তিনশত পয়ষট্টি পৃষ্ঠা পর্ব-০১

0
800

#তিনশত_পয়ষট্টি_পৃষ্ঠা
#লেখিকা_মুসফিরাত_জান্নাত
#পর্বসংখ্যা_০১

বিয়ের তিন বছর অতিবাহিত হলেও স্বামীর ঘর রেখে শাশুড়ির ঘরে রাত কাটাতে হয় প্রিয়তাকে।এটা নিয়ে শুরুতে তার আক্ষেপ না থাকলেও দীর্ঘদিন হলো স্বামীর সান্নিধ্য পেতে মন ছটফট করে।বিয়ের পর কোন নারীই বা স্বামী থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে চায়!অথচ তার তাই করতে হচ্ছে।সে কেবলই নিশ্চুপ হয়ে দিন গুনতে থাকে কবে তার অপেক্ষার অবসান হবে।কবে তার স্বামীকে নিজের করে পাবে।এভাবে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর আজ তার সেই অপেক্ষার অবসান হতে চলেছে।তাই কয়েকটি শাড়ি নিয়ে রান্না ঘরে শাশুড়ীর কাছে যেতো নেয় পছন্দ করে দিতে।কিন্তু যাত্রাপথে দরজার বাহির থেকে একটি কথা শুনে থমকে গেলো সে।তার শাশুড়ী বিচলিত হয়ে বলছেন,

“তায়্যেব তো বিদেশ থেকে চলে আসছে মেঝো বউ।বাড়িতেও পৌঁছে গেলো বলে।অথচ ছোট বউ মাকে ওর বলা কথাগুলো এখনো বুঝিয়ে বলতে পারলাম না।ও বাড়ি ফিরে আবার গণ্ডগোল পাকাবে না তো!”

শাশুড়ি মায়ের বিচলিত কথার জবাবে সুমি নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলে,

“ঝামেলা তো করতে পারেই আম্মা।আপনার ছোট ছেলে যে গোঁয়ার।বাড়ি ভর্তি মানুষ জনও তো মানবে না।তারচেয়ে না হয় ছোট জা কে কথা গুলো বলে দেন।”

জবাবে তিনি ইতস্তত করে বলেন,

“কিন্তু বউমাকে এসব বলি কি করে, বল তো?তুমি একটু আমার হয়ে ওকে বলে দেবে?বুঝিয়ে বলো।ও যেনো ভেঙে না পড়ে।”

দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে শাশুড়ির এমন কথা শুনে প্রিয়তার পিলে চমকে উঠলো। সন্দেহের উদ্রেগ হলো হৃদয়ে।তাকে কি জানাতে বলেছে তার স্বামী?যা বলতে তার শাশুড়ির এতো দ্বিধা!আর তা না জানালে হুট করে হট্টগোলের কথাই বা আসছে কেনো?বাই এনি চান্স কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে নি তো?সে শুনেছে বিদেশ গিয়ে ভিসা সংক্রান্ত জটিলতায় ভুগে অনেককে বিয়ে করতে হয়।তায়্যেবও এমন কিছু করেনি তো?পরে সেই মেয়ে দেশে নিয়ে ফিরেছে।প্রশ্নটা মনে আসতেই নিজস্ব পৃথিবী চুরমার হয়ে গেলো তার।মাথা ভনভন করে ঘুরতে লাগলো।দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইলো বিশ্রী ভাবে।এমন কিছু হলে সে সইবে কীভাবে?চোখ ছাপিয়ে কান্না এল তার।কিন্তু মনকে বুঝ দিলো এমন কিছু তো নাও হতে পারে।বিস্তারিত না জেনে কষ্ট পাওয়া বোকামি।সে কোনোমত নিজেকে সামলে নিয়ে কান সজাগ রেখে তাদের কথপোকথন শুনতে লাগলো।

কানে বাজলো সুমির আঁতকে ওঠা কণ্ঠের জবাব,

“না মা,আমি কিছুতেই এসব বলতে পারবো না।ছোট জা তার স্বামী আসবে বলে আজ সাত দিন হলো নিজের ঘর গোছাচ্ছে।পুরো ঘর গুছিয়ে নিজেও এখন সাজ গোছ করতে বসেছে।এই আনন্দিত মুখের উপর কি করে এসব বলবো আমি?ওই ছোট্ট মনকে ভাঙার সাধ্য আমার নেই।”

কথাটা বলে মন ভার করলো সুমি।

“যা ভাঙার তা এমনি ভাঙবে সুমি।হয়তো আগে অথবা পরে।তায়্যেব এলে তখন তো প্রিয়তা ঠিকই সব জানবে।মাঝখান থেকে এখন বললে কোনো ঝামেলা হবে না।তাই এত ইতস্তত না করে সরাসরি তাকে গিয়ে বলে দাও, তায়্যেব তার সাথে সংসার করতে চায় না।সে যেন তার নিজের সীমা মেপে চলে।পারলে বাবার বাড়ি চলে যায়।ঝামেলা শেষ।”

তরকারিতে লবন ছিটিয়ে পাশ থেকে হেয়ালি করে কথাটা বললো উপমা।সম্পর্কে প্রিয়তার বড় জা হয় সে।উপমার এমন হেয়ালী মিশ্রিত উত্তর শুনে তার দিকে কটমট করে তাকান জামেলা বানু।অভিব্যক্তিতে স্পষ্টতর ফুটে ওঠে তিনি বড় ছেলের বউয়ের কথায় সন্তুষ্ট নন।প্রতিউত্তরে তিনি বিরক্ত কণ্ঠে বলে ওঠেন,

“কী বলছো তা বুঝে বলছো তো বড় বউ?কথাটা এভাবে বলা যত সহজ বউমাকে গিয়ে বলা অত সহজ নয়।মেয়েটা কতদিন হলো স্বামী ফিরবে বলে আনন্দে আছে।ঘর দোর সাজিয়ে নিজে সাজতে বসেছে।এখন এটা শুনলে তার কি হবে সেটা ভেবেছো?”

শাশুড়ি মায়ের কথায় বিরক্ত হয় উপমা।’চ’ সদৃশ্য শব্দ উচ্চারন করে বলে,

“উফ আম্মা!যেখানে সে আর আমাদের কেউ হয়ে থাকছেই না, সেখানে তার চালচুলোর কথা ভাবার কোনো প্রয়োজন আছে বলেন?আপনার ছেলে দিয়ে ছেলের বউয়ের সাথে সম্পর্ক।আপনার ছেলেই তো তাকে মানছে না,তবে তাকে নিয়ে ভাবনা কিসের?”

জবাবে গম্ভীর কণ্ঠে জামেলা বানু বলেন,

“ভাবনার বিষয় তো আছেই উপমা।তায়্যেব যদি সত্যি প্রিয়তাকে ছেড়ে দেয়, তবে ছাই পড়বে এই বংশের ইজ্জতে।আমাদের শশুরদের এই বংশে কোনো ছেলে দুই তিন বিয়ে করে সংসার করা স্বাভাবিক ঘটনা।কিন্তু কেবল মাত্র দ্বিতীয় বিয়ে করবে বলে আগের বউও তালাক দেওয়া কোনো সহজ ঘটনা না। এই বাড়ির নিয়মে তা নেই।এই ঘরে একবার যে মেয়ে পা রাখে সে সারাজীবনের জন্য রাখে।এখন চাইলেই কি সেই নিয়ম পাল্টানো যাবে?আমরা মুরুব্বী হয়ে এসব কিভাবে মেনে নিবো বলো?”

শাশুড়ি মায়ের কথার প্রতিক্রিয়া স্বরুপ সায় মেলায় সুমি।অপরদিকে কোনো রুপ বিলম্ব না করে উপমা বলে ওঠে,

“যুগ বদলাইছে আম্মা।আগের খেই ধরে থাকলে কি চলবে বলেন?তাছাড়া এসব নিয়ম আপনারা ধরে রাখতে চাইলেও আপনার ছেলে যে তা রাখবে না তা ভালো করেই জানেন।প্রিয়তাকে ডিভোর্স দেওয়া যেমন বাড়ির লোক মানবে না, তেমনি তাকে ডিভোর্স না দিলে আমার বোন নীলিও তায়্যেবকে বিয়ে করবে না। সে সাফ বলে দিয়েছে সতীনের ঘর করা তার পক্ষে অসম্ভব ব্যাপার।তাই তায়্যেবকে প্রিয়তাকে ডিভোর্স দিতেই হবে।তাই দেরী না করে তাকে জানিয়ে দেন।দেবরজী এতদিন পর এসে ঝামেলা লাগাক তা ভালো দেখাবে না।”

দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে এসব শুনে আকাশ থেকে পড়ার জোগাড় হলো প্রিয়তার।কোথাও যেনো বা’জ পড়লো মনে হলো।তার বর তবে দেশে ফিরে তাকে ডিভোর্স দিয়ে অন্য কাওকে বিয়ে করার প্ল্যান করেছে?আর এসবকে নিরব সমর্থন করে চলেছে সবাই।সে আর সহ্য করতে পারল না।পা ফেলে এগিয়ে গেলো ঘরে।ওকে দেখে জামেলা বানু ও সুমি ভড়কে গেলো।তড়িৎ মুখ শুকনো করে ফেললেন জামেলা বানু।উপমার মাঝে কোনো হেলদোল দেখা গেলো না।বরং বিজয়ের হাসি হাসলো সে।প্রিয়তার হাতে তিনটি শাড়ি ঝুলছে।যা পছন্দ করে দেওয়ার জন্য সাথে এনেছিলো সে।শাড়িটা হাতে ধরে রেখে কাঁপা কাঁপা গলায় সে জিজ্ঞেস করলো,

“মা, আপনারা যা বললেন তা কি সত্যি?উনি সত্যি আর আমার সাথে সংসার করবেন না বলেছেন?”

প্রিয়তার প্রশ্নে অসহায় চোখে তাকান জামেলা বানু।মুখ গলিয়ে কোনো শব্দ উচ্চারণ করতে পারেন না সে।বিবেক টনটন করছে তার।মেয়েটার মনের উপর দিয়ে বইয়ে যাওয়া ঝড় যেনো নিজ চোখে দেখছেন তিনি।যার বিধ্বস্ততা তার চোখে মুখেও ফুটে উঠছে।তিনি বেশ বুঝতে পারছেন মেয়েটা সব কথা শুনেছে।কিন্তু সে যে দরজার বাহিরে ছিল এটা তিনি বুঝতে পারেননি।তীব্র অনুশোচনায় দু চোখের দৃষ্টি নামিয়ে ফেললেন তিনি।কিছু সময় নিরব থেকে প্রিয়তা সুমির দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,

“সে কি সত্যিই এই কথা বলেছে ছোট ভাবি?সে সত্যি নীলি আপুকে বিয়ে করবে জানিয়েছে?”

জবাবে মাথা নুইয়ে ফেললো সুমি।এদের নিরবতাতেই উত্তরটা লুকানো ছিলো।তবুও উপমা পাশ থেকে তার ভদ্র ভাষার আড়ালে লুকিয়ে রাখা বিষ দাঁত দেখিয়ে বললো,

“সত্যি না মিথ্যা তা না হয় নিজ চোখেই দেখো তুমি।আমার বোন নীলি আর তায়্যেব যখন একসাথে বাড়ি ঢুকবে তখনই উত্তরটা পেয়ে যাবে আশা করছি।”

কথাটা বলে কেমন করে হেসে উঠলো উপমা।তা দেখে উত্তেজিত হলো প্রিয়তা।বিয়ের পর থেকেই উপমার কটু কথা শুনে চলতে হচ্ছে তাকে।তার ছোট বোনের স্থানে প্রিয়তা এ বাড়ির বউ হওয়ার ব্যাপারটা উপমা মেনে নেয় নি কখনো।উপমার আশা ভঙ্গ হয়েছে জন্য এমন করছে ভেবে এতদিন নিরবে এসব সহ্য করে গিয়েছে সে।হয়তো একদিন সব ঠিক হবে ভেবেছিলো।কিন্তু আজ এমন অবস্থায় রাগে তার শরীর জ্বলে উঠলো।জবাবে সে বললো,

“ওহ আপনার বোন তাহলে এখনই উদ্দেশ্য হাসিলে নিজের লেজ এগিয়ে দিয়েছে তাই না?সাথে করে নিয়ে আসবে তাকে।তো বেশ আনুক!কিন্তু আমার অপরাধ টা কি সেটা না শুনে আমিও যাচ্ছি না এ বাড়ি ছেড়ে।একসময় তো নীলি আপুকে রিজেক্ট করেই তিনি আমাকে বিয়ে করলেন।এখন আবার সেই নীলি আপুর জন্যই আমাকে ছাড়বেন!কারণটা কি তার জবাব আমার জানতে হবে না?”

উত্তেজিত হয়ে কথাগুলে বলে প্রিয়তা।তার কথায় উপমা সহাস্যমুখে বলে,

“মানুষ একবার ভুল করে কাঁদায় পা ফেলেছে বলে যে সেখানেই পা ডুবিয়ে রাখবে তা তো নয় ছোট জা।বরং কাঁদা থেকে পা তুলে তাড়াতাড়ি ধুয়ে ফেলাটাই মানুষের কর্ম।তায়্যেবও তাই করছে।আমার বোনকে রিজেক্ট করে তোমাকে বিয়ে করার মতো ভুলটা সে অনেক আগেই ধরতে পেরেছে।তাই তো দেশে ফেরার আগে নিজের জীবনের ভুল শুধরে নিতে চাইছে।তুমি বরং আর অপমানিত না হয়ে এখন নিজের বাড়ি ফিরে যাও।নিজের স্বামীকে অন্যের সাথে দেখে সহ্য করতে পারবে না।”

“আপনার আর দরদ দেখানো লাগবে না।নিজের জ্ঞান আমার আছে।কি করবো না করবো তা আমার ব্যাপার।বোনকে তো লেলিয়ে দিয়েছিলেন আমার সংসার ভাঙতে।এবার শান্তি তো!”

দাঁতে দাঁত চেপে এসব বলে প্রস্থান করে প্রিয়তা।তার কথায় ক্রুদ্ধ হয় উপমা।কিন্তু জবাব দেওয়ার সুযোগ পায় না।প্রিয়তা ততক্ষনে চলে গিয়েছে।জামেলা বানু কিছু না বলে উপমার দিকে একবার কড়া চোখে তাকিয়ে দেখে প্রিয়তার পিছু যায়।ঘরে গিয়ে চুপটি করে বসে রয়েছে মেয়েটি।তাকে সাহস দিয়ে তিনি বললেন,

“তুমি একদম চিন্তা করো না প্রিয়তা।তায়্যেব আরেকটা বিয়ে করলেও এ বাড়িতে নিজের পুরো দস্তুর অধিকার পাবে তুমি।আমি এখনো মা’রা যাইনি।আর আমি থাকতে এ বাড়ির চৌকাঠ থেকে কেও উচ্ছেদ করতে পারবে না তোমাকে।”

কথাটা বলে প্রিয়তার কাধে হাত রাখলেন তিনি।জবাবে প্রিয়তা মুখ গম্ভীর করে বললো,

“আপনার ছেলে যদি সত্যি অন্য কাওকে বিয়ে করে তবে এ বাড়ি থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই আম্মা।সতীনের ঘর করার সখ আমারও নেই।তবে আমি থাকতেও অন্য নারীতে জড়ালো কেনো, আর যদি এমনটাই করবে তবে আমাকে বিয়ে করলো কেনো এই জবাব আমার চাই।আমার জীবন নিয়ে তো এত সহজে কাওকে খেলতে দিবো না আমি।জবাবদিহি করতে হবে এর জন্য।এমনকি আপনারা যদি সায় দেন আপনাদেরও পস্তাতে হবে বলে দিলাম।”

জামেলা বানু প্রিয়তাকে প্রতিউত্তরে কিছু বলতে গিয়েও দমে গেলেন। মেয়েটির শক্ত চোখ মুখের দিকে তাকিয়ে থমকে গেলেন একেবারে।এ যেন এক অচেনা নারী।এই সমাজ থেকে একদম ভিন্ন কেও।যেখানে অন্য মেয়ে হলে এমন সংবাদে কেঁদে বুক ভাসাতো, অথচ এই মেয়ে নিজের ঘর ভাঙার গান শুনেও নিরব, নিস্তব্ধ।জামেলার হটাৎ করেই মনে হলো সব যেনো পাল্টে গিয়েছে।এই দুনিয়াও বদলে গিয়েছে।আগের রীতিনীতি পোড়ার গন্ধ তার নাক ছুঁয়ে দিলো যেনো।সে কেবল ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে