তবুও মনে রেখো পর্ব-০৬

0
136

#তবুও_মনে_রেখো।[০৬]

১৬,
রাহনাফরা দেশে ফিরেছে সপ্তাহখানেক হলো। খাইরুল মামুন এখন মোটামুটি সুস্থ। বড় সাহেব ঠিক করেছেন তার এবং রুপার বিয়ে দিবেন। তাই তিনি সকলকে গ্রামে ডেকেছেন। সবাই এখন গ্রামে উপস্থিত আগামীকাল তাদের বিয়ে। বিয়েটা যেহেতু ঘরোয়া ভাবেই সম্পন্ন হবে তাই কাউকে দাওয়াত করা হয়নি। ঘরের লোক রুপার পরিবার আর শহর থেকে এসেছে রাহনাফ আলীহান ও রাহি। মৌ আর সৈয়দা মাহবুবা মিলে রবিনের বাড়িতে যান।রবিনের শরীরটাও ঠিক যাচ্ছে না আজকাল। আগের মত বলবান সে নেই, শরীর শুকিয়ে গেছে মুখে অরুচি ধরেছে খাবার খেতে পারে না সে। জন্মদাতা পিতার এমন অবস্থা দেখে কষ্টে বুক ফেটে যাই মৌয়ের। কান্না লুকাতে শাড়ির আঁচলে মুখ চেপে ধরে মৌ। সৈয়দা মাহবুবা মৌকে সামলে বাড়ি নিয়ে আসেন আর রবিনকে বলেন এবার সে যেন ঠিক একটা ডক্টর দেখিয়ে নেয়।

উঠোনে গল্পের আসর জমিয়েছে মেহেররা। খাওয়া-দাওয়ার জন্য আছে পেঁয়াজ কাচা মরিচ দিয়ে মুড়ি মাখানো সিঙ্গারা ও কোকাকোলা। রাহি কোকাকোলার গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললো,

“এমন বিয়ে বাড়ি আমি আগে কোথাও দেখিনি ইয়ার। বিয়ে বাড়ি না যেন কোন মৃত্যুপুরীতে আছি সবাই শোক দিবস পালন করছে।”

মৌ বলল,
“গ্রামে বেশিরভাগ বাড়িতে এমন করেই বিয়ে হয়। আসলে শহরে বাবুদের মত গ্রামের মানুষের অত টাকা-পয়সা নেই তো তাই তারা ঘরোয়া ভাবেই বিয়ে দিতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। যদিও গ্রামে এখন নগরের সভ্যতা এসে গেছে মানুষ আগের মত নেই সবাই এখন হাসি আনন্দ হইচই এই সবই পছন্দ করে। তবুও মামা আর খালার তো বয়স হয়েছে তাই নানাজান চাচ্ছে না যে তাদের বিয়েতে এত হইহুল্লোর করতে। নানাজান আমাদের গ্রামের একজন সম্মানিত ব্যক্তি আর একটা কিছু হলেই গ্রামবাসিরা তাকে নিয়ে সমালোচনা করে। নানাজান চাচ্ছেন না এই মুহূর্তে কোন সমালোচনার মুখে পড়তে।”

আলীহান তার আদেক খাওয়া সিঙ্গারাটা মুখে পুরে নিল। আড় চোখে মৌয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মামা আর আন্টির জন্য বাসর ঘরটা সাজাবো তো নাকি সেটাও হবে না সমালোচনার ভয়ে।”
” এখানে আবার সমালোচনা আসলো কোথা থেকে?” প্রশ্ন করলো মেহের।
আলিহান হাসিমুখে জবাব দিলো,
” না মানে তোমাদের গ্রামের মানুষ বলতেই পারে বুড়ো বয়সে বিয়ে করছে এতে আবার বাসরঘর সাজাতে হবে কেন?”
” এটা তুমি একদম ঠিক বলছো ভাইয়া।”
মেহের অনেকক্ষণ যাবৎ লক্ষ্য করছে রাহনাফ মুড়ি মাখানো খাচ্ছে আর কিছু ভেবে চলেছে। তারা সবাই মিলে এত কথা বলছে আর রাহনাফ কিছুই বলছে না। কৌতুহলী দৃষ্টিতে রাহনাফের দিকে তাকালো মেহের রাহনাফ তখনো ভাবনায় বিভোর। মেহের প্রশ্ন করল
“রাহনাফ আপনি কিছু বলছেন না যে?”
রাহনাফ মুখে মুড়ি পুড়ে বলল,
“এটা বেস্ট ছিল।”
“কোনটা? “প্রশ্ন করল মেহের।
“এই যে মুড়ি মাখানোটা।” হাতটা সামনে বাড়িয়ে বলল রাহনাফ।
কিছুক্ষণ পর তাদের গল্পের আসরে যুক্ত হল রেদওয়ান। রেদওয়ানকে দেখে রাহি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। প্রথম দর্শনে যেকোনো ব্যক্তি রেদওয়ানের দিকে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য হয়। আসলে তার পরনে জামাকাপড়ই সবাইকে আকর্ষিত করে তাকিয়ে থাকতে। রেদওয়ানের পরনে ইয়োলো কালারের ট্রাউজার ও টি শার্ট। গলায় লম্বা একটা মালা সাথে গিটারের লকেট লাগানো। মাথায় কোঁকড়ানো চুল এক কানে দুল। রাহি কেবলার মত তাকিয়ে আছে রেদওয়ানের দিকে। রেদওয়ান মাথার চুলকে হেসে বলল,
“সরি আমি মনে হয় লেট করে ফেললাম।”
আলীহান হেসে বলল,
” না না শালাবাবু ঠিক আছে। খুব বেশী লেট হয়নি।”
মৌ বলল,
“কোথায় ছিলি এতক্ষণ?”
” চাচ্চুকে নিয়ে ডক্টরের কাছে গিয়েছিলাম।”
রাহি সবার দিকে এক নজর তাকালো। তারপর মৌকে জিগ্যেস করলো,
” এই জন্ডিসটা তোমার কে হয় ভাবি?”
রাহির প্রশ্ন শুনে সকলে কৌতূহলী হয়ে তাকালো তার দিকে। রেদওয়ান কপাল কুঁচকে বলল,
” জন্ডিস মানে? কে জন্ডিস?”
রাহি মুখ বাকিয়ে বলল,
“জন্ডিস মানে বুঝেন না। এইচবিএসএজি চিনেন? নাক সিটকিয়ে বলল, গেটআপ দেখে তো জন্ডিস ছাড়া অন্যকিছু মনে হচ্ছে না।”
রেদওয়ান মুখ গোজ করে বসে রইলো। সবাই মিলে অনেকটা সময় কাটিয়ে বাড়ির ভিতরে চলে যায়। মেহের আর মৌ সৈয়দা মাহবুবার সাথে হাত মিলিয়ে কাজ করে। আলিহান রাহি রেদওয়ান গ্রাম দেখতে যায় আর রাহনাফ যায় খাইরুল মামুনের ঘরে। খাইরুল মামুন বিছানায় গম্ভীর হয়ে বসে কিছু ভাবছেন। বিছানার একপাশে খবরেরকাগজ তার উপর খাইরুল মামুনের চসমা। রাহনাফের বুঝতে অসুবিধা হলোনা তিনি খবরেরকাগজ পড়েই কিছু ভাবতে বসেছেন। দরজার সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে রাহনাফ বলল,
” স্যার, আপনি কি ব্যাস্ত?”
খাইরুল মামুন রাহনাফকে দেখে হাসার চেষ্টা করে বললে,
” রাহনাফ যে, এসো এসো।”
ভিতরে ঢুকে বিছানায় এক পাশে খাইরুল মামুনের বরাবর বসে রাহনাফ। বলে,
” আপনার অসম্পন্ন কাজটাকে নিয়ে ভাবছেন।”
” হ্যাঁ, ভাবছিলাম। আমার স্বপ্নটা মনেহয় অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ক্যার্থবার্ট কেন এমনটা করলো সেও তো আমাদের টিমের একজন ছিলো।” দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন খাইরুল মামুন। বললেন, সেদিন যদি ক্যার্থবার্ট এমনটা না করতো তাহলে,,
রাহনাফ খাইরুল মামুনের শুকিয়ে যাওয়া মুখটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো অতঃপর বলল,

” স্টিফেন হকিং এর কথা মনে আছে। বিশ্বের সেরা পদার্থবিদের মধ্যে তিনি একজন। ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণবিবরের অস্তিত্ব ও প্রকৃতি এবং মহাবিশ্বের বিগ ব্যাং থিওরির ব্যাপারে তার অবদান চির স্মরণীয় হয়ে আছে। খুব অল্প বয়সে জটিল অসুখে পঙ্গু হয়ে গেলেও তার গবেষণা থেমে থাকেনি পঙ্গুত্বকে জয় করে চালিয়ে গেছেন বিজ্ঞানের জগতে তার অগ্রযাত্রা। হকিংয়ের অসুখটির নাম মোটর নিউরন ডিজিজ যার অন্য নাম amyotrophic lateral sclerosis (ALS)। এই অসুখটি হলে মস্তিষ্কের যেসব নিউরন বা স্নায়ুকোষ দেহের বিভিন্ন অঙ্গ বা মাংসপেশীর নাড়াচাড়া নিয়ন্ত্রণ করে, সেগুলো আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে যেতে থাকে ফলে রোগীর দেহের বিভিন্ন অংশ আস্তে আস্তে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যায়। শুরুতে হাঁটাচলা সমস্যা হয় আস্তে আস্তে পঙ্গু হয়ে যায় রোগী। আর শেষে নিঃশ্বাস নেওয়ার ক্ষমতা ও চলে যায়। ভয়াবহ এই রোগটির কোনো কারণ জানা নেই আর কোন চিকিৎসাও নেই। আর এই রোগ যাদের হয় তারা খুব বেশি হলে দুই থেকে পাঁচ বছরের মধ্যেই মারা যায়। এই সংবাদটি জানার পর মুষড়ে পড়লেন হকিং। এত গবেষণা এত কাজ অথচ বাচবেন খুব অল্প কয়দিন। ডাক্তাররা রায় দিলেন উনি আর দু’বছর বড়জোর বাঁচবেন তাই পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিলেন তারা।কিন্তু পদার্থবিজ্ঞান হল হকিং এর জান প্রাণ এছাড়া কোনভাবেই বাঁচবেন না তিনি তাই সিদ্ধান্ত নিলেন যতদিন বাঁচবেন কাজ করে যাবেন। শিক্ষাগুরুর ডেনিস শিয়ামা উৎসাহ দিলেন । ছড়ি কিংবা ক্রাচ হাতে কষ্ট করে গবেষণা চালাতে লাগলেন। পরে অবশ্য সুখবর পেলেন। তার অসুখটি অন্যান্য এএলএস রোগীর মত দ্রুত দেহে নানা অংশে ছড়াচ্ছে না। ফলে পুরো দেহ অবশ হয়ে যেতে অনেকদিন লাগতে পারে। হকিং যেন দ্বিতীয় জীবন হাতে পেলেন কষ্ট করে হলেও বিপুল উদ্যমে গবেষণা করে ১৯৬৬ সালে শেষ করলেন তার পিএইচডি। থিসিসের জন্য পেলেন অ্যাডামস প্রাইজ।
“তুৃমি কি বলতে চাইছো রাহনাফ? ”
“সেটা আপনি বুঝেছেন স্যার।”
“সেটা কি করে সম্ভব?”
“সম্ভব। সবই সম্ভব। আপনার ইচ্ছে আছে মেধা আছে এখন পরিকল্পনা করুন। পরিকল্পনাই ভবিষ্যৎ কে বর্তমানে নিয়ে আসে। ভাবুন স্যার ভাবুন। জেমস টি ম্যাকরের সেই বিখ্যাত উক্তির কথা মনে আছে।”
“কোনটা?”
” একজন ব্যক্তি হিসেবে আপনার ক্ষমতা কতটুকু, সেটি কোন ব্যাপার নয়। আপনি যা কিছু করেছেন, তার চাইতেও বেশি কিছু করার সক্ষমতা রয়েছে আপনার।”

যেটা ঘটেছে সেটা আমরা কেউ পাল্টাতে পারবোনা তাই আপনার উচিৎ অতীত নিয়ে না ভেবে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবা। স্যার আপনি আমাদের দেশে একটা ল্যাব তৈরী করে নতুন করে আবার সবটা শুরু করেন। আপনার বেষ্টটা দিন দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে। এখনো কিচ্ছু শেষ হয়নি অনেকটা সময় আছে আপনার হাতে। নিজের উপর বিশ্বাস রাখুন। জীবনে বিশ্বাসটাই সব। বিশ্বাসেই সম্পর্ক চলে,বিশ্বাসেই জীবন চলে,বিশ্বাসেই পৃথিবীও চলছে।”

খাইরুল মামুন মন দিয়ে রাহনাফের কথা শুনলেন। বললেন,
” আমি আবার নতুন করে সবটা শুরু করতে চাই। আমাকে পারতেই হবে। উন্নত বিশ্বের জন্যে আমার এ সাফল্যটা খুব প্রয়োজন। আমাদের দেশে গ্রাম অঞ্চলে সবুল শ্যামল প্রকৃতি দেখা গেলেও শহরে এগুলো বিলুপ্তপ্রায়। ইংল্যান্ড দেখেছি আর্টিফিশিয়াল কালচারাল’র মাধ্যমে ফসল উৎপাদন করা হয়। বাতাশে অক্সিজেন নেই বলে বিভিন্ন ধরনের পাওয়ার প্ল্যান্ট ব্যবহার করা হয়। আমাকে আমার রিসার্চ কমপ্লিট করতেই হবে। রাহনাফ আই নিড ইউর হেল্প।”

গ্রামে আসার পর থেকেই মেহেরকে এড়িয়ে চলছে রাহনাফ। মেহের অনেকবার কথা বলার চেষ্টা করলেও হ্যা না ছাড়া তেমন কিছু বলে নি রাহনাফ। রাগ হয়েছে মেহেরের। রাগে অভিমানে সেও রাহনাফের থেকে দূরত্ব বজায় রাখছে। খাইরুল মামুন ও রুপার বিয়ের সম্পন্ন হলে সবাই মিলে গল্পের আসর জমায়। রাহি আর মেহের দুজনে মিলে সবার জন্যে চা নিয়ে আসে। রাহি সবাইকে চা দিলেও মেহের রাহনাফের হাতে চায়ের কাপ দেয়। রাহনাফ চায়ের কাপে চুমুক দিতেই ঝালে মুখ কুঁচকে সেটা ফেলে দেয়। এই দৃশ্য দেখে মেহের খিলখিলিয়ে হেসে উঠে। মনে মনে বলে, আমাকে এড়িয়ে চলা তাইনা এবার বুঝো মজা।” মেহেরের হাসি দেখে রাগ হয় রাহনাফের। রাগে সে ঝাল চা সবটা এক চুমুকে খেয়ে ফেলে। এই ঘটনায় হতবম্ব সবাই। মেহর শুধু নির্বাক দৃষ্টিতে থাকিয়ে রইলো রাহনাফ লাল হয়ে যাওয়া থমথমে মুখের দিকে।

১৭,
মাঝরাত থেকে মুশলধারে বৃষ্টি পড়ছে। পাচটার পর থেকে বৃষ্টির বেগ কমলেও আকাশের মুখ ভারী। সারে পাঁচটার এর্লামে ঘুম ভাংলো আলিহানের। ঘুম ভেঙে নিজের বুকের মাঝে উদ্ধার করলো মৌকে। ছোট বিড়াল ছানার মতো গুটিশুটি পাকিয়ে মৌ আলিহানকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। আলিহান মৌয়ের ঘুমন্ত মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
“একিই, মনহারিণী যে প্রাণহরণ করতে চলেছেন।আর কিছুক্ষণ আমার উপর এভাবে শুয়ে থাকলে আমি চাপা পড়ে এক্কেবারে শেষ। ”
এই বলে আলিহান মৌয়ের মাথার এলোমেলো চুলে বিলি কেটে দিতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর ঘুম ভাঙ্গে মৌয়ের। চোখ খুলে আলিহানকে দেখতে পেয়ে মৃদু হেসে আরো জাপটে ধরে সে আলীহানকে। আলীহানের বুকে নাক ঘষে বলে,
“কটা বাজে?”
“এইতো ছয়টা হবে আর কি।”
“আজ অফিস আছে তোমার? ”
“না আজ অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি বাড়িতে একটা ইম্পোর্টেন্ট কাজ আছে। ”
“বাড়িতে আবার তোমার কি কাজ?”
“তোমার বোন এমন একটা কান্ড করেছে আমার ভাইটার মুড অফ। এবার সেটাই ঠিক করতে হবে।”
“রাহনাফ এখনো রেগে আছে মেহেরের উপর!”
” সেতো আছেই দেখো না সারাদিন কেমন থমথমে মুখে ঘুরে বেড়ায় দেখে মনে হয় বউ মরছে শালার।”
আলীহান মৌকে ছেড়ে উঠে বসে মোবাইল হাতে নিয়ে কাউকে এসএমএস করে। মৌ বসে চুলে খোপা করতে করতে বলে,
“কি করবে ভাবছো কিছু?”
“সব ভাবা হয়ে গেছে। এবাররর শুধু দুটোকে এক করতে হবে। যে করেই হোক মেহেরকে রাহনাফের রাগ ভাঙাতে হবে।”
” মেহেরের যা রাগ উল্টো মেহের রাগ না করলেই হলো।”
” এই এটা তুমি একদম ঠিক বলছো।”
মৌ ওয়াশরুমে চলে গেলে আলিহান রাহিকে এসএমএস করে বলে রুমে আসতে। রাহি আসতেই দুজনে আজকে সারাদিনের প্ল্যান শুরু করে দেয়।

সকাল আটটা বাজে ত্রিশ মিনিট। রাহনাফরা সবাই খাবার টেবিলে উপস্থিত নেই শুধু আলীহান। কিছুক্ষণ পর আলিহান ডাইনিং রুমে উপস্থিত হলো তবে আজ সে অফিসে যাওয়ার জন্যে তৈরী হয়ে আসেনি। বাড়িতে যেভাবে থাকে সেই ভাবে আসছে। পরনে শুধুমাত্র একটা ট্রাউজার আর ট্রিশার্ট। আলিহানকে দেখে রাহনাফ প্রশ্ন করলো,
” আজ অফিস নেই তোর।”
আলিহান চেয়ার টেনে বসে তার মাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
” মা খাবার দাও। খুব ক্ষিধে পেয়েছে।”
রাহনাফ জুসের গ্লাস হাতে নিয়ে ভ্রুতে সামান্য ভাজ ফেলে তাকিয়ে রইলো আলিহানের দিকে। আলিহান কোনদিকে না তাকিয়ে এক টুকরো রুটি মুখে পুরে বলে,
” আমরা একটা পিকনিকের আয়োজন করতে চাচ্ছি।
রাহনাফ এক নিঃশ্বাসে জুস গলঃকরন করে বলল,
” আমরা মানে কারা? আমি তো কিছু জানিনা।”
” তোকে জানানো হয়নি। রাহি জানে তাইনা রাহি। ”
রাহি উপর নিজ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। আরমান হাসান বললেন,
” কোথায় পিকনিক করতে চাচ্ছো তোমরা?”
” আমাদের বাড়ির পিছনে যে বাগানটা আছে সেখানেই আয়োজন করি।”
” আচ্ছা বেশ তাহলে আমরাও থাকছি তোমাদের সাথে।”
আলিহান আড় চোখে রাহনাফকে একনজর দেখে নিয়ে বলল,
” তুইও আজ অফিস থেকে ছুটি নিয়েনি।”
” লাঞ্চের পর নিবো।”
” আমাদের কত কাজ আর তুই কিনা বিকালে আসবি। অফিসে যেতে হবে না আমাদের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করবি।”
আরহাম হাসান বললেন,
” একদিনেরই তো ব্যাপার। ছুটি নিয়ে নাও রাহনাফ।”
অবশেষে রাহনাফকে রাজি হতেই হলো ছুটি নেওয়ার জন্যে। তখন রাহি বলল,
“আচ্ছা মেহের আপুকে আসতে বললে কেমন হয়?”
মেহেরের কথা শুনতেই রাহনাফের হাত থেমে যায়। আড় চোখে সবাইকে দেখে খাবারে মনোযোগ দেয় তখন রাহনাফের মা বলে,
” এটা তো ভালো কথা। আচ্ছা রাহনাফ তুমি খাওয়া শেষ করে মেহেরকে গিয়ে নিয়ে আসবে।”
” আমি! আমি কেন?”
” মেহের তোমার হবু স্ত্রী। তুমি যাবেনা তো কে যাবে?”
” হবু স্ত্রী না ছাই।” দাঁত চিবিয়ে বলল রাহনাফ। মৌ বলল,
” আমি তাহলে মেহেরকে কল করে বলে রেডি হয়ে থাকতে।”

১৮,
“এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হতো তুমি বলতো” রাহনাফের কাঁধে হাত রেখে পুরনো দিনের উত্তম সুচিত্রার এভারগ্রীন গানটা কেবল গুনগুন করে গায় ছিল মেহের এমন সময় রাহনাফের বাইকটা যায় নষ্ট হয়ে। গাড়িটা দু তিনবার ম্যানুয়াল স্টার্ট দিলেও বাইক আর চলে না। রাহনাফ ভ্রু কুঁচকে মেহেরকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“একটু নামতো বিগড়ে গেছে মনে হচ্ছে।”
মেহের বোকা বোকা চোখে রাহনাফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কি বিগড়ে গেছে?”
রাহনাফ বিরক্ত মুখে উত্তর দিল
“তোমার মাথা। দেখতে পারছ না গাড়ি বিগড়ে গেছে।”
মেহের মুখ কুঁচ করে বাইক থেকে নেমে বলল,
” বুঝতে পারিনি, বুঝতে পারলে শুধু শুধু আপনার ধমক খাওয়ার জন্য তো আর বলতাম না।”
এই কথা বলে মেহের অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে মনে মনে বলল,
“এখন একটু বেশি বেশি করছে।। হ্যাঁ মানছি আমি ওকে ঝাল খেয়েছিলাম তার জন্য তো সরিও বলছি তাও দেখো মুখটা এমন করে রেখেছে যেন ঝাল নয় বিষ খাইয়ে ছিলাম ওকে। মুখটা যেন মেঘলা আকাশের মতই গুমরা গুমোট, এমন মুখ দেখেই তো গাড়িটা বিগড়ে গেছে।”
রাহনাফ পকেট থেকে মোবাইল বের করতে করতে বলল,
” আলিহানকে কল করছি তোমাকে নিয়ে যাবে ”
মেহের রাহনাফের সাথে একটু সময় কাটানোর জন্যে বলল,
“আমি যাব না। আপনাকে এমন একাকি রাস্তায় বিপদের মুখে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না।”
রাহনাফ সরু চোখে মেহেরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কিইই, বিপদ? কিসের বিপদ? আমি কোন মেয়ে নাকি যে ফাঁকা রাস্তায় আমার কোন বিপদ হবে।”
“এই শুনুন ফাঁকা রাস্তায় ছেলেদেরও বিপদ হয় বুঝলেন তো। আর আমি আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না। পিকনিক স্পটে যেতে হলে দুজন এক সাথেই যাব না হলে না।”
মেহেরে এই কথা শুনে রাহনাফের শত রাগের মাঝেও মুখে হাসি ফুটে উঠলো। সেই হাসি মেহের দেখতে পেলো না। মনে মনে বলল,
“তাও স্বীকার করবে না আমার সাথে থাকতে চায়। আচ্ছা বেড়ে পাকা মেয়ে তো। তবে আমিও নরম হবোনা। সেদিন কি হাল হয়ছিলো আমার। ঝালের চোটে ঠান্ডা পানি খেয়ে খেয়ে সর্দি ধরে গেলো ভুলবো আমি সে কথা। এর ঠিক শোধ না তুলে আমিও শান্ত হবো না।”

এই কথা ভাবতে ভাবতে আলিহানকে কল করলো রাহনাফ। আলিহানকে গাড়ি নিয়ে আসতে বললে সে বলে ব্যাস্ত আছে আসতে পারবেনা। রাহনাফের লোকেশন বলার পর সে জানায় সামনেই একটা গ্যারেজ আছে সেখান থেকে বাইক সাড়িয়ে তারপর ফিরে আসতে। আলিহানের সাথে কথা বলে রাহনাফ বাইক ঠেলে সামনে এগোতে থাকে আর মেহের তার পিছে।

আলিহান কথা বলা শেষ করে মোবাইল হাতে নিয়ে মিটমিটে হাসতে থাকে। মৌ আর রাহি আলিহানের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মৌ উঠে গিয়ে আলিহানের সামনে দাঁড়িয়ে কোমড়ে হাত গুজে বলে,
” কার কল ছিলো? হাসছো কেন এভাবে?”
” আমার ভাইটার ফোন ছিলো গো গিন্নী। বাইক খারাপ হয়ে গেছে দুজনে এখন একাকি নির্জন রাস্তায় বুঝলে।
ভালোই সুযোগ হয়েছে ওদের এবার দুজনের মান অভিমান মিটিয়ে নিক।”

গ্যারেজে বাইক রেখে মেহেরকে নিয়ে একটা কফিশপে যায় রাহনাফ। মেহের কফির মগে চুমুক দিয়ে বলল,
” সরি, সেদিন প্রাঙ্ক করার জন্যে।”
” মানছো তাহলে সেদিন প্রাঙ্ক করেছিলে?”
“হুম।”
“কেন করেছিলে?”
“এমনি।”
“এমনি এমনি কিছু হয় নাকি? সবকিছুরই কোন না কোন কারন থাকে। বলো কেন করেছিলে?”
মেহের মনে বলল,
” এমন প্রশ্ন করছে যেব আমি কোন ক্রিমিনাল আর ওনি পুলিশ। এখন যদি বলি আপনি আমাকে ইম্পরট্যান্ট দেননাই তাই ঝাল খাইয়েছিলাম তাহলে না জানি আর কত প্রশ্ন করবে।” রাহনাফের দিকে অসহায় মু করে তাকিয়ে ডুক গিলে বলল,
“রাগে করেছিলাম।
রাহনাফ ভ্রু কুঁচকে বলল,
“হোয়াট? রাগে? কেন আমি তোমাকে রাগানোর মতো কি করেছিলাম।”
“কেন রাগ হবে না আমার। মামাকে নিয়ে আসার পর থেকে আমাকে পাত্তাই দেননা। আগে রোজ রাতে কল করতেন এখন সেটাও করেননা। আমাকে সব সময় এড়িয়ে চলেন রাগ হবেনা আমার।”
” এই ছোট্ট কারনে এত রাগ।”
“এটা ছোট্ট কারন?”
“তা নয়তো কি? মেহের আমি কিছুদিন ব্যাস্ত ছিলাম স্যারের অনেক কাজ ছিলো যেগুলো আমাকে করতে হয়েছে সাথে আমার অফিসের কাজ তাই তোমাকে সময় দিতে পারিনি। এর কারনে এত রাগ?”
” হুম। সরি বলছি তো। এখন আর আমার উপর রেগে নেই তো?”
” আমার রাগ এত সহজে কমবে না। আমি এর শোধ নিয়ে ছাড়বো।”
“কি শাস্তি দিবেন বলুন। কান ধরে উঠবোস করবো। না হলে আপনিও আমাকে ঝাল খাইয়ে দিন।”
” না না তা হয় নাকি। হতেই তো পারে তুমি আমার থেকে ঝাল বেশী খাও তখন তোমাকে খাল খাইয়ে আমার লাভটা কি শুনি। ”
“তাহলে,,,
“ভাবো ভাবো বড় তো কম হওনি। বড়দের মতো করে ভাবো।”
মেহের কিছুক্ষণ ভাবার পর চমকে উঠে বলল,
” মিষ্টি খাবেন। আমি আপনাকে অনেক মিষ্টি খাওয়াবো। সেদিন ঝাল খাইয়েছিলাম আজ মিষ্টি খাওয়াবো।”
রাহনাফ মাথা নেড়ে বলল,
“সুগারে ভয় আছে ওই জিনিস খাওয়া যাবেনা অন্য কিছু ভাবো।”
মেহের ঠোট উল্টে মাথা চুলকে বলল,
” তাহলে টক কিছু?”
” এসিডিটির ভয় আছে।”
“তাহলে নোনতা,,,,
” ওরে বাবা নুন মানে বিষ। হাই প্রেশার ধরাবে নাকি।”
মেহের বিরক্ত মুখে বলল,
” রোগের ডিপি একটা।
এমন সময় গ্যারেজ থেকে কল আসলো রাহনাফের বাইক ঠিক হয়ে গেছে। রাহনাফ কফির মগে শেষ চুমুক দিয়ে মেহের দিকে মুখটা বাড়িয়ে বলল,
” ভাবো মেহুরানি ভাবো। বড়দের মতো করে ভাবো।”
এই কথা বলে কফির বিল দিয়ে বেড়িয়ে যায় কফিশপ থেকে আর মেহের ভাবুক হয়ে তার পিছে যায়।

চলবে,,,,,,
#মাহফুজা আফরিন শিখা।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে