#তাসের ঘর
ঐশিতা সেন
পর্বঃ ০৫+০৬
দীপকে খেলনা দিয়ে বসিয়ে দোলা শুয়ে আছে।শরীরটা খুব খারাপ লাগছে।যদিও এখন জ্বর নেই।কিন্তু জ্বর জ্বর ভাব আছে।শরীরও দুর্বল লাগছে।তখন ঝড়ের গতিতে রিপন রুমে এসে দোলাকে টেনে মাটিতে নামাল।
রিপনঃ অলক্ষ্মী তুই আমার জীবনে কেন এসেছিস?আমার লাইফটা জাস্ট হেল করে দিয়েছিস।তোর মরণ নেই?কেন চলে যাচ্ছিস না আমার জীবন থেকে?আমি তোর মুখও দেখতে চাই না।আমাকে একটু শান্তিতে বাঁচতে দিবি না?
বলে দোলাকে মারতে লাগল।অসুস্থ শরীরে আগের আঘাতের উপর আঘাত করায় দোলা ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠল।
দোলাঃ আমাকে মারছ কেন?আমি কি করেছি?প্লিজ মেরো না।আহ লাগছে।মাগো আহহ্।
রিপনঃ চুপ একটা শব্দও করবি না।
ব্যথায় দোলা চিৎকার করে কাঁদতে লাগল।
রিপনঃ চুপ করতে বলেছি না?চুপ।কোন সাউন্ড করবি না।কথা শুনবি না নাহ?
বলে দোলার গলা টিপে ধরল।দোলা রিপনের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা মরছে।কিন্তু পুরুষালি শক্ত হাতের শক্তির সাথে পারছে না।এদিকে দোলার দম বন্ধ হয়ে আসছে।ফর্সা মুখটা লাল বর্ণ ধারণ করেছে।কিন্তু রিপনের সেদিকে খেয়াল নেই।নিজের রাগ ঝাড়তে ব্যস্ত।দীপ।কাঁদতে কাঁদতে রিপনের হাত সরানোর চেষ্টা করছে।
দীপঃ সালো।মা ব্যতা পাচ্চে।সালো না।মায়ায়া।বাবা সালো।মায়ের কত্ত হচ্চে।
দীপ রিপনে ধাক্কাচ্ছে কিন্তু একটুও নড়াতে পারছে না।কলিংবেলের আওয়াজে রিপনের হুঁশ ফিরল।দোলার গলা ছেড়ে দিল।ভীত দৃষ্টিতে দোলার দিলে তাকাল।কতবড় ভুল করতে যাচ্ছিল বুঝতে পারল।যদি দোলার কিছু হয়ে যায় ও ফেঁসে যাবে।দোলার বাবা-ভাই রিপনকে ছেড়ে দেবে না।
রিপনের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে দোলা কাশতে লাগল।একটুর জন্য দম বন্ধ হয়ে যায় নি।গলায় পুরুষালি দশ আঙ্গুলের দাগ দৃশ্যমান।দীপ মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল।
আবার কলিংবেল বেজে উঠায় রিপন দরজার কাছে গেল।লেন্সের দিকে তাকিয়ে দেখে বাইরে বিল্ডিংয়ের মিসেস দত্ত,মিসেস দে,মিসেস গোপ দাঁড়িয়ে আছে।মিসেস দেব আর রাত্রী ছাড়া।রিপনের ওদের দেখে ঘাম ছুটতে লাগল।দৌড়ে দোলার রুমে গেল।দোলাকে ছেলে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
রিপনঃ এই এই মেয়ে কান্না অফ কর।উফ বলছ না ফ্যাসফ্যাস করবি না।দোলা মানা করছি কিন্তু।কান্না অফ কর।
দোলা থামল না।
রিপনঃ যদি কান্না অফ না করিস তাহলে আবার মারব।
রিপনের কথায় দোলা ভয় পেয়ে গেল।আস্তে আস্তে ফোঁপানো বন্ধ করল।ছেলেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বসে রইল।রিপন সোফায় থম মেরে বসে রইল।দরজা খুলবে কি না ভাবতে লাগল।এদিকে বাইরে থেকে রিপনের নাম ধরে ডেকে সবাই দরজা খুলতে বলল।
রিপনদের বিল্ডিং তিন তালা।নীচতালায় রাত্রীরা আর মিসেস দেবরা থাকেন।দুতালায় রিপনরা আর অজয় গোপের পরিবার থাকে।তিনতালায় পূজারা আর সীমান্ত দে এর পরিবার থাকে।
মিসেস দেঃ রিপনদা দরজা খুলুন।দরকার আছে।
ভিতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ নেই।
মিসেস গোপঃ কি হলো দরজা খুলছেন না কেন?কি করছেন এতক্ষণ ধরে।
মিসেস দত্তঃ এবার দরজা না খুললে আমরা কিন্তু দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকব।
রিপনঃ আসছি।এক মিনিট দাঁড়ান।
দোলার দিকে তাকিয়েঃ এই শুন একদম বেশি কথা বলবি না।ওরা যেন জানতে না পারে নি।ঠিক হয়ে বস।
বলে রিপন এসে দরজা খুলে দিল।দরজা খুলতেই মিসেস দত্ত,মিসেস গোপ,মিসেস দে ভিতরে ঢুকলেন।
রিপনঃ আরে আপনারা?হঠাৎ?
মিসেস দত্তঃ আপনি যা শুরু করেছেন তাতে আসতে তো হবেই।
রিপনঃ আ..আমি?আমি আবার কি করলাম।আচ্ছা আপনারা দাঁড়িয়ে কেন বসেন।
ওরা বসল।
মিসেস দেঃ দিদি কোথায়?উনাকেও ডাকুন।
রিপনঃ দো..দোলা?দোলাকে কেন?ও তো ঘুমাচ্ছে।
মিসেস গোপঃ ও তাই নাকি?একটু আগেই মারলেন আর আমরা আসতে আসতে উনি ঘুমিয়েও পড়লেন?
মিসেস দত্তঃ আপনি কি শুরু করেছেন বলবেন?এভাবে দোলাদিকে কেন মারেন?উনি আপনার স্ত্রী আর আপনি?ছিঃ
রিপনঃ হ্যাঁ ও আমার স্ত্রী আমার যা ইচ্ছা তাই করব আপনাদের কি?
ততক্ষনে দোলা দীপকে নিয়ে ওখানে চলে আসে।ওর শরীরের মারের দাগ স্পষ্ট।মিসেস দত্ত দোলাকে সোফায় বসালেন।
মিসেস দেঃ আপনার স্ত্রী বলে আপনি যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন মি.রিপন।
মিসেস গোপ দীপকে কোলে নিলেন।
মিসেস গোপঃ দীপ তোমার বাবা তোমার মাকে মেরেছে?
দীপঃ হ্যাঁ মেলেছে।বাবা পঁচা মাকে মালে।এভাবে এভাবে মেরেছে(হাত দিয়ে মার দেখিয়ে),বেল্ত দিয়ে মেলেছে,গলা তিপে মেলেছে।
দীপের কথা শুনে সবাই দোলার দিকে তাকাল।ওর গলা লাল হয়ে আছে।দাগ পড়ে গেছে।
মিসেস দত্তঃ এসব কি মি.রিপন।আপনি বাচ্চটার সামনে ওর মাকে জানোয়ারের মতো মারেন?একটুও লজ্জা করে না?
মিসেস দেঃ আপনার সমস্যাটা কোথায়?প্রতিদিন এই অশান্তি কেন করেন?আজ বলেই দিন।দোলাদিকে নিয়ে কি সমস্যা।কেন উনার গায়ে হাত তুলেন।আপনি পরিবেশটা নষ্ট করছেন মি.রিপন।
মিসেস দত্তঃ তা নয় তো কি?বউয়ের গায়ে হাত তুলা আইনত অপরাধ জানেন না?আপনি আইন লঙ্ঘন করছেন।তাছাড়া আপনার জন্য আমাদের বাচ্চারা ভুল শিক্ষা নিচ্ছে।আপনার নিজের বাচ্চার সাথে সাথে আমাদের বাচ্চাদের মনে খারাপ প্রভাব বিস্তার করছেন।ওদের একটা অসুস্থ পরিবেশ উপহার দিচ্ছেন।
মিসেস গোপঃ একজন শিক্ষিত ব্যক্তি হয়ে অশিক্ষিতের মতো কাজ করতে লজ্জা করে না?আপনি তো উচ্চশিক্ষিত,বিসিএস ক্যাডার।এই আপনার শিক্ষা?নিজের পুরুষত্ব জাহির করতে বউ পিটান?
রিপনঃ তো কি করব?চলে যাচ্ছে না কেন ও?কত বার বলেছি চলে যেতে তাও কেন নির্লজ্জের মতো পড়ে আছে।সহ্য হয় না ওকে আমার।প্রতিদিন চোখের সামনে দেখতে রাজি না।ওকে আমার পছন্দ না।ওর মুখও দেখতে চাই না।ওকে বলুন চলে যেতে।আমাকে মুক্তি দিতে।
মিসেস দত্তঃ কেন যাবেন?উনি কি ফেলনা?যদি ভালো নাই লাগে তাহলে বিয়েটা কেন করেছিলেন?কেউ কি দোলাদিকে আপনার ঘাড়ে ঝুলিয়ে দিয়েছে?নাহ দেয় নি।বিয়ের প্রস্তাব আপনি পাঠিয়েছিলেন।তাহলে এখন কেন এই ব্যবহার?
রিপনঃ আমি কিচ্ছু না জানি।কিচ্ছু এক্সপ্লেইন করতে চাই না।আমি ডিবোর্স চাই।আর কিছুদিন পরেই আমাদের ডিবোর্স।
মিসেস গোপঃ বাহ সুন্দর কথা বললেন।একবারও নিজের ছেলের কথা ভেবেছেন?আপনাদের ডিবোর্স হলে ওর কি হবে?
রিপনঃ কেন ও ওর মায়ের কাছে থাকবে।
মিসেস দেঃ আপনার কোনো দায়ভার নেই?আপনি জানেন এই সমাজে ডিবোর্সীদের হাল কি হয়?আপনি জানেন পিতৃহীন একটা সন্তানের ভবিষ্যতে কতটা অন্ধকার?তাও বলছেন ডিবোর্স দিতে চান।ওকে ডিবোর্সের কারন?ওটা তো বলুন।
রিপনঃ আপনাদের বলতে বাধ্য নই।
মিসেস দত্তঃ এটা তো ভাবেন এরপর দোলা আর দীপের কি হবে?
রিপনঃ ওকে আমি দোলাকে তাড়িয়ে দেব না।ও সারাজীবন আমার বাসায় থাকতে পারবে কাজের লোক হিসেবে।এইবাড়িতে কাজ করবে থাকবে খাবে।আমি দীপের পড়ালেখার দায়িত্ব নিতেও রাজি।শুধু আমাকে আমার মতো চলতে দিতে হবে।
মিসেস দত্তঃ সহজ কথায় বলতে চাইছেন দোলাকে সতীনের ঘর করতে হবে?সতীনের দাসী হয়ে থাকতে হবে?
রিপনঃ না সতীনের ঘর করতে কেন?ওকে তো আমি বউ বলে মানি না।ও আমার বউ না।ও যদি আমার বউই না হয় সতীন আসবে কোথা থেকে?
দোলাঃ অনেক হয়েছে রিপন।অনেক বলেছ।আমি তোমার অগ্নিসাক্ষী করে বিয়ে করা বউ।তুমি বলছ আমি তোমার বউ না?তাহলে আমি কে?ডিবোর্স চাই না তোমার?পেয়ে যাবে।তোমার সাথে সংসার করা আমার পক্ষেও আর সম্ভব না।অনেক সহ্য করেছি।তোমার মতো স্বামীর আমার প্রয়োজন নেই।তুমি একটা অমানুষ।যেকোনো সময় আমাকে মেরে ফেলতেও তোমার হাত কাঁপবে না।যে তুমি নিজের সন্তানকেও মানতে চাও না সেই তোমাকে আমিও স্বামী হিসেবে মানতে চাই না।তোমাকে স্বামী মানতে ঘৃণা করে।সে ব্যক্তি ঘরে বউ-বাচ্চা রেখে..(বড় করে শ্বাস ফেলল)
রাগে শরীর কাঁপছে।
দোলাঃ আমি শুধু সংসারটা বাঁচাতে সব সহ্য করেছি কিন্তু আর না।তুমি আমাকে তোমার রক্ষিতার দাসি বানাতে চাও?থেক তুমি তোমার রক্ষিতা নিয়ে।তোমার সাথে আমিও আর সংসার করব না।
রিপনঃ দোলায়ায়ায়া।তোর সাহস..
মিসেস দত্তঃ গলা নামিয়ে।আপনার সাহস তো কম না আমাদের সবার সামনে উনাকে ধমকি দেন।
রিপনঃ আপনারাও কি শুনেন নি ওর কথা?কি বলছে ও?ওর সাথে সংসার করব?যে আমাকে স্বামী হিসেবে সম্মান করতে পারে না?একটুও শ্রদ্ধাবোধ আছে ওর আমার প্রতি?
মিসেস দেঃ যে স্বামী বউকে এভাবে মারতে পারে,নিজের বউকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে পারে না,দিনের পর দিন দুর্ব্যবহার করে,স্ত্রী হিসেবে মানে না তাকে শ্রদ্ধা করা তো দূর লাথি মেরে পা নষ্ট করার ভুলটাও করা উচিত না।
মিসেস দে এর জবাব রিপনের গায়ে কাঁটার মতো বিঁধল।
রিপনঃ আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন।
মিসেস দত্তঃ মান অপমান বোধ আপনার আছে?
রিপন তো রাগে ফুঁসতে আছে।
মিসেস দত্তঃ সে যাই হোক দোলাদিকে এখানে রেখে যাওয়ার ভুল করব না।অনেক সহ্য করেছেন উনি।আর না।আপনার বাসায় আর একমুহূর্তও না।এখানে থাকলে আপনি উনাকে কখন জানি মেরেই ফেলবেন।যদি মন থেকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে ফিরিয়ে আনতে পারেন তাহলেই উনি এখানে আবার আসবেন।নইলে না।দোলাদি আর দীপ আপনার সাথে থাকবে না।
চলুন দিদি।
দোলাও সায় জানিয়ে উঠে দাঁড়াল।ওর মনে এক প্রকার ভীতি জেগেছে।রিপনের ওকে মেরে ফেলতেও হাত কাঁপবে না।
মিসেস দত্তঃ তবে হ্যাঁ একটা কথা বলতেই হয় আপনি আসল সোনা রেখে নকল হীরা বেছেছেন দাম তো আপনাকেই দিতে হবে।
উনারা দোলা আর দীপকে নিয়ে রিপনের বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেন।দোলার চলে যাওয়াতে রিপন খুশিই হলো।ঝটপট রাত্রীকে কল দিল।
🍁
বাইরে মিসেস গোপ দোলাকে যা বললেন তাতে সবাই অবাক।
(চলবে)