তাসের ঘর পর্ব-০৩+০৪

0
640

#তাসের ঘর
ঐশিতা সেন
পর্বঃ ০৩+০৪

হেলমেট খোলার সাথে সাথে রিপনের হাস্যজ্বল মুখটা দৃশ্যমান হলো।রিপন রাত্রীকে বাইকে উঠতে বলে বাইক স্টার্ট করল।
রিপনঃ আরে রাগছ কেন?ইচ্ছে করে দেরি করেছি নাকি?দোলাকে উত্তমমধ্যম দিতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল।
রাত্রীঃ আজ আবার মেরেছ?
রিপনঃ হ্যাঁ মারব না তো কি করব?একটা কাজও ঠিক মতো করেনা।ওকে কি এমনিতে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াচ্ছি?আজ তরকারিতে লবণ কম হয়েছে তাই দিয়েছি গালে একটা বসিয়ে।তারপর ও মুখে মুখে তর্ক করতে শুরু করে দিল।যতবড় মুখ না তত বড় বড় কথা বলে তাই দিয়েছিও সেইভাবে।
রাত্রীঃ আমি কিন্তু রান্নাবান্না কিছুই তেমন পারি না।রান্না ঠিক করে না হলে আমাকেও দিবে নাকি চড়থাপ্পড়?(ভ্রূ কোঁচকে)অনিক কিন্তু আমাকে রাঁধতে দেয় না।ও নিজেই রাঁধে।
রিপনঃ উফ মাঝখানে ওই অনিককে টানছ কেন?তুমি আর দোলা এক নাকি?দোলা এসেছে কাজের লোক হয় আর তুমি যাবে রাজরানি হয়ে।তোমাকে আমি মাথায় তুলে রাখব।কোনোকাজ করতে দেবোই না।একবার শুধু ওই দোলাকে বিধায় হতে দাও।
রাত্রীঃ হুম আপদটা যত তাড়াতাড়ি বিধায় হবে ততো আমাদের মঙ্গল।আচ্ছা আজ তুমি ওকে মারলে কিন্তু শব্দ শুনা গেল না কেন?
রিপনঃ মুখ বেঁধে মেরেছি আওয়াজ করছিল বলে।
রাত্রীঃ বেশ করেছ।সবসময় খালি আমাদের কাজে ব্যাঘ্রা দেয়।অসহ্য একটা।একটুও লজ্জাও করে না।তুমি বারবার ওকে চলে যেতে বলো কিন্তু ও যাওয়ার নামই নেয় না।ঘাঁটি গেড়েই বসেছে।
রিপনঃ চিন্তা কর না খুব শীঘ্রই ডিবোর্স দেব।আর মাত্র কিছুদিন।তারপর শুধু তুমি আর আমি।(মুচকি হেসে)
রাত্রীর হেসে রিপনের কাঁধে মাথা রাখল।
দুজনে একটা পার্কে চলে গেল।
রিপনঃ আজ ছুটি নিয়েছি।সারাদিন একসাথে কাটাব।
রাত্রীঃ সারাদিন?কিন্তু অত্রি?
রিপনঃ উমম।অত্রির স্কুল যতক্ষণ ততক্ষণ নাহয় থাকি।
রাত্রীঃ হুম সেটাই হবে।
এটা আজ প্রথম না।প্রতিদিনই রাত্রী অত্রিকে স্কুলে দেওয়ার নাম করে রিপনের সাথে ঘুরে বেড়ায়।রিপন অফিস টাইম থেকে ২ঘণ্টা আগে বাড়ি থেকে বের হয়।তারপর রাত্রীর সাথে ঘুরে ফিরে অফিস যায়।মাঝে মাঝে ছুটি নিয়েও ঘুরে।কিন্তু নিজের বউকে ১মিনিটও টাইম দেয় না।
🍁
সকালের রান্নাবান্না সেরে,স্বামী-পুত্রদের খাইয়ে দোলার মা মিসেস দেব দোলাদের বাসায় এলেন।হাসিমুখে ঘরে ঢুকলেও মেঝেতে রক্তাক্ত মেয়েকে দেখে হাসিমুখ বিলীন হয়ে গেল।বড্ড আদরের মেয়ে দোলা তাদের।মা-বাবার একমাত্র মেয়ে হিসেবে যেমন আদুরে দুইভাইয়ের একমাত্র বোন হিসেবেও তেমন আদুরে।এটাই বোধহয় মেয়েদের কপাল বাপের বাড়িতে যেখানে রাজকন্যা স্বামীর বাড়িতে সেখানে রাজরানীর জায়গায় চাকরানির মতো থাকতে হয়।
মিসেস দেব তাড়াতাড়ি মেয়ের কাছে ছুটে গেলেন।
মিসেস দেবঃ দোলা মা কি হয়েছে তোর?দাদুভাই তোমার মায়ের কি হয়েছে?
দোলার গায়ে হাত দিয়ে বুঝতে পারলেন জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।
দীপঃ দিদা বাবা মালে?মাকে মেলেছে?বাবা পুঁচা।
মিসেস দেব আর কিছু না বলে দোলাকে কোনোরকমে তুলে বিছানায় শুয়ালেন।জল এনে গা মুছিয়ে দিলেন।কাপড় পালটে দিয়ে ক্ষতস্থানে ঔষধ লাগিয়ে কপালে জল পটি দিলেন কিছুক্ষণ।ফাঁকে ফাঁকে ঘরটা গুছিয়ে দীপকেও খাইয়ে দিলেন।যদিও দীপ খেতে নারাজ।দোলার একটু একটু জ্ঞান ফিরলে দোলাকেও তুলে খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে দিলেন।কিছুবাদে দোলার জ্বরটা ছাড়ল।মিসেস দেব আবার গাটা মুছিয়ে দিলেন।দোলাকে ঘুম পাড়িয়ে দীপকে পাশে বসিয়ে রান্নাঘরে গেলেন।মায়ের আদর পেয়ে দোলাও অনেক দিন বাদে শান্তিতে ঘুমাল।মিসেস দেব রান্নাবান্নার কাজ সেরে আবার দোলার কাছে এলেন।
দুপুর ১ঃ৩০টায় দোলার ঘুম ভাঙ্গল।
মিসেস দেবঃ আজ কেন মেরেছে?
দোলা সবটা মাকে বলল।
মিসেস দেবঃ সহ্য কর মা আরেকটু সহ্য কর।আমাদের হাতে যে কিছু নেই।যদি কিছু করতে যাই রিপন যে তোকে ডিবোর্স দেবে।তখন কি হবে ভেবে দেখেছি।বাচ্চা ছেলেটাকে নিয়ে কি করবি?ভেবেছিলাম একটা বাচ্চা কাচ্চা হলে ছেলেটা শুধরে যাবে।কিন্তু না এমন একটা ফুটফুটে ছেলে থাকা সত্ত্বেও..সব কপালের দোষ।কোন কুক্ষণে যে এমন ছেলের সাথে তোর বিয়ে ঠিক করেছিলাম।
দোলা মাকে জড়িয়েঃ মা আমি আর এখানে থাকব না মা।ওই লোকটা আমাকে মেরে ফেলবে(কাঁদতে কাঁদতে)
মিসেস দেবঃ কাঁদে মা।একটু ধৈর্য ধর।একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।
দোলাঃ সব ঠিক হতে হতে না আমিই না থাকি।
মিসেস দেবঃ দোলায়া।এমন কথা বলিস না।ভগবানে বিশ্বাস থাক।একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।
মিসেস দেব দোলাকে ফ্রেশ হতে বলে খাবার নিয়ে এলেন।দোলাকে খাইয়ে রিপনের জন্য খাবার বেড়েঃ দোলা আমি দীপের বাবার জন্য খাবার বেড়ে দিয়েছি ও আসলে দিয়ে দিস।আমি এখন বাসায় যাই।ওর বাবা আর ভাইরা এলো বলে।
দোলাঃ ঠিক আছে।সাবধানে যেও আর আমার জন্য চিন্তা করো না আমি ঠিক আছি।
🍁
রাত্রী অত্রিকে নিয়ে বাসায় ফিরে দরজা খুললে অত্রি লাফাতে লাফাতে রুমে গেল।রাত্রী জুতো ঠিক করে ঢুকতে যাবে তখন পাশের ফ্ল্যাটের মিসেস ধরের কথা শুনে পিছু ফিরল।
মিসেস ধরঃ কোথায় গেছিলে?
(মিসেস ধর রাত্রীর থেকে অনেক বড় তাই তুমি করেই ডাকেন)
রাত্রীঃ এইত্তো অত্রিকে স্কুল থেকে নিয়ে আসলাম দিদি।
মিসেস ধরঃ তা রিপনের সাথে পার্কে কি করছিলে?
রাত্রী ধরা খাওয়ার মতো মিসেস ধরের দিকে তাকাল।
রাত্রীঃ রিইরিপনের স..সাথে?কই?
মিসেস ধরঃ মিথ্যে বলে লাভ নেই।সবাই সব জানে।তোমার লজ্জা করে না তোমার নিজের সংসার থাকতে অন্যের সংসার ভাঙ্গতে?কত সুন্দর সংসার তোমার।অনিক তোমাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে।মেয়েকে নিয়ে তো ভালোই আছো।তাহলে দোলার সংসার ভাঙ্গছ কেন?নির্লজ্জ মেয়েমানুষ তুমি না তো সংসার করার যোগ্য না তো কারো ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য।অনিক আসলে আমি ওকে সব বলব।তুমি যে রিপনের কাঁধে মাথা রেখে ঢং করছিলে সব ছবি আছে আমার কাছে।প্রমাণ সহ দেখাব।
রাত্রী কিছুটা ঘাবড়ে গেল।পরক্ষণে নিজেকে সামলেঃ ঠিক আছেন বলে দিয়েন।কি হবে?এমনিতেই দোলাকে ডিবোর্স দিয়ে রিপন আমাকে বিয়ে করবে।অনিকের সাপোর্ট দিয়ে কি করব?
আচ্ছা দাদা তো সবসময় বাসায় থাকেন না,ধরেন আপনি যখন বাইরে গেলেন তখন হিয়াকে(মিসেস ধরের মেয়ে) একটা ছেলে সমেত ঘরে পাওয়া গেল তাহলে কি হবে?কিংবা কলেজ থেকে ফিরার সময় হিয়াকে যদি কেউ কিডন্যাপ করে রেপ করে কিংবা আপনাদের অনুপস্থিতিতে বাসায় এসে রেপ করে তখন?মেয়ে বিয়ে দিতে পারবেন তো?আশেপাশের লোক যখন ছিঃ ছিঃ করবে তখন?মান-সম্মান থাকবে তো?
মিসেস ধর দমে গেলেন।একটাই মাত্র মেয়ে উনার।ওর কোনো ক্ষতি হলে কি করবেন।
রাত্রীঃ পার্কের কোনো খবর যদি অনিকের কান পর্যন্ত পৌঁছে তাহলে হিয়া..
বলে শয়তানি হাসল।
🍁
বিকালে মিস্টার দত্তের মা আর মেয়ে ছাদে বসে আছেন।তখন নাচতে নাচতে অত্রি ছাদে এলো।মিস্টার দত্তের মেয়ে পুজাকে দেখে ওর কাছে দৌড়ে গেল।
অত্রিঃ দিদি আমার সাথে খেলবে?
পূজাঃ আমি তোমার সাথে কি খেলব?আমি তো কত্তো বড় আর তুমি কত্তো ছোট?
অত্রিঃ বড় হয়ে গেছ বলে কি খেলতে পারবে না?
পূজাঃ তা পারব।এবার বল কি খেলবে?
অত্রিঃ উমমম্(একটু ভেবে)লুকোচুরি।
পূজাঃ ঠিক আছে।তুমি লুকাও আমি খোঁজব।
অত্রিঃ আচ্ছা।তুমি দিদার কাছে গিয়ে দাঁড়াও আমি ১০গুনার পর খুঁজবে।
পূজাঃ আচ্ছা।
পূজা আর ঠাকুমার কাছে চলে গেল।
পূজার ঠাম্মাঃ উফ এই মেয়ের সাথে বেশি মিশিস না তো।দূরে দূরে থাকবি।
পূজাঃ কেন?
পূজার ঠাম্মাঃ কেন আবার এই মেয়ের ভালো না।
পূজাঃ অত্রি আবার তোমার কোন পাকা ধানে মই দিল?
পূজার ঠাম্মাঃ অত্রি দেয় নি ওর মা দিয়েছে।খারাপ মেয়েমানুষ কোথাকার।নিজের সংসার রেখে অন্যের সংসার ভাঙ্গতে যায়।(রাগে গজগজ করতে করতে)
পূজাঃ এতে অত্রির দোষ কোথায়?ও কি করেছে?
পূজার ঠাম্মাঃ করে নি কিন্তু দেখিস বড় হয়ে ঠিক অন্য কারো সংসার ভাঙ্গবে।যেমন মা তেমনই তো মেয়েও হবে।বদ মেয়েমানুষ।
পূজাঃ তুমি সব জেনে বসে আছো?অত্রির মা করেছে অত্রিও কি তাই করবে নাকি?তাহলে তো বলতে হয় দীপের সাথেও মিশা উচিত না।দীপের বাবা যা করছে দীপও তা করবে।
পূজার ঠাম্মাঃ উফ তুই বুঝতে পারছিস না।দীপ আর অত্রি কি এক হলো নাকি?দীপ দোলার আদর্শে বড় হয়েছে রিপনের না।
পূজাঃ আর অত্রিও অনিক আংকেলের আদর্শে বড় হচ্ছে রাত্রী আন্টির না।
পূজার ঠাম্মাঃ ওই অনিকই বা কোন ধোঁয়া তুলসী পাতা।অন্ধের মতো বউকে বিশ্বাস করে।আমার তো মনে হয় ওর ও কোনো বাইরে চক্কর চলছে।
পূজাঃ উফ ঠাম্মি তুমি একটু বেশিই সন্দেহ করো।
পূজার ঠাম্মাঃ কি বেশি সন্দেহ করি হুম?আমি সবসময় ঠিক সন্দেহই করি।তোদের মতো চোখ কান বন্ধ রেখে চলি না।রিপন আর রাত্রীর মাখামাখি দেখে আমারই তো প্রথমে সন্দেহ হয়েছিল।তখন তোরা আমার কথআ পাত্তা দিস নি।দেখলি তো আমার কথাই মিলল।আর অনিক কেমন ধরণের মানুষ।নিজের বউয়ের উপর একটুও কর্তৃত্ব নেই?বউ যেমন বলে ও তেমন চলে।পুরো বিল্ডিংয়ের মানুষ জানে রিপন আর রাত্রীর ব্যপারে।আর ওই অনিক নিজের বউয়ের পরক্রিয়ার কথা জানে না।কেমন ব্যাটাছেলেরে বাবা!ঢং(মুখ বাকিয়ে)
পূজাঃ উফ থাম।অত্রি শুনতে পাবে।ও এখনো বাচ্চা।এসবের খারাপ প্রভাব ওর উপর পড়বে।
পূজার ঠাম্মাঃ এই একদম জ্ঞান দিবি না।
অত্রিঃ দিদি কোথায় তুমি?আমাকে খুঁজে বের করো।
পূজাঃ হ্যাঁ আসছি।
বলে পূজা অত্রিকে খুঁজতে লাগল।
🍁
রাতে রাত্রী আর রিপন সবার দেখা করল।অনিক এখনো বাড়ি ফিরে নি তাই রাত্রী আসতে পেরেছে।
রাত্রীঃ উফ এভাবে আর কতদিন?আমার একটুও ভালো লাগছে না।জানো আজ কি হয়েছে?
রিপনঃ কি?
রাত্রী মিসেস ধরের কথা সব বলল।
রিপনঃ ভালো করেছে।হিয়ার নামে ভয় দেখালে উনি কিছু করতে পারবেন না।
রাত্রীঃ কিন্তু এভাবে কাকে কাকে কতদিন আটকাবে?পুরো বিল্ডিং ওই দোলার দলে।সবাই উত পেতে থাকে কীভাবে আমাদের ধরবে।এখনো কোনো প্রমাণ পায় নি তাই চুপ আছে।যেদিন পাবে ছাড়বে না।সব ওই দোলার ষড়যন্ত্র।কাটার মতো গলায় আটকে আছে।না এপারে যাচ্ছে মা ওপারে।লাইফটা হেল করে দিল।
রিপনঃ (রেগে)ঠিক বলেছ।ওই দোলার জন্য সব হচ্ছে।ও না থাকলে কবেই তোমাকে নিজের করতাম।আজ ওর আর রক্ষে নেই।এমন শাস্তি দেব জীবনেও ভুলবে না।
বলে হনহনিয়ে বাসার দিকে রওয়ানা হলো।পিছন থেকে রাত্রী শয়তানি হাসল।
(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে