ডাক্তার ম্যাডাম পর্ব-০২

0
1772

#ডাক্তার_ম্যাডাম
#পর্ব_০২
#মুমতাহিনা_জান্নাত_মৌ

❝ডাক্তার ম্যাডাম!আই লাভ ইউ❞
❝উইল ইউ ম্যারি মি ডাক্তার ম্যাডাম?❞

মেডিকেলে চান্স পাওয়ার পর থেকে এইরকম মেসেজ দিনেরাতে আসতে থাকে তানিশার কাছে।সেজন্য মেসেজ অপশন অফ করে রেখেছে তানিশা, যাতে বাহিরের কেউ বিরক্ত করতে না পারে।কিন্তু আজ এই অচেনা ছেলেটার মেসেজ দেখে তানিশার চোখ যেনো কপালে উঠে গেলো।তানিশা ভাবতে লাগলো,
এই ছেলেটি তার ফ্রেন্ডলিস্টে আসলো কিভাবে? তানিশার জানামতে সে তো অচেনা কোনো ছেলের ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট একসেপ্ট করে নি।

তানিশা সেজন্য তাড়াতাড়ি করে মেসেজ টা চেক করতে লাগলো।কিন্তু মেসেজ টা সীন করার আগেই হঠাৎ তন্নি কল দিলো। তানিশা সেজন্য তন্নির কল আগে রিসিভ করলো।তানিশা ফোন রিসিভ করতেই তন্নি বললো,
তানিশা আজ তো বৃহস্পতিবার।সেজন্য কলেজ শেষ হওয়া মাত্র আমাদের বাসার দিকে রওনা দিবি।এক সেকেন্ড ও দেরী করবি না।কারণ তোকে আমার ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে।মনে হচ্ছে কত দিন ধরে দেখি না তোকে।
তানিশাকে দেখার জন্য নাকি তন্নির মন টা ভীষণ ছটফট করছে।আসলে তন্নি মেয়েটা ভীষণ একগুয়ে আর জেদী।সেজন্য যখন যেটা করতে বলে তানিশাকে সেটাই শুনতে হয়।আবার তানিশারও সব কথা শোনে তন্নি।কারণ অসম্ভব রকমের ভালো বন্ডিং ছিলো দুই বান্ধুবীর মধ্যে।মানে একজন আরেকজনের জন্য জীবন পর্যন্ত দিতে রাজি আছে।
এই রকম বন্ধুত্ব সচারাচর দেখা যায় না আজকাল।

তন্নির এমন জোরাজোরি দেখে তানিশা কলেজ শেষ করেই তন্নির মামার বাসার দিকে রওনা দিলো।আগে মাঝেমধ্যে প্রায়ই যেতো,কিন্তু এখন আর যাওয়ার সময় হয় না তার।
তানিশা তার ড্রেস চেঞ্জ করার ও সুযোগ পেলো না।কারণ তন্নি তাকে আর এক মুহুর্ত ও থাকতে দিচ্ছে না দূরে।সেই থেকে কল করেই যাচ্ছে।তন্নির সাথে কথা বলতে বলতে তানিশা মেসেজ দেওয়া ছেলেটির কথা একদম ভুলেই গেলো।

মেডিকেলের স্টুডেন্টদের কাছে বৃহস্পতিবার দিনটা সবচেয়ে বেশি আনন্দের দিন।কারণ বৃহস্পতিবার আসলেই যেনো প্রতিটা স্টুডেন্ট ঈদের আনন্দ অনুভব করে।সেজন্য বৃহস্পতিবারে হোস্টেলের সকল মেয়েরা অনেক অনেক আনন্দ করে।এই বৃহস্পতিবার হচ্ছে তানিশাদের রেস্টুরেন্ট বার।কারণ শনিবার কোনো বড়সড় পরীক্ষা না থাকলে তারা বাহিরেও ঘুরতে যাই সবাই।
সারা সপ্তাহ তাদের যেমনই কাটুক, এই একদিনের আনন্দে তারা পুরো সপ্তাহের সকল কষ্ট ভুলে যায়।কারো বার্থডে করা,একসাথে খাওয়া,চুটিয়ে আড্ডা,ক্লাসের খুনসুটি এগুলো নিয়ে খুব মজা করে হোস্টেলের প্রতিটা মেয়ে।

তানিশাদের এবারের শনিবারে কোনো এক্সাম নাই বিধায় সে তন্নিদের বাসায় যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।তানিশা বাসার দিকে যাচ্ছে আর মনে মনে নোমান কে নিয়ে ভাবতেছে,
নিজেকে নিয়ে খুবই অহংকার করো।ভেবেছো তুমি ছাড়া আর এ দুনিয়ায় কেউ মেধাবী নেই।ঢাকা মেডিকেলে পড়াশোনা করো দেখে অহংকারে মাটিতে পা পড়ে নাই।আমাদেরকে মানুষ ই মনে করো নাই।এখন কোথায় গেলো তোমার সেই অহংকার?তোমার সব অহংকার তো একদম ধূলিসাৎ হয়ে গেলো।আমিও তো তোমার মেডিকেলেই চান্স পাইয়া গেলাম।এখন ঐ অহংকারী মুখখানা কেমনে দেখাবে?ইসঃ কি যে আনন্দ লাগছে আমার।এই ভেবে তানিশা খুশিতে একদম গদগদ হয়ে রয়েছে।

তানিশা তন্নিদের বাসায় ঢুকতেই তন্নির বড় ভাই আমানের সাথে দেখা।
আমান কোচিং এ যাচ্ছে।সেজন্য বেশ তাড়াহুড়ো করে বের হচ্ছিলো বাসা থেকে।তানিশাকে দেখামাত্র বলে উঠলো,
আকাশের চাঁদ আজ কোনদিকে উঠেছে?তোমাকে তো আজকাল দেখাই যায় না!

তানিশা আমানের কথা শুনে হেসে উঠে বললো,ভাইয়া সময় হয় না এখন।পড়াশোনা নিয়ে ভীষণ প্যারার মধ্যে আছি।আগে জানলে মেডিকেলে কখনো ভর্তিই হতাম না।

–জানি জানি।আমাকে আর বলতে হবে না সে কথা।আমাদের ছোটো মিয়া তো মেডিকেলের পড়া পড়তে পড়তে ইতোমধ্যে পাগল হয়ে গেছে।কোনদিন যে আমাদের ভুলে যায়।এই বলে আমান হো হো করে হেসে উঠলো।

হঠাৎ কলেজ থেকে নোমান ও বাসায় আসলো।তানিশার দিকে একবার তাকিয়েই তার ভাইকে জিজ্ঞেস করলো,ভাইয়া কয় টা বাজে দেখেছো?কোচিং এ যাবে কখন?

আমান ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো,ওহ শীট।ইটস টু লেট।তানিশা তুমি বাসার ভিতর চলে যাও।কোচিং থেকে এসে কথা বলছি।এই বলে আমান তাড়াতাড়ি করে চলে গেলো।

কিন্তু নোমান কোনো কথা না বলে তানিশার দিকে তাকিয়ে মুচকি একটা হাসি দিয়ে বাসার মধ্যে প্রবেশ করলো।
এই প্রথমবার অহংকারী ছেলেটার হাসি দেখার সৌভাগ্য হলো তানিশার।তানিশা মনে মনে ভীষণ চিন্তার মধ্যে পড়ে গেলো।
সে ভাবতে লাগলো নোমান তাকে দেখে এভাবে হাসলো কেনো?না সে মেডিকেলে চান্স পাইছে দেখে ভাব জমাতে চাচ্ছে।
তানিশা ঠিক করলো সে কিছুতেই নোমান কে পাত্তা দিবে না।এতোদিন কথা বলা তো দূরের কথা সে তার সামনেই আসে নি।আর আজ হঠাৎ এমন হাসি দিয়ে চলে গেলো মনে হয় কত বছরের পরিচয় তাদের।
তানিশা তার লম্বা চুলের বেনুনি টা পিছন থেকে সামনে টেনে নিয়ে বাসার ভিতর প্রবেশ করলো।

আসলে তানিশার ধারণা ছিলো সম্পূর্ণ ভুল।কারণ নোমান হেসেছে অন্য কারণে।তানিশার গায়ে এখনো সেই সাদা এপ্রোণ টি জড়িয়ে রয়েছে।সে ড্রেস চেঞ্জ পর্যন্ত করে নি।নোমান তানিশাকে কলেজের ড্রেসে দেখেই এভাবে মুচকি একটা হাসি দিলো।নোমান মনে মনে ভাবলো মেডিকেলে চান্স পাইছে দেখে এপ্রোণ গায়ে দিয়েই গেস্টের বাসায় চলে এসেছে।হায়রে মেডিকেলের ছাত্রী!দুনিয়ায় আর মনে হয় কেউ মেডিকেলে পড়ে না।

তানিশা বাসার ভিতর প্রবেশ করতেই দেখে নোমান ডাইনিং টেবিলেই বই নিয়ে বসে পড়েছে।মাত্র কলেজ থেকে ফিরেছে সে,কই একটু ফ্রেশ হবে,খাওয়াদাওয়া করবে তা না করে সোজা পড়াশোনা শুরু করে দিয়েছে।

আসলে নোমান সারাক্ষণ শুধু পড়ালেখাই করে।ফ্যামিলির যেকোন প্রোগ্রামেও তাকে দেখা যায় না।
এটা অবশ্য তার দোষ নয়।কারণ মেডিকেলের স্টুডেন্ট রা প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষ কিছুটা আনন্দে কাটালেও তৃতীয় বর্ষে কমিউনিটি মেডিসিন ও ফরেনসিক মেডিসিনের মতো কঠিন কঠিন সাবজেক্ট পড়তে হয়।সেজন্য চাপ টা একটু বেশি তাদের।আর সেজন্যই প্রচুর পড়তে হয়।কারো সাথে বসে গল্প করে অযথা টাইম ওয়েস্ট করে না তারা।

নোমানের চেহারা দেখলেই বোঝা যায় অনেক আনরোমান্টিক আর ভীষণ অহংকারী ছেলে একজন!যার হাতে সবসময় একখানা বই থাকবেই। আর মাথাটা থাকবে সবসময় নিচু।চশমা ছাড়া তো তার এক সেকেন্ড ও চলে না।সারাদিন পড়তে পড়তে অকালেই চোখ দুটি নষ্ট করে ফেলেছে সে।চশমা ছাড়া সবকিছু আবছা আবছা দেখে নোমান।
তানিশা নোমানকে দেখে মনে মনে ভাবতেছে আসলেই আপনার অনেক বেশি দেমাক,তা না হলে একবার তো কিছু একটা জিজ্ঞেস করা যায়,যেহেতু এটা তাদের বাসা।
তানিশার মতো এমন সুন্দরী, মেধাবী আর ভদ্র মেয়ের সাথে কথা বলে না তাকে তো অহংকারীই বলা যায়।নোমানের ভাই আমান আবার ভীষণ পছন্দ করে তানিশাকে।তানিশার সাথে কি সুন্দর করে কথা বলে। দেখা হলেই ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে।

হঠাৎ তন্নি এসে উপস্থিত হলো সেখানে।সে তো তানিশাকে দেখামাত্র জড়িয়ে ধরলো।আর আনন্দে তাকে নিয়ে ঘোরাতে লাগলো।তার খুশি যেনো আর ধরছে না।কতদিন পর দেখা তাদের!

তানিশাকে এভাবে ঘোরানোর ফলে তার মাথা যেনো বনবন করে ঘুরতে লাগলো।সে তখন বললো,তন্নি থাম এবার।পরে যাবো তো।
তন্নি সেই কথা শুনে থেমে গেলো।আর তানিশার হাত ধরে তার রুমের দিকে যেতে ধরলো।

নোমান তবুও একটিবার তাকালো না অথচ দুই বান্ধুবি এতোক্ষণ কি চিৎকার চেঁচামেচিই না করলো।মনে হচ্ছিলো পাঁচ মিনিটের একটা সুনামি হয়ে গেলো।

তন্নির রুমে ঢুকতেই তানিশার, তায়েব চৌধুরীর সাথে দেখা।তায়েব চৌধুরীও তানিশাকে ভীষণ পছন্দ করেন।আর নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসেন।তানিশা মেডিকেলে চান্স পাইছে দেখে তায়েব চৌধুরী ভীষণ খুশি হয়েছেন।

তানিশা তায়েব চৌধুরী কে দেখামাত্র সালাম দিলো।তায়েব চৌধুরী সাথে সাথে সালামের উত্তর দিয়ে বললো, মা তানিশা কেমন আছো?পড়াশোনার কি অবস্থা।
তানিশাও হাসিমুখে উত্তর দিলো, আলহামদুলিল্লাহ মামা। অনেক ভালো আছি।আর পড়াশোনাও ভালোই চলছে।

হঠাৎ তায়েব চৌধুরী তন্নির দিকে তাকিয়ে বললো,এই না হলো আদর্শ বাপের আদর্শ মেয়ে।দেখ,এক চান্সেই সরকারি মেডিকেলে চান্স পেয়ে গেলো।আর তুই কি করলি?
একই কলেজে পড়লি তোরা,একই সাথে কোচিং করলি তবুও তুই সরকারি মেডিকেলে চান্স পাইলি না।আর তানিশাকে দেখ কোনো টাকা পয়সা খরচ না করেই এক চান্সে সরকারি মেডিকেলে চান্স পেয়ে গেলো।

তন্নি তার মামার কথা শুনে এক মুহুর্ত ও থাকলো না সেখানে।মন খারাপ করে বেলকুনিতে চলে গেলো।কারণ তায়েব চৌধুরী এই কথাটা এখন রোজ রোজ বলে।যেটা শুনলে তন্নির ভীষণ কষ্ট হয়।এমনিতেই সে কোথাও চান্স পায় নি,তার উপর তার মামা আবার কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেয়।

#চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে