তবু ভালো আছি পর্ব-০৮ এবং শেষ পর্ব

0
661

#তবু_ভালো_আছি
#রাজেশ্বরী_দাস_রাজী
#অন্তিম_পর্ব

নিজের খেলার ঘরে মাদুরের ওপর অভিমানে মুখ ফুলিয়ে বসে আছে শ্রেয়া, মৃন্ময় সেই তখন থেকেই তার রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করছে কিন্তু কাজ হচ্ছেনা বিশেষ। শ্রেয়া তার দিকে ভালোভাবে তাকাতেও নারাজ। ছোট্ট শ্রেয়ার অভিমানী সেই চোখ থেকে মাঝে মাঝেই টুপটাপ করে ঝড়ে পড়ছে জল, মৃন্ময় পরম স্নেহে রাগ ভাঙাতে ভাঙাতে সেগুলো মুছে দিচ্ছে, সে মৃন্ময়কে বাঁধা দিচ্ছে না কিন্তু তার দিকে তাকাচ্ছেও না। যদিও শ্রেয়ার অভিমানের কারণটা নিছকই ছোট নয়। মূল কারণটা হচ্ছে মৃন্ময়ের দূরে ট্রান্সফার, আগামীকাল সকালেই এই শহর ছেড়ে পাড়ি দেবে মৃন্ময়। উপরন্তু বাকিরা জেনেছে প্রায় সপ্তাহ খানিক আগে কিন্তু আগে থেকেই সাহস যুগিয়ে শ্রেয়াকে বলে উঠতে পারেনি কেউই, এমনকি মৃন্ময়ও না। যখন থেকে মৃন্ময়ের ট্রান্সফারের খবরটা শ্রেয়া শুনেছে তখন থেকেই শিশু হৃদয় প্রচন্ড ভারাক্রান্ত হয়ে রয়েছে তার।

মৃন্ময় ঘর থেকে বাইরে আসতেই রুশার মুখোমুখি হলো সে। রুশা তাকে দেখতেই প্রশ্ন করলো,

“কীরে পারলি বোঝাতে? মান ভাঙলো একটু তার?”

মৃন্ময় বিরস মুখে উত্তর দিলো,

“একটু কমেছে রাগ, বোধ হয় আপাতত অল্প অল্প বুঝেছে।”

রুশা মৃদু মাথা দোলালো, সামান্য ভেবে বলল,

“মৃন্ময় একটা কথা বলি? সকালে তো তুই চলেই যাবি তার আগে একবার শ্রুতির সাথে কথা বলে নিয়ে দেখ না রে তোদের নিয়ে।”

মৃন্ময় রুশার কথার মানে প্রথমে বুঝতে না পেরে বিস্মিত কণ্ঠে বলল,

“মানে? কীসের কথা বলছিস?”

“আই মিন আমি জানি অতীতে কী কী হয়েছে বাট সেগুলো ঘটেছে অনেক বছর আগে। এতদিনে কতকিছু বদলে গেছে। সবকিছু ভুলে তো সেকেন্ড চান্স দিয়ে নতুনভাবে আবার জীবনটা শুরুও করা যায়। আমি জানি না আমি ঠিক বলছি নাকি ভুল কিন্তু তুই একবার কথা তো বলে দেখতেই পারিস। এখনই সুযোগ, এরপর তো তুই দূরে থাকবি, আরোই সুযোগ পাবি না তেমনভাবে কথা বলার। আর শ্রুতি যদি না চাই তবে তাই হবে, কিন্তু কথা তো বল একবার নিজেদের নিয়ে।”

