#ডাক্তার_ম্যাডাম
#পর্ব_০৩
#মুমতাহিনা_জান্নাত_মৌ
তন্নি এবং তানিশা দুইজনই এইচ,এস,সি তে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়ে মেডেকেল এ চান্স পাওয়ার জন্য রেটিনা কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়।
দূর্ভাগ্যবশত তন্নি কোনো সরকারি মেডিকেল এ চান্স না পাওয়ায় সে দ্বিতীয় বার সুযোগ নিচ্ছে।যদি দ্বিতীয় বার ও না হয় তখন তার মামা প্রাইভেট মেডিকেলে ভর্তি করে দেবে।
কিন্তু তানিশা প্রথম সুযোগেই চান্স পেয়ে যায়।
তানিশা এই ঢাকা মেডিকেলে চান্স পাওয়ার জন্য অনেক পরিশ্রম করেছে।সে একটি রাত ঠিকভাবে ঘুমায় নি।তার মনের মধ্যে ভীষণ জিদ ছিলো।সে সবসময় একটি কথাই ভাবতো,
“সবাই যদি পারে তাহলে সে কেনো পারবে না”।
এদিকে তন্নি তায়েব চৌধুরীর কথা শুনে মন খারাপ করে বেলকুনিতে গিয়ে দাঁড়ালো।তানিশাও সেখানে চলে গেলো।তানিশা তন্নির কাছে গিয়ে বললো,
তুই কি আমাকে সেই জন্য ডেকেছিস তোদের বাসায়?তুই মুখ গোমড়া করে থাকবি আর আমি তোর রাগ ভাঙ্গাবো?
তন্নি তখন কাঁদতে কাঁদতে বললো,মামা সবসময় শুধু তোর ই উদাহরণ দেয় এখন।কেনো যে তোর সাথে আমার দেখা হলো,আর কেনোই বা তোকে বেস্ট ফ্রেন্ড বানিয়ে এই বাসায় আনলাম!এখন দিনরাত তো শুধু এটাই শুনতে হয় আমাকে।আমি তো একজন মানুষ।আমার তো খারাপ লাগে।মামা কেনো যে এভাবে কষ্ট দেয় আমাকে বুঝি না কিছু।
তানিশা তখন তন্নির চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বললো, মামা তোর ভালোর জন্যই এভাবে বলে।তুই তাহলে মন দিয়ে পড়াশোনা করবি।প্রথমবার সুযোগ পাস নি তো কি হইছে,আরো একবার তো চান্স আছে।দ্বিতীয় বার ইনশাআল্লাহ পেয়ে যাবি।
তন্নি সেই কথা শুনে তানিশাকে জড়িয়ে ধরে বললো,তুই আবার মন খারাপ করলি নাকি?আমি কিন্তু মন থেকে কিছু বলি নি।
–না না।কিসের মন খারাপ?
হঠাৎ টুং করে আবার মেসেজ আসলো তানিশার ফোনে।
❝আই লাভ ইউ ডাক্তার ম্যাডাম❞প্লিজ রিপ্লাই দাও।আমি তোমার সাথে কিছু কথা বলতে চাই।
তানিশা মেসেজটি এড়িয়ে যেতে চাইলো।কিন্তু তন্নি তার আগেই তানিশার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে বললো,
কি ব্যাপার তানিশা?প্রেম করছিস নাকি?এতো টুং টুং করে কিসের আওয়াজ হচ্ছে?এই বলে তন্নি মেসেজটি সিন করলো।তন্নি মেসেজটি দেখে মাথায় হাত দিয়ে বললো,
–ও মাই গড।তানিশা এই ছেলেটা কে?১০০+ মেসেজ।
তানিশা তখন তন্নির হাত থেকে ফোন টা নিয়ে বললো,দূর চিনি না আমি।
তন্নি তখন তানিশার মাথায় একটা টোকা দিয়ে বললো,আমি কি ছোট বাচ্চা।যেটা বোঝাবি ওটাই বুঝবো।তুই যদি না চিনিস তাহলে এই ছেলে তোর ফ্রেন্ড লিস্টে আসলো কিভাবে?
তানিশা তন্নির কথা শুনে তাড়াতাড়ি করে ছেলেটির সকল মেসেজ চেক করতে লাগলো।কারণ তানিশা নিজেও বুঝতে পারছে না,আসলে ছেলেটা কে?
কিন্তু ছেলেটির প্রথম মেসেজ দেখে তানিশা যেনো শূন্যে ভাসতে লাগলো।
এই তো সেই মেয়েটা,যে তানিশাকে তার ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট এক্সসেপ্ট করার জন্য বার বার অনুরোধ করেছিলো।আর বলেছিলো,আপু আমিও এবার মেডিকেলে চান্স নিতে চাই।প্লিজ হেল্প মি।আপনি কিভাবে প্রস্তুতি নিয়েছেন জানাবেন প্লিজ।
তানিশা তার সাধ্যমতো মেয়েটাকে সাহায্য করেছিলো।কোন কোচিং সেন্টার ভালো হবে,কি কি বই কিনতে হবে এসব বিষয় এ পরামর্শ দিয়েছিলো।তারপর থেকে রেগুলার মেয়েটি তাকে মেসেজ দিতে থাকে।কিন্তু তানিশা ব্যস্ত থাকার কারণে যথাসময়ে রিপ্লাই দিতে পারে না।কিন্তু যখন সময় হয় তখন কথা বলে।
কিন্তু আজ হঠাৎ সেই মেয়ে ছেলে হয়ে গেলো কিভাবে?কুইন শামিমা থেকে আজ কিং শামিম হয়ে গিয়েছে।তারমানে এটা ফেক আইডি ছিলো!এতোদিন সে এই ফেক আইডির সাথে কথা বলে তার মূল্যবান সময় নষ্ট করেছে।
এদিকে তন্নি শুধু বার বার বলছে,কি হলো তানিশা?কিছু বলছিস না যে?ছেলেটাকে রিপ্লাইও দিচ্ছিস না?
তানিশা তখন তন্নিকে সব কিছু খুলে বললো।
এদিকে তানিশা মেসেজ সীন করায় ছেলেটি একের পর এক মেসেজ দিতেই আছে।ছেলেটি লিখেছে,
“এতোদিন আমি মিথ্যা কথা বলেছি।
আসলে আমি কোনো মেডিকেলে চান্স নিতে চাই না।এটা ছিলো তোমার সাথে কথা বলার বাহনা মাত্র।
আমি একজন ছেলে।
তোমাকে আমার অনেক বেশি ভালো লাগে।
কিন্তু বলা হয়ে ওঠে নি।
আমি একজন পুলিশ অফিসার।
আমি তোমাকে অনেক বেশি ভালোবাসি আর বিয়েও করতে চাই।
তানিশা কোনো উত্তর দিলো না।সে মনে মনে ভাবলো রিয়েল আইডির ছেলেদেরকেই পাত্তা দেই না,আর এই ছেলে আসছে ফেক আইডি দিয়ে প্রপোজ করতে। এসব লোকের সাথে আজাইরে কথা বলে সময় নষ্ট করতে চাই না।সেজন্য ব্লক দেওয়ার জন্য ব্লক অপশনে যেতেই ছেলেটি আবার মেসেজ দিলো তানিশাকে,
–হ্যালো ডাক্তার ম্যাডাম!কিছু বলছো না কেনো?এতোদিন তো ভালোই কথা বলতে।তা আজ হঠাৎ এতো অহংকারী হয়ে গেলে কেনো?আমিও কিন্তু একজন নামকরা পুলিশ অফিসার।ইচ্ছা করলে তোমাকে তুলে নিয়ে যেয়ে বিয়ে করতে পারি।ভালোভাবে বললাম দেখে গায়ে লাগাচ্ছো না আমার কথা?
মেসেজ টা দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গেলো তানিশা।কারণ ঢাকা শহরে সে একলা থাকে।কোনো নিকট আত্নীয় কেউ নেই।শুধু আছে এই কলেজের বান্ধুবীটাই। এভাবে কেউ যদি হুমকি দেয় তাহলে তো ভয় পাবারই কথা।তবুও সাহস করে উত্তর দিলো তানিশা,
–বিয়ে করা তো দূরের কথা আপনি আমার ধারেকাছেও ঘেষতে পারবেন না।আর আপনি যত বড়ই অফিসার হন না কেনো আমার তাতে কিছু যায় ও আসে না।
–এতো অহংকার তোমার?মেডিকেলে পড়ছো দেখে কি এতো অহংকার দেখাতে হবে?
তানিশা তখন বললো, অনেক পরিশ্রম করে মেডিকেলে চান্স পাইছি,সেজন্য তো একটু অহংকারী হবোই।
ছেলেটি তখন রাগের ইমোজি দিয়ে বললো,
–এই যে মিস তানিয়া।এরকম দুই চারটা মেডিকেল স্টুডেনদের আমি পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
তানিয়া নাম শুনে ভীষণ হাসি পেলো তানিশার।সে তখন হা হা ইমোজি দিয়ে বললো,যে আমার নামটাই ঠিক করে জানে না,সে আবার নাকি আমাকে উঠে নিয়ে যাবে।তানিয়া না।আমি মিস তানিশা।আর আপনার পকেটে আপনি কাকে কাকে রাখবেন সেটা আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার।
ছেলেটি তখন বললো, চ্যালেঞ্জ রইলো তোমার সাথে।শনিবার দেখি কি করে কলেজে ঢুকতে পারো তুমি?সোজা উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করবো তোমাকে।
তানিশা এই মেসেজ দেখার সাথে সাথে তাকে চিরদিনের জন্য ব্লক লিস্টে পাঠিয়ে দিলো।তবে তার ভীষণ ভয় হতে লাগলো।ছেলেটি তাকে এভাবে চ্যালেঞ্জ করলো কেনো?এখন সত্যি সত্যি যদি উঠিয়ে নিয়ে যায়?
তন্নি তানিশাকে এমন ভয় করা দেখে বললো,তুই আসলেই একজন পাগল মেয়ে।ও বললো আর তোকে উঠিয়ে নিয়ে গেলো?এতো সহজ?
আরে ফেসবুকে এরকম অহরহ ছেলে আছে যাদের কোনো কাজকর্ম নেই।হুদাই মেয়েদেরকে এভাবে ডিস্টার্ব করে আর ভয় দেখায়।
তানিশা তন্নির এমন শান্ত্বনা শুনেও তার আতংক কিছুতেই দূর হলো না।তার বুক দুরুদুরু করে কাঁপতে লাগলো।
এদিকে তন্নি তানিশাকে এমন ভয় করা দেখে তার মন ভালো করার চেষ্টা করতে লাগলো।তাকে ছাদে নিয়ে গেলো।সেখানে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে তারপর নিজের হাতে তানিশাকে নুডলস রান্না করে খাওয়ালো।বিকালবেলা আবার দুই মগ কফি বানিয়ে নিয়ে বেলকুনিতে বসে কিছুক্ষণ গল্প করলো।তানিশা সবকিছু ভুলে যাওয়ার ট্রাই করলো।আর তন্নির সাথে দিনটি উপভোগ করতে লাগলো।এই ভাবে হাসি আনন্দে কখন যে দিন পেরেয়ি রাত হয়ে গেলো তানিশা টেরই পেলো না।
রাতের বেলা হঠাৎ তন্নি মিউজিক এর সাউন্ড বেশি করে দিয়ে তার তালে তালে নাচতে লাগলো আর বলতে লাগলো,
আহা ঊ ঊ আহা ঊ ঊ
সাঁহ চুটকী জো তুনে কাতী হৈং
জোরী সে কাতী হৈং, যহাঁ বহাঁ
রোতী হূঁ, মেং তুঝসে রোতী হূঁ
মুঝে মানা লে না ও জান-এ-জান
ছেড়েংগে হম তুঝক
লড়কী তূ হৈং বড়ী বুম্বাত
আহা আহা আহা আহা
উহ লা লা, উহ লা লা,
উহ লা লা, উহ লা লা
তূ হৈং মেরী ফংতাসী
চূ না না, চূ না না,
চূ না না, চূ না না
অব মেং জবান হো গযী
তন্নি এবার তানিশাকেও ডাকলো তার সাথে ডান্স করার জন্য।
কিন্তু তানিশা আসতে চাইলো না।তন্নি তখন জোর করেই তানিশার হাত ধরে লাফাতে লাগলো।একেবারে যাকে বলে উরাধুরা নাচ।
তানিশা বুঝতে পারছে না তন্নিকে আজ হঠাৎ এতো খুশি খুশি লাগছে কেনো?
হঠাৎ দরজায় দাঁড়িয়ে নোমান চিৎকার করে বললো,শাট আপ!কি শুরু করেছিস তন্নি?বন্ধ কর এসব গান বাজনা।
নোমান জোরে জোরে চিল্লাছে আর বলছে,এতো জোরে সাউন্ড দিয়ে কেউ গান শোনে নাকি?বাসায় তো তুই একা না?বাকি মেম্বারদের কথাও তো ভাবতে হবে?
নোমানের এতো জোরে জোরে চিল্লানি তন্নীর কানেই পৌঁছলো না।সে চোখ বন্ধ করে সেই আগের মতোই গানের তালে তালে ডান্স করছে।কিন্তু তানিশা নোমানের কন্ঠ শুনে অনেক আগেই থেমে গেছে।সে তখন তাড়াতাড়ি করে নিজেই গিয়ে মিউজিক টা অফ করে দিলো।
এতোক্ষণে তন্নির হুঁশ ফিরে এলো।গান বন্ধ হওয়ায় সে যখন চোখ মেলে তাকালো,আর নোমানকে দাঁড়িয়ে থাকা দেখে সাথে সাথে বললো,
নোমান ভাইয়া আপনি এই সময়ে বাসায়?
আপনার না আজ ওয়ার্ডে ক্লাস আছে।
#চলবে,
#ডাক্তার_ম্যাডাম
#পর্ব_০৪
#মুমতাহিনা_জান্নাত_মৌ
আমি বাসায় না থাকলে তুই কি এরকমই পাগলামি করিস?
–না,না।কি বলছেন এসব?আমি তো মাত্র পড়াশোনা শেষ করে মিউজিক টা অন করেছি।
নোমান তন্নির কথা শুনে বললো, মনে তো হয় না তুই আজ পড়তে বসেছিলি?এভাবে মিথ্যা কথা বলে কি লাভ তন্নি?এতে ক্ষতি কিন্তু তোরই হচ্ছে।যা পড়তে বস।এই বলে নোমান তানিশার দিকে একবার তাকিয়েই আবার তার চোখ ফিরে নিলো।আর রুম থেকে বের হয়ে গেলো।
তানিশা তার জায়গাতেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।নোমান রুম থেকে বের হওয়া মাত্র তন্নি বললো,
এখন কয়টা বাজে তানিশা? নোমান ভাইয়া আজ এতো তাড়াতাড়ি ফিরলো কেনো?
তানিশা ঘড়ি দেখে বললো ৯ টা বাজে।
–মাত্র ৯ টা।আর তাতেই ভাইয়ার ওয়ার্ড করা শেষ হয়ে গেলো?
তানিশা তন্নির কথা শুনে বললো, আজ হয় তো ওয়ার্ডের ক্লাস তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেছে।সেজন্য উনিও তাড়াতাড়ি ফিরেছেন বাসায়।
আসলে নোমানকে এখন সারারাত ওয়ার্ডেই থাকতে হয়। সারারাত ওটিতে থেকে আবার সকাল সাতটায় ক্লাসে এটেন্ড করে সে।সকল ক্লাস শেষ করে তবেই সে বাসায় ফেরে।কিন্তু আজ একটু নোমান তাড়াতাড়িই বাসায় ফিরেছে।সেজন্য তন্নি ভীষণ অবাক হলো।
তন্নি নোমানের কথা শুনে কিছুক্ষণ বই নিয়ে পড়াশোনা করলেও তার আর ইচ্ছে করলো না পড়তে। বাসায় তার বেস্ট ফ্রেন্ড এসেছে আর সে তাকে সময় দেওয়া বাদ দিয়ে বই নিয়ে বসে থাকবে?না,তা কিছুতেই হবে না।এজন্য তন্নি বই বন্ধ করে তানিশার কাছে চলে গেলো।
তানিশা একা একা বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে আছে আর মনে মনে ভাবছে কবে যে সেও চতুর্থ ইয়ারে উঠবে?চতুর্থ ইয়ারে উঠলে তবুও ডাক্তার হবার স্বপ্নের প্রায় কাছাকাছি চলে যাওয়া যায়।কারণ তখন ওয়ার্ডে ক্লাস হয় নিয়মিত।ডাক্তার হওয়ার সকল নিয়মকানুন কিছুটা শিখে ফেলে স্টুডেন্টরা।
হঠাৎ তন্নি পিছন দিক থেকে তানিশাকে ধরায় সে একদম চমকে উঠলো।তানিশা ভয়ে বুকে থু থু ছিটিয়ে দিলো।
তন্নি তা দেখে হাসতে হাসতে বললো,ডাক্তারদেরকে সবসময় সাহসী হতে হয়।কিন্তু তুই তো একদম ভিতুর ডিম।
তানিশা তখন বললো,আমি মোটেও ভয় পাই না তন্নি।কিন্তু তুই যেভাবে হঠাৎ এসে ধরেছিস ভয় পাবারই তো কথা।
–আচ্ছা বাদ দে।চল না একটু গল্প করি এখন।
তানিশা সেই কথা শুনে বললো, তোর কি পড়াশোনা শেষ হয়েছে?
–রাখ তো পড়াশোনা। ছুটির দিনেও যদি বই নিয়ে বসে থাকতে হয় তাহলে সে ছুটি দেওয়ার কি মানে?তার উপর আবার তুই এসেছিস বাসায়।আজ হবে না এসব পড়াশোনা।চল কিছুক্ষন গল্প করি।
–কি গল্প করবি?
–যেকোন গল্প?
তানিশা তখন তন্নির দিকে ভালো করে তাকালো।তন্নির চোখেমুখে কেমন যেনো প্রেম প্রেম গন্ধ।নতুন প্রেমে পড়লে মুখে যেমন একটা আনন্দের ঝটকা দেখা যায় ঠিক তেমনি তন্নির মুখখানা জ্বলজ্বল করছে।তানিশা তখন নিজেই জিজ্ঞেস করলো,
একটা সত্যি কথা বলবি?
–কি?
–তোর হয়েছে টা কি বল তো?তোকে কেমন জানি আজ অন্যরকম লাগছে।তুই কি কিছু বলতে চাস আমাকে?
তন্নি তানিশার কথা শুনে চুপ করে থাকলো।কারণ সে সত্যিই কিছু একটা বলতে চায়।কিন্তু বলার সাহস হচ্ছে না তার।আর তন্নি তানিশাকে এজন্যই ডেকেছে তার বাসায়।কারণ সে কথাটা তানিশাকে না বলে থাকতে পারছে না।
হঠাৎ নোমান আবার আসলো তন্নির রুমে।আর তন্নি তন্নি বলে চিৎকার করতে লাগলো।তন্নি নোমানের ডাক শোনামাত্র রুমে চলে গেলো।নোমান তন্নিকে দেখামাত্র বললো,
কি রে?রাত কয় টা বাজে।রুমে আলো জ্বালানো কেনো?
–না মানে ভাইয়া এতোক্ষণ পড়লাম।এখন পড়া শেষ সেজন্য একটু বেলকুনিতে বসে গল্প করছিলাম তানিশার সাথে।
–এতো রাতে গল্প?যা ঘুমে পড়।
–আজ ছুটির রাত না!আরেকটু দেরীতে ঘুমাবো।
নোমান তখন বললো,না এখনি ঘুমাবি।আর যদি ঘুম না ধরে তাহলে আবার পড়তে বস।মেডিকেলে চান্স নিতে গেলে এক সেকেন্ডও নষ্ট করা যাবে না।প্রতিটা সেকেন্ডের অনেক মূল্য এখন।
তানিশা বেলকুনি থেকেই নোমানের সব কথা শুনছিলো।
হঠাৎ নোমান বললো,তোর বান্ধুবী তোকে উপদেশ দেয় না?তুই যে এভাবে সময় নষ্ট করছিস সে কিছু বলে না?
–হ্যাঁ বলে।
–কই তোর বান্ধুবী? ডাক দেখি?
তন্নি সেই কথা শুনে তানিশাকে ডাকতে গেলো।
তানিশা তন্নির কথা শুনে ভীষণ অবাক হলো।নোমান তাকে ডাকছে?যে ছেলে জীবনেও কথা বলে নি তার সাথে।সে আজ হঠাৎ ডাকতে যাবে কেনো?সে নিশ্চয় ভুল শুনেছে।
সে জন্য তানিশা বেলকুনিতেই দাঁড়িয়ে রইলো।
তন্নি তখন বললো, কি রে? কি হলো?শুনতে পাস নি?নোমান ভাইয়া ডাকছে তোকে?
তানিশা তন্নির কথা শুনে রুমে চলে আসলো।
কিন্তু তানিশা রুমে আসতেই নোমান তানিশাকেও একটা ধমক দিলো।নোমান বললো,
বান্ধুবীকে পড়াশোনার বিষয় এ সাহায্য করো না?না শুধু তা তা থই থই করে নাচানাচি করো?
তানিশা নোমানের কথাশুনে একদম বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো।
নোমান এবার শান্তসুরে বললো,তুমি তো মেডিকেলে চান্স পাইছো,তা তোমাকে তো আর বলতে হবে না মেডিকেলে চান্স নিতে গেলে কতটা পরিশ্রম করতে হয়?
–জ্বি।
–তুমি কি চাও না তোমার বান্ধুবীও মেডিকেলে চান্স পাক।
–হ্যাঁ অবশই।
–তাহলে সে কেনো এভাবে সময় নষ্ট করছে?কিছু বলো না কেনো তাকে?এভাবে সময় নষ্ট করলে তো সে এবারও সুযোগ পাবে না।
তানিশা সেই কথা শুনে তন্নির দিকে তাকালো।আর তন্নি তানিশার দিকে।
নোমান তা দেখে বললো এভাবে তোমরা একে অপরকে দেখছো কেনো?আমি কিছু বলছি কিন্তু।
তন্নি সেই কথা শুনে সেখান থেকে চলে গেলো। আর একটা বই হাতে নিয়ে আবার পড়া শুরু করলো।তন্নি মনে মনে ভাবতে লাগলো এই নোমান ভাই টা তাকে এতো শাসায় কেনো?আর মেডিকেলে যে চান্স পেতে হবে তার কি মানে?
তানিশা তার জায়গাতেই দাঁড়িয়ে থাকলো।সে মনে মনে ভাবতে লাগলো এই বাসাতে আসাটাই তার ভুল হয়ে গেছে।কেনো যে সে আসতে গেলো?
হঠাৎ নোমান তানিশাকে বললো,তুমি এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেনো?তোমার কি কোনো পড়াশোনা নাই?তানিশা সেই কথা শুনে নিজেও চলে যেতে ধরলো।
নোমান তখন বললো,ওয়েট!ওয়েট!আগেই কোথায় যাচ্ছো?আগে বলো তোমার পড়াশোনা কেমন চলছে?সবকিছু বুঝতে পারছো তো?
তানিশা কি উত্তর দেবে কিছুই বুঝতে পারলো না।
নোমান তখন বললো,শুধু এপ্রোণ গায়ে দিয়ে ঘুরলেই ডাক্তার হওয়া যায় না।মেডিকেলে চান্স পেতে যতটা পরিশ্রম করেছো তার থেকে হাজার গুন পরিশ্রম করতে হবে এই মেডিকেলে টিকে থাকতে গেলে।তাছাড়া তুমি মাত্র ভর্তি হয়েছো তো এখনো কিছু বুঝতে পারছো না।দুই দিন পরে ঠিকই টের পাবে।তখন এভাবে পাগলের মতো নাচানাচির সময় ই পাবে না।
তানিশা নোমানের কথা শুনে নিচ মুখ হয়ে থাকলো।কারণ নোমান সত্যি কথাই বলেছে।তানিশা ইতোমধ্যে সত্যি হাঁপিয়ে উঠেছে।ডাক্তার হওয়ার শখ তার অনেক আগেই ঘুচে গেছে।
তানিশাদের কলেজে ক্লাস নেওয়ার জন্য আলাদা ডিপার্টমেন্ট থাকে।এসব ডিপার্টমেন্টে গিয়ে গিয়ে ক্লাস করাটাই তো মারাত্নক রকমের ঝামেলা মনে হয় তানিশার কাছে।
বায়োকেমিস্ট্রির ক্লাস টা খারাপ না লাগলেও এনাটমির ডেমো ক্লাস টা এক বর্ণ ও বুঝে উঠতে পারছে না তানিশা।তার উপর আবার ফিজিওলজি তো আছেই।পড়তে পড়তে তানিশার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা!
আবার এসব বিষয়ে নিয়মিত পরীক্ষা লেগেই থাকে।
সবচেয়ে ছোট পরীক্ষা হলো আইটেম,যেটা প্রতিদিনই হয়ে থাকে।এটা মূলত ভাইভার মতো।
বেশ কয়েকটা আইটেম মিলে একটা কার্ড হয়।তারপর কয়েকটা কার্ড পরীক্ষা মিলে একটা টার্ম পরীক্ষা হয়।রিটেন,ভাইভা,প্রাক্টিটিক্যাল তো আছেই।সবশেষে তিনটা টার্ম মিলে একটা প্রফেশনাল পরীক্ষা হয়।
কার্ড, টার্ম আর প্রফ নামক যে পরীক্ষাগুলো হয়,
তানিশা মনে করে সেগুলো কোনো পরীক্ষায় নয়,তানিশার কাছে সেগুলো যন্ত্রনা,নির্যাতন,আর মানসিক চাপ মনে হয়।
পড়তে পড়তে একেক টা স্টুডেন্ট পাগলের মতো হয়ে যায়।তানিশার অবস্থাও এখন পাগলের মতো।কোথাও বেড়াতে যেতেও পারে না সে।দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে তার।তার বাবা মা নিজেরাই ঢাকাতে এসে দেখে যায় তাকে।
কারণ মেডিকেল কলেজে কোনো লম্বা ছুটি থাকে না।ঈদের ছুটি,পূজার ছুটি ঠিক যতদিন সরকারি অফিসে থাকে, তাদের ছুটিও ততোদিন ই থাকে।
তানিশা এখন মনে মনে ভাবে কোন দুঃখে যে মেডিকেলে পড়তে এলাম?
তানিশা কিছুক্ষনের জন্য তার মেডিকেল লাইফ নিয়ে কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে গেলো।
তানিশা প্রথম যেদিন মেডিকেলে এপ্রোণ জড়িয়ে ক্লাস করতে গেলো, ভীষণ উত্তেজনা ভর করছিলো তার মনে।সাদা এপ্রোণ টাকে সবচেয়ে পবিত্র কাপড় মনে হয়েছিলো তার।প্রথম দিন স্যার দের জ্ঞানগর্ভ কথা শুনে ভেবেছিলো,আহা!কতই না সুন্দর হবে জীবন টা এখন।কত ভালো লাগবে মানুষের সেবা করতে পেরে।সেই খুশিতে আব্বু আম্মুকে ফোন করে বললো,
বাবা, আমার জন্য অনেক অনেক দোয়া করো,মা আমার জন্য বেশি করে দোয়া করো।আমি যেনো মানুষের মতো মানুষ হতে পারি।সারাজীবন অন্যের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে পারি।
কিন্তু নবীন তানিশা সেদিন বুঝে উঠতে পারে নি মানুষের সেবা করতে যেসব পর্যায় পার হতে হবে তা পার করতে গিয়ে সে নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়বে।
আসলে মেডিকেল কলেজ মানেই, ভীষণ পড়ার চাপ,প্রতিযোগিতা, কদিন যেতে না যেতেই শুধু পরীক্ষা আর পরীক্ষা,খিদে চেপে রেখে ক্লাসের পর ক্লাস করে যাওয়া।
তারপরও এতো কষ্টের মাঝে নিজেকে নিয়ে গর্ববোধ করে তানিশা।কারণ বাবা মার স্বপ্নটা যে পূরন করতে পেরেছে।তানিশার বাবার ভীষণ ইচ্ছা ছিলো,তানিশা একদিন অনেক বড় ডাক্তার হবে।এলাকার মধ্যে প্রথম এমবিবিএস ডাক্তার হবে সে।সেই স্বপ্ন পূরনের পথেই আছে তানিশা।
তবে সাদা এপ্রোণ টি গায়ে দেওয়ার পর থেকে তানিশার সম্মান যেনো বহুগুন বেড়ে গেছে।কোথাও যদি এপ্রোণ গায়ে দিয়েই যায় আজব ধরনের এক সম্মানিত ব্যক্তি হয়ে যায় সে।
কথায় আছে না,সূর্যের চেয়ে বালির উত্তাপ বেশি থাকে।তেমনি ডাক্তার দের থেকে মেডিকেল স্টুডেন্ট দের সম্মান যেনো অনেক বেশি থাকে।
একবার তানিশার বাবা হসপিটালে চেকাপ করানোর জন্য ঢাকায় এসেছিলেন।তানিশা কলেজ শেষ করেই বাবাকে নিয়ে হসপিটালে যায়।রিসেপশনে সিরিয়াল নিতে গিয়ে এমন খাতির করা শুরু করলো সবাই,তানিশার জীবনদশায় এরকম খাতির কখনোই পাই নি সে।
তানিশা সবসময় ভাবে,সে বড় কোনো ডাক্তার হতে পারবে কিনা জানে না,তবে এখন থেকেই সকল মানুষের ভালোবাসা পাচ্ছে প্রচুর।
এদিকে নোমান তানিশার প্রফের পরীক্ষার ব্যাপারে একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে।কিন্তু তানিশা এখনো তার কল্পনার রাজ্য থেকেই ফেরে নি।
#চলবে,