“তিমির”পর্ব ১২
“আমাদের একজনের বাইরে গিয়ে ওই গ্লাসটা নেওয়া উচিত।”
আবিরের কথায় সাথে সাথে ধ্রুব বলল, “আমি যাচ্ছি।”
সে ফ্ল্যাশলাইট জ্বালানোর কিছুক্ষণ পর আঁধারে মিলিয়ে গেল। আমি আবারও আবিরের সুগন্ধটা পাচ্ছি। হয়তো আমার মাথা ঝিমঝিম করতে শুরু করেছে। আমার রাগটা উবলে উঠবে, এমন সময় ভাগ্যিস আলো দেখতে পেলাম। এই আলো আমার উদ্বিগ্নতা বাড়িয়ে দিয়েছে। ওপারে ধ্রুবকে দেখে স্বস্তি পেলাম। যাক, কেসটার কোনো একটা গতি হয়েছে। আমরা দু’জন গ্যারেজে নেমে এলাম।
আবির বলল, “এই একটা গোপন পথই কেসটার সবধরনের ক্লু লুকিয়ে রেখেছে। আরেকটু আগে জানলে। বাই দ্যা ওয়ে, আলিয়া, একটু মজিদকে ডেকে আনতে পারবে?”
আমি মজিদ ভাইকে ডেকে আনলাম। তিনি এলে আবির বলল, “গ্যারেজ সাধারণত কতক্ষণ খোলা থাকে?”
“এটার চাবি আমার আছে। যখনই কারো প্রয়োজন হয়, তখন খুলে দিই।”
“তাহলে তুমি পার্টির রাতে অস্বাভাবিক কিছু দেখনি কেন?”
“আমি তো সেদিন খুলে রেখেছিলাম। গাড়ির আসা-যাওয়া চলতে থাকবে ভেবে সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত খুলে রেখেছি।”
“ওহহো, তুমি কি শিওর এখানে কেবল আসগর সাহেব আর তার বোনের গাড়িই ছিল?”
! হ্যাঁ। গ্যারেজটা শুধু ওই দুটো গাড়িই রাখার মতো। বাকি গাড়ি বাইরে উঠানে পার্ক করানো ছিল।”
“আর… আসগর সাহেবের বোনের গাড়িটা কোন সাইডে ছিল?”
মজিদ ভাই সাইডটা মনে করতে পারল না।
আবির চিন্তিত ভঙিতে আপন মনেই যেন বলতে লাগল, “আমার মনে হচ্ছে, সে রাতে আসিয়া ঘরে এসে কান্না করছিল। ওই ঘরে কেউ একজন আগে থেকেই লুকিয়ে রয়েছিল। এমন সময় সে তার খুন করেছে। এরপর আসিয়ার লাশকে বস্তায় ঢুকিয়ে টেনে-হিঁচড়ে এই পথের শেষের অংশে আনা হয়। যেহেতু ফ্লোরে রক্ত দেখেছি, সেহেতু বস্তা টেনেই আনা হয়েছে। পথটাও একই সময়ে কেবল একজনের হাঁটার যোগ্য হওয়ায় আমার মনে হচ্ছে, খুন একজনই করে তাকে এখানে এনেছে। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। এখানে গ্যারেজে হয়তো কেউ একজন ছিল, যে কিনা গ্লাসটা সরিয়ে দেওয়ার অপেক্ষা করছিল। এরপর দুই খুনি কিংবা তার বেশি খুনি লাশকে গাড়িতে বসিয়ে জঙ্গলের দিকে নিয়ে যায়।”
“কিন্তু,” আমি বললাম, “আসিয়ার ঘরের দরজা খোলা পাওয়া যায়, বাবার কথায় জেনেছি। যদি এখানেই শেষ হয়, তবে ওর লক করে রাখা ঘরের দরজা বাহির থেকে কীভাবে খোলা পাওয়া যায়? আর ওই ড্রেসিং টেবিলটা পথটার ভেতর থেকে সরানো যায় না। ওটা ভারী ছিল।”
“তাইতো। হয়তো খুনিদের একজন পুনরায় এই পথ দিয়ে গিয়ে ড্রেসিং টেবিল জায়গায় এনে পথটা ঢেকে দিয়েছিল। আর…”
“আর ওটা কোনো ছেলেরই কারসাজি।” হঠাৎ ধ্রুব বলল, “কারণ আলিয়া ড্রেসিং টেবিল সরাতে পারছিল না।”
“হ্যাঁ, আমার ভীষণ বল প্রয়োগ করতে হয়েছিল। আর আমি বলতে চাইছিলাম, এরপর ওই ব্যক্তিই দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে মেহমানদের সাথে মিশে গিয়েছে বা বেরিয়ে পড়েছে।”
“আপনি বুঝাতে চাইছেন, এখানে থাকা দুটো গাড়ির মালিকের যেকোনো একজনই খুনটা করেছে?”
“এক্সেক্টলি! নইলে লাশটা কোনো বোকাই এটুকু পথ গোপনভাবে এনে বাকিটা কাউকে দেখিয়ে নিয়ে যাবে। তবে এমনটা সরাসরি বলছি না, গাড়ির মালিকগুলোই দোষী। এমনও হতে পারে, গাড়ি তাদের। খুনি অন্য কেউ। আমরা বরং আবারও এই পথ দিয়ে যাই। আর কোনো ক্লু পেলে…”
আবির ওখানে ঢুকতে লাগল। আমি আর ধ্রুবও তাকে অনুসরণ করছি। কয়েক মিনিটেই আমরা পথের শুরুতে পৌঁছলাম। সারাপথ আর কিছুই পাওয়া যায়নি। কিন্তু আবির ভাঙা গ্লাসগুলোর ওপর ঝুঁকে পড়ল। সবুজ রঙের গ্লাসগুলো ভেজাও দেখাচ্ছে। আবির একটা টুকরোর ঘ্রাণ নিয়ে নাক কুঁচকাল, “মদ।” ওহ্, কী?
“মদের বোতল এখানে কেন আসবে? আসিয়া কখনওই ড্রিংকস করেনি!”
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।
গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা
◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।
আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share
আবিরের চোখ তৎক্ষণাৎ উজ্জ্বল দেখাল, “তোমার আপন-আত্মীয় যারা আছে, তাদের মধ্যে মদ কে খায় তা জানো?”
“না।” নিশ্চয় বাবা খান না। তাকেই আমি আপাতত জানি।
“আমারও কিছু মনে পড়ছে না। তবে এটুকু জানি, কেউ একজন আছে, যে মদ খায়। কেসটার কোনো গতি না দেখায়, আমি সবগুলো ইনফরমেশন ডকুমেন্ট করে রেখেছি। বাসায় গেলে হয়তো জেনে ফেলতে পারব।”
বাসার কথা বলায় বললাম, “সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। সাবিলা কিন্তু…”
“ওহহো। এই, তুমি কি মুখেই এতক্ষণ শ্বাস নিচ্ছিলে?”
“হ্যাঁ। ওসব বাদ দাও। আমি তোমার সাথে যাব।”
তাদের সুগন্ধটা.. আমি এবার নাক দিয়ে শ্বাস নিতে লাগলাম। ওহ্! আবার না। যেই আমি ঘ্রাণটা নিলাম, আমার দম ঘুটে আসার উপক্রম হলো। মাথা ঝিমঝিম করছে। ধ্রুব আমাকে ধরে ফেলল। ওর পবিত্র শরীরটাকে আমার ধাক্কা দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু আমার চেতনা কাজ করছে না। কেউ একজন হয়তো আমায় কোলে নিয়েছে। আমি নিজের বিরুদ্ধে লড়ে গেলাম। বহুকষ্টে বললাম, “আবির, আমি অনেকদিন সাবিলার কাছে যাইনি। আমি যাব.. তোমা..”
“প্লিজ, কথা বলো না।” হয়তো আবির বলল।
“তুমি ঠিক হয়ে গেলে আমিই তোমাকে দিয়ে আসব।” এক সুরেলা মিষ্টি কণ্ঠ কাকে যেন বলল, “ওর ব্রেন সবসময় উত্তেজিত থাকে। তাই মাঝে মাঝে ওর অস্বস্তি বোধ হয়। এটা তেমন কিছু না। আপনি যেতে পারেন।”
অতঃপর সুগন্ধ কিছুটা কমে গেছে। আমার কিছুটা স্বস্তি ফিরে এলো। বাজি ধরছি, ওরা কেবল দুইজন একটি ঘরে থাকলে সেই ঘরে আর সুগন্ধির দরকার হবে না।
“আলিয়া, তুমি কি জানো, তোমার অবস্থা খুব খারাপ? তুমি কিসের বিরুদ্ধে লড়ছ বলো তো একটু।”
তোমাদের সুগন্ধের বিরুদ্ধে। সুগন্ধটা অতিষ্ঠ লাগলে আমার রাগ উঠে। এই রাগে তোমাদের না কিছু করে বসি। এজন্য, নিজেকেই শাস্তি দেই। আর তোমাকে কথাটি বলতে পারব না। তুমি যদি এখানে আসা বন্ধ করে দাও!
“কিছুরই না। আজকাল একটু চিন্তা করলেই ঘুরপাক খাই। তুমি বলো, আবির কি তোমায় সন্দেহ করেছে? আই অ্যাম সরি। কিন্তু কেন তুমি কাউকে কিছু জানাতে চাও না? ওরা অনেক ভালো। সাবরিনা আর আদিলও।”
“আমি জানি। তবু সাবরিনা কিন্তু তাদের পরিবারের বংশধরদের মাঝে অধিক ক্ষমতাশীল। তিনি আমার মায়ের সমতুল্য না হলেও, তারা বছরের পর বছর ভালোবাসার অপেক্ষা করায় তাদেরকে পূর্বপুরুষই ধরা যায়। সর্দারের আশেপাশে ক্ষমতাধরদের মাঝে তিনি থাকেন। আর আমি পালিয়ে এসেছি বিধায়.. ”
“তুমি পালিয়ে এসেছ?”
“হ্যাঁ,” সে আমার দিকে ঘুরে বসল যেন সবকিছুই বলবে, “শোন, সাবরিনা যখন আদিলের সাথে ওই বাড়িতে সংসার পেতেছিল, তখন সে দুয়েকবার আমাদের জায়গাটা ঘুরে এসেছে। আমরা সেই ফাঁকে তার জীবনের কাহিনি শুনেছি। তোমাদের কাছে যেমন আমাদের জীবনী ইন্টারেস্টিং মনে হয়, তেমনই মানুষের জীবনী আমার খুব ইন্টারেস্টিং লেগেছে। কিন্তু আমি ছিলাম আমার বংশে মা-বাবার পর একমাত্রই ক্ষমতাধর। আমার সঙ্গী নির্ধারিত ছিল। সেও তার বংশের মধ্যে চতুর্থ ক্ষমতাধর।”
“কি! সঙ্গী? আর ইউ ম্যারিড?”
সে হাসল, “না, আমাদের আঠারো বছরের পরই মিলন মানে পৃথিবীর ভাষায় বিয়ে হয়। এর আগে সঙ্গী খুঁজে পাওয়া গেলেও কেউ এক হয় না, তবে ফ্রেন্ডের ন্যায় থাকে। আমার সূত্রী পরীকে খুব তাড়াতাড়িই খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। এজন্যই সর্দার আমাদের কালো ব্যান্ডগুলোও দিয়েছেন।”
আমি তাকে থামাই, “তোমার সঙ্গীর শক্তি কেমন?”
“ডেঞ্জারাস। একমাত্র তাদের বংশেই সবার চরিত্রে রাগ বেশি। তাদের বংশের মোট চারজন বজ্রপাতের সংস্পর্শে আসতে পারে। আমি তো ছোট ছিলাম। সেসময় সে তখনও বজ্রের সঠিক ব্যবহার করতে পারত না।”
“তারপর?” আমার কেন যেন খারাপ লাগল। ধ্রুবের.. সঙ্গী.. “ওর নাম কী?”
“আমাদের নাম থাকে না! ইউ নো, সকলেই মাইন্ড রিডার। কথা- ভাষা কিছুর প্রয়োজন নেই।”
“ওহ্, ভুলে গিয়েছি।”
“তবে ওর কাজ অনুযায়ী ওকে বিজলী বলতে পার।”
“নামটিও ডেঞ্জারাস।”
“হা হা। শোন, আমি এখানেই নয়, উপরেও সবসময় সোজা, ইমোশনলেস থাকতাম। ওকে ফ্রেন্ড হিসেবেও আমার ভালো লাগত না।” আহ্, শান্তি!! “তবে ও আমাকে সবসময় ঠিক করার চেষ্টা করত। তার অহেতুক রাগ আমার ভালো লাগত না। আচ্ছা যাক।
আমি তখন নয়-দশ বছরের ছিলাম। সাবরিনার কাহিনিগুলো শুনে আমার পৃথিবীতে আসার ইচ্ছে জাগে। আমার মা এসব বুঝতে পেরেছেন। তিনি আমাকে অন্যান্য ভাই-বোনের ন্যায় অনেক ভালোবাসতেন। সেসময়ই সাবরিনা নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল।
এটা ঠিক না হলেও মা আমায় পৃথিবীতে নিয়ে এলেন। আমরা দুজনই হাতকে ব্যবহার করে মানুষের জ্ঞান রপ্ত করি। মা অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমাকে রেখে চলে গিয়েছেন। আমাকে তখন আমার বর্তমান মা পেলেন। ওদের একটা ছেলে জিসান থাকার সত্ত্বেও আমার রূপ দেখে আমাকে ওরা পালতে শুরু করেছে। আমি কিন্তু আমাদের সব সংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এখানে থাকতে শুরু করেছি। কিন্তু জানতাম না, ঠিক এই নির্জন জায়গায়ই একসময় সাবরিনা থাকার জন্য সিলেক্ট করেছিল। আমি দশ বছর বয়সী হয়েও এখানের সতেরো বছর বয়সী ছেলেদের সমতুল্য জ্ঞান রাখতাম।
সত্যিই, এখানের সবকিছু আমার খুব ভালো লাগে। আমি বাজি ধরতে পারি, আমাদের জায়গা থেকে এই জায়গাই বেশি সুন্দর। আর বন্ধু হিসেবে তুমিও।”
আমি হাসলাম। “তুমি মনে করো, সাবরিনা সর্দারকে তোমার ঠিকানা জানিয়ে দেবে? তিনি এমনটা নয়। তিনি ভালোবাসার অনেক দাম দেন। আর তিনিও পৃথিবীর মায়া বুঝেন। তোমাকে ধরিয়ে দেবেন না। আমি বিশ্বাস করি।”
“তুমি আমাদের মিলাতে কেন চাও বলো তো?”
“কারণ আমাকে একসময় আবির বলেছে, আসিয়ার লাশ পাওয়ার পর তারা যে তদন্ত শুরু করেছিল, সে সময় ধ্রুব নামের একটি ছেলেকে দেখে সে কিছুটা দ্বিধা করেছে। কিসের সাথে যেন তোমার মিল পেয়েছে। সে আবারও তোমাকে নিয়ে ভেবে বলল, তুমি দেখতে আদিলদের মতোই। আমাকে বলেছিল, ‘এটিই হয়তো সেই ছেলেটি, যে কিনা আট বছর আগে পরীদের জগত থেকে পালিয়েছিল।”‘
ধ্রুবের শ্বাস থেমে গেল।
“আবির তবু বিষয়টাকে নিয়ে সিরিয়াসলি কিছু ভাবেনি। হয়তো সে তোমার ব্যাপারে ভাবতে চায় না। তুমি আমার সাথে ওই বাসায় চলো। আই প্রমিজ ইউ, কিছু হবে না।”
বাইরে এসে দেখলাম, ধ্রুব একটি নতুন বাইক পেয়েছে। সে উঠার পর আমিও তাতে উঠে পড়ি। একটু পর আমরা বাড়িটায় পৌঁছে গেলাম। সে সাহস পাচ্ছে না। আমি তাকে তার হাত ধরে নিয়ে ভেতরে ঢুকি। আজ সাবরিনা আর আদিল হলঘরেই আছে। ধ্রুবকে দেখে তারা থমকে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
সাবরিনা বিস্ময়ে বলল, “এই ছেলেটি ধ্রুব। নামটা খুব সুন্দর, মিনিংফুল। ঠিক তোমার গুণের মতোই।” ওহ্, সাচ অ্যা বায়োডাটা রিডার। তিনি হয়তো এও বুঝে ফেলেছেন, ভবিষ্যতে ধ্রুব পূর্বপুরুষদের মধ্যে একজন হতো। কিন্তু পৃথিবীতে চলে এসেছে।
“দেখেছ? সাবরিনা বুঝছে তোমার তেষ্টা।”
“আসলেই,” সাবরিনা বলল, “পৃথিবী লোভনীয় একটি জায়গা। আর মানুষগুলোও। তুমি ভয় পেও না। আমি সর্দারকে কিছুই জানাব না। কারণ তুমি যে ভুলটি করে ফেলেছ, তার জন্য শাস্তি বরাদ্দই।” তিনি হাসলেন, “তুমি এই শাস্তি এখন তো মোটেও চাইতে পার না।”
শাস্তি? ধ্রুব কি আর ওখানে যেতে পারবে না? ইশ, এদের মাইন্ড যদি একবার পড়তে পারতাম! ধ্রুবকে নিচে রেখে আমি সাবিলাদের ঘরে গেলাম। সে গান গেয়ে হেলেদুলে ঘরের মধ্যে হাঁটছে। সে সবসময়ের মতোই সাদা রঙের কাপড় পরেছে। আবির অনেকগুলো ফাইল একত্র করেছে। সাবিলা আমাকে দেখে খুশিতে লাফিয়ে উঠল, “আলিয়া, তুমি আসোনি কেন আমাকে দেখতে?” বেচারি এই বাসায় আমি ছাড়া নতুন কিছু দেখতেও পায় না।
“আমি একটু অসুস্থ ছিলাম।”
সে অস্থির হয়ে উঠল। আমি মুখ দিয়ে শ্বাস নিচ্ছি, যাতে অসুস্থতা আবার শুরু না হয়ে যায়। আমি ওকে শান্ত করালাম। ও বলল, “জানো, একটু আগে ইভা এসেছিল।”
“ওহহো। আমি তাকে দেখতে পারলাম না। আকবর সাহেবের মেয়ে না?”
“হ্যাঁ।”
আমি তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললাম, “অনেক মিস করেছি তোমাকে।”
সে বড় বোনের ভাব নিয়ে আমার মাথা তার বুকের ওপর রাখল। আমি তার হৃদস্পন্দন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু তা একটু ধীর। মনে হয়, তিন সেকেন্ড পরপর কম্পিত হচ্ছে।
“একটি কথা জানা হলো না। পরীরা কেমন পোষাক পরে?”
“সত্য বলতে আমি কখনও দেখিনি। তবে মা বলেছেন, তাদের কাপড় আমাদের মতোই। কেবল ভিন্ন হলো, তারা মেঘের পোষাক পরে।”
“হুহ, ওয়াও। যদি একবার দেখতে পারতাম!”
সে হঠাৎ আবিরকে বলল, “আবির, আমি আলিয়ার মতো জিন্স পরব।” ওহ্, আমার মতো হতে চায়।
আবির বলল, “দেখবে, তোমার ভালো লাগবে না।”
“জিন্স সাদা রঙের তো আনা যায়।”
“ওকে, আনব।
আমরা সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলাম। ধ্রুব একপাশে সুন্দরভাবে দাঁড়িয়েছিল। তাকে পুরাই একটা মডেলের মতো দেখাচ্ছে। ধ্রুবের সম্বন্ধে আবির আর সাবিলাও জানতে পেল। এরপর খাবারের আয়োজন হয়। সাবিলা খেতে চাইছিল না। সে ক্ষুধার কারণে কেবল একবেলাই কোনোভাবে খায়। অতিরিক্তগুলো বমির ন্যায় বেরিয়ে আসে। আমি খাবারের সুগন্ধ নিতে গেলাম। অমনিই আমার ভেতরে জ্বালা হতে শুরু করল। মাথা ঝিমঝিম করা, কপাল ব্যথা করা, রাগ উবলে উঠা, চেতনাশক্তি কমে আসা সবই একত্রে দেখা দিলো। এখন কেবল একজন নয়। আমি চারজনের সুগন্ধ পাচ্ছি। আর পারছি না। নিজের বিরুদ্ধে লড়াই করে আমি ঘুরপাক খেলাম। বেশ কয়েকটা হাত আমাকে খপ করে ধরল। কে যেন আমায় কোলেও নিল। এই বাহুগুলো আমার চিরচেনা….
আমি যখন চোখ খুললাম, আমার পেটে মোচড় দিয়ে উঠল। এমন সময় একটা সুরেলা কণ্ঠ বলল, “ক্ষিধে পেয়েছে?”
“হ্যাঁ।”
আমি ফ্রেশ হয়ে খাবার খেয়ে নিলাম।
“কালরাত…”
‘অনেকক্ষণ ওখানে ছিলে। শেষে তোমাকে এখানে নিয়ে আসা উচিত বলে মনে করেছি। তুমি সারারাত বেহুঁশ ছিলে।” সে শেষের কথাটা মাতালের ন্যায় উচ্চারণ করল।
“এভাবে বলছ কেন?”
“তোমার দুঃখে আমিও দুঃখ পাচ্ছি। তুমি ঘুমে কেঁপেছ, কেঁদেছ।”
“তুমি সারারাত এখানে ছিলে?”
“চলে গিয়েছিলাম। বেলকনি দিয়ে আবার এসেছি।”
“তুমি ঘুমাও না?”
“ঘুমাই। কিন্তু মানুষের সাথে থাকতে থাকতে অভ্যাস কেবল ছয় ঘণ্টারই আছে। বাকিটা সময় এদিক-ওদিক ঘুরি।”
“কোথায় কোথায়?”
“জঙ্গলটা আমার অনেক প্রিয়। কিন্তু জানতাম না, এরই বামপাশটায় সাবিলারা বাস করে। শোন, তুমি একটু বেশিই হুঁশ হারাচ্ছ। তুমি বাসায়ই থাক। আবির কেস প্রায় হেন্ডেল করে ফেলেছে। কেবল খুনির কাছে পৌঁছার দেরি। আমিও তার সাথে যাব।”
“এখানে থাকার জন্যই কাল সাবিলাকে একেবারের জন্য দেখে আসতে গিয়েছিলাম।”
“একেবারের জন্য মানে?”
তুমি জানো না, আমার রাগটা অনেক কষ্টে আমি দমিয়ে রাখি। কোনো আপনের ক্ষতি আমি করতে চাই না। আর আমার মনে হচ্ছে…
আমি বেশিদিন জীবিত থাকব না।
“ধ্রুব, আমি অনেক কষ্ট পাচ্ছি। সত্য বলতে তোমাদের খুশবোটা আমি সইতে পারি না। মাথা ঝিমঝিম করে। আমার ভেতর উদ্ভট এক রাগের তৈরি হয়েছে, যা আগে ছিল না। এখন আমি সামান্য ঘৃণার রেশকেও অনেক লম্বা করে টানি। কেন এমনটা হচ্ছে জানি না।”
ইচ্ছে হচ্ছে, এখনই ধ্রুবকে বলি, প্লিজ এখান থেকে চলে যাও। আমি তোমার সুগন্ধটা সইতে পারছি না। কিন্তু আমি চাই, সে আমার পাশে থাকুক। সে আমার হাতটা ধরল। এক.. দুই.. পাঁচ.. দশ সেকেন্ড পেরুলে আমি ঝটকা মেরে হাত সরিয়ে নেই, “ধ্রুব, তোমার এই হাত আমি বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারি না।”
সে ব্যথিত হলো। “তোমার অনেক বড় একটা সমস্যা হয়েছে। তোমাকে আমি সুস্থ দেখতে চাই। আমার মনে হচ্ছে না, ডাক্তার তোমাকে সারাতে পারবে। রোগটা তোমার মনের, মস্তিষ্কের।”
“হুম।” আমার খুব ভালো লাগল। ভেবেছিলাম, সে আমাকে দূরেই ঠেলে দেবে। কিন্তু সে অনেক স্বচ্ছ! আমার মনটার তল আরও খানিকটা পড়ে গেল। “প্লিজ, আমায় একটু জড়িয়ে ধরবে?”
সে বুঝেছে আমার চাহিদাটা। সে আমাকে প্রথমবারের মতো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। তাতেও কোমলতা ছেয়ে আছে। সে মৃদু ঠান্ডা। তার শরীর অনেক হালকা। মাত্র পাঁচ সেকেন্ডই এসব অনুভব করতে পারলাম। এরপর সে নিজ দায়িত্বেই আমাকে ছেড়ে দেয়।
আমি আজ অনেক অনেক দিন পর কারো এতটা সান্নিধ্যে এসেছি। এই আলিঙ্গনে যেন আমি বন্ধুর ন্যায় বোন আসিয়া, সাবিলা, এবং কোমলমনা মা… সকলেরই ভালোবাসার স্পর্শ পেলাম। কতদিনই না এর তেষ্টা ছিল, যা এই বন্ধুটা পূরণ করে দিয়েছে। বন্ধু হিসেবেই গভীর ভালোবাসা নিয়ে আমি ওর দিকে তাকালাম। স্বস্তিতে আমি ভুলে নাকে দীর্ঘভাবে শ্বাস নিয়ে ফেললাম। অমনিই সেই সুগন্ধ… ধ্রুবকে আমি অসুর শক্তি নিয়ে ধাক্কা দেই। সে ড্রেসিং টেবিলের জিনিস সহ ফ্লোরে অনেক শব্দ করে পড়ে গেল। সে মানুষ হলে সম্ভবত ঘরের দেয়ালেই ছিটকে পড়ত। সে হালকা, তবে হয়তো মাটিতে মানুষের চেয়ে বেশি ভার দিয়ে থাকে। আমি প্রতিক্রিয়া দিয়ে উঠার আগেই বাবা দৌড়ে এলেন।
“কী হয়েছে?”
ড্রেসিং টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ধ্রুব নেই। সে হয়তো অদৃশ্য। আমি বাবাকে জবাব দিতে পারছি না। পারছি না বলতে, আমি আমার ধ্রুবকে অসুর শক্তি দিয়ে আঘাত করেছি। আমি কেবল ঠোঁট কামড়িয়ে কাঁদতে লাগলাম। বাবা পরিচিত দৃশ্য দেখে চিন্তিত ভঙ্গিতে চলে গেলেন। সুগন্ধটাও আর পেলাম না।
দুপুরের খাবারটা খেতে গেলে দেখলাম, আমার খাবার আলাদাভাবে ঝাল করে রান্না করা হয়নি। বাবা বলল, “মজিদ একটু অসুস্থ। একটু এডজাস্ট কর।”
এডজাস্ট? পানসে খাবারগুলো কি কোনো খাবার? আমি দাঁতে দাঁত কামড়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। বাবা কিছু না বুঝে কেবল পিছু পিছু আসছেন। রান্নাঘরে খুব ধীরভাবে মজিদ ভাই প্লেট ধুচ্ছেন। তিনি আমার দিকে ফিরলে অপরাধীর ন্যায় দাঁড়িয়ে পড়লেন। আমি মাত্র কয়েক সেকেন্ডে তার সামনে চলে গেলাম এবং তার গলা চেপে ধরলাম। এই শক্তির প্রভাবে মজিদ ভাই শূন্যে উঠে গেল। খেয়াল করলাম, বাবা তাকে ছাড়াতে ব্যস্ত। তারপর কী যেন ধেয়ে এলো। মজিদ ভাই আমার কাছ থেকে রক্ষা পেল। আমি এতক্ষণ যতটা সম্ভব, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছি। এখন আর না পেরে ধ্রুব আর বাবা একজনের বুকে গিয়ে পড়লাম….
আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। ধ্রুব বাবাকে বলছে, “মজিদ ভাইকে ছুটি দেওয়া উচিত। এখন থেকে আমি তার পাশে থাকার চেষ্টা করব।” নো…
আবিরকে খুনির কাছে পৌঁছতে সাহায্য করার নাম করে ধ্রুবকে আমি বিকেলে পাঠিয়ে দেই। রাতটা আমি অভুক্তই কাটিয়েছি। আসিয়াকে রাগান্বিত অবস্থায় দেখেছি, বীভৎস লোকটির উপস্থিতি অনুভব করেছি, দুঃস্বপ্ন দেখেছি এবং আমার জীবিত থাকার আশাও হারাচ্ছি। এতটা কষ্ট জীবনে আর কখনও পাইনি। আমি আর বাইরে যাব না। আর না। পৃথিবীকে আমি আর দেখব না। ব্যস! আর কয়দিনই কষ্ট পাব। ঠিক মায়ের মতোই ছটফট করে মরব। আমি চোখ উল্টাতে শুরু করলাম। স্বাভাবিক রাখতে আর ভালো লাগছে না। ধ্রুব ফোন করল। আজ সে আসবে না।
ব্রেকফাস্ট সেরে ঘরে বসে রয়েছি। এক ভদ্রলোককে বাবা নিয়ে এসেছেন। লোকটি আমার সম্বন্ধে উদ্ভট প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে লাগল। বাবা কি সাইকিয়াট্রিস্টকে এনেছেন?
(চলবে..)
লেখা: ফারিয়া কাউছার
(আমি এতো বড় বড় পর্ব লিখি। ভালো একটা কমেন্টও পাই না। হয়তো আমি এটাই ডিজার্ভ করি। আমি বলব না, কমেন্ট না করলে পর্ব দিব না। শুধু বলব, কেমন হচ্ছে, খারাপ হচ্ছে কিনা এটা অন্তত বলবেন। নিজেকে শোধরাতে পারব।)