শ্রুতি রান্নাঘর থেকে নিজের শোবার ঘরের দিকেই যাচ্ছিল সেইসময়, ফলস্বরূপ তাদের কথাটা শুনতে পেলো সে। মৃন্ময় রুশার কথার পরিবর্তে কিছু বলতে যাচ্ছিল তখন, তবে সামনে শ্রুতিকে হুট করে দেখে খানিকটা থতমত খেয়ে উঠলো তারা দুজনেই। শ্রুতিও যেন খানিক অস্বস্তিতেই পড়লো, শ্রুতি তাদের মুখের দিকে একবার চেয়ে পাশ কাটিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো। রুশা চিন্তিত মুখে মৃন্ময়ের দিকে তাকালে সে বলল,

“আমি ওর সাথে একটু কথা বলে আসছি।”

রুশা সম্মতি জানালে মৃন্ময় এগিয়ে গিয়ে দরজার মৃদু টোকা দিয়ে “আসছি।” বলেই ভেতরে এলো। শ্রুতি উল্টোদিকে মুখ করে ছিল তখন, মৃন্ময় মৃদু শ্বাস টেনে সাধারণভাবেই বলল,

“শ্রুতি কালকে তো সকালে চলে যেতে হবে আমাকে, আপাতত তেমন দেখা বা কথা হয়তো হবে না, আসলে আমি বলতে চেয়েছিলাম…”

তার কথার মাঝেই শ্রুতি নিজের উৎকণ্ঠা কাটিয়ে উঠে তার দিকে ঘুরে বলল,

“মৃন্ময় আমার কথাটা শোনো, আমার দ্বারা আবার নতুন করে কিছু শুরু করা সম্ভব নয়।”

হুট করে শ্রুতির মুখে এমন কথা শুনে মৃন্ময় সামান্য অবাক হয়েই স্থির চোখে তাকালো তার দিকে। শ্রুতি আবারো বলল,

“দেখো মৃন্ময়, আগে কোনো এককালে আমাদের মধ্যে যা ছিল তা ছিল, কিন্তু তারপরে সব ভুলে এই বিগত বছরগুলোতে আমরা আবারো ভালো বন্ধু হয়ে উঠতে পেরেছি। দূরে রইলেও আমি এই বন্ধুত্বের সম্পর্কটাকে নষ্ট করতে চাইনা। তোমার সাথে শ্রেয়ার সুন্দর একটা সম্পর্ক আছে, সেটাও নষ্ট হোক আমি চাইনা, আমি জানি তুমিও চাওয়া। তাই বলছি বেশী আর কিছু আমার থেকে আশা কোরো না। আমি নতুন করে তোমার ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছি ঠিকই, কিন্তু সেই প্রাক্তন থেকে প্রেমিকা আর হয়ে ওঠার সাধ্য আমার সত্যিই নেই। তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ মৃন্ময়, তবে এমন কিছুর অনুরোধ তুমি আমাকে কোরো না। কারণ এমন কিছু ঘটলে আমি নিজের চোখেই নিজে ছোট হয়ে থাকবো। এমনটা হলে এইযে ভালো থাকার লড়াই, যেটার জন্য এতকিছু, মুহুর্তেই সেই লড়াইতে হেরে যাবো আমি নিজের কাছেই। প্লীজ আমাকে হারিয়ে দিও না।”

নিজেকে স্বাভাবিক করে তুলতে সামান্য সময় লাগলো মৃন্ময়ের, নিজেকে সামলে নিয়েই সে স্বাভাবিক নরম কণ্ঠে বলল,

“তোমাকে হারতে আমি দেবো না। চিন্তা নেই, এমন কোনো প্রস্তাবও আমি তোমায় দেবো না। আমি জানি তোমার পক্ষে এমন কিছু সম্ভবও নয়। বর্তমানে আমাদের মাঝে যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক আছে, সেটা আমার কাছেও বড্ড দামী। এর থেকে বেশী আমি কিছু আশা কখনোই করিনি।”

“আরো কিছু কথা বলবো, শুনবে? এখনো সময় আছে, নিজের জীবনটা নিজের মতো গুছিয়ে ফেলো। আঙ্কেল আন্টিরও তো একটা স্বপ্ন আছে তোমায় নিয়ে। তাছাড়া তুমি কেন নিজের জীবনটা এভাবে নষ্ট করছো? আমি আগেও তোমায় বলেছি, এখন আবারো বলছি তুমি অযথা আমার জন্য নিজের জীবন এভাবে নষ্ট কোরো না। নাহলে আমার নিজেকেও বড্ড অপরাধী মনে হবে সবসময়। মনে হবে আমার জন্যই তোমার জীবনটা নষ্ট হয়ে গেলো। আমি সেটা চাই না। আমি সত্যিই চাই তুমি ভালো থাকো। তুমি বিয়ে করো মৃন্ময়।”

শ্রুতির কথায় মৃন্ময় হেসে বলল,

“বিয়ে করলেই যে সবসময় মানুষ ভালো থাকে সেটা তুমি পার্সোনালি বিশ্বাস করো?”

মৃন্ময়ের কথায় শ্রুতি দ্বিধায় পড়লো, সামান্য ভেবে না-সূচক মাথা নাড়ালো।

“বিয়ে, সংসার এইসবের থেকেও মানুষের কাছে আসলে জরুরি কী? সত্যিই করে ভেবে বলো তো।”

মৃন্ময়ের প্রশ্নে শ্রুতি সামান্য সংকোচ নিয়েই বলল,

“ভালো থাকা, কিন্তু…”

মৃন্ময় আবারো বলল,

“ঠিক ভালো থাকা। আমি বিয়ে করিনি কারণ আমার মনে হয়নি। তুমি এটা কখনোই ভেবো না যে তোমার জন্য আমার জীবনটা নষ্ট হয়েছে বা হবে। আমার জীবনের যে সুন্দর স্মৃতিগুলো রয়েছে, তাদের কিছুর কৃতিত্ব কিন্তু তোমার আর পরবর্তীকালে শ্রেয়ার। আমি যে এতদিন তোমাদের পাশে ছিলাম সেটাও আমার নিজের কথা ভেবে, নিজের জন্য, নিজের মনের শান্তির জন্য। আর যদি পরবর্তীকালে আমার মনে হয় যে কারোর সাথে আমি সত্যিই ভালো থাকবো, তবে আমি অবশ্যই বিয়ে করবো।”

“কথা দাও।”

মৃন্ময় মৃদু হেসে বলল,

“কথা দিলাম। আর আমি তখন তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম যে আমাদের তেমন দেখা হবে না, নিজেদের খেয়াল রেখো। শ্রেয়া বাচ্চা মানুষ, প্রথম প্রথম আমায় আগের মতো দেখতে পাবেনা বলে একটু কষ্ট পাচ্ছে। তবে ও বুদ্ধিমতী, ঠিকই বুঝতে পারবে, ওকে একটু বোঝানোর চেষ্টা কোরো।”

শ্রুতি ওপর-নীচে মৃদু মাথা নাড়ালো। রুশা একটু আগেই ঘরের দিকে আসছিল, তাদের কথা ভালোই শুনতে পেলো সে। মৃন্ময় নিজের কথাটুকু বলে বাইরে আসতে গেলেই আবারো একবার রুশার মুখোমুখি হলো সে, মৃন্ময় তার দিকে একবার চেয়ে চলে আসতে গেলে রুশা বলল,

“সত্যিই চলে যাবি মৃন্ময়? সবকিছু থেকে দূরে সরিয়ে নিজেকেও কষ্ট দিচ্ছিস কেন তুই বলতো? এটা কি খুব জরুরি? নিজের একটা ভুলের জন্য এভাবে সারাজীবন কষ্ট পেয়ে যাবি?”

শ্রুতি তাকালো তাদের দিকে, মৃন্ময় থেমে মৃদু স্বরে বলল,

“হ্যাঁ জরুরি, সকলের ভালো থাকার জন্য, আমার নিজের ভালো থাকার জন্য। আর ভুলের কথা বললি তো!”

মৃন্ময় সরে এসে রুশার সামনে এসে দাঁড়ালো, ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে বলল সে,

“তখন তোকে উত্তরটা দিতে পারিনি, এখন বলি? কিছু কিছু ভুলের সেকেন্ড চান্স হয়না, সেই ভুলগুলোর মাশুল আমাদের দিতেই হয়। কারণ যেটাই হয়ে থাকুক না কেন একটা ভুল তো আমি করেইছি আর সেই ভুলের মাশুল আমাকে আমার এই পুরোটা জীবন দিয়ে যেতেই হতো। কিন্তু এখন আমি অনেকটাই বোঝামুক্ত। অন্তত এটা ভেবে শান্তি পাবো যে যার কাছে আমি অপরাধী হয়ে ছিলাম সে আমাকে ক্ষমা তো করেছে। তবে হ্যাঁ আবারো যদি কখনো মানুষ হয়ে জন্ম নিই, পরের জন্মে সুযোগ পেলে নিজের এই ভুল শুধরে সব ভয়কে অতিক্রম করে হলেও নিজের ভালোবাসাকে নিজের করে নেওয়ার সাহস যেন ঈশ্বর আমাকে দেন এই প্রার্থনা করি। আর বাকি এই জন্মে যাকে ভালোবেসেছিলাম তাকে না হয় নাই বা পেলাম কাছে, দূরেই রইলাম। সবসময় কি মানুষ সবকিছু পাই?”

রুশা করুণ চোখে চেয়ে রইলো। তাদের দুজনকেই কিছু বলার ক্ষমতা তার এখন নেই। দুজনেই তো যে যার জায়গা থেকে ঠিক। মৃন্ময় “ভালো থেকো” বলে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে শ্রুতির দিকে চেয়েই যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। সদর দরজার কাছে আসতেই শ্রেয়া তার কাছে ছুটে এসে বলল,

“তুমি আমাকে ভুলে যাবে না তো ভালো আঙ্কেল?”

মৃন্ময় তার গালে আলতো হাত ছুঁইয়ে বলল,

“কখনো ভুলবো না।”

“প্রমিজ?”

“প্রমিজ। মায়ের কাছে যাও প্রিন্সেস। মায়ের খেয়াল রেখো।”

শ্রেয়া বাধ্য মেয়ের মতো মাথা দুলিয়ে মায়ের কাছে চলে গেলো। মৃন্ময় ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এসে একবার পিছু ঘুরে ওপরের দিকে শ্রুতির ঘরের জানালার দিকে তাকালো একবার, শ্রুতি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে তার যাওয়ার পথের দিকেই চেয়ে ছিল। মৃন্ময় গভীর একটা শ্বাস টানলো, সামনে ঘুরে হাঁটা ধরলো সে।

.
.

“সেকি মিস তারমানে সেই ছেলে মেয়ে দুজন আলাদা হয়ে গেলো?”

ছাত্রীর কণ্ঠে বর্তমানে ফিরলো শ্রুতি। এতক্ষণ ক্লাস টুয়েলভের ছাত্র-ছাত্রীদের গল্প শোনাচ্ছিল শ্রুতি। আজ তারা বায়না ধরেছিল ক্লাস করবে না কিছুতেই, বরঙ না হয় অন্যকিছু করা যাক আজকের ক্লাসে। শ্রুতি তাদের জোরাজুরির বশে পড়েই তাদের ছাড় দিয়েছিল আজ, তারপর তারা গল্প শোনাতে বললে কী ভেবে যেন নাম বাদ দিয়ে যতটুকু বলা উচিত ততটুকু নিজেই গল্প করে বলা শুরু করেছিল সে।

“তারমানে তারা একে-অপরের থেকে দূরে চলে গেলো। ইশ! তবে তো তাদের ভালো থাকাই হলো না মিস।”

ছাত্রের কথায় শ্রুতি নড়ে-চড়ে বসে উত্তর দিল,

“দূরে চলে গেলো ঠিক, তবে ভালো থাকা হলো না কে বলেছে?”

সকলে কৌতূহল নিয়ে তাকালো। তাদের দেখে মনে হচ্ছে হাজারো প্রশ্ন যেন ঘোরাফেরা করছে এইসকল কিশোর-কিশোরীর মনে এইসময়, যার উত্তর কেবল আছে শ্রুতির কাছে। একজন ছাত্রী প্রশ্ন করলো,

“তারপরে তারমানে তারা সত্যি ভালো আছে? তারপর কী হলো বলুন না মিস।”

শ্রুতি সামান্য হেসে বলল,

“তারপর? হ্যাঁ, তারপর তারা ভালো আছে। একে অপরের থেকে দূরে আছে তবু ভালো আছে। আসলে জানো তো, মাঝে মাঝে বোধ হয় অন্যদের অথবা নিজের ভালোর জন্য হলেও আমাদের কিছু জিনিস অথবা কিছু মানুষদের থেকে দূরে সরে আসতে হয়! সে সেটা একটা সময় আমাদের কাছে যতটাই প্রিয় হয়ে থাকুক না কেন। এবং কিছুসময় এটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়ায় আমাদের জন্য।”

.
.

স্কুল শেষে স্কুলের বাইরে এসে দাঁড়াতেই শ্রেয়া হুট করে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো শ্রুতিকে। রোজ স্কুলশেষে একসাথেই বাড়ি ফেরে মা-মেয়ে। শ্রেয়া বর্তমানে এক কিশোরী, শ্রুতির স্কুলেরই ক্লাস এইটের ছাত্রী সে। শ্রুতি চোখ-মুখ কুঁচকে শ্রেয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“উফ বাবা তোকে নিয়ে আমি আর পারবো না! কী যে করিস তুই সবসময়। আর এই! তুই এখন আবার আইসক্রিম খাচ্ছিস?”

শ্রেয়া হেসে আইসক্রিমে কামড় বসিয়ে বলল,

“আরে আমার সুইট মা, তুমি বকলেও আমার তোমাকে এত মিষ্টি লাগে কেন বলো তো? আর মাঝে মাঝে আইসক্রিম খেলে কিছু হয়না। তুমি খাবে?”

শ্রেয়া আইসক্রিমটা সামনে বাড়িয়ে দিলো। শ্রেয়া অত্যন্ত প্রাণোচ্ছল একটি মেয়ে, অনেকটা তেমনই যেমন শ্রুতি তার স্কুলজীবনে ছিল। শ্রেয়ার ওপর রাগ করে থাকার সাধ্য আদৌ কারোর আছে বলে শ্রুতির মনে হয়না। শ্রুতিও পারলো না। শ্রুতি মেয়ের কথায় হেসে ফেলে শ্রেয়ার গালে হালকা চা*পড় মে*রে বলল,

“না! বেয়াদব মেয়ে একটা!”

শ্রেয়া শ্রুতিকে হাসতে দেখে বলল,

“দ্যাটস লাইক মাই সুইট মা। তুমি হাসলে তোমায় ফুলের থেকেও সুন্দর লাগে তুমি জানো?”

শ্রুতি মেয়ের কথা দুদিকে সামান্য মাথা নেড়ে হাসলো আরো একদফা। শ্রুতি আর শ্রেয়া ধীরে-সুস্থে বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরলো। প্রতিদিনের ন্যায়ই হাঁটতে হাঁটতে নিজের কথার ঝুলি খুলে বসলো শ্রেয়া তার মায়ের কাছে, কথায় কথায় শ্রেয়া বলল,

“জানো কালকে ভালো আঙ্কেল আর ভালো আন্টির সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলার সময় ভালো আঙ্কেলদের যে কুকুরটা আছে না বোজো, ওকে দেখলাম। কতো কিউট হয়েছে জানো ও?”

শ্রুতি মৃদু হেসে বলল,

“তাই?”

সে তাদের প্রসঙ্গে আরো কিছু কথা তুলল। বলে রাখা ভালো শ্রুতিকে মৃন্ময় যাওয়ার সময় যে কথা দিয়েছিল সেটা সে রেখেছিল। ট্রান্সফার নিয়ে চলে যাওয়ার প্রায় দুইবছরের মাথায় মৃন্ময় বিয়ে করেছিল। তার স্ত্রীর নাম মিতালী। মিতালীর বয়স প্রায় শ্রুতির সমান। মৃন্ময় বিয়ের আগেই তাকে নিজের অতীতের সকল কথা খুলে বলেছিল। মিতালী অত্যন্ত বুদ্ধিমতী একজন মেয়ে। সে মৃন্ময়কে ঠিকই বুঝেছিল। এবং সবকিছু মেনে নিয়েই মৃন্ময়ের পাশে থাকতে চেয়েছিল সে। মৃন্ময় যে শ্রেয়াকে ভালোবাসে সেটাও সে জানে, শ্রেয়াকে মিতালী নিজেও যে ভালোবাসে না সেটা নয়। তারা দূরে থাকলেও তাই মাঝে মাঝেই ফোনে কথা হয় তাদের শ্রেয়ার সাথে। মিতালীকেই ভালো আন্টি বলে ডাকে শ্রেয়া। সবশেষে এটুকু বলা চলে মিতালীর সাথে মৃন্ময় ভালো আছে, তারা একসাথে সুখে আছে। ব্যপারটা শ্রুতিকেও মনে মনে শান্তি দেয়। সে তো এমন কিছুই চেয়েছিল যে তারা সকলে নিজেরা নিজেদের মতোভাবে ভালো থাকুক। কারোর খারাপ চেয়ে নিজে ভালো থাকতে তো সে চায়নি কখনো।

কিছুক্ষণ আগেই বৃষ্টি হয়েছে, রাস্তা এখনো ভেজা রয়েছে। বর্ষার মৃদু শীতল হাওয়া গায়ে এসে লাগলো শ্রুতির। হাঁটার মাঝেই আকাশের দিকে একবার চোখ তুলে চাইলো সে। শ্রুতি চোখ বন্ধ করে একবার জোরে শ্বাস টানলো, মনটা বেশ হালকা অনুভব করলো সে, মন-মস্তিষ্কে বিচলন করছে তার শান্তি শান্তি একটা ভাব। সে সুখে আছে, তার আর তার সন্তানের ভালো থাকার লড়াইয়ে একপ্রকার বিজয়ী হয়েছে সে, তারা সত্যিই এখন ভালো আছে। ভাবতেই মনের শান্তি ভাবটা বেড়ে উঠলো তার। অতীতের সবকিছু ফেলে অনেক আগে এগিয়ে এসেছে সে। অতীতে যা যা হয়েছে সেগুলো নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিছু বর্তমানে নেই তার মনে। তবে এইসবের থেকেও সবচেয়ে বড় জিত তার কাছে এটাই যে কেউ প্রশ্ন করলে এখন আর মিথ্যে বলতে হয়না তাকে যে “তবু ভালো আছি।” এখন মন থেকে বলতে পারে সে যে তারা ভালো আছে। নিজেদের মতোভাবেই ভালো আছে। সত্যিই খুব ভালো আছে তারা। নিজের ভাবনায় এক চিলতে হাসি ফুটলো শ্রুতির ঠোঁটের কোণে। শ্রুতিকে অন্যমনস্ক দেখে শ্রেয়া তার হাত ধরে বলল,

“মা, কী ভাবছো আবার তুমি?”

শ্রুতি চট করে তাকালো তার দিকে, মৃদু হেসে বলল,

“কিছু না, তারপর বল কী হলো?”

শ্রেয়া আবারো নিজের কথার ঝুলি খুলল, শ্রুতি হাসিমুখে সব শুনতে শুনতে এগিয়ে গেলো সামনের দিকে।

~~~সমাপ্ত~~~

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে