#ডাক্তার_ম্যাডাম
#পর্ব_১৪
#মুমতাহিনা_জান্নাত_মৌ
তন্নি জিদ ধরে বসলো তানিশাকেই প্রথম বলতে হবে কে তার ভালোবাসার মানুষ? কিন্তু তানিশা সরাসরি বলতে পারলো না।সে তখন তন্নিকে বললো,ছেলেটি তোর চেনাজানার মধ্যে। এখন গেস কর,কে হতে পারে?
–আর কিছু ক্লু দে।চেনাজানার মধ্যে অনেক ছেলেই তো আছে।
তানিশা তখন চোখ বন্ধ করে বললো,তোর,,,,, ভাইয়া আমাকে প্রোপোজ করেছেন।আমার তো এখন পর্যন্ত বিশ্বাস হচ্ছে না।উনি নাকি আমাকে অনেক বেশি ভালোবাসেন।
তন্নি সেই কথা শুনে তানিশার গলা ধরে বললো,আমান ভাইয়া,তাই না?এটা আমি আগে থেকেই জানি।শুধু আমি না।আমার পরিবারের সবাই জানে এ কথা।তায়েব মামা তো ইতোমধ্যে আমান ভাইয়ার সাথে তোর বিয়ের কথা পাকাপোক্তও করে ফেলেছেন।
তানিশা সেই কথা শুনে বললো,কি বলছিস এসব?আমানের সাথে আমার বিয়ে!ইমপজিবল!
তানিশা নোমানের কথা বলতে যাবে ঠিক তখনি তন্নি বললো,
–হ্যাঁ আমান ভাইয়াই!তোর বিশ্বাস হচ্ছে না তো?দুই একদিন পরে মামা যখন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসবে তখন ঠিক বিশ্বাস হবে।আমান ভাইয়ার সাথে তোর বিয়ে দিতে চান মামা।আর নোমান ভাইয়ার সাথে,,,বলেই নিচ মুখ হলো তন্নি।
তানিশা তখন বললো,কি হলো?থামলি কেনো?
–আর নোমান ভাইয়ার সাথে আমার বিয়ে হবে।এই কথা বলেই তন্নি নিচ মুখ হলো।
তন্নির কথা শুনে তানিশার মাথা যেনো চক্কর দিয়ে উঠলো।সে কি বলছে এসব পাগলের মতো?তানিশা বলতে ধরে আর বললো না কিছু।
হঠাৎ তন্নি বললো, একটা সিক্রেট কথা বলি শোন।
তানিশা র চোখ একদম ছলছল করছিলো,সে তন্নির দিকে তাকাতে পারছিলো না।
তন্নি তখন বললো,কি হলো শুনবি না সিক্রেট কথাটি?
–হ্যাঁ বল।এই বলে তানিশা আবার নিচ মুখ হলো।
তন্নি তখন বললো,কথাটা কিন্তু খুবই সিক্রেট।সবাই বলতে বারণ করেছে।তবুও বলছি।যে ছেলেটা ফেইক আইডি থেকে তোকে বিরক্ত করতো সে আর কেউ নয় আমাদের আমান ভাইয়া।ভাইয়া তোকে অনেক বেশি ভালোবাসেন।আর সেদিন যে ছেলেগুলো এট্যাক করেছিলো সেগুলোও আমান ভাইয়ার টাকায় কেনা লোক ছিলো।ছেলেগুলো তোর কোনো ক্ষতি করতো না সেদিন।জাস্ট ভয় দেখানোর জন্য এট্যাক করেছিলো।আমান ভাইয়া চাইছিলো তুই যেনো ছেলেগুলোর ভয়ে আমাদের বাসায় থাকতে রাজি হস।যাতে করে উনি রোজ রোজ তোকে দেখতে পান।ভাবতে পারছিস কত বেশি ভালোবাসেন উনি!
এক সেকেন্ডের মধ্যে তানিশার হাসিখুশি মুখটি একদম কালো হয়ে গেলো।সে যে উঠে রুমে চলে যাবে এ শক্তিও নেই তার।আর কথা বলার ভাষা তো একদম হারিয়েই ফেলেছে।তবুও সে জিজ্ঞেস করলো,
তোর নোমান ভাইয়া কি জানে তোদের বিয়ের কথা?
–বলতে পারছি না।আমাকেও তো এখন পর্যন্ত কেউ বলে নি।তায়েব মামা আর মা দুইজন মিলে যখন গল্প করছিলেন তখনি আমি দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে সব শুনেছি।মামার অনেক ইচ্ছা আমাকে নোমান ভাইয়ার বউ বানাবেন।আর তোকে বানাবেন আমান ভাইয়ার বউ।কি দারুন হবে তাই না?দুইজন এক বাসাতেই থাকতে পারবো?তুই খুশি হস নি?
তানিশা কোনো উত্তর দিলো না।সে উলটো তখন তন্নিকে জিজ্ঞেস করলো, তুই না বললি কাকে যেনো তুই ভালোবাসিস। তাহলে নোমানের সাথে বিয়ের কথা শুনে এতো খুশি কেনো হয়েছিস?
তন্নি সেই কথা শুনে বললো,আরে,আমার ভালোবাসার মানুষ টিও হলো নোমান ভাইয়া।ওনাকে না আমি অসম্ভব রকম ভালোবাসি।আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না মামা আর মাও এটাই চায়।
জানিস তানিশা! নোমান ভাইয়াকে না আমার অনেক আগে থেকেই ভীষণ ভালো লাগে।ওনার শাসন,আমার প্রতি কেয়ারিং দেখেই বুঝে ফেলছি উনিও আমাকে অনেক বেশি ভালোবাসেন।আজ পর্যন্ত ওনাকে কোথাও যেতে দেখি নি আমি।আর আজ তোর বাড়িতে এসেছেন তিনি।শুধুমাত্র আমার জন্য এসেছেন।আমার না আর এতো বেশি অপেক্ষা ভালো লাগছে না। শুধু দিন গুনছি, কবে সেই দিন আসবে?কবে আমরা সারাজীবনের জন্য এক হয়ে যাবো।তুই ভাবতে পারবি না!এতো খুশি আমি জীবনেও হই নি।আই এম সো এক্সসাইটেড তানিশা!এই বলে তন্নি তানিশার গলা জড়িয়ে ধরলো।
তানিশা তন্নির কথা শুনে একদম বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো।তার মুখ দিয়ে আর কোনো কথা বের হলো না।তবুও তানিশা তোতলাতে তোতলাতে বললো,তুই সিওর,তোদের বিয়ে ঠিক হয়েছে?
–হ্যাঁ একদম।
তানিশা তখন বললো, কিন্তু নোমান যদি তোকে ভালো না বাসে?
তন্নি তখন বললো, আমি সিওর উনিও আমাকে ভালোবাসেন।তুই জানিস না উনি আমার কত খেয়াল রাখেন বাসায়।এক নজর না দেখলে তন্নি তন্নি করে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে ফেলেন।আর মামা কি না বুঝেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?উনি ওনার ছেলের মনোভাব দেখেই এতো বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।তুইও তো দেখেছিস নিজের চোখে।নোমান ভাইয়া সবসময় আমার খোঁজখবর নিতো।কিভাবে ডাকতো সবসময়।
–হুম।
মুহুর্তের মধ্যে তানিশার সব স্বপ্ন যেনো ভেংগে চুরমার হয়ে গেলো।সে তখন তন্নিকে বললো, আমার না ভীষণ ঘুম পাচ্ছে।আমি এখন রুমে যাবো।
তন্নি তখন বললো,তুই তো নিজের কথা ভালোভাবে কিছুই বললি না?আমান ভাইয়া তো তোকে প্রপোজ করেছে বুঝলাম,কিন্তু তুইও কি ওনাকেই ভালোবাসিস?
–না,আমি ওনাকে মোটেও ভালোবাসি না।
তন্নি সেই কথা শুনে বললো, কি বলছিস এসব?উনি তো তোকে অনেক বেশি ভালোবাসেন। তাছাড়া আমান ভাইয়া কিন্তু অনেক ভালো ছেলে।
তানিশা তখন বললো তুই কি জোর করে আমাকে ভালোবাসতে বলছিস?
–না,না।ইমপজিবল।জোর করবো কেনো?তোর মন যাকে চাইবে তুই তাকেই ভালোবাসবি,আর তাকেই বিয়ে করবি।আমি তো শুধু তায়েব মামার সিদ্ধান্তের কথা জানালাম তোকে।তাছাড়া নোমান ভাইয়ার সাথে আমার বিয়ে তো আর নড়চড় হচ্ছে না।কিন্তু আমান ভাইয়ার জন্য খারাপ লাগছে।আচ্ছা তুই কি তাহলে অন্য কাউকে ভালোবাসিস?
তানিশা অনেককিছু ভেবে বললো,হ্যাঁ,ভালোবাসি।
তন্নি সেই কথা শুনে বললো, কে সে?বল আমায়।
–তোর নোমান ভাইয়াকে।
নোমানের কথা শুনে তন্নির মুখ চোখ যেনো শুকিয়ে গেলো।সে তখন কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, তুই কি সত্যি বলছিস?
তানিশা তন্নির চোখের পানি দেখে বুঝে গেলো তন্নি সত্যি সত্যি নোমানের প্রেমে পাগল হয়ে গেছে।একে আর বেশি কিছু বলা যাবে না।তা না হলে ঘটনা অন্য দিকে মোড় নেবে।সেজন্য তানিশা হাসতে হাসতে বললো,
তুই প্রাংক বুঝিস না?আমি তো প্রাংক করলাম তোর সাথে।আমিও দেখলাম তুই তোর নোমান ভাইয়াকে কত টা ভালোবাসিস।একদম চোখে জল এসে গেছে দেখছি।এই বলে তানিশা তন্নির চোখের পানি মুছে দিলো।
তন্নি সেই কথা শুনে বললো,এরকম প্রাংক আর কখনোই করবি না।বুকের ভিতর একদম ধক করে উঠেছিলো।আর একটু পরে মনে হয় নিঃশ্বাস টাই বন্ধ হয়ে যেতো আমার।যদি সত্যি হতো তখন তাহলে কি হতো?আমি তো আমার বান্ধুবির মনে মোটেও কষ্ট দিতে পারতাম না।নিজে কষ্ট পাইতাম তবুও তোর সাথে ওনার মিলাইয়া দিতাম।
তানিশা দেখলো তন্নির চোখ দিয়ে আবার পানি পড়ছে।এ মেয়ে তো নোমানের প্রেমে একদম হাবুডুবু খাচ্ছে।সেজন্য তানিশা বললো, না না?কি বলছিস এসব?আমি কোন দুঃখে তোর নোমান ভাইকে ভালোবাসতে যাবো।দুনিয়ায় কি ছেলের অভাব নাকি?তাছাড়া অমন বদমেজাজী, রাগী আর অহংকারী ছেলে আমার মোটেও পছন্দ নয়।
তন্নি সেই কথা শুনে বললো,ওনাকে সম্মান দিয়ে কথা বল তানিশা।তোর কিন্তু হবু দুলাভাই উনি।তাছাড়া তুই যেমন টা ভাবিস উনি মোটেও তেমনটা নয়।আমার চোখে দেখা বেস্ট পুরুষ হলেন আমার নোমান ভাইয়া।সরি সরি শুধু নোমান।এখন ভাইয়া বললে কেমন যেনো লাগে।এই বলে তন্নি হা হা করে হেসে উঠলো। তন্নির এই হাসির শব্দ যেনো তানিশার কানে কান্নার শব্দের মতো মনে হলো।সে কিছুতেই এটা সহ্য করতে পারতেছিলো না।এতোদিন ধরে পুষে রাখা ভালোবাসার যে এখানেই সমাপ্তি ঘটবে তানিশা স্বপ্নেও ভাবে নি সেটা।
হঠাৎ তন্নি বললো তাহলে তুই যে বললি তোরও ভালোবাসার মানুষ আছে।সে কে তাহলে?
–আছে একজন। পরে একদিন পরিচয় করে দেবো।
–নাম টা অন্তত বল।
তানিশা তন্নির প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে বললো আমার কথা বাদ দে তো এখন।তুই তোর ভালোবাসা নিয়ে ভাব এখন।আর এক মিনিট লেট করিস না।তাড়াতাড়ি নোমানকে তোর মনের কথা জানিয়ে দে।তা না হলে উনি আবার অন্য জায়গায় মন দিয়ে বসে থাকবে।তখন কি করবি?
তন্নি তখন বললো,না,না এরকম হতেই পারে না।তার আগেই ওনাকে আমি সারাজীবনের জন্য দখল করে নিবো।
–তবুও।নিজের ভালোবাসা নিজের কাছেই যত্ন করে রাখতে হয়।
তন্নি সেই কথা শুনে বললো, আমায় একটু হেল্প করবি তানিশা।আমি কিভাবে ওনাকে ভালোবাসার কথা বলবো বুঝতে পারছি না।আমার হয়ে তুই একটু বলে দিবি ওনাকে।
তানিশা তখন বললো, আমি বললে হবে না।তোর মনের কথা তোকেই জানাতে হবে।এই বলে তানিশা চোখের পানি মুছতে মুছতে রুমে চলে গেলো।
–এই তানিশা!যাচ্ছিস কেনো?শোন?বলতে বলতে তন্নিও তানিশার পিছু পিছু রুমে চলে গেলো।
জীবনের সবচেয়ে খারাপ রাত মনে হয় আজকেই ছিলো তানিশার।সে কিছুতেই এটা মানতে পারছিলো না।এভাবে চোখের সামনে নোমানকে অন্য কারো হতে দেখলে সে এটা সহ্য করবে কিভাবে?কিন্তু তন্নিকে কষ্ট দিয়ে ওর চোখের সামনে তো আবার নোমানকেও বিয়ে করতে পারবে না সে।কি করবে সে এখন?ওদিকে তন্নি তো একদম হাবুডুবু খাচ্ছে নোমানের প্রেমে।তানিশা কিছু আর ভাবতে পারছে না।তার দুচোখে কোনো ঘুম নেই।তবুও ঘুমানোর চেষ্টা করলো সে।
হঠাৎ নোমান মেসেজ দিলো তানিশাকে।হাই তানিশা!
তানিশা ভুল করে সিন করলো বাট রিপ্লাই দিলো না।তার চোখে দিয়ে অনবরত পানি পড়তে লাগলো।প্রেম শুরু না হতেই এভাবে বিচ্ছেদ হয়ে যাবে তার স্বপ্নেও কল্পনা করে নি সে।তার এতো কষ্ট হচ্ছে যে সে মুখ চেপে চেপে কান্না করতে লাগলো।
তানিশা রিপ্লাই দিচ্ছে না দেখে নোমান আরেকটা মেসেজ দিলো,কি হলো তানিশা? রিপ্লাই দিচ্ছো না কেনো?
তানিশা এবার অফলাইনে চলে গেলো।সে আর সহ্য করতে পারছিলো না।
হঠাৎ কিছুক্ষণ পরে কে যেনো দরজায় ঠকঠক করতে লাগলো। তানিশা আন্দাজ করতে পারলো এটা নোমানই হবে।সেজন্য সে আর দরজা খুলে দিলো না।কিন্তু নোমান দরজা ঠকঠক করতেই আছে।এদিকে তন্নি শব্দ শুনে তানিশাকে ডাকতে লাগলো।কিন্তু তানিশা কিছুতেই উঠলো না।তখন তন্নি ভাবলো তানিশা হয় তো ঘুমে গেছে সেজন্য সে নিজেই যখন জিজ্ঞেস করলো কে?
ওপাশ থেকে কেউ সাড়া দিলো না।তখন তন্নি দরজা খুললো।কিন্তু দরজা খুলে দেখে কেউ নাই সেখানে।তন্নি তখন আবার এসে শুয়ে পড়লো।
এদিকে তানিশা জেগেই আছে।সে বুঝতে পারলো নোমান তন্নির কথা শুনে চলে গিয়েছে। অসহ্য ব্যাথায় ছটফট করতে করতে তানিশা সারারাত পার করলো।তার এই কষ্ট সে কিভাবে দূর করবে ভাবতেই তার দু চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো।
পরের দিন ভোর থেকে তানিশার বোনের বিয়ের সব কাজকর্ম শুরু হয়ে গেলো।সবাই ভীষণ ব্যস্ত কাজকর্ম নিয়ে।তানিশার মোটেও মন ভালো নেই।তবুও একপ্রকার বাধ্য হয়েই তাকেও সামিল হতে হচ্ছে।সে একটিবারের জন্য আজ নোমানের মুখোমুখি হলো না।সকালের নাস্তা দেওয়ার জন্য আজ তানিশা তন্নিকে পাঠালো।ওদিকে নোমান ভেবেছিলো নিশ্চয় তানিশা নিজে আসবে আজ।কিন্তু যখন নোমান দেখলো তন্নি এসেছে নাস্তা দিতে তখন নোমান বললো, কি রে তানিশা কোথায়?তুই নাস্তা নিয়ে এসেছিস কেনো?
তন্নি তখন বললো, ও ব্যস্ত আছে।
–কিসের এতো ব্যস্ততা? একবার ডাকতে পারবি ওকে?
–কোনো দরকার আছে ওর সাথে?
–হ্যাঁ।একবার গিয়ে বল নোমান ডাকছে।
তন্নি সেই কথা শুনে বললো, আপনার কিছু লাগলে আমাকে বলতে পারেন।
নোমান সেই কথা শুনে নিজেই উঠে গেলো।তন্নি কিছু বুঝতে পারলো না।সেজন্য সেও নোমানের পিছু পিছু চলে গেলো।এদিকে তানিশা নোমানকে আসা দেখে অন্য রুমে চলে গেলো।সে চাইছিলো না নোমানের মুখোমুখি হতে।কারণ সে আর তাকে দেখতে পারবে না।নোমানকে দেখলে তার কষ্ট আরো দ্বিগুন বেড়ে যাবে।
এইভাবে সারাটা দিন তানিশা নোমানের থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে লাগলো।এদিকে নোমান তানিশাকে দেখতে না পেয়ে একদম ছটফট করতে লাগলো।সে নিজেও কিছু বুঝতে পারলো না।হঠাৎ তানিশার হলো কি?সে তার থেকে এভাবে পালিয়ে বেড়াচ্ছে কেনো?
কিছুক্ষণ পরে বরযাত্রীরা আসলো।তানিশা এতোক্ষণে বের হলো রুম থেকে।কারণ হবু দলুভাইকে সে বরণ করে ঘরে তুলবে।সেজন্য তার চাচাতো,ফুফাতো আর মামাতো বোনরা ডাকাডাকি শুরু করে দিয়েছে।তানিশা মিষ্টি আর শরবতের গ্লাস নিয়ে গেটে চলে গেলো।তবে তার মুখে একটুও হাসি নাই।অথচ আজ সে কত আনন্দ করবে বলে কত প্লান করে রেখেছে।
তানিশা আজ আর একটুও সাজগোছ করলো না।একদম সিম্পল সাজে বের হলো।তার লম্বা চুলগুলো বেনুনি ঘরে বুকের উপর দিয়ে সামনে রাখলো।আর পরনে একটা সালোয়ার কামিজ ছিলো।অতচ আজ তানিশার ঝকঝকে একটা সোনালী কালারের গাউন পড়ার ইচ্ছা ছিলো।সে আগেই সব পরিকল্পনা করে নিয়েছিলো।তার বোনের বিয়েতে অনেক মজা করবে আর মন মতো সাঁজবে।লম্বা গাউনের সাথে সুন্দর করে চুলগুলো বেঁধে তাতে টাটকা বেলি ফুল গুজে দেবে।কিন্তু যেখানে তার মনেই নাই শান্তি সেখানে সে কি করে সাজবে?
তানিশাকে এতোক্ষণে দেখে নোমানও পিছু পিছু চলে গেলো তানিশার।কিন্তু এতো মানুষ জনের মধ্যে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারলো না সে।তবুও অনেকবার চেষ্টা করলো তাকে ডাকার জন্য।কিন্তু তানিশা নোমানের ডাক শুনেও না শোনার ভান করে থাকলো।নোমানের ভীষণ অসহ্য লাগছিলো।সে বুঝতে পারলো না তানিশা হঠাৎ এমন করছে কেনো?নোমানের এবার ভীষণ রাগ উঠলো।সে তখন সবার সামনেই তানিশার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আর বললো রুমে চলো,কথা আছে তোমার সাথে।
তানিশা তখন বললো,কি করছেন সবার সামনে?সরে যান আমার সামনে থেকে।
নোমান তখন বললো তাহলে রুমে চলো।তা না হলে সবার সামনেই কিন্তু বলবো।তানিশা যখন দেখলো নোমান কিছুতেই শুনছে না সে তখন বললো ঠিক আছে আমি যাচ্ছি।এই বলে সে আবার সরে গেলো।
নোমান রুমের মধ্যে তানিশার জন্য অপেক্ষা করছে।কিন্তু তানিশা নোমানের কাছে না গিয়ে তার চাচার বাড়িতে চলে গেলো।তানিশার চাচী ভীষণ অবাক হলো তানিশাকে দেখে।তানিশা বিয়ে বাড়ি বাদ দিয়ে এখানে কি করে?
তানিশা জানালো তার শরীর ভালো লাগছে না।ভীষণ মাথা ব্যাথা করছে।সেজন্য সে কিছুক্ষণ নিরিবিলি থাকতে চায়।
তানিশার চাচী সেই কথা শুনে তানিশাকে তালা চাবি দিয়ে নিজেও বিয়ে বাড়িতে চলে গেলো।
এদিকে তন্নি তানিশাকে খুঁজে খুঁজে একদম হয়রান হয়ে গেলো।অন্যদিকে নোমান ও খুঁজছে।আমান আবার নিজেও তার মনের কথা বলার জন্য রেডি হচ্ছে।কিন্তু তানিশার দেখা আর কেউ পেলো না।
সবাই যখন তানিশার কথা জিজ্ঞেস করছিলো তখন তানিশার চাচী বললো,ও আমাদের বাড়িতে আছে।ওর নাকি শরীর ভালো লাগছে না।তন্নি সেই কথা শুনে সবার আগে চলে গেলো।সে গিয়ে দেখে তানিশা শুয়ে আছে। তার শরীর সত্যি খারাপ।তন্নি সেজন্য তানিশাকে রেস্ট করতে বললো।আর নিজেও বিয়ে বাড়িতে চলে গেলো।
আমান সেখানে যেতে চাইলে তন্নি বললো,,ভাইয়া যায়েন না ওখানে।ও একটু একা কিছুক্ষণ রেস্ট নিতে চায়।সেজন্য আমান আর গেলো না।
কিন্তু নোমান যখন জানতে পারলো তানিশার শরীর খারাপ সে আর এক সেকেন্ড অপেক্ষা করলো না।তাড়াতাড়ি তানিশার চাচীর বাড়ি চলে গেলো।কিন্তু তানিশা তার আগেই সেখান থেকে সরে গেছে।সে জানে নোমান এখানেও আসবে।
সারাদিন পালিয়ে বেড়ালেও তানিশার বোনের বিদায় বেলায় তানিশা আর পালাতে পারলো না।আবার নোমানের সাথে তার দেখা হয়ে গেলো।কিন্তু তানিশা নোমানকে কথা বলার সুযোগই দিলো না।সে তার বোনের সাথে যাবে বলে আগেই গাড়িতে গিয়ে বসলো।এদিকে তন্নি ভীষণ চিন্তার মধ্যে পড়ে গেলো।তানিশা তার বোনের বাড়ি চলে গেলে সে একা একা কি করবে?তানিশা তখন তার কাজিনদের বললো তন্নির সাথে সাথে যেনো তারা সবসময় থাকে।আর একদিনের ই তো ব্যাপার।কালকে বউ ভাতে তো দেখা হচ্ছেই।
নোমান তানিশাকে দেখামাত্র গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো।আর বললো,তানিশা তুমি ঠিক আছো?
–হুম।এই বলে তানিশা মাথা নাড়লো।
হঠাৎ গাড়ি স্টার্ট দিলো।
সেজন্য নোমান দূর থেকেই দেখতে লাগলো তানিশাকে।তানিশা নোমানকে তাকানো দেখে তার চোখ ফিরিয়ে নিলো।নোমান বুঝতে পারলো তানিশা তার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।নোমান বুঝে ফেললো তানিশা তাকে পছন্দ করে না।সেজন্য এভাবে তাকে ইগ্নোর করছে।কিন্তু সে যদি তাকে পছন্দ নাই করে তাকে তো বলবে কথাটা।কিন্তু তানিশা কিছু বলছে না কেনো?নোমান এজন্য ভীষণ টেনশনের মধ্যে পড়ে গেলো।
পরের দিন তানিশার বোন তানিয়ার বৌভাত।সেজন্য সবাই আজ তানিয়াকে তার শশুড় বাড়ি থেকে আনতে যাবে।কিন্তু নোমানের আর ইচ্ছে করলো না তানিশার মুখোমুখি হওয়ার।কিন্তু তার আবার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে তানিশা এমন কেনো করছে।এজন্য নোমান শেষ বারের জন্য তানিশার সাথে কথা বলতে চায়।আজ আর তারা তানিশার বাড়িতেও থাকবে না।আজকেই নোমানরা ঢাকায় চলে যাবে।এ কয়দিনে তার পড়াশোনার অনেক ক্ষতি হইছে।আর সে কোনো ক্ষতি করতে চায় না।
নোমানরা তাদের গাড়ি করেই তানিয়ার বাড়ি চলে গেলো।তানিয়ার হাজব্যান্ড একজন নামকরা ব্যবসায়ী।সেজন্য অবস্থা মোটামুটি ভালোই।গ্রামেই তিনতালা বিল্ডিং করেছে।নোমান বাড়ির ভিতর যেতেই দেখে তানিশা তার বোনের সাথে বসে আছে।তানিশার পাশে সিফাত ও আছে।দুইজনে মনের সুখে গল্প করছে।তানিশা নোমানকে দেখে আরো বেশি করে গল্প করতে লাগলো।নোমান তা দেখে শুধু রাগে কটমট করছে।সে রাগান্বিত হয়ে তার হাত মুষ্ঠি করে নিলো।পরে আবার ভাবলো যে তার নয় তার জন্য এতো কিসের রাগ?যদি সে আপন কেউ হতো তখন তার উপর অধিকার ফলানো যেতে।সেজন্য নোমান হাতের মুষ্ঠি ছেড়ে দিলো।এদিকে তন্নি দৌঁড়ে গিয়ে তানিশাকে জড়িয়ে ধরলো।এই এক দিন দেখতে না পারায় তার মন টা একদম অস্থির হয়ে আছে।তবে তানিশার মনে অতোবেশি আনন্দ দেখা গেলো না।সে শুধু জড়িয়ে ধরলো বাট কোনো কথা বললো না।ওদিকে নোমান সামনেই দাঁড়িয়ে আছে।
তন্নি তখন বললো, আমরা তো আজ বাসায় চলে যাচ্ছি।জানি না আর কবে দেখা হবে।তবে আমি ডাকলে অবশ্যই যাবি আমাদের বাসায়।
তানিশা তখন বললো, এর মধ্যে আমারও আর সময় হবে না রে।ঢাকায় গিয়ে পুরোদমে পড়াশোনা শুরু করতে হবে।অনেক লজ হয়ে গেছে এই কয়দিনে।আর তুই ও মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করিস।সামনে কিন্তু এক্সাম।মেডিকেলে কিন্তু চান্স পেতেই হবে।
তন্নি তখন বললো, দিলি তো আবার ভয় পাইয়ে।এই কয়দিন একটু পড়া নামক প্যারা থেকে দূরে ছিলাম।আবার শুরু হয়ে গেলো বাড়তি টেনশন।
তানিশা তখন বললো,ডাক্তারের বউ হতে হলে নিজেকেও সেই হিসেবে তার যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে তন্নি।মন দিয়ে পড়াশোনা কর।ইনশাআল্লাহ চান্স পেয়ে যাবি।
তন্নি তখন বললো,তুই কিন্তু এখনো আমার হবু দুলাভাই এর নাম বললি না?
তানিশা তখন হাসতে হাসতে বললো তুই ও না।সেই এক বিষয় নিয়ে পড়ে আছিস।বললাম তো পড়ে বলবো।আগে নিজে পাকাপোক্ত করে নেই।
বৌভাতের দিনেও তানিশা সিম্পল সাজে আছে।তবুও তাকে দেখতে অসম্ভব সুন্দর লাগছিলো।মুখখানা একদম গোমড়া করে বসে আছে সে।মনে হচ্ছে সে চির দুঃখী।তার মনে কোনো শান্তি নাই। এদিকে তানিশা একটু সিফাতের সাথে কথা বলায় সে আর তানিশার পিছুই ছাড়ছে না।বার বার কথা বলার জন্য এগিয়ে আসছে।এমনিতেই তার কিছু ভালো লাগছে না,তার মধ্যে আবার নতুন এক ঝামেলা তৈরি হলো।তানিশা পড়ে গেলো মহা বিপদের মধ্যে।
তানিশা কিছুক্ষণের জন্য নিজেকে আড়াল করে রাখতে চাইলো, সেজন্য সে গাড়িতে গিয়ে বসে থাকলো।কিন্তু গাড়ির ভিতর বসতেই তানিশা একদম চমকে উঠলো।কারণ নোমান আগে থেকেই গাড়ির মধ্যে বসে আছে।নোমান জানতো আজও তানিশা সবার আগে গাড়িতে গিয়ে বসে থাকবে।নোমানকে দেখামাত্র তানিশা তাড়াতাড়ি করে চলে যেতে ধরলো।কিন্তু নোমান তার আগেই তানিশাকে আবার টেনে এনে বসালো।তানিশা ভয়ে একদম কাঁপতে লাগলো।কারণ তন্নি দেখলে খুবই খারাপ হয়ে যাবে।তাছাড়া বাহিরের কেউ দেখলেও তার মানসম্মান একদম নষ্ট হয়ে যাবে।হঠাৎ তানিশা খেয়াল করলো সিফাত ও এদিকেই আসছে।তানিশা তখন নোমানকে বললো,প্লিজ ছেড়ে দিন আমাকে।সিফাত আসছে গাড়ির দিকে।নোমান সেই কথা শুনে তানিশাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
#চলবে,
#ডাক্তার_ম্যাডাম
#পর্ব_১৫
#মুমতাহিনা_জান্নাত_মৌ
❝প্লিজ ছেড়ে দিন আমাকে।সিফাত আসছে গাড়ির দিকে।❞
নোমান সেই কথা শুনে আরো জোরে জড়িয়ে ধরলো তানিশাকে।আর বললো,আসতে দাও।আর দেখতে দাও ওকে।
–কি বলছেন এসব ভুলভাল? আপনি কিন্তু এবার আপনার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন।এই বলে তানিশা নোমানকে ধাক্কা মারে।
–এখনো ছাড়ি নি সীমানা।এই বলে নোমান তানিশাকে আবার তার বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে। আর এবার একটু শান্ত কন্ঠে বলে,কি হয়েছে তোমার?হঠাৎ কেনো এমন আচরণ করছো?আর এভাবে পালিয়েই বা বেড়াচ্ছো কেনো?
তানিশা সেই কথা শুনে বললো, কই পালাচ্ছি?আমি তো আমার জায়গাতেই আছি।
–জীবনেও না।আগের তানিশা আর এখনকার তানিশার মধ্যে অনেক তফাত দেখতে পাচ্ছি।আমি আগের তানিশাকে ফেরত চাই।
–সম্ভব না।ছাড়ুন আমাকে।এই বলে তানিশা আবার নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো।কিন্তু নোমানের বুক থেকে এবার আর সে ছাড়া পেলো না।
নোমান তখন বললো, জোরাজোরি করো না তানিশা।আজ তুমি কিছুতেই আমার থেকে ছাড়া পাবে না।আমাকে আগে সত্য কথা বলে দাও।
–কিসের সত্য কথা?
–তুমি কি আমার প্রপোজ রিজেক্ট করছো?আমি বলতে চাচ্ছি তুমি কি আমায় ভালোবাসো না?
তানিশা নোমানের কথা শুনে বললো,এতোকিছুর পরেও আপনি এই কথাটা জিজ্ঞেস করতে পারলেন?আমি তো ভেবেছি আপনি ইতোমধ্যে সেটা বুঝে গেছেন।
–মানে কি বলতে চাচ্ছো তুমি?
–আমি পরিষ্কার ভাবে বলছি আমি আপনাকে ভালোবাসি না।
নোমান সেই কথা শুনে তানিশার মুখটি উপরে তুলে বললো, তানিশা আমার দিকে তাকাও প্লিজ।ভালো করে আমার চোখের দিকে তাকাও।দেখো একবার,নোমান তোমার জন্য কতটা পাগল হইছে।এইভাবে তাকে মাঝপথে ছেড়ে চলে যেওয়ো না।
তানিশা সেই কথা শুনে তার চোখ নামিয়ে নিয়ে বললো,আমি কবে আপনাকে বলেছি যে আমি আপনাকে ভালোবাসি।আপনাকে কে আমার জন্য বসে থাকতে বলেছে।আমি আবারও স্পষ্ট করে বলতে চাই যে আমি আপনাকে ভালোবাসি না,আর কখনো বাসিও নি।আর ভবিষ্যৎ এ ও বাসবো না।
নোমান তানিশার কথা শুনে একদম স্তব্ধ হয়ে গেলো।সে কখনোই আশা করে নি এটা।সে তো ভেবেছিলো তানিশাও হয় তো তাকে পছন্দ করে।কারণ তানিশা সবসময় তার দিকে তাকাতো,তাকে দেখে মুচকি মুচকি হাসতো।আজ সে একেবারে মুখের উপর না করে দিলো।সত্যি অবিশ্বাস্য লাগছে তার।নোমান সেজন্য এবার তানিশার গা ধরে বললো তানিশা,প্লিজ ফান করো না আমার সাথে।আই এম সো সিরিয়াস।প্লিজ টেল মি দা ট্রুথ এন্ড স্টপ ইওর মেডন্যাস নাউ।
তানিশা নোমানের কথা শুনে বললো,আমার গা ছাড়ুন।বলছি না আমাকে যখন তখন এভাবে ছোঁবেন না।আর আমি সত্য কথা বলছি।কোনো পাগলামি করছি না আমি।এই বলে তানিশা নোমানকে ধাক্কা দিয়ে গাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো।
নোমান একদম হা হয়ে গেলো।এতোবড় অপমান সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলো না।সে রাগে তার হাতে রাখা মোবাইল টিই ভেংগে ফেললো।তার রাগ তবুও কমলো না।অবশেষে নোমান কাউকে কিছু না বলে গাড়ি নিয়ে একা একা বাসার দিকে চলে গেলো।
এদিকে তন্নি আর আমান খুঁজে খুঁজে একদম হয়রান হয়ে গেলো।তারমধ্যে আবার নোমানের ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে।ভীষণ টেনশনের মধ্যে পড়ে গেলো তারা।অন্যদিকে তানিশারও ভীষণ ভয় হতে লাগলো।নোমান আবার রাগ করে খারাপ কিছু করলো না তো?
তন্নি কাঁদতে কাঁদতে একদম শেষ হয়ে গেলো।নোমান হঠাৎ এভাবে কোথায় উধাও হলো?
তন্নি আর আমান তখন তাদের বাড়িতে ফোন দিয়ে নোমানের কথা জানালো।কিন্তু তারা বললো নোমান এখনো আসে নি বাসায়।সেজন্য আমান আর তন্নি এক মুহুর্ত ও দেরী করলো না।তারাও নিজেদের বাড়ির দিকে রওনা দিলো।তারা ভেবেছে হয় তো নোমান রাস্তার মাঝখানে আছে।সেজন্য এখনো ফেরে নি বাসায়।কিন্তু তন্নিরা যখন বাড়িতে পৌঁছলো তারা গিয়ে দেখে নোমান এখনো আসে নি।এবার বাসার সবাই ভীষণ টেনশন করতে লাগলো।হঠাৎ নোমান কাউকে কিছু না বলে কই গেলো?তার আবার কোনো বিপদ হলো না তো?
এইভেবে তায়েব চৌধুরী পুলিশের কাছে গিয়ে মিসিং ডায়েরী লিখলো। পুলিশ সাথে সাথে নোমানকে খুঁজতে লাগলো।তবুও তার কোনো হদিস পেলো না কোথায়।
তানিশা এবার ফোন দিলো তন্নিকে।কারণ তারও ভীষণ টেনশন হচ্ছিলো।কিন্তু তন্নি কাঁদতে কাঁদতে বললো,না ফেরে নি এখনো।তানিশা সেই কথা শুনে নিজেও ভয়ের মধ্যে পড়ে গেলো।সে ভাবতে লাগলো,সে এটা কি করলো?এইভাবে নোমানকে কষ্ট দেওয়া তার মোটেও উচিত হয় নি।কিন্তু নোমানকে হ্যাঁ বললে ওদিকে আবার তন্নি কষ্ট পেতো।সেও তো ভীষণ জেদী।হয়তো রাগ করে নিজের জীবন টাই শেষ করে ফেলতো।সেজন্যই তো সে নোমানকেই না করে দিয়েছে।
তানিশার আর অন্য কোনো উপাই ছিলো না।সেজন্য সে নামায পড়ে নোমানের জন্য দোয়া করতে লাগলো।আর বলতে লাগলো,
হে আল্লাহ,নোমান যেখানেই থাক না কেনো ও যেনো ভালো থাকে।ওর যেনো কোনো বিপদ না হয়।হে আল্লাহ আমাকে অনেক অনেক ধৈর্য্য দাও,যাতে আমি সব যন্ত্রণা নিজের বুকে চেপে রাখতে পারি।এই বলে তানিশা কাঁদতে লাগলো।তার যে কষ্ট হচ্ছে সেটা অন্য কেউ দেখতে না পারলেও সে ঠিক বুঝতে পারছে।এই যন্ত্রণা অন্য কেউ কখনোই বুঝতে পারবে না।অসহ্য যন্ত্রণায় তানিশা কাঁতরাতে লাগলো।সে এই যন্ত্রণা না সহ্য করতে পারছে না কাউকে বলতে পারছে।
নোমান নিঁখোজ হওয়ার কথা শুনে তানিশা আর গ্রামে কিছুতেই থাকতে পারলো না।সে সোজা নোমানদের বাসায় চলে আসলো।বাসায় এসে দেখে একজন লোকও ঠিক নাই।সবাই নোমানের টেনশনে খাওয়া দাওয়া পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছে। তানিশা কাকে কিভাবে শান্ত্বনা দেবে বুঝে উঠতে পারলো না।তখন তানিশা নিজের হাতে সবাইকে রান্না করে খাওয়াতে লাগলো।কিন্তু খাবারের প্রতি কারো কোনো রুচি ছিলো না।তবুও তানিশা নিজের পরিবারের মতো সবাইকে জোর করে করেই একটু করে খাওয়ালো।
অবশেষে দুইদিন পরে নোমান সুস্থ অবস্থায় ফিরে এলো।
আসলে নোমান সেদিন রাগ করে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে তার বাসার দিকে আসে নি।সে কোনদিকে গিয়েছিলো তা নিজেও জানে না।সে চলতেই আছে চলতেই আছে।এভাবে দিন পেরিয়ে রাত হয়ে যায় নোমান তবুও ড্রাইভিং করেই যাচ্ছে।তার ইচ্ছে করছিলো না বাসায় ফিরতে। সেজন্য সে আর ফেরে নি।কিন্তু যখন তার মনে হলো তার কি এমন হয়েছে? সে এমন কেনো পাগলামি করছে?সামান্য একটা মেয়ের কারণে তার নিজের পরিবার এমনকি নিজেকেও অযথাই কষ্ট দিচ্ছে।না,সে ভেংগে পরার মতো ছেলে নয়।তাকে আরো অনেকটা পথ চলতে হবে।সে একজন ভবিষ্যতের ডাক্তার।তার এভাবে পাগলামি মানায় না।সেজন্য নোমান ফিরে এসেছে বাসায়।
নোমান বাসায় আসার সাথেই সবাই তাকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরলো।একের পর এক প্রশ্ন করতে লাগলো সবাই।কিন্তু নোমান কারো প্রশ্নের উত্তর দিলো না।সে শুধু জানালো, ভীষণ টায়ার্ড সে,তার এখন ঘুমের দরকার।এই বলে নোমান তার রুমে চলে গেলো।
এদিকে তানিশা যখন দেখলো নোমান সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরেছে তার টেনশন কিছুটা দূর হলো।সেজন্য সে তার হোষ্টেলে যেতে চাইলো।কিন্তু তন্নি কিছুতেই যেতে দিলো না তানিশাকে।সে তানিশাকে কিছুদিন থাকতে বললো।কিন্তু তানিশা তার পরীক্ষার অজুহাত দিয়ে চলে গেলো।সে চাইছিলো না আর নোমানের মুখোমুখি হতে।অন্যদিকে নোমান নিজেও তানিশার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।সেজন্য সে একবারও তানিশার দিকে তাকায় নি।তানিশা বুঝতে পেরে গেছে নোমান ভীষণ অভিমান করেছে তার উপর।আর তানিশা তো এটাই চাই।এইরকম অভিমান থাকাই ভালো।তাহলে নোমান আর তাকে বিরক্ত করবে না।
তানিশা অনেকদিন পর কলেজে আসলো।আর কলেজে যেতেই তানিশার বান্ধুবীরা একদম তাকে ঘিরে ধরলো।তানিশা তার গ্রামে গিয়ে কি কি মজা করলো সবাই সেটা জানতে চাইলো।বিশেষ করে লিরা আর রিশা হলো তানিশার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু।তানিশা তার বোনের বিয়ে সম্পর্কে ও বিস্তারিত ভাবে বললো।
লিরা তখন বললো গ্রামের লোকজন এবার তোকে ডাক্তার ম্যাডাম বলে ডাকে নি?তুই নাকি ইতোমধ্যে ডাক্তার হয়ে গেছিস?
তানিশা সেই কথা শুনে হাসতে হাসতে বললো,এবার আর শুধু ডাক্তার ম্যাডাম বলে নি।সবাই আমার কাছে ট্রিটমেন্ট করার জন্যও এসেছে।সবাই ভাবছে আমি ডাক্তারি চাকরি করি সেজন্য বিভিন্ন ঔষধ বুঝে নিতে আসলো।কেউ কেউ তো চেকাপ করার জন্যও এসেছে,আর বলছে তানিশা দেখতো আমার কোনো অসুখ আছে কিনা।দুই দিন ধরে কেনো খেতে পারি না।কোনো কোনো সুস্থ মানুষ ও হুদাই চিকিৎসার জন্য এসেছে।ফ্রির কথা শুনলে যা হয় আর কি?
লিরা আর রিশা তো ইতোমধ্যে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে।তানিশা তখন বললো,তোরাই বল এখন আমি তাদের কি করে বোঝায় যে,আমি এখনো ডাক্তার হইনি। মাত্র মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা শুরু করছি।আরো ৫ বছর অপেক্ষা করার পর তবেই কিছু একটা হতে পারবো।ডাক্তারির এখনো কিছুই আয়ত্ত করতে পারি নি সেটা কেউ বুঝতেই চাইছে না।তারা তো ভাবে আমি একজন ডাক্তার।
রিশা তখন বললো,তোর এলাকার সবাই যখন তোকে ডাক্তার বানিয়েই দিয়েছে তাহলে তুই এই সুযোগে একটু ডাক্তার হওয়ার ট্রায়াল দিতি।গায়ে এপ্রোণ জড়িয়ে চোখে একটা চশমা দিয়ে আর কানে স্টেথোস্কোপ লাগিয়ে চেক করতি সবাইকে।
তানিশা সেই কথা শুনে বললো,আমি কি স্টেথোস্কোপ নিয়ে গেছি নাকি?আমি গেছি বোনের বিয়েতে মজা করার জন্য।
রিশা তখন বললো স্টেথোস্কোপ নাই তো কি হয়েছে হাতের নাড়ি অনুভব করে দেখতি আর কান পেতে বুকের হৃদস্পন্দন পরীক্ষা করতি।ব্যাস হয়ে গেলো পরীক্ষা করা।
তানিশা অনেকদিন পর কলেজে এসে কলেজের লাইব্রেরি তে বসে পড়াশোনা করার পরিবর্তে গল্পের আসর পাতিয়েছে।তার বোনের বিয়েতে লিরা আর রিশাকেও দাওয়াত দিয়েছিলো কিন্তু তারা যায় নি।কারন তাদের পরিবার যেতে দেয় নি।
এদিকে তানিশাদের পিছন বেঞ্চে কলেজের লাইব্রেরি তে ভীষণ মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছিলো নোমান।তানিশারা এতো জোরে কথা বলছিলো যে সবার পড়াশোনায় সমস্যা হচ্ছিলো।নোমান তখন বাধ্য হয়ে তানিশাদের বেঞ্চে চলে গেলো।
নোমানকে দেখামাত্র রিশা বললো,হায় ভাইয়া,কেমন আছেন?
–জ্বি ভালো।এই বলেই নোমান রিশা আর লিরার দিকে তাকিয়ে বললো,তোমরা কি পড়তে এসেছো?না গল্প করতে এসেছো?পড়ার ইচ্ছা থাকলে চুপচাপ বই দেখো আর যদি না ইচ্ছা থাকে তাহলে মাঠের মধ্যে চলে যাও।এই বলে নোমান চলে গেলো।সে একটিবারের জন্যও তানিশার দিকে তাকালো না।
রিশা আর লিরা নোমানকে এমন রাগান্বিত দেখে ভীষণ অবাক হলো।তারা সবচেয়ে বেশি অবাক হলো এই ভেবে যে নোমান কেনো তানিশার সাথে কথা বললো না।অথচ সে সেদিন কলেজ আসে নি দেখে বার বার তানিশার কথা জিজ্ঞেস করছিলো।আর আজ তানিশার দিকে তাকালোও না।
হঠাৎ লিরা বললো,আচ্ছা তানিশা একটা সত্যি করে কথা বলবি?নোমান ভাইয়া আসলে তোর কে হয়?সেদিন ওনার সাথে একই গাড়িতে চলে গেলি।আবার তুই যখন তোর বোনের বিয়েতে গিয়েছিলি তখন আবার নোমান ভাইয়া তোর কথা জিজ্ঞেস করলো?
তানিশা লিরার কথা শুনে ভীষণ অবাক হলো।নোমান সত্যি তার কথা জিজ্ঞেস করেছিলো?তাকে ভীষণ কৌতুহলী লাগছিলো।সে তখন লিরাকে বললো,আমার বান্ধুবী তন্নির মামাতো ভাই সে।সেই সুবাদে পরিচয়।আর কিছু না।সেদিন ওদের বাসায় গিয়েছিলাম তো সেজন্য ওনার সাথেই কলেজে এসেছিলাম।আচ্ছা ওসব কথা বাদ দে।তার আগে বল নোমান আমার কথা কি কি জিজ্ঞেস করেছিলো?
রিশা তখন বললো, আমাদের দুইজনকে ডেকে বললো,তোমরা কি তানিশার ফ্রেন্ড?
আমরা বললাম হ্যাঁ।তারপর বললো তানিশাকে দেখছি না যে?আমরা তখন বললাম ও ওর বাড়ি গিয়েছে।ওর বোনের বিয়ে ঠিক হয়েছে।
তানিশা রিশার মুখে এসব কথা শুনে একদম চমকে উঠলো।তার মানে নোমান তাকে অনেক বেশি মিস করেছে।আর সেজন্যই লিরা আর রিশাকে এভাবে জিজ্ঞেস করেছে।তানিশা তখন লিরাকে বললো,আর কি কি জিজ্ঞেস করেছে নোমান?
–না আর কিছু না।
আসলে প্রিয় মানুষের কথা শুনতে সবারই ভালো লাগে।সেজন্য তানিশা এভাবে বার বার জিজ্ঞেস করছিলো ওদের।
তানিশার এমন কৌতুহল দেখে লিরা আর রিশা দুইজন দুইজনার দিকে তাকালো।তারা বুঝতে পারলো কিছু একটা গন্ডগোল আছে।তবে তানিশা যে চাপা স্বভাবের মেয়ে মনে হয় না তার মুখ থেকে তারা কথা বের করতে পারবে।যা করার টেকনিকে করতে হবে।
#চলবে,