#তবুও_মনে_রেখো। [০১]
#মাহফুজা আফরিন শিখা।
১,
ভোরের আলো ফুটে উঠার সাথে সাথে ঘুম ভেঙে যাওয়া সৈয়দা মাহবুবার বরাবরের অভ্যাস৷ বিছানায় বসে আযানের জবাব দিয়ে বিছানা ত্যাগ করেন। তারপর অজু করে নামাজ আদায় করেন। নামাজ শেষ হলে বেলকনিতে চলে যান।এই সময়টায় তিনি বেলকনিতে দাঁড়িয়ে নীরব আকাশের সাথে মনের কথা বলেন। সময়টা তার নিজের , একলা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে জিবনের সমস্ত হিসাব নিকাশ করে।জিবনের অর্ধেকটা সময় তার গ্রামেই কেটেছে তাইতো শহুরে হাওয়া তার এতদিনের অভ্যাস পরিবর্তন করতে পারেনি। তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে অতীতের কথা ভাবেন। নওশাদ যে তাকে ছেড়ে চলে গেছে মাঝে মাঝে এই কথাটা মন মানতেই চায়না৷ কি করেই বা মানবে! নওশাদ যে তার স্বামী, প্রথম প্রেম তাকে ভুলে যাওয়া কি এতটাই সহজ। নওশাদ তাকে নাই ভালোবাসলো সে তো ভালোবেসেছিল, মন প্রান উজার করে ভালোবেসেছিল৷ তাইতো কোনটা ভালোবাসা আর কোনটা অভিনয় সেটা টেরও পায়নি সৈয়দা মাহবুবা৷ তবে এসবের জন্যে তিনি নিজেকেই দোষ দেন বরাবর। তিনি মনে করেন নওশাদকে নিজের কাছের ধরে রাখার ক্ষমতা তার ছিলোনা৷ দোষ তার নিজের৷ সে ভালোবাসতে পারেনি। না হলে নওশাদ কেন তাকে সন্তানসম্ভাবনা অবস্থায় ছেড়ে চলে যাবে? নওশাদের চলে যাওয়ার পর কতটা একা হয়ে পড়েছিল সে৷ প্রসবকালে যে মানুষটাকে তার সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন ছিলো সেই পাশে ছিলো না কত কষ্টে দিন কেটেছে। সেদিনের ঊনিশ বছরের যুবতী থেকে আজ এখানে একজন সু’প্রতিষ্ঠিত নাগরিক হয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে তাকে কম অপমান লাঞ্জনা সহ্য করতে হয়নি৷ মাঝে মাঝে এইসব কথা ভেবে দু’চোখের কোল ভরে আসে সৈয়দা মাহবুবার৷ তারা ভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে শাড়ির আচলে চোখ মুছেন সৈয়দা মাহবুবা। তাকে কাঁদলে চলবে না। তার চোখে অশ্রু মানায় না৷ সে ফুটফুটে এক কন্যা সন্তানের মা৷ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় যুদ্ধা হলেন একজন না। যে সব পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে পারেন। বাড়ির ভিতরে সে মা আর বাহিরে বাবা। মেয়ের মুখের দিকে তাকালেই জিবনের সমস্ত না পাওয়ার কথা ভুলে যান তিনি৷ তার আর নওশাদের একমাত্র কন্যা মেহেরের মুখের দিকে তাকালেই বুকটা ধুক করে উঠে তার। মেহের একদম বাবার রুপ পেয়েছে৷ গায়ের রংটা নওশাদের চেয়ে একটু চাপা হলেও মায়াবী তার মুখখানা৷ এই মেয়েকে নিয়েই তার জিবন৷ জিবনের এই পাওয়া না পাওয়া ব্যর্থতার মাঝে মেহের যেন তার একটুকরো স্বর্গ। মেহের শুধু দেখতেই বাবার মতো হয়নি রাগ জেদ আর বুদ্ধিতেও নাওশাদের চেয়ে কম নয়৷ মেহেরের বয়স যখন সাত বছর তখন নওশাদের সাথে তার প্রথম দেখা হয়। বাংলা সিনেমার বাবাদের মতো সেও মেহেরকে নিজের কাছে টেনে নিতে চায়৷ মেহের সেদিন নওশাদের কাছে যায়নি। আসলে সে চিনতেই পারেনি এটা তার বাবা।নওশাদ সেদিন কেঁদেছিল। মেয়ের এমন প্রত্যাখান সে মেনে নিতে পারেনি৷ তারপর থেকে রোজ আসতো মেহেরের স্কুলের সামনে তাইতো গ্রাম ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছে শহরের বুকে৷ তারপর আর গ্রামে পা দেওয়া হয়নি। মেহের আজ বিশ বছরের কুমারী মেয়ে৷ মেয়েকে নিয়ে বড্ড চিন্তা সৈয়দা মাহবুবার৷ বাবার প্রতি রাগ আর ঘৃনায় পুরুষ বিদ্বেষী হয়ে উঠেছে মেহের। এখনো পর্যন্ত তার কোন ছেলে বন্ধু নেই। ভুলেও কখনো বাবার কথা বলেনা। এমনকি মেহেরের সামনে যখনি নওশাদের কথা উঠে তখনি রেগে যায়। তাই এই বাড়ির কেউ কখনো নওশাদের কথা তুলে না। অতীতের কথা মনে হলেই দীর্ঘশ্বাস ফেলেন সৈয়দা মাহবুবা। সূর্যের আলো পৃথীবির বুকে ছড়িয়ে পরতেই বেলকনি ছেড়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ান। তারপর সকলের জন্যে নাস্তা তৈরী করেন। সৈয়দা মাহবুবা এবং মেহের ছাড়াও এই বাড়িতে আছে আরো দুজন, রুপা এবং মৌ। রুপা সৈয়দা মাহবুবার মামাতো বোন আর মৌ, বন্ধুর মেয়ে।
রুপার ডাকে ঘুম ভাঙে মেহেরের। চোখ কচলে হাই তুলে উঠে বসতেই সামনে রুপাকে দেখে ভ্রু কুচকে ফেলে ফেলে মেহের। প্রশ্ন করে,
” তুমি সকাল সকাল আমার রুমে কি করছো? মৌ কোথায়?”
” ঘুমাচ্ছে।”
“কোথায়?”
” নিজের রুমে। তোর সাথে রাতভর ভুতের মতো ঘুরবে নাকি।”
দুহাতে মাথার চুল বাধতে বাধতে মেহের বলে,
” একা একা কাজ করছিলে তাই কোম্পানি দিতে এলাম। এখন আমাকেই কথা শুনাচ্ছো। তাই বলি করো ভালো করতে নেই।”
মেহের চলে যায়। রুপা ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে টেবিলের উপর পরে থাকা খাতাগুলো গুছিয়ে নেয়।
_____________
মৌ ঘুমাচ্ছে। পাশেই ওর মোবাইল ভাইব্রেট করছে। বিছানা হাতরে একটা বালিশ খুঁজে নিয়ে সে মাথার উপর রেখে বলল,
“মেহু তোর ফোন বাজছে। তাড়াতাড়ি রিসিভ কর আমার ঘুমের বারোটা বাজাস না।”
রুমে প্রবেশ করার সময় মৌ’এর কথা শুনে মেহের বলে,
” আমার না তোর ফোন বাজছে।”
” এই সকাল সকাল আবার কার কি হলো।”
” তোর গুড মর্নিং চুমু বাকি পরছে। তাড়াতাড়ি উঠ আর দিয়ে দে। নাহলে বেচারা আলিহান আবার বিছানা ছেড়ে উঠতে পারবে না।”
ঘুম ভাঙে মৌ’এর। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে। একটা বালিশ মেহেরের দিকে ছুঁড়ে বলে,
” ছি, মেহু এসব কি কথা বলছিস।”
মেহের বালিশ ধরে বিছানায় রাখে। বলে,
“আমি বললে ছিঃ তাইনা। নিজেরা যখন মোবাইলে চুমু ছোড়াছুড়ি করো তখন কিছুনা।”
” চুমু ছোড়াছুঁড়ি করে কেমনে।”
মেহের মৌয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
“কল রিসিভ কর আগে।”
মৌ কল রিসিভ করে।ওয়াশরুমে চলে যায় মেহের। ওদের এই প্রেম আলাপনের মাঝে সে থাকতে চায়না। ভিডিও কলে কথা বলার সময় আলিহান মাঝে মাঝে ফ্লাইং কিছ দেয় আর মৌ তখন লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠে। মৌ’য়ের সামনে থেকে মৌকে লজ্জায় ফেলার কোন ইচ্ছেই নেই মেহেরের। মেহের চলে যেতেই মৌ বলে,
” এত সকাল সকাল কি বলবে বলো। আমার ঘুম হয়নি ঘুমাবো।”
“ভাবি আমি রাহি বলছি। ” মোবাইলের স্কিনে একটা মেয়ের ছবি দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলে মৌ। প্রশ্ন জাগে মেয়েটা কে? ভাবি কথাটা মাথায় আসতেই নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে মৃদু হাসে। ওপাশ থেকে মেয়েটা বলে,
” কেমন আছো ভাবি?”
” ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?
” ভালো। অনেকদিনের ইচ্ছে ছিলো তোমাকে দেখার। ভাই কখনো নিয়ে যায়নি আমাকে। তাই আজ সকাল সকাল তোমাকে বিরক্ত করলাম। নাও ভাইয়ের সাথে কথা বলো।”
মৌ আর কিছু বলার সুযোগ পেলনা। মেয়েটা আলিহানের হাতে মোবাইল দিলো। মৌ আলিহানকে জিগ্যেস করলো,
” মেয়েটা কে?”
” আমার ছোট বেলার গার্লফ্রেন্ড।”
” মানে।”
” আমার কাজিন রাহি।”
“আচ্ছা তাই বলো। আমি ভাবলাম,,,
“কি ভাবছিলে, সত্যিকারের গার্লফ্রেন্ড। হা হা হা।”
” না ঠিক তা নয়। এখন রাখছি।”
” দেখা হচ্ছে বিকালে।”
২,
বাসের সিটে হেলান দিয়ে বসে আছেন সৈয়দা মাহবুবা। মিষ্টি কালারের শাড়ি পরে গায়ে কালো শাল জড়িয়ে রেখেছেন।মাথায় চুলগুলো খোপা করা। সামনের কিছু চুলে পাক ধরেছে তার। চুলে পাক ধরাকে অনেকেই বয়সের ছাপ হিসেবে ধরে নেয়। বয়স বাড়লে চুল পাকবে এটাই স্বাভাবিক। আবার অনেকেই বলে থাকে অভিজ্ঞায় চুল পাকে। আজকাল চোখেও ঝাপসা দেখেন তিনি। তাই পাওয়ারওয়ালা চসমা পরেছেন। উচ্চমাধ্যমিকের অংকের শিক্ষিকা তিনি। ক্লাস শেষ করে বাড়ি ফিরছেন। বাসের সিটে হেলান দিয়ে চোখদুটি বন্ধ করে নেন সৈয়দা মাহবুবা। মনে পরে তার সে বিষাদময় অতীতের কথা। নওশাদের সাথে ডিভোর্স হওয়ার পর বাড়ির সবাই বিয়ের জন্যে চাপ দিতে থাকে তাকে। তখন সৈয়দা মাহবুবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করা নিয়ে আপত্তি করলে কেউ আর কখনো তাকে বিয়ে কথা বলেন না। কিন্তু গ্রাম বাসিরা তার নামে নানা কথা রটাতে থাকে। মেয়ের দোষ আছে বলেই স্বামি তাকে ছেড়ে চলে গেছে। কেমন মেয়ে স্বামিকে নিজের কাছে রাখার ক্ষমতা নাই। প্রথমে খারাপ লাগলেও কিছু বলতেন না সৈয়দা মাহবুবা। কারন যারা সামনে এসে দু একটা সান্তনার বাণী শুনায় দূরে গিয়ে তারাই সমালোচনা করে। সকলের তিক্ত কথা হজম করে নেন। সবার সব অপমান মুখ বুঝে সহ্যকরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে তিলতিল করে বড় করেছেন তিনি মেহেরকে। আর মেহেরকে বুঝিয়েছেন এক দিন এই সমাজও তাদের সম্মান দিবে। বড় করে শ্বাস ত্যাগ করেন সৈয়দা মাহবুবা। আজ তার সব কষ্ট সার্থক। তিনি এখন গর্ব করে বলতে পারবেন,
– আমি স্বতঃস্ফূর্ত, স্বতন্ত্র একজন নারী। একজন একক মা। একটা সুন্দরী কন্যার মা আমি, যাকে আমি একা হাতে লালন পালন করেছি। এবং একজন চল্লিশ বছরের মহিলা যে এই বাংলাদেশের একজন দায়িত্বশীল নাগরিক। হ্যাঁ আমি গর্ব করে বলতে পারি, আমি তাকালপ্রাপ্ত একজন মেয়ে। আমার জিবন এবং শরীরের ত্রুটি রয়েছে।”
জীবন কারও জন্য থেমে থাকে না। তাই, মা হওয়ার পর যদি বিবাহবিচ্ছেদ কিংবা বৈধব্যের অঘটন ঘটে, তাহলেও বিরহে অশ্রুবিসর্জন নয়, একলা মা হয়েও দায়িত্ব নিয়ে পূর্ণ আনন্দ উপভোগ করা যায়। এমন উত্তরণের কাহিনি বহু ছবিতেই তুলে ধরা হয়েছে।আমাদের সমাজ আজও সিংগল মাদার-এর বিষয়টিকে খুব সহজে মেনে নিতে পারেনি। সন্তানকে বড়ো করার দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে, পুরুষের সাহায্য ছাড়া মহিলারা অক্ষম বলে মনে করে আমাদের সমাজ। হাজারো প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে হয় একলা মায়েদের। অবশ্য, সিংগল মাদার হওয়া কঠিন জেনেও, শুধু মনের জোরে লড়াই জারি রেখেছেন অনেকে। তার অন্যতম উদাহরণ হলো সৈয়দা মাহবুবা। সৈয়দা মাহবুবা যেদিন প্রথম মেহেরকে স্কুলে ভর্তি করাতে যান তখন সেখানেও তাকে অপমানিত হতে হয়। স্কুলের এক শিক্ষক তার চরিত্রের দিকে আঙ্গুল তুলে। মেহের সৈয়দা মাহবুবার পাপের ফল এটা বলতে তিনি দ্বিধাবোধ করেন নি। স্কুলের শিক্ষকদের অনেক বুঝিয়েও সৈয়দা মাহবুবা সেদিন মেহেরের বাবার পরিচয় আড়াল করতে পারেন নি। বাধ্যহয়েই তাকে মেহেরের বাবার নাম বলতে হয়। হ্যঁ মেহেরের সাথে ওর বাবার সম্পর্ক এটাই। একটা সার্টিফিকেট। এর বাইরে কিছুনা। সার্টিফিকেটে বাবার নামের জায়গায় গুনে গুনে এগারো অক্ষরের একটা নাম লিখে মেহের এটাই ওর সাথে ওর বাবার সম্পর্ক।
৩,
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে পরখ করছে আর বিড়বিড় করছে মেহের। মৌ খাটের উপর পা তুলে বসে মেহেরকে দেখছে আর হাসছে। মেহের আয়নার মৌয়ের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে বলে,,
” খুব হাসি পাচ্ছে তাইনা। আমার ঘুম ভাঙিয়ে এখন যাবি বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে। অভিশাপ দিলাম, ব্রেক আপ হয়ে যাবে। ”
” শকুনের দোয়ায় গরু মরে না।” মৌ একগাল হেসে বলল। মেহের গম্ভীর কন্ঠে বলে,
” তুই গরু নাকি?”
” তুই শকুন হলে আমাী গরু হতে আপত্তি নাই।”
” শকুন তোর সতিন। আমি কেন হবো।”
মৌ কিছু বলবে তখনি ওর সেলফোনটা বেজে উঠে। মৌ মোবাইলের দিকে তাকিয়ে বলল,
” আলিহান মনে হয় এসে পরেছে। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে মেহু।”
আরো দশ মিনিট পর মেহের রেডি হয়ে ড্রয়িংরুমে আসে। ড্রয়িংরুমে তখন চলছিলো চায়ের আসর। সুফায় আলিহান সহ আরো তিনজন বসে আছে যাদের কাউকে মেহের চিনেনা। মেহের সবাইকে একনজর দেখে নিলো। আলিহানের পাশে বসা মেয়েটি দেখতে একটু বাচ্চাদের মতো। মোটা গুলোমুলো গাল তার। সাজগোজও সাধারণ। উল্টোপাশে বসা ছেলেমেয়ে দুটোর মুখ দেখতে পেলো না। রুপা আর মৌ আলিহানের পাশে সিঙ্গেল সুফায় বসে চা খাচ্ছে। মেহেরকে দেখে আলিহান বলল,
” আরে শালিকা সাহেবা, আসেন আসেন আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম।”
মেহের মৃদু হেসে আলিহানের পাশে গিয়ে বসলে আলিহান সবার সাথে মেহেরের পরিচয় করিয়ে দিলো। আলিহানের পাশে বসা গুলুমুলো মেয়েটয় রাহি অপর পাশে বসা রাহনাফ আর আরুশি। রাহি আর রাহনাফ আলিহানের কাজিন। আরুশি রাহনাফের বড় মামার মেয়ে। পরিচয় পর্ব শেষ হওয়ার পর সবাই মিলে বেড়িয়ে যায় বাড়িতে থাকে শুধু রুপা একা।সৈয়দা মাহবুবাও কোন একটা কাজে বাহিরে গেছেন। একা বাড়িতে মনটা বিষন্ন লাগছিলো রুপার তাই সে নিজের রুমে চলে আসে। বালিশের নিচথেকে ডাইরি বের করে সেটাতে কলমের আচর কাটে,
” এক পৃথিবীর সব ক’টা ফাগুন জড়ো করে ফুলদানির কোলাজে সাজিয়ে রেখেছি। অপেক্ষা কেবল অপেক্ষা আমার। ঐ আকাশ রঙের শাড়ি আর খোঁপায় দুধ-সাদা রঙের বেলী পরে, লাল টুকটুকে সূর্যটাকে কপালে বসিয়ে অপেক্ষা করছি তোমার।”
____________
মেহেরদের বাসা থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে একটা পার্কে আসে সবাই মিলে। পার্কটা ছোট হলেও মানুষের আনাগোনা অনেক বেশী। পার্কের এক পাশে বয়ে চলেছে নদী। নদীর কিনারে বসে সবাই মিলে। ওদের থেকে কিছুটা দূরে বসে আছে আরো কয়েকজন ছেলে। তাদের একজনে গিটার বাজাচ্ছে আর গান গাইছে অন্য আরেকজন ভিডিও করছে। কেউ মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত তো কেউ গান শুনায় ব্যস্ত। মেহের সে দিকে তাকিয়ে গান শুনছে। গিটারে সুর তুলে খুব সুন্দর করে গান গাইছে, এই সুন্দর স্বর্নালী সন্ধ্যায় একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু। মনোযোগ দিয়ে শুনলো পুরো গানটা। সম্ভবত এই গান ইউটিউব চ্যানেল ফেসবুক পেজে আপলোড করবে। ছেলেটার গানের গলা বেশ ভালোই। মেহের পূর্ণ নজরে পরখ করছে ছেলেদের। এর মধ্যেই মেহের খেয়াল করছে রাহনাফ তাকে দেখছে। মেহেরের চোখে চোখ পড়তেই সে নিজের দৃষ্টি সড়িয়ে অন্যদিকে তাকায়। বিরক্ত বোধ করে মেহের। ছেলেদের এমন স্বভাব তার কোন কালেই পছন্দ হয়নি। ছেলেটাকে কিছু বলবে এমন পরিস্থিতিও নেই। আরুশি রাহনাফের সাথে চিপকে বসে আছে। আলিহান বলল,
” আমরা ট্রিপে যাওয়ার প্ল্যান করছি। তোমরা কি যাবে আমাদের সাথে? প্রশ্নটা করলো মৌয়ের দিকে তাকিয়ে। মৌ বলল,
” কোথায় যাবে?” প্রশ্ন করে মৌ।
“এখনো ঠিক করা হয়নি। ঢাকার বাইরে কোথাও যাবো। আসলে রাহনাফ আর আরুশি অনেকদিন পর দেশে ফিরলো। আরুশি কিছুদিন পর চলে যাবে তাই ভাবছি কোথাও ঘুরে আসি ওদের নিয়ে।”
” কেন? কোথায় ছিলো এতদিন?”
রাহনাফের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো মেহের। রাহনাফ এবার পূর্ন দৃষ্টিতে তাকালো মেহেরের দিকে। এই প্রথম দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। আলিহান বলল,
” ইংল্যান্ড থাকতো ওরা। আরুশির পুরো পরিবার সেখানেই থাকে। রাহনাফ ও পড়াশুনার জন্যে ওর মামার কাছে চলে যায়।”
” পড়াশুনার জন্যে দেশের বাহিরে কেন যেতে হবে? আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা কি ভালো নয়?”
“ভালো। তবে এতটাও ভালো নয় যতটা আপনি ভাবছেন।” মেহেরের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে রাহনাফ।”
রাহনাফের কথাটা মনে হয় বুকের গভীরে লাগলো মেহেরের। বুকের ভিতর হঠাৎ করেই সব গোলমাল হয়ে গেলো। এতক্ষণের গুছিয়ে নেওয়া কথাগুলো সব এলোমেলো হয়ে গেলো। চোখ নামিয়ে নিলো সে। আগে তো কখনো এমন হয়নি। সবার চোখে চোখ রেখে কথা বলেছে সে। ডিবেটে হাজার হাজার মানুষের সামনে বক্তব্য দিয়েছে। কখনো নিজেকে বিভ্রান্ত মনে হয়নি। আজ হচ্ছে কেন? রাহনাফ কি তবে সত্যিই বলছে আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার তেমন উন্নত নয়। নাহলে কেন প্রতিবছর এত এত ছাত্রছাত্রী দেশের বাহিরে যাবে পড়াশুনার জন্যে? উত্তর পেল না মেহের। চোখ তুলে তাকালো রাহনাফের দিকে। রাহনাফ তখন আলিহানের সাথে কথা বলছে। মৌ বলে
” তাহলে চল কক্সবাজার যাই।”
আপত্তি জানালো রাহি।বলল,
” পানি আর বালু দেখার জন্যে কক্সবাজার যাবো না। চল না চট্টগ্রাম কিংবা সিলেটে যাই। পাহাড়ের স্থবিরতা, শান্ত স্নিগ্ধ রুপ দেখে মুগ্ধ হওয়া ছাড়া উপায় নেই! পাহাড় তার সুবিস্তৃত অকৃপন সম্ভারে প্রকৃতিকে করেছে মহীয়ান। ভাবতেই মন কেমন রোমাঞ্চিত হয়ে উঠে।”
আলিহান রাহির কান টেনে বলল,
“আজকাল একটু বেশীই রোমাঞ্চিত হচ্ছিস। ঘটনা কি?”
রাহি আলিহানের হাত সড়িয়ে বলে,
” কোন ঘটনা নেই ভাই। আমার পাহাড় খুব ভালো লাগে। প্লিজ ভাইয়া নিয়ে চলনা।”
রাহির এমন আবদার শুনে মৃদু হাসলো রাহনাফ। সে বলল,
“তাহলে তাই হোক”
ঠিক করা হলো চট্টগ্রাম যাবে এবং সেটা আগামি পরশু।
সেদিন আর ট্রিপে যাওয়া হলোনা। আলিহান আর রাহনাফ যখন মৌ’দের নিতে আসলো তখন দেখলো ওদের বাসার গেটে তালা ঝুলছে। মৌ’কে কয়েকবার কল করলো আলিহান প্রতিবারই নাম্বার বন্ধ তাই দুজনে গেটের সামনে অপেক্ষা করতে লাগলো। সময় বয়ে যেতে লাগলো। মৌ’কে আরো কয়েকবার কল করলো তারপর মেহেরের নাম্বারে কল দিলো। রিং হওয়া সত্বেও কল রিসিভ করলো না মেহের। রাগ হলো আলিহানের। রাগে মোবাইল ছুড়ে ফেলতে গিয়েও ফেলল না। চিন্তা এসে ভর করলো মাথায়। তিন বছরের রিলেশন আলিহান আর মৌ’য়ের। মৌ আগে কখনো এমন করেনি হঠাৎ করে উধাও হওয়ার কারন বুঝতে গিয়ে দুশ্চিন্তা ঝেকে বসলো আলিহানের মাথায়। মেহেরের নাম্বারে অনবরত কল দিতে লাগলো। আশ্চর্য! কল রিসিভ করছে না কেন মেহের। রাহনাফ আলিহানকে বলল,
“এরা হঠাৎ করে গেলো কোথায়?”
“বুঝতে পারছিনা।”
প্রায় এক ঘন্টা পর পাশের বাসার এক ভদ্রলোকের দেখা পেলো। তিনি বাজার থেকে ফিরছিলেন। রাহনাফ লোকটার সামনে গিয়ে তাকে সালাম দিয়ে জিগ্যেস করলো,
“আপনি বলতে পারবেন এই বাসার সবাই কোথায় গেছে?”
লোকটার মুখ গম্ভীর হয়ে গেলো। তিনি বললেন,
“মাহবুবার বাবা খুবই অসুস্থ। আজ ভোরে সবাই মিলে মাহবুবার গ্রামে গেছে।”
রাহনাফ মাহবুবাকে চিনতে পারলোনা। সে আলিহানের দিকে তাকালো। আলিহান বলল,
” আন্টির গ্রাম কোথায়? মানে বিভাগ জেলা জানেন কিছু? ”
“সেটা তো বলতে পারলাম না বাবা।”
“আচ্ছা, চাচা ধন্যবাদ আপনাকে।”
লোকটা চলে যাওয়ার পর রাহনাফ গাড়িতে বসলো। আলিহানকে বলল,
” মৌ হয়তো ব্যস্ত আছে। এত দুশ্চিন্তা করতে হবে না। গাড়িতে বস।”
“কোথায় যাবি এখন?”
“বাড়ি ফিরে যাই। ট্রুরে তো আর যাওয়া হবে না।”
মাথা নাড়ালো আলিহান। রাহনাফের পাশের সিটে বসতেই সাই সাই করে চলে গেলো গাড়ি।
চলবে,,,,,