তপ্ত সরোবরে পর্ব-৩০+৩১+৩২

0
772

#তপ্ত_সরোবরে
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৩০.

ঘড়িতে রাত পৌনে নয়টা বাজছে। ব্যস্ত ঢাকার শহর আলোকিত হয়ে উঠেছে। রাস্তার একপাশ ধরে গন্তব্যহীন হেঁটে চলেছে ফারজাদ। আধাঘন্টার মতো ওভাবেই হেঁটে এসে পৌঁছাল সে পরিবাগ ফুটওভার ব্রিজের কাছে। সিঁড়ি বেয়ে আস্তে করে উঠে গেল ওপরে। ছাউনির নিচে একপাশে দাঁড়িয়ে হতে থাকা সিগারেটটা জ্বালালো। সে অবশ্য রেগুলার স্মোকার না, মুড অনুযায়ী ধূমপায়ী! এই তার জায়গাটা ভাল্লাগে। এখান থেকে নিচে তাকালে শা শা করে গাড়ি চলে যেতে দেখা যায়। যে গাড়িগুলো আসছে তার বিভিন্ন রঙা হেডলাইটের আলো একত্র মিশ্রিত হয়ে সুন্দর একটা অনুভূতি জাগায়। অথচ আজ কেন জানি এসবও ভালো লাগছে না। বহুদূর হেঁটেছে, সেজন্যই বোধহয় শরীরটা মেজমেজ করছে, পা লেগে আসছে। কোনো কিছুতেই একটু শান্তি বোধ হচ্ছে না। নাক, গলা, কপালের আশপাশ দিয়ে অদ্ভুতভাবে জ্বলছে। সিগারেট খাওয়ার জন্য বোধহয়! বুঝতে পারল না, তবে সিগারেট ফেলল না, টানতে থাকল।

লোকে দেখেছে ফারজাদের সব আছে। তার কোনো পিছুটান নেই, কোনো পরোয়া নেই, সে এক সতন্ত্র সত্ত্বা, যার মাঝে রুহু নেই বোধহয়। কেউ কোনোদিন খতিয়ে দেখেনি, চেষ্টা করেনি ফারজাদকে উদঘাটন করতে। দ্বিজার আচরণে কেন জানি ফারজাদের মনে হয়েছিল, এই ছোট মেয়েটা অন্তত বোঝে তাকে। কত ধৈর্য্য আর মেনে নেয়ার ক্ষমতা, নিশ্চয়ই ফারজাদকে বুঝেই। আর তাই তো ধীরে ধীরে ফারজাদ নিজেকে মেলে ধরছিল তার সামনে। অথচ সেই মেয়েটাও কত দ্রুত বিরক্ত হয়ে গেল, অতিষ্ট হয়ে উঠল। ফারজাদের ভেতরে সঞ্চারিত নতুন প্রত্যাশাকে মারিয়ে এগিয়ে গেল নিজ আলয়ে। সেদিন না ফারজাদ বলল তাকে, তার ওই বাড়ি যাওয়া যাবে না। যাওয়ার কথাও বলবে না আর। নিজের ভাবনার উপর হাসল ফারজাদ–এরা এই ফারজাদকে চেনেই না। ফারজাদ কবেই নিজেকে মুড়ে নিয়েছে নিজের চাদরে সবকিছু থেকে আলাদা এক জগতে! সে তো কাউকে আহ্বান করে নি তার কাছে আসতে! সে তো কোনোকিছু জোর করে ধরে রাখার মতো মানুষ না। মানুষ জোরপূর্বক এলেও বরং ফিরিয়ে দেয়া লোকটা সে। যাক গে ভালোই হয়েছে, সে আবার নিজের একাকীত্বের বেড়াজালে মন-প্রাণ লুটিয়ে মজে যেতে পারবে। ভেতর থেকে প্রশ্ন আসল, ‘সান্ত্বণা দিচ্ছ নাকি হে নিজেকে?ʼ

রেগে উঠল ফারজাদ, ‘কীসের সান্ত্বণা? তুমি কি বলতে চাইছ, আমার কাউকে ছাড়া চলে না?ʼ

-‘চলে তো! তুমি চাকা লাগিয়ে চালাও, তাই চলে। তবে চলতে বোধহয় চায়না। এটা অন্তত আজ আমার কাছে অস্বীকার কোরো না। আমার কাছে লুকানো যায় না কিছু, তবুও ব্যর্থ চেষ্টা করো, এতো বোকা কেন তুমি? আবার মানুষের কাছে নিজেকে কত সাবলম্বী দেখাও! আমি তো চিনি তোমায়! লুজার একটা!ʼ

নিজের ধিক্কার সহ্য হলো না ফারজাদের। নেমে এলো ফুটওভার ব্রিজ থেকে। শরীরটা একদম সায় দিচ্ছে না। এমন লাগছে কেন? সে এতো দুর্বল তো ছিল না কোনোকালে! এবার আর এই চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিটের পথ হেঁটে যাবার শক্তি আসছে না। পকেটে হাত গুজল, সস্তি পেল একটু, সামান্য কিছু টাকা আছে। রিক্সা ভাড়া করল একটা।

বিশ মিনিটের মতো লাগল ফ্লাটে পৌঁছাতে। দরজা খুলতেই কেমন এক হাহাকার যেন ধোঁয়ার মতো ছড়িয়ে যায় চারপাশে। আশ্চর্য! ক’দিন আগেও এই যে একা ফ্লাটে ঢোকার সময় সে সর্বোচ্চ শান্তি অনুভব করেছে। কেউ নেই আশেপাশে, শুধুই সে আর তার এই বদ্ধ কুটিরের দেয়ালগুলো। নিজেকে উপহাস করে হাসল ফারজাদ, ভাই, তুই কি আবার বউ পাগলে হয়ে গেলি নাকি? ছিহ! মানাচ্ছে না তোর সাথে। দেখ, বউ বাপের বাড়ি গেছে, এটার স্বাদ বিবাহিত প্রতিটা পুরুষকেই গ্রহন করতে হয়।

নিজের এই রসিকতা ফারজাদকে মজা দিলো না একটুও, বরং ভেতরে জ্বলে উঠল যেন। অতিষ্ট পায়ে রুমে ঢুকল। আলো জ্বালিয়ে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে ব্যাগটা বের করল। গোসল করে বেরিয়ে খুব আলগোছে এটা লুকিয়ে ফেলেছিল এখানে, দ্বিজার দেখে ফেললে প্রশ্ন করতো, তার চেয়ে বড়ো কথা দেখে ফেলতো, যেটা ফারজাদ চায় না।

রজনীগন্ধা ফুলগুলো নেতিয়ে গেছে, কালচে ছাপ পড়েছে। গোলাপের লাল টকটকে রঙটা একটু ফ্যাকাসে হয়ে এসেছে, সতেজতা হারিয়েছে ব্যাগের ভেতর থেকে।ফারজাদ তাকিয়ে থেকে একটু হাসল। ব্যাগ থেকে আরও একটা জিনিস বের করল। গোল্ড প্লেটের দুটো চকচকে চিকন চুড়ি। মোহাম্মদপুর থেকে কিনেছিল বারোশো টাকা দিয়ে। চকচক করছে চিকন চুড়িগুলো, দ্বিজার চিকন, ছোট্ট হাত দুটোয় খুব মানাতো, তা কেনার সময়েই ভেবেছিল ফারজাদ। ভেবেছিল, চুড়িদুটো মেয়েটার দুহাতে পরিয়ে দিয়ে বলবে, ‘এখন এটা দিয়ে চালিয়ে নে। হাতে টাকা পয়সা হলে স্বর্ণের গড়িয়ে দেব।ʼ

দুর্বল পায়ে হেঁটে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। হাতের ফুলের ছড়াদুটো জোরে করে ছুঁড়ে মারল কোথাও। এখন বুঝতে পারছে, তার গা কাঁপিয়ে জ্বর আসছে। নাক, কপাল, বুক জ্বলে যাচ্ছে। সর্দিজ্বরে পড়বে। মাঝেমধ্যেই গা’টা ঝাঁকুনি দিয়ে শিউরে উঠছে। মাথায় তীব্র ব্যথা ছড়িয়ে পড়ছে। অসহ্য লাগছে শরীরের ম্যাজম্যাজে ভাবটা। আর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আর পারল না। ঘড়িতে সাড়ে দশটা রাত। বিছানায় শুয়ে পড়ল। গা জ্বলছে, আবার ঠাণ্ডা লাগছে। লাইটটা অফ করা দরকার, তবে শরীরে ওঠার শক্তি পাওয়া গেল না। মাথা ভনভন করছে যেন, চোখ জ্বলছে, গলা আটকে আসছে। ফারজাদের মনে হয়, জ্বরে ভোগার সময়ের চেয়ে শরীরে জ্বর আসার অসুস্থতাটুকু বেশি যন্ত্রণার হয়। দাঁতে দাঁত চেপে চোখদুটো বুজে শুয়ে রইল ওভাবেই। এসব বহুরকম যন্ত্রণার সাথে পরিচিত সে, এভাবেই বহুরাত কাতরে পার করেছে। বাড়িতে নিজের ঘরে ছটফট করেছে পড়ে পড়ে, তবুও কোনোদিন আম্মাকে ডাকে নি। তার অসুস্থতা বা দুর্বলতা দেখেনা লোকে বহুবছর। তার অহংকার দেখেছে লোকে, নাক উচু স্বভাব দেখেছে, স্টাইল মেরে বুক ফুলিয়ে নিজের মতো ঘুরে বেরাতে দেখেছে লোকে। আজও তা-ই দেখবে, চিরদিন তা-ই দেখাবে ফারজাদ লোককে।


রাতের খাবার দিলরুবা বেগম ঘরে নিয়ে এলেন। দ্বিজা ফোন কানে ধরে বসে আছে, অস্থির দেখাচ্ছে ওকে। জিজ্ঞেস করলেন, “কী হইছে, কারে কল করতেছিস?ʼʼ

দ্বিজা উদ্বেগ লুকানো হাসি দিয়ে বলল, “ভাবলাম ফারজাদকে কল করে শুনে নিই খেয়েছে কিনা। আচ্ছা, তুমি খাইয়ে দাও, এরপর কল করে জেনে নিচ্ছি।ʼʼ

পরম আদরে খাইয়ে দিলেন দিলরুবা বেগম মেয়েকে। কতদিন পরে এই ঘরটা যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে, এমন লাগল তার কাছে। তিনি আরও কিছুক্ষণ মেয়ের সাথে কথাবার্তা বলে চলে গেলেন। ধীরে ধীরে দ্বিজার চেহারায় ঘোর আধার নেমে এলো। রাত সাড়ে এগারোটা বাজছে, ফারজাদ কল রিসিভ করছে না কেন? সে কোনো ভুল করে ফেলেছে কি আজ! মনের ভেতর খচখচ করছে খুব। একটাবার বলে আসার সুযোগটুকু হয়নি তার, তখন কী হয়েছিল, সে এতো উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল কেন কুমিল্লা আসার জন্য? এখন মনে হচ্ছে, আব্বু গেছিল, দু একদিন থাকতেও পারতো, এরপরে আরামেও তো আসা যেত, এক বেলায় হুট করে সিদ্ধান্ত, তারপর চলে আসাটা কতটুকু উচিত হয়েছে!

সারারাত ঘুম এলো না ওর। কী যে অশান্তি লাগছে মনের মধ্যে। ফারজাদ হাত পা ছড়িয়ে টানটান হয়ে ঘুমায়, সে তার পাশে অল্প একটু জায়গা নিয়ে শুয়ে থাকতো। আজ একা বিছানায় কেমন যেন অন্যরকম লাগছে, পাশটা খুব খালি খালি লাগল, বুকে হাহাকার লাগছে। একবার উঠে বসল, আবার শুয়ে পড়ল, এপাশ-ওপাশ করল, ঘুম চোখে ধরা দিলো না। শেষ রাতের দিকে ভাবল, আবারও কল করবে। ফারজাদ অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করে দেরী করে ঘুমায়, কিছুক্ষণ আগেই হয়ত ঘুমিয়েছে, এখন কল করা ঠিক হবে না। কল করল না আর। সস্তি নেই তবুও মনে, মনটা কেমন উদাস হয়ে পড়ছে অকারণেই। এরকম রাত কেটেছিল শেষ বার বাড়ি থেকে যাবার আগের রাতে। দ্বিজার হুট করে মনে হলো, ফারজাদ ছাড়া তার সস্তি নেই, ফারজাদ তার প্রশান্তিরূপে অশান্তি হয়ে উঠেছে বোধহয়! লোকটা সাথে থাকলেও জ্বালা, না থাকলেও!


সকাল হতে হতে ফারজাদের জ্বর বাড়ল। চোখদুটো নির্ঘুম রাতের প্রভাবে লাল হয়ে আছে, জ্বরের কারণে পানি পড়ছে চোখ দিয়ে। বারবার হাঁচি হচ্ছে, মাথাটা ভার হয়ে আছে, যেন কিছু ঠলকাচ্ছে ভেতরে। ওভাবেই সকাল নয়টা বাজতে বাজতে খালি পেটে বেরিয়ে পড়ল ফ্লাট ছেড়ে। পানি খাওয়ার রুচিটুকু নেই। পা দুটো টলছে খুব, অথচ শরীর অসুস্থতা হার মানল তার চাপা জিদের কাছে। অফিসে গিয়ে প্রথমে রুহুল আমিন সাহেবের সাথে দেখা করে, কাস্টাডিরুমে ঢুকল। সামাদ জিজ্ঞেস করল, “স্যার, আপনাকে দেখে তো অসুস্থ লাগছে।ʼʼ

-“দেখতে অসুস্থ লাগাটা খারাপ কিছু না। আর তাছাড়াও, আসলে আমি সুস্থ, আপনার চোখ অসুস্থ, সামাদ সাহেব।ʼʼ

-“স্যার, এই অবস্থায় রসিকতা করবেন না। এমনিতেও এই শরীর নিয়ে ডিউটিতে মনোযোগ দিতে পারবেন না।ʼʼ

-“আমি বলেছি তাই?ʼʼ

-“জি না, স্যার। আমি বলছি।ʼʼ

-“আর বলবেন না। তাতেই দেখবেন চমৎকার ডিউটি করে যাচ্ছি।ʼʼ

সামাদ হতাশ হয়ে উঠে গেল চেয়ার ছেড়ে। মাসুদকে নিয়ে এসে বসানো হলো। ফারজাদ প্রশ্ন করল, “আপনি দৌঁড়ালেন কেন কাল আমায় দেখে?ʼʼ

-“স্যার, পুলিশ দেখে দৌঁড়ানোটা অপরাধ আর সেই অপরাধে আমাকে গ্রেফতার করা হয়েছে?ʼʼ

ফারজাদ নাক টেনে, চোখ বুজে কিছুক্ষণ টেবিলে কনুই চেপে বসে রইল। ওভাবেই বলল, “আমি পুলিশ, তা আমার কোথায় লেখা আছে?ʼʼ

মাসুদ একটু অপ্রস্তুত হাসল, “আপনি তো পুলিশই, স্যার! এটা এসপি ব্রাঞ্চের অফিস, আপনি সেখানে নিয়ে এলেন আমায়, আবার প্রশ্ন করছেন।ʼʼ

ফারজাদ হাঁচি দিলো দুটো। শব্দ করে ‘আলহামদুলিল্লাহʼ উচ্চারণ করল, এরপর বলল, “আপনার কথায় যুক্তি আছে। তবে আপনি যখন দৌঁড়েছেন তখন এই দশতলা এসপি ব্রাঞ্চের অফিস আমি কাধে নিয়ে ঘুরছিলাম না। আর না এই কাস্টাডি রুমটা। আলামিনকে চেনেন?ʼʼ

বেশ কিছুক্ষণ স্বীকার করল না লোকটা। ফারজাদ ওভাবেই বসে রইল, কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। অসহ্য লাগছে সবকিছু। শরীর নেতিয়ে আসতে চাইছে। তবুও বেশ কিছুক্ষণ জেরা করল, তবে কাজ হলো না। অবশেষে সামাদকে বলল, “ওনার খাতির যত্নের ব্যবস্তা করো। মিথ্যা বলে ক্লান্ত উনি।ʼʼ

লোকটা খুব সচেতন আর আরামপ্রিয়। তাকে টর্চার করার প্রয়োজন পড়ল না, ফারজাদের কথা শুনে কিছুক্ষণচুপ থেকে প্রস্তুতি নিলো বোধহয়। ফারজাদ হাত উচিয়ে থামতে বলল সামাদকে। লোকটা বলল, সে আর আলামিন টুকটাক ড্রা গ বিক্রি করে। তবে তারা দুজন কোনো ডিলারের সাথে যুক্ত না, তারা কোনো গ্যাং সম্বন্ধে কিছু জানে না।

কথাগুলো নেহাত সস্তা কথা। যা সকল সাসপেক্টই বলে থাকে, কমন স্বীকারোক্তি। যা পছন্দ হলো না ফারজাদের।
তবে ক্ষেপল না ফারজাদ, শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল, “আমার ফ্লাট থেকে আলামিনকে বের করেছিল কে?ʼʼ

-“আমি, স্যার।ʼʼ

-“সে কোথায় এখন?ʼʼ

-“জানি না।ʼʼ

ফারজাদ ঘাঁড় দুলালো, যেন সে বিশ্বাস করেছে মাসুদের কথা এবং বিবেচনা করছে বিষয়টা, এক পর্যায়ে বলল, “তাহলে কি আপনাকে ছেড়ে দেয়া উচিত?ʼʼ

লোকটার চোখ দুটো চকচক করে উঠল। খুশিতে বোধহয় মুখ দিয়ে হ্যাঁ-ও বলতে পারল না। ফারজাদ বলল, “তার বদলে আমায় কী দেবেন?ʼʼ

লোকটা অবুঝের মতো তাকিয়ে রইল। ফারজাদ আবার বলল, “আপনি যদি আলামিনকে ধরিয়ে দেন তবে আপনার ছুটি। নয়ত জানেন? প্রাথমিক পর্যায়েই তিনমাসের ট্রেনিং পেয়েছি অ স্ত্র চালানোর। আর অর্ডার আছে, সাসপেক্টকে ওপেন-শ্যুট করার।ʼʼ

শেষের কথাটায় সামাদ ভ্রু কুঁচকাল। ফারজাদ চরম ধুরন্ধর আর আজব লোক–তার ভালো ধারণা হয়েছে এ ব্যাপারে। তবুও কেন জানি খারাপ লাগে না তার ফারজাদকে। ফারজাদ যা-ই করে, বেশ উপভোগ করে সে। ভালো লাগে তার ফারজাদকে।


ফারজাদ ফ্লাটে ফিরল রাত আটটার দিকে। এই শরীর নিয়ে সারাটা দিন পুরোদমে ডিউটি করেছে। সামাদ অবশ্য অনুরোধ করে সন্ধ্যার পর ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। সারাদিনে তেমন কিচ্ছু পেটে পড়েনি। গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরের তোড়ে। ফ্লাটের দরজাতে হাত রাখতেই ওর মনে হলো, দরজায় তালা নেই। সে ভুল বোঝেনি, শুধু নব ঘুরাতেই খুলে গেল দরজাটা। টলতে টলতে ঢুকল ওভাবেই ভেতরে। রুমে ঢুকে হাতে থাকা ওষুধের প্যাকেট ও খাবারগুলো রেখে রক্ষাকবজটা প্যান্টের পেছনে গুজে নিলো কোনোরকমে। হাতঘড়ি খুলতে খুলতে গিয়ে পৌঁছাল সেই রুমে যেখানে আলামিন বন্দি ছিল। দরজাটা খোলা, আলামিন ভেতরে বসে আছে। ফারজাদ এক নজর আলামিনকে দেখে একটু মাথা ঝুঁকিয়ে কপালটা চেপে ধরে বলল, “আমার ফ্লাটের প্রেমে পড়েছ নাকি, আলামিন? পালিয়ে গিয়েও ফিরে ফিরে আসছ, নজর রাখছো! ব্যাপার কী?ʼʼ

আলামিন দাঁত কেলিয়ে হাসল একটু, “না স্যার, আপনার প্রেমে পড়ছি। আপনে আসলেই সবার থেইকা আলাদা, মনে হয় আপনের মাথায় সমস্যা আছে তাই না, স্যার?ʼʼ

-“তা আছে একটু, তবে তুমি কী করে বুঝলে তা?ʼʼ

বলতে বলতে দুর্বল পায়ে এগিয়ে গেল ফারজাদ রুমের ভেতরে। আলামিন বলল, “আমারে খুব সহজভাবে নিতেছেন, স্যার।ʼʼ

-“উহ, ভুল ধারণা তোমার। তুমি কোনো বিশেষ কিছু না আমার কাছে। ইভেন, কোনো কিছুই বিশেষ না আমার কাছে। আমার কাছে সব কিছুই সহজ, সাধারণ। তেমনই তোমাকেও কঠিনভাবে নেয়ার কিছু দেখছি না। কী বলো তো! জীবনে এক একটা বিষয়ের ওপর একাধিক রকমের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, তাহলে ভাবো তো সব বিষয় মিলিয়ে কত অভিজ্ঞতা আমার! কোনোকিছুতেই আমি ঠিক চমকাতে পারি না, বুঝলে! আর এজন্য তোমার মতো অনেকেই আমাকে পাগল ভাবে।ʼʼ

আলামিন হাতের ছুরিটা এগিয়ে ধরল, “উহ! স্যার! আর আগাবেন না খবরদার। হিসাব-নিকাশ যা দূর থেইকাই হোক। কিন্তু আপনে তো অসুস্থ, স্যার!ʼʼ

-“তাতে কী সমস্যা? ভয় পাচ্ছ?ʼʼ

আলামিনের বোধহয় কথাটা পছন্দ হলো না। কিছুক্ষণ কেমন করে যেন চেয়ে রইল। এতো স্বাভাবিক কীভাবে এই লোক! একটু ঘাবড়ায়নি, চমকায়নি, ভয় পায়নি, আর না এখন অবধি আসার কারণ জিজ্ঞেস করল। তার ওপর যে মাত্রায় অসুস্থ শরীর! তবুও চেহারাটা একদম উৎকণ্ঠাহীন, নির্বিকার! ফারজাদ দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। মেঝের ওপর ঠাস করে বসে পড়ল। মাথাটা ঝুঁকিয়ে নিঁচু হয়ে বসে রইল ওভাবেই। আলামিন জিজ্ঞেস করল, “আপনে আমার পেছনে পড়ছেন ক্যান?ʼʼ

-“এটা আমার ডিউটি। নয়ত কোনো সমস্যা নেই তোমাদের নিয়ে আমার।ʼʼ

-“যদি সমস্যা না থাকে তাইলে এমন কইরা পিছে পড়ছেন ক্যান?ʼʼ

-“বললাম তো, ডিউটি।ʼʼ

-“ডিউটি তো আপনের ডিপার্টমেন্টের আর সবাইরও। তারা তো এমনে বাগড়া দিবার আসে না আমারে কামে। আপনে স্যার খুব বাড়াবাড়ি করতেছেন।ʼʼ

ফারজাদ দুর্বল কয়েকটা শ্বাস ফেলল। দম আটকে আসছে কেমন যেন! খুব স্বাভাবিক ভাবে যেন রসিকতা করে জিজ্ঞেস করল, “এর ফলাফল কেমন হবে আমার?ʼʼ

-“খারাপ, স্যার। খুব খারাপ। আপনের ডিপার্টমেন্টের বহুত অফিসাররে কিইনা রাখছি। তারাই আরও নিরাপত্তা দেয় আমারে। আপনে তার মইদ্দে কয়টারে সাজা দিছেন, এই এক ফল্ট আপনের, আবার পিছে লাইগা রইছেন আমার। স্যার, মারা পড়বেন এমনে চলতে থাকলে। কী চান কী আপনে?ʼʼ

আস্তে করে বলল ফারজাদ, “যা চাইব দেবে নাকি?ʼʼ

-“আপনে চান, দেহি। কেউ কী আর খালি হাতে যায় নাকি আমাগোরে কাছে চাইয়া? ভরায়ে দিই, স্যার! আপনে কী চান কন, দিমু।ʼʼ

-“তোমার বসের নাম জানতে চাই। আসলে পুরো পাচারটার লিংক কোথায়? কোথা থেকে সার্ভিস আসে মালের..

ফারজাদের কথা শেষ হলো না এ পর্যায়ে। আলামিন বোধহয় বুঝতে পারল, সে যা বোঝাতে এসেছে বা যে ডিলটা করতে এসেছে, তা সম্ভব নয় ফারজাদের সাথে। ফারজাদের কথা শেষ না হতেই ঝেপে আসল তার দিকে। ফারজাদ ব্যাপারটা আন্দাজ করে কোনোরকম অসুস্থ হাতে পিস্তলটা বের করল। বেশ কিছুক্ষণ জাপটাজাপটি হলো দুজনের মাঝে। ফারজাদের সবল দেহটা নেতিয়ে পড়েছে জ্বরের তোড়ে। ঠিকমতো শ্বাস নিতে পারছে না। তবুও যতদূর সম্ভব চেষ্টা করে গেল নিজেকে রক্ষার। এক পর্যায়ে বন্দুকটা ছিটকে পড়ল কোথাও। ফারজাদের দু চোখ ঘোলা লাগছে। তার ওপর সারা শরীরে বিষব্যথা। সে উঠে দাঁড়িয়ে আলামিনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে পিস্তলটা তুলে নিলো হাতে। আলামিনের হাতে পিস্তল গেলে, তার কাহিনীর সমাপ্তি ঘটতে মাত্র সময়ের ব্যবধান।

ততক্ষণে আলামিন ছুরি হাতে এগিয়ে এসেছে তার দিকে। আবারও হাতাহাতি চলল দুজনের মাঝে। হাতাহাতির মাঝে গোঙানির আওয়াজ আসছে শুধু। গলা চেপে ধরেছে ফারজাদ আলামিনের। আলামিন কীভাবে যেন খুব আলগোছে ফারজাদের বাহুতে আঘাত করল। শার্ট সহ হাতটা গভীর জখম হলো। ফারজাদ আর্তনাদ করে উঠল। র ক্ত চুইয়ে পড়তে লাগল সেখান থেকে। ফারজাদের জ্বরে ভোগা শরীরটায় ছুরির আঘাতে আরও দুর্বল হয়ে পড়ল এবার। একটা লাত্থি দিলো আলামিনের উরু বরাবর। হাঁটু ভেঙে পড়ে গেলেও, সে এখনও বেশি শক্তিশালী ফারজাদের চেয়ে। হাতাহাতি আরও একবার চলল।

এক পর্যায়ে সশব্দে একটু গুলি চলার আওয়াজ এলো পুরো ফ্লাট কাঁপিয়ে। থেমে গেল দুজনের গোঙানির আওয়াজ। থমকে গেল পরিবেশ, শ্বাস আটকে রইল বোধহয়। বুলেট ছোড়ার বিকট আওয়াজের পর পরিবেশটা একদম নিস্তব্ধ, গুমোট হয়ে রইল। চারদিকের আওয়াজ কানে আসছে ঝাপসা হয়ে। কানে তালা লেগে গেছে গুলির শব্দে।

চলবে..

[ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন]

#তপ্ত_সরোবরে
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৩১.

সকাল সকাল উঠে দ্বিজা বের হয়ে পড়ল মামার বাড়ির উদ্দেশ্যে। তার এ ব্যাপারে খুব মিশ্র অনুভূতি কাজ করছে যে–সে আর ফারজাদ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার পর দুই বাড়ির মানুষ নিজেদের মাঝে সমঝোতা কোরে নিয়েছে। কী আশ্চর্য! আগে করলে কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যেত? তার মন-মস্তিষ্ক বিষণ্ণতায় ডুবে আছে। কী হচ্ছে জানে না। অথচ চারপাশের কিছুই নজরে আসছে না। সে যে খুশিটা নিয়ে কুমিল্লার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিল তা কোথাও খুব বাজেভাবে মিলিয়ে গিয়েছে এখানে এসে পৌঁছার পর। কাল রাত থেকে বুকটা পুড়ছে। সে বুঝে গেছে, ফারজাদ তাকে কোনোদিন ভালোবাসবে না। সেদিন শুধু উত্তেজনায়, কর্তব্যের তাগিদে হয়ত সঙ্গে নিয়ে গেছিল। নয়ত এই যে এখানে আসার পর সে এই দুইদিনে এতবার বে-হিসেব কল করেছে। কলটা একবার রিসিভ করে দুটো কথা বলার প্রয়োজন মনে করেনি। সারাদিন না হয় ব্যস্ত সে, রাতে যখন বাড়ি ফেরে তখনও কথা যায় না দু-এক মিনিট? হাহ! সে-ই পাগল, যে ফারজাদের একটু মনোযোগ পেয়ে কত কী ভেবে বসেছিল।

তার এখন আর ফারজাদদের বাড়িতেও যেতে ইচ্ছে করছে না। ও বাড়ি গেলেই তো সকলে নানান প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবে। সেই কবে এসেছে ও বাড়ি থেকে, আজ কেমন একটা সংকোচ কাজ করছে। আম্মু চলে গেছে সকালেই, সেখানে লাবন্য এসেছে, ফারিন এসেছে। হাটতে হাঁটতে হুট করে মনে পড়ল, ফারজাদ এতো তাড়াতাড়ি সব ভুলে গেল! কয়দিনে সব রাগ, অভিমান ভুলে গেছে! আচ্ছা! ভুলে গেছে তো? নাকি? ভাবনায় পড়ে গেল দ্বিজা–ফারজাদ তো সে ধরণের নয়! ফারজাদ নিজেও আসে নি, তাকে পাঠিয়েছে। আচ্ছা! সেই রাগেই কি তার ফোন তুলছে না, কথা বলছে না! সে কি ভুল করে ফেলেছে! দ্বিজা বুঝতে পারল না সে কী করবে? এই অশান্তি আর ভালো লাগছে না তার। সবকিছু এলেমেলো হয়ে এলো তার। কান্না পেল খুব রাস্তার মাঝখানে। জীবনের এই টানপোড়েন আর নেয়া যায় না। এতদূর পৌঁছে আর ফিরে গেল না, বহুদিন পর ঢুকল নিজের অতীত আনন্দশ্রমে। তবে আজ এই বাড়ি তাকে একটুও আনন্দ দিচ্ছে না।


গুলির শব্দে পাশের ফ্লাটের লোকজন এগিয়ে এলো ফারজাদের ফ্লাটে। নব ঘুরিয়ে দরজা খোলা গেল। তারা আশ্চর্য হলো, দরজা খোলা রেখে বন্দুক দিয়ে খেলছে কোন পাগল? ফারজাদকে পাওয়া গেল রক্তাক্ত অবস্থায় মেঝেতে শায়িত। কাধের পাশ দিয়ে রক্তের ধারা নেমেছে। কালচে ঘন রক্তে সাদা টাইলস জর্জরিত তখন। বাহুতে গভীর ক্ষত। সকলে আৎকে উঠল, এমন দৃশ্য চোখের সামনে দেখা সাধারণ মানুষের জন্য ভবাবহ এক অভিজ্ঞতা। ফারজাদের হুশ মনেহয় আছে এখনও। কাতরাচ্ছে যেন, তবে তা প্রকাশিত হচ্ছে না, সেই শক্তিটুকু নেই তার মাঝে যে সে গা দুলিয়ে ছটফট করে। এক লোক এগিয়ে এসে নাকের কাছে হাত দিলো, নিঃশ্বাস যেন পড়ছেই না। পাশেই পিস্তল পড়ে আছে, অথচ আর কেউ নেই আশেপাশে। আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে নাকি ছেলেটা? সকলের মাঝে গুঞ্জন উঠল। ফারজাদের মুখটা দেখে মায়া হলো খুব সকলের। দ্রুত চিকিৎসা প্রয়োজন এর, যে হারে রক্ত ঝরছে, বাঁচানো মুশকিল হয়ে যাবে।

ফারজাদকে সার্জারীতে নেয়া হলো রাত দশটায়। গুলিটা বুকের ডানপাশে যকৃত যেখানে অবস্থান করে তার খানিক ওপরে ক্লাভিকল নামক হাড় ফুড়ে বেরিয়ে গেছে। কাধ থেকে হাত সংযোগহীন হয়ে পড়েছে বলা চলে। ডাক্তারদের মুখে চিন্তার ছাপ পড়ল। তারা এখনও নিশ্চিত নয়, রোগীর পরিণতি কী হবে, তবুও চেষ্টার ত্রুটি রাখা তো চলবে না। যে লোকগুলো ফারজাদকে হাসপাতালে এনেছেন তারা ফারজাদের ফোন ঘেটে বরং সামাদ নামটা বারবার পেল। সেখানেই কল লাগাল।

সামাদ অবাক হলো, “আপনারা কারা কথা বলছেন? স্যার কোথায়?ʼʼ চিন্তিত হয়ে পড়ল সামাদ, ফারজাদের সঙ্গে খারাপ কিছু হয়নি তো?

লোকটা বলল, “ফারজাদ হাসপাতালে। আপনি একটু আসুন এক্ষুনি।ʼʼ

পথে সামাদের চিন্তা হতে লাগল, জ্বর কি খুব বেশি উঠেছে ফারজাদের? সে যতদ্রুত সম্ভব হাসপাতালে এলো। লোকটা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, “আপনার কে হয় ফারজাদ?ʼʼ

-“আমার সিনিয়র, আমি তার সহকারী। স্যারের কি জ্বর খুব বেশি, ফিট-টিট লেগে গেছে?ʼʼ

-“হ্যা, গা’টাও খুব গরম দেখলাম। তবে আপনার স্যার মনেহয় আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল নিজেকে গুলি করে।ʼʼ

সামাদ চমকে উঠল, যে ভয়টা তারা পাচ্ছিল কয়দিন ধরে, সেরকমই কিছুই ঘটে গেছে নিশ্চয়ই! ফারজাদ নিজেকে মারতে যাবে কেন? নিশ্চয়ই ফ্লাটে খারাপ কিছু ঘটে গেছে! কিন্তু এরা কালপ্রিটকে দেখেনি কেন? কতক্ষণ পর ফ্লাটের ভেতরে এগিয়ে গেছিল? তার খুব চিন্তা হতে লাগল, সে নিজে ফারজাদকে ওষুধ কিনে দিয়ে ঘন্টা দুয়েক আগে বাড়ি গেছে। বুকটা কেমন হু হু করে উঠল একটু, ফারজাদের ওপর তার একটা মায়া আছে আসলে। এই লোকটা খুব শক্ত, নিজের ব্যথার একদমই প্রকাশ করে না। আচ্ছা! স্যারের বাড়িতে তো জানানো হলো না! ওনার স্ত্রী আসেনি কেন সঙ্গে? আসলে তো ওটির বাইরেই থাকার কথা।

ফারজাদের এই দুর্ঘটনা যে প্রোফেশনাল তা নিশ্চিত সামাদ। অতএব, চিকিৎসার যাবতীয় খরচা ডিপার্টমেন্টই বহন করবে। কিন্তু পরিবারের মানুষদের আসা অপরিহার্য দরকার এখন। ফারজাদের ফোনটা এখন তার হাতে, কিন্তু কাকে কল করবে? ফারজাদের ফ্যামিলি মেম্বারদের নম্বর চিনবে কী করে সে?

ফারজাদের সার্জারী চলছে, সে বাইরে পায়চারী করতে শুরু করল। কী হবে, আল্লাহ জানেন। খুব হাঁসফাঁস লাগল সামাদের! কী থেকে কী হয়ে গেল? একবার দেখলও না সে, কোথায় কীভাবে গুলিটা লেগেছে। আচ্ছা, বুলেট যদি শরীর থেকে বের না করা যায়? নিজের চিন্তার ওপর বিরক্ত হলো সামাদ! ধমক দিল, বি পজেটিভ। কিচ্ছু হবে না, খারাপ জায়গায় লাগলে এতক্ষণে খারাপ কিছু হয়ে যেত, এখনও তো চেষ্টা চলছে! নিশ্চিত সেফ কোনো স্থানে বুলেট লেগেছে! সামাদের ইচ্ছে করল একবার ফ্লাটে গিয়ে চেইক করে আসতে, যদি বুলেট সেখানে পাওয়া যায়, তাহলে আরও একটু নিশ্চিন্ত হওয়া যেত। কিন্তু এখন ফারজাদকে রেখে যেতে পারবে না সে।

পুরো তিনঘন্টার লড়াইয়ের পর ডাক্তার সাহেব বের হলেন ওটি থেকে। তার মুখ দেখে কিছু আন্দাজ করা যাচ্ছে না। সামাদ জিজ্ঞেস করল, “স্যার! কী অবস্থা স্যারের!ʼʼ

-“এখন এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারছি না, আসলে বলতে চাইছি না। এখন আপাতত সে অচেতন, সেন্স ফিরতে দেরি হতে পারে। দেখুন, ব্যাপারটা আর সব কেইস থেকে আলাদা, এখানে পুলিশ কেইস হবে, পেশেন্টের বুলেট লেগেছে, বুঝযে পারছেন! খতিয়ে দেখা হবে ব্যাপারটা।ʼʼ

সামাদ বিরক্ত হলো, “স্যার নিজেই পুলিশ! স্পেশাল ব্রাঞ্চ।ʼʼ

ডাক্তার কিছু বললেন না আর। সামাদ বসে রইল বেঞ্চের ওপর। যদিও তার এসব দায়িত্ব নেই, তবুও কেন জানি দায়িত্বের ওপরেও অন্য কিছু অনুভব করছে সে, যা তাকে টেনে বসিয়ে রাখল রাতটা এই হাসপাতালেই।


সকাল সকাল রান্নাবাড়ার ধুম পড়েছে। ফারহানা বেগমের মেজাজ ভালো নেই। তার শান্তি লাগছে না কোথাও, আরও একটা মানুষ অজানা অস্থিরতায় ছটফটাচ্ছে–দ্বিজা। এতো মানুষের এসব কোলাহল ভালো লাগল না, সে মাথায় ওড়না টেনে বাগানে গিয়ে দাঁড়াল। পেছন পেছন লাবন্য এলো, “কী রে! কাল থেকে দেখছি কেমন মনমরা হয়ে আছিস? কাহিনি কী?ʼʼ

-“ভালো লাগছে না, লাবন্য আপু। তুই যা।ʼʼ

-“ভালো লাগছে না কেন, সেটাই তো জানতে চাইছি!ʼʼ

-“জানানোর মতো কিছু নয়।ʼʼ

-“ওরে আমার গোপনীয়তা রক্ষাকারী মেডাম! দেখ সংসার জীবনে এসব চলেই।ʼʼ

দ্বিজা বিরক্ত হয়ে ঘাঁড় ঘুরাল, “কী চলে?ʼʼ

-“তোদের কী চলছে?ʼʼ

-“কিছুই চলছে না। তার সঙ্গে আমার কোনো লেনাদেনা নেই। জানিস, লাবন্য আপু, ফারজাদ কখনও আমায় ভালোবাসবে না রে! আমিই শুধু তাকে পুষে গেলাম।ʼʼ

শেষের দিকে দ্বিজার কণ্ঠটা কাঁপল। লাবন্য শুধাল, “কী করে বুঝলি তা?ʼʼ

লাবন্যর প্রশ্নে দ্বিজা মলিন হাসল, “এই যে আমি দুদিন হলো এসেছি, একবার নিজে থেকে খোঁজ নেয়নি। আমি কমপক্ষে শ বার কল করেছি, তা পর্যন্ত রিসিভ করেনি। ওই সামনে থাকলেই যা দায়িত্ব পালন করে। আমি শুধু তার দায়িত্ব রে, আপু।ʼʼ

লাবন্য কিছুক্ষণ চুপ থেকে কী যেন ভাবল, হঠাৎ-ই ভাবুক কণ্ঠে বলল, “আমি অবাক হচ্ছি, ফারজাদ ভাই যেভাবে তোকে নিয়ে চলে গেছিল সবাইকে বাদ-ছাদ দিয়ে, এত তাড়াতাড়ি সব ভুলে গেল? তোকে পাঠিয়ে দিলো এখানে? আমি অন্তত চিনি ফাদজাদ ভাইকে, তার অভিমান বরফের মতো শান্ত, হাওয়ার মতো অদৃশ্য! একটু সাহিত্যিক লাগছে কথাগুলো, তবে আমিই একমাত্র মানুষ যে ফারজাদকে জানি। এই ব্যাপারটা একটু ঘাপলা লাগছে তখন থেকেই যখন শুনেছি তুই এসেছিস ফুপার সাথে।ʼʼ

দ্বিজাকে একটু চিন্তিত দেখাল। সে কপাল জড়িয়ে চোখ মেলে তাকাল লাবন্যর দিকে, “মানে? কী জানিস তুই ফারজাদকে? কী বলছিস?ʼʼ

লাবন্য পাত্তা দিলো না ব্যপারটা, “ বাদ দে! হয়ত এখন বদলেছে ফারজাদ ভাই, সব সময় তো আর মানুষ এক রকম তীব্র অভিমানী থাকে না। আগে তো সহ্যও করতে পারতো না, এখন কেমন সংসার করছে তোকে নিয়ে।ʼʼ

দ্বিজা অধৈর্য্য হয়ে পড়ল, “তুই আর ফারজাদ এতো ভারী ভারী কথা বলিস কেন?ʼʼ আবার কিছুক্ষণ চুপ থেকে কিছু ভাবল, হিসেব কষল কিছু একটা, এরপর আস্তে করে মলিন স্বরে বলল, “লাবন্য আপু! আমি মনে হয় বিরাট ভুল করে ফেলেছি রে!ʼʼ

দুপাশে অনবরত ঘাঁড় নাড়ল দ্বিজা, “আমি অজান্তেই বোকার মতো বিশাল ভুল করে ফেলেছি। তুই ঠিকই বলেছিস, তুই আসলেই বুঝিস ওই চাপা মানুষটাকে, আমিই মূর্খ বুঝতে পারিনি। সেদিন ফারজাদ নিজের ক্ষোভকে লুকিয়ে আমাকে আব্বুর সাথে তুলে দিয়েছে। এখন বুঝতে পারছি আমি। আমি বিশাল ভুল করে ফেলেছি।ʼʼ

লাবন্য বুঝল না কিছুই। বারবার জিজ্ঞেস করল, “কী বলছিস, কী হয়েছে? এই দ্বিজা!ʼʼ

দ্বিজা হারিয়ে গেছে কোথাও, সে ভুলের হিসেবে মেলাচ্ছে! তার করা বোকামির হিসেব মেলাচ্ছে! এইতো সপ্তাহ দুয়েক আগে ফারজাদ তাকে এই বাড়ির নাম নিতেও নিষেধ করেছিল। অথচ সে আব্বুকে পেয়ে সব, সবটা ভুলে কান্নাকাটি শুরু করল। সে আসলেই ফারজাদের অযোগ্য, মূর্খ! ফারজাদের সাথে চলার মতো না সে। ফারজাদ কঠিন, অদ্ভুত এক মানুষ। দ্বিজা লাবন্যর দিকে তাকাল, এই মেয়েটা ফারজাদকে ঠিক কতটা বুঝলে কিচ্ছু না জেনে-শুনে আসল বিষয় টেনে বের করে আনতে পারে? তার চোখ ভরে উঠল–নিজেকে ধিক্কার দিলো সে, ফারজাদ এজন্যই বলেছিল তার সাথে দ্বিজা চলতে পারবে না। ফারজাদের আবেগ নেই, দ্বিজা আবেগী মেয়ে! শুধু ভালোই বেসে গেছে বোধহয়, ওই মানুষটাকে বোঝেনি কোনোদিন। লাবন্যর পেটের দিকে নজর গেল দ্বিজার। বিয়ে হয়ে পরের ঘরে গিয়ে, দুই মাসের অন্তঃসত্ত্বা মেয়েটা আজও ফারজাদকে এতো বোঝে! অথচ সে ভালোবাসল, পাগলামী করল, বউ হয়ে একসাথে মাস দুই সময় কাটাল মানুষটার সাথে, অথচ তাকে আয়ত্ত করতে পারল না। আজ নিজের ভালোবাসার উপর নিজের সন্দেহ তৈরী হওয়ায় ডুকরে কেঁদে ফেলল মেয়েটা।

লাবন্য হকচকিয়ে গেল, “কী হয়েছ? এই পাগলি! কাঁদছিস কেন? আরে! সংসারে এমন হয়ই! আমাকে দেখ, কালও এখানে আসার সময় ইরফানের সাথে একচোট ঝগড়া বাঁধিয়ে এসেছি। সে সকাল থেকে কল করছে আমি ফোন তুলছি না। শোন, তুইও ফারজাদ ভাইকে কল দিয়ে কথা বল, আমার নম্বর থেকে কল কর, দেখ তুলতে পারে। এই নে আমার ফোন। কাঁদিস না দ্বিজা! এতদিন পর দেখা, কাঁদতে দেখলে ভালো লাগে?ʼʼ

দ্বিজার চোখ মুছিয়ে দিলো লাবন্য। দ্বিজা ভাঙা স্বরে বলল, “আমার মুখ নেই ফারজাদের সাথ কথা বলার। দিস না কল, আমি কথা বলব না।ʼʼ

লাবন্য মানল না। জোর করেই কল করল ফারজাদের নম্বরে। কল বাজল, রিসিভ হলো একটু পরেই। তা দেখে দ্বিজার বুকে আর এক ঘা লাগল। তার মানে নির্দিষ্ট করে শুধু তার কলই এটেন্ড করছে না ফারজাদ। হু হু করে কেঁদে ফেলল মেয়েটা। লাবন্যর খুব কষ্ট হচ্ছে এবার। ওপাশে ফোনে কেউ ‘হ্যালোʼ ‘হ্যালোʼ করছে একাধারে। এরই মাঝে দ্বিজা প্রায় দৌঁড়ে সেখান থেকে ভেতরে চলে গেল। তাকে আর থামানো গেল না। লাবন্য ফোন কানে ধরে বলল, “হ্যালো, ফারজাদ ভাই! কী খবর আপনার?ʼʼ

-“আপনি কে ফারজাদ স্যারের?ʼʼ

লাবন্য ভ্রু কুঁচকাল, “মানে! আমি কি রং নম্বরে কল করে ফেলেছি? এটা ফারজাদ ভাইয়ের নম্বর না?ʼʼ

-“জি না, ম্যাম! আপনি সঠিক নম্বরে কল করেছেন। স্যারের ফোন এখন আমার কাছে রয়েছে। তবে যদি একটু নিজের পরিচয়টা দিতেন আর কী!ʼʼ

-“ফারজাদ ভাইয়ের ফোন আপনার কাছে? আপনি কে?ʼʼ

-“আমি ওনার সহকারী।ʼʼ

-“ও! আমি ওনার চাচাতো বোন, লাবন্য সুলতানা।ʼʼ

সামাদ সবিনয়ে বলল, “ম্যাম! আপনি কি একটু ফারজাদ স্যারের পরিবারে কেউ অর্থাৎ ওনার অভিভাবক মানে বুঝতে পারছেন! ওনার বাবার সঙ্গে আমার কথা বলাতে পারবেন?ʼʼ

-“হ্যাঁ, পারব। কিন্তু কী দরকার?ʼʼ

সামাদ লাবন্যকে বলল না, বরং আজাদ সাহেবকে চাইল। সামাদের বুক থেকে বোঝা নেমে গেছে যেন। সে নিজে ফারজাদের পরিবারকে যোগাযোগ করা নিয়ে কী যে উদ্বিগ্ন ছিল। আজাদ সাহেব খুশিতে আটখানা হলেন যে ফারজাদের কল এসেছে, কিন্তু খুশিটা প্রকাশ করলেন না। ফোন কানে ধরেই বললেন, “কী রে! মনে পড়ে বাপরে!ʼʼ

সামাদ বলল, “সরি আঙ্কেল! আমি ফারজাদ স্যার নই। আমি তার সহকারী সামাদ হোসাইন। এখন আমি যা বলব আপনাকে, একটু ধৈর্য্যে ধরে শুনবেন, প্লিজ! আসলে জানেনই তো এই পেশার ব্যাপরটাই এমন! কাল রাতে কোনো একভাবে ফারজাদ স্যার গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, এবং এখন তিনি হাসপাতালে অবজারভেশনে আছেন। প্লিজ চিন্তিত হবেন না। ইনশা-আল্লাহ সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে, আর আপনারা যদি পারেন..

কে শোনে আর সামাদের সান্ত্বণার বাণী! আজাদ সাহেব যেন কাঁচের মূর্তির মতো খান খান হয়ে ভেঙে পড়লেন। ধপ করে বসে পড়লেন দরজার কপাট ধরে মেঝেতে। লাবন্য তড়িঘড়ি এগিয়ে গেল, “বড়ো আব্বা! কী হয়েছে তোমার! ও বড়ো মা! ফিরোজা আপা! আম্মা, ফুপু! ও বড়ো মা! এসো এদিকে। বড়ো আব্বা! কী হয়েছে, কী বলল লোকটা? কথা বলছ না কেন?ʼʼ

ফারহানা বেগম ছুটে এলেন। চেঁচামেচি শুনে নিচে নেমে এলো দ্বিজা সিঁড়ি বেয়ে। বড়ো মামা মেঝেতে হাত পা ছেড়ে বসে আছেন। প্রথমে সকলে ভাবল, আজাদ সাহেবের কিছু হয়েছে! আজাদ সাহেব হঠাৎ-ই চিৎকার দিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না, ফারহানা বেগমের দিকে চেয়ে আহাজারী করে উঠলেন, “ও ফারজাদের মা! তোমার ফারজাদের বুকে গুলি লাগছে গো! ও-য় এখন হাসপাতালে পইড়া আছে..ʼʼ

দ্বিজা কয়েক পা পিছিয়ে গেল রোবটের মতো পা ফেলে। ফারহানা বেগম বসে পড়লেন স্বামীর পাশে। সেদিন ফারজাদ মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেছে বাড়ির ওই গেইট দিয়ে, এরপর দ্বিজার বাপের থেকে দ্বিজাকে নিয়ে চলে গেছে ঢাকা। আর তারপর এই দিন ছিল কপালে! ফারহানা বেগম আর নড়লেন চড়লেন না। বোধহয় দাঁত লেগে গেছে। আরও একটা ছোট্ট দেহ পেছনে কাতরাচ্ছে মাটিতে পড়ে, এবার সবার সেদিকে নজর গেল।

চলবে..

#তপ্ত_সরোবরে
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৩২.

ফারজাদের সেন্স নেই আঠারো ঘন্টা যাবৎ। দুপুর গড়িয়ে গেছে। ব্যস্ত হাসপাতালের সরু বারান্দা জুড়ে লোকের আনাগোনা। সব ছাপিয়ে ফারজাদের বাড়ির মানুষ গুলো যাযাবরের মতো বসে, দাঁড়িয়ে আছে। যে লোক ফারজাদকে ভর্তি করেছে সে এনেছে ফারজাদকে মালিবাগের ইবনে সিনাতে।

ফারজাদকে যে কেবিনে রাখা হয়েছে তার বাইরে দরজার এক কোণে ঠেস দিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো বসে দ্বিজা। তার নজর ওপরের দিকে, অনির্দিষ্ট কোথাও আটকে আছে। চোখ দুটো বোধহয় আজ মেয়েটার ঝরনার বিশেষত্ব লাভ করেছে। একাধারে কোণ বেয়ে জল গড়াচ্ছে। দিলরুবা বেগম তাকালেন মেয়ের দিকে, তার মনে হলো দ্বিজা ইহজগতে নেই বোধহয়! খবর দিলো সামাদ সকাল আটটার দিকে, তারা ঢাকা পৌঁছেছে দুপুর বারোটায়। যোহরের আজানের আগ দিয়ে ডাক্তার জানল ফারজাদের অভিভাবক পৌঁছেছে। সে জানালেন, বেশ ভালো পরিমাণে রক্ত গেছে দেহ থেকে, সার্জারীর সময় রক্তের খুব প্রয়োজন ছিল, তবে ফারজাদের রক্ত তার মতোই বেকায়দা গ্রুপের– এ নেগেটিভ। পাওয়া বেশ দুষ্কর। তবে এখন আর রক্ত না দিলেই নয়। ডাক্তার বললেন, “আপনারা যথাসম্ভব ব্লাড যোগাড় করুন।ʼʼ

দ্বিজা কেবিনের দরজায় মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। আচানক ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে এলো, “স্যার! আমার রক্ত এ-নেগেটিভ। চলুন, কোথায় ডোনেট করতে হবে, জলদি চলুন স্যার! আসুন, আসুন।ʼʼ

হাঁটা ধরেছে মেয়েটা। ডাক্তার একটু অবাক হয়ে তাকালেন, পাগলের মতো করছে মেয়েটা। শরীরে হাড়ের গায়ে অতিরিক্ত মাংস নেই এক টুকরো, মুখ চোখ শুকনো, বয়স আর কত হবে, ঊনিশ? ডাক্তার মানা করলেন, “তুমি ব্লাড ডোনেট করে নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়বে। আপনারা অন্য কোনো ব্যবস্থা করুন, জলদি।ʼʼ

-“অসুস্থ হই আর মরে যাই তা আমি বুঝব। আপনার তো বুক ফাটার কথা নয়। আপনি ডাক্তার রোগী বাচানো আপনার কর্তব্য। যে ওই যে ওই বেডে অচেতন পড়ে আছে, তাকে বাঁচানোর চেয়ে এই যে আমি দিব্যি দাঁড়িয়ে আছি তার প্রতি ডাক্তারী দেখাচ্ছেন? দেরী হচ্ছে, চলুন তাড়াতাড়ি।ʼʼ

দিলরুবা দ্রুত এসে মেয়েকে ধরলেন। করুণ চোখে তাকালেন ডাক্তারের দিকে, ক্ষমা চাইলেন মেয়ের হয়ে। ডাক্তার এবার ধমকে উঠলেন, “উন্মাদ হলেই সব সমাধান হয়ে যাবে? বোকা মেয়ে! আমরা চেষ্টা করছি না?ʼʼ

নাক শিউরে তাকাল দ্বিজা। হঠাৎ-ই আবার ধীরে ধীরে কাতর হয়ে উঠল মলিন মুখটা, আপনারা কেমন চেষ্টা করছেন, “স্যার! এখন কোথায় কার কাছে রক্তের খোঁজ করতে যাবে। দেরি হয়ে যাচ্ছে, স্যার! ফারজাদের দিকে তাকিয়ে দেখুন না! কেমন করে পড়ে আছে! স্যার, আমার কিচ্ছু হবে না, আমার শরীরে রক্তের অভাব নেই। স্যার, ফারজাদের কিছু হলে আমার কী হবে? এই শরীরে রক্ত বাঁচিয়েই বা কী করব তখন?ʼʼ

কেমন শিশু বাচ্চাদের মতো অবুঝ জিদ। কথাগুলো বলতে বলতে ডুকরে কেঁদে উঠল মেয়েটা। দিলরুবা বেগমের বুকে সইল না। ফিরোজা চোখের পানি মুছে দ্বিজাকে ধরল, দিলরুবা বেগম সরে গেলেন মেয়ের কাছ থেকে। ডাক্তার হতাশ এক শ্বাস ফেলে চলে গেলেন কেবিনের দিকে। নার্সের পিছু পিছু চলল দ্বিজা। তিনদিন পর দেখল ফারজাদকে। ইশ! সে সেদিন বাসের জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ওই চটা ভ্রুওয়ালা মুখটা দেখতে পায়নি। পাবার কথা নয় তো! পরবর্তি দেখা এই হালে হবে, সেদিন কী করে দেখা হয়!

ডাক্তার বলেছিল ব্লাড দেয়ার পর ওকে বেডরেস্টে রাখতে, আমিষ ও শর্করা জাতীয় খাদ্য দিতে। সে রক্ত দিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে অল্প একটু পানি মুখে নিয়ে নিয়েছিল বোতল থেকে।

সপ্তাহখানেক আগে সন্ধ্যার পর দ্বিজা বারান্দায় বসেছিল। ফারজাদ এলো, দ্বিজা উঠল না। হাতমুখ ধুয়ে নিজেই এসে পাশে বসল দ্বিজার। ঘাঁড় ঘুরিয়ে দেখল না সে। দুটো চকলেট এগিয়ে দিলো ফারজাদ, “চকলেট পছন্দ তোর?ʼʼ

-“হু।ʼʼ দ্বিজা নিলো চকলেট দুটো, ডেইরি মিল্ক চকলেট। ফারজাদ জিজ্ঞেস করল, “বলিসনি তো কখনও!ʼʼ

-“বলতে হবে কেন?ʼʼ

-“মন খারাপ নাকি তোর?ʼʼ

-“না। মন খারাপ হবে কেন?ʼʼ

-“কারণের তো আর অভাব নেই।ʼʼ

দ্বিজা জবাব দিলো না। ফারজাদও বেশ কিছুক্ষণ চুপ রইল। এরপর বলেছিল, তোকে ভালোবাসি অথবা বাসব এমন কিছু বলব না। তবে তোকে ভালো রাখার আছে। তুই আমার কর্তব্য আর….ʼʼ

-“আর?ʼʼ ফারজাদের কথা শেষ না হতেই তাচ্ছিল্য হেসে জিজ্ঞেস করল দ্বিজা। বেশ কিছুদিন খুব অনীহা জন্মে গেছিল ফারজাদের ওপর যেন। আগ্রহ নিয়ে কথা বলতো না আর, এড়িয়ে চলেছে খুব। ওই ফ্লাটে একাকীত্বে বন্দি জীবনটার ওপর অজান্তেই বোধহয় বিতৃষ্ণা চলে এসেছিল ওর। খুব এড়িয়ে চলছিল সে ফারজাদকে। কেন জানি কিছুই ভালো লাগতো না আর, যেন ফারজাদকেও না। মনের মধ্যে সবসময় একটা অভাববোধ, মাঝেমধ্যে বোধহয় অনুশোচনাও এসে ভিড় করতে শুরু করেছিল। সে কতটা ঠিক করেছে, কতটা ভুল! সেদিন ফারজাদ আলতো করে কপালে চুমু দিয়ে বলেছিল, “আর জানিনা। কিন্তু যথাসাধ্য চেষ্টা থাকবে তোকে ভালো রাখার। আমাকে একটু সময় দে, সবকিছুসহ নিজেকেও একুট গুছিয়ে নেয়ার সুযোগ দে। আমি বদলাচ্ছি, নিজেকে, আশপাশকে, চেষ্টা করছি আরও বদলানোর। সব ঠিক করে দেব আমি, একটুও কম রাখব না। আর এই ফ্লাটও ছেড়ে দেব ভাবছি। নতুন একটা ভালো ফ্লাট নেব, কিছু ফার্নিচারও কিনতে হবে। এই শ্মশান মার্কা ফ্লাট আমার জন্য ঠিক থাকলেও, তুই তো আর আমি না। তাই একটু জীবন্ত একটা ফ্লাট নিতে হবে, আর সেখানে মানুষের ব্যবহার্য কিছু জিনিস আনতে হবে।ʼʼ

আনমনেই কথাগুলো বলে হেসেছিল ফারজাদ সেদিন। যেন নিজের কথাতে নিজেই বেশ মজা পেয়েছে সে।

চোখদুটো বুঝতেই সেই স্মৃতি এসে কিছুক্ষণ ধরা দিলো মস্তিষ্কে। শব্দ করে পাগলের মতো কেঁদে উঠল দ্বিজা। দৌঁড়ে এলেন দিলরুবা বেগম, হাবিব সাহেব, ফারিন। ফারহানা বেগম গুনগুন করে কেঁদে চলেছেন বাড়ি থেকে বাস, বাস থেকে এখানে এসে পৌঁছানোর পর থেকে এখন অবধি। সবার চোখে পানি বুকে বিষাদ থাকলেও এই মেয়ের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। সহ্য করা যাচ্ছে না এই মেয়ের বুক ছেঁড়া, আর্তনার আর হাহাকার। মাঝেমধ্যেই চোখ বুজে কিছুক্ষণ চুপ থাকে আবার জোরে করে কেঁদে ওঠে। উঠে দাঁড়িয়ে টলমলে পায়ে দৌঁড়ে যায় কেবিনের দরজায়। আবার ধীরে ধীরে এসে ধপ করে বসে পড়ে হাসপাতালের ধুলোয় জড়ানো নোংরা মেঝের ওপর শরীর মেলে দিয়ে।


লাবন্য আর আমেনা বেগম রয়ে গেছেন বাড়িতে। ওনার হাঁপানি আছে, তাই চেয়েও যেতে পারেননি, কেউ নেয়নি। লাবন্য এ অবধি সকাল থেকে তিন চারবার বমি করেছে। তার শরীর এই ভালো, এই খারাপ হয়ে গেছে। ইরফান এলো দুপুরে। দুপুরের খাওয়া-দাওয়া এ বাড়িতেই করল। লাবন্য কথা বলছে না। তার সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে এজন্য নাকি তা বোঝা যাচ্ছে না। ইরফানকে লাবন্য সেই সকাল নয়টায় কল করে বলেছে, খবরটা। ইরফান পৌঁছেছে দুপুরে। এরপর থেকে দুজনের বাক-বিতণ্ডা চলছে। ইরফান লাবন্যকে নিয়ে যাবে না ঢাকা এ অবস্থায়। লাবন্য জানিয়ে দিয়েছে, তাহলে সে একাই যাবে সেখানে। এরপর আরও একবার জিজ্ঞেস করেছিল ইরফানকে, “নিয়ে যাবে কি না ঢাকায়!ʼʼ

ইরফান গম্ভীর মুখে অস্বীকার করেছে, “এ অবস্থায় জার্নি করলে তোমাকেও ওই একই হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। বোঝার চেষ্টা করো, তুমি তো অবুঝ মেয়ে নও, লাবন্য!ʼʼ

লাবন্য চিৎকার করে উঠল, “আমি অবুঝ নই, তবে তুমি স্বার্থপর নিশ্চিত। ফারজাদ ভাই ওখানে মরছে কি বাঁচছে, আর আমি এখানে দুই মাসের পেট নিয়ে সিন্দুকে উঠে থাকি! মানুষের তো আর বাচ্চা পেটে থাকে না! তারা তোমার মতো বউকে বাক্সে তুলে রাখছে!ʼʼ

ইরফান শুধু চোখ মেলে তাকাল, কথা বলল না। তার মুখটা ভারী গম্ভীর। শান্ত মানুষ সে। তৈরী হতে হতে লাবন্যর একটু হুশ এলো। নরম সুরে বলার চেষ্টা করল, “তুমি কে বুঝছো না! সকলে গেছে ওখানে। কারও কাছ থেকে খবর নেবার জো নেই। কেউ ফোন তুলছে না। কী হয়েছে, কতটা সিরিয়াস অবস্থা, ভালো কি মন্দ কিছুই জানিনা। কীভাবে বসে থাকি এভাবে বাড়িতে। বমির ওষুধ খেয়েছি তো, আর হবে না বমি।ʼʼ

বাসেও ইরফান কথা বলল না কোনো। ধরে তুলল ব্যাগটা, এরপর লাবন্যকে উঠিয়ে এনে সিটে বসিয়ে বসিয়ে দিলো। যেন লাবন্য নিজের পায়ে চলাচল করতেও অপারগ। এই নিয়েই আজকাল তর্কাতর্কি লাগে তাদের মাঝে। লাবন্যর মনে হয় ইরফান যেভাবে তাকে ট্রিট করে যেন সে ল্যাংড়া, খোঁড়া, কানা প্রতিবন্ধী। লাবন্য হাতে পানির বোতল ধরিয়ে দিয়ে চুপচাপ বসে রইল পাশে। লাবন্যর মনটা খারাপ লাগছে। এই মানুষটার ওপর রাগ করে থাকাও এক অসম্ভব কর্ম। খুব খারাপ লাগছে এখন, নিজের খিটখিটে মেজাজের ওপর রাগ লাগছে। আজকাল মেজাজটা সবসময় চড়েই থাকে তার। তবুও কোনো অভিযোগ নেই মানুষটার। শুধু নিয়ম করে ক্ষেপায় লাবন্যকে। কিছুক্ষণ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থেকে বলল, “ফারজাদ ভাই আমার চাচাতো ভাই। আমার তো বড়ো ভাই নেই, আর একসাথে মানুষ হয়েছি এই বাড়িতে। জানো, আব্বুর চেয়ে বেশি অবদান আমার জীবনে আমার বড়ো আব্বার। সেই ফারজাদ হাসপাতালে পড়ে আছে গুলি খেয়ে..

-“রচনা শুনতে চেয়েছি আমি? যা বলছো সব জানা কথা। অজানা কিছু বলো, এমনিতেও বোর হচ্ছি।ʼʼ

ভ্রু জড়িয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ ইরফানের দিকে। ইরফানের মুখটা এখনও গম্ভীর। তার হাতের বাহুর ফাঁকে হাত ঢুকিয়ে মাথাটা চেপে দিলো কাধে। আস্তে করে জিজ্ঞেস করল, “কয়টা বাজে, কখন পৌঁছাব ঢাকা? সেই কতদিন আগে এসেছি ঢাকা থেকে, আর যাওয়া হয়নি।ʼʼ

হঠাৎ-ই মনে পড়ল লাবন্যর, একবার ফারজাদকে বলেছিল, ঢাকা যাবার ইচ্ছের কথা। ফারজাদ জিজ্ঞেস করেছিল, ইচ্ছে থাকলে যাবি, তবে কী! লাবন্য আর কথা বলেনি। তখন সে আসলেই বোকা আর বাচ্চা ছিল। সেদিনের কথা মনে পড়ে হাসি পেল। সে ফারজাদের সাথে যাবার আকাঙ্ক্ষা নিয়েই বলেছিল কথাটা। অথচ যাচ্ছে নিজের ভাগ্যের সাথে। সে খুশি এবং সন্তুষ্ট নিজের তকদিরের ওপর। একটুও অভিযোগ নেই আর। আরও একটু গা মিলিয়ে বসল ইরফানের। ইরফান হাত দিয়ে আগলে নিলো ওকে। চোখদুটো বুজে নিলো পরম শান্তিতে। তখনই আবার মনে পড়ল ফারজাদের কথা। বুকটা ভার হলো, না জানি কী হালে পড়ে আছে হাসপাতালে! কেমন আছে এখন? কী খবর! আচ্ছা! সামাদ গুলিটা লেগেছ বুকের ওপরে। তড়াক করে মাথাটা সরিয়ে নিলো ইরফানের বুক থেকে। বুকটা ধুকধুক করছে, খারাপ কিছু হবে না তো!


একুশ ঘন্টা পেরিয়ে যাবার পরেও কোনো রকম প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না ফারজাদের। গুলিটা লেগেছে বক্ষপিঞ্জরের ডান পাশে যকৃতের ওপরের দিকে কাধের নিচে। গুলিটা পিঠ চিড়ে বেরিয়ে গেছিল। বামপাশে লাগলে হৃদযন্ত্রের ক্ষতি হবার সম্ভাবনা থাকতো এবং হতে পারতো ঘটনাস্থলেই ফারজাদ মারা যেতে পারতো। তবে সেই রিস্কটা নেই এখন আর। তবে রিস্ক তো কাটছেই না। রক্ত দেয়া হয়েছে বেশ কয়েক ঘন্টা আগে। এর জন্য জ্ঞান ফেরার সময়সীমা চব্বিশ ঘন্টার বেশি ডাক্তাররা দিতে পারেন না। তাতে সেন্সলেস অবস্থায় কোমা অথবা ডেড হয়ে যাবার শতভাগ চান্স রয়েছে। তার মধ্যে কেটে গেছে একুশ ঘন্টা।

ফারজাদের গায়ে ফিট লাগার সমান জ্বর ছিল। ফারজাদ তরতরে, তাগড়া পুরুষ মানুষ। তাই হয়ত ফিট লেগে যায়নি, অথচ তার শরীরের তাপমান ১০৪ ডিগ্রি ফরেনহাইট ছাড়িয়ে গেছিল। বাহুতে গাঢ় ক্ষত, সেখান থেকে রক্ত ঝরেছে, বুক থেকে ব্যাপক হারে রক্ত গেছে। শিরা ছিন্ন করে গুলি ফুঁড়ে বেরিয়ে গেছে পিষ্ঠদেশ ছেদ করে।

ডাক্তার চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তিনি অপেক্ষারত ছিলেন আঠারো ঘন্টা পার হলে নিশ্চিত জাগ্রত হবে ফারজাদ। অথচ এবার আর অপেক্ষা করার মানে হয় না। দ্বিজা পাগলপাড়া হয়ে উঠেছে, উদ্ভ্রান্তের মতো লাফালাফি, ছোটাছুটি শুরু করেছে। বারবার ফারজাদকে গিয়ে ডাকছে। আবার ছুটে যাচ্ছে নার্সকে ডাকতে, ডাক্তারকে ডাকতে। এরপর বিলাপ করতে বসছে, “ফারজাদ উঠছে না কেন? কথা বলছে না কেন? ডাক্তাররা শুধু আর সব রোগীদের চিকিৎসা করছে, ফারজাদের দিকে নজর দিচ্ছে না। ওকে সেবা করছে না..ʼʼ

ডাক্তারসাহেব এলেন আজাদ সাহেবের কাছে। আজাদ সাহেব মুখ তুলে চাইলেন। ডাক্তার বললেন, “দেখুন, আমরা আবার পেশেন্টকে অবজার্ভ করেছি, এণ্ড উই নটিসড, হি ইজ স্টিল নো ব্রেথিং। আপনি বুঝতে পারছেন আমার কথা? তার শ্বাসরোধ হয়ে আছে। ফুসফুস ধীরে ধীরে কার্যক্ষমতা হারাচ্ছে। ফুসফুসের প্রসারণে বাধাগ্রস্থতা দেখা দিয়েছে। এবং নার্ভ সক্রিয়তা হারিয়েছে। একুশ ঘন্টা অভার। এতক্ষণে একবার হলেও তার একটা আঙুল হলেও মুভ করার ছিল, বাট উই আর সরি। সো.. সো নিকেথামাইড আইইন একটা কোরামিন দিতে হবে। আপনি না-দাবী দিন। বেশী দেরী করা যাবে না। কেঁদে ফেললেন আজাদ সাহেব। না-দাবী! হায়রে!

দ্বিজা থেমে গেছে যেন। শ্বাস আটকে চেয়ে দেখল কোরামিন ইঞ্জেকশন পুষের না-দাবীতে সাইন করে দিলেন আজাদ সাহেব।

আর্তনাদ করে উঠল মেয়েটা সৃষ্টিকর্তার কাছে, আল্লাহ পাক! আমার বুক খালি করবেন না আপনি, আমার কলিজায় থাবা দেবেন না আপনি। আমার দাবী এটা আপনার কাছে, এখনও বহুত হিসেব মেলানো বাকি আছে।

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে