তপ্ত সরোবরে পর্ব-১৮+১৯+২০

0
702

#তপ্ত_সরোবরে
#তেজস্মিতা_মর্তুজা

১৮.

“আপনাকে কে বলল আমি ফারজাদ ভাইয়াকে পছন্দ করতাম?ʼʼ

“আগের কথা ছাড়ো, এখন তো তুমিই বলছ।ʼʼ

লাবন্য নাক কুঁচকায়, “আমি বলছি?ʼʼ

“বলছ না?ʼʼ

লাবন্য গম্ভীর মুখে নাক শিউরে তাকিয়ে রয়। ইরফান ঠোঁট চেপে হেসে বলল, “মাঝরাতে এসব অলক্ষুনে প্রশ্ন না করে একটু রোমান্টিক কথা বললেও তো পারো।ʼʼ

লাবন্য অপ্রস্তুত হয়ে চোখ বড়ো করে তাকাল। এরপর রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে রইল ইরফানের দিকে। ইরফান লাবন্যর চোখের দিকে এবার পূর্ণদৃষ্টি মেলে তাকাল, ঘাঁড় নেড়ে ভ্রু নাচিয়ে চমৎকার ভঙ্গিতে বলল, “কী হয়েছে? কী জানতে চাও? ফেলে আসা কাল নিয়ে আমার কোনো লেনদেন নেই। ফেলে আসা সেই অতীতকে ধরে রাখা যায় যার পরিণতি বর্তমানে প্রভাব ফেলছে। তুমি তো মুভ অন করেছ, লাবু! ইনফেক্ট, স্বামী-স্ত্রী হবার আগে আমরা কিন্তু বন্ধু, এটা ভোলা যাবে না। আর বন্ধু হিসেবে তোমার চোখের ভাষা পড়াটা খুব কঠিন ছিল না আমার জন্য। মোরওভার, বন্ধু হিসেবে আমার রিয়্যাকশনটাই বা কেমন হওয়া উচিত ছিল? নিশ্চয়ই তোমায় সান্ত্বণা দেয়া, সঙ্গ দেয়া এবং সেই কষ্ট ভুলে নতুন করে বাঁচার প্রেরণা যোগানো? যা আমি করতে পেরেছি কিনা জানিনা, তবে চেষ্টা থাকবে সবসময়।ʼʼ

লাবন্য অভিভূত নজরে তাকিয়ে ছিল এতক্ষণ ইরফানের দিকে। ইরফান কথা থামাতেই আনমনে প্রশ্ন করে উঠল, “আর স্বামী হিসেবে? স্বামী হিসেবে কিছু বলার নেই?ʼʼ

শব্দ করে শ্বাস ফেলল ইরফান। লাবন্যর দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিয়ে আস্তে করে বলল, “উহু! তখন তো আর আমি ছিলাম না। আর প্রেমে পড়ার বয়সও তোমার পেরিয়ে যাচ্ছিল। সে হিসেবে দোষটা আমারই, আমি তোমার লাইফে আগে এন্ট্রি মারলে আর ফারজাদ বাবুর প্রেমে পড়ার সুযোগ পেতে না। আমিও তো করেছি প্রেম, কারণ তখন তুমি ছিলে না। শোধ গেছে।ʼʼ

বলেই চোখ মারল ইরফান, তার সহজ হাসিটা ঠোঁটে ঝুলছে। লাবন্য অবাক হয়। একটা মানুষের সর্বক্ষণের অভিব্যক্তি সকল কিছুর পরিপেক্ষিতে এত সহজ কী করে হয়? সবকিছু মেনে নেয়ার ভয়ানক শক্তিধর এই মানুষটা। সব কিছুর সহজ ব্যাখ্যা আছে তার কাছে। লাবন্য মুচকি হাসল। বারান্দার রেলিংয়ে হাত প্রসারিত করে আকাশের দিকে তাকিয়ে হাস্যজ্জ্বল কণ্ঠে উদাসী গলায় জিজ্ঞেস করল, “আপনি সত্যিই প্রেম করেছেন আগে?ʼʼ

ইরফান তড়াক করে ঘাঁড় ঘুরিয়ে লাবন্যর দিকে তাকায়। ঝরঝরে একটা হাসি দিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে বলল, “আর ইউ জেলাস, লাবু?ʼʼ
কথাটা শেষ করে দুষ্টু প্রানখোলা হাসিতে মেতে উঠল ইরফান। হঠাৎ-ই হাসি থামিয়ে ছোটো বাচ্চাদের মতো আবদার করার ভঙ্গিতে বলল, “একটা সিগারেট খাই? একটা মাত্র। তুমি চাইলে তোমাকেও দু-এক টান মারতে দেব, সত্যি!ʼʼ

লাবন্য চোখ সরু করে তাকাল। ইরফান বাচ্চাদের মতো ঠোঁট ফুলিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল, “এই জন্য বলতাম, ব্যাচলর লাইফ ইজ বেস্ট।ʼʼ

একটু চুপ থেকে আবার বলল, “এই, তোমাকে বলেছি না–আমায় ‘আপনিʼ ডাকবে না। তোমার এই ডাকে, বউয়ের কাছে ভরা যৌবনের কালটা বুড়ো বুড়ো লাগলে এটাও এক ধরণের ছ্যাঁকা। তুমি তোমার এই ডাক দিয়ে আমার দুই যুগ বয়স বাড়িয়ে দিচ্ছ দিন দিন।ʼʼ

লাবন্যর ভ্রু কুঁচকায়। সে সবসময় বলতে পারে না ঠিকই। তবে মাঝেমধ্যেই তুমি সম্বোধন করে ফেলে। তা কি এই লোকের হিসেবে শামিল হয় না? এর ঢঙ দেখে লাবন্য আজকাল খুব হাসে, বারবার হাসে, প্রায় সবসময় হাসে। তার মনে হয়–ভাগ্য ততটাও নির্মম নয়, যতটা কঠোর ক্ষেত্রবিশেষ মনে হয়। নিজেকে এবং পরিস্থিতিকে সময় দিতে হয়। সৃষ্টিকর্তা একাধারে শুধু মানুষকে নিরাশ করেন না মোটেই। কিছু কেড়ে নিলে কোথাও না কোথাও কিছু দেনও বটে! এটাই তবে তার ইনসাফ! লাবন্যর নিজেকে সুখী-সুখী লাগে আজকাল খুব। সাথে অজানা ভয় চড়ে উঠছে কোথাও–মুক্তমনা, প্রাণোচ্ছল এই মানুষটিকে হারিয়ে ফেলার।


দ্বিজার রাতটা কেটেছে নিজেকে বোঝাতে। সে বুঝিয়েছে নিজেকে, ইরফানের বলা কথাগুলোকে বিশ্লেষন করেছে, তার সঙ্গে নিজের অনুভূতির সমীকরণ তৈরী করেছে, সবশেষে–ফারজাদের প্রতিক্রিয়াকে সামনে রাখায় সবটা মুচরে পিষে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে। নিজের সঙ্গে এই একরাত ত্যাগের যূদ্ধ চালিয়ে সে ছেড়ে দিয়েছে ফাদজাদকে তার জায়গায়। নিজেকে শাসিয়েছে—আর লাগবে না ফারজাদকে।

মানসিক যন্ত্রণা পীড়া দিলে মানুষ সচরাচর ঘুরেফিরে সৃষ্টিকর্তার শরণাপন্ন হয়, বেজায় শান্তিদায়ক স্থান সিজদার জায়গাটা। ফজরের আজানের ধ্বনি শোনা গেলে উঠে গিয়ে ওযু করে এসে ফজরের নামাযে বসে যায় দ্বিজা। এরপর অসহ্য মাথা ব্যথায় কাতর হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল, তখন প্রকৃতিতে আলো ফুটে উঠেছে।
বেলা দশটার দিকে দিলরুবা বেগমের দরজা ধাক্কানিতে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলো দ্বিজা। আব্বু ডেকেছে তাকে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওড়নাটা ভালোভাবে শরীরে পেঁচিয়ে আম্মুর পিছু পিছু অপ্রতিভ পায়ে হেঁটে ডাইনিং রুমে গিয়ে উপস্থিত হলো। ওর দিকে না তাকিয়েই হাবিব সাহেব শক্ত গলায় বললেন, “খেতে বসো।ʼʼ

দ্বিজার খেতে ইচ্ছে করছে না, তবুও ক্ষীণ হাতে চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে খেতে বসে গেল। খেতে খেতে হঠাৎ-ই হাবিব সাহেব প্রশ্ন করলেন, “এখন তোমার মতামত কী? ওয়াহিদের চাচা কল করছিল সকালে। ভাবনা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেও।ʼʼ

“সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি। বিয়ে করব না।ʼʼ

আবার যেন ধপ করে জ্বলে উঠলেন হাবিব সাহেব, “বিয়ে করবা না, তো কী করবা? আমার মান সম্মান নিয়ে ডুগডুগি খেলবা? অপদার্থ মেয়ে! পাত্রপক্ষের সামনে খুব নিজের মতামত জানাতে শিখছ না? এই পাত্র গেলে তোমার তো বিয়েই হবে না। তোমার মতো অপদার্থ, অবাধ্য মেয়েরে কেউ ঘরে তুলবে? কী করবা ভাবছ? ওই আমার শ্যালকের ছেলের সাথে ভাগবা? আমি তোমারে টুকরা করে কেটে পানিতে ভাসায়ে দেব…

বাইরে গেট খোলার শব্দ এলো। হাবিব সাহেব একবার তাকালেন সেদিকে। আবার ফিরে বলতে লাগলেন, “তুই চাস বা না চাস তোর বিয়ে এইখানেই হবে। তোর মতো মেয়ের মন্তব্যে পরোয়া নাই আমার।ʼʼ

ফারজাদ এসে দাঁড়াল খাওয়ার টেবিলের থেকে একটু দূরে। দ্বিজা বিস্মিত নজরে তাকায় সেদিকে, গলায় আটকে যাওয়া ঢোকটা গিলে নেয় বুকের ধুকপুকানির সাথে। যেই মানুষটার বিরহে সে আজ সে ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রায়, সেই মানুষটা এসে দাঁড়াচ্ছে সামনে এমন এক সংকটাপন্ন সময়ে! হাবিব সাহেব ভ্রু কুঁচকে ক্ষিপ্ত নজরে তাকায় ফারজাদের দিকে, “তোমার মতলব কী? আমার বাড়িতে আগুন লাগায়ে মন ভরেনি? এবার আবার তামাশা দেখবার আসছ? তোমার মতোন অপদার্থের কাছে আর আশাই বা কী করা যায়? জীবনে করছটা কী? মানুষের চামড়া আছে নাকি তোমার বাড়ির কারও গায়ে? তোমার বাপের কাছে জীবনে মানুষ ভালো কিছু পায়নি, তোমার কাছে কী আশা করা যায়? নিজের জীবনটারেই তো গোল্লায় দিছো। দেখলে তো মেশিন ছাড়া আর কিছু লাগে না। সেই কালে অকাম-কুকাম করে নিজের জীবনের খেলা সাঙ্গ করছ, এখন আর কাউরে ভালো থাকতে দেখতে মন চায়না? আমার মেয়ের পিছনে লাগছ এখন?ʼʼ

বলতে বলতে হাবিব সাহেব এগিয়ে গেলেন ফারজাদের দিকে। ফারজাদ নীরব-নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। আস্তে করে মাথাটা নামিয়ে নিয়ে বলল, “ফুপা, মিস-আন্ডার্স্ট্যান্ডিং হচ্ছে আপনার। আপনি শুধু শুধু দ্বিজার ওপর..ʼʼ

এবার তেড়ে গেলেন হাবিব সাহেব গজরাতে গজরাতে ফারজাদের দিকে, “তুমি শিখাবা আমায় কোনটা ভুল? তোমার বাপে আমারে বলছিল–আমি নাকি জীবনে কিছূই করতে পারব না। তুমি কী করছ? কিচ্ছু করতে পেরে শেষমেষ পুলিশের চাকরি করবার লাগছ? সে তুমি যা খুশি করো। আমার মেয়ের থেকে দূরে থাকবা। তোমার পরিবারের কোনো লোকের ছায়াও যেন আমার বাড়ির উপরে না পড়ে।ʼʼ

ফারজাদ কিছুসময় শীতল নজরে তাকিয়ে থেকে বলল, “ফুপা, এখানকার বিষয়টা এগুলো না। আপনি পুরোনো কথা নিয়ে এত ক্যাচক্যাচ করছেন। হয়েছে কী সেটা শুনতে এসেছি।ʼʼ

“এত ভোলাভালা সাজছ কেন? জানো না কী হইছে, হ্যাঁ? তোমার বিরহে কেউ বিয়ে শাদি বাদ দিয়ে সন্ন্যাসীনী হবার পথে, আর তুমি জানো না কী হইছে?ʼʼ

“দ্বিজা বিয়ে যখন বিয়ে করতে চাইছে না, তখন আপনিই বা জোর করছেন কেন? পড়ালেখা করুক, বিয়ে বয়স তো আর পেরিয়ে…ʼʼ

“চুপ করো বলতেছি, আর একটা কথাও বলবানা তুমি। তোমার থেকে পরামর্শ চাইছি আমি? আমার বাড়িতে আগুন লাগায়ে এখন আবার আসছ শুকনো খড় ছুঁড়তে? কে তুমি হে?ʼʼ

“আমি ফারজাদ। দ্বিজার মামাতো ভাই।ʼʼ

“তাই নাকি? মামাতো ভাই? এই জন্য পাত্রপক্ষের সামনে নির্লজ্জের মতোন ‘নাʼ করে মেয়ে?ʼʼ

“তাহলে ও নিজের মতামত জানিয়েছে, এখানে আমি মামাতো ভাই হওয়া না হওয়াতে যায়-আসে কী, ফুপা?ʼʼ

“তুমিই তো ভরকাইছ। এখন ভালো মানুষ সাজছ? তোমারে চিনি না আমি? অপদার্থ, হারাম*খোঁড় কোথাকার! আমার মেয়েরে তুমি না উশকানি না দিলে এমনে এমনেই এত দূর গেছে সে? তুমি বলবা আমি মেনে নেব? সাধু পুরুষ তুমি? তোমার গোটা পরিবাররে চেনা আছে আমার। এই জন্য ওই মহিলারে কইছিলাম ওই বাড়িত আমার মেয়েরে নিয়া যাইস না। খুব ভালো মানুষ সাজতে আইছ আজ…ʼʼ

ফারজাদ একদম শান্ত। তার চোখে-মুখে অস্পষ্ট এক নিস্প্রভতা বিরাজ করছে। হয়ত পুরোনো দিনের কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা ঠেলে আসছে মস্তিষ্কে। পুরোনো কোনো হৃদয় ছিন্নভিন্ন করা ঘটনার পুনরাবৃত্তির ভয় পাচ্ছে ছেলেটা। সেরকমই কিছু একটা ঘটতে চলল আজও। ফারজাদ ক্ষীণ স্বরে দমে যাওয়া কণ্ঠে কেবল বলল, “আপনার ভুল হচ্ছে, ফুপা!ʼʼ

এবার হাবিব সাহেব অবাঞ্ছিত এক কাজ করতে উদ্যত হলেন। তেড়ে গিয়ে অকথ্য ভাষায় বকে উঠে হাত উঠালেন ফারজাদের ওপর। মুখে বললেন, “আমার ভুল হচ্ছে, হারামির বাচ্চা!ʼʼ

অথচ ওনার হাত ফারজাদ অবধি পৌঁছায় না। মাঝখানে এসে যোদ্ধার হাতের ঢালের ন্যায় দাঁড়িয়ে পড়ল দ্বিজা। তার চোখে-মুখে স্পষ্ট জলন্ত ক্ষোভ। খপ করে ফারজাদের পেশিবহুল হাতটা চেপে ধরল নিজের ছোট্ট হাতের তালুতে। একটু জোর প্রয়োগ করে ফারজাদকে পিছিয়ে নিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে যায় একদম ফারজাদের সামনে আব্বুর মুখোমুখি। জলন্ত গলায় বলল, “খবরদার আব্বু, ফারজাদের গায়ে হাত তোলার চেষ্টা করবেন না। অনেকক্ষণ ধরে যা নয় তা বলে যাচ্ছেন। আপনি সম্মান বলতে কী বোঝেন? আপনার সম্মান আছে আর কারও নেই? ফারজাদ ছোটো বাচ্চা? আপনি ওর গায়ে হাত তুলতে যাচ্ছেন। অন্তত ততক্ষণ এরকম কিছুই হবে না, যতক্ষণ এখানে আমি দাঁড়িয়ে আছি।ʼʼ

দ্বিজার গলাটা কেঁপে ওঠে কিঞ্চিৎ। পরিবেশটা থমথম করছে। ফারজাদ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একদৃষ্টে ছোট্ট এই তেজস্বিনীর দিকে তাকিয়ে। তার ভেতরে কোথাও বহুদিনের দাঁড়িয়ে থাকা দ্বিধার দেয়ালটায় ধাক্কা লাগছে বোধহয়! এই পুচকি মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে তার মতো একটা এসবিআই অফিসারের সামনে নিজের বাপের মোকাবেলায়! দ্বিজা চিৎকার করে উঠল, “আব্বু! কী মনে হয় আপনার? যত ঠিক বুঝ, যত বাস্তব জ্ঞান আপনারই আছে? আমি বলছি আপনি শুধুই একটা গোমরা, অহংকারী লোক। আর আপনার অহংকার আপনাকে অন্ধ করে রেখেছে। তাই তো ঠিক ভুল বাছ-বিচারের পরোয়া না কোরে মনগড়া অপবাদের দায়ে নিজের পুরাতন ক্ষোভ মিটাচ্ছেন!ʼʼ

হাবিব সাহেব এবার নিয়ন্ত্রণ হারালেন। দ্বিজার গালে সজোরে একটা থাপ্পর মারলেন। দ্বিজার মাঝে ভয় বা সংকোচের চিহ্ন প্রকাশ পেল না। আগের চেয়ে আরও দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “মারেন, আরও কয়েকটা থাপ্পর পাওনা আমার। এই যে এতদিন আপনাকে ভুল বুঝতে দিয়েছি। আপনার যা ইচ্ছে ভেবে বসে আছেন। কী মনে হয় আপনার? আপনি যা ভাবেন শুধু তাই-ই ঠিক?ʼʼ

“দ্বিজা চুপ কর নয়ত..ʼʼ

“নয়ত কী? নয়ত কী, আব্বু?ʼʼ

হাবিব সাহেব দ্বিজাকে পার করে এবার ফারজাদের দিকে আক্রমনাত্মক চিত্তে এগিয়ে যায়, দাঁতের মাড়ি চেপে বলতে লাগলেন, “তোর এসব স্পর্ধা আসে কোত্থেকে। তোর মাথাটা খাইছে এই অসভ্য, হারামি! যার ভিতরে মানুষের রক্ত-মাংসই নাই, ওর থেকেই তো শিখছিস এসব? এই জন্য এত প্রেম?ʼʼ

দ্বিজা ক্ষ্যাপাটে সিংহীর মতো গর্জে উঠল, থামেন আপনি! আপনার কাণ্ডজ্ঞানের খুব অভাব, আব্বু! আপনি বারবার ফরজাদের দিকে এগিয়ে যাবেন না, বলছি। আমি মাঝখানে আছি আমায় মারতে পারছেন না? ও কী করেছে? ভুল করেছি আমি, যা সব কিছু করেছি, সব আমি। এই কথাটা মাথায় ঢুকছে না আপনার? পরের ছেলের গায়ে হাত তুলতে যেতে এবার সম্মানে বাধছে না আপনার? আমি আছি তো আপনার সামনে, মারেন আমায়। আমায় মারেন!ʼʼ

শেষের কথাটা দ্বিজা সমস্ত গলার জোর দিয়ে বলে ওঠে। হাবিব সাহবে হঠাৎ-ই চুপ মেরে গিয়ে বিস্ময় ও ক্রোধে একাকার হয়ে কেবল ঝলসানো চোখে তাকিয়ে রইলেন দ্বিজার দিকে। ফারজাদ নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে। তার ভেতরে তোলপাড় চলছে। একদৃষ্টে কেবল সবটুকু মনোযোগ ধরে রেখেছে সে দ্বিজার ওপর। দ্বিজা কয়েকবার জোরে জোরে শ্বাস নিলো। তার চোখে জমে থাকা পানিটুকু টুপ করে গড়িয়ে পড়ে এবার গাল বেয়ে। মুখ তুলে এবার অদ্ভুত শান্ত স্বরে বলতে শুরু করল,

“আব্বু! আপনি জানেন না, আপনি কত বড়ো ভুলের মাঝে আছেন। আপনার কী মনে হয়–এই লোকটা আমার প্রেমিক?ʼʼ

কান্নামিশ্রিত স্বরে কথাগুলো বলতে বলতে হঠাৎ-ই মলিন হাসল দ্বিজা। আবার বলল, “যন্ত্রণা আব্বু! ফারজাদ যন্ত্রণা আমার। যাকে আমি সেই কবে থেকে নিজের ভেতরে খুব আদরে পালন করছি। আপনি বোঝেন না–এই লড়াই আমার একার? আব্বু আপনি কার ওপরে আঙুল উঠাচ্ছেন প্রেমের দায়ে? যে মানুষটার অস্বীকৃতিতে আজ এই হাল আমার? আপনি অপবাদ দিচ্ছেন তাকে, আব্বু!ʼʼ

দ্বিজার কথাগুলো শুনতে উপহাসের মতো লাগে। যেন সে নিজেকে উপহাস করছে, উপহাস করছে ফারজাদকে, উপহাস করছে আব্বুর ধারণাকে।

“আমি ভালোবাসি ফারজাদকে আব্বু! ফারজাদ তো কোনোদিন কোমল নজরেও তাকায়নি আমার দিকে। আমি ভালোবাসি ফারজাদকে–এর চেয়ে এ ব্যাপারে আর একটা শব্দও বেশি নেই। এরপর আর কিছুই না, আব্বু!
এ পর্যন্তই। আজ অবধি যা হয়েছে সবটা আমার একার এই নির্লজ্জ অনুভূতির জোরে।ʼʼ

হাবিব সাহেব তাকিয়ে আছেন মেয়ের মলিন অশ্রুসজল মুখটার দিকে। হুট করে জ্বলে উঠলেন যেন, এগিয়ে এলেন হুড়মুড়িয়ে, “তাহলে ও এখানে কী করতেছে, আমার বাড়ির মান-সম্মান, শান্তি, আমার সুখ সব খাইছে। ওরে তো..

সজোরে ধাক্কা দিতে যান তিনি ফারজাদকে। দ্বিজা একহাতে ফারজাদের হাতটা ধরে অপর হাতে হাবিব সাহেবের বাহুতে ধাক্কা দিয়ে নিজে ফারজাদকে নিয়ে একটু পিছিয়ে যায়। যেন ফারজাদ একটা বাচ্চা ছেলে, তাকে নিরাপত্তা দেয়া অবশ্য কর্তব্য দ্বিজার। ফারজাদ মোটেই চেষ্টা করছে না নিজেকে বাঁচাতে। সে তলিয়ে যাচ্ছে কোথাও। যে তলে ডুবছে সে, সেই সরোবরের গভীরতা নেই। অতীতের বিষাক্ত অভিজ্ঞতার স্মৃতিমূলক তীরটা বুকে আঘাত করছে, তো আবার বর্তমানের এই আশাতীত দৃশ্য তাকে প্রবল শক্তিশালি স্রোতের ন্যায় ভিজিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দূর অজানায় কোথাও!

চলবে…

#তপ্ত_সরোবরে
#তেজস্মিতা_মর্তুজা

১৯.

হাবিব সাহেব বললেন, “বের হয়ে যা, দূর হ আমার সামনে থেকে। তোর মতো মেয়ের দরকার নেই কোনো বাপের। চলে যা এক্ষুনি নয়ত আবার হাত উঠে যাবে কিন্তু! যা বের হ..

ফারজাদ বোধহয় সম্বিত ফিরে পেল এতক্ষণে, “ও বেরিয়ে যাবে কেন? বেরিয়ে কোথায় যাবে? আপনি আমায় নাহয় বের করে দিতে পারেন, ওকে..ʼʼ

হাবিব সাহেব আবার ধাক্কা দিতে উদ্যত হলেন ফারজাদকে, “তোমার জন্যে আজ আমার বাড়ির এই অশান্তি। আমার মেয়ে তো বেয়াদব আছেই, সাথে তুমি নষ্টের মূল। আর যেকোনো কারোর সাথে আমি সম্বন্ধ করতে রাজি আছি, কিন্তু তোমারে মতোন হারামির বাড়ির সাথে না। তোমার বাপ-চাচায় কম কথা শোনাই নাই আমায়। তোমার ফুপুরে নিয়ে এসে নাকি না খাওয়ায়ে রাখছিলাম আমি। আমি জীবনে কোনো কাজ পাব না, আমি ভাতুরে। তুমি সেই ভাতুরের বাড়িতে দাঁড়ায়ে থাকবা না। বের হও, যাও বলতেছি। এই কথাই ক্যান উঠবে? তোমারে জরায়ে আমার মেয়ের নাম উঠবে না ক্যান? সহ্য করব আমি? ওরে আমি ভাতুরে বাপ র ক্ত ঘামায়ে কামাই করে মানুষ করছি। ওর উপর ওই বাড়ির লোকের সরষে দানার ওতখানি অধিকার সহ্য করব ভাবছ? আগে ওরে
খু ন করব, তারপর তোমারে… তুমি এখানে আসছ সাফাই গাইবার জন্যে..

হাবিব সাহেব ক্রোধে ফেটে পড়ে আবার এগিয়ে গেলেন ফারজাদের দিকে।

দ্বিজা অসহ্য, অতিষ্ট ভঙ্গিতে চিৎকার করে উঠল, “থামেন তো আপনারা! এত তামাশা আর নিতে পারতেছি না আমি। আব্বু আপনি থামেন প্লিজ।ʼʼ

দ্বিজা হঠাৎ-ই চুপ মেরে যায়। মাথাটা নামিয়ে ঠোঁটটা জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে নেয়, কিছু বলার প্রস্তুতি নিচ্ছে সে। এরই মাঝে হাবিব সাহেবের যেন সইল না। উনি আবার বেসামাল হয়ে উঠলেন, “যাও তুমি আগে বের হও এইখান থেকে, ফারজাদ ভালো কথা বলতেছি চলে যাও, তোমারে কাউরে সহ্য হইতেছে না আমার..ʼʼ

“আব্বু আমি বিয়ে করে নেব।ʼʼ হুটহাট কথাটা বলতেই হাবিব সাহেব মনোযোগ ভ্রষ্ট হয়ে তাকালেন দ্বিজার দিকে। দ্বিজা এবার মাথা তুলে তাকাল, “আপনি যেখানে চাইবেন বিয়ে করে নেব আমি। শুধু আর কোনো পরিহাস বা ঠাট্টামূলক কিছু না ঘটুক এ ব্যাপার নিয়ে। আব্বু, এত কিছুর পরেও আর ফারজাদকে চাওয়ার প্রসঙ্গ কেন উঠছে এখনও, আব্বু! লাগবে না আর তাকে। বিয়ে করে নেব আমি। ওয়াহিদকে বিয়ে করে নেব। আর ফারজাদকে চাই না আমার, আপনি চাইলেও চাই না, ফারজাদ চাইলেও আর চাই না।ʼʼ

হাবিব সাহেব এবার কিছু বলতে গিয়েও নিজেকে সংবরণ করলেন। দ্বিজা আবার বলল, “আমি শুধু একটু সময় চাইছিলাম। এখন বিয়ে করার ইচ্ছে ছিল না, ব্যাস। কিন্তু এখন খুব ইচ্ছে করছে। আপনি ব্যবস্থা শুরু করেন। কিন্তু ফারজাদেকে দোষ দেবার চেষ্টা করবেন না। ভুল আমি করেছি। ফারজাদ কোনো ভুল করে না। জানেন, ফারজাদ আমায় বলেছিল–আমার এই অনুভূতি সস্তা, ঠুনকো, ফালতু অনুভূতি। এই কথাটা বুঝতে পারলাম এতগুলো দিন এত সব নিচু ঘটনা ঘটার পর। ফারজাদ কখনও ভুল বলে না, আর না আপনি। দেখেন না, আজ এই অনুভূতি সস্তা বলেই তো এসব সস্তা ঘটনা ঘটে যাচ্ছে এটাকে কেন্দ্র করে। এই ফিলিংসটা ফালতু, আর ঠুনকো বলেই তো আমি আজ ফালতু মেয়ের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে। ফিলিংসটা ঠুনকো ছিল বলেই আজ হুট করে ফারজাদকে ছেড়ে অন্য কারও সঙ্গে জীবন কাটানোর জন্য কত সহজে রাজী হয়ে গেলাম। আজ আরেকবার প্রমাণ হয়ে গেল–আপনি আর ফারজাদ কখনও ভুল বলেন না, ভুল করেন না, কখনোই না। ফারজাদ এই বাজে অনুভূতিতে পড়ে নি, কোনোভাবেই না, কোনোভাবেই না। হি ইজ পারফেক্ট, আব্বু, হি ইজ অনলি দ্য পারফেক্ট ম্যান। আর সেই তাকে আপনি কত কথা শোনাচ্ছেন। যেখানে এরকম হীন, লাঞ্ছিত, দামহীন ফিলিংসে মিছেমিছি ভেসে যাচ্ছি, আমি শুধু আমি।ʼʼ

দ্বিজার কথায় স্পষ্ট পরিহাস, ধিক্কার মিছিল করে বেড়াচ্ছে। তার কথা এবং কম্পমান কণ্ঠস্বরে প্রতিটা শব্দে শব্দে বিক্ষোভ, প্রতিটা ধ্বনিতে উপহাস খেলে বেড়াচ্ছে। আজ হুট করে ভুলভাল শব্দ উচ্চারণ করা, বোকা, আবেগী, ছোট্ট চঞ্চল দ্বিজাকে বিশাল ভারী জ্ঞানের পরিণত এক মেয়ে লাগছে। একেকটা কথায় ফুটে উঠছে বুকে চেপে রাখা তিক্ত অভিজ্ঞতার ছাপ। আপন মনেই ফারজাদের ঠোঁটের কোণে এক বিন্দু হাসি পরিস্ফুট হলো। মলিন, গুমোট হাসি। মেয়েটা ওকে ভুল প্রমাণ করতে ব্যস্ত, জানা-অজানায় অথবা আজকের এই প্রজ্জ্বলিত আচরণের ঝংকারে!

দ্বিজা আকাশের দিকে মুখ তুলে লম্বা এক দীর্ঘশ্বাস টেনে নিলো। অতঃপর একটা শক্ত ঢোক গিলে ভাবুক কণ্ঠে ধীর স্বরে বলল, “ফারজাদ কখনও এর আগে এভাবে অপমানিত হয় নি। অথচ আপনি তাকে অপমান করেছেন। এজন্যই হয়ত সে আমাকে এত ঘৃণা করে, আমার থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে চেষ্টা করে সবসময়। আমি শুধু ভাবছি–একটা মেয়ে এতগুলো মানুষের অশান্তির কারণ হয় কেমনে? এই প্রশ্নের উত্তর হয়ত কোনোদিন পেতাম না, যদি না আমি আমাকে দেখতাম।ʼʼ

গাঢ় এক শ্বাস ফেলল দ্বিজা, “আমার শুধরানো দরকার। আমার পাপমুক্তির জন্য তওবা করা দরকার। আব্বু আপনি তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করেন। সবার দুঃখের দিন শেষ করব আমি এবার। আব্বু আপনার ইচ্ছে মতোন আমি সব করব এবার।ʼʼ


রাত দশটা বেজে কয়েক মিনিট পেরিয়েছে। ফিরোজা এসে ইনভেস্টিগেশন করে গেছে–ফারজাদ কোথায় গিয়েছিল, হঠাৎ-ই বাড়ি কেন ফিরেছে, কী হয়েছে তার? সুবিধাজনক কোনো উত্তর না পেয়ে চলে গেছে সে ফারজাদের হাতে লাইটার ধরিয়ে দিয়ে। ছাদের একদম কিনারায় দাঁড়িয়ে ফারজাদ। খোলা মাঠের প্রান্ত থেকে ছুটে আসা ঝিরঝিরে হাওয়া ফারজাদের হাতের সিগারেটের আগুনে হল্কা জাগাচ্ছে। তাতে একটা টান দিয়ে ফারজাদ হাসল এবার। নিজেকে উদ্দেশ্য করে ঠাট্টার হাসি হাসল। সে নাকি অপমানিত হয় নি কখনও! দ্বিজা বলেছে আজ, হুহহ! পাগলি মেয়েটা জানে না ফারজাদের হারানোর খাতার পৃষ্ঠা সংখ্যা কত বৃহৎ! এটাই ফারজাদের এই অদ্ভুত আচরনগত দিকের সাফল্য। কেউ কখনও ফারজাদকে ব্যর্থ ভেবে সহানুভূতি দেখাবার সুযোগ পায় না। বরং ফারজাদ নিজের আচরণ দ্বারা নিজেকে ডুবিয়ে ফেলেছে এক সমৃদ্ধির নিষ্ঠুর জগতে।

এমন একটা দিনই তো ফারজাদকে আজকের ফারজাদ হিসেবে তেরী করেছে। তা ওই বোকা মেয়েটা জানে না? উহু, জানে না! তবে সেই দিনের সঙ্গে আজকের একটা বৈশাদৃশ্য আছে, সেটা জানা দরকার এই মেয়ের। যেটা আজ ফারজাদের খুব বলতে ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে–পরিণতি। সেদিনের পরিণতির সঙ্গে আজকের পরিণতি মিলছে না। অথচ আজও একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তার নিজের বাপের সামনে, আজও ফারজাদের গালে থাপ্পড় পড়ার ছিল, আজও একবার ভুল প্রমাণিত হয়ে ঘোর অপমানে জর্জরিত হবার ছিল ফারজাদের। আচ্ছা! আজও যদি সেদিনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটত, তাহলে ফারজাদ কেমন হয়ে যেত বাকি জীবনটা? একদম মৃত মানুষের মতো হয়ে যেত? হয়ত হত না, হয়ত হত, জানা নেই। তবে ঘটে নি তেমনটা।
ফারজাদ ডান হাতের তালুটা উঁচিয়ে ধরে চোখের সামনে আনল। অন্ধকারে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। এই হাতের কব্জি চেপে ধরে সামনে দাঁড়িয়ে বুক ফুলিয়ে বাপের মুখের ওপর স্বীকার করেছে দ্বিজা–আমি ফারজাদকে ভালোবাসি, আব্বু!

ফারজাদ অবাক চোখে তাকিয়ে রইল ক্ষণকাল নিজের হাতের দিকে। অদ্ভুত কিছু চলছে ভেতরে। কোথাও কিছু ভেঙে যাচ্ছে, ধসে পড়ছে–হতে পারে একটা পাহাড়সম ভয়, হবে হয়ত দ্বিধার প্রাচীর অথবা আঘাত লাগছে অনুরাগের কড়াঘাতে বুকের মাঝটায়! নির্দিধায়, নির্ভয়ে কী করে পারল মেয়েটা ফুপার মতো টগবগে লোকের সামনে এমন একটা কথা উচ্চারন করতে? থাপ্পড় খেয়ে থামেনি, যেন ভেতরের চাপা জ্বলন আরও উগ্র হয়ে বেরিয়ে এসেছে বাইরে। এত সাহস ওই দ্বিজা কোথায় পেল, কীসের জোরে পেল? বুক কাঁপেনি, দ্বিধায় বাঁধেনি। ফারজাদ কি পারত না নিজেকে বাঁচিয়ে নিতে? ওই পুঁচকি মেয়ে তাকে সংরক্ষণের দায়ে বাপের মোকাবেলায় কেন দাঁড়াবে? নাহ, একদম উচিত হয়নি। আজ মেয়েটা এমন একটা কাজ করেছে, এমন কিছু কথা বলেছে বলেই তো ফারজাদ ঘটা চলে ছাদে দাঁড়িয়ে মেয়েটার কথা ভাবতে শুরু করেছে। এটা কি ঠিক করেছে দ্বিজা?

ঘরের লাইট নিভিয়ে জানালার কাঁচ সরিয়ে সেদিকে মুখ করে শুয়ে আছে দ্বিজা। চোখটা নির্নিমেষ দেখছে ওই ঘোলাটে অন্ধকার চাঁদকে। এত গভীর মায়া আর মূগ্ধতা কবে জন্মেছিল দ্বিজার মাঝে ফারজাদের জন্য? সেই তো ক’মাস আগে কনকনে শীতের ভোরে ফারজাদের বাহু চেপে ধরেছিল দ্বিজা। ফারজাদ কী করল! সন্তপর্ণে দ্বিজার হাতটা ছাড়িয়ে দিয়ে চোখে-মুখে একটা অপ্রস্তুতকর ভাব ফুটিয়ে তুলল। আর, আর সেদিন? যেদিন অর্ধনগ্ন অবস্থায় একা ঘরে দ্বিজা ফারজাদের সামনে পড়ল? তাগড়া এক পুরুষের দৃষ্টি সংযোজন! সংযত নজর, সংযত অনুভূতি, আর সংযত আবেগ–একটা নারীর ওপর একটা পুরুষের এটাই কি দায়িত্ববোধ নয়? নারীর সম্ভ্রমে লোলুপ দৃষ্টিপাত থেকে নিজ দৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখা? যেখানে দ্বিজা রাস্তাঘাটে বহুত এমন পুরুষ দৃষ্টি দেখেছে–দ্বিজাকে অথবা অন্য নারীদেহকে চোখ দ্বারা চিবিয়ে খেতে।

দ্বিজার চোখ গড়িয়ে দু-ফোঁটা পানি বালিশে পড়ল। মুখে এক মুগ্ধতার হাসি ফুটে উঠতে উঠতেই আবার তা মিলিয়ে গিয়ে ধপ করে জ্বলে উঠল ত্যাগের আগুন। যে আগুন বিগত এক দিন ধরে তীব্র ঝলকানিতে জ্বলছে ভেতরে। শক্ত মুখে তাকিয়ে রইল আসমানের পানে। ফারজাদের থেকে মনোযোগ বিঘ্নিত করে আকাশ দেখায় মনোযোগী হবার চেষ্টা করল। বালিশের পাশে থাকা ফোনটা কেঁপে উঠল দ্বিজা কল কেটে যাবার আগ মুহূর্তে তা মহা অনাগ্রহের সাথে হাতে তুলে নিলো। স্ক্রিনে জ্বলছে–ফারজাদ নামটা। চোখটা চেপে বুজে নিয়ে একটা ঢোক গিলে শক্ত হাতে রেখে দিলো ফোনটা। বেজেই চলেছে ফোন। একাধারে বাজছে। কঠিন চিত্তে ফোনটা রিসিভ করে কানে তুলল।

“দ্বিজা!ʼʼ

দ্বিজা জবাব দিলো না। ফারজাদ আবার ডাকল, “দ্বিজা?ʼʼ

“হু।ʼʼ

“তুই কি আসলেই বিয়ে করছিস? তোর ইচ্ছে না থাকলে…

“হু, আসলেই বিয়ে করছি এবং আমার ইচ্ছেতেই।ʼʼ

অবুঝের প্রশ্ন করল ফারজাদ, “তোর ইচ্ছেতেই?ʼʼ

“হু, আমার ইচ্ছেতেই।ʼʼ

“এক্সাইটমেন্টে মানুষ যে সিদ্ধান্ত নেয়, তা মঙ্গলকর হয় না মানুষের জন্য। তুই এ ব্যাপারে আরেকটু সময় নিতে পারতি।ʼʼ

“এক্সাইটমেন্ট? কীসের এক্সাইটমেন্ট? আমি আর আমার পরিস্থিতি দুইটাই একদম শান্ত।ʼʼ

“তাই নাকি? আমায় জ্ঞান দিচ্ছিস?ʼʼ

“হু, দিচ্ছি। যেমন আপনি রাসায়নিক পদার্থের মতো অল্প সময়ের ব্যবধানে রঙ পরিবর্তন করছেন। এতদিন তো মনে হচ্ছিল আমার বিয়েতে আপনার নাচের ঠেলায় আমার বাপের বাড়ির উঠোন ভেঙে চেড়াবেড়া হয়ে যাবে। আজ আবার এত তাড়াতাড়ি বিয়ের কুফল জানিয়ে জ্ঞান দিচ্ছেন। আসলে আপনার সমস্যা কোথায়? মাথায় নাকি মানুষের ভালো থাকায়?ʼʼ

প্রথম কথাগুলো দ্বিজা ফারজাদকে ধিক্কার দিয়ে বললেও শেষের কথাগুলো ভীষণ বোকা বোকা লাগল, এবার তারা সিরিয়াস টপিক থেকে বেরিয়ে, নিজেদের লুকিয়ে বরং সাধারণ ঝগড়ায় নেমে পড়ার অবস্থায় চলে এলো।

ফারজাদ নিজের রাগ সংবরণ করে বলল, “ও আচ্ছা, তো তুই খুব ভালো আছিস? আর আমি খারাপ আছি, এজন্য তোর ভালো থাকা দেখে সমস্যা হচ্ছে? হাতের কাছে পেলে থাপড়ে মুখে ঝাঁজ কমিয়ে দিতাম। আমাকে তোর বাপের মতোন মনে হয় নাকি?ʼʼ

“আমার বাপ কী করেছে আপনার? আজকে ছেড়ে দিলে আপনার চোপড়া ভেঙে দিতো।ʼʼ

“দ্বিজা! আমার শরীর খুব কাঁপছে রে ভয়ে। কাঁপার চোটে ছাদ থেকে পড়ে মরে গেলে সাতদিন পর এসে খয়রাত খেয়ে যাস। তোর তোর বাপ চোপড়া ভাঙত না-হয়। ছাড়িস নি কেন? সামনে এসে দাঁড়িয়ে ঢঙ করার কী ছিল?ʼʼ

“ইচ্ছে। মানুষের জীবনে ইচ্ছে গুলোকে ঠুকরাতে নেই। আজ খুব ইচ্ছে করছিল ঢঙ করতে, করেলাম। ফোন রাখুন।ʼʼ

“ফোন রাখব না তো কি তোর মতো ঝগড়াটে আর বেয়াদবের সাথে সারারাত কথা বলব ভেবেছিস? তোর কপালে শনি আছে। একবার বিয়ে হোক তারপর বুঝবি।ʼʼ

“ওয়াহিদ তো আর আপনার মতোন খাঁটাশ না। বেশ সুখে থাকব আমি। আপনি দেইখেন তখন।ʼʼ

“অবশ্যই দেখব। তার আগে কথা তো বলতে শেখ। ‘দেইখেনʼ না ওটা হবে শুদ্ধ ভাষায় ‘দেখবেনʼ।ʼʼ

দ্বিজা বিরক্তিতে কলটা ঠাস কেটে দিলো। লোকটার মাথার তার কাটা সেই আগে পরের থেকেই। আজ আব্বুর কথা শুনে একদম প্যাচ লেগে গেছে।

কথার মোড় কোথা থেকে ঘুরতে ঘুরতে কোথায় পৌঁছাল, কী থেকে কী কথা হলো, আসলে যে কী হলো কারও বোধগম্য হচ্ছে না কল কাটার পর। আসলে কথা কী হলো? কোথা থেকে কোথায় পৌঁছাল তারা?

চলবে..

[ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন]

#তপ্ত_সরোবরে
#তেজস্মিতা_মর্তুজা

২০.

বাড়ি ফিরলে ফারজাদের রুটিন একদম চেঞ্জ হয়ে যায়। সকাল সকাল উঠে আর শারীরিক কসরতটা করা হয়না, ভোর সকালে জগিংয়ে বের হয়ে ঘাম ঝরানো হয় না দেহের। ঘুম থেকে উঠতেও দেরী হয়ে যায়। তার ওপর শেষ রাতের দিকে ঘুমিয়েছে সে। উঠতে বেলা সাড়ে দশটা বাজল। বরাবরের মতো বাড়ির সকলে খেয়ে-দেয়ে নিজস্ব কাজে ব্যস্ত হয়েছে। আজাদ সাহেব আড়ৎয়ের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাবার সময় কয়েকটা ধাক্কা দিয়েছিলেন বটে ফারজাদের দরজায়। কে করে দরজা ধাক্কার পরোয়া! সকালের ঘুম বড় মধুর কিনা!

ঘুম থেকে উঠে ব্রাশে টুথপেস্ট লাগিয়ে ব্রাশ হাতে করে অপর হাতে লুঙ্গি ধরে রুম থেকে বের হলো ফারজাদ। ঘাঁড়ে গামছা ঝুলছে। ফিরোজাকে দেখে বলল, “কবে এসেছিস তুই?ʼʼ

ফিরোজা বিরক্তিভরা মুখে নাক ছিটকাল, “আজ আবার এত আমার খোঁজ কেন তোর? জীবনে তো কোনোদিন নিতে দেখি নাই। সর সামনে থেকে।ʼʼ

ফারজাদ হঠাৎ-ই ওড়না টেনে ধরল ফিরোজার। গলায় ফাঁস লাগতেই সরু কণ্ঠে চিৎকার করল ফিরোজা,
“আম্মা!ʼʼ

ফারজাদ আঙুলের কোণে লেগে থাকা টুথপেস্ট ওড়নায় মুছতে মুছতে বলল, “এত ক্যানক্যান করিস কেন সারাক্ষণ? বড় হোস নি?ʼʼ

এক বাচ্চার মাকে শাসন করছে এই ছেলে! ফিরোজা কপট কড়া স্বরে বলল, “ওই! একদম বাপ সাজতে আসবি না। তোর মতো খিটখিটে মানুষ মানুষকে জ্ঞান দিলে জ্ঞানের অপমান হবে, ছাড় তো।ʼʼ

ফারজাদ ওড়না না ছেড়ে আরও শক্ত করে হাতে পেঁচিয়ে ধরে বলল, “চল, বাগানে বসি।ʼʼ

ফিরোজা নীরব সম্মতি তো জানাল, তবে মুখে ভেঙচি কেটে। ফিরোজার মুখ ভেঙচানো দেখে ফারজাদ চট করে মৃদূ হেসে ফেলল। যা ফিরোজা আশা করেনি। মৃদু অবাক চোখে তাকিয়ে সে-ও হেসে ফেলল এবার। হুট করে আজ ফারজাদকে সে-ই ছোট্ট ফারজাদ লাগছে, আগের দিনের ফারজাদ!

বাগানে এসে দাঁড়িয়ে ফারজাদ হুকুম করল, “যা, চেয়ার নিয়ে আয়।ʼʼ

ফিরোজা সরু চোখে মুখ ফুলিয়ে চেয়ার আনতে গেল। ফারজাদ ফোন লাগাল পুলিশ কনস্টেবল রফিককে। বলল, “রফিক সাহেব, আমার ফ্লাটে নজরদারি যেন না হটে। আর আজ ভেতরে যাবেন একটু। ওই ছেলেটাকে টুকটাক খাবার, পানি দেবেন।ʼʼ

ফিরোজা কথা বলতে বলতে এসে দাঁড়াল পাশে। ফারজাদ হাত উঁচিয়ে ধরল, ইশারায় চুপচাপ চেয়ার রেখে বসতে বলল। এরপর রফিকের উদ্দেশ্যে বলল, “আর একা যাবার দরকার নেই। দু-একজন সঙ্গে নিয়ে যাবেন। এডিক্টেড, তার ওপর নিশ্চয়ই ট্রেইন্ড আছে ছেলেটা। আমার ফ্লাটের চারপাশে যেন কোনো সময়-ই ফাঁকা না হয়। কড়া নজরে রাখুন আশপাশটা।ʼʼ

ফোন কেটে আবারও ফোনের দিকে মনোযোগ দিয়ে স্ক্রিনে স্ক্রল করতে করতে হুট করে প্রশ্ন করল ফিরোজার উদ্দেশ্যে, “আমার কি সত্যিই পরিবর্তন দরকার?ʼʼ

“ভুতের মুখে রাম রাম!ʼʼ

ফারজাদ ফোন থেকে মাথা তুলে বলল, “কেন, তাতে সমস্যা কী? রামচন্দ্র ভালো মানুষ একটা, বড়ো বীর ছিলেন, তার ভেতরে দেবতা ছিল, তাকে স্মরণ করার অধিকার ভুতের নেই নাকি?ʼʼ

“রামের নাম নিলে ভুত পালায়, গাধা। সেই ভুত নিজে রামের নাম ক্যান নিবে?ʼʼ

“আচ্ছা, তো আমি ভুত, নাকি আমার পরিবর্তন হবার ব্যাপারটা রাম রাম?ʼʼ

“দুইটাই।ʼʼ

“আসলেই কি খুব খারাপ আমি?ʼʼ

“তোর কথা পরে আসতেছে, আগে তোর আচরণ।ʼʼ

ফোনটা কানে তুলে মুখে কৃত্রিম বিরক্তিভাব ফুটিয়ে বলল, “তুই তো ব্যক্তিগত আক্রোশে বলছিস এসব। তোর কাছে নিরপেক্ষ, সঠিক একটা মন্তব্য জানতে চাওয়ার বোকামি দিয়ে শুরু করলাম আজকের দিনটা, শ্যাহ! যা এখান থেকে!ʼʼ

ফিরোজা উঠে যেতে যেতে বলল, “তো তুই ভাবতেছিস এরকম একটা ব্যাপারে সিরিয়াস মন্তব্য জানাব আমি? যেখানে তোর মতো খাঁটাশের পরিবর্তন অসম্ভব?ʼʼ

ফারজাদ মুখে ‘চ্যাহʼ এর মতো উচ্চারণ করে মাথা ঝাঁকাল অতিষ্ট ভঙ্গিতে। গলা উঁচিয়ে বলল, “আমার ল্যাপটপটা দিয়ে যা।ʼʼ

ফিরোজা নিজেও গলা বাড়িয়ে বলল, “আগে গিলে যান সাহেবজাদা! এরপর বসবেন ধ্যানে।ʼʼ

ওপাশ থেকে কল রিসিভ হয়েছে। ফারজাদ এবার ফোনে মনোযোগী হয়ে বলল, “হু, ইরফান ভাই?ʼʼ

“আরে ফারজাদ বাবু যে! কী খবর, সব ঠিকঠাক?ʼʼ

ফারজাদ মৃদু হেসে জিজ্ঞেস বলল, “চলছে আল্লাহর রহমতে ঠিকঠাক। আপনার হালচাল?ʼʼ

“আর গরীবের হাল আবার চাল। চলে যাচ্ছে দিন। তা কী মনে করে?ʼʼ

এ কথা বলে ফোন কানে ধরে এরই মাঝে ইরফান আবার ডেকে উঠল, “ও লাবু… লাবন্য!ʼʼ

সে যে ফারজাদ কলে থাকায় অপ্রস্তুত হয়ে লাবু ডেকে ফেলে আবার ঠিক করে লাবন্য ডাকছে, তা শুনে হাসল ফারজাদ, “অফিসের জন্য বের হচ্ছেন নাকি? এখন থাক তাহলে, আই উইল কল ইউ ব্যাক এনাদার টাইম?ʼʼ

“আরে, সে তো প্রতিদিনই বের হই। তবে প্রতিদিনই তো আর শ্যালক বাবুর সঙ্গে কথা হয় না তাই না? বলুন বলুন।ʼʼ

ফারজাদ দ্বিধা-সংকোচহীনভাবে বলল, “ওয়াহিদের নম্বরটা লাগত।ʼʼ

ইরফান কিছুক্ষণ চুপ থেকে কিছু ভাবল বোধহয়। এরপর হাস্যজ্জ্বল কণ্ঠে বলল, “আচ্ছা, আচ্ছা। আমি মেসেজ করে দিচ্ছি কেমন!ʼʼ


ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার মাঝে পরীক্ষা দিয়ে বের হবার পথে গেইটের বাইরে প্রতিদিন বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের বিজ্ঞাপন পত্র হাতে পেয়েছে দ্বিজা। সব মিলিয়ে এক বোঝা হয়েছে। তার ইচ্ছে ছিল ভার্সিটির জন্য ট্রাই করা। রেজাল্ট কেমন হবে তা জানা নেই। তবে একদম ফেলে দেবার মতো হবে না। ভার্সিটির একটা এডমিশন কোচিংয়ের বিজ্ঞাপনের কাগজ নিয়ে বসেছে সে বিছানা এক কোণায়, জানালা ঘেষে। উদাসী চোখে তাকিয়ে কিছুক্ষণ দেখল কাগজগুলো উল্টেপাল্টে। এরপর একটু মনোযোগী হলো কাগজগুলো দেখায়। তখনই রুমে প্রবেশ ঘটল দিলরুবা বেগমের। তার উপস্থিতি টের পেয়ে দ্বিজা দ্রুত কাগজটা কপট অনীহার সঙ্গে বিছানায় এক কোণে রেখে দিলো। দিলরুবা বেগম বিছানায় বসে কিছুক্ষণ মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে থাকলেন। দ্বিজা প্রাণপনে চেষ্টা করছে নিজেকে একদম স্বাভাবিক দেখাতে। কেন জানি তার একদমই আন্তরিক হতে ইচ্ছে করছে না আম্মুর সাথে। এমনকি সে কী চায়–সেসবও আর জানাতে বা বোঝাতে চায় না সে কাউকে। এই যেমন সে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন দেখে তা আম্মুকে বুঝতে দেবে না বলে হাতের বিজ্ঞাপনের কাগজটা সন্তর্পণে নামিয়ে রাখল হাত থেকে। দিলরুবা বেগম জিজ্ঞেস করলেন, “মন খারাপ?ʼʼ

দ্বিজা ঘাঁড় নেড়ে বলল, “মন খারাপ কেন হবে?ʼʼ

প্রসঙ্গ বদলানোর ছলে একদম স্বাভাবিক স্বরে বলার চেষ্টা করল, “কোনো দরকারে এসেছ নাকি, আম্মা? কিছু বলবে?ʼʼ

দিলরুবা বেগম ক্ষণকাল চুপ থেকে এরপর বললেন, “তোর আব্বু ডেট দিয়ে দিছে। আজ রবিবার। সামনের শুক্রবারে গায়ে হলুদের কথা বলছে ওরা। ওরা ঘটা করে নিয়ে যাইতে চায়। শোন দ্বিজা, আগে যা হইছে ভুলে যা। তোর বাপরে তো চিনিস। তুই যা করছিস, তার সব দোষ আর রাগ আমার ওপর এসে পড়ছে। সব সহ্য করতেছি খালি তোর জন্যে। ওসব ভুলে এখন নিজের আর আমার জন্য যা ভালো হয় তা কর। মন খারাপ করে থাকার কিছু নেই। ফারজাদ এরকমই, এইটা সবাই জানে। ওর কাছে আশা রাখছে কেউ এ যাবৎ! ওর সাথে শান্তি পাইতি তুই? কোনো বাপ মা কোনোদিন চাইবে না ওর কাছে নিজের মেয়ে দিতে। আল্লাহ যা করে মঙ্গলের জন্যেই করে। ওসব ভাববি না আর।ʼʼ

দ্বিজা নিশ্চুপ শুনল কথাগুলো। কোনো জবাব দিল না। আম্মু উঠে চলে গেলে সে আবার উদাস চোখে বাইরে তাকাল। সব-ই বোঝে সে। তবে সে বুঝলে চললে তো হতোই। এই পাগল মনটাকে বোঝানোর বা শান্ত করার উপা কী? এত বেহায়া কেন মন? এত কেন বেলেহাজ! যে জিনিস ছেড়ে দিয়ে সামনের দিনে অন্য পথে হাঁটা লাগাতে হবে, সেই জিনিসের প্রতি এমন মায়ার টান কেন অনুভূত হবে? সে তো আত্মমর্যাদাবোধকে কাছে টেনে নিয়ে তাকে দূরে সরিয়েছে। সে পরিস্থিতিকে মেনে নিয়ে ত্যাগ করেছে সেই পথ। তবুও তা ঘনকালো মেঘের মতোন তাড়া করে বেড়াবে কেন? ছেয়ে রাখবে কেন ভাবনায়? কেন ভুলে যাবে না?

গোধূলি নেমে আসা আকাশের দিকে দৃষ্টি মেলে নিজের অজান্তেই দ্বিজা গুনগুনিয়ে উঠল,

প্রথমও যৌবনও বেলা, আমারে পাইয়া অবলা..
প্রেম শিখাইয়া গেল ছাইড়া, গেল গোওও..
জ্বালাইলে যে প্রেমও আগুন, জল দিলে তা বাড়ে দিগুণ
এখন আমি কী করি উপায়…


আজ হঠাৎ-ই ফারজাদ আজানের ধ্বনি কানে আসতেই মাগরিবের নামায আদায়ের উদ্দেশ্যে মসজিদে পা রাখল। বহুদিন পর সে নিজ ইচ্ছায় প্রভুর নিকট আত্মসমর্পণে গেল। নামায শেষে বের হয়ে নির্দিষ্ট গন্তব্য কফিশপে পৌঁছাল সে। মাঝের একটা টেবিলে বসে আছে ওয়াহিদ। চোখ দিয়ে ইশারা করে হাত প্রসারিত করে কোণার একটা একটা টেবিলে বসতে বলল ওয়াহিদকে। বসতে বসতে বলল, “কী অবস্থা? দিনকাল কেমন যাচ্ছে?ʼʼ

“সে যাচ্ছে ভালোই। তবে হঠাৎ মেজর ফারজাদ সাহেব ডাকলেন আমায়? আসলেই ভয় ভয় লাগছে একটু। কোনো বে-আইনী কিছু করে ফেলেছি নাকি?ʼʼ

ওয়াহিদের কথায় ফারজাদ হাসল। পকেট থেকে সিগারেট বের করে তাতে দিয়াশলাই জ্বালিয়ে বলল, “মেজর?ʼʼ

একটু থেমে দুপাশে ঘাঁড় নেড়ে বলল, “তুমি তো দেখছি এক ধাক্কায় কতগুলো পদ প্রমোশন করিয়ে দিলে। এএসপি তে জয়েন করেছি কেবল। যাই হোক, তুমি ঠিক অপরাধ করো নি, তবে একটা অকাজ করতে যাচ্ছ।ʼʼ

ওয়াহিদ অবাক হলো, “প্রথমেই এএসপি? এটাকে কম বলতে চাচ্ছেন আপনি? আর অকাজ?ʼʼ

“হুম, অকাজ। তোমার বিয়ে কবে?ʼʼ

ওয়াহিদ একটু কপট লজ্জিত হাসল, “সামনের শুক্রবারের পরের শুক্রবারে। তো কি এটাকে অকাজ বলছেন নাকি এএসপি সাহেব?ʼʼ

ফারজাদ সিগারেটে একটা টান দিয়ে কফি প্লেস করতে আসা ওয়েটারের দিকে একবার তাকিয়ে বলল, “হুম, তা-ই। আচ্ছা, দ্বিজাকেই কেন বিয়ে করছ?ʼʼ

“কেন তাতে সমস্যা কোথায়? এ ব্যাপারে কোনো সমস্যা আছে নাকি?ʼʼ

“প্রশ্ন একটা আমিও করেছি তোমাকে, এবং তোমার আগে।ʼʼ

ফারজাদের হঠাৎ রাশভারী হয়ে ওঠা মুখের দিকে তাকাল ওয়াহিদ। বলল, “পছন্দ করি ওকে, লাবন্য ভাবীকে দেখতে গিয়ে দেখেছিলাম, সেদিনই পছন্দ হয়েছিল। কেন কী হয়েছে?ʼʼ

ফারজাদ সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বরং নিজে প্রশ্ন করল, “দ্বিজাও পছন্দ করে তোমাকে?ʼʼ

এবার একটু অপ্রস্তুত হলো ওয়াহিদ, “না মানে.. হ্যাঁ ও রাজী তো বিয়েতে।ʼʼ

“আসলেই?ʼʼ

ওয়াহিদ বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকায় ফারজাদের দিকে। সে পরিস্থিতি এবং ফারজাদের কথা বা কথার মর্ম বা উদ্দেশ্য কিছুই ঠিকঠাক উদ্ধার করতে পারছে না। কিছু বলার প্রস্তুতি নিল, অথচ ফারজাদ ওকে বলার সুযোগ না দিয়ে হুটহাট প্রশ্ন করে বসল, “শুধুই পছন্দ নাকি ভালো-টালোও বাসো?ʼʼ

ওয়াহিদ মাথা নিঁচু করে হাসল একটু, “হুম, আমার মনে হয় শুধু পছন্দ হলে বিয়ে পর্যন্ত যেতাম না। ভালোও বাসি।ʼʼ

ফারজাদ নিজে নিজেই একটু তাচ্ছিল্য করার মতো বলল, “মনে হয়?ʼʼ এরপর ঠোঁট উল্টে মাথা ঝাঁকাল মৃদু, “তাই না? তো কাউকে পছন্দ করলে বা ভালোবাসলেই বিয়ে করতে হবে কেন? পছন্দ না করে বিয়ে করা যায় না?ʼʼ

ওয়াহিদ হতবুদ্ধি হলো এবার। আস্তে আস্তে ফারজাদের প্রশ্ন এবং কথাগুলো কেমন অদ্ভুত প্যাচানো হয়ে উঠছে। ভ্রু কুঁচকে বলল, “বুঝিনি আপনার কথা। না মানে, ভালো না বাসলে বা পছন্দ না করলে তাকে নিয়ে সারাজীবন কাটানো যায় নাকি সুখে? মনের একটা ভালো লাগা বা চাহিদার ব্যাপার আছে না?ʼʼ

খুব বুঝেছে এমনভাবে বিজ্ঞের মতো মাথা দুলিয়ে বলল ফারজাদ, “এটা প্রযোজ্য শুধু ছেলেদের ক্ষেত্রে নাকি মেয়েদের জন্যও?ʼʼ

ওয়াহিদের একটু রাগ লাগছে এবার। লোকটা আসলেই আইন বিভাগের লোক এবার আরেকবার বিশ্বাস হচ্ছে। সাধারণ কথাগুলো এত পেচিয়ে বলার মানে কী? বলল, “ তা কেন হবে? সবার নিজের পছন্দমতো সঙ্গী নির্বাচনের স্বাধীনতা আছে। অবশ্যই মেয়েদেরও..ʼʼ

কথা শেষ হলো না ওয়াহিদের। ফারজাদ বলে উঠল, “দ্বিজা কি সেই সুযোগটা পাচ্ছে?ʼʼ

ওয়াহিদ থামল একটু। কপাল জড়িয়ে তাকিয়ে রইল ক্ষণকাল ফারজাদের দিকে। কিছু বুঝতে চেষ্টা করল বোধহয়। এরপর বলল, “তার মানে কী বলতে চাচ্ছেন, দ্বিজা রাজী না বিয়েতে?ʼʼ

ফারজাদ সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে তা ঠোঁট থেকে নামিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে বলল, “তা তোমার জানার চেষ্টা করা উচিত ছিল না? করেছ? যেখানে দেখতে যাওয়ার দিন সে সকলের সামনে অকপট বলেছে সে বিয়ে করতে চায় না। তুমি কিছুক্ষণ আগে কোন ভিত্তিতে বললে, সে রাজী বিয়েতে?ʼʼ

ফারজাদের শীতল স্বরে বলা কথাগুলোতে ওয়াহিদ মিইয়ে গেল একদম। ফারজাদ সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়া গালে রেখেই কফিতে চুমুক দিলো। ধোঁয়া ও কফি একসাথে গিলল। এরপর তাকাল ওয়াহিদের দিকে। ওয়াহিদের চোখ-মুখ একটু ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে। সে কেমন জালে ফেসে গেছে যেন এমন মনে হচ্ছে। ফারজাদ এসবি অফিসার নাকি উকিল? ওহহো! সে শুনেছিল ফারজাদ এলএলবি তে অনার্স করেছে। সে থতমত হয়ে কোনোমতো বলল, “ওর আব্বু মত দিয়েছে।ʼʼ

কথাটা বলে ওয়াহিদের মনে হলো ফারজাদের সমানে এটা একটা খুবই সস্তা আর বোকা বোকা যুক্তি পেশ করেছে সে। কিন্তু চট করে একটা কৌতূহল জাগল। ফারজাদকে জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু আপনি কেন এসব বলতে ডেকেছেন আমায়?ʼʼ

ফারজাদ চারপাশে ঘাঁড় ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে বলল, “আমার কর্তব্য?ʼʼ

“আপনার কর্তব্য? কীসের কর্তব্য?ʼʼ

“মামাতো ভাইয়ের কর্তব্য।ʼʼ

ওয়াহিদ গোমরা মুখে চোখ ছোটো করে সন্দিহান কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, “শুধুই মামাতো ভাইয়ের কর্তব্য পালন করতে এখানে এভাবে এই কথা এরকম উকালতি করে বলতে এসেছেন?ʼʼ

ফারজাদ ওয়াহিদের কথায় ওর দিকে তাকিয়ে সামান্য বাঁকা হেসে বলল, “আপাতত তা-ই। তবে একটা গ্রেট এক্সাইটেড ট্রুথ হচ্ছে–দ্বিজা ফারজাদকে ভালোবাসে। সে ভালোবাসা বহত কিছুর ঊর্ধ্বে। যা এড়িয়ে যাবার মতো নয়। আর সেই অনুভূতিকে বুকে চেপে সে অন্য কাউকে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গ্রহন করবে, এটা অবিচার হয়ে যাবে না? আফটার অল, আমি আইন ও ন্যায়বিচার বিভাগের কর্মকর্তা।ʼʼ

ওয়াহিদ তাকিয়ে রইল কেমন করে যেন ফারজাদের দিকে। সে কিছুই মেলাতে পারছে না এতক্ষণে ঘটে যাওয়া ও হয়ে যাওয়া কথার হিসবেটা। বিশেষ করে এই ফারজাদের ওপর রাগ হচ্ছে। মারাত্মক রাগ। কোথা থেকে শুরু করে কোথায় নিয়ে এলো ব্যাপারটা। আবার কথাবার্তাও চরম অদ্ভুত!

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে