তন্ময়ের তনু পর্ব-২৬+২৭

0
2423

#তন্ময়ের_তনু
#পর্ব_২৬
#Jechi_Jahan

আমি এখন হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি কিন্তু কেও আমার পাশে নেই।কেও এসে এটাও বলছে না আমার বেবি ঠিক আছে কিনা।আমাকে গাড়ী তে উঠানোর পর থেকে আমার আর কিছু মনে নেই।তখন আমি পরে যাওয়ার পর আমার খুব ব্লিডিং শুরু হয়ে যায়।তখন তন্ময় আমাকে কোলে করে গাড়িতে এনে শুইয়ে দিতেই আমি অজ্ঞান হয়ে যায়।আর এখন কিছুক্ষন মাত্র হলো আমার জ্ঞান ফিরেছে।

নার্স-আরে আপনি উঠে গেছেন??

আমি-হুম!!

নার্স-এখন কেমন লাগছে আপনার???

আমি-ভালো।

নার্স-আপনি প্রেগন্যান্ট ছিলেন???

আমি-হুম!!!

নার্স-ওহ,,(দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে)

আমি-আচ্ছা আমার পরিবারের লোকজন কই??

নার্স-ওনারা বাইরে আছে।

আমি-আমার কাছে এখন আসতে পারবে???

নার্স-হুম,,,আপনি বসুন আমি পাঠাচ্ছি।(বলে চলে গেলো)

আমি-আচ্ছা,,,,

তন্ময়-তনু,,,(তনুর কাছে বসে)

আমি-আপনি আমার পাশে ছিলেন না কেনো???

তন্ময়-বাইরে কিছু কাজ ছিলো তাই আসিনি।

আমি-ওহ,,,আচ্ছা তন্ময়।

তন্ময়-হুম বলো।

আমি-আমাদের বেবি ঠিক আছে তো???

তন্ময়-নিশ্চুপ,,,

আমি-কিছু বলছেন না কেনো???

তন্ময়-তুমি বসো আমি আসছি।(বলে চলে গেল)

আমি-(এমন করে চলে গেলেন কেনো উনি)

সাবিয়া-তনু!!(দরজার সামনে এসে)

আমি-মা ভেতরে আসো।

সাবিয়া-এখন কেমন আছো??(তনুর পাশে বসে)

আমি-ঠিক আছি।

সাবিয়া-হঠাৎ করে এমন হবে ভাবতে পারিনি।

আমি-মা একটা কথা জিজ্ঞেস করি??

সাবিয়া-করো!!

আমি-মা আমার বাচ্চাটা বেঁচে আছে তো?

সাবিয়া-(তনুর কথা শুনে চোখে পানি জমে গেল)
তুমি তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও।ডাক্তার বলেছে তোমাকে আজ বাড়ি নিতে পারবো।

আমি-কিন্তু….

সাবিয়া-আমি আসি।(বলে চলে গেলো)

এরপর আমার কেবিনে আর কেও আসেনি।এক জন নার্স এসে আমার ড্রেস চেঞ্জ করে দিল।চেঞ্জ করার সময় আমার পেটে খুব ব্যাথা হচ্ছিল।এতে আমার মনে একটা ভয় জেগে যায়।কারণ আমি যখন নিচে পরি তখন আমার পেটটা সোজা ফ্লোর এর সাথে লাগে।এমন হলে তো বাচ্চা বেঁচে থাকার কথা না।আরো তো সামান্য কারণেও নাকি বাচ্চা মিসক্যারেজ হয়ে যায় আর আমার তো জটিল।

তন্ময়-তনু!!(তনুর সামনে এসে)

আমি-হু হুম!!

তন্ময়-তুমি রেডি,,,তো চলো।

আমি-তন্ময় আমার পেটে খুব ব্যাথা করছে।

তন্ময়-আচ্ছা চলো আমি ফার্মেসি থেকে পেইন কিলার কিনে দিবো।

আমি-হুম।

তন্ময়-চলো।(বলে আমাকে ধরে নিতে লাগলো)

আমাকে নিয়ে তন্ময় বাড়িতে ফিরলে সোজা রুমে চলে যায় আমাকেও নেয় না।ওনার এই কাজে আমি অবাক হলেও বাকিরা অবাক হয়নি।আমার আবার ভয় হচ্ছে যে বাচ্চা টা ঠিক আছে তো।তা ছাড়া কেও তো আমাকে কিছু বলছেও না।

জেনি-ভাবী তুমি রুমে যাও।

আমি-হুম যাবো!!!

জেনি-তোমার শরীল খারাপ মাত্র হাসপাতাল থেকে এসেছো তাই রুমে গিয়ে রেস্ট নাও।

সাবিয়া-হ্যাঁ তনু রুমে যাও আমি তোমার জন্য কিছু খাবার নিয়ে আসি।

আমি-আচ্ছা মা!!!

আমি রুমে এসে দেখি তন্ময় খাটে বসে আছে।তাই আমিও গিয়ে ওনার পাশে বসি।আমি বসলে উনি আমার দিকে একবার তাকিয়ে আবার সামনের দিকে তাকিয়ে যায়।

আমি-তন্ময়!!

তন্ময়-বলো শুনছি।

আমি-এভাবে বসে আছেন কেনো??

তন্ময়-এমনি।

আমি-আপনি আমার উপর রাগ করে আছেন?

তন্ময়-আমি রাগ করার কে??

আমি-তন্ময় আমি সরি।আমি মানছি আমার আপনার কথা শুনে নিচে যাওয়া উচিত ছিলোনা।কিন্তু এতো দিন একটা রুমে বসে থাকতে থাকতে আমার ভালো লাগছিলো না তাই আমি…

তন্ময়-তাই তুমি আমার বাচ্চাটা মেরে দিলে।(রেগে)

আমি-কি??(বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলাম)

তন্ময়-আরে অবাক হচ্ছো কেন এটাই চেয়েছিলে না তুমি যে আমার বাচ্চাটা মরে যাক।

আমি-তন্ময় আপনি এসব কি বলছেন??(কেঁদে)

তন্ময়-কি বলছি বুঝতে পারছো না??দাঁড়াও তোমাকে বুঝিয়ে বলছি,,,আজ তোমার জেদের কারণে আমাদের বাচ্চা মারা গেছে।

আমি-মিথ্যে কেনো বলছেন আপনি আমাদের বাচ্চা তো ঠিক আছে।(কেঁদে)

তন্ময়-আমি তোমার সাথে এখন মিথ্যা বলবো??(রেগে চিৎকার করে)

আমি-তন্ময় সত্যিই কি আমাদের বাচ্চা আর নেই??(তন্ময়ের কাছে গিয়ে ওনার দুই বাহু ধরে)

তন্ময়-যখন পরেছিলে তখনই বাচ্চা মারা গেছে।পেয়েছো তোমার উত্তর।(রাগে চোখে পানি জমে গেলো)

আমি-আমার বাচ্চাটা আর নেই।আমি আমার বাচ্চার খুনি।(বলতে বলতে মেঝেতে বসে গেলাম)

সাবিয়া-তন্ময়!!!

তন্ময়-মায়ের দিকে তাকিয়েও কিছু বলেনা।

সাবিয়া-তনু ওভাবে বসে আছে কেনো???(মেঝেতে বসা তনুর দিকে তাকিয়ে)

আমি-আমার বাচ্চাটা আর নেই মা।

সাবিয়া-তনু শান্ত হও তুমি এভাবে ভেঙ্গে পরলে কিভাবে হবে।দেখো প্রথম প্রথম এরকম অনেক জনের হয় তাই তুমি এত চিন্তা করো না।

তন্ময়-প্রথম প্রথম ওর এমন হতো না মা যদি ও আমার কথা শুনে চলতো।ওর কারণে শুধুমাত্র ওর কারণে আমার সন্তান পৃথিবীর আলো দেখতে পারেনি।(রেগে)

সাবিয়া-তন্ময় চুপ কর,,,,পাগল হয়ে গেছিস?(রেগে)

তন্ময়-হ্যাঁ মা আমি পাগল হয়ে গেছি।(কেঁদে)

সাবিয়া-তন্ময় ছেলেদের কাঁদতে হয়না কেনো কাঁদছিস তুই???

তন্ময়-সন্তান মারা গেলে সব বাবাই কাঁদে।

সাবিয়া-তন্ময় এটা একটা এক্সিডেন্ট।আজ ফ্লোর পরিষ্কার করা হয়েছিলো পানি দিয়ে।তাহলে ফ্লোর তো বেজা থাকবেই।আর দুঃভাগ্য বশত তনুই ফ্লোরে পা দিয়ে দেয় তো,,,,

তন্ময়-রুম থেকে না বেরলে এমন কিছুই হতোনা।

সাবিয়া-তন্ময় তুই আবার,,,,

আমি-মা উনি তো ভুল কিছু বলেনি।

সাবিয়া-তনু,,,

আমি-আজ আমার জন্যই আমার সন্তান টা নেই।আমি চাইলে ওনার কথা শুনতে পারতাম কিন্তু আমি তো ওনার কথাই শুনিনি।আমি আসলেই আমার সন্তানের খুনি।

আমি এসব বলে রুম থেকে বের হয়ে গেলাম।রুম থেকে বের হয়ে সোজা ছাদে চলে এলাম।সন্ধ্যার সময় হালকা হালকা আলো থাকায় জায়গাটা মন্দ লাগছে না।আমি অনেকক্ষণ ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে চোখের পানির বিসর্জন দিচ্ছি।হঠাৎ খেয়াল করি আমার পাশে কেও দাঁড়িয়ে আছে।

আমি-ইমন যাও এখান থেকে।(কেঁদে কেঁদে)

ইমন-তুনি কিভাবে বুঝলে আমিই এসেছি???

আমি-ইমন আমার ভালো লাগছেনা তুমি যাবে এখান থেকে।(চিৎকার করে)

ইমন-তনু আমি তোমার মনের অবস্থা টা বুঝছি।কিন্তু এভাবে থাকলে তো তোমার শরীল খারাপ করবে।শীত কালে এভাবে চাদর ছাড়া ছাদে দাঁড়িয়ে আছো ঠান্ডা লেগে যাবে তো।

আমি-তুমি আবার কবে থেকে আমার ব্যাপারে ভাবতে শুরু করলে।লাগবেনা আমার তোমার এসব ন্যাকামি কেয়ারিং। (রেগে)

ইমন-তনু তোমার আমার উপর রাগ করারটা স্বাভাবিক কিন্তু এখন তুমি একটু নিজের ব্যাপারে ভাবো।এভাবে ভেঙ্গে পরলে চলেনা।

আমি-একদম সিমপ্যাথি দেখাতে আসবে না।তুমি আমার থেকে যত দূরে থাকবে আমি ততই ভালো থাকবো।

ইমন-তনু এমন কেনো করছো??

আমি-কারণ তুমি আমার সংসার ভাঙ্গতে চেয়ে ছিলে।নিজে তো আমার সাথে সংসার করতে পারোনি।আর যেই শুনেছো আমার বিয়ে হয়েছে ওমনি আমার সংসার ভাঙ্গতেও চলে এলে।

ইমন-তনু আমি ভুল করেছি কিন্তু সেটার শাস্তি ও পাচ্ছি।কিন্তু এখন তোমাকে নিজের প্রান্তন না নিজের একজন বন্ধু ভেবে বলছি।প্লিজ এভাবে ভেঙ্গে পরোনা।

আমি-এসব নিজের বউকে গিয়ে বলো আমাকে বলতে এসোনা।যাও এখান থেকে,,,(কেঁদে)

ইমন-ওকে আমি চলে যাচ্ছি কিন্তু তুমিও ছাদে থেকো না।প্লিজ তুমিও যাও।

আমি-ইমন তোমায় আমাকে নিয়ে ভাবতে হবেনা।
তুমি যাও এখান থেকে।(চিৎকার করে

আমার চিৎকারে ইমন ছাদ থেকে চলে গেলো।কিন্তু আমি ছাদে দাঁড়িয়ে সেই কান্না করে যাচ্ছি।
প্রায় অনেকক্ষণ ছাদে থেকে আমি রুমে চলে আসি।রুমে এসে তন্ময়কে আর দেখলাম না।কিন্তু রুমটা এখন কেমন খালি খালি লাগছে।যেনো কিছু জিনিস সরিয়ে ফেলা হয়েছে।খানিকক্ষণ পরে মনে পরলো যে আমার বাচ্চার জন্য কিনে রাখা খেলনা আর পুতুল গুলো নেই।আমি এসব দেখে আবার কান্নায় ভেঙ্গে পরি।

সাবিয়া-শুনছো??

তন্ময়ের বাবা-হুম বলো।

সাবিয়া-তন্ময় কে একটু বোঝাও না।

তন্ময়ের বাবা-কেনো কি হয়েছে???

সাবিয়া-বাচ্চার জন্য তন্ময় তনুকে দায় করছে।

তন্ময়ের বাবা-এখন বোঝাতে গেলে বিষয়টা অন্য দিকে চলে যাবে।২-৩ দিন যাক তারপর আমি ওকে বুঝাবো।

সাবিয়া-ওকে ভালোভাবে বুঝিয়ো।

তন্ময়ের বাবা-যে তুমি চিন্তা করোনা।

তন্ময়-বাবা আসবো।

তন্ময়ের বাবা-আরে আয় আয়।

তন্ময়-আমার মায়ের সাথে কিছু কথা ছিলো।

সাবিয়া-কি বল।

তন্ময়-আমার সাথে বাইরে চলো।

সাবিয়া-আচ্ছা চল।(বলে তন্ময় কে নিয়ে বাইরে চলে গেলো)

তন্ময়-এবার শুনো।

সাবিয়া-হুম বল।

তন্ময়-জেনির রুমে একটা বড় বাক্স আছে।ওই বাক্সটা তুমি ভাইয়াকে দিয়ে দিয়ো।

সাবিয়া-কি???

তন্ময়-আমি জেনির রুমে একটা বাক্স রেখেছি ওই বাক্সটা তুমি ভাইয়াকে দিয়ে দিয়ো।

সাবিয়া-তুই নিজে দিয়ে দে।

তন্ময়-বাক্স টা আমি ধরবো না।

সাবিয়া-কি আছে বাক্সে??

তন্ময়-তুমি নিজে দেখে নিও।(বলে চলে গেলো)

তন্ময় ওর মায়ের কাছ থেকে সোজা রুমে চলে গেলো।রুমে গিয়ে দেখলো তনু নিচে বসে খাটের উপর মাথা রেখে কাঁদছে।তন্ময়ের এখন তনুকে জাস্ট অসহ্য লাগছে।ওর কাছে তনুর চোখের পানি গুলোও কেমন যেনো তুচ্ছ হয়ে গেছে।

তন্ময়-জেনি.(চিৎকার করে)

আমি-তন্ময়,,,(লাফিয়ে উঠে)

তন্ময়-জেনি,(আরো জোরে চিৎকার করে)

জেনি-কি হয়েছে ভাইয়া??(হাঁপাতে হাঁপাতে)

তন্ময়-তনু আজ থেকে রাতে তোর সাথে থাকবে।

জেনি-কেনো ভাইয়া?

তন্ময়-যেটা বলেছি সেটা শুন।

জেনি-আমি রাখবোনা।

তন্ময়-তুই না রাখলে আমি চলে যাবো।

জেনি-রাগ করছো কেনো??

তন্ময়-তুই রাখবি কি রাখবি না???

জেনি-ভাবীর এখন তোমার কাছে থাকা দরকার।

তন্ময়-সেটা আমি বুঝে নিবো।

জেনি-কিন্তু….

আমি-জেনি আমি তোমার সাথেই থাকবো।

জেনি-ওকে।

আমি আর দেরি না করে ওই রুম থেকে জেনির সাথে জেনির রুমে চলে গেলাম।জেনির রুমে গিয়ে আমি আমাদের বেবির জন্য কিনে রাখা খেলনার বাক্সটা দেখলাম।এই বাক্স করেই তন্ময় খেলনা আর পুতুল এনেছিলো আমাদের বাচ্চার জন্য।কিন্তু এটা এখানে কি করছে।

আমি-জেনি!!!

জেনি -হুম ভাবী।

আমি -এই বাক্সটা তোমার রুমে কিভাবে???

জেনি-ভাইয়া তোমাদের রুম থেকে আনিয়েছে।

আমি-ওহ!!!

জেনি-কেনো ভাবী!!!

আমি-নাহ এমনি।

জেনি-ভাবী ভাইয়া এখন তোমার উপর রাগ করে আছে তো তাই তোমার সাথে এমন করছে।দেখবে যখন রাগ ভেঙ্গে যাবে তখন আগের মতো হয়ে যাবে।তোমার সাথে ভালো ভাবেই থাকবে।

আমি-হুম।

রাতে আমি কিছু না খেয়ে ঘুমাতে গেলাম।কিন্তু কিছুতেই ঘুম হচ্ছিল না।হঠাৎ মধ্যরাতে কেও দরজায় নক করে।জেনি বেঘোর ঘুমে থাকায় ও টের পায়নি।আমি গিয়ে দরজা খুলতেই কেও আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো।

-চলবে

#তন্ময়ের_তনু
#পর্ব_২৭
#Jechi_Jahan

দরজা খোলার সাথে সাথে তন্ময় আমাকে টেনে নিচে নিয়ে যেতে লাগলো।আমি শুধু ওনার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি।উনি আমাকে নীচে এনে খাবারের টেবিলে বসিয়ে দিলো।

তন্ময়-আমার বাচ্চার খেয়াল রাখোনি তাই বলে নিজের খেয়াল ও রাখবে না।

আমি-মানে???

তন্ময়-রাতে খাওনি কেনো??

আমি-(ভয়ে মাথা নিচু করে আছি)

তন্ময়-কিছু জিজ্ঞেস করছি।

আমি-খিদে ছিলোনা।

তন্ময়-খিদে ছিলোনা মাই ফুট।(রেগে)

আমি-এমন করছেন কেনো??

তন্ময়-চুপ”””একটা কথাও বলবেনা।আমি এখন তোমাকে খাবার এনে দিবো।তুমি এখনই আমার সামনে সব খাবার শেষ করবে।

আমি-আমার সত্যি খেতে ইচ্ছে করছে না।

তন্ময়-চুপ।

তন্ময় রান্নাঘরে গিয়ে আমার জন্য খাবার বাড়তে লাগলো।আমিও গিয়ে ওনার পাশে দাঁড়ালাম।উনি আমাকে দেখে তেমন পাত্তা দিলেন না।সবকিছু একদম বেশি বেশি করে নিয়েছে।আমাকে খেতে দিলে আমি ওনার ভয়ে খেতে শুরু করি।

তন্ময়-এভাবে খাচ্ছো কেনো???

আমি-কই???

তন্ময়-টেবিলে গিয়ে খাও।

আমি-না এখানেই ঠিক আছে।

তন্ময়-একবার পানি,একবার ভাত এভাবে খাচ্ছো কেনো???

আমি-গিলতে কষ্ট হচ্ছে। (খেতে খেতে)

তন্ময়-ভালো লাগছে না???

আমি-না।

তন্ময়-ওকে তাহলে রেখে দাও।

আমি-আচ্ছা।

আমি খাবারটা রেখে হাত ধুয়ে নিলাম।শেষে রান্না ঘর থেকে যখন বেরবো তখন তন্ময় আমায় ডেকে থামিয়ে দেয়।

তন্ময়-কই যাও?

আমি-রুমে।

তন্ময়-আমি যেতে বলেছি।

আমি-না(মাথা নিচু করে)

তন্ময়-তাহলে???

আমি-সরি!!

তন্ময়-দাঁড়িয়ে থাকো।

আমাকে বকাবকি করে তন্ময় চুলা জ্বালালো।আমি শুধু ওনার চুলা জ্বালানোর কারণটা ভাবছি।আমাকে অবাক করে উনি প্যানে আমার জন্য বাড়া খাবার গুলো দিয়ে দিলেন।খাবারে শুধু ভাত,গরুর মাংস আর চাইনিজ সবজি ছিলো।উনি সেসব একসাথে ভেজে আমাকে খেতে দিল।

আমি-আবার??

তন্ময়-আগে ভালো লাগেনি এখন ভালো লাগবে।

আমি-আমি এতগুলো খাবোনা।

তন্ময়-তনু দুপুর থেকে তুমি খাওনি।

আমি-তো???

তন্ময়-তোমার বেখেয়ালির কারণে নিজের সন্তান কে হারিয়েছি কিন্তু তোমাকে হারাতে পারবোনা।(বলে চলে গেলো)

আমি-(উনি হয়তো ঠিকই বলেছেন আমার সন্তানের মৃত্যুর জন্য আমি নিজেই দায়ী।আমি যেনো একটা অপয়া যেখানে যাই সেখানেই সবকিছু ধ্বংস করে ফেলি।আমার জন্য বাবা মাকে ডিভোর্স দিতে চেয়েছিলো,আর আজ আমার জন্য আমার সন্তানের মৃত্যু হলো।আমি আর না ভেবে খাবারটা শেষ করে রুমে চলে গেলাম)

((সকালে))

সকালে যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন নিজেকে তন্ময়ের রুমে আবিষ্কার করি।নিজেকে তন্ময়ের রুমে দেখে খানিকটা অবাক হই সাথে ভয়ও পাই।আমাকে এই রুমে দেখলে তন্ময় হয়তো রেগে যাবে।আমি ভয় ভয়ে খাট থেকে নেমে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি আর সামনে যাচ্ছি।সামনে যেতে যেতে হঠাৎ তন্ময়ের সাথে একটা ধাক্কা খাই।

তন্ময়-ওয়াট???

আমি-সরি সরি!!(মাথা নিচু করে)

তন্ময়-তুমি এখানে???

আমি-(ভয়ে চুপ করে আছি)

তন্ময়-আমার রুম থেকে এমন চোরের মতো বের হচ্ছো কেনো তুমি??

আমি-এই না না আমি কিছু চুরি করিনি।

তন্ময়-আমাদের বেবি মিসক্যারেজ না হলেও তুমি বোধহয় ওকে সামলাতে পারতে না।

আমি-এটা কেনো মনে হলো???

তন্ময়-কারণ তুনি নিজেই তো একটা বাচ্চা সাথে আরেকটা বাচ্চা কিভাবে সামলাতে।

আমি-এতোই বাচ্চা মনে হয়??

তন্ময়-রাতে তুমি আমার রুমে কেনো এসেছো??

আমি-আমি এসেছি???

তন্ময়-তুমিই তো এসেছো।

আমি-সরি সরি।(বলে ভয়ে ওনার সামনে থেকে জেনির কাছে চলে এলাম)

জেনি-আরে ভাবী!!

আমি-জেনি আমি রাতে ওনার কাছে গিয়ে
ছিলাম???

জেনি-না তো।

আমি-তাহলে আমি ওনার রুমে কিভাবে গেলাম।

জেনি-ভাইয়াই তোমাকে সকালে নিয়ে গেছে।

আমি-কেনো???

জেনি-কারণ আমি বলেছিলাম।

আমি-তুমি কেনো বললে।

জেনি-আসলে আজ আমার একটা ফ্রেন্ড এসে ছিলো আমার কাছে।

আমি-তাতে কি হয়েছে??

জেনি-ও রুমে এসে তোমাকে দেখলে কি না কি বলতো যার জন্য আমি…

আমি- ওহ বুঝেছি।

জেনি-নাস্তা করেছো তুমি???

আমি-না।

জেনি-আজ অনেক দেরিতে উঠেছো।

আমি-হুম,,,টেরই পাইনি।

জেনি-যাও ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করতে যাও।

আমি-একেবারে শাওয়ার নিয়ে নিই।

জেনি-ঠিক আছে।

আমি এবার আমাদের রুমে ভয়ে ভয়ে আসলাম।
রুমে এসে দেখি তন্ময় নেই।আমি আলামারি থেকে আমার একটা সবুজ রঙের কামিজ নিয়ে ওয়াশরুমে যেতে যাই।কিন্তু ওয়াশরুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ।আমি ভাবলাম কে হতে পারে ভেতরে।পরক্ষণে মনে পরলো তন্ময়ের কথা তাই আমি তাড়াহুড়ো করে রুম থেকে বের হয়ে যাই।

আমি-আউ,,,,(পেটে হাত দিয়ে)

অভি-তনু কি হয়েছে??(তন্ময়ের কাছে আসতে গিয়ে তনুর সাথে দেখা হলো।তনু কেমন অসুস্থ বোধ করছে তাই ওকে ধরলাম)

আমি-পেটে ব্যাথা করছে।

অভি-তন্ময় তোমাকে মেডিসিন দেয়নি।

আমি-দিবে বলেছিলো হয়তো ভুলে গেছে।

অভি-তন্ময় ও না দিন দিন একটা পাগল হচ্ছে।ও কি জানেনা বেবি মিসক্যারেজ হলে মাঝে মাঝে পেটে ব্যাথা হয়।

আমি-থাক ভাইয়া ভুলে গেছে হয়তো।

তন্ময়-কি হয়েছে???(পেছন থেকে)

অভি-কি হয়নি সেটা বল।(রেগে)

তন্ময়-আর কিছু কি হওয়ার বাকি আছে।

অভি-তুই ওই টপিকটা মাথা থেকে ঝাড়।

তন্ময়-কি হয়েছে সেটা বলো।

অভি-তনু কে মেডিসিন দিসনি কেনো??ওর তো পেটে ব্যাথা করছে।

তন্ময়-আমি রাতে জেনির রুমে রেখে এসেছিলাম ও কি দেখেনি???

আমি-আমি খেয়াল করিনি।

তন্ময়-এখন গিয়ে খেয়ে নিও।

আমি-আচ্ছা।(বলে চলে যেতে লাগলাম)

তন্ময়-জামা কাপড় নিয়ে কই যাচ্ছো??

আমি-জেনির রুমে শাওয়ার নিতে।

তন্ময়-এই রুমে কি হয়েছে??

আমি-এখানে তো আপনি ছিলেন।

তন্ময়-আমি কি এখন বের হইনি।

আমি-(মাথা নিচু করে আছি)

তন্ময়-যাও।(রেগে)

আমিও ওনার কথায় আমাদের রুমে গিয়েই শাওয়ার টা নিই।গোসল করে যখন আয়নার সামনে চুল শুকাতে লাগলাম।আয়নার দিকে তাকিয়ে আমার মন খারাপ হয়ে গেলো।এই দুই মাসে আমি যখনই আয়নার সামনে দাঁড়াতাম। তন্ময় তখনই পেছন থেকে আমার পেটে হাত দিয়ে রাখতো আর বেবির সাথে কথা বলতো।এখন তো আর বেবি টা নেই তাই তন্ময়ও নেই।যদি আর একটা মাস আমি অপেক্ষা করতাম তাহলে হয়তো আমার বেবিটা বেঁচে থাকতো।ডক্টর তো বলেছিলো এই তিন মাসে পেটে হালকা আগাত লাগলেও বেবি মিসক্যারেজ হয়ে যাবে।

খাবার টেবিলে—

সাবিয়া-তন্ময় তনু কই??

তন্ময়-শাওয়ার নিতে গেছিলো।

সাবিয়া-একবার গিয়ে ডেকে আসতে পারলি না। নিজে একা এসে নাস্তা করতে বসে গেছে।

তন্ময়-তো এখন কি নাস্তা করতাম না।

সাবিয়া-তোর কথা তো বাদই দিলাম।অভি তোকে ও বলি হারি তুইও মেয়েটাকে ডাকতে পারলি না।

অভি-মা শাওয়ার নিচ্ছিলো তাই…

আমি-কি হয়েছে ভাইয়া???(পেছন থেকে)

অভি-ওই তো এসে গেছে।

সাবিয়া-এতো দেরি করলি কেনো???

আমি-চুল শুকাচ্ছিলাম।

তন্ময়-(ও আজকে শাড়ী ছেড়ে কামিজ কেনো পরলো??ও কি জানেনা আমার ওকে শাড়ীতেই ভালো লাগে)কতক্ষণ ধরে শাওয়ার নিয়েছো??

আমি-বেশি সময় লাগেনি।

সাবিয়া-আচ্ছা এখন খেতে বস।

আমি-হুম।

+++++++++++++

অনু-মা কিছু খাওনা।

রাজিয়া-আমার ছোট মেয়েটার এই অবস্থা আর আমি এখানে বসে বসে খাবো।(কান্না করে)

অনু-এতই যখন দরদ তাহলে ছোট বেলা থেকে এমন করছে কেনো???

রাজিয়া-আমি তখন ভুল ছিলাম আমার মেয়ের তো কোনো দোসই ছিলোনা।তবুও আমি ওকে দোষ দিলাম।(কান্না করে)

অনু-আচ্ছা এখন কিছু খেয়ে নাও।

রাজিয়া-মেয়েটা তো আমার উপর অনেক অভিমান করে আছে তাইনা??

অনু-না মা তনু তোমার উপর কোমো অভিমান করে নেই।ও তো শুধু তোমার অপেক্ষায় থাকতো।

রাজিয়া-ওকে আজকে এখানে নিয়ে আসবি।

অনু-ওর উপর এত বড় একটা ধকল গেছে ওর মন মানসিকতা ও এখন মনে হয় ভালো লেই।কিছু দিন গিয়ে পর গিয়ে নিয়ে আসবো।

তনুর বাবা-লাগবেনা তনুকে আনা।

অনু-কেনো বাবা???

তনুর বাবা-তনু এখান থেকে ওখানেই বেশি ভালো থাকবে।এখানে আসলে ও হয়তো দুঃখে কষ্ট আরো ভেঙ্গে পরবে।

অনু-তুমি এসব কি বলছো??

তনুর বাবা-তো আর কি বলবো।তুই বল এই সময় এ মেয়েরা বেশির ভাগ কার কাছে থাকে,,,তার মায়ের কাছে।কিন্তু আমার তনুর ভাগ্য এতই খারাপ যে তার মা থেকেও নেই।

অনু-বাবা এমন করে বলোনা।

তনুর বাবা-তো কেমন করে বলবো অনু।তনু তো কম চেষ্টা করেনি তোর মায়ের কাছে যাওয়ার।কিন্তু তোর মা কি করেছে ওকে দূরে ঠেলে দিয়েছে।আমার করা দোষের জন্য ওকে দায়ী করেছে ওকে কষ্ট দিয়েছে।

রাজিয়া-শুনো না,,,

তনুর বাবা-তোমার কি মাথায় এতোটুকু বোধবুদ্ধি নেই।সেদিন আমি তোমাকে অপমান করেছি,
আমি তোমাকে থাপ্পড় মেরেছি,আমি তোমাকে ডিভোর্স দিবো বলেছি।কিন্তু তুমি এসবের জন্য আমার ছোট মেয়েটাকে কষ্ট দিলে।

অনু-বাবা এসব কি বলছো প্লিজ থামো।

তনুর বাবা-তোর মা আজ বুঝবে কাওকে কষ্ট দিলে সেই কষ্ট তার কাছেও ফিরে আসবে।
(বলে চলে গেলো)

এই চার-পাঁচ দিন আমি জেনির রুমেই থাকছি।আমার আর তন্ময়ের সেই আগের জুটিটা আর নেই।আগে আমরা একসাথে কত হাসতাম কিন্তু এখন কথা বললেও মুখে সেই হাসিটা নেই।এই কয়দিনে তন্ময় আমার সাথে না হাসলেও আমার খেয়াল রাখতে ভুলেনি।আজ বিকালে আমি ছাদে দাঁড়িয়ে আমার বেবির কথা ভাবছিলাম।হঠাৎ তন্ময় আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে থাকে।ওনাকে দেখে আমি যেই ওখান থেকে চলে আসতে যাই উনি ওমনি আমার হাত ধরে ফেলে।

তন্ময়-আমার থেকে এতো পালাই পালাই করছো কেনো???

আমি-কই???

তন্ময়-আর এখন শাড়ী না পরে কামিজ কেনো পরো???

আমি-ভালো লাগেনা তাই।

তন্ময়-তোমার ভালো লাগুক আর না লাগুক তুমি শাড়ী পরবে।কারণ তোমার শাড়ী পরা আমি পছন্দ করি।বুঝেছো???

আমি-বুঝেছি কিন্তু??

তন্ময়-যাও এখন গিয়ে পরে আসো।

আমি-এখনই???

তন্ময়-যাও।

আমি ছাদ থেকে নামার সময় ইমনকে ছাদে উঠতে দেখি।ইমনকে দেখে এখন আমার কোনো কিছুই ফিল হয়না।না আগের মতো কষ্ট,ভালো বাসা,ঘৃণা কিছুই না।আমি ওর না তাকিয়ে ওর পাশ কাটিয়ে নিচে চলে যাই।

ইমন-ভাইয়া!!

তন্ময়-আরে ইমন আয়।

ইমন-কি করছো??

তন্ময়-কিছুনা এমনে দাঁড়িয়ে আছি।

ইমন-তুমি তনুর সাথে এমন করো কেনো??

তন্ময়-কি করলাম???

ইমন-ওর বেবি মিসক্যারেজ হওয়ার পর থেকে তুমি ওর সাথে ভালোভাবে কথা বলোনা।ওকে নিজের রুমে থাকতে দাওনা।শুধু একটা জিনিস বাদে,,,সেটা হলো ওর খেয়াল রাখতে ভুলোনা।

তন্ময়-আমি এমন কেনো করি জানতে চাস???

ইমন-হুম!!!

তন্ময়-কারণ ওকে দেখলে আমার কষ্ট হয়।কি তনু ছিলো আর কি তনু হয়ে গেলো।ওর মুখে কোনো হাসি নেই,আনন্দ নেই।ওকে এমন দেখলে আমার খুব কষ্ট হয়ে।তাই এমন করি,,,

ইমন-এমন করে তো তুমি ওকে আরো বেশি কষ্ট দিয়ে দিচ্ছো।

তন্ময়-এমন না যে শুধু কষ্ট হয় ওকে দেখলে আমার অপরাধ বোধ ও হয়।

ইমন-কেমন অপরাধ বোধ??

তন্ময়-সেদিন দোষটা তনুর ছিলোনা,,,,দোষটা আমার ছিলো।আমি সেদিন ওর হাতটা ধরতে পারিনি।যদি সেদিন আমি ওর হাতটা ধরতাম তাহলে আজ আমার বাচ্ছাও বেঁচে থাকতো আর তনুর সেই হাসি খুশি মুখটাও দেখতে পারতাম।
(কেঁদে কেঁদে)

ইমন-এতে তোমাদের কারোর দোষ নেই ভাইয়া।এটা শুধু মাত্র একটা এক্সিডেন্ট।

তন্ময়-এক্সিডেন্ট হলেও আমি পারতাম তো।(কেঁদে কেঁদে)

ইমন-তুমি আজ আমাকে অনেক সত্যি বলেছো।আজ আমিও তোমাকে কিছু সত্যি কথা বলতে চাই।

তন্ময়-কি সত্যি???(স্বাভাবিক হয়ে)

-চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে