তপ্ত সরোবরে পর্ব-৩৪

0
452

#তপ্ত_সরোবরে
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৩৪.

প্রকৃতিতে বৃষ্টি নেমেছে ঝিরঝিরিয়ে। সকাল থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। ফারজাদের ঘুমটা ভাঙল বুকের ওপরে টনটনে ব্যথায়। বেশ বেলা হয়েছে, রাতে ব্যথার ওষুধ খেয়ে ঘুমানোর পর সকালে ডাক্তার ডাকতে নিষেধ করেছেন। নরম, স্যুপ জাতীয় খাবার দেবার কথা বলা হয়েছে। স্যুপটা বানিয়ে দিলো ফারিন। দ্বিজা রুমে এসে দেখল, চোখ খুলে শুয়ে আছে বিছানায় ফারজাদ। দূর থেকে মানুষটার দিকে তাকিয়ে দুটো বড়ো শ্বাস ফেলল। আজ নিজেকেসহ আশপাশের সবকিছু অন্যরকম লাগছে। এ বাড়িতে এর আগের বারও সে শুধু মেয়ে হিসেবে এসেছে, আজ এই রুম, গোটা বাড়ির বড়ো ছেলের বউ সে। দেখতেও তেমনই লাগছে– হাতে চুড়ি, মাথার ওড়নাটা পড়ে গেছে, চুলে খোঁপা, অবাধ্য চুলগুলো আশপাশ দিয়ে বেয়ে আছে, গতকাল রাতে একটা চেইন পরিয়ে দিয়েছেন গলায় ফারহানা বেগম।

সারারাত একসাথে শুয়ে থাকার পরেও কোনো কথা বলেনি ফারজাদ। একটুও কি ইচ্ছে হয়না লোকটার, দ্বিজাকে কাছে ডাকতে? শরীরটা শিরশির করে উঠল কেমন যেন! টেবিলের ওপর স্যুপের বাটি রেখে ফারজাদকে ডাকল মৃদু স্বরে, “উঠেন, এটা খেয়ে ওষুধ খেতে হবে।ʼʼ

ফারজাদ কথা বলল না। পিঠটা বিষব্যথা হয়ে আছে, উঠতে গেলে নিশ্চিত তীব্র যন্ত্রণার মুখে পড়তে হবে। উঠার চেষ্টা করতেই মুখ-চোখ বিকৃত হয়ে এলো তার। দ্বিজা গিয়ে ডাহবাহু চেপে ধরল। ফারজাদ নিরস মুখে একবার তাকিয়ে ওভাবেই উঠে দাঁড়াল। মাথা ঝিমঝিম করছে, এন্টিবায়োটিকের কড়া প্রভাব দেহে। ব্যান্ডেজ লাগানো বাঁ হাতটা এগিয়ে এনে দ্বিজার হাতটা বাহু থেকে ছাড়িয়ে দিলো। আস্তে আস্তে নিজেই হেঁটে বাথরুমে ঢুকল।

দ্বিজা মাথা নত করল, পরপর কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানা গোছাতে আরম্ভ করল। ফারজাদের ঘরের চারপাশে বইয়ের স্তুপ বলা চলে। ইংরেজি বই, সাথে আরও কী কী বই সব। আলমারীটা খুলে সকালে ভাজ করা জামাকাপড়গুলো ঢুকিয়ে পাল্লা আটকানোর সময় ফারজাদ বের হলো।

দ্বিজা খাইয়ে দিলো স্যুপটুকু, নিঃশব্দে বোবার মতো খেল ফারজাদ। দ্বিজা যখন গায়ের ওড়নার প্রান্ত তুলে মুখ মুছিয়ে দিতে গেল, ফারজাদ ওড়নাটা কেঁড়ে নিলো। নিজেই মুখটা মুছে বলল, “ওষুধ পরে খাচ্ছি, পানি রেখে যা বেডসাইড টেবিলের ওপর।ʼʼ

লাবন্য এসে বসল ফারজাদের সামনে। দ্বিজা ঘর ঝাড়ু দিচ্ছে তখন। পিঠের পেছনে বালিশ খাঁড়া করে হেলান দিয়ে বসে আছে ফারজাদ। লাবন্য জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছেন এখন?ʼʼ

ফারজাদ হ্যাঁ-বাচক ঘাঁড় ঝাঁকাল একবার, “তোর কী অবস্থা! পুচকে পুচকে মেয়েরা সব বউ, মা হয়ে যাচ্ছে। শরীর ভালো?ʼʼ

লাবন্য লজ্জা পেল। দ্বিজা পেছন ফিরে তাকাল একবার, আবার ঘরের নোংরাটুকু ঝেটিয়ে নিয়ে বাইরে চলে গেল। লাবন্য জিজ্ঞেস করল, “কেমন চলছে আপনার?ʼʼ

-“জানিস তো, আমার কোনোসময় খারাপ চলে না।ʼʼ

মুখ ফিরিয়ে হাসল লাবন্য, “তা তো বটেই, আপনি অলওয়েজ ফাইন।ʼʼ

-“এক্সাক্টলি!ʼʼ

একটু সিরিয়াস হলো লাবন্যর মুখভঙ্গি, “তা নাহয় সবার কাছে। আমি তা মানি কী করে?ʼʼ

-“তুই আবার বিশেষ নাকি আমার কাছে?ʼʼ

লাবন্যর অপমানিত বোধ করার কথা থাকলেও সে হাসল, গভীরতা টেনে বলল, “কেমন আছেন?ʼʼ

ফারজাদ খোলা জানালা দিয়ে বাড়ির পেছন দিকে তাকাল। দোতলার জানালা দিয়ে মেঘলা আকাশ দেখা যাচ্ছে, বৃষ্টি অবশ্য নেই এখন। সেদিকে চেয়ে বলল, “যেদিন থেকে জীবনের উদ্দেশ্য হারিয়েছি, এরপর থেকে বহুদিন বাঁচি না। কতবছর বাঁচা হয়না আমার।ʼʼ

লাবন্যর বুক ভার হলো, নিঃশ্বাসের ওজন বাড়ল, “সবার কি স্বপ্ন পূরণ হয়?ʼʼ

-“না, হয়না।ʼʼ কিছুক্ষণ চুপ রইল ফারজাদ, হুট করে আবার বলল, আজকাল কী মনে হয় জানিস? আমি আসলেই বেশি বেশি। আমার এই তীব্র অভিমান, জিদ, আত্মত্যাগ, দম্ভ, আমার ভেতরের চাপা আমিটা সবই অমূলক। যা কেউ বোঝেনা, যে-সবের মূল্য নেই এই মূখ্য সমাজে, সেসব কেন বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি। শুধু শুধু অনেকগুলো বছর নষ্ট করেছি। আজকাল নিজের ওপর অতিষ্ট হয়ে পড়েছি। এসব ভালো লাগছে না আমার।ʼʼ

-“এত ভারী কথা বলবেন না সবসময়। খুলে কথা বলতে পারেন না? কী বোঝাতে চাইছেন? আপনি যা পুষছেন ভেতরে, যা সয়ে যাচ্ছেন সর্বক্ষণ, তা বোঝার লোক নেই বলে সেসব মূল্যহীন, সেসব ঝেরে ফেলতে হবে, তাই তো?ʼʼ

লাবন্যর ধমকে ফারজাদ হাসল, “ঠিক বলেছিস! আমি বেশিই দার্শনিক হয়ে উঠেছি জীবনে। যার কোনো ভিত্তি নেই।ʼʼ

-“একথা আগে মাথায় আসেনি কেন? দেখুন, মানুষ আপনার বুকে লাগা বুলেটের আঘাত দেখে তো হা-হুতাশ করবে, চিৎকার করে কাঁদবে। ভেতরে সব পুড়ে একমুঠো ছাই হওয়া শূন্যস্থান চিড়ে বেরিয়ে আসা ধোঁয়াটুকু মানুষের বিরক্তির কারণ হবে শুধু। তাই বলছি, হয় বনবাসে যান, নয়ত স্বাভাবিক জীবনযাপন করুন। আপনার আচরণ সকলের কাছে চরম বিরক্তির, সকলের ভাষায় অমানুষিক আচরণ বলে গণ্য। কী দরকার এভাবে জীবন-যাপনের?ʼʼ

ফারজাদ কপট বিরক্ত হলো, “তুই জ্ঞান দিচ্ছিস আমায়? যা, যা এখান থেকে।ʼʼ

-“আমার কোনো শখ নেই আপনার মতো পাগলের কাছে বসে থাকার।ʼʼ

লাবন্য উঠে গেল। ফারজাদ হেসে ফেলল, মলিন হাসি নাকি তাচ্ছিল্যের, তা বোঝার উপায় নেই। ওষুধগুলো খেল না। বুকে ব্যথা করছে। কেন জানি ইচ্ছে করল, দ্বিজাকে ডেকে এনে সামনে বসিয়ে রাখতে, ডাকল না। ওষুধ খেলে শরীর ঝিমিয়ে আসবে, বমি পাবে। ওষুধ না খেয়ে উঠে দাঁড়াল টলমলে পায়ে। হেটে গিয়ে বারান্দায় রাখা চেয়ারে বসে পড়ল। চেয়ার ভেজা ছিল, তাতে কী! মেঘ কেটে যাচ্ছে, দেখে মন খারাপ হলো তার। তবুও কেমন করে যেন চেয়ে রইল আকাশের দিকে।

চোখের সামনে ভেসে উঠল তিতকুটে এক অতীত। উত্তরাতে থাকার সময় প্রায় দিন ঘন্টাখানেক সময় ব্যয় করে চলে যেত ফারজাদ পলাশীতে। বুয়েট ক্যাম্পাসের বাইরে গিয়ে উত্তেজিত চোখে চেয়ে থাকতো বিল্ডিংগুলোর দিকে। দারোয়ানকে দেখে ভাবত, আজ তো ঢুকতে দিবে না, একদিন এমন আসবে দাপট করতে করতে ঢুকব এই ক্যাম্পাসে। তিতুমীর হলের সামনে দাড়িয়ে ভেতরের বিল্ডিংয়ের সারি সারি কামরার দিকে তাকিয়ে ঠিক করতো, সে এডমিট হবার পর কোন রুমটা পেলে ভালো হয় এখানে! রুম ঠিক করা ছিল হলের, যে হলেই সিট পাক, ওই রুমে জায়গা নেয়ার চেষ্টা করবে। জীবন এমন কেন! চাওয়াগুলো এভাবে ধোঁয়া হয়ে যায়, পেছনে ফেলে বহুদূর চলে আসার পরেও পিছু ছাড়ে না সেই পাগলাটে আকাঙ্ক্ষাগুলো!

ছটফটিয়ে উঠল ফারজাদ। আশ্চর্য! আজও কেন চোখে জল জমবে? সাত বছর পেরিয়ে গেছে! আজও কেন বুক পুড়বে? কী মসিবত! দ্রুত চোখদুটো আঙুল দিয়ে হিংস্র হাতে চাপ দিয়ে ধরল। চোখের মণিদুটো লাল হয়ে উঠেছে। ওই তরুণ জীবনের ব্যর্থতাগুলো পিছুই ছাড়ে না আজীবন! কী করার আছে! ভাবনায় এলো, বেঁচে আছে কেন সে? এই যে মাঝেমধ্যেই এই যন্ত্রণা ওঠে ভেতরে, সহ্যক্ষমতার সীমা পেরিয়ে যায়, তারমানে সহ্য করা যায় না। অসহ্য এই যন্ত্রণাকে উপশম করতে মৃত্যুর বিকল্প নেই। ফারজাদ অবাক হলো নিজের ভাবনার ওপর। এই চিন্তা বহুদিন পর এলো আজ। আগে আসলে বহুবার কড়া নেশা সেবন করে তখনকার জন্য চুপ করিয়েছে নিজেকে। ডাক্তার বলেছিলেন, “তুমি প্যানিকে আছো, ফারজাদ। এসব ভাবনা এলে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। কাউকে এসব বলতে যাবে না। মানুষ বুঝবে না, উল্টো তোমায় ডিস্ট্র্যাক্ট করবে।ʼʼ

‘ব্যর্থতা পাগলামিতে পরিণত হয় কখন?ʼ এই প্রশ্নের জবাবে মানসিক ডাক্তার বলেছিলেন, যখন ব্যর্থতাটা মেনে নেয়ার মতো হয় না। সফল হবার হয়ত সবরকম ওয়ে তোমার ছিল, তবুও কোনো এক এক্সিডেন্ট! সময় ভয়াবহ প্রবাহমান এক চলক। সঠিক সময়ে কাজে না লাগিয়ে পেরিয়ে এসেছ, আর সেই শূন্যতা তোমায় ক্ষয় করছে। সবসময় ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করবে।ʼʼ

ফারজাদের হাতে কেউ হাত ছোঁয়াল। চমকে উঠল, তড়াক করে চোখ মেলে তাকাল। দ্বিজা নিজেও চমকে উঠল ফারজাদকে এভাবে চমকে উঠতে দেখে। ওষুধ খুলছে মেয়েটা, সামনের টুলের ওপর পানির জগ ও গ্লাস এনে কখন রেখেছে, টেরই পায়নি ফারজাদ। দ্বিজা ওষুধ এগিয়ে দিয়ে বলল, বেলা কত হলো, সকাল নয়টার মধ্যে সকালের ওষুধ খাওয়ার কথা বলেছেন ডাক্তার।ʼʼ

ফারজাদ ওষুধগুলো গিলল কোনোমতো। শরীর ভালো লাগছে না। দ্বিজা হঠাৎ-ই ভেজা গামছাটা দিয়ে সযত্নে ফারজাদের মুখ, গলা মুছিয়ে দিতে লাগল। ভড়কাল ফারজাদ, “আরে! উহফ! কী করছিস? সরা এসব।ʼʼ

নিজের কাজ করতে করতে দ্বিজা বলল, “ঘরে চলুন। ওষুধ খেয়েছেন, এখন শুয়ে থাকতে হবে আপনার।ʼʼ

-“এসব লাগবে না আমার। তুই নিজের কাজে যা।ʼʼ

-“আমার কাজ কী? ঘরে অসুস্থ স্বামীকে ফেলে রেখে কোথায় কোন কাজে যাব?ʼʼ

ফারজাদ চোখ তুলে তাকাল, মেয়েটা একদিনে যেন বিশাল বড়ো গৃহিনী হয়ে উঠেছে, নাকি ভাব ধরেছে সেরকম! আবার পাল্টি খাবে! এসব কী ধরণের কথাবার্তা! অসুস্থ স্বামী! কথাটা কেমন যেন অদ্ভুত শোনাল ফারজাদের কানে। দ্বিজার স্বরও কেমন আবেদনময়ী লাগল শোনাল। মেয়েটা কী করছে, কী চলছে তার ভেতরে! মেয়ে মানুষ এত রূপক হবে কেন? ফারজাদকে ধরে এনে বিছানায় বসাল দ্বিজা। আবার বৃষ্টি শুরু হলো বাইরে। জানালার কাঁচ পেরিয়ে বৃষ্টির ঝাপটা এসে বিছানায় পড়ছে। কাঁচটা লাগিয়ে দিলো দ্বিজা। বারান্দায় বসে থেকে মাথায় ছিটেফোঁটা পানি পড়ে চুলগুলো ভিজে গেছে। কতটা আক্কেল-জ্ঞানহীন হলে মানুষের শরীরে জ্বর থাকা সত্ত্বেও এভাবে বারান্দায় বসে থাকতে পারে। তোয়ালেটা এনে মাথার চুলটা মুছে দিলো দ্বিজা। পাশে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ ফারজাদের চুল নেড়েচেড়ে দিলো, চুলগুলো আলতো টেনে দিলো। যেভাবে ছেলেরা চুল সেট করে সেভাবে চুলগুলো গুছিয়ে, আবার এলোমেলো করে নাড়তে থাকল, কপালের দুপাশ টিপে দিলো।

ফারজাদ বালিশে হেলান দিয়ে বসে খাটের বক্সের সাথে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুজে আছে। তার খারাপ লাগছে না এই সেবাটুকু। মাথায় ঝিমুনি ধরে আসছে, এই ম্যাসাজটুকু খুবই দরকার এই সময়। যা সে পাচ্ছে, তবে অপ্রস্তুত লাগছে বিষয়টা। কপালটা আলগোছে জড়িয়ে ফেলল, এই মেয়ে এসব অদ্ভুত আচরণ করছে কেন? কাল দাদির কাছে বহুক্ষণ সময় কাটানোর ফল নিশ্চিত! এসব পতিসেবা কে শিখিয়েছে ওকে! ধরে বেঁধে স্বামীর খেদমতে লেগে পড়েছে সকাল থেকে!

চোখ বুজে থেকে কঠিন এক ঢোক গিলে বলল, “দরজার পর্দা টেনে দরজা চাপিয়ে দিয়ে আয়।ʼʼ

দ্বিজার গা’টা অজান্তেই শিউরে উঠল একটু। নিঃশব্দে গিয়ে দরজাটা চাপিয়ে এসে আবার হাত দিলো ফারজাদের মাথায়। এর মাঝে ভেজা চোখদুটো মুছে ফেলেছে ওড়নায়। ফারজাদ বামহাতে দ্বিজার হাতটা চেপে ধরে ঘুরিয়ে টেনে এনে বিছানায় নিজের পাশে বসাল। দ্বিজার থুতনি নত হয়ে গলায় ঠেকেছে। ফারজাদ চোখ খুলে তাকাল, দ্বিজার কান্না দেখে আকস্মিক মাথা গরম হলো, “কাঁদছিস কেন? তোকে বলেছি এতো সেবাযত্ন করতে? সেবা করতে ভাল্লাগছেনা করবি না, তাই বলে কেঁদেকেটে সেবার করতে হবে?ʼʼ

দ্বিজার নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হলো, কতটা অবুঝ আর ত্যাড়া হলে একটা মানুষ সোজা বিষয়ের এমন উদ্ভট মানে বের করে? লোকটা ইচ্ছে করে এসব করে! নয়ত আর কী? সে জবাব দিলো না। ফারজাদ টান করা পা গুছিয়ে, গোছানো পা’টা সটান করে দায়সারা ভঙ্গিতে বলল, “পা টিপে দে, ঘুমাব আমি। আর যদি কান্না পায়, তাহলে বের হয়ে যাবি। ফারিনকে পাঠাবি।ʼʼ

অবহেলা এটা? দ্বিজার নাকের পাটা ফুলে আবার নেমে গেল। টুপ এক ফোঁটা জল নাকের ডগা থেকে বিছানার চাদরে পড়ল। ফারজাদ মহাবিরক্ত হলো, “কী সমস্যা! কাঁদছিস কেন? কেউ মরেছে? মেয়ে মানুষ ঢঙ্গি হয় কেন, বলতো আমায়? খুব আগ্রহী আমি এই প্রশ্নের উত্তর পেতে। এতো অপ্রয়োজনীয়, লোক দেখানো আবেগ, আর মুহুর্তে মুহুর্তে সেই আবেগের স্থল পরিবর্তনটা কি মেয়েলোকের গঠনগত স্বভাব।ʼʼ

মাথা তূলল না দ্বিজা। ফারজাদের মেজাজ চড়ে গেল বোধহয়, “জবাব দে!ʼʼ বন্ধ ঘরে কথাটা বাজ পড়ার মতো গর্জে উঠল যেন, দাঁত খিঁচে বলল, “মরাকান্না জুড়েছিস কেন? মরিনি এখনও, বেঁচেই আছি তোদের ন্যাকা আবেগের ঠেলায়। আর কাঁদিস না, চোখ মুছে ফেল। লুক, লক এট মি, আ’ম এবস্যুলিউটলি ফাকি** ফাইন!ʼʼ

বকে উঠল ফারজাদ। কীসের যেন চাপা ক্ষোভ খানিকটা প্রকাশিত হয়ে গেল হুট করে। জোরে জোরে দুটো শ্বাস নিলো। এরপর আপনা-আপনিই চাপা স্বরে বলতে লাগল, “আমিও কতবড়ো বোকা শালা! ভালো থাকতে চেয়ে বসি মাঝেমধ্যেই। ভালো থাকার যে ক্যাপাসিটি লাগে, তা-ই তো নেই আমার মধ্যে। তুই এখন আদিক্ষেতা আসছিস, পুরো বাড়ি স্নেহের জোয়ারে ভাসছে। আমার সহ্য হয়না এসব লোক দেখানো পিরিত।ʼʼ

দ্বিজার মন হলো, ফারজাদের মানসিক ভারসাম্য একটু হলেও সটকে গেছে এই মুহূর্তে। তার নিজের আচরণে নিজের নিয়ন্ত্রণ নেই আপাতত। কী বলতে চাইছে, কী দেখাতে চাইছে অথবা করতে চাইছে, তা নিজেই মেলাতে পারছে না। সে একটু নত হলো, পা এগিয়ে নিলো ফারজাদের। ফারজাদ বলল, “পা টিপতে হবে না, রাখ!ʼʼ

কণ্ঠটা একটু দুর্বল লাগল শুনতে। ওষুধ খেয়েছে একগাদা। এখন এতো উত্তেজিত হওয়া মোটেও ঠিক হয়নি তার। বুকের ডান পাশ চেপে ধরল বামহাত দ্বারা। দ্বিজা উঠে দাঁড়াল ফারজাদের পাশে। বালিশ ঠিক করে দিতে দিতে বলল, “পরেও তো চেঁচানো যেতো, আমি তো আর ভেগে যাচ্ছি না।ʼʼ

ফারজাদের ইচ্ছে করল, ঠাস করে একটা চড় লাগাতে দ্বিজার গালে। এই যে মাঝেমধ্যেই ম্যাচিউর, মাত্রাতিরিক্ত ধৈর্য্যশীল মেয়েদের মতো আচরণ করে, এখানেই তো বিভ্রান্ত হয় ফারজাদ। একবার হয়েছিল, এরপর তার মাশুল গুনেছে আর হবে না। একরত্তি দুর্বলতা আসতে দেবে না ফারজাদ এই বহুরূপী মেয়ের ওপর। মাথা কাজ করছে না মনে হলো, গোলমেলে লাগছে সবকিছু। দ্বিজা আস্তে করে ধরে শুইয়ে দিলো বালিশে। চলে যেতে উদ্যত হলে হাত ধরে পাশে বসাল ওকে ফারজাদ।

মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ফারজাদের দিকে পূর্ণদৃষ্টি মেলে তাকাল ফারজাদের মুখের দিকে। চোখের নিচে কতখানি গর্ত হয়ে তাতে কালো দাগ পড়েছে। ফ্যাকাশে রক্ত শূন্য মুখটা। দাড়ি-গোফ অযত্নে বেশ বেড়ে গেছে। সবসময় ফিটফাট ফারজাদের মুখের নকশা বদলে ফেলেছে অসুস্থতা। সরু নাকের ডগায় ঘাম জমে আছে, ভ্রুটা কুঁচকে আছে হালকা। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপালে পড়ে আছে। কপাল থেকে চুলগুলো সরিয়ে পেছনে ঠেলতে ঠেলতে একদৃষ্টে চেয়ে রইল অদ্ভুত দুর্বোধ্য মানুষটাদ দিকে। হুট করে নির্লজ্জ এক ইচ্ছে জেগে বসল, ফারজাদের কপালে সিক্ত একটা চুমু খেতে ইচ্ছে করল। সে এমন হয়ে যাচ্ছে কেন? আজকাল ফারজাদের গা ঘেষতে মন চায় অবচেতনায়। দৈহিক একটা আকর্ষণ বোধ করতে শুরু করেছে এই পুরুষটার প্রতি সে। মাঝেমধ্যেই ফারজাদের বিশাল শরীরটার দিকে তাকালে গা কেঁপে ওঠে কেমন যেন! আড়ষ্ট হয়ে পড়ে সে। সে অদ্ভুতভাবে খেয়াল করছে, তার নিজের মাঝে খুব করে ফারজাদের বউ হয়ে ওঠার একটা প্রবনতা জন্মেছে। এই যে বউ বউ ভাবটা তাকে দোলা দিচ্ছে, ফারজাদের সেবা যত্ন করতে একটা শিহরণ নড়েচড়ে উঠছে ভেতরে। একটু ইনিয়ে-বিনিয়ে নত হতে ইচ্ছে করছে স্বামীর কাছে। ফারজাদের চোখ বোজা মুখের দিকে ভাবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঠোঁটটা কাঁমড়ে ধরল!

এরকম হুটমেজাজী লোকের সঙ্গে জীবনযাপনটা তার বেশ কষ্টকর হবে। বুঝে নিতে যতদিন দেরি হবে, ততদিন বেশ কষ্টসাধ্য হবে চলাচল। যার নিজের মেজাজ এবং চিন্তাধারায় নিয়ন্ত্রণ নেই, তার সঙ্গে ঠিক কীভাবে চলবে সে? আচ্ছা! সে-ই শুধু মানিয়ে নিচ্ছে, নাকি ফারজাদও চেষ্টা করছে? হুট করে ভাবনাটা মাথায় আসার পর আবার প্রশমিত হয়ে গেল এটা ভেবে–এর চেয়েও বেশি আক্রোশ পাওনা তার ফারজাদের কাছে!

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে