দুই ধরনের খাবার রাখা হলো। এক বড় বাটিতে অনেকগুলো ঝাল পাকুরা আর ঝাল ডিম ভাজা। আমার আগের চারজনের খাবার। আরেকদিকে এক মাঝারি সাইজের বাটিতে পায়েস, একজনেরই সমতুল্য। আমি বড় বাটির দিকেই ঝুঁকে পড়লাম। সবাই অহেতুক উদ্বিগ্ন হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আমি জানি, আমি এখনও ঠিক হইনি। ঠিক হওয়াটা একটি স্বপ্ন, যা কখনও পূরণ হওয়ার কল্পনাও করিনি।
একটি পাকুরা মুখে দেওয়ার পর আমি হাসলাম। বলেছি না সবই আগের মতো আছে? কিন্তু পরক্ষণে… আহ্, কি ঝাল! চোখে পানি এসে গেল। আমি পাশে থাকা ধ্রুবের ঘাড় কামড়ে ধরি। একত্রে কয়েকটি গলার হাসির আওয়াজ শুনতে পেলাম। একই সময়ই আমাকে দুইজোড়া ডানা বাতাস করতে শুরু করল।
(চলবে…)
লেখা: ফারিয়া কাউছার

এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।

গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা

◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।

আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share