ডাক্তার ম্যাডাম পর্ব-১৬+১৭+১৮

0
1371

#ডাক্তার_ম্যাডাম
#পর্ব_১৬
#মুমতাহিনা_জান্নাত_মৌ

গভীর রাতে হঠাৎ করেই তানিশার ঘুম ভেংগে গেলো। তার কিছুই ভালো লাগছে না।কেনো জানি ভীষণ মন খারাপ লাগছে তার। এজন্য তানিশা একটা বই নিয়ে পড়তে বসলো। হার্টের রাইট করোনারী আর্টারী কোন দিক দিয়ে কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে,রাইট এট্রিটামে কি কি ফিচার পাওয়া যায় এগুলো জোরে জোরে পড়তে লাগলো তানিশা।তানিশা এতো জোরে জোরে পড়ছিলো যে রিশা আর লিরার ঘুম ভেংগে গেলো।তারা তখন চোখ ডলতে ডলতে বিছানায় বসে বললো,তানিশা!কি হয়েছে তোর?আজ হঠাৎ এতো জোরে জোরে পড়ছিস কেনো?তানিশা ওদের কন্ঠ শুনে থেমে গেলো।আসলে তানিশা কিন্তু কখনোই সবার সামনে এতো জোরে জোরে পড়াশোনা করে না।কিন্তু যখন দেখে কেউ নাই বা তার পড়াশোনায় মন বসছে না ঠিক তখনি এতো জোরে জোরে আওয়াজ করে পড়াশোনা করে সে।

রিশা এগিয়ে এসে বললো,তানিশা!এতো রাতে পড়ছিস যে?কাল তো ছুটির দিন।আজ একটু রেস্ট নি।তানিশা সেই কথা শুনে বই রেখে শুয়ে পড়লো।যদিও তার ঘুম আসছে না তবুও ঘুমানোর চেষ্টা করলো।

পরের দিনও ঠিক এই সময়েই তার ঘুম ভেংগে গেলো। কিন্তু আজ আর তার পড়তে ইচ্ছে করলো না।কারণ জানালার ফাঁক দিয়ে বড় একটা চাঁদ দেখা যাচ্ছে দেখে সে পর্দা টা সরিয়ে দিয়ে জানালার রেলিং এ মুখ লাগিয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো।তারপর তার কিছু একটা মনে হলো, সেজন্য সে খাতা আর কলম নিয়ে বসে পড়লো।সে একবার বাহিরে তাকাচ্ছে তো আরেকবার খাতায় লিখছে,

জ্যোছনা রাতে একা বসে তোমার কথা ভাবি,
এই হৃদয়ের আঙ্গীনাতে তোমার ছবি আঁকি।
বিরহতে ভালোবাসা,অশান্তিতে মন,
দিবানিশি তোমাকে ভাবি সারাক্ষণ।
নিচে ছোট্র করে মনের অজান্তে লিখলো নোমানের নাম।নামটি লিখে সে যেনো অন্য রকম এক শান্তি অনুভব করলো।সেজন্য আবার লিখলো নোমানের নাম।তানিশা বুঝতে পারছে না এমন কেনো হচ্ছে তার।সেজন্য সে বার বার নোমানের নামটি লিখতে লাগলো।

হঠাৎ লিরা উঠে এলো।সে ওয়াশরুমে যাবে বলে উঠেছিলো।কিন্তু তানিশার পড়ার টেবিলের বাতিটা জ্বালানো দেখে এগিয়ে এলো।

–কি রে তানিশা! কি করছিস এতো রাতে?

তানিশা যেনো একদম চমকে উঠলো।আর খাতা টা তাড়াতাড়ি করে ভাজ করে লুকিয়ে রাখলো।

লিরা তানিশার এমন পরিবর্তন দেখে কিছু বুঝে উঠতে পারছিলো না।তানিশা কেমন যেনো অন্যমনস্ক হয়েছে আজকাল।তার আচরনেও অনেক পরিবর্তন এসেছে।মনে হয় সে কোনো কিছু নিয়ে ভীষণ চিন্তিত আছে।লিরা তানিশাকে জিজ্ঞেস করলো এই তোর কি হয়েছে?তুই কি কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তিত?
তানিশা তখন হেসে উত্তর দিলো না তো।তোরা অযথাই চিন্তা করছিস আমাকে নিয়ে।

পরের দিন কলেজে টিফিন পিরিয়ডে আজ সবার আগে ক্যান্টিনে চলে গেলো তানিশা। যে যার মতো খাবার খাচ্ছে।তানিশার বান্ধুবীরাও খাচ্ছে।কিন্তু তানিশা খাওয়া বাদ দিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে।

হঠাৎ নোমান আর তার বন্ধুরা প্রবেশ করলো ক্যান্টিনে।কিন্তু নোমান একবারের জন্যও তানিশার দিকে তাকালো না।নোমান সোজা বেঞ্চে বসে তার খাওয়া শুরু করে দিলো।নোমান বই পড়ছে আর খাচ্ছে।অন্যদিকে তার তাকানোর সময় ই নেই।কিন্তু তানিশা লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতে লাগলো নোমানকে।সে আজকাল নোমানের দিকে তাকিয়ে থাকতেই বেশি আনন্দ পাচ্ছে।সারাজীবন এভাবে তাকিয়ে থাকতে পারলে তার জীবনটা মনে হয় ধন্য হতো।তানিশা কিছুতেই নোমানকে ভুলতে পারছে না।কি করে সে ভুলবে নোমানকে এসব ভাবতে ভাবতেই টিফিন পিরিয়ড শেষ হয়ে গেলো।তানিশার আর কিছু খাওয়া হলো না।
এদিকে নোমান টিফিন পিরিয়ড শেষ হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে তার ক্লাসে চলে গেলো।কিন্তু তানিশা তখনো সেখানেই রয়ে গেলো।তানিশার বান্ধুবীরা বুঝতে পারছে না কিছু।হঠাৎ তানিশার হলো টা কি?ইদানীং সে বেশ অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে।আগের মতো আর যখন তখন বই হাতে নিয়ে বসে থাকে না।কেমন যেনো হয়ে গেছে সে।আজ খাবার টাও খেলো না।

ক্লাস শেষ হওয়া মাত্র প্রতিটা মেয়ে হোস্টেলের দিকে যেতে লাগলো।হঠাৎ নোমানের সাথে মুখোমুখি দেখা তানিশার।দুইজন দুইজনকে দেখামাত্র কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো তারপর যে যার মতো চোখ ফিরিয়ে নিলো।অথচ এক সময় দুইজন দুইজনকে দেখার জন্য একদম অস্থির হয়ে ছিলো অথচ আজ দেখা হওয়ার পরও কারো মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না।তারা কি কথা বলবে বা কিভাবে শুরু করবে সেটাই তো জানে না।মনে হচ্ছে তারা কখনোই কাউকে দেখে নি।কত অচেনা তারা!অথচ মনে মনে দুইজনই কথা বলার জন্য পাগল হয়ে আছে।

হঠাৎ রিশা বললো,হাই ভাইয়া,হাউ আর ইউ?
নোমান ছোট্র করে উত্তর দিলো ফাইন।তারপর সেখান থেকে চলে গেলো।
তানিশা কিছুক্ষণ সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকলো।তবে পিছন ফিরে তাকানোর সাহস হলো না।তবুও সে অল্প একটু তার ঘাড় বাঁকা করে দেখলো।কিন্তু তানিশা সাথে সাথে আবার তার ঘাড় ঘুরালো।কারণ নোমান এদিকেই তাকিয়ে আছে।তানিশা বুঝতে পারলো নোমান যতই অভিমান করুক না কেনো সে এখনো তাকে ভুলতে পারে নি।নোমানের চাহনি দেখে তানিশার বুকের ভিতর টা ধক করে উঠলো।তার চোখে জল পর্যন্ত এসে গেলো।তানিশা আর থাকতে পারলো না সেখানে।দৌঁড়ে হোস্টেলের দিকে চলে গেলো।

এদিকে রিশা আর লিরা এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে লাগলো।কারণ তারা কিছুটা আন্দাজ করতে পারলো।এক পর্যায়ে তারাও তাড়াতাড়ি করে হোস্টেলে চলে গেলো আর তানিশার কাছে এসে বললো,
তানিশা!তুই কি নোমান কে পছন্দ করিস?বা তোদের মধ্যে আবার প্রেম টেম কিছু হলো নাকি?

তানিশা নোমানের ব্যাপারটা হেসে উড়িয়ে দিয়ে বললো,তোদের মাথা সত্যি গেছে।আমার কি প্রেম করার সময় আছে নাকি?পড়েই কুল পাই না।কখন প্রেম করতে যাবো?

অন্যদিকে নোমান তানিশাকে যতই দেখছে তার বুকের ভিতর ভালোবাসার আগুন ততই দাউদাউ করে জ্বলছিলো।কিন্তু তার যে ভয়ংকর রকমের ইগো।সে আর কখনোই নিজের থেকে কিছু বলতে যাবে না,একবার বলেই তানিশার কাছে সে ভীষণ ভাবে অপমানিত হয়েছে।আর মরে গেলেও নিজের থেকে কিছু বলবে না সে।নোমানের কথা তানিশা যদি সত্যি তাকে ভালোবাসে তাহলে নিজের থেকেই সে ফিরে আসবে।আর তাকে ভালোবাসার কথা বলবে।নোমানের এখনো প্রতিটা সেকেন্ডে শুধু তানিশার কথায় মনে হচ্ছে সে মনে মনে ভাবছে তানিশা কি একবারও তার ভালোবাসা ফিল করতে পারছে না।এতোটা হৃদয়হীনা সে!

পরের দিন সকালবেলা রুম ঝাড়ু দিতে গিয়ে রিশা সেই পেজ টা খুঁজে পায় যেটাতে তানিশা নোমানের নাম লিখেছিলো।নোমানের নাম দেখামাত্র রিশার আর বুঝতে বাকি রইলো না।সে তখন সরাসরি পেজটা দেখিয়ে বললো,তানিশা!
এখনো বলবি যে তুই নোমানকে ভালোবাসিস না?

তানিশা সাথে সাথে পেজ টি কেড়ে নিয়ে বললো, হ্যাঁ বলবো।যে আমি নোমানকে ভালোবাসি না।
লিরা তখন বললো তাহলে পেজে নোমানের নাম লিখেছিস কেনো?
তানিশা তখন বললো এটা তন্নির জন্য লিখেছি।ও নোমানকে নিয়ে লিখতে বলেছিলো।
লিরা আর রিশা দুইজনই অবাক।এই মেয়ে বলে কি?তন্নি আবার কোথা থেকে এলো মাঝখানে?

তানিশা তখন বললো, তোরা এভাবে অবাক হচ্ছিস কেনো?সত্যি বলছি আমি।তন্নি আর নোমানের বিয়ে ঠিক হইছে।সেজন্য তন্নি নোমানকে নিয়ে কিছু একটা লিখে তাকে দিতে চায়।আমাকে বলেছিলো লিখতে তাই লিখেছি।এই বলে তানিশা সেখান থেকে চলে গেলো।তবে তার চোখের কোনে জমে থাকা জল আর আড়াল করতে পারলো না সে।রিশা আর লিরা এতোক্ষণে সবকিছু পরিষ্কার বুঝে গেলো।কিন্তু তারা আর এ বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে চাইলো না।কারণ যেখানে তাদের বান্ধুবী এ নিয়ে কিছু বলছে না সেখানে এ ব্যাপার নিয়ে তাদের আলোচনা করা মোটেও শোভনীয় নয়।

প্রায় এক সপ্তাহ ধরে তন্নির সাথে তানিশার কথা হয় না।তন্নিও কল দেয় না।আবার তানিশাও দেয় না।কিন্তু আজ হঠাৎ তন্নি কল দিলো।তানিশা রিসিভ করার সাথে সাথে তন্নি বললো,
কংগ্রাচুলেশনস।
তানিশা বেশ অবাক হলো।তন্নি হঠাৎ কংগ্রাচুলেশনস জানাচ্ছে কেনো?
সেজন্য তানিশা বললো বুঝতে পারলাম না।কিসের জন্য কংগ্রাচুলেশনস জানাচ্ছিস?
তন্নি তখন হাসতে হাসতে বললো আমাদের আমান ভাইয়া পুলিশ অফিসার হয়েছেন।খুব শীঘ্রই জয়েন করছেন তিনি।
তানিশা সেই কথা শুনে বললো,তোর আমান ভাইয়াকে না জানিয়ে আমাকে কংগ্রাচুলেশনস জানাচ্ছিস কেনো?
তন্নি তখন হাসতে হাসতে বললো, ও তুই বুঝবি না।সামনের কাল মামা যাচ্ছে তোদের বাড়ি।রেডি থাকিস।এই বলে তন্নি হি হি হি করে হেসে উঠলো।

তন্নির কথা শুনে তানিশার মাথায় যেনো আকাশ ভেংগে পড়লো।এমনিতেই তার মন ভালো নেই তার উপর তন্নি এটা কি নিউজ শুনালো।কারন তানিশা বুঝতে পারছিলো তার মামা কেনো যাচ্ছে তাদের বাড়ি।

হঠাৎ তন্নি বললো, কাল একবার আসতে পারবি বাসায়?কাল আমাদের বাসায় একটা পার্টির আয়োজন করেছেন মামা।ভীষণ মজা করবো দুইজনে।

–না আসতে পারবো না।অনেক পড়া বাকি আছে।আর কলেজ যেতেই হবে রেগুলার।এখন একটা ক্লাসও মিস দেওয়া যাবে না।এই বলে তানিশা কল কেটে দিলো।

তন্নি বেশ অবাক হলো।তানিশা ভালোমন্দ কিছু জিজ্ঞেস না করেই এভাবে কল কেটে দিলো কেনো?

এদিকে তানিশা তন্নির কল কেটে দিয়ে সাথে সাথে তার বাবাকে কল দিলো।

তহিদুল সাহেব কল রিসিভ করতেই তানিশা বললো,বাবা আমি কিন্তু এখন কিছুতেই বিয়ে করবো না।
তহিদুল সাহেব তখন হাসতে হাসতে বললেন,হঠাৎ বিয়ের কথা বলছিস কেনো মা?আর কে তোকে বিয়ে দেবে এখন?
তানিশা তখন বললো আগেই জানিয়ে রাখলাম।যত ভালো কোনো ঘর আসে না কেনো ডাক্তার না হওয়া পর্যন্ত আমি বিয়ে করবো না।

–ঠিক আছে,ঠিক আছে।বিয়ে নিয়ে তোকে এতো ভাবতে হবে না।তুই মন দিয়ে শুধু পড়াশোনা কর।

তানিশা তখন বললো আচ্ছা বাবা আজ তাহলে রাখি,এই বলে তানিশা কল কেটে দিলো।তহিদুল সাহেব তানিশার কথা নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ভাবতে লাগলেন।হঠাৎ তানিশা তার বিয়ের কথা কেনো বললো?

কিছুক্ষণ পরেই তায়েব চৌধুরী ফোন দিলো তহিদুল সাহেব কে।আর জানিয়ে দিলো তিনি কাল আসছেন তানিশাদের গ্রামে।কিন্তু কেনো আসছেন সেটা বললেন না।তহিদুল সাহেব তো বেজায় খুশি সেই কথা শুনে।কারণ তায়েব চৌধুরী নিজেই আসতে চাচ্ছেন তাদের বাসায়।এর চেয়ে খুশির সংবাদ আর কি হতে পারে?

কথামতো পরের দিনই তায়েব চৌধুরী রওনা দিলেন তানিশাদের বাসায়।সাথে তাহমিনা চৌধুরী ও আছেন।হরেক রকমের মিষ্টি আর ফলমূল নিয়েছেন তারা।মনে হচ্ছে বিয়ে হয়েও গেছে।তায়েব চৌধুরী এতোটা আশা নিয়ে যাচ্ছেন সেখানে।আজ আর তন্নি, আমান বা নোমানকে নিলেন না।

তহিদুল সাহেব তায়েব চৌধুরী কে রিসিভ করার জন্য অনেক আগেই মেইন রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন।আর বার বার ফোন করতে লাগতেন।সেজন্য তায়েব চৌধুরীদের বাড়ি চিনতে বেশি কষ্ট হলো না।তারা সহজেই তানিশাদের বাড়ি পৌঁছে গেলো।

তানিশার মা শিউলি বেগম হরেক রকমের পিঠা আর তাদের নিজস্ব গাছের ফলমূল দিয়ে বানানো জুস নিয়ে হাজির হলেন।সবার আগে তিনি সালাম দিলেন তায়েব চৌধুরী কে।তায়েব চৌধুরী সাথে সাথে উত্তর দিয়ে নানা বিষয় এ গল্প করতে লাগলেন।
হঠাৎ রুমে সোহান আর তানিয়া প্রবেশ করলো।কারণ তারাও কাল এসেছে বাড়িতে।
তানিয়াকে দেখামাত্র তায়েব চৌধুরী বললো, মাশাল্লাহ মা,তুমি মনে হয় তানিশার বোন তাই না?
তানিয়া সেই কথা শুনে সালাম দিয়ে বললো,জি মামা।আমি তানিয়া।আর ইনি আমার হাজব্যান্ড। সোহান ও সালাম দিলো সবাইকে।
এদিকে তাহমিনা চৌধুরী শুধু ফুঁসছেন।তিনি মোটেও থাকতে চাচ্ছিলেন না।শুধু ভাইয়ের মন রক্ষার্থে চলে এসেছেন।কিছুক্ষণ গল্পসল্প করার পর তায়েব চৌধুরী আমানের কথা বললেন।সে যে পুলিশ অফিসার পদে জয়েন করছে সেটা শুনে সবাই বেশ খুশি হলো।তহিদুল সাহেব বলেই ফেললেন বাহঃ আমান বাবা পুলিশ অফিসার হবে এখন!ভালোই তো।

হঠাৎ তায়েব চৌধুরী তহিদুল সাহেবের হাত ধরে বললো,আমি একটা কথা বলতে চাই রাখতে হবে কিন্তু।
–কি কথা?বেশ আশ্চর্য হয়েই জিজ্ঞেস করলেন তহিদুল সাহেব।
তায়েব চৌধুরী তখন নির্ধিদ্বায় বললো, আমি তানিশাকে আমার বাড়ির বড় বউ হিসেবে চাচ্ছিলাম।যদি আপনারা সবাই রাজি থাকেন।
তহিদুল সাহেব সেই কথা শুনে বললো, কিন্তু তানিশা তো এখন কিছুতেই বিয়ে করবে না।সে ডাক্তার হবে তারপর বিয়ে করবে।
তায়েব চৌধুরী সেই কথা শুনে বললো, আমার আমান খুব পছন্দ করে তানিশাকে।সে তাকে বিয়ে করতে চায়।যদি তানিশা রাজি না থাকে বিয়ে করতে অন্তত রেজিস্ট্রার করে রাখা যায় আপাতত।
তহিদুল সাহেব ভীষণ বিপদের মধ্যে পড়ে গেলেন।তিনি বুঝতে পারলেন সেজন্য কাল তানিশা হঠাৎ বিয়ের কথা বললো।কিন্তু তানিশা যদি রাজি থাকতো তাহলে তো এভাবে বারণ করে দিতো না।এখন তহিদুল সাহেব কি উত্তর দেবেন বুঝতে পারলেন না।

তহিদুল সাহেব কে চুপচাপ থাকা দেখে তায়েব চৌধুরী বললেন,এতো কিসের চিন্তাভাবনা করছেন?আপনি মা তানিশার সাথে কথা বলে তবেই আমাদের জানিয়েন।তানিশা যদি রাজি থাকে তাহলে তো আলহামদুলিল্লাহ। আর যদি রাজি না থাকে তাহলে কারো কিছু করার নাই।তবে আপনাদের কাছে রিকুয়েষ্ট ওকে যদি একটু রাজি করাতেন খুব ভালো হতো।কারণ আমার ছোট ছেলের সাথে তন্নির বিয়েটাও দিতে চাই এখুনি।সেজন্যই এতো বেশি রিকুয়েষ্ট করছি।দুই বান্ধুবি এক বাসায় থাকলে খুব ভালো হবে।

তহিদুল সাহেব কথা দিলেন না।তবে বললেন তিনি তানিশার সাথে এ বিষয়ে আলোচনা করে তবেই ফাইনাল উত্তর দিবেন।

তায়েব চৌধুরী আর তাহমিনা চৌধুরী বেশ কিছুক্ষণ থাকলো তানিশাদের গ্রামে।তায়েব চৌধুরীর ভীষণ ভালো লেগেছে গ্রামটা।সেজন্য তিনি ঘুরেফিরে একটু দেখতে চাইলেন।এরই মধ্যে তন্নি ফোন দিয়ে জানালো নোমান এক্সিডেন্ট করেছে।নোমানের এক্সিডেন্টের কথা শুনে তায়েব চৌধুরী আর এক সেকেন্ড দেরী করলেন না।তাড়াতাড়ি করে রওনা দিলেন। অন্যদিকে তানিশার বাবা আর মাও নোমানের এক্সিডেন্টের কথা শুনে তায়েব চৌধুরীর সাথেই চলে আসলেন শহরে।

আমান আর তানিশার বিয়ের কথা শুনে নোমান নিজেকে ঠিক রাখতে পারছিলো না।সেজন্য রাগে দুঃখে আজও গাড়ি নিয়ে বের হয়েছিলো।কিন্তু আজ আর সে সুস্থ অবস্থায় ফিরে আসলো না।হঠাৎ পিছন দিক থেকে অন্য আরেকটা গাড়ি ধাক্কা মারায় নোমান গাড়িসহ খাদে পড়ে যায়।তখন স্থানীয় লোকেরা তাকে হাসপাতালে এডমিট করায়।নোমানের অবস্থা খুবই শোচনীয়। বাসায় শুধু তন্নি একাই আছে।সে একদম পাগলের মতো চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিলো।অবশেষে কোনো উপাই না দেখে সে তানিশাকে ফোন দেয়।তানিশা নোমানের এক্সিডেন্টের কথা শুনে আর এক সেকেন্ড দেরী করলো না।দৌঁড়ে হাসপাতালে চলে আসলো।তানিশার সাথে তার বান্ধুবী রিশা আর লিরাও এসেছে।
#চলবে,

#ডাক্তার_ম্যাডাম
#পর্ব_১৭(বোনাস পর্ব)
#মুমতাহিনা_জান্নাত_মৌ

নোমানের অবস্থা খুবই শোচনীয়। এখন পর্যন্ত জ্ঞান ফেরে নি তার।মাথায় প্রচন্ড ভাবে আঘাত পাওয়ায় সাথে সাথে সে অজ্ঞান হয়ে যায়।এজন্য এক মুহুর্ত দেরী না করে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট এবং নিউরো সার্জারির সুবিধা আছে এমন হাসপাতালেই নিয়ে আসা হয়েছে নোমানকে।নোমানকে পাশ ফিরিয়ে উপুড় করে শুইয়ে রাখা হলো যাতে বমি করলে তা ফুসফুসে চলে না যায়।এবার নোমান কে সাবধানে নড়াচড়া করা হচ্ছে কারণ ঘাড়ে চোট লাগলে বেকায়দায় তা বেড়ে গিয়ে অবস্থা গুরুতর হতে পারে। এদিকে আবার নোমানের তড়কা দিয়ে রক্ত পড়াও শুরু হইছে।ডাক্তার সেজন্য রক্ত পরিষ্কার করে কাপড় চাপা দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিলো।এবং যে জায়গা টা থেকে রক্তপাত হচ্ছে সেই জায়গাটা সেলাই করে দিলো।এদিকে স্যালাইন চালানো হচ্ছে,শ্বাসনালিতে নল ঢুকিয়ে শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক করা হচ্ছে।মাথার ক্ষত জায়গা সেলাই করে ব্যান্ডেজ করা হলো।আপাতত এইরকমই রাখা হলো নোমানকে।নোমানের জ্ঞান ফিরলে বা সে মোটামুটি সামলে উঠলে সিটি স্ক্যান করা হবে।স্ক্যান রিপোর্টের ফলাফল অনুযায়ী ডাক্তারেরা নোমানের চিকিৎসা পদ্ধতি শুরু করে দিবেন।

এদিকে এক এক করে নোমানের সকল আত্নীয়স্বজন আসা শুরু করলো।সবাই ভীষণ চিন্তার মধ্যে আছে।তন্নি নোমানের এমন অবস্থা দেখে সে নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়ছে।কখন যে সে কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়।তানিশা তো বোবার মতো চুপ হয়ে আছে।তবে তার ভিতরে একদম ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে।একটু জোরে জোরে কাঁদতে পারলে কিছুটা হালকা হতে পারবে সে।তানিশা আর তার কান্না চেপে রাখতে পারছে না,সেজন্য বাথরুমে চলে গেলো।আর জোরে জোরে চিৎকার করে করে কাঁদতে লাগলো।তার এই মুহুর্তে ইচ্ছে করছে নোমানের কাছে গিয়ে তার পাশে বসে তাকে নোমান নোমান বলে ডাক দিতে।কিন্তু তার যে কোনো অধিকারই নাই নোমানের পাশে বসার।তাকে নোমান নোমান বলে ডাকার অধিকারই নাই আর ছোঁয়ার তো প্রশ্নই আসে না।

রিশা আর লিরাও তানিশার পিছু পিছু চলে গেলো।তারা তানিশাকে এভাবে কাঁদতে দেখে বাথরুম থেকে বের করে আনলো।আর বললো,তানিশা শান্ত হ।প্লিজ তানিশা এভাবে কাঁদিস না।তানিশা তবুও থামছে না।লিরা তখন বললো,এর পরও বলবি তুই নোমানকে ভালোবাসিস না?কেনো লুকাচ্ছিস তোর ভালোবাসার কথা?আমরা জানলে কি ক্ষতি হবে?

তানিশা সেই কথা শুনে লিরার গলা ধরে আরো জোরে জোরে কাঁদতে লাগলো।রিশা তখন তানিশাকে শান্ত্বনা দিয়ে বললো,তানিশা চুপ কর।কাঁদলেই কি নোমান সুস্থ হয়ে যাবে।নামায পড়ে দোয়া কর আল্লাহর কাছে।

তানিশা সেই কথা শুনে হঠাৎ কান্না থামিয়ে দিলো তারপর অযু করে হাসপাতালের বারান্দায় একটা কাপড় বিছিয়ে দুই রাকাত নফল নামায আদায় করলো।আর আল্লাহর কাছে নোমানের প্রাণ ভিক্ষা চাইলো।নোমান যাতে তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যায় সেজন্য দোয়া করতে লাগলো।তানিশার চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি পড়তে লাগলো।তার কষ্ট কেউই বুঝতে পারছে না।আসলে কাউকে মন থেকে ভালোবাসলে তাকে কখনোই ভোলা যায় না।প্রিয় মানুষের ক্ষতি কেউই সহ্য করতে পারে না।তার বিন্দুমাত্র ক্ষতি হোক সেটা কেউ জীবনেও চাইবে না।আসলে প্রেম সঠিক হলে তাকে ভোলা অসম্ভব ব্যাপার।

তায়েব চৌধুরীরা এতোক্ষণে পৌঁছে গেলো হাসপাতালে। নোমানের এমন অবস্থা দেখে তিনি আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারছিলেন না।কিন্তু আমান তায়েব চৌধুরী কে বললো,বাবা চিন্তার কোনো কারণ নেই।এখন নোমানের জ্ঞান ফিরেছে।আরেকটু সুস্থ হলেই সিটি স্ক্যান করা হবে।ততোক্ষণ পর্যন্ত আমাদের সবাইকে একটু ধৈর্য্য ধরতে হবে।তায়েব চৌধুরী কিছুতেই মানতে পারছিলেন না।তিনি আমানের গলা ধরে মেয়ে মানুষের মতো জোরে জোরে কাঁদতে লাগলেন।
অন্যদিকে তহিদুল সাহেব আর শিউলি বেগমও তায়েব চৌধুরী কে শান্ত্বনা দিতে লাগলেন।তারা বোঝাতে লাগলেন এমনিতেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
তাহমিনা চৌধুরী তন্নির এমন অবস্থা দেখে খুবই ভয় পেয়ে গেলেন।কারণ তন্নি ভীষণ ভেংগে পড়েছে।সেজন্য তাহমিনা তন্নিকে বাসায় নিয়ে যেতে চাইলো।কিন্তু তন্নি কিছুতেই গেলো না।সে হাসপাতালেই থাকবে বলে জানালো।

সারাদিন সারারাত সবাই হাসপাতালেই পড়ে থাকলো।কারো চোখে কোনো ঘুম নাই।না আছে ক্ষুধা।সবাই শুধু নোমানের সুস্থ হওয়ার অপেক্ষায় আছে।তহিদুল সাহেব নিজ দায়িত্বে সবার জন্য হালকা কিছু খাবার কিনে আনলেন।কিন্তু টেনশনে কেউই কিছু খেলো না।তবুও তিনি জোর করেই খাওয়ালেন সবাইকে।তায়েব চৌধুরী এবার তহিদুল সাহেবের গলা ধরে কাঁদতে লাগলেন।নোমানের কষ্ট তিনি সহ্য করতেই পারছেন না।

তিন দিন পর নোমান মোটামুটি নড়াচড়া করলো।তার রক্ত পড়াও বন্ধ হয়েছে।সে তার ঠোঁট নাড়িয়ে কথা বলার চেষ্টা করতে লাগলো।ডাক্তার যখন দেখলো নোমান মোটামুটি অবস্থায় আছে এজন্য ডাক্তার নোমানকে সিটি স্ক্যান টেবিলে শুইয়ে দিলেন।তারপর টেবিলটি বৃত্তাকার একটি স্ক্যানারের মধ্যে নেওয়া হলো।যেখানে এক্সরে টিউব ও সেন্সর থাকে।টিউব ও সেন্সর খুব দ্রুত গতিতে ঘুরতে থাকে,তবে এটি বাইরে থেকে দেখা যায় না।এরপর নোমানকে কন্ট্রাস্ট মেটেরিয়াল ইনজেকশন হিসেবে শিরায় দিয়ে দেওয়া হলো।এসময় নোমানকে নড়াচড়া করতে বারন করা হলো।ইন্টারকমের মাধ্যমে বাহিরে থেকে নোমানের সাথে যোগাযোগ করা হচ্ছে।একটি স্বচ্ছ জানালা দিয়ে নোমানের উপর নজরও রাখা হচ্ছে।

সিটি স্ক্যান করার পর ডাক্তার জানালো ভয়ের কোনো কারণ নাই।যা ক্ষতি বাহিরেই হয়েছে।ভিতরে সব ঠিকঠাক আছে।মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ হয়েছে কিনা এজন্যই করা হয়েছিলো সিটি স্ক্যান।কিন্তু মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ হয় নি।অল্পের জন্য বেঁচে গেছে সে।তবে ভবিষ্যতে যেনো এরকম কোনো দূর্ঘটনা না ঘটে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।

নোমান যখন ভালোভাবে সবাইকে চিনতে পারলো আর কথা বলার ট্রাই করলো সবার আগে তন্নি ছুটে গেলো নোমানের কাছে।সে নোমানকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগলো।নোমান তখন বললো, এই পাগলি কাঁদছিস কেনো?আমি তো ঠিকই আছি।তন্নি তবুও থামলো না।সে আরো জোরে জোরে কাঁদতে লাগলো।ডাক্তার তখন বললো,কি করছেন?রোগীর সামনে এতো জোরে কাঁদছেন কেনো?এই বলে ডাক্তার বললো,এনাকে প্লিজ বাহিরে নিয়ে যান।তন্নি সেই কথা শুনে বললো না আমি বাহিরে যাবো না।এই বলে সে কান্না থামিয়ে দিলো।তায়েব চৌধুরী, আমান,তাহমিনা চৌধুরী সবাই নোমানের পাশে গিয়ে বসলো।তবে তারা কেউ কোনো কথা বললো না।

ওদিকে তানিশা দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।সে না পারছে নোমানের কাছে আসতে না পারছে হাসপাতাল থেকে চলে যেতে।সে যে নোমানের কেউই হয় না। নোমানের পাশে গিয়ে বসার বা তাকে ভালোমন্দ কিছু জিজ্ঞেস করার কোনো অধিকারই নাই তার।তানিশার এসব মনে হতেই চোখে জল চলে এলো।সে তখন মনে মনে ভাবতে লাগলো নোমান যখন তার কেউ হয় ই না তাহলে তার জন্য এতো কেনো কষ্ট হচ্ছে তার?ব্যাথায় বুকটা ফেটে যাচ্ছে।মনে হচ্ছে পুরো দুনিয়া তার বিপক্ষে চলে গেছে।

নোমান হঠাৎ তানিশাকে খেয়াল করলো।সে তানিশাকে দেখামাত্র আর চোখ ফিরিয়ে নিতে পারলো না।নোমানের এমন তাকানো দেখে তানিশা চোখ মুছতে মুছতে নোমানের কাছে চলে এলো।বাট নোমানের পাশে বসার সাহস পেলো না। বা তাকে কিছু জিজ্ঞেস করার ও সাহস হলো না তার।অন্যদিকে নোমান মনে মনে বললো,কি দরকার ছিলো এখানে আসার?তোমাকে দেখলে আমি আরো বেশি অসুস্থ হয়ে যাবো।তার চেয়ে বরং চলেই যাও।এই ভেবে নোমান এবার তার চোখ ফিরিয়ে নিলো।

নোমান তানিশার বাবা মাকে দেখে বললো,আংকেল,আন্টি আপনারাও এসেছেন?

–জ্বি বাবা।তোমার দূর্ঘটনার খবর শুনে আর এক মুহুর্ত থাকতে পারলাম না।এই বলে তারাও নোমানের কাছে চলে গেলো।আর সে এখন কেমন আছে সেটা জিজ্ঞেস করলো।

এদিকে তন্নি নোমানকে খাওয়ানোর জন্য স্যুপ রেডি করে আনলো।তারপর নিজের হাতে তাকে খাইয়ে দিতে লাগলো।।নোমান খাচ্ছে আর তানিশার দিকে তাকাচ্ছে।এবার নোমান বললো,তন্নি ভালোভাবে খাওয়া।
তানিশা এই দৃশ্য দেখে আর রুমের ভিতর থাকতে পারলো না।সে রুম থেকে বের হয়ে গেলো।তানিশাকে চলে যাওয়া দেখে নোমান মনে মনে হাসতে লাগলো।আর ভাবতে লাগলো তাহলে এই কাহিনী!

এদিকে তানিশাকে বাহিরে যাওয়া দেখে রিশা আর লিরাও চলে গেলো।তার তানিশার হাত ধরে বললো,নোমান কি তোকে ভালোবাসে? না তুই একাই নোমানকে ভালোবাসিস?
তানিশা চুপচাপ থাকলো।
লিরা তখন বললো, রিশা তুই চুপ থাক তো।ও যখন বলতে চাচ্ছে না তখন কেনো জোর করে শুনতে চাচ্ছিস?
তানিশা এতোক্ষণে মুখ খুললো।সে সমস্ত কথা তাদের সাথে শেয়ার করলো।তারপর বললো,এখন তোরাই বল আমার কি করা উচিত?

রিশা তখন বললো, কি করা উচিত মানে?আলবত নোমানকে তোর ভালোবাসার কথা জানানো উচিত।আগে নিজের চিন্তা তারপর পরের চিন্তা।
লিরা তখন বললো, তুই কি সহ্য করতে পারবি যখন নোমান তন্নিকে সত্যি সত্যি বিয়ে করবে?
তানিশা সেই কথা শুনে লিরার দিকে তাকালো।লিরা তখন তানিশাকে জড়িয়ে ধরে বললো,তন্নি সামান্য স্যুপ খাওয়াচ্ছে আর সেটাই তোর সহ্য হলো না,তুই বাহিরে চলে আসলি।আর সারাজীবন যখন সে নোমানকে নিজের করে নিবে তখন কিভাবে সহ্য করবি?

তানিশা তখন কাঁদতে কাঁদতে বললো,তাহলে সারাজীবন আমি তন্নিকে কাঁদিয়ে ওর চোখের সামনে একই বাড়িতে কি করে থাকবো?ওর মনের অবস্থা তখন কি হবে?আমার যেমন কষ্ট হচ্ছে ঠিক ওর ও তো এমন কষ্টই হবে?
লিরা তখন বললো, থাক তোকে কিছু বলতে হবে না। আমি কথা বলবো তন্নির সাথে।আর নোমানকেও বলবো।

–না,না।লিরা এ কাজ কখনোই করবি না তুই।প্লিজ তোর দুটি পায়ে পড়ি।তন্নি সহ্য করতে পারবে না।দেখলি না নোমানের এক্সিডেন্ট হওয়াই সে কত টা ভেংগে পড়েছিলো।
রিশা তখন বললো, তুই ও তো ভেংগে পড়েছিস।

–বাদ দে এসব কথা।চল আমরা এখন চলে যাই হোষ্টেলে।তন্নি জিজ্ঞেস করলে বলবি পরীক্ষা আছে।তা না হলে আমাকে আবার তন্নি জোর করেই ওদের বাড়ি নিয়ে যাবে।
এই বলে তানিশা আবার নোমানের রুমে ঢুকলো।গিয়ে দেখে তন্নি নোমানকে পানি খাওয়াচ্ছে।
নোমান তানিশাকে দেখে বললো,তন্নি মুখ টা মুছে দিলি না?
তন্নি সেই কথা শুনে হাত দিয়ে নোমানের মুখটি মুছে দিলো।
তন্নির এমন সেবা করা দেখে তায়েব চৌধুরী ভীষণ খুশি হলেন।আর মনে মনে ভাবলেন যাক অবশেষে নোমানের দেখাশোনা করার লোক পাওয়া গেলো।তন্নি খুব যত্ন করে নোমানকে দেখে রাখবে।

তানিশাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা দেখে তায়েব চৌধুরী বললেন, মা তানিশা এখানে এসে বসো।

–না মামা।আমি এখন বসবো না।আমাকে হোষ্টেলে যেতে হবে।

–না,আজ আর হোষ্টেলে যাও না।তোমার বাবা মাকে নিয়ে আমাদের বাসায় থাকবে আজ।তোমার মা এই প্রথমবার এলো আমাদের এখানে।সেজন্য তুমিও থাকবে ওনাদের সাথে।

–কিন্তু মামা আমার খুব ইম্পর্ট্যান্ট একটা পরীক্ষা আছে।আমাকে যেতেই হবে হোষ্টেলে।

আমান সেই কথা শুনে বললো, আমি রেখে আসবো কলেজে।কোনো সমস্যা হবে না।

নোমান তখন হঠাৎ করেই তানিশাকে বললো,
হ্যাঁ ভাবি, থেকে যান।ভাইয়া যখন নিজের মুখে বলছে তখন আর না কইরেন না।কলেজে সময়মতো রেখে আসবেন ভাইয়া।

আমান সেই কথা শুনে নোমানকে বললো, কি বলছিস এসব সবার সামনে?

নোমান তখন তানিশার দিকে তাকিয়ে বললো,খারাপ কি বললাম?ভাই এর বউ তো ভাবিই হয়।

তানিশা সেই কথা শুনে নোমানের কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো,আপনি কি করে বুঝলেন যে আমার সাথেই আপনার ভাই এর বিয়ে হবে?

নোমান তখন বললো,কেনো তুমি জানো না কিছু?পুরো পরিবার রাজি,ভাইয়া রাজি,তোমার পরিবার রাজি।তাহলে তো ভাইয়ার সাথেই বিয়ে ফাইনাল তোমার।

–আমি রাজি কিনা সেটা তো বললেন না?

নোমান তখন হাসতে হাসতে বললো,আমি নিশ্চিত তুমিও রাজি।আর সেজন্যই তো,,,,,। নোমান হঠাৎ থামিয়ে গেলো।সে আর বললো না কিছু।সে বলতে চেয়েছিলো তুমি ভাইয়াকে বিয়ে করবে দেখেই আমার প্রপোজ এক্সসেপ্ট করো নি।আমাকে মুখের উপর না করে দিয়েছো।

তানিশা এবার নোমানের সাথে অযথা কথা বলে সময় নষ্ট করলো না।সে তায়েব চৌধুরী কে বললো,মামা আমি একটা কথা বলতে চাই।

–কি কথা মা?

–আমি আমান ভাইয়াকে সবসময় ভাই এর চোখে দেখে আসতেছি।তাকে কখনোই আমি আমার স্বামী ভাবতে পারবো না।প্লিজ মামা আমাদের সম্পর্ক টা এভাবে শেষ করবেন না।আমি আমান ভাইয়াকে কখনোই বিয়ে করতে পারবো না।প্লিজ মামা বোঝার চেষ্টা করুন।এভাবে জোরজবরদস্তি করে কখনোই বিয়ে হয় না।

তায়েব চৌধুরী একদম হা করে তাকিয়ে রইলো তানিশার দিকে।তানিশা এসব কি বলছে?এরকম উত্তর তিনি কখনোই আশা করেন নি।অন্যদিকে তানিশার বাবা মাও অবাক।

আমান তানিশার কথা শুনে ভীষণ মন খারাপ করলো। সেজন্য সে রুম থেকে চলে যেতে ধরলো।তখন তানিশা বললো,ভাইয়া দাঁড়ান প্লিজ।আগেই যাবেন না।আমার কিছু কথা প্লিজ শুনে যান।

আমান তখন বললো কি আর শুনবো তোমার কথা?তুমি তো বলেই দিলে আমাকে বিয়ে করবে না।আমি কোনো মন খারাপ করি নি। কারণ এসব প্রেম ভালোবাসা বিয়ে কখনোই জোর করে আদায় করা যায় না।আমি একপাক্ষিক ভাবে শুধু ভালোবাসলেই তো হবে না।অপরজনকেও তো ভালোবাসতে হবে।এই বলে আমান চোখ মুছতে মুছতে রুম থেকে বের হয়ে গেলো।

তানিশা বুঝতে পারলো আমানের সত্য টা মেনে নিতে খুবই কষ্ট হচ্ছে।কিন্তু আজ যদি তানিশা সত্য টা না প্রকাশ করতো তখন আমান হয় তো তার পথ চেয়েই বসে থাকতো সারাজীবন।
আমান সত্যি তানিশাকে অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছে।কিন্তু কিছুই করার নাই তানিশার।সে কখনোই আমানকে বিয়ে করতে পারবে না।আমানকে স্বামী হিসেবে ভাবতেই তার পুরো শরীর শিউরে ওঠে।

হঠাৎ তাহমিনা চৌধুরী তার ভাই এর হাত ধরে বললো,ভাই তানিশা তো আমানকে বিয়ে করবে না বলে না করে দিলো।এখানে তো কারো কিছু করার নাই।এখন তাহলে তন্নি আর নোমানের বিয়েটা এনাউন্স করে দাও।তা না হলে দেখা যাবে নোমানও মুখের উপর না করে দিয়ে বলবে, আমি তন্নিকে বিয়ে করতে পারবো না।
তায়েব চৌধুরী সেই কথা শুনে বললো,তানিশা আমার আপন কেউ হয় না।সেজন্য ওর উপর আমি জোর খাটাতে পারলাম না।কিন্তু তানিশা যদি আমার নিজের কেউ হতো অবশ্যই ওকে আমি রাজি করাতাম।সে কখনোই আমার মুখের উপর না করতে পারতো না। কিন্ত নোমান আমার ছেলে আর তন্নিও আমার আপন ভাগ্নি।এদের কে আমি যা করতে বলবো এরা তাই করবে।আমার মুখের উপর কথা বলার সাহস এদের জীবনেও হবে না।

নোমান তার বাবার কথা শুনে বললো,বাবা কি বলছো এসব?তন্নির সাথে আমার বিয়ে মানে?

–হ্যাঁ তন্নির সাথে তোমার বিয়ে আমি অনেক আগেই ঠিক করে রেখেছি।তুমি সুস্থ হলেই শুভকাজ টা তাড়াতাড়ি সারতে চাই আমি।

–কিন্তু বাবা আমার তো পড়াশোনা এখনো শেষ হয় নি।পড়াশোনা কম্পিলিট না হতেই কিসের বিয়ে?তাছাড়া তন্নি আমার বোনের মতো।

তায়েব চৌধুরী সেই কথা শুনে চিৎকার করে বললো, স্টপ!আমার মুখের উপর কথা বলার সাহস কই পেলি?তুই তানিশা নস,যে কিছুই বলবো না।ভুলে যাস না।
তুই আমার ছেলে।আমি যা ডিসিশন নিবো সেটাই ফাইনাল।এই বলে তায়েব চৌধুরী রুম থেকে বের হয়ে গেলেন।

তায়েব চৌধুরী আসলে তানিশার উপর রাগ ঝাড়তে না পেরে সেই রাগ নোমানের উপর ঝাড়লেন।তায়েব চৌধুরী ভীষণ মন খারাপ করেছেন তানিশার উপর।তানিশা যে তার স্বপ্নটাই ভেংগে চুরমার করে দিয়েছে।

নোমান বুঝতে পারলো না কিছু।সে কি করবে এখন?তানিশা যদি তাকে আশ্বাস দিতো তাহলে তার কথা সে তার বাবাকে বলে দিতো।এখন নোমান যদি তার বাবাকে বলে সে তানিশাকে ভালোবাসে কিন্তু তানিশা যদি আবার বলে সে ভালোবাসে না নোমানকে তখন তো তার বাবা আরো ভীষণ ভাবে রেগে যাবেন।সেজন্য নোমান পুরো সিদ্ধান্ত তানিশার উপর ছেড়ে দিলো।তানিশা যদি নিজের মুখে এসে নোমানকে বলে যে আমি আপনাকে ভালোবাসি।প্লিজ তন্নিকে বিয়ে করবেন না তবেই নোমান তানিশার কথা তার বাবাকে জানাবে।

#চলবে,

#ডাক্তার_ম্যাডাম
#পর্ব_১৮
#মুমতাহিনা_জান্নাত_মৌ

তায়েব চৌধুরী তানিশার উপর একটু বেশিই মন খারাপ করেছেন।সেজন্য তিনি পরের দিন থেকেই আমানের জন্য পাত্রী দেখা শুরু করে দিলেন।কিন্তু আমান সাফ জানিয়ে দিলো সে এখনি বিয়ে করবে না।আসলে আমানের মনে যে এখনো তানিশার নামই লেখা আছে।এতো সহজে কি করে সে নাম ভুলে যায় সে?অন্যদিকে নোমান তানিশার অপেক্ষায় বসে আছে।কখন এসে তানিশা বলবে আই লাই ইউ নোমান।কিন্তু তানিশা একবারের জন্যও নোমানের কাছে এলো না।না একটা মেসেজ দিলো সে।নোমান সেজন্য ধরে নিলো তানিশা তাকে সত্যি ভালোবাসে না।সে নিছক অপেক্ষা করছে তানিশার জন্য।এখন তানিশার মনে কি চলছে সেটাই দেখার পালা।

আজ তানিশা কলেজ যাবে না বলে রিশা আর লিরাকে
জানিয়ে দিলো।রিশা আর লিরা যখন জানতে চাইলো সে কেনো যাবে না তখন উত্তরে তানিশা বললো,তন্নি দেখা করতে আসবে।সে আমার সাথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চায়।
তানিশার কথা শুনে রিশা আর লিরা দুইজন দুইজনার দিকে তাকালো।
তারপর রিশা আর লিরা বললো,দোস্ত,তন্নি আজ তোকে কি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবে তা আমরা জানি না তবে তুই আজ অন্তত তন্নিকে তোর ভালোবাসার কথা জানিয়ে দিস।তুই নিজের মুখে বললে ও নিশ্চয় আর নোমানকে বিয়ে করতে রাজি হবে না।তোদের ভালোবাসার কথা শুনলে ও আরো খুশিই হবে।একবার বলেই দেখ না?
তানিশা কোনো উত্তর দিলো না।সে চুপচাপ রেডি হতে লাগলো।এদিকে রিশা আর লিরা হোষ্টেল থেকে বের হয়ে গেলো।

তানিশা আজ সুন্দর একটা কচুর পাতা কালারের থ্রি পিচ পড়লো।।যার ওড়না আর পায়জামা পিংক কালারের ছিলো।তানিশা তার লম্বা চুলগুলোকে বেনুনি করে নিলো।তারপর মুখে একটু ক্রিম আর পাউডার লাগিয়েও নিলো।ঠোঁট দুটি তার কেমন যেনো শুষ্ক লাগছিলো সেজন্য হালকা করে একটু পিংক কালারের জেল লাগালো।তারপর কাঁধে একটা ব্যাগ নিয়ে হোষ্টেল থেকে বের হলো।

তানিশা প্রথমে একটা রিক্সায় উঠলো তারপর বললো মামা পার্কে চলুন।তানিশাকে ভীষণ চিন্তিত দেখা যাচ্ছিলো।সে নিজেও জানে না আজ কি হতে চলেছে।তবুও সাহস নিয়ে যাচ্ছে সে।আসলে সে নিজেও আজ নোমান আর তার মধ্যকার সম্পর্ক টা নিয়ে তন্নির সাথে আলোচনা করতে চায়।তন্নিকে জানাতে চায় ব্যাপারটা।তন্নির মনোভাব জেনে তবেই সে নোমানকে তার মনের কথা জানাবে।তবে তানিশার ভীষণ ভয় হতে লাগলো।তন্নি কি আদৌ ব্যাপারটাকে সহজভাবে নিতে পারবে?

তানিশা রিক্সা থেকে নামতেই দেখে তন্নি অনেক আগেই এসেছে।তানিশাকে দেখামাত্র তন্নি নিজেই এগিয়ে আসলো।আর তার হাত ধরে পার্কের ভিতর নিয়ে গিয়ে একটা বেঞ্চে বসলো।তন্নিকে ভীষণ চিন্তিত দেখা যাচ্ছিলো। তানিশা বুঝতে পারলো না তন্নি কি এমন গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবে যে এতো সকাল সকাল তাকে আসতে বললো?

তানিশা নিজেও কিভাবে শুরু করবে বুঝতে পারছিলো না।তখন তন্নি বললো তুই এমন মুখ কালো করে আছিস কেনো?কিছু কি বলবি?তানিশা তখন বললো আগে তুই বল।কি জন্য ডেকেছিস আমাকে যা ফোনে বলা যেতো না।
তন্নি তখন বললো আমি তো বলবোই। তার আগে তোর কথা শুনতে চাই।
তানিশা বুঝতে পারছে না কিছু।তন্নি এভাবে তাকে জোর করছে কেনো?তারপর আবার ভাবলো যখন তন্নি তাকে বলতে বলছেই তাহলে এই সুযোগে তার বলা উচিত।

তানিশা তখন তন্নির হাত ধরে বললো, তন্নি তুই তো তোর নোমান ভাইয়াকে অনেক বেশি ভালোবাসিস কিন্তু তোর নোমান ভাইয়া কি তোকে ভালোবাসে?

তন্নি সেই কথা শুনে হাসতে হাসতে বললো তোর মনের মধ্যে কি এতোক্ষণ এই কথাটিই ঘুরপাক খাচ্ছে?

তানিশা তখন বললো আমি কিন্তু ফান করছি না।প্লিজ আমার প্রশ্নের উত্তর দে।
তন্নি তখন বললো হ্যাঁ ভালোবাসে।সেইজন্যই তো কাল মামা এনাউন্স করেই দিলো আমাদের বিয়ের।আর দেখলি না নোমান ভাইয়াও কিছু বললো না।

তানিশা তখন বললো, তুই তাহলে বুঝতে পারিস নি ব্যাপারটা।তোর নোমান ভাইয়া যে বললো তোকে উনি বোনের চোখে দেখেন।তোকে কিছুতেই বিয়ে করতে পারবে না সে।শুনিস নি এটা?

এই কথা শোনামাত্র তন্নির চোখ জলে ছলছল করতে লাগলো।সে তখন কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,কিন্তু মামা তো এটাও বললো যে তিনি যা সিদ্ধান্ত নিবেন সেটাই শুনতে হবে নোমান ভাইয়াকে।মামার সিদ্ধান্তের বাহিরে নোমান ভাইয়া কিছুতেই যেতে পারবেন না।
তানিশা তখন বললো তাই বলে তুই ওনার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে করবি?এভাবে জোর করে বিয়ে করে তুই কিন্তু মোটেও শান্তি পাবি না।
তন্নি হঠাৎ চিৎকার করে বলে উঠলো এতে তোর কি প্রবলেম?আমি জোর করে বিয়ে করছি না ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে করছি?
তানিশা তন্নির এমন রাগান্বিত চেহারা থেকে থ হয়ে গেলো।তন্নিকে তো এখনো সে বলেই নি কিছু আর তাতেই সে যেরকম আচরণ করছে আর যদি সে সত্য টা শোনে তাহলে যে কি করবে ভাবতেই তানিশার শরীর শিউরে উঠলো।

তানিশা এবার তন্নিকে অন্য কৌশলে বলার চেষ্টা করলো।তানিশা তখন বললো তন্নি একটু বোঝার চেষ্টা কর।তোর নোমান ভাইয়া কিন্তু তোকে মোটেও ভালোবাসেন না।তিনি অন্য আরেকজন কে ভালোবাসেন।যদি তুই জানতে চাস উনি কাকে ভালোবাসেন আমি সেটা বলে দিতে পারি।কারণ আমি জানি সেটা।

তন্নি সেই কথা শুনে হঠাৎ একটা কার্ড বের করে বললো,নোমান ভাইয়া কাকে ভালোবাসে সেটা আমার দেখার বিষয় নয় এখন।ওনার সাথে আমার বিয়ে হচ্ছে এটাই এখন বাস্তব।
তানিশা কার্ড টা হাতে নিয়ে তন্নির দিকে তাকিয়ে বললো কিসের কার্ড এটা?
তন্নি তখন বললো খুলে দেখ কিসের কার্ড?

তানিশা সাহস করে খুলেই ফেললো কার্ডটা।সে স্পষ্ট দেখতে পেলো বর আর কনের জায়গায় নোমান আর তন্নির নাম লেখা।
হঠাৎ তন্নি কার্ড টা কেড়ে নিলো তানিশার থেকে।আর বললো,এই জন্যই ডেকেছিলাম তোকে।আর এটাই আমার সেই গুরুত্বপূর্ণ কথা।নোমান ভাইয়ার সাথে আমার বিয়ে ফাইনাল হয়ে গেছে। বিয়েটা ঘরোয়াভাবে হচ্ছে এজন্য তোকে দাওয়াত দিতে পারলাম না।সরি।তাছাড়া তোর উপর আমাদের পরিবারের আর কোনো সদস্যের ইন্টারেস্ট নাই। সবাই ভীষণ মন খারাপ করেছে তোর উপর।মামা তো সেই লেভেলের রেগে আছেন,তিনি তো তোর মুখ আর কোনোদিনই দেখবেন না,অন্যদিকে আমান ভাইয়াও ভীষণ মন খারাপ করেছেন।তিনিও চান না তুই আর দ্বিতীয় বার আমাদের বাসায় আয়।আমাকেও সবাই বারণ করে দিয়েছে যেনো আমি তোর সাথে আর কোনো সম্পর্ক না রাখি।তোর সাথে কোনো যোগাযোগ ও না করি।আমি এখন কি করতে পারি বল?পরিবারের কথা না শুনলে বাসায় আর কেউ ঢুকতে দেবে না আমাকে।সেজন্য আমি সিদ্ধান্ত নিলাম সবাই যখন চাচ্ছে আমরা আর দেখা না করি, আর কোনো যোগাযোগ ও না করি তাহলে সেটাই হবে।এটাই আমাদের শেষ দেখা।ভালো থাকিস।এই বলেই তন্নি চোখের পানি মুছতে মুছতে চলে গেলো।সে আর এক সেকেন্ডও দেরী করলো না।

এদিকে তানিশা তার জায়গাতেই দাঁড়িয়ে রইলো।তন্নির কথাবার্তা শুনে তো সে একদম বোবা হয়ে গেলো।তন্নি তাকে এসব কি শুনিয়ে গেলো?তানিশা আর এক পাও এগোতে পারলো না।সে হঠাৎ মাথা ঘুরে পার্কের মধ্যেই পড়ে গেলো।কিন্তু পার্কের আশেপাশে রিশা আর লিরাও ছিলো।তারা সাথে সাথে রিক্সায় করে তানিশাকে হোষ্টেলে নিয়ে গেলো।

আসলে লিরা আর রিশা তানিশার কষ্ট কিছুতেই সহ্য করতে পারছিলো না।তানিশাকে সারাক্ষণ এভাবে চিন্তিত দেখে তারা সিদ্ধান্ত নিলো তন্নিকে জানাবে ব্যাপারটা।তন্নি আর তানিশা যেহেতু বেস্ট ফ্রেন্ড নিশ্চয় তন্নি বুঝতে পারবে ব্যাপারটা।যেহেতু নোমান নিজেও তানিশাকে প্রচন্ড ভালোবাসে সে হিসেবে তানিশার সাথে নোমানের মিল হওয়াটা খুব জরুরি ।যেই ভাবা সেই কাজ।তারা কাল রাতেই তানিশা আর নোমানের মধ্যকার সম্পর্কের কথা বলে দেয় তন্নিকে।রিশা আর লিরা ভেবেছিলো তন্নি বুঝতে পারবে ব্যাপারটা আর সেজন্যই তানিশাকে ডেকেছিলো।কিন্তু তন্নি যে এতো স্বার্থপর একটা মেয়ে সত্যি তাদের জানা ছিলো না।

তন্নি কাল রিশা আর লিরাকে কিছু না বললেও আজ সে পরিষ্কার করে তানিশাকে বুঝিয়ে দিয়ে গেলো যে সে নোমানকে কারো হতে দেবে না।নোমান তাকে পছন্দ করুক বা না করুক তবুও সে নোমানকেই বিয়ে করতে চায়।নোমানকে পাওয়ার জন্য তন্নি শেষ পর্যন্ত তানিশার সাথে তার এতোদিনের বন্ধুত্নের সম্পর্ক নষ্ট করে ফেললো।তাকে স্পষ্ট করে বলে দিলো সে যেনো আর তাদের বাসায় না যায় এমনকি তাদের কারো সাথে কথাও না বলে।

রিশা আর লিরা ভীষণ টেনশনের মধ্যে পড়ে গেলো।কারণ এখন পর্যন্ত তানিশার জ্ঞান ফেরে নি।তানিশা তন্নির কথা শুনে ভীষণ শকড পেয়েছে।সে ভাবতেও পারে নি তন্নি এইভাবে তাদের মধ্যকার সম্পর্ক নষ্ট করে ফেলবে।
অবশেষে তানিশার জ্ঞান ফিরলো।তবে সে চোখ মেলে তাকাতেই তাড়াতাড়ি করে উঠতে ধরলো।কারণ সে যে তার বিছানায় শুয়ে আছে।কিভাবে সে তার রুমে আসলো কিছুই বুঝতে পারলো না তানিশা।তানিশাকে ওঠা দেখে লিরা আর রিশা বললো,উঠছিস কেনো?শুয়ে থাক।
তানিশা তা শুনে বললো, না আমি ঠিক আছি।তার আগে বল আমি কিভাবে এলাম এখানে?
লিরা আর রিশা চুপ করে রইলো।
তানিশা তখন বললো তোরাও পার্কে গিয়েছিলি?
–হুম।
–কেনো গিয়েছিলি?তানিশা চিৎকার করে বলতে লাগলো।
লিরা আর রিশা তখন তানিশাকে আবার শুইয়ে দিলো আর বললো, দোস্ত শান্ত হ।আমরা তোর কতটা আপন জানি না তবে তোর কষ্টে আমাদেরও ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।যদি আমরা তোর মনের আশা পূরণ করে দিতে পারতাম তাহলে খুব ভালো লাগতো।প্লিজ দোস্ত বাস্তবতা বুঝতে শেখ। তুই ওই মেয়ের জন্য কতটা সেক্রিফাইজ করলি আর ও তোকে উলটো বাঁশ দিয়ে চলে গেলো।এখনো সময় আছে নোমানকে তুই সবটা পরিষ্কার করে বলে দে।তা না হলে কিন্তু আমরাই বলে দিবো নোমানকে।

তানিশা তখন রিশা আর লিরার হাত তার মাথায় রেখে বললো,দোহাই লাগে দোস্ত,এই কাজ কখনোই করবি না তোরা।ওদের কে ভালো থাকতে দে।তাছাড়া অনেক লেট হয়ে গেছে।ওদের বিয়ে ফাইনাল হয়ে গেছে।এই সময়ে আমি কোনো অশান্তি চাই না।

লিরা তখন বললো কিন্তু নোমান নাকি তোকে ভালোবাসে তাহলে কি করে এই বিয়েটা সে করছে?এটা আবার কোন স্টাইলের ভালোবাসা?ও যদি মন থেকে ভালোবাসতো তোকে তাহলে কখনোই এভাবে বিয়েতে রাজি হতো না।অন্তত আরেকবার তোকে বলতে পারতো বা তার পরিবারকে জানাতো তোর কথা।

তানিশা সেই কথা শুনে বললো,আমার কপালে মনে হয় এটাই লেখা ছিলো সেজন্য এরকম হলো আমার ভাগ্যটা।আচ্ছা তোরা বাদ দে এসব কথা এখন।ওদের জন্য দোয়া কর।আমিও ওদের জন্য অনেক অনেক দোয়া করবো।এই কথাগুলো বলতেই তানিশার চোখে জল এসে গেলো।সে হঠাৎ লিরাকে জড়িয়ে ধরে জোরে জোরে চিৎকার করে করে কাঁদতে লাগলো।তার চোখের পানি আজ কিছুতেই বাঁধ মানছে না।সে আজ ইচ্ছা মতো কেঁদে নিলো।তারপর নিজেই নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করলো আর কখনোই নোমানের কথা ভাববে না।নোমান যেহেতু এখন তন্নির হাজব্যান্ড সেহেতু নোমানকে নিয়ে ভাবাও এক ধরনের পাপ কাজ হবে।

রিশা আর লিরা মনে মনে ভাবতে লাগলো হায় রে তানিশা!বুকের মধ্যে কষ্ট জমা রেখে এইভাবে নিজেকে শান্ত্বনা দিচ্ছিস?তুই কি সত্যি নোমানকে ভুলতে পারবি?মনে তো হয় না পারবি।
আসলেই তানিশা এখন পর্যন্ত নোমানকে ভুলতে পারে নি।আজও রাতের পর রাত শুধু তার কথাই মনে হয় তানিশার।নোমানের হয় তো হয় না কিন্তু তানিশা আজও অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে।আজও সেই স্মৃতি তার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে।নোমান তাকে কতবার বুকের সাথে জড়িয়ে ধরেছে আর তার মুখে ভালোবাসি শব্দ টা শুনতে চেয়েছে।কিন্তু তানিশা শুধুমাত্র তন্নির কথা ভেবেই তার ভালোবাসাকে শেষ করে ফেলেছিলো সেদিন।
সেদিনের পর থেকে আর কোনোদিনই নোমান বা তন্নি দুইজনের একজনও তানিশার সাথে দেখা করে নি বা কল করে নি।অন্যদিকে তানিশাও নিজের থেকে কারো সাথে যোগাযোগ করে নি।তাদের সম্পর্কের ইতি এইভাবেই হয়ে যায়।
কে এখন কি অবস্থায় আছে কেউই সেটা জানে না।

|||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||

পুরনো স্মৃতি মনে হতেই তানিশার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে লাগলো।সে এতোক্ষণ তার স্বপ্নের জগতে হারিয়ে গিয়েছিলো।

❝কি হলো ডাক্তার ম্যাডাম?কোন জগতে এভাবে হারিয়ে গেলেন?❞
সহকারী ডাক্তারের কথা শুনে তানিশা একদম চমকে উঠলো।সে ভুলেই গিয়েছিলো এখন তন্নির সিজার করা হবে।তন্নির চোখ বাধা ছিলো বিধায় সে তানিশাকে এখনো দেখে নি।
তানিশা সেজন্য তাড়াতাড়ি করে তন্নির অপারেশন শুরু করে দিলো।পুরো অপারেশন কম্পিলিট হতে ৩০-৪০ মিনিট সময় লাগলো তার।

অপারেশনের পরপরই তন্নিকে অপারেশন কক্ষের বাইরে অন্য আরেকটা রুমে নিয়ে আসা হয়। এদিকে তন্নির হাজব্যান্ড ইকবাল তার মেয়েকে কোলে নিয়ে একের পর এক গল্প করতে লাগলো।সে ভীষণ খুশি।তবে তন্নির শাশুড়ির মন টা একটু খারাপ।তিনি বোধ হয় ছেলে বাচ্চা চেয়েছিলেন।তন্নির বড় মেয়েও ভীষণ খুশি ছোট বোনকে পেয়ে।আর বাচ্চাটা কি সুন্দর ফুটফুটে হয়েছে!দেখলেই আদর করতে ইচ্ছা করবে সবার।
তন্নি সজাগই আছে। সেজন্য তার সদ্য ভূমিষ্ট হওয়া মেয়েকে বুকের দুধ পান করানোর জন্য ইকবাল তন্নির পাশে রাখলো।তন্নিও ভীষণ খুশি মেয়েকে পেয়ে।ইকবাল খুশিতে তন্নির কপালে একটা কিস করলো। তন্নি তখন হেসে বললো,কি করছো সবার সামনে?ইকবাল তখন মুচকি একটা হাসি দিয়ে বললো নিজেরই তো বউ।
ইকবাল আর তন্নিকে দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তারা বেশ সুখে আছে।কি মিল দুইজনের মধ্যে!দুইজনের মুখেই সুখের হাসি!

তাহলে নোমান কোথায়?
তানিশা বুঝতে পারছে না কিছু।আর ইকবালের সাথেই বা তন্নির কিভাবে বিয়ে হলো?নোমানের সাথে কেনো তন্নির বিয়ে হলো না?তানিশা এসব প্রশ্নের উত্তর এখন কার থেকে শুনবে?

#চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে