তপ্ত সরোবরে পর্ব-৩৫

0
748

#তপ্ত_সরোবরে
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৩৫.

ঘুম ভাঙল দ্বিজার। পাশেই কারও বসা অবয়ব নজরে আসতেই চমকাল। ফারজাদ উঠে বসে আছে। দ্রুত নিজেও উঠে বসল, “কী হয়েছে? কেমন লাগছে? উঠেছেন কেন? ডাকতে পারেননি?ʼʼ

ফারজাদ মুখ কুঁচকাল, “সকাল সকাল টেপ রেকর্ডার অন হয়ে গেল! ছেলে হয়েছে, কোলে নিবি?ʼʼ

চট করে মুখ টিপে হেসে ফেলল দ্বিজা, “ভালোই হলো, আমার কষ্ট করতে হলো না। এরকম জামাই কয়জনের ঘটে জোটে!ʼʼ

ফারজাদ মাথাটা নত করে বসল, তবুও বোঝা গেল আনমনেই তার ঠোঁট প্রসারিত হয়েছে।

ওড়না খুঁজে পাচ্ছে না দ্বিজা। আশ্চর্য! রাতে তো গায়ে ছিল বলেই মনে পড়ছে তার! একসময় কাঁথার নিচে কুঁকড়ে যাওয়া অবস্থায় পেল, দ্রুত গায়ে কোনোরকম জড়িয়ে নেমে দাঁড়াল। ফারজাদ ওর দিকে তাকায়নি। কী ব্যাটাছেলে! হাসি পেল হুট করে দ্বিজার। সারারাত হাত পা ছড়িয়ে দ্বিজাকে কাছে নিয়ে শুয়ে ছিল এখন আর তাকাচ্ছে না।

রান্নাঘরে ঢুকতে ঢুকতে ডাকল, “বড়োমামি! তাওয়া গরম করে একটা কাপড় সেঁকে দাও তো!ʼʼ

ফারহানা ফিরে তাকালেন, “কী করবি?ʼʼ

-“এক কাত হয়ে শুয়ে থেকে ঘাড় বাঁকা করে ফেলেছে তোমার ছেলে, সকাল থেকে ঘাঁড়ের ব্যথায় উঠে বসে আছে।ʼʼ

পাশেই আমিনা বেগম বসে ছিলেন, তিনি মৃদু ধমক দিলেন, “মামি আবার কী? আম্মা কইবি।ʼʼ

-“নানু তুমি চুপ করো তো! আমার মামি হয়, আমি মামিই বলব। মুখে আসবে আম্মা-টাম্মা!ʼʼ

-“তাইলে ওর পোলাও তোর খালাতো ভাই লাগে, ওর লাগি এত ব্যস্ত হওয়া লাগতো না তোর, বয় ওই পিড়ির উপরে। ওর আম্মা যাইয়া লাগাইয়া দিয়ে আসুক।ʼʼ

দ্বিজা হেসে ফেলল। আমিনা বেগম হাসলেন অল্প একটু, “সেঁক দিয়ে কাজ হইতো না শুধু, সরষের তেল আর রসুন গরম করে দাও।ʼʼ

কুসুম গরম তেল নিয়ে দ্বিজা ঘরে এলো। ফারজাদ ওভাবেই বসে আছে। সে তেলের পাত্রটা বেড-সাইড টেবিলে রেখে ফারজাদের সামনে এসে বসল। এই শার্ট দিন তিনেক আগে পরেছে, এরপর আর আর্ম স্লিং খোলা হয়নি বাহু থেকে, শার্ট বদলানোও হয়নি। দ্বিজা বিপরীতে পিঠ করে সামনে বসে ধীর হাতে ফারজাদের শার্টের দুটো বোতাম খুলল। ফারজাদ জোরে শ্বাস নিলো দুটো এদিক-ওদিক তাকিয়ে।

ঘাড়টা আলগা করে তাতে আস্তে আস্তে তেল মালিশ করছে দ্বিজা। ফারজাদ মুখ বিকৃত করে ঘাঁড়টা কাত করে নিলো, “আহ! ঘাঁড় মটকে মারার প্লান আছে নাকি? অবশ্য পেত্নিরা মানুষ খু ন এই উপায়েই করে।ʼʼ

দ্বিজা দাঁত খিঁচে আরও জোরে চাপ দিলো। ফারজাদ আর্তনাদ করে উঠল। বামহাতটা ছড়িয়ে দিলো বালিশের ওপর। ঘাঁড়ে হাত দিয়ে তেলেতেলে জায়গাতে দু একবার আঙুল ঘুরিয়ে দ্বিজার হাতের সংস্পর্শ পেল, ওমনি এক ঝটকায় দ্বিজাকে ধরে সামনে এনে ফেলল। ভ্রু নাচিয়ে সন্দিহান কণ্ঠে বলল, “আজকাল এত সেবা-যত্ন করছিস কেন?ʼʼ

দ্বিজা খোঁচা দিলো, “কেউ ঘরে চ্যাগায়ে পড়ে আছে, সেবা করতে হবে না? এটা তো মানবতা! আপনার জায়গায় অন্যকেউ থাকলেও তাই করতাম।ʼʼ

ফারজাদ দ্বিজার হাত মুচরে ধরল, মাড়ি পিষল, “আমার ঘরে অন্যকেউ আসবে কী করে?ʼʼ

দ্বিজা আবার উঠতে যায় মালিশ করার উদ্দেশ্যে, ফারজাদ ব্যান্ডেজে মোড়ানো হাত দিয়ে টেনে ধরল দ্বিজাকে, “লাগবে না তোর সেবা। তোর সেবা তুই অন্য কাউকে কর।ʼʼ

দ্বিজার চুল খুলে গেছে, তা খোঁপা করতে করতে বলল, “আর ইউ জেলাস?ʼʼ

-“অল্প একটু।ʼʼ

দ্বিজা ভ্রু কুঁচকাল, “কী বিষয়ে?ʼʼ

-“আমার ফুপাতো বোন অন্য কারও চাকরানী করবে!ʼʼ

দ্বিজার হাসি বন্ধ হলো, “তার মানে আমি আপনার চাকরানী করছি?ʼʼ

-“আমার তো করছিস না, তুই যে কারও করছিস। এবং যে কারও মতো আমিও একজন অসুস্থ, হাত-পা হীন মানুষ তাই মানবতা দেখাচ্ছিস!ʼʼ

-“উকিল হবার ছিল আপনার।ʼʼ

সামান্য আনমনা হলো ফারজাদ, “উহু, ইঞ্জিনিয়ার।ʼʼ

-“ইঞ্জিনিয়ারদের তো এমন পয়েন্ট খুঁজে কথা বলার দরকার হয় না। তারা কৌশলে প্রকৌশলী করে নিজের পেশা চালায়।ʼʼ

ফারজাদ কথা বলল না। দ্বিজা নিজেও কিছুক্ষণ নিচে তাকিয়ে চুপ রইল, এরপর নিচু গলায় বলল, “বড়ো মামা, আর মামী কত আফসোস করে আপনি তাদের সাথে কথা বলেন না। মা-বাবাই তো!ʼʼ

ফারজাদ ঠোঁট একপেশে করে বাঁকিয়ে বলল, “এখানেই হয়ত তোর আর আমার পার্থক্যটুকু। চোখের সামনে দেখে এক মুহুর্তে সব ভুলে বাপের বুকে পড়ে কান্নাকাটি করা তুইটার কাছে এর চেয়ে ভালো মোটিভ বা এডভাইস পাওয়ার আশা রাখি না আমি।ʼʼ

দ্বিজার মন খারাপ হলো, একটাই দোষ ফারজাদের, ছোটো ছোটো বিষয়গুলো মনের ভেতরে ঠিক যতটা গাঢ় করে পুষে রাখে, বাইরে ততটাই হালকাভাবে ছেড়ে দেয়। বোঝাই যায় না আচরণে, সে কিছু ভারী পালন করছে! দ্বিজা আস্তে করে বলল, “আমি আপনার মতো ত্যাগী না, আমি একদম আপনার মতো না। আর..ʼʼ

-“আর?ʼʼ

মুখটা গম্ভীর হলো দ্বিজার, “আর আমার মনে হয় ঠিকও হয়নি আপনাকে চাওয়াটা! ভুল আপনার ছিল, আপনি সেদিন..ʼʼ

-“কী দেখে চেয়েছিস আমায়?ʼʼ

দ্বিজা উত্তর খুঁজে পেল না। বেশ কিছুক্ষণ পর দুদিকে মাথা নাড়ল, “জানি না।ʼʼ

ফারজাদ বলল, “অপশন দিই–রূপ, গুণ, পেশা, আচরণ, স্বভাব.. আব.. আর কী দেখে চাওয়া যায় মানুষকে?ʼʼ

দ্বিজা তাকাল ফারজাদের দিকে, হুট করে তার জবাব এলো, “রূপ!ʼʼ

দ্বিজাকে অবাক করে দিয়ে ফারজাদ হো হো করে হেসে ফেলল। দ্বিজা ভ্রু কুঁচকে অর্ধ হাসিমুখে চেয়ে থাকে ফারজাদেদ হাসির দিকে। এরকম হাসি দ্বিজা ফারজাদের বহুকাল দেখেনি। সে তখন খুব ছোটো ছিল, তখন বোধহয় ফারজাদ হাসতো এমন করে। মানুষ বদলায়, মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুকণার ন্যায় মানুষও প্রতিক্ষণে বদলায়। হাসি মুখেই বলল ফারজাদ, “রূপ! তো আমার লম্বা ঘন কালো চুল আছে, কাজল রাঙা চোখ, দুধে আলতা গায়ের রঙ, চিকন ঠোঁট..ʼʼ

দ্বিজা ফিক করে হেসে ফেলল। হাসি সামলে বলল, “মেয়েদের এসব থাকতে হয়, তা আপনি জানলেন কী করে? আপনি তো তাকানই না কারও দিকে।ʼʼ

-“উপন্যাস পড়ে ঔপন্যাসিকদের বর্ণনা থেকে জেনেছি। তোকে কে বলল আমি তাকাই না কারও দিকে?ʼʼ

-“আমাকে আর কার বলতে হবে? আমিই সকলকে বলতে পারব আপনার সমস্যা আছে। মানে চোখে।ʼʼ

ফারজাদ দ্বিজার দিকে দৃষ্টি আটকে কেমন বদমায়েশের মতো গা কাঁপিয়ে হাসল। দ্বিজার হজম হচ্ছে না ব্যাপারটা! এই লোকের যেকোনো কিছু রূপক হতে পারে, কোনো কিছুতে ভরসা নেই। যখন তখন এই হাসি বদলে যাবে তীব্র ক্ষোভে। তবুও সে অবাক হচ্ছে, ফারজাদের এমন প্রাণখোলা হাসিতে। লোকে বলে মেয়েদের হাসির ঝনঝন আওয়াজ নাকি পুরুষের বুকে ঝড় তোলে। ওরা বোধহয় পুরুষের বুক উজাড় করা হো হো হাসির আওয়াজ শোনে নি। যে কারও বুকে তুফান তোলার যোগাড়। ফারজাদের হাসির আওয়াজে একেকবার বিভাজন আসছে, দ্বিজা প্রতিবার নতুন করে মুগ্ধ হলো প্রিয় পুরুষটির ওপর। সে কেন চেয়েছিল লোকটাকে, জানে না। আর আজ ছাড়ার কোনো কারণও নেই তার কারণে। তার মুখে আনমনেই একটা চমৎকার মুচকি হাসি উদিত হলো। ঠোঁট বুজে হেসে বুক ভরে একটা শ্বাস নিলো, তার চোখ ভরে উঠতে চাইছে। ইচ্ছে করছে একবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে লোকটাকে। এই লোকটা কোনোদিন জানবে না, বেডে পড়ে থাকার দিনগুলো এই ছোট্ট মেয়েটা কীভাবে কাটিয়েছে।

হঠাৎ-ই ফারজাদের চোখ বুজে বেডে শুয়ে থাকা দৃশ্যটা মনে পড়তেই দ্বিজা সমস্ত নিয়ন্ত্রণ হারাল নিজের। আর্ম স্লিংকে উপেক্ষা করে তীব্র বেগে ছুটে পাড়ের দিকে আসা ঢেউয়ের মতোন আছড়ে পড়ল ফারজাদের বুকে। শক্ত চরে জড়িয়ে ধরে মুহুর্তের মাঝে হু হু করে কেঁদে উঠল। মানুষটা বসে আছে, কথা বলছে তার সঙ্গে, হাসছে—এটা সত্য। অথচ যদি মিথ্যে হতো! দ্বিজা আরও শক্ত করে চেপে ধরল স্বামীর গলাটা। ফারজাদ ব্যথা পাওয়া সত্ত্বেও বামহাতটা এগিয়ে নিয়ে মাথায় হাত দিলো দ্বিজার। কেমন করে যেন মুচকি হাসল, “জানিস! লোকে বলতো আমায় নাকি বোঝা যায় না, আমি পাগল। অথচ আজকাল আমি তোকে বুঝতে পারি না। কোনো কিছুরই কোনো সঠিক স্থায়িত্ব নেই যেন তোর।ʼʼ

-“বুঝতে চেষ্টাই করেন নি কখনও।ʼʼ

কপট গম্ভীর হলো ফারজাদ, “এতো ভারী হয়ে গেছিস তুই, যে তোকে বুঝতে আবার আলাদা করে চেষ্টা করতে হবে?ʼʼ

দ্বিজা জবাব দিলো না, পরখ সুখে ফারজাদের বুকের বাঁ পাশে মাথাটা আলগোছে রেখে চোখজোড়া বুজে নিলো। এ সুখ অবিনশ্বর, অক্ষয়, এই সুখ অনবদ্য! চিরকাল এখানে মাথা রেখে সুখের দিগন্তে ভেসে বেড়ানো যাবে, আর শোনা যায় দিগন্ত নাকি অসীম! অর্থাৎ এই সুখও অমর, শাশ্বত!
হালকা করে মাথা রেখেছে দ্বিজা, তবুও ফারজাদের বুকের মাঝে অবস্থিত হৃদযন্ত্রের ঢিপঢিপ আওয়াজটা কানে লাগছে খুব। খুব কাছে এসেছে নাকি সে, নাকি আন্দোলন চলছে কোনো কারণে এই বুকে! সে টের পেল বিটগুলো তার গালে মৃদু ধাক্কার মতো একটা পরশ দিচ্ছে।


ফারজাদ একরাতে ঘুমানোর সময় খুব অসুবিধা বোধ করছিল, এক টানে আর্ম স্লিংটা গলা থেকে বের করে ছুঁড়ে ফেলেছে, আর সেটা ঝোলায় না গলায়। বাহুর ব্যান্ডেজ খোলা হয়েছে। ক্ষত শুকাচ্ছে সেখানে, চটা পড়েছে। সপ্তাহ তিনেক হচ্ছে ফারজাদ গ্রামে এসেছে। এরমাঝে একবার ইরফানকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকা গেছিল ডাক্তার দেখাতে। ডাক্তার ভারী কোনো কাজে বেজায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। এবং খুব সাবধানে চলাচল করার পরামর্শসহ উত্তেজিত হতে নিষেধ করেছেন। ডিপার্টমেন্ট থেকে কলে খোঁজ খবর চলছে, খুব শীঘ্রই ডিউটিতে জয়েনে ডাকা হয়েছে। বাড়ির লোকে বিশেষ করে দ্বিজা আজকাল ঘুরিয়ে পেচিয়ে খুব বোঝাতে চায় এই পেশা ছেড়ে দিতে। আর না ফিরতে ঢাকা। সে এখান থেকে যাবে না, ওর এখানে সংসার করতে ভালো লাগছে, এটাকে সংসার মনে হচ্ছে। ঢাকায় যতদিন ছিল ততদিন মনে হয়েছে, সেও ফারজাদের কোনো কাস্টাডিতে বন্দি কয়েদি। কোনো পরিস্থিতিতেই তার এই বাড়ি থেকে যেতে ইচ্ছে করে না। বাপের বাড়ির চেয়ে এই বাড়ি তার বেশি আপন। ঢাকার চার দেয়ালের কোনো কারাগারে মরার মতো পড়ে থাকতে সে যেতে চায়না। যেকোনো পাবলিক কম্পানিতে চেষ্টা করলেই ফারজাদ ভালো পদে জব পেয়ে যাবে, তাছাড়া আজাদ সাহেবের আড়ৎ তো রয়েছে। কতশত লোক আয় রোজগার করে খাচ্ছে সেখানে।

ফারজাদের কানে তুলো। সে ঘুরছে-ফিরছে, সিগারেট টানছে, মাঠের আল ধরে হাঁটতে যাচ্ছে, বই পড়ছে, দ্বিজার সাথে ঝগড়া করছে, ওষুধগুলো নিয়মিত খাচ্ছে না, প্লান প্রোগ্রাম করছে টুস করে ঢাকা ফিরে যাবার—চলে যাচ্ছে তার দিন।

আজাদ সাহেব বিশাল অনুষ্ঠান করবেন এবার ছেলের বিয়ের। তাতে হয়ত ছেলের মনটা ঠিক হবে! ঠিক না হোক! ওরকম ত্যাদড় ছেলে জন্মানোর পর তার মন ঠিক হবার আশা না রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ! কিছু মানুষ এতো জটিল মানসিকার হয়, যাদের বুঝতে নতুন করে বোঝা শিখতে হয়। সেসব লোকের সাথে ওত বোঝাপড়া না করতে যাওয়া ভালো। কোনকালে কবে কী হয়েছিল, ওরকম তো সব বাপ-মা সন্তানকে ধিক্কার দিয়ে থাকে, এখন তা যদি সে সইতে না পারে, তাতে আজাদ সাহেব আর করবেনই বা কী? বাপ-মায়ের মনের কষ্ট বোঝে না নিজে, আবার বলে কয়ে বেড়ায় তাকে কেউ বোঝে না। দরকার নেই অত বোঝাবুঝির। জিদ করে এই ঝুঁকিপূর্ণ চাকরিতে ঢুকেছে। সে যা ইচ্ছে করুক। বাপ হিসেবে তার দায়িত্ব তিনি পালন করবেন। লোক দাওয়াত করা হয়ে গেছে। বাজার টুকটাক প্রতিদিনই করছেন। গত রাতে ফারজাদের সঙ্গে আলাপ করতে গেলেন এ বিষয়ে, তার নাকি কোনো মতামতই নেই এ ব্যাপারে। সে যাচ্ছে ইরফানকে সঙ্গে নিয়ে গোমতী নদীর চড় দেখতে।

রাতের বেলা এসেই হাঁকডাক পেরে দ্বিজাকে ডেকে নিজের ঘরে ডেকে নিলেন আজাদ সাহেব। সকলেই এসে বসল তাকে ঘিরে। একটা মেজেন্টা আর নীলের মিশ্রনে জামদানী কাতান এনেছেন। সেটাই আগে বের করলেন। দ্বিজার চোখ জুড়িয়ে যায় তা দেখে, মেয়েরা অবাক চোখে তাকিয়ে দেখল নেড়েচেড়ে শাড়িটা। কোনো খবর ছাড়াই নিজেই দুটো শাড়ি কিনে এনেছেন আজাদ সাহেব। অপরটা বের করে আরও মুগ্ধ সকলে। লাল টুকটুকে বেনারসী। বেজায় দামী একখান শাড়ি, বিয়ে শাড়ি। দ্বিজার কেন জানি আনন্দে কান্না আসছে। সে কাঁদল না। আরেকটা ব্যাগে গয়নার বাক্স। কানের দুল, গলার হার, রুলী বালা, ছোট্ট একটা সোনালী চকচকে নাকফুল। অবাক হয়ে প্রশ্ন করল দ্বিজা, “কবে এসব বানাতে দিয়েছ, মামা?ʼʼ

-“তা জেনে তোর কী? আমি পরবি, আমি দেখে পরান জুড়াব। ওই বাদররে কস, কাল ওর শেরোয়ানী কিনতে যাব আমার সাথে যেন যায়।ʼʼ

রাতে ঘুম আসছে না দ্বিজার। চোখের সামনে অলংকার আর শাড়ি গুলো নাচছে। হাত-পা শিউরে শিউরে উঠছে, কখন সেসব গায়ে পরবে, সাজ পুরো হলে তাকে দেখতে খেমন লাগবে? কয়টা ছবি উঠবে, কী কী ভাবে উঠবে? এই পানসে লোক কি ছবি উঠবে তার সাথে? ফারজাদ বলল, “লাইট বন্ধ করবি নাকি মুখ আলো দিচ্ছিস আমার?ʼʼ

-“মুখ আলো দেয়া কী?ʼʼ

-“সনাতন ধর্মীরা ঠাকুর ঘরে আলো জ্বালিয়ে রাখে, সেটাকে মেইবি মুখ আলো দেয়া বলে। আমি সিওর না।ʼʼ

-“আপনি ঠাকুরের চেয়ে কম কীসে?ʼʼ

-“নাহ! অতটাও অনুভূতিহীন না আমি।ʼʼ

-“ঠাকুর বরং আপনার অতখানি অনুভূতিহীন হতেই পারবে না কখনও।ʼʼ

ফারজাদ দ্বিজার গালে মৃদু থাপ্পড়ের মতো মেরে ওকে ধাক্কা দিলো, “সর এখান থেকে।ʼʼ নেমে দাঁড়িয়ে বলল, “বিছানা ঠিক করে দে, ঘুমাব।ʼʼ

-“বড়ো মামা আমাদের..ʼʼ

-“হু! বিশেষ কিছু তো না। অনুষ্ঠান হবে, তাই বলে কি আজ থেকেই ঘুমানো যাবে না, এরকম নিয়ম আছে? ঘুমাব আমি!ʼʼ

দ্বিজা মুখটা এমন করল, ফারজাদ বলল, “সেন্টি খাচ্ছিস কেন? রাতে ভাত খাসনি?ʼʼ

দ্বিজা হাত পা ছুঁড়ল, দু’দিকে অনবরত মাথা ঝাঁকাল, “ভাই! আমি আপনার সাথে থাকব না। আমি বাড়ি যাব, বিশাল ভুল করেছি, আপনার মতো আধমরা পাবলিকের সাথে জীবন কাটানো অসম্ভব। আমি এখন বেঁচে আছি, জীবিত, সামাজিক একটা মানুষ, শখ-আহ্লাদ আছে আমার, জোয়ান মানুষ আমি, সবচেয়ে বড়ো কথা স্বাভাবিক মানুষ আমি। ঘাটের পানির মতো স্বাদহীন, অজীবিত, ভাইরাস টাইপের জীব-জড়ো অবস্থার লোকের সাথে এ জীবন কাটবে না আমার। সো ব্রো, ক্ষমা চাই, দোয়াও চাই।ʼʼ

ফারজাদ শব্দ করে হেসে ফেলল গা দুলিয়ে, “এজন্য বলা হয়, রিলেশন সেম এইজ হলে ভালো হয়। বয়স হচ্ছে তো আমার, এখন আর এসব ভাল্লাগে না, বুঝলি!ʼʼ

এমনভাবে বলল কথাটা ফারজাদ, দেখে অভিনয়টা একদম সত্তর বছরের বুড়ার মতো লাগল। দ্বিজা হাসার বদলে গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করল, “বয়স কত আপনার?ʼʼ

-“যাই হোক, ঠিক বয়সে বিয়ে করলে আমার মেয়ের সাথে স্কুলে যেতে পারতি তুই।ʼʼ

-“হু, খুবই খাঁটি কথা বলেছেন একখান। কিন্তু আপনাকে তো আর মামা চার-পাচ বছর বয়সে বিয়ে দিতো না, তারপর ধরুন পরের বছর মেয়ে হলে, তার সাথে স্কুলে যেতাম আমি। আর ওয়েট ওয়েট, ধরুন দিলোও বিয়ে, তখন সেই বয়সে আপনার বাচ্চা হতো?ʼʼ

কথাটা বলতে বলতে না চাইতেও হেসে ফেলল দ্বিজা। ফারজাদ বলল, “আমার তো এ কালেও হবে না। আমার বউয়ের হতো।ʼʼ

মুখ ফেরাল দ্বিজা, “সেই ক্যাপাসিটি থাকে না, ভাই ওই বয়সে।ʼʼ

-“তুই বিয়ের আগে জীবনে ভাই বলিসনি, এখন ভাই ভাই করে যাচ্ছিস! ব্যাপার কী? ভাই ভাই গন্ধ বের হচ্ছে আমার গা থেকে?ʼʼ

দ্বিজা চোখ উল্টালো, “তখন মনে রঙ ছিল, জানতাম না আপনাকে। তাই বহুত ভুলভাল রঙ-বেরঙের সঙ লেগে থাকতো মনে। অথচ বিয়ের পর আপনার ভাবসাব দেখে দেখে যা বুঝেছি, আপনি ভাইয়ের চেয়েও বড়ো ভাই, মানে নানা যাকে বলে।ʼʼ

ফারজাদ নিঃশব্দে হাসল, “এত রঙহীন আমি?ʼʼ

-“উহু, রঙহীন না। সিরিয়াস না আপনি কোনো বিষয়ে! মানে কোনো কিছুতেই আনন্দ বা দুঃখ হয়না আপনার! অথচ ছোটো ছোটো বিষয় ধরে রেখে বছরের পর বছর শোক পালন করে যান মনে মনে।ʼʼ

ফারজাদ হাসল। লুঙ্গি পাল্টে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরল। এরপর বলল, “চল, হেঁটে আসি।ʼʼ

-“অন্ধকার তো রাস্তায়।ʼʼ

-“এজন্যই যাব।ʼʼ

অন্ধকারে ঢাকা প্রকৃতি। রাস্তা থেকে দুপাশে খুব বেশি দূরে নয় বিস্তর মাঠ। থেকে থেকে ওদিক থেকে শেয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে। পাশাপাশি হাঁটছে দুজন, মাঝখানে অল্প ফাঁক। দ্বিজার মনে পড়ল শীতের সেই সকালের কথা, ওইদিনই বোধহয় প্রথম এই লোকটার জন্য বুকে হৃদযন্ত্রের অন্যরকম স্পন্দন টের পেয়েছিল সে। মুখে যত যা-ই বলুক, ফারজাদের এই নির্লিপ্ত চিত্তই তো যত আকর্ষণের মূলে রয়েছে। কর্তব্য ও দায়িত্বে মানুষটা গ্রামের কর্মঠ ছেলে, পেশাগত ও ভাবসাবে সাহেব, মানসিকভাবে ঠিক গম্ভীর নয়, তবে একটু দায়সারা, তীব্র চাপা অভিমানী। মায়া মায়া লাগে খুব। বুক ভরে শ্বাস নিলো সে। গ্রামের খোলা মাঠের শীতল হাওয়া বুক অবধি ভিজিয়ে দিলো। এই মানুষটাকে হারানোর পর বেঁচে থাকার সাধ্যি নেই ওর। এই যে প্রতিদিন নিয়ম করে যুক্তিতর্কে মিলিয়ে দুজন ঝগড়া করে, এর বেশি চাওয়া কিছু নেই ওর।

দ্বিজার বাঁ হাতের আঙুলে শক্ত করে আঙুল ঢুকিয়ে জোট পাকাল ফারজাদ। দ্বিজা একটু চমকে উঠল। কথা বলল না। হাটতে হাঁটতে ফারজাদ হঠাৎ-ই বলল, “হুমায়ুন আহমেদ কী বলেছিলেন জানিস? ‘যে ভালোবাসা যত গোপন, সেই ভালোবাসা তত গভীর।ʼ কাউকে ভালোবাসতে, তার জন্য ছটফট করতে, কোনো নির্দিষ্ট সময় বা কাল নির্ধারণ অথবা ঢাকঢোল পিটিয়ে বিশেষ আয়োজনের প্রয়োজন নেই। সেটা হয় আনুষ্ঠানিকতা, ভালোবাসা না। ভালোবাসায় কিছু আনুষ্ঠানিকতা ক্ষেত্রবিশেষ থাকতে পারে, তবে আনুষ্ঠানিতায় ভালোবাসা থাকে না। কবে, কখন, কীভাবে জানি মানুষের মনে কারও জন্য একটা গভীর বিস্তৃত জালের মতো মায়া ছড়িয়ে পড়ে, তা থেকে মানুষ চাইলে দূরে থাকতে পারে, তবে জালের সীমানা ছেড়ে মুক্ত হতে পারে না আজীবন। অনুভূতি প্রকাশমূলক কথাগুলো কাউকে সামনে বসিয়ে তার চোখের দিকে তাকিয়ে কীভাবে বলা যায়, জানা নেই। আসলেই বলা যায় কি-না তাও জানা নেই আমার। ভালোবাসার ভাষা নেই, ভাষায় ভালোবাসা নেই। আমি প্রেমিক নই, সাধারণ ছেলে। প্রেমিকেরা বিশেষ কিছু হয় বোধহয়, আমি খুব অ-বিশেষ। তোকে ছাড়তে পারব না, বিশ্বাস কর তুই চলে গেলে ধরতে যাব না। ফিরে এসে নাও পেতে পারিস, হতে পারে মানিয়ে নিলে আমার সর্বস্ব পেয়ে যেতে পারিস।ʼʼ

চলবে..

[রিচেইক করিনি। ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